সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
আমি যে খুব ট্রেকিং প্রিয় মানুষ তা নয়, তবে বিগত কয়েক বৎসর ধরে, মানে আমার দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাসের সময়কালের মধ্যে, বৎসরান্তে একবার গবেষণাগারের সকলের সাথে আমি কোনো না কোনো পর্বতে হাইকিং করতে যাই। করোনা মহামারীর পূর্বে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গিয়েছিলাম সোবেকসানে (সোবেক পর্বতে, কোরিয়ান 'সান' শব্দটির অর্থ পর্বত), আবার ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসেও আমরা গিয়েছিলাম ওই পর্বতে। তবে পার্থক্য ছিল সেবার যাওয়া-আসার পথটি এবার আসা-যাওয়ার পথ ছিল, অর্থাৎ সেবার যে পথে পর্বতের শিখরে পৌঁছেছিলাম এবার সে পথে শিখর থেকে নিচে নেমেছিলাম, আর যে পথে সেবার নেমেছিলাম এবার সে পথে উঠেছিলাম। এবার এই স্থান সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক। প্রায় ৩২২.৪ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে গড়ে ওঠা সোবেক পর্বত দক্ষিণ কোরিয়ার একটি জাতীয় উদ্যান। জিরিসান (Jirisan) এবং সিওরাকসানের (Seoraksan) পর এটি তৃতীয় পর্বতীয় জাতীয় উদ্যান (আমি পূর্বে একটি ব্লগে বিভিন্ন প্রকার জঙ্গল বা বনভূমি নিয়ে আলোচনা করেছি)। অন্যান্য পর্বতের ন্যায় এই পর্বতেরও একাধিক শিখর রয়েছে, যেমন বিরবং (Birobong-1,439.5 মিটার), গুঙ্গমংবং (Gungmangbong-1,420.8 মিটার), ইয়নহুয়াবং (Yeonhwabong-1,383 মিটার), দশলবং (Dosolbong-1,314.2 মিটার)। এই পর্বতীয় জাতীয় উদ্যানটি তিনটি প্রদেশের যথা গিয়ংসাংবুক (Yeongju/ ইয়ংজু শহর), চুংছেওংবুক (Danyang/ দানিয়াং শহর), এবং গ্যাংওয়ান (Yeongwol/ ইয়ংওল শহর) সীমানা স্পর্শ করে বিস্তৃত রয়েছে। ইয়ংজু শহরের সন্নিকটের উপত্যকাগুলির মধ্য দিয়ে নাকদংগাং (নাকদং নদী, কোরিয়ান শব্দ 'গাং' শব্দটির অর্থ নদী), এবং দানিয়াং শহরের সন্নিকটের উপত্যকাগুলির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে নামহাংগাং বা নামহাং নদী। এই জাতীয় উদ্যানটিতে রয়েছে প্রায় ১০৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ এনং ২৬৩৯ প্রজাতির প্রাণী। তবে অধিক ঠান্ডার কারণে আমি যাত্রাপথে কোনো প্রাণী দেখতে পাইনি। ২০০৭ সালে IUCN ইকোলজিকাল ভ্যালু (Ecological value) বা পরিবেশগত গুরুত্ব বিচার করে সোবেকসানকে IUCN ক্যাটেগোরি-II জাতীয় উদ্যান হিসেবে চিহ্নিত করে।
সোবেকসানের সর্বোচ্চ শিখর বিরবং, উচ্চতা ১৪৩৯ মিটার। যাঁরা আমাদের দেশে পর্বত ট্রেক বা হাইকিং করে থাকেন এ উচ্চতা তাঁদের নিকট নেহাৎই যৎসামান্য, তবে নাতিশীতোষ্ণ (Temperate) অঞ্চলে যে ভৌগোলিক অবস্থানে এই পর্বতটি অবস্থিত সে স্থানে ডিসেম্বর মাসে তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আসে পাশে থাকে, কাজেই বেশ ঠান্ডা। পূর্বের বৎসরটিতে (২০১৯ সালে) আমরা আগের দিন দুপুরে পর্বতের পাদদেশ থেকে রওনা হয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা ট্রেক করে আশ্রয়স্থলে পৌঁছেছিলাম, প্রচন্ড তুষারপাত হওয়ার কারণে সেই রাত্রি আমরা আশ্রয় স্থানে অতিবাহিত করে পরদিন ভোর সাড়ে ৪ টে নাগাদ রওনা হয়ে সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বে পর্বত শিখরে পৌঁছই।
যেহেতু আমি খুব একটা ট্রেক করিনা, কাজেই সকল ট্রেক কিট বিশেষ করে রান্নার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমার ছিল না। আমরা খাবার, জল ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই উঠেছিলাম, সকলে এই সকল দ্রব্যাদি ভাগ করে নিয়েছিলাম যেন কারও লাগেজ অধিক ভারী না হয়। আশ্রয়স্থলের একদিকে রান্না আর খাওয়ার জন্যে ঘর ছিল। সেখানে সকলে নিজের স্টোভ, পাত্র সব নিয়েই গিয়েছিলো, যে যার খাবার বানিয়ে নিচ্ছিলো। আমাকে স্বাভাবিক কারণেই অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল, যেটা খুব একটা উপভোগ্য ছিল না। বাইরের দেশে স্বনির্ভর হওয়াটাই কাম্য। এখানে একটা কথা উল্লেখ্য যে, পরদিন ভোরে আমরা যখন রওনা হয়েছিলাম সেই স্থান পরিষ্কার করে সকল আবর্জনা আমরা সাথে নিয়ে নিয়েছিলাম, সেই স্থানে কিছুই ফেলে আসিনি।
সেই অসামান্য আর অনবদ্য সূর্যোদয়ের রূপ বর্ণনা করার শব্দ আমার কাছে নেই। এই প্রত্যুষ মনে এক নব আনন্দের দিগন্ত উন্মোচন করে, মেঘের মধ্যে দাঁড়িয়ে সূর্যের নরম সোনালী আভা যখন দিক থেকে দিকান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে সেই মনোমুগ্ধকর চিত্রকে অনুধাবন করে প্রকৃতি মাতাকে প্রণাম করি।
এবার (২০২২ সালে) কিন্তু আমরা সূর্যোদয় দেখিনি, আমরা পর্বতের পাদদেশ থেকে আমরা রওনা হয়েছিলাম ভোর ৫ টেতে, কাজেই শীর্ষদেশে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে ৮ টা বেজে যায়।
আমরা পূর্বের দিনটি ইয়ংজু শহরে একটি পেনশন-এ অতিবাহিত করি। এই শহরের ফরেস্ট রিসার্চ
ইনস্টিটিউটে সেমিনার শেষ হতে দেরি হওয়ায় সেই দিন আমরা রওনা হতে পারিনি। কাজেই পরদিন
ভোরবেলা প্রায় চারটের সময়ে প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যখন পর্বতের পাদদেশে এসে পৌঁছয় তখন
প্রায় ভোর পৌনে ৫ টা। ট্রেকিং উপযোগী পোশাক পরিহিত হয়ে যখন যাত্রা শুরু হলো তখন ৫ টা
বাজে।
শুরুর রাস্তা বেশ খাড়াই, প্রথম ৪০ মিনিট বেশ ভালোই বেগ পেতে হয়। এ পথে এই সময়ে শুরু থেকেই আইস ক্লেট লাগিয়ে নেওয়া, পায়ে বটম গার্ড পরে নেওয়া উচিত, আমিও তাই করেছিলাম। তবে আমার সাথে কোনো ট্রেকিং পোল ছিল না, সেটা বেশ মুশকিলের। কিন্তু একটা শক্ত পোক্ত গাছের লম্বা ডাল পেয়ে গেলাম, হয়তো ফিরতি পথে কেউ ফেলে গিয়েছিলো। এই ঠান্ডায় আর্দ্রতার লেশ মাত্র নেই, কাজেই গাছের ডাল গুলি খুবই শুষ্ক ও ভঙ্গুর কিন্তু আমার লাঠিটি বেশ শক্তই ছিল এবং এতে আমার বেশ সুবিধা হয়েছিল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক রুট করা রয়েছে। হাঁফাতে হাঁফাতে চলেছি সেই পথে, চারিদিক খুব অন্ধকার।
অত্যাধিক ঠান্ডায় একটা সুবিধা হলো কোনো প্রকার জীবজন্তু এই সময় খুব একটা এসে পরে না। আমার কাছে কোনো টর্চ ছিল না, তবে কয়েকজন সাথীর সাথে তা ছিল। বরফ প্রায় ফুট খানেক হবে এবং স্থানে স্থানে তা আরও বেশি। আমি প্রচন্ড ক্লান্ত পড়েছিলাম প্রথম ঘন্টায়, কাজেই পথের পাশে বসে পড়েছিলাম, কয়েক মিনিটের বিশ্রাম আবার পথ চলা। একটা ছোট মোনোপড আমি নিয়ে গিয়েছিলাম, তবে তা সেট করে ছবি তুলতে দস্তানার মধ্যে থেকে হাত বের করতেই ঠান্ডায় অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হচ্ছিলো (দস্তানার ভিতর থেকে আমার আঙ্গুল ফোনের ক্যামেরা সেট করতে ঠিক করে কাজ করছিলো না), কাজেই ফটো তোলা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছিলো অন্ধকারে, বরং আলো ফুটলে তা কিছুটা সহজ হলো। এই জঙ্গলে ডেসিডুয়াস উদ্ভিদের প্রাধান্য চোখে পড়ার মতন, শীতে তাদের সকল পাতা ঝরে গেছে, তারা পত্রশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে স্থানে স্থানে কনিফেরাস উদ্ভিদও রয়েছে, তাদের পত্রগুলি সূঁচের ন্যায় অভিযোজিত হওয়ায়, পরিধি কম হওয়ায় তা থেকে সমস্ত জল বেরিয়ে যায়নি ফলে সেগুলি শুষ্ক হয়ে যায়নি। এবার ধীরে ধীরে স্বর্ণাভ আভা ছড়িয়ে পড়ছে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করলাম। গাছের ডালের মধ্যে দিয়ে কমলা বর্ণের সূর্য।
চলা, কখনও একটু বিশ্রাম, ছবি তোলা, আবার চলা। হঠাৎ চোখে পড়লো অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অব্জার্ভেটরি, নতুন উদ্যম এলো, এ পথ আমার জানা, এর পর আর সামান্য পথ অতিক্রম করলেই শিখরে পৌঁছবো আমরা। প্রায় চার ঘন্টা ট্রেক করে আমরা পৌঁছলাম শীর্ষে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য। তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের থেকেও কম। এবার কিছুটা জল খেয়ে বেশ ফিট লাগলো।
যখন প্রান্তদেশে এসে পৌঁছলাম তখন প্রায় বেল বারোটা বাজে। এবারের মতন বিদায় সোবেকসান। সবাই খুব ক্লান্ত, এবার দ্বিপ্রাহরিক আহার সারতে হবে আর তারপর বাড়ি ফেরা।
ডিসেম্বর ২০১৯, ডিসেম্বর ২০২২










কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন