সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
বিশ্বায়নের প্রভাব আজকের জীবনে সর্বত্র। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক, পাঠক-পাঠিকা দেখুন তো বিষয়টি পরিচিত কিনা !
দৃশ্য ১- এই তো সেদিন দুর্গাপুজোর শিরনামা (বা ব্যানার) নিয়ে আলোচনার সময়ে জনৈক ব্যক্তি শিরনামাটি বাংলা ভাষায় তৈরী করতে বললেন, তবে মত ভারী হলো ইংরেজী ভাষায় ব্যানারটি লেখার পক্ষে।
দৃশ্য ২- জনৈক ব্যক্তি তাঁর নিকট এক আত্মীয়র বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন কিন্তু রাস্তায় গাড়ির ভিড় অত্যন্ত বেশি থাকায় দেরি হয়ে যাচ্ছে। বারবার মুঠোফোনটি বেজে উঠছে, সবাই যে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে, সে গেলে তবে কেক কাটা হবে।
দৃশ্য ৩- বাড়িতে আজ অনেক বন্ধু-বান্ধব এসেছে। অনেক দিন পরে দেখা-সাক্ষ্যাতের সুযোগ পেয়েছে সবাই। সবাই ঠিক করলো পিজ্জা আর কোক অর্ডার দেওয়া হবে।
এরূপ বিভিন্ন দৃশ্য আজ চতুর্দিকে দৃশ্যমান। তবে এর মধ্যে থেকে খাদ্যের বিষয়টিতে আলোকপাত করা আমার উদ্দেশ্য। আজকের নগরকেন্দ্রিক ভারতে পশ্চিমা খাদ্য সংস্কৃতি বেশ চোখে পরে। মানুষের মধ্যে অধিক প্রক্রিয়াজাত খাবার (Ultra-processed foods) এবং পানীয়ের পছন্দ উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ছে। বিশ্বায়নের ফলে দেশগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্য আর সব কিছুর সাথে রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যেরও ভাগাভাগি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, টেলিভিশন শো এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পশ্চিমা খাবারের এক্সপোজার (Exposure) ভারতীয় জনমানসে পশ্চিমা খাবারের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহে অবদান রেখেছে। নগরায়ন এবং যৌথ পরিবারের স্থানে ক্ষুদ্র পরিবারের (Nuclear family) উত্থান ঐতিহ্যগত খাদ্যাভ্যাস (Traditional food habit) পরিবর্তন করেছে। ব্যস্ত শহুরে জীবনধারা প্রায়শই দ্রুত এবং সুবিধাজনক খাবারের (Convenient food) জন্য অগ্রাধিকার দেয়, যার মধ্যে পশ্চিমা-স্টাইলের ফাস্ট ফুড এবং প্যাকেটজাত খাবার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। রেস্তোরাঁ এবং ফাস্ট-ফুড চেইন (Fast food chain) সহ আতিথেয়তা শিল্প (Hospitality industry) পশ্চিমা স্বাদগুলি প্রবর্তন এবং জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা বলাই বাহুল্য। ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি এবং পিৎজা হাট-এর মতো আন্তর্জাতিক ফাস্ট-ফুড চেইনগুলির ভারত জুড়ে শহুরে কেন্দ্রগুলিতে উপস্থিতি রয়েছে। এখানে দু'টি তথ্য উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ভারতে প্রথম ম্যাকডোনাল্ডস রেস্তোরাঁটি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে মুম্বইয়ের বান্দ্রাতে খুলেছিলো। বর্তমানে (২০২২ খ্রিস্টাব্দের কোম্পানিটির রিপোর্ট অনুযায়ী) ভারতে ৫১২ টি ম্যাকডোনাল্ডস রেস্তোরাঁ রয়েছে। অন্যদিকে ভারতবর্ষের ৩৭১ টি শহরে ডোমিনোসের ১৭০১ টি রেস্তোরাঁ রয়েছে (২০২২ খ্রিস্টাব্দ)। এতো শুধু এই কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফাস্ট-ফুড চেইনের পরিসংখ্যান। এর পাশাপাশি বিভিন্ন রাস্তার ধারের স্টলে (Street food stall) বা স্থানীয় রেস্তোরাঁতেও এই সকল খাদ্যগুলি সুলভ। এখানে উল্লেখ্য, ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁগুলিতেও (Fine dining restaurant) প্রায়শই ফিউশন উপাদানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য রন্ধনশৈলীকে মিশ্রিত করে বিভিন্ন স্বাদের জন্য। পাশ্চাত্য উপাদান (Western ingredients/Recipes) এবং রান্নার কৌশলগুলি (Culinary) ক্রমবর্ধমানভাবে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় রেসিপিগুলিতে একত্রিত হচ্ছে।
ফিউশন রন্ধনপ্রণালী (Fusion culinary), যা ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উভয় রান্নার উপাদানকে একত্রিত করে, জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আজকে "বাটার চিকেন পিজ্জা" বা "ভারতীয় মশলা সহ মশলাদার পাস্তা" এর মতো খাবারগুলিতে প্রায় প্রতিটা শহরেই সুলভ এবং তা আমাদের রসনা তৃপ্ত করে।
এখন প্রশ্ন হলো এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসলাম কেন ? বিশ্বায়ন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় তো ভালো, তবে সমস্যা কোথায় ? আসলে আমার মনে হয় বিশ্বায়নের মূল সূত্রটি গাঁথা 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে'- তে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে')। এখন যদি শুধু নেওয়ার দিক ভারী হয় তবে তা ভারসাম্য হারায়। আহারের বৈচিত্র সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এক প্রকারের আহার্যের ক্রমবর্ধমান চাপে যেন অন্য আহার্য বস্তুগুলি ক্রমে হারিয়ে না যায়, সেটা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। যে প্রকারে আমরা পশ্চিমের খাদ্যবস্তুগুলিকে আপন করে নিয়েছি, এমনকি বেশ কিছুক্ষেত্রে আমাদের স্বাদ অনুসারে মেটামর্ফোস (Metamorphose) করেছি সেই প্রকারে আজ পর্যন্ত কিন্তু আমাদের খাদ্যগুলিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। আমাদের খিচুড়ি, ইডলি, দোসা, নারকেলের তক্তি, চন্দ্রপুলি, পিঠা, আঁচার ইত্যাদি একান্ত আমাদের খাদ্যগুলি নিজেদের মধ্যেই যে শুধু সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে তা নয়, বরং অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন অধিক প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলির সাথে প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়েই পড়ছে। কাজেই এক্ষেত্রে বিশ্বায়নের থেকে পশ্চিমায়নের পাল্লাটি অধিক ভারী হয়ে পড়েছে। এটি সম্ভাব্যভাবে ঐতিহ্যগত রন্ধনপ্রণালীকে (Traditional culinary) ক্ষয় করা এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের সাথে যুক্ত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলিতে অবদান রাখার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। আমাদেরও আমাদের নিজস্ব খাদ্যগুলিকে বিশ্বের সামনে আরও অধিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন