পৃষ্ঠাসমূহ

Underutilized and lesser known food লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Underutilized and lesser known food লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

ভারতের সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষা উন্নত করতে ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের ভূমিকা (Role of traditional foods in improving India's healthy food and nutrition security)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী ব্লগটিতে আমি সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যগত জ্ঞান কেন আবশ্যিক সেই বিষয়ে আলোচনা করেছি। সেখানে প্রধানত আমি কারণগুলিকে উল্লেখ করেছি, তবে বিশদে উদাহরণ সহযোগে সেগুলি বর্ণনার অবকাশ এখনও রয়েছে, সে বিষয়ে আমি পরে অবশ্যই লিখবো। বর্তমান ব্লগটিতে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কি কি উপায়ে সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষায় এই ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করবো। 

ভারত বর্তমানে পুষ্টিগত সমস্যা যেমন অপুষ্টি (Undernutrition) এবং স্থূলতার (Obesity) মতো দ্বৈত সমস্যার (Double burden) মুখোমুখি হচ্ছে। খাদ্য আসলে পুষ্টি উপাদানগুলির (Nutrients) উৎস।  প্রয়োজনের থেকে কম খাদ্য গ্রহণ করলে তার ফলে পুষ্টির ঘাটতি (Deficiency of nutrient) হয় এবং বিভিন্ন পুষ্টিউপাদানের ঘাটতি জনিত রোগ বৃদ্ধি পায়। যেমন ধরো, লোহার অভাবে এনিমিয়া, বা ভিটামিন ডি (Vitamin D), ভিটামিন বি-১২ (Vitamin B12), ভিটামিন এ (Vitamin A), ফোলিক অ্যাসিড (Folic acid) ইত্যাদির অভাব, এগুলো কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যমান। আবার অন্য দিকে প্রয়োজনাধিক খাদ্য গ্রহণ (মূলত অধিক ফ্যাট এবং শর্করা জাতীয়) এবং সেডেন্টারি জীবনযাপনের (Sedentary Lifestyle) জন্যে স্থূলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন, হার্টের রোগ বাড়ছে ইত্যাদি। কাজেই খাদ্য এবং পুষ্টির মাত্রা সঠিক থাকা প্রয়োজন, হ্রাস পাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া দুটোই কিন্তু সমস্যা। মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কাজেই খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে - এই যে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করা- এটা হলো খাদ্য সুরক্ষা (Food Security); সঠিক পরিমাণে তা গ্রহণ, কেবলমাত্র পেট ভরানো নয় বরং খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পুষ্টি উপাদানগুলির প্রয়োজনীয় মাত্রা শরীরে সুনিশ্চিত করা - এটা হলো খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষা (Food and Nutrition Security)। এখন আবার আর একটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো এই খাদ্য উৎপাদন এবং ব্যবহারের পদ্ধতি এমন হওয়া দরকার যেন তা পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে, অর্থাৎ খাদ্য পুষ্টি এবং পরিবেশের সুরক্ষা। এই তিনটি সুরক্ষাই, অর্থাৎ সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষা (Sustainable Food and Nutrition Security), নিশ্চিত করা অপরিহার্য।  

সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি (Traditional foods) গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি পুষ্টিগুণে ভরপুর (Rich in nutrients), সংস্কৃতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ (Culturally important) এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই (Environmentally sustainable)। ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শস্য, ডাল, শাক-সবজি এবং দুগ্ধজাত পণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে (অনুগ্রহ করে পড়ুন আমাদের খাদ্যের পশ্চিমায়ন, এ ছাড়াও একাধিক কারণ রয়েছে, পরবর্তীতে কখনও সেই বিষয়ে আলোচনা করবো) ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলির ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে, আর এরফলে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স হারিয়ে ফেলছি। যেমন  মিলেট - এর পুষ্টিগুণ যেমন উন্নত তেমন পরিবেশ সহায়কও বটে, কাজেই মিলেটের ব্যবহার সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে (অনুগ্রহ করে পড়ুন পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট)। ভারতবর্ষ মিলেট ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা আশাপ্রদ। যে সকল ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি আদিবাসী সম্প্রদায় ব্যবহার করেন, সেগুলির উৎপাদন পদ্ধতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায় তাদের উৎপাদন টেকসই পদ্ধতিতে হয়, প্রচলিত পদ্ধতিতে এগুলির অন্তর্ভুক্তিকরণ পরিবেশের স্থায়িত্বকে বৃদ্ধি করবে। অনেক সময় দেখা যায়, বেশ কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ (প্রাণীজ, উদ্ভিজ্জ বা ছত্রাক) তাঁরা পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে ব্যবহার করেন। এখানে গুরুত্ব প্রদান করা উচিত কারণ পূর্বে তাদের সংগ্রহ পদ্ধতিগুলি নিয়ন্ত্রিত থাকলেও, বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে (বাস্তুতন্ত্রের পরিধি হ্রাস পাওয়া, চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন ইত্যাদি) তা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে পারে। যেমন খাদ্যোপযোগী বন, জলাভূমি বা জলাশয়গুলো থেকে বিভিন্ন উদ্ভিদ, ছত্রাক, শামুক-ঝিনুক বা বিভন্ন কীট সংগ্রহ। এই সকল সম্পদগুলিকে যদি  চাষের মাধ্যমে উৎপাদন করা যায়, তবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হতে পারে যা পুষ্টি প্রদানের পাশাপাশি পরিবেশকেও সুরক্ষা প্রদান করে। শুধু তাই নয়, এটি জীবনযাত্রার অন্যতম পথও হতে পারে। 

এস্থানে কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের এবং তাদের পুষ্টিগুণ সম্বন্ধে উল্লেখ করলে বিষয়টি আর একটু সরল হবে। 

বাজরা - ডাইয়েটারি ফাইবার, প্রোটিন, লৌহ, ভিটামিন বি সমৃদ্ধ, গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। 

রাগী - ডাইয়েটারি ফাইবার, ক্যালশিয়াম, লৌহ, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। 

বাঁশের আগা -  ডাইয়েটারি ফাইবার, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ফাইটোস্টেরল সমৃদ্ধ। 

ছুরপি (চমরিগাইয়ের দুধ থেকে প্রস্তুত) - প্রোটিন, ক্যালশিয়াম সমৃদ্ধ প্রোবায়োটিক।   

গুন্দ্রুক (ফার্মেন্টেড শাক ) - ডাইয়েটারি ফাইবার, লৌহ, ল্যাক্টিক অ্যাসিড ব্যাক্টেরিয়া সমৃদ্ধ।  

চুলি - লৌহ, ক্যালশিয়াম, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। অ্যামারান্থের বীজ অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড সমৃদ্ধ। 

শামুক - প্রোটিন সমৃদ্ধ কিন্তু স্নেহ খুব কম, অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড, ক্যালশিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ। 

লাল পিঁপড়ের 'ডিম' এবং লাল পিঁপড়ে -  প্রোটিন, ক্যালশিয়াম, জিঙ্ক, লৌহ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। 

রেশমকীটের পিউপা - প্রোটিন, লৌহ, জিঙ্ক সমৃদ্ধ।      

ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলি যে কেবলমাত্র পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ তা নয়, ঐতিহ্যবাহী ফসল এবং খাবারের ব্যবহার কৃষি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং টেকসই কৃষির জন্য সহায়ক। বাজরার মতো অনেক ঐতিহ্যবাহী ফসল খরা সহনশীল এবং কম উপকরণে বেড়ে ওঠে, যা অনিশ্চিত বৃষ্টিপাতের পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ এবং স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসের সাথে গভীর সংযোগ স্থাপন করে।

এবার কি করলে এই ব্যাপারে কিছুটা উন্নতি হতে পারে, সেই বিষয়ে আলোচনা করা যাক। এখানে আমি আমার ধারণা অনুসারে কিছু পথের উল্লেখ করছি।  

১. জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তি (Inclusion in National Nutrition Program): সরকারি কর্মসূচিগুলিতে যেমন পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (PDS), মিড-ডে মিল এবং ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস (ICDS), ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন বাজরা, ডাল এবং স্থানীয় সবজির অন্তর্ভুক্তি করা উচিত। এটি পুষ্টিগত মান উন্নত করার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ফসলের চাহিদা সৃষ্টি করবে। কিছু ক্ষেত্রে চালু হলেও, যা প্রশংসাযোগ্য, এতে আরো গুরুত্ব প্রদান করা যেতে পারে। 

২. কৃষক-কেন্দ্রিক উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খল সমর্থন (Supporting Farmer-led Production and Supply Chain): কৃষকদের ঐতিহ্যবাহী ফসল চাষে প্রণোদনা (Incentive) দিতে হবে, কারণ এগুলি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হলেও বাণিজ্যিক ফসলের তুলনায় কম লাভজনক। নীতিগুলি কৃষকদের বাজার সংযোগ, ভর্তুকি এবং কারিগরী সহায়তা প্রদান করা উচিত। ঐতিহ্যবাহী ফসলের চাষের জন্য বীজ ভর্তুকি, কারিগরী প্রশিক্ষণ এবং জৈব কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগ করা- এগুলি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

৩. জৈব এবং টেকসই কৃষির প্রচার (Promotion of Organic and Sustainable Agriculture): অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবার জৈব এবং টেকসই পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়, যা মাটি স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করতে সহায়ক। জৈব চাষকে উৎসাহিত করলে এই খাবারগুলির পুষ্টিমূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং বাজারে একটি বড় সুবিধা থাকবে। "পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা" (PKVY) বা তার প্রসারণ এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারে বলে মনে হয় ।  

৪. ভোক্তা সচেতনতা তৈরি (Increasing Consumer Awareness): নাগরিকদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে শিক্ষিত করার জন্য নীতিমালা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য প্রচারণা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সম্প্রদায়-ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে, বিশেষ করে শহুরে এলাকায়। 

৫. ঐতিহ্যবাহী খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and Development in Traditional Food Processing): ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলি আরও সুস্বাদু, সুবিধাজনক এবং আধুনিক ভোক্তাদের জন্য আকর্ষণীয় করতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলির উপর ভিত্তি করে উন্নত পুষ্টিসমৃদ্ধ পণ্য তৈরি এবং প্যাকেজিং ও সংরক্ষণের উন্নতি হবে।

৬. স্থানীয় জ্ঞান সংরক্ষণ (Preservation of Indigenous Knowledge): ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং তাদের পুষ্টিগুণ সম্পর্কিত স্থানীয় জ্ঞান সংরক্ষণ এবং প্রচার করা জরুরি। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঐতিহ্যবাহী খাবারের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে সহায়ক হবে। ঐতিহ্যবাহী খাদ্যব্যবস্থার অধ্যয়নকে শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ করা এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় জ্ঞানকে সংরক্ষণ ও প্রচার করা প্রয়োজন।

৭. পরিকাঠামো উন্নতি ও বাজার অ্যাক্সেস (Improving Infrastructure and Market Access): ঐতিহ্যবাহী খাবারের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং পরিবহন পরিকাঠামো উন্নত করতে হবে। বাজার অ্যাক্সেস উন্নত করে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা হ্রাস করে কৃষকরা তাদের ফসলের জন্য ন্যায্য মূল্য পেতে পারেন। গ্রামীণ এলাকায় ঐতিহ্যবাহী ফসলের জন্য অবকাঠামো এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে।

ভারতের খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষা নীতির অংশ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচার অপুষ্টি মোকাবেলা, কৃষির টেকসই উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। কৃষক প্রণোদনা, ভোক্তা সচেতনতা, এবং গবেষণার মাধ্যমে গৃহীত নীতির মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব বলেই মনে হয়। 

সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যগত জ্ঞান কেন আবশ্যিক? (Why is traditional knowledge essential for sustainable food and nutrition security?)

সম্পত ঘোষ  (Sampat Ghosh)

বর্তমান আলোচনায় প্রথম প্রয়োজন ঐতিহ্যগত জ্ঞান (বা  Traditional Knowledge) কি সেটা বোঝা।

ঐতিহ্যগত জ্ঞান বলতে বোঝায় সঞ্চিত জ্ঞান, অনুশীলন, দক্ষতা, উদ্ভাবন এবং প্রজ্ঞাকে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কোনো সম্প্রদায় বা সমাজের মধ্যে সময়ের সাথে সাথে প্রবাহিত হয়। এটি সাধারণত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (Cultural tradition), আদিবাসী বা স্থানীয় বিশ্বাস (Indigenous belief) এবং স্থানীয় পরিবেশগত প্রেক্ষাপটে (Ecology and Ecosystem) নিহিত থাকে। [অনুগ্রহ করে পড়ুন: বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য, বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা

কিভাবে সম্প্রদায়গুলি প্রকৃতি, সম্পদ এবং সমাজের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে, ঐতিহ্যগত জ্ঞান তাকে প্রভাবিত করে। ঐতিহ্যগত জ্ঞান প্রায়ই মৌখিকভাবে বা ব্যবহারিক প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রেরিত হয় এবং কৃষি (Agriculture), স্বাস্থ্যসেবা (Healthcare), প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা (Natural resource management), খাদ্য ব্যবস্থা (Food system), আধ্যাত্মিকতা (Spirituality) এবং কারুশিল্প (Crafts) সহ জীবনের বিভিন্ন দিককে অন্তর্ভুক্ত করে।  

সমসাময়িক সময়ে, খাদ্য ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত ঐতিহ্যগত জ্ঞান বিভিন্ন কারণে সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার আলোচনায় ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বর্তমান ব্লগটিতে এই ঐতিহ্যগত জ্ঞান কোন কারণগুলির জন্যে প্রাসঙ্গিক তার উল্লেখ করবো। 

() জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ (Conservation of Biodiversity): ঐতিহ্যগত জ্ঞানে প্রায়ই এমন অনুশীলন জড়িত থাকে যা জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণকে উৎসাহিত করে। উদাহরণস্বরূপ, আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি বিভিন্ন ধরণের শস্য এবং গবাদি পশুর জাত চাষ এবং ব্যবহারের পদ্ধতি তৈরি করেছে, যা কীটপতঙ্গ, রোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে স্থিতিস্থাপকতার জন্য প্রয়োজনীয় জিনগত বৈচিত্র্যে অবদান রাখে। 

() স্থানীয় পরিবেশের সাথে অভিযোজন (Adaptation to Local Environment): ঐতিহ্যগত জ্ঞান স্থানীয় পরিবেশ এবং জলবায়ুতে গভীরভাবে প্রোথিত। এটি নির্দিষ্ট বাস্তুসংস্থানীয় অবস্থা (Ecological conditions), যেমন মাটির ধরন, বৃষ্টিপাতের ধরন এবং তাপমাত্রার তারতম্যের জন্য টেকসই চাষাবাদ (Sustainable agriculture) অনুশীলনের জ্ঞান প্রদান করে। এই জ্ঞান সম্প্রদায়গুলিকে বহিরাগত ইনপুটগুলির (Input) উপর খুব বেশি নির্ভর না করে পরিবর্তিত পরিবেশগত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম করে। 

() প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ (Conservation of Natural Resources): অনেক ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি জল, মাটি এবং বনের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেয়। কৃষি-বনায়ন (Agroforestry), ফসলের ঘূর্ণন (Crop rotation) এবং টেরেসিংয়ের (Terracing) মতো কৌশলগুলি মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে, ক্ষয় রোধ করতে এবং জলের উৎস সংরক্ষণে সহায়তা করে, যা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বে অবদান রাখে।

() সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক তাৎপর্য (Cultural and Social Significance): ঐতিহ্যগত জ্ঞান প্রায়ই সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যে স্থাপন (Embed) করা হয়। তারা শতাব্দীর সঞ্চিত জ্ঞানের প্রতিফলন করে, মৌখিক ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান এবং সম্প্রদায়ের অনুশীলনের মাধ্যমে প্রজন্মের মধ্যে চলে গেছে। এই ঐতিহ্যগুলি সংরক্ষণ এবং সম্মান করা শুধুমাত্র মূল্যবান কৃষি জ্ঞানের সংক্রমণ নিশ্চিত করে না বরং সামাজিক সংহতি এবং পরিচয়ও বৃদ্ধি করে।

() পুষ্টির বৈচিত্র্য (Nutritional Diversity): ঐতিহ্যগত খাদ্যগুলি সাধারণত বৈচিত্র্যময় এবং সুষম, স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ খাবারের বিস্তৃত পরিসরকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই বৈচিত্র্য কেবলমাত্র উন্নত পুষ্টিতে অবদান রাখে না বরং কয়েকটি প্রধান ফসলের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে, ফসলের ব্যর্থতা বা বাজারের ওঠানামার ঝুঁকি হ্রাস করে।

() স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন (Resilience and Adaptation): ঐতিহ্যগত জ্ঞান সম্প্রদায়গুলিকে স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন কৌশলগুলির সাথে সজ্জিত করে যা বহু প্রজন্ম ধরে বৈচিত্র্যময় এবং প্রায়শই চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে বসবাস করে। এই অভিযোজিত ক্ষমতাগুলি চরম আবহাওয়ার ঘটনা, কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাব বা অর্থনৈতিক ধাক্কার মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলির সাথে মোকাবিলা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

() স্থায়িত্ব (Sustainability): ঐতিহ্যগত কৃষি অনুশীলনগুলি প্রায়শই তাদের কম বাহ্যিক ইনপুট প্রয়োজনীয়তা এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরতার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। জীববৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্য এবং বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিস্থাপকতার মতো কৃষি-বাস্তবতাত্ত্বিক নীতিগুলিকে প্রচার করে, ঐতিহ্যগত জ্ঞান টেকসই খাদ্য উৎপাদনের দিকে পথ দেখায় যা নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাবগুলি হ্রাস করে।

আশা করি সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্যগত জ্ঞানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বোঝা গেলো। 

ভারতের ট্রাইবাল খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ (Exploring Tribal Food Systems of India)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী ব্লগটিতে (ভারতের স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ) আমি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় খাদ্য এবং রন্ধনপ্রণালীর উল্লেখ করেছি । অবশ্যই তা একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ, বলাই বাহুল্য যে তার বাইরে অনেক উপাদেয় পদ রয়েছে, কয়েকটি আইকনিক পদ ও প্রণালীকে তুলে ধরেছি মাত্র। আশা করি কর্মসূত্রে বা বেড়াতে গেলে পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয়ই ওই সকল স্থানীয় খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ করবেন। আজকের এই ব্লগটিতে আমি আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপজাতিদের বিভিন্ন খাদ্য পদ নিয়ে আলোচনা করব, অন্যথা আমাদের দেশের খাদ্য বৈচিত্র্য সম্বন্ধে যে আলোচনা আমি শুরু করেছি তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। 

ভারতবর্ষ অসংখ্য আদিবাসী বা উপজাতির আবাসস্থল। দেশের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই উপজাতিরা তাদের অনন্য রীতিনীতি, ভাষা এবং উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছেন বা করে চলেছেন। এই ব্লগে, আমরা ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য ভান্ডারের অন্বেষণ করব যা এই সম্প্রদায়গুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রেখেছে। আমার জীবনের দীর্ঘ সময়কাল ভারতেবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে, কাজেই কিছু ক্ষেত্রে এই লেখা আমার কাছে অনেকটা নস্টালজিয়ার মতন। বাংলা সাহিত্যেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের খাদ্যের বা খাদ্যরীতির কথা উঠে এসেছে। এই মুহুর্তে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পালামৌ' এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের 'আরণ্যক' উপন্যাসটির কথা মনে আসছে। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পালামৌ’ ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকেও উক্ত অঞ্চলের কোল জাতির মধ্যে খাদ্য হিসেবে মহুয়া ফুলের ব্যবহারের কথা জানা যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'আরণ্যক' উপন্যাসে লিখেছেন- 'আমাদের এ জঙ্গল-মহালের পূর্বে-দক্ষিণ সীমানা হইতে সাত-আট ক্রোশ দূরে অর্থাৎ সদর কাছারি হইতে প্রায় চৌদ্দ-পনের ক্রোশ দূরে ফাল্গুন মাসে এক প্রসিদ্ধ মেলা বসে। ....... মেলার এক অংশে তরিতরকারির বাজার বসিয়াছে, কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় শুঁটকি কুচো চিংড়ি ও লাল পিঁপড়ের ডিম বিক্রয় হইতেছে। লাল পিঁপড়ের ডিম এখানকার একটি সুখাদ্য। তাছাড়া আছে কাঁচা পেঁপে, শুকনো কুল, কেঁদ-ফুল, পেয়ারা ও বুনো শিম।'

সত্যজিত রায় মহাশয়ের পরিচালিত 'আগুন্তুক' ছায়াছবিটি আমার অন্যতম প্রিয় সিনেমা। ছায়াছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মনমোহন মিত্র আদিবাসীদের কৃষি, বুনন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ঔষধি, স্থাপত্য, শিল্পকলা ইত্যাদির কথা সাধারণ শহুরে মানুষদের প্রতিনিধি অনিলা দেবীর পরিবার এবং পারিবারিক বন্ধুর সামনে তুলে ধরেন, যদিও তাঁরা সেগুলির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না। এখানে একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কাটে, মনমোহন বলেন তিনি আদিবাসী নন বলেই তাঁর ফিল্ড নোট (Field notes) নেওয়ার প্রয়োজন হয়। সত্যি, আজ পৃথিবী যখন স্থায়িত্বের (Sustainability) জন্যে লড়ে যাচ্ছে, তখন আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমাজ থেকেই নেওয়া ফিল্ড নোটগুলি উল্টাতে হয় বইকি, তাতেই যে রয়েছে স্থায়িত্বের চাবিকাঠি ।

ভারতে উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালী ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত, জমি, ঋতু এবং আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ উপাদানগুলি ব্যবহার করেন। উত্তর-পূর্বের জঙ্গল থেকে শুরু করে রাজস্থানের শুষ্ক মরুভূমি পর্যন্ত, প্রতিটি অঞ্চল ভূগোল, জলবায়ু এবং সাংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত স্বতন্ত্র রন্ধনসম্পর্কীয় পরিচয় নিয়ে গর্ব করে। 

ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, আদিবাসী উপজাতিদের আবাসস্থল, খাদ্য শুধুমাত্র ভরণ-পোষণ নয় বরং জীবনের একটি উদযাপন। ভাত, মাছ, শুঁটকি মাছ এবং বাঁশের আগা (Bamboo shoot) এই অঞ্চলের অনেক উপজাতীয় খাদ্যের ভিত্তি। নাগাল্যান্ডের নাগা উপজাতিরা তাদের ঝাল ঝাল সুস্বাদু মাংসের খাবারের জন্য বিখ্যাত, প্রায়শই শক্তিশালী 'ভুত ঝোলোকিয়া' মরিচ দিয়ে রান্না করা হয়। মেঘালয়ের গারো এবং খাসি উপজাতিরা সুস্বাদু আচার এবং চাটনি তৈরি করতে বাঁশের আগা ফার্মেন্ট করেন, যা খুবই উপাদেয়। উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় বিভিন্ন কীট-পতঙ্গকে খাদ্য (Edible insects) হিসেবে ব্যবহার করেন। অরুণাচল প্রদেশে বিভিন্ন উৎসবে মিথুনের মাংস (Bos frontalis) মানুষের রসনা তৃপ্ত করে। এখানে মুরগি বা মাটনের থেকে শুয়োরের মাংসের ধিক্য দেখা যায়। পানীয়ের মধ্যে অরুণাচলের আপং (Apong-rice beer), নাগাল্যান্ডের জুথো (Zutho), সিকিমের ছাঙ (Chang) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আবার মিজোদের স্থানীয় ডেলিকেসি জাওলাইদি- আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত ওয়াইন (Zawlaidi- Grape wine) এক প্রেমের গল্প বলে। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পানীয় গ্রহণে কোনো বৈষম্য আমি দেখিনি, স্থানীয় মানুষকে মাতলামি করতেও আমার বিশেষ চোখে পড়েনি।

মধ্য ভারত বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল, প্রত্যেকের নিজস্ব রন্ধন ঐতিহ্য রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের গোন্ড এবং বাইগা উপজাতিরা মহুয়া ফুল, তেন্দু পাতা ইত্যাদি বনজ পণ্যের দক্ষতার সাথে ব্যবহারের জন্য পরিচিত। মহুয়া, বিশেষ করে, উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালীতে একটি বিশেষ স্থান রাখে, যা আলকোহলিক পানীয় (Alcoholic beverages) এবং মিষ্টি খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আদিবাসীদের বিভিন্ন মিলেটের, যেমন কোদো, কুটকি ইত্যাদির ব্যবহার (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট), বীজ সংরক্ষণ, কৃষি পদ্ধতি ইত্যাদি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়িত্ব এবং পুষ্টির নিশ্চয়তার দৃষ্টিকোণ খুবই প্রাসঙ্গিক। ছত্তিশগড়ের লাল পিঁপড়ের চাটনী, ঊড়িষ্যার G.I. ট্যাগ প্রাপ্ত 'কাই-চাটনী' (লাল পিঁপড়ের চাটনী- watery semi-solid paste of red weaver ant), মধ্য ভারতের স্থানীয় আদিবাসীদের খাদ্য হিসেবে শামুকের (Edible snails) ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। 

সবুজ পশ্চিম ঘাটের মাঝখানে অবস্থিত, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং কেরালার উপজাতি সম্প্রদায়গুলি রন্ধনসম্পর্কীয় আনন্দের একটি আকর্ষণীয় সম্ভার অফার করে। মহারাষ্ট্রের ওয়ারলি উপজাতি, তাদের শিল্পের জন্য পরিচিত, এছাড়াও রন্ধনশিল্পে পারদর্শী, পিঠলা-ভাকড়ি (Pithla-Bhakri- খামিরবিহীন রুটির সাথে বেসনের তরকারি) এর মতো হৃদয়গ্রাহী খাবার তৈরি করে। দক্ষিণ ভারতে কুরিচিয়া এবং কুরুম্বা মতো আদিবাসী উপজাতিরা বনের সবুজ শাক (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক), মিঠা পানির মাছ এবং বন্য মাংস দিয়ে রান্নার শিল্প আয়ত্ত করেছে, এমন খাবার তৈরি করেন যা যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর।

পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের কেন্দ্রস্থলে, রন্ধন প্রথাগুলি প্রকৃতি উপাসনা এবং পূর্বপুরুষদের আচারের সাথে গভীরভাবে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল উপজাতি ফসল কাটার মরসুম উদযাপন করে সোহরাই নামে পরিচিত একটি জমকালো ভোজের সাথে, যেখানে 'ধুসকা' (Dhuska- ডিপ-ফ্রাইড রাইস প্যানকেক) এবং পিঠা-র মতো খাবার রয়েছে। এদিকে, ওডিশার বোন্ডা উপজাতি বন্য মাশরুম, কন্দ এবং সবুজ শাক তাদের প্রতিদিনের খাবারে অন্তর্ভুক্ত করে।

আধুনিকীকরণ (?) এবং পরিবেশগত অবক্ষয় দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ভারতের সমৃদ্ধ উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য প্রচেষ্টা চলছে। ঐতিহ্যগত জ্ঞান (Traditional Knowledge) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রজম্নের পর প্রজন্ম মুখে মুখেই প্রচলিত, লিখিত ভাবে না থাকার জন্যে তা অবক্ষয়িত, এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তাই আমাদের সেই ফিল্ড নোটগুলিকেই ভরসা করতে হয়। 'আগুন্তুক' ছবিতে নিজের চিকিৎসার জন্যে মনমোহন মিত্র এমন এক ওঝাকে ডেকেছিলেন যাঁর নখদর্পনে ছিল ৫০০ ঔষধি গাছ-গাছড়ার গুণাবলীর তথ্য, এ কিন্তু নেহাত কল্পনা নয়, এরূপ উদাহরণ আমি দেখেছি। তবে স্থানান্তর (Migration), স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় (Ecosystem degradation), জীব বৈচিত্রের হ্রাস (Biodiversity loss) পাওয়া ইত্যাদির ফলে এই জ্ঞানভাণ্ডার আজ ক্ষয়িষ্ণু। এই মূল্যবান জ্ঞান ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা আবশ্যক। আদিবাসী সমাজের এই কম কার্বণ ফুটপ্রিন্ট (Low carbon footprint) বৈশিষ্টযুক্ত খাদ্য ব্যবস্থা পরিবেশের স্থায়িত্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে। সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে খাদ্য উৎসব, রন্ধনসম্পর্কীয় কর্মশালা এবং ডকুমেন্টেশন প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলি দেশীয় খাবার এবং ঐতিহ্যগত রান্নার পদ্ধতির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে। উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য উৎযাপন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে, আমরা শুধুমাত্র ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করি না বরং ভবিষ্যত প্রজন্মকে লালন করার জন্য আমাদের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকেও রক্ষা করি।

উপসংহারে, ভারতের উপজাতীয় খাবারগুলি প্রকৃতির সাথে গভীর সংযোগের প্রমাণ যা সারা দেশে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। উত্তর-পূর্বের কুয়াশা-ঢাকা পাহাড় থেকে মধ্য ভারতের রৌদ্রে ভেজা সমভূমি পর্যন্ত, এই সকল খাদ্যের প্রতিটি কামড় স্থিতিস্থাপকতা (Resilience), ঐতিহ্য (Tradition) এবং খাদ্য ও সংস্কৃতির (Food culture) মধ্যে স্থায়ী বন্ধনের গল্প বলে। পরিশেষে উল্লেখ করি, এছাড়াও অনেক পদ বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে, সমস্ত পদের বর্ণনা একটি সংক্ষিপ্ত ব্লগে সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি আইকনিক পদের বর্ণনা এই ব্লগটিতে করলাম।

পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক (Nutrition security and food - Part-3: Green leafy vegetables)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্বের পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন  পর্ব-১ পর্ব-২ 


বর্তমান পৃথিবীতে অন্যতম একটি সমস্যা হল 'মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ডেফিসিয়েন্সি' (Micro-nutrient deficiency), যা অনেক সময় 'হিডেন হাঙ্গার' (Hidden hunger) বলেও পরিচিত। পুষ্টির উপাদানগুলির দিকে যদি আমরা তাকাই, তবে দেখব কয়েকটি পুষ্টি উপাদান, যেমন শর্করা (Carbohydrate), স্নেহ পদার্থ (Fat), আমিষ জাতীয় পদার্থ (Protein), আমাদের শরীরে দৈনিক অধিক পরিমানে আবশ্যক বা প্রয়োজন, তাই এই উপাদানগুলিকে 'ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট' (Macro-nutrient) বলা হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকটি পুষ্টি উপাদান যথা খনিজ (Minerals) এবং ভিটামিন (Vitamins) স্বল্প পরিমানে আবশ্যক, তাই এগুলিকে 'মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট' বলা হয়ে থাকে। স্বল্প পরিমানে প্রয়োজন হলেও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা খনিজ পদার্থ (Minerals) এবং ভিটামিনগুলি অত্যন্ত আবশ্যক, অন্যথায় শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়ায় সমস্যা উৎপাদন হয়ে থাকে।। উদাহরণস্বরূপ, প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষ লোহার (Iron) স্বল্পতায় ভোগেন (McLean et al., 2009), আবার প্রায় ১.০২ বিলিয়ন মানুষ ভিটামিন A-র অভাবের শিকার (Akhtar et al., 2013)।

এই হিডেন হাঙ্গার কে প্রতিরোধ করার অন্যতম একটি পথ হল আহারে শাকের ব্যবহার কারণ এর মধ্যে খনিজ, ভিটামিন উপযুক্ত পরিমানে বিদ্যমান এবং নানান কার্যকরী বৈশিষ্ট্যসম্পূর্ণ  রাসায়নিক উপাদানও এর মধ্যে পাওয়া যায়। বাঙালির পাতে শাক নতুন নয়। কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আহারের বর্ণনায় শাকের উল্লেখ রয়েছে। কবি লিখেছেন:

"প্রথমে শুকুতা ঝোল দিল ঘন্ট শাক

প্রশংসা করয়ে সাধু বেঞ্জনের পাক।

ঘৃতে জবজব খায় মীন মাংস বড়ি

বাদ কর‍্যা খায় ভাজা কই দুই কুড়ি।

অম্বল খাইয়া পিঠা জল ঘটী ঘটী

দধি খায় ফেনি তায় শুনি মটমটী।"

আবার বিভিন্ন প্রকার শাক এবং তাদের রন্ধন প্রক্রিয়ারও উল্লেখ রয়েছে চন্ডীমঙ্গল কাব্যে:

"সাক তুলিতে দুয়া ফিরে বাড়ি বাড়ি

'খে করা নিল দুষা রঙ্গিন চুপড়ি।

নট্যা রাঙ্গা তোলে পাট পালঙ্গ-নলিতা

তিত পলতার পাতা ডগা তুলিল পলতা।

সাজ্যাতা পাজ্যাতা বন-পুই তুলে বলা

হিনচা কলমী শাক তোলে ডানিকলা।

কড়্যা সাক তোলে দুয়া ফিরে খেতি খেত

মহরি সোলপা  ধন্যা খিরপাই বেত।

বাড়ি বাড়ি ফিরে দুয়া দিয়া বাহুনাড়া

ডগী ডগী তোলে পুই পুনুকা কাঁচড়া।

কোমল কাঁকুড়ি-ডগা তুলিল করেলা

নাউডগা তোলে কিছু কচি কচি বলা।

বাছা ধুয়্যা শাক দুয়া করিল সাঁচনা

লতা পাতা শাক আগে রন্ধিল লহনা।

রন্ধন করেন রামা করি বড় ত্বরা

ঘন্টে  পুর‍্যা এড়ে রামা কুড়িয়া পাথরা।

ঘৃতে জবজব রান্ধে নলিতার শাক

কটু তৈলে বাথুয়া করিল দৃঢ় পাক।

রহিত কুমুড়া -বড়ি আলু দিয়া ঝোল

বদরী শকুল মীন আম্রে মুসুরি

পান দুই ভাজে রামা সরল সফরি।

পঞ্চাশ বেঞ্জন অন্ন করিল রন্ধন

থালায় ওদন বাটী ভরিয়া বেঞ্জন।

সাধ খান খুল্লনা নারীজন

অভয়ামঙ্গল গান শ্রীকবিকঙ্কন।"

কয়েক দশক পূর্বে খাদ্য তালিকার দিকে দৃষ্টিপাত করলে যে সকল আহার্য বস্তু দৃষ্টিগোচর হবে তা আজ আর হয়না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাঙালির শাক জাতীয় খাদ্যের তালিকাটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছেঅনেক শাক-ই আজ হারিয়ে গেছে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম কালীপুজোআর তার আগের দিনটিতে চোদ্দ প্রকারের শাক খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। কেন বা কিভাবে এই প্রচলন হলোতা আমি বিশেষ জানিনা। তবে বেশ মনে পড়েছোটবেলায় কখনও মামারবাড়ি গেলে দিদির সাথে ভোরবেলা যেতাম শাক তুলতেযা সব শাক পাওয়া যায় গ্রামের ক্ষেতের পাশেজলা জায়গায়সবগুলো চিনতাম না। পরবর্তীকালে চোদ্দশাক কিনতে বাজারে গেলে লালশাক সহযোগে অনেকটা পাতা দিয়ে দিতে দেখেছিএটাই এখন চোদ্দশাক বলে পরিচিত। কিন্তু একাধিকবার চোদ্দরকমের শাক বাজারে আলাদা আলাদা খোঁজ করে দেখেছি তা জোগাড় করা খুব সহজ নয়। বর্তমান বাজার পালংপুঁইলালএবং কিছু সময় লাউমুলোপাট শাকেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কলমিসাঞ্চেবেতোঘেঁটু শুশনিহেলেঞ্চা ইত্যাদি ধীরে ধীরে সংকোচনের আওতায়, বিশেষত শহর বা শহরতলিতে, এসে পড়ছে। এই সংকোচন কিন্তু আমাদের পুষ্টিকেও সংকুচিত করছে। নিচের টেবিল-১ -এ দেখে নিই প্রচলিত কয়েকটি শাক যা আমরা আমাদের আহারে ব্যবহার করে থাকি।

Table 1: বাংলায় তথা ভারতবর্ষে খাদ্য সিহেবে ব্যবহৃত কতগুলি শাকের তালিকা


এছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে আরো বিভিন্ন শাক পাওয়া যায়। কয়েকটি উদাহরণস্বরূপ, উত্তরাখণ্ডের দুম (Allium semnovii), জংলী চউলি (Amaranthus bilatum), ঢোল কানালি (Girardinia diversifolia), পায়ুম (Rumex nepalensis), পুয়ানু (Smilacina purpurea) ইত্যাদি (Mishra et al., 2008), আবার মনিপুরের ইয়েলাং (Polygonum barbatum), থামোউ (Nelumbo nucifera), চিংইয়েঙসিল (Antidesma diandrum) ইত্যাদি (Konsam et al., 2016) উল্লেখ করা যায়। পুষ্টিগত দৃষ্টিকোণ থেকে উল্লেখযোগ্য হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শাকগুলি আশেপাশের বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্র (চাষের ক্ষেত সংলগ্ন জমি, জলাজমি ইত্যাদি) থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, বা কখনো ক্ষেতের পাশে শাকগুলি এমনিতেই হয়ে থাকে, সাধারণত চাষ করা হয় না। স্থানীয় মানুষজন সেই সকল শাক সংগ্রহ করে নানান উপায়ে প্রস্তুত করেন। যদি এই উন্নত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন শাকগুলির দিকে মনোনিবেশ করা না হয় তবে নিবিড় কৃষি পদ্ধতি (Intensive agriculture), নগরায়ন (Urbanization) ইত্যাদির চাপে এগুলি ধীরে ধীরে অবহেলিত হতে হতে হারিয়ে যাবে।

এবার শাকের পুষ্টিগুণের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। শাকের মধ্যে অধিক পরিমানে আঁশ জাতীয় পদার্থ, খনিজ (পুষ্টি গুরুত্বের) উপযুক্ত মাত্রায় বিদ্যমান থাকার জন্যে এগুলি আমাদের দেহের পুষ্টিসাধনে সহায়তা করে। আবার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে এর গুরুত্বও খুব বেশি। লাল শাক, মেথি শাক, কুমড়ো শাক তুলনামূলকভাবে অধিক লোহা ধারণ করে। আবার অধিকাংশ শাক যেহেতু ভিটামিন C (এস্করবিক অ্যাসিড) ধারণ করে, যা লোহা শোষণ করতে সহায়তা করে (Timoshnikov et al., 2020), সেইজন্যে শাকের মাধ্যমে শরীরে লোহার প্রয়োজনীয়তা বেশ কিছুটা মেটে।

Table 2: বিভিন্ন প্রকার প্রচলিত শাকের খনিজের পরিমান (mg/100g) (Source: Longvah et al., 2017)


Ca= ক্যালশিয়াম (Calcium), P= ফসফরাস (Phosphorus), Mg= ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium), K= পটাশিয়াম (Potassium), Na= সোডিয়াম (Sodium), Fe= লোহা (Iron), Cu= তামা (Copper), Mn= ম্যাঙ্গানিজ (Manganese), Zn= দস্তা (Zinc)

Table 3: বিভিন্ন প্রকার প্রচলিত শাকের থেকে প্রাপ্ত ক্যারোটিন (Carotene) এবং ভিটামিনের (mg/100g; Vitamin B7, B9, Vitamin K1: µg/100g) পরিমান (Source: Longvah et al., 2017)


Vitamin B1= থিয়ামিন (Thiamin), Vitamin B2= রাইবোফ্লাভিন (Riboflavin), Vitamin B3= নিয়াসিন (Niacin), Vitamin B5= প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (Pantothenic acid), Vitamin B6= পাইরিডক্সিন (Pyridoxine), Vitamin B7= বায়োটিন (Biotin), Vitamin B9= ফলিক অ্যাসিড (Folic acid), Vitamin E = টোকোফেরোল (Tocopherol), Vitamin C= এস্করবিক অ্যাসিড (Ascorbic acid), Vitamin K1= ফাইলোকুইনোন (Phylloquinone)

বিটা ক্যারোটিন থেকে ভিটামিন-A সংশ্লেষিত হয়। কাজেই খাদ্যের মাধ্যমে বিটা ক্যারোটিন গ্রহণ ভিটামিন A-র অভাব দূরীকরণে সাহায্য করবে। বেশিরভাগ শাকের ক্ষেত্রে বিটা ক্যারোটিন বেশ অধিক পরিমানে পাওয়া যায় (Akhtar et al., 2012)।  যেমন প্রতি ১০০ গ্রাম লাল শাকে ৮৪৫৭ মাইক্রোগ্রাম, বেথুয়া শাকে ১০৭৫ মাইক্রোগ্রাম, মেথি শাকে ৯২৪৫ মাইক্রোগ্রাম, কচু শাকে ৫৭৫৮ মাইক্রোগ্রাম, সরিষা শাকে ২৬১৯ মাইক্রোগ্রাম, কুমড়ো শাকে ১৪৫৫ মাইক্রোগ্রাম, মুলো শাকে  ২৫৯১ মাইক্রোগ্রাম, পালং শাকে ২৬০৫ মাইক্রোগ্রাম বিটা ক্যারোটিন পাওয়া যায়। ক্যারোটিন আবার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Anti-oxidant) হিসেবেও কাজ করে। কাজেই শাক অধিক মাত্রায় ক্যারোটিন ধারণ করে বলে এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এক্টিভিটিও বেশ অধিক হয়, যা মানবদেহের জন্যে উপকারী।

অধিকাংশ শাকে, বিশেষত কচু শাক, পালং শাক, সরিষা শাক ইত্যাদিতে  ভিটামিন B9-র পরিমান অধিক হয়ে থাকে। ভিটামিন B9 ফলিক অ্যাসিড বা ফোলেট নামে পরিচিত। এটি  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান। লোহিত রক্ত কণিকা (Red blood corpuscle) নির্মাণে এবং এর ফল অনুসারে এনিমিয়া (Anemia) প্রতিরোধ করতে ফোলেটের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও DNA সংশ্লেষণে (DNA synthesis) এবং মেরামতে (DNA repair) ফোলেট প্রয়োজনীয়। ফোলেটের অভাবে নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (Neural tube defect) হয়ে থাকে। ফ্যাট মেটাবলিসম (Fat metabolsim)-র ক্ষেত্রেও ফোলেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ওবেসিটি (Obesity) কমাতে এর গুরুত্ব রয়েছে (da Silva et al., 2014)। অস্টিওব্লাস্ট (Osteoblast/হাড় গঠনে প্রয়োজনীয় কোষ) এবং অস্টিওক্যালসিন (Osteocalcin/নন-কোলজিনীয় প্রোটিন হরমোন) মেটাবোলিজমে ভিটামিন K1-র গুরুত্ব অনেক। যেহেতু শাক অধিক পরিমানে ভিটামিন K1  ধারণ করে তাই শাক খেলে হাড় গঠনের উন্নতি হয় (Sim et al., 2020)। আবার ক্যালসিয়ামের পরিমানও শাকে অধিক থাকে যা মানবদেহের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী।

কাজেই এই ছোট একটি আলোচনার মাধ্যমে বোঝা গেল শাকের গুরুত্ব। প্রতিদিন আহারের পাতে শাক অবশ্যই থাকুক, এর ফলে আবশ্যক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলি যেমন শরীরে প্রবেশ করবে তেমনই চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে এই উন্নত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন শাকগুলি অমিল বা অবলুপ্ত হয়ে যাবে না।

তথ্য সহায়তা (References)

Akhtar, S.; Ahmed, A.; Randhawa, M.A.; Atukorala, S.; Arlappa, N.; Ismail, T.; Ali, Z. 2013. Prevalence of vitamin A deficiency in South Asia: causes, outcomes, and possible remedies. Journal of Health Population and Nutrition 31(4), 413-423. https://doi.org/10.3329/jhpn.v31i4.19975 

Akhtar, S.; Karak, C.; Biswas, P.; Chattopadhyay, A.; Hazra, P. 2012. Indigenous leafy vegetable: A potential source of β-carotene and ascorbic acid. International Journal of Vegetable Science 18(4), 370-375. https://doi.org/10.1080/19315260.2011.649163 

da Silva, R.P.; Kelly, K.B.; Rajabi, A.A.; Jacobs, R.L. 2014. Novel insights on interactions between folate and lipid metabolism. Biofactors 40(3), 277-283. https://doi.org/10.1002/biof.1154 

Konsam, S.; Thongam, B.; Handique, A.K. 2016. Assessment of wild leafy vegetables traditionally consumed by the ethnic communities of Manipur, northeast India. Journal of Ethnobiology and Ethnomedicine 12, 9. https://doi.org/10.1186/s13002-016-0080-4 

Longvah, T.; Ananthan, R.; Bhaskaracharya, K.; Venkaiah, K. 2017. Indian Food Composition Tables. National Institute of Nutrition (Indian Council of Medical Research), Hyderabad, India.

McLean, E.; Cogswell, M.; Egil, I.; Wojdyla, D.; de Benoist, B. 2009. Worldwide prevalence of anaemia, WHO vitamin and mineral nutrition information system, 1993-2005. Public Health Nutrition 12(4), 444-454. https://doi.org/10.1017/S1368980008002401 

Mishra, S.; Maikhuri, R.K.; Kala, C.P.; Rao, K.S.; Saxena, K.G. 2008. Wild leafy vegetables: A study of their subsistence dietetic support to the inhabitants of Nanda Devi Biosphere Reserve, India. Journal of Ethnobiology and Ethnomedicine 4, 15. https://doi.org/10.1186/1746-4269-4-15

Sim, M.; Lewis, J.R.; Prince, R.L.; Levinger, I. et al. 2020. The effect of vitamin K-rich green leafy vegetables on bone metabolism: A 4-week randomised controlled trial in middle-aged and older individuals. Bone Reports 12, 100271. https://doi.org/10.1016/j.bonr.2020.100274 

Timoshnikov, V.A.; Kobzeva, T.V.; Polyakov, N.E.; Kontoghiorghes, G.J. 2020. Redox interactions of vitamin C and iron: inhibition of the Pro-Oxidant activity by Deferiprone. International Journal of Molecular Science 21(11), 3367. http://doi.org/10.3390/ijms21113967


জোয়ারের সুজি (Sorghum Semolina)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh) 

মিলেটের পুষ্টিগুণ পূর্বেই  (পর্ব-২: মিলেট) আলোচিত হয়েছে।   

পূর্বের ব্লগটিতে জোয়ারের খিচুড়ির প্রস্তুত করার পদ্ধতি সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে (জোয়ারের খিচুড়ি)। জোয়ারের আটা থেকেও বেশ কিছু সুস্বাদু আর পুষ্টিকর খাদ্য প্রস্তুত করা যায়। জোয়ারের আটা বাজার থেকে ক্রয় করা যায় আবার জোয়ারের শস্যদানা থেকে তা সহজেই বাড়িতে তৈরী করে নেওয়া যায়। প্রথমে সেই পদ্ধতিটি সম্বন্ধে বলা যাক।  

প্রয়োজন মতন জোয়ার (শস্যদানা) নিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।  তারপর একটি থালায় তা পাতিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।  সূর্যালোকেও শুকিয়ে নিতে পারেন তবে খেয়াল রাখবেন ধুলোবালি যেন থালায় এসে না পরে। যদি তা সম্ভব না হয় তবে এমনিতেই রান্না ঘরে একটি পরিষ্কার জায়গায় তা রেখে দিন, দু-এক দিনে তা শুকিয়ে যাবে। 

এরপর মাইক্রোওয়েভে (৭০০W) মিনিট খানেক গরম করে তা ঠান্ডা করে নিতে হবে (সূর্যালোকে ভালোভাবে শুকালে মাইক্রোওয়েভে পুনরায় শুকিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই)। অতঃপর গ্রাইন্ডারে দানাগুলি পিষে আটা তৈরী করে নিতে হবে। গ্রাইন্ডারে দানাগুলি পেশার ফলে সেগুলি ভেঙে গুঁড়ো হয়ে আটায় পরিণত হবে, তবে ভাঙা দানাগুলি পরিমাপ এক হবে না, কাজেই তা চেলে (সুক্ষ্ম চালুনির সাহায্যে) মিহি আটা আলাদা করে নিতে হবে, পুনরায় বাকি দানাগুলিকে ঘুরিয়ে একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আটা চেলে নিতে হবে। হাওয়া না ঢোকে এমন পাত্রে আটা সযত্নে তুলে রাখুন। দুইবার এইভাবে দানাগুলি গুঁড়ো করে চেলে নেওয়ার পর কিছু দানা পরে থাকবে, যা আয়তনে মিহি আটার থেকে কিছুটা বড়, এগুলিকেও হাওয়া না ঢোকে এমন পাত্রে সযত্নে রেখে দিতে হবে। এগুলি দিয়ে সুজি প্রস্তুত করা যেতে পারে যা সুস্বাদু তো বটেই আর পাশাপাশি জোয়ারের পুষ্টিতে সমৃদ্ধ। এটি একটি প্রাকৃতিকভাবে গ্লুটেন-ফ্রি (Gluten free) উন্নত উপকরণ। 

গ্রাইন্ডারে দানাগুলি পিষে আটা তৈরী করার সময়ে একটি সুমিষ্ট ঘ্রান অনুভূত হবে যা সত্যই একটি উপরি পাওনা বলে ধরতে পারেন।

জোয়ারের ক্ষুদ্র দানাগুলিকে প্রথমে শুকনো খোলায় একটু ভেজে নিতে হবে। তারপর ঘি বা তেলে (সাধারণভাবে ঘি বা তেল কোনোটিরই অধিক ব্যবহার কাম্য নয়) সামান্য নুন সহযোগে আর একটু ভেজে নিতে হবে। 

এরপর প্রয়োজন মতন জল (১০০ গ্রাম দানার জন্যে তিন থেকে চার কাপ জল লাগবে) দিয়ে ১২-১৫ মিনিট ফুটিয়ে নিয়ে হবে, এই সময় কাজু, কিশমিশ ইত্যাদি যোগ করতে পারেন। দানা গুলি নরম হয়ে এলে স্বাদ অনুযায়ী চিনি যোগ করুন। চিনি যোগ করার সময় স্বাদ নিয়ে দেখুন আপনার স্বাদ অনুসারে উপযুক্ত হচ্ছে কিনা, সেই মতন চিনি ব্যবহার করুন। এবার কিছুক্ষন ঢাকা দিয়ে রাখুন। জোয়ারের সুজি প্রস্তুত।  

মিলেটের ব্যবহার আপনার আহারের তালিকাকে প্রসারিত করবে এবং আপনার খাদ্য পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হবে।

জোয়ারের খিচুড়ি (Sorghum Khichudi)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


আমরা প্রায়ই খিচুড়ি খেয়ে থাকি। খিচুড়ির প্রধান উপকরণ চাল আর ডাল, এর সাথে কিছু সব্জি যোগ করে বেশ সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর  এই খাদ্যটি  প্রস্তুত করা হয়। একসময় বর্ষণমুখর দিনে যে উপাদেয় বস্তুটি পাতে পড়লে মন আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত, বর্তমান ব্যস্ত জীবনে তা একটি অপরিহার্য খাদ্য হয়ে উঠেছে। তবে খিচুড়িতে যদি চালের বদলে কখনও কখনও মিলেট ব্যবহার করা যায়, তবে এর পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে আবার একটু মুখের স্বাদ বদল করলে ভালোও লাগে। সাবুদানার বা ওটের খিচুড়ি এখন খুব পরিচিত। এই ব্লগটিতে আমি জোয়ায়ের খিচুড়ি প্রস্তুত করা নিয়ে আলোচনা করব। 

মিলেটের পুষ্টিগুণের বিষয়ে পড়ুন, পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট

জোয়ারের খিচুড়ির প্রধান উপাদান দুটি হলো জোয়ার আর ডাল।  পরিবারের সদস্য সংখ্যার উপর নির্ভর করে যতটা জোয়ার নিতে হবে, ডালের পরিমান হতে হবে তার অর্ধেক। যেদিন এটি রান্না করা হবে তার পূর্বের দিন জোয়ার সারারাত (প্রায় ৮-১০ ঘন্টা) ভিজিয়ে রাখতে হবে। 

পরদিন সেই ভেজানো জোয়ার প্রেসার কুকারে প্রায় ৮ থেকে ১০ টি সিটি দিয়ে উপযুক্তভাবে সিদ্ধ করে নিতে হবে। 

মসুর বা মুগ যে কোনো ডাল-ই ব্যবহার করা যেতে পারে। ডাল ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। সব্জির মধ্যে ব্যবহার করতে পারেন কড়াইশুঁটি, ফুলকপি, গাঁজর, কুমড়ো, টমেটো, বেল-পেপার বা ক্যাপসিকাম ইত্যাদি। সব্জিগুলি ধুয়ে কেটে নিতে হবে, কড়াইশুঁটি ছাড়িয়ে নিতে হবে। পেঁয়াজ কেটে নিতে হবে, কাঁচালঙ্কা কুঁচিয়ে নিতে হবে, আদা আর রসুন বেটে নিতে হবে। 

এবার কড়াইতে তেল দিয়ে একটু উষ্ণ হলে তাতে জিরা, ধনে, পেঁয়াজ, আদা বাটা, রসুন বাটা, কুঁচোনো কাঁচালঙ্কা দিয়ে একটু নাড়িয়ে নিতে হবে। মিনিট দুয়েক নাড়িয়ে তার মধ্যে কেটে রাখা সব্জিগুলি দিয়ে একটু ভেজে নিন, পরিমান (স্বাদ অনুযায়ী) মতন নুন এবং হলুদ যোগ করুন। এরপর এর মধ্যে ডাল আর সিদ্ধ করে রাখা জোয়ার দিয়ে ভালোভাবে মিনিট পাঁচেক নাড়তে হবে। পরিশেষে জল দিয়ে সমস্ত উপকরণগুলিকে সিদ্ধ হতে দিন। আঁচ কমিয়ে মিনিট পনেরো কড়াইটিকে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে, প্রস্তুত হয়ে যাবে জোয়ারের খিচুড়ি।  

জোয়ারের খিচুড়ির সাথে রায়তা, আঁচার, পাঁপড় ভালো সহযোগী হিসেবে কাজ করে। জোয়ারের দানাগুলি একটু মোটা এবং রুক্ষ, চালের মতন অতটা মসৃন নয়, এটি খাওয়ার সময় উপলব্ধি করতে পারেন। নতুন স্বাদ উপভোগ করুন। সকল খাদ্যশস্যকেই আহারে স্থান দিন, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সকলকেই ব্যবহার করুন, খাদ্য বৈচিত্র্য বাড়লে, পুষ্টির মান উন্নত হবে। 

পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট (Nutrition security and food - Part-2: Millet)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্বের পর্বটি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন পর্ব-১

ভারতবর্ষ ২০২৩ সালকে আন্তর্জাতিক মিলেট বৎসর হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেছিল, যা ফুড এবং এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (Food and Agriculture Organisation of United Nations) ও জাতিসংঘের (United Nations) সাধারণ পরিষদ অনুমোদন করেছে (FAO events)। আমরা এই পর্বে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মিলেট নিয়ে আলোচনা করবো

মিলেটের ব্যবহার ভারতবর্ষে কিন্তু আজকে নতুন নয়,বরং খাদ্যশস্য হিসেবে এর ব্যবহার প্রায় ৫০০০ বছর পুরোনো। খাদ্য হিসেবে এর ব্যবহারের উল্লেখ সিন্ধু সভ্যতার সময়কালের বিভিন্ন পর্যায়ে পাওয়া যায়, বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে তা আমাদের সামনে উঠে এসেছে। তৎকালে গম এবং বাৰ্লির ব্যবহার যে হতো তা ভালোভাবে নথিভুক্ত, কিন্তু মিলেট ব্যবহারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি প্রথম পর্যায়ে ভালোভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি, কিন্তু বর্তমানে জানা যায় মিলেট শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ শস্যই ছিল না বরং কোনো কোনো অঞ্চলে তা প্রধান শস্যদানা হিসেবে বিবেচিত হতো (Weber and Kashyap, 2016)।প্রারম্ভিক হরপ্পা সভ্যতা থেকে পরিণত এবং পরবর্তীতে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে হরপ্পা সভ্যতার নানান স্থানে জোয়ার সহ নানান মিলেটের ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায় (Pokharia et al., 2014)। 

মিলেট উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে এগুলির ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। মূলত যে সকল মিলেট ভারতবর্ষে পাওয়া যায় সেগুলি হলো  জোয়ার (Sorghum)বাজরা (Pearl millet),  রাগি (Finger millet)কোদো (Kodo millet)কুটকি (Little millet)কাকুম (Foxtail millet)সাংবা (Barnyard millet)চিনা (Proso millet) ইত্যাদি (Rao et al., 2018)। ভারতবর্ষে এইসকল মিলেটকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার রীতি রয়েছে। মধ্যপ্রদেশে অধ্যাপনাকালে গবেষণার কাজে বাইগা (Baiga) এবং গোন্ড (Gond) জাতির কয়েকটি গ্রামে ঘুরেছিলাম। কোদো এবং কুটকি তাঁদের প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। বাইগা মানুষ হাল দিয়ে মাটি কর্ষণ করেন না কারণ তাঁরা ভূমিকে মাতা রূপে গণ্য করেনকাজেই মায়ের গায়ে আঘাত লাগে (হলকর্ষণে ভূমি মাতা আঘাত পাবেন) এমন কিছু করেন না। ভূমি পরিষ্কার করে তাঁরা বীজ ছড়িয়ে দেনআর তা থেকে গাছ হয়এরূপ চাষাবাদ 'বেওয়ার' ('Bewar') নামে পরিচিত (Guha, 1996)।

Table 1: ভারতবর্ষে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকার মিলেট শস্য

ইংলিশ নাম

বিজ্ঞানসম্মত নাম

বাংলা/স্থানীয় নাম

Barnyard millet

Echinochloa frumentacea

সাংবা/শ্যামা

Finger millet

Eleusine coracana

রাগি/মারবা

Foxtail millet

Setaria italica

কাকুম/কাওন

Kodo millet

Paspalum scrobiculatum

কোদো

Little millet

Panicum sumatrense

কুটকি/সামা

Pearl millet

Pennisetum glaucum

বাজরা

Proso millet

Panicum miliaceum

চিনা

Sorghum

Sorghum bicolor

জোয়ার


সত্তরের দশকে ভারতবর্ষে সবুজ বিপ্লব সংগঠিত হয়। বলাই বাহুল্য এর ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল অনেকটাই। আজ যে ভারত তার প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেই উৎপাদন করতে পারে আর এ ব্যাপারে অন্য দেশের উপর বিশেষ নির্ভরশীল নয় তা অবশ্যই দেশের অগ্রগতিকেই প্রকাশ করে। তবে সবুজ বিপ্লব অধিক উৎপাদনশীল শস্য-র উপর মনোনিবেশ করায় ধান, গমের চাষ এবং উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, অপরপক্ষে জোয়ারবাজরা (Pearl millet)রাগি (Finger millet), স্মল মিলেট, বাৰ্লি ইত্যাদির চাষ অনেকটাই কমে যায় (Nelson et al., 2019)। ১৯৬১ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত কৃষি জমির আয়তনের দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে, ধান, গম আর ভুট্টার চাষের জমির আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে, অপরপক্ষে বার্লি, মিলেট আর জোয়ারের চাষের জমি হ্রাস পেয়েছে (Figure 1)। উৎপাদনের তথ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেও দেখা যাবে বাৰ্লি বা জোয়ারের উৎপাদন ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে, মিলেটের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা খুব বেশি নয়, এবং উৎপাদনের স্থিতিশীলতাও লক্ষ্যণীয় নয়। অপরপক্ষে সহজ কারণেই চাল, গম এবং ভুট্টার উৎপাদন দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে (Figure 2)।

Figure 1: ১৯৬১ টি ২০২০ পর্যন্ত ফসল (Cereals) অনুসারে কৃষিজমি আয়তনের হিসাব (Food and Agriculture Organisation হইতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে Source: FAOSTAT)

Figure 2: ১৯৬১ টি ২০২০ পর্যন্ত ফসল (Cereals) অনুসারে উৎপাদনের হিসাব (Food and Agriculture Organisation হইতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে Source: FAOSTAT

এবার মিলেটের পুষ্টিগুণ লক্ষ্য করা যাক। Table 2-র মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার মিলেটের পুষ্টি উপাদানের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হল। সাধারণভাবে দেখা যায়মিলের চালের থেকে প্রোটিনস্নেহ জাতীয় পদার্থফাইবার এবং অ্যাশের মাত্রা প্রায় সকল ধরণের মিলেটে অধিক পরিমানে বিদ্যমান। গমের প্রোটিনের মাত্রা বেশ কয়েকটি মিলেটের যেমন কোদোকুটকিরাগি বা সাংবা থেকে অধিক থাকলেওফাইবার তুলনামূলকভাবে কম পরিমানে থাকে। ডায়েটারি ফাইবার (Dietary fiber) অধিক থাকার সুবাদে মিলেটের গ্লাইসেমিক ইনডেক্সও (Glycemic index) কম হয়, যা পুষ্টিগুণের দৃষ্টিকোণ থেকে খুব উপকারী। তুলনামূলকভাবে চাল অধিক শর্করা জাতীয় পদার্থ ধারণ করে এবং ডায়েটারি ফাইবার থাকে অত্যন্ত কম।

Table 2: বিভিন্ন প্রকার মিলেটের পুষ্টিগুণের তালিকা (g/100g) এবং প্রতি ১০০গ্রাম খাদ্য প্রাপ্ত শক্তির পরিমান (Kcal) (Data obtained from Nutritive value of Indian Foods, National Institute of Nutrition, Hyderabad, 2007; Source: Rao et al., 2016)

Millet

C

P

F

CF

M

E

Barnyard millet (সাংবা)

65.5

6.2

2.2

9.8

4.4

307

Finger millet (রাগি)

72.0

7.3

1.3

3.6

2.7

328

Foxtail millet (কাকুম)

60.9

12.3

4.3

8.0

3.3

331

Kodo millet (কোদো)

65.9

8.3

1.4

9.0

2.6

309

Little millet (কুটকি)

67.0

7.7

4.7

7.6

1.5

341

Pearl millet (বাজরা)

67.5

11.6

5.0

1.2

2.3

361

Proso millet (চিনা)

70.4

12.5

1.1

2.2

1.9

341

Sorghum (জোয়ার)

72.6

10.4

1.9

1.6

1.6

349

Rice (Raw, Milled) (চাল)

78.2

6.8

0.5

0.2

0.6

345

Wheat (Whole)(গম)

71.2

11.8

1.5

1.2

1.5

346


C= Carbohydrate, P= Protein, F= Fat, CF= Crude fiber, M= Mineral matter, E= Energy 

পুষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে যে সকল খনিজ (Minerals) আবশ্যক সেগুলি প্রায় সকল প্রকার মিলেটে বিদ্যমান এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালের থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক (Table 3)। যেমন রাগি অধিক পরিমানে ক্যালশিয়াম ধারণ করে যার মাত্রা ৩৪৪ মিলিগ্রাম প্রতি ১০০ গ্রাম রাগিতেযেখানে প্রতি ১০০ গ্রাম চালে মাত্র ১০ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম থাকে।  একইভাবে ফসফরাসম্যাগনেসিয়ামপটাশিয়াম ইত্যাদির মাত্রাও তুলনামূলকভাবে অধিক থাকায় রাগির পুষ্টিগুণ অধিক। কুটকিবাজরাসাংবা ইত্যাদি মিলেটে লোহার পরিমান অনেক বেশি থাকেখাদ্য হিসেবে যা গ্রহণ করলে লোহার অভাবে যে এনিমিয়া হয়যার প্রাবল্য দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতবর্ষে বিশেষত মহিলাদের মধ্যে অধিক প্রকটতার প্রকোপ কমানো যেতে পারে।

Table 3: বিভিন্ন প্রকার মিলেটে খনিজের পরিমান (mg/100g) (Data obtained from Nutritive value of Indian Foods, National Institute of Nutrition, Hyderabad, 2007; Source: Rao et al., 2016)

Millet

Ca

P

Mg

K

Na

Fe

Cu

Mn

Zn

Barnyard millet (সাংবা)

20

280

82

--

--

5.0

0.60

0.96

3.0

Finger millet (রাগি)

344

283

137

408

11.0

3.9

0.47

5.49

2.3

Foxtail millet (কাকুম)

31

290

81

250

4.6

2.8

1.40

0.60

2.4

Kodo millet (কোদো)

27

188

147

144

4.6

0.5

1.60

1.10

0.7

Little millet (কুটকি)

17

220

133

129

8.1

9.3

1.00

0.68

3.7

Pearl millet (বাজরা)

42

296

137

307

10.9

8.0

1.06

1.15

3.1

Proso millet (চিনা)

14

206

153

113

8.2

0.8

1.60

0.60

1.4

Sorghum (জোয়ার)

25

222

171

131

7.3

4.1

0.46

0.78

1.6

Rice (Raw, Milled) (চাল)

10

160

90

--

--

0.7

0.14

0.59

1.4

Wheat (Whole) (গম)

41

306

138

284

17.1

5.3

0.68

2.29

2.7


Ca= ক্যালশিয়াম (Calcium), P= ফসফরাস (Phosphorus), Mg= ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium), K= পটাশিয়াম (Potassium), Na= সোডিয়াম (Sodium), Fe= লোহা (Iron), Cu= তামা (Copper), Mn= ম্যাঙ্গানিজ (Manganese), Zn= দস্তা (Zinc)

ভিটামিনের দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় মিলেট অধিকমাত্রায় ভিটামিন ধারণ করে থাকে (Table 4)। যেমন জোয়ার, বাজরা, রাগি, কাকুম ভিটামিন A ধারণ করে থাকলেও, সাধারণত চালে তা অমিল, তবে গমের মধ্যে ভিটামিন A থাকে। বাজরাতে, এখানে উল্লেখিত বাকি মিলেটগুলি থেকে, তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় ভিটামিন A বর্তমান। থিয়ামিন (Thiamin) প্রায় সকল প্রকার মিলেট, চাল, ও গমে পাওয়া যায়। রাইবোফ্লাভিন (Riboflavin) চালের তুলনায় বিভিন্ন প্রকার মিলেটে অধিক মাত্রায় বর্তমান থাকে। গমে অধিক মাত্রায়  নিয়াসিন (Niacin) বর্তমান থাকলেও চাল এবং বিভিন্ন প্রকার মিলেটেও তা বিদ্যমান। ফলিক অ্যাসিডও (Folic acid) মিলেট যথা বাজরা, কোদো, জোয়ার, রাগি, কুটকি ইত্যাদিতে অধিক পরিমানে পাওয়া যায়। গমে ফলিক অ্যাসিড বেশ অধিক মাত্রায় থাকলেও চালের মধ্যে তার পরিমান বেশ কম। 

Table 4: বিভিন্ন প্রকার মিলেট থেকে প্রাপ্ত ভিটামিনের পরিমান (mg/100g; for carotene an folic acid: µg/100g ) (Data obtained from Nutritive value of Indian Foods, National Institute of Nutrition, Hyderabad, 2007; Source: Rao et al., 2016)
Vitamin A= ক্যারোটিন (Carotene), Vitamin B1= থিয়ামিন (Thiamin), Vitamin B2= রাইবোফ্লাভিন (Riboflavin), Vitamin B3= নিয়াসিন (Niacin), Vitamin B5= প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (Pantothenic acid), Vitamin B6= পাইরিডক্সিন (Pyridoxine), Vitamin B9= ফলিক অ্যাসিড (Folic acid), Vitamin E = টোকোফেরোল (Tocopherol)

সুতরাং পুষ্টিগুণের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সহজেই বোঝা যায় মিলেট খুব উপকারী। প্রফেসর স্বামীনাথন (Professor M.S. Swaminathan) যথার্থই পরামর্শ দিয়েছেন  মিলেটকে, সাধারণভাবে যা 'Coarse grain' বলে পরিচিত, 'Nutririous millets' বলাটাই অধিক উপযোগী (Ravi et al., 2010)। আমরা সহজেই দৈনন্দিন আহারের তালিকাটিকে একটু প্রসারিত করতেই পারি, সেখানে থাকুক জোয়ার, বাজরা, রাগি ইত্যাদি মিলেট, এতে আহারের সামগ্রিক পুষ্টির মানও উন্নত হবে আবার কম ব্যবহৃত বা উপেক্ষিত হতে হতে এই উন্নত গুণমানসম্পন্ন মিলেটগুলিও হারিয়ে যাবে না।  

তথ্য সহায়তা (Reference)

Guha, R. 1996. Savaging the civilised Verrier Elwin and the tribal question in late colonial India. Economic and Political Weekly 31. https://www.jstor.org/stable/4404559 

FAO events, International Year of Millets 2023: Building momentum for the year. 
https://www.fao.org/new-york/events/detail/en/c/1473311/#:~:text=Join%20us%2C%20as%20we%20commemorate,the%20International%20Year%20of%20Millets., accessed 10th May 2022.

Pokharia, A.K.; Kharakwal, J.S.; Srivastava, A. 2014. Archaeobotanical evidence of millets in the Indian subcontinent with some observations on their role in the Indus civilization. Journal of Archeological Science 42: 442-455. https://doi.org/10.1016/j.jas.2013.11.029 

Rao, B.D.; Bhat, B.V.; Tonapi, V.A. 2018. Nutricereals for Nutritional Security. Strategies for mainstreaming millets for prosperous farming and healthy society. ICAR- Indian Institute of Millets Research, Hyderabad, India. 164P.

Rao, B.D.; Vishala, A.D.; Christina, G.D.A.; Tonapi, V.A. 2016. Millet Recipes- A Healthy Choice by ICAR-Indian Institute of Millets Research, Hyderabad, India.

Ravi, S.B.; Swain, S.; Sengotuvel, D.; Parida, N.R. 2010. Promoting nutritious millets for enhancing income and improved nutrition: A case study from Tamil Nadu and Orissa. In: Mal, B.; Padulosi, S.; Ravi, S.B. (Eds.), Minor Millets in South Asia: Learnings from IFAD-NUS Project in India and Nepal. Biodiversity International, Maccarese, Rome, Italy and M.S. Swaminathan Research Foundation, Chennai, India. 185P. 

Nelson, A.R.L.E.; Ravichandran, K.; Antony, U. 2019. The impact of the green revolution on indigenous crops of India. Journal of Ethnic Foods 6: 8. https://doi.org/10.1186/s42779-019-0011-9 

Weber, S.; Kashyap, A. 2016. The vanishing millets of the Indus civilization. Archeological and Anthropological Sciences 8: 9-15. https://www.doi.org/10.1007/s12520-013-0143-6 


রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...