সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
জীবাশ্মগুলি প্রদর্শনের পাশাপাশি সেগুলির বর্ণনা এবং সহজভাবে জীবাশ্ম-র সম্পর্কিত (সংজ্ঞা, কিভাবে এগুলি জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে ইত্যাদি) তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম সমৃদ্ধ এই উদ্যানটি পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত একমাত্র জীবাশ্ম উদ্যান।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে কাষ্ঠ জীবাশ্মগুলিকে আবহাওয়া জনিত পরিবর্তনের (weathering) হাত থেকে রক্ষা করতে এগুলিকে কাঁচের বাক্সে রাখলে আরো ভালো হতো। এরপর পায়ে পায়ে গ্রামবাংলার মেঠো পথ ধরে, দু'পাশে কৃষিজমি রেখে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম কোপাই নদীর ধারে। বেশ কিছুক্ষন প্রকৃতিকে প্রাণ ভরে অনুভব করলাম, তখন সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে, ফিরে এলাম হোটেলে। রাতের আহার সেরে আজ বিশ্রাম।
বেশ সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো। বেলা ৯ টা নাগাদ আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। প্রাতঃরাশ সেরে প্রথম গন্তব্য সৃজনী শিল্পগ্রাম। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের প্রধানত পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জীবন ধারণ, ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে এস্থানে। প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্যে রয়েছে এক একটি কটেজ (Cottage) আর তার মধ্যে রাখা রয়েছে তাঁদের জীবন ধারণের চিত্র, উপাদান, ঐতিহ্যের নানান নিদর্শন। এখানে স্থান পেয়েছে নিকোবর, আন্দামান, মণিপুর, ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, বাংলা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের জীবন ধারা।
এরপরের দ্রষ্টব্য উত্তরায়ণ।
'এটা কার বাড়ি?
ছবিতে যে দাদু কে দেখছিস,
এটা তাঁর বাড়ি।'
উত্তরায়নের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সামনের থেকে ভেসে এলো বছর তিন চারেকের দিদি
আর ভাইয়ের কথোপকথন। রবি কিরণে উদ্ভাসিত তখন চতুর্দিক, বাইরে
অঝোর ধারায় বৃষ্টি হলেও আজ মন মেঘমুক্ত,
যা আছে তা শুভ্র আর তাকে বহন করে চলাই কর্তব্য।
দ্রষ্টব্যগুলি ঝাপসা আজ,
দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় তাঁর বৌদ্ধিক সত্ত্বার উপর। কবির চেতনা, সংকল্প, দৃঢ়তা, কর্তব্যপরায়ণতা
আজ পাথেয়।
রবীন্দ্র সংগ্রহালয়-র নিকটে অবস্থিত রথীন্দ্র সংগ্রহালয়।
গ্রাম্য ভারতের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতিসাধন সম্ভবপর নয়, তা উপলব্ধি করেছিলেন কবি। কৃষির উন্নয়নের পথেই গ্রাম তথা ভারতবর্ষের উন্নতি সম্ভব। শিলাইদহের জমিদারী দেখাশুনার ভার কবির উপর ন্যস্ত হতেই তিনি তাঁর গ্রামীণ পুনর্গঠনের চেতনাকে রূপায়িত করেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, কুটির শিল্প, তাঁতবোনা কোনোকিছুই এই পুনর্গঠনের কর্মকান্ড থেকে বঞ্চিত হয়নি। স্বনির্ভর, আত্মবিশ্বাসী গ্রামীণ ভারত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কবির দৃঢ় পদক্ষেপ, কৃষি, শিল্প আর ঐতিহ্যের সাথে বিজ্ঞানের মেলবন্ধন সমাজের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছিল। চাষের জন্যে ট্র্যাক্টর, ধান ভাঙানোর জন্যে হাস্কিং মেশিনের ব্যবহার, গরিব চাষি বা কারিগরের জন্যে স্বল্পসুদে ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্যে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা, বিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে কবির শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, শ্রীনিকেতন স্থাপন এবং এর জন্যে কৃষি অর্থনীতিবিদ L.K. Elmhirst কে আমন্ত্রণ করে আনা, মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিকল্পে পদক্ষেপ ইত্যাদি অতি সুপরিচিত। কবি তাঁর সন্তান রথীন্দ্রনাথ, জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি (ছোট মেয়ে মীরা দেবী-র সাথে বিবাহ হয়েছিল), বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ছেলে সন্তোষ চন্দ্র মজুমদার কে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন। বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে কৃষিবিজ্ঞান বিভাগ।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে দেখা হলো কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে, সংগীত, নৃত্য
এঁদের পড়াশুনার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাত্যহিক জীবন, বিভাগের
পড়াশুনা পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হলাম। এখানে শিক্ষক-শিক্ষিকা কে দাদা-দিদি বলা
প্রচলিত। শ্রেণীকক্ষের অভ্যন্তরে কবি কখনোই শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ করতে চাননি, সেই
দর্শন আজও প্রতিফলিত হয় বিশ্বভারতী-তে। শিক্ষাকে বহন না করে বাহন করার কর্তব্য 'লোকশিক্ষা'-য় মনে
করিয়ে দেন কবি। তাঁকে উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা চিরকালীন। তাঁর বৌদ্ধিক সত্ত্বাকে মর্মে
ধারণ করতে পারলে তবেই সমাজ উন্নততর হতে পারে।
দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে বল্লভপুর অভয়ারণ্য আর তারপর সোনাঝুরির হাট।
বাউল গাইছে, ধ্বনিত
হচ্ছেন লালন ফকির, সহজ ভাষায় জীবন দর্শনের এই বোধ চিরকাল প্রাসঙ্গিক থাকবে। এবার ফিরে চলা, ফিরতে
হবে দৈনন্দিন জীবনে কিছুটা উপলব্ধি সাথে নিয়ে।
















কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন