সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
ইতিপূর্বে ভুটান (এ বিষয়ে আমি একটি ভ্রমণ কাহিনী 'দিন তিনেকের ভুটান' লিখেছিলাম যেটি 'আমাদের ছুটি' অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল) ছাড়া যে সকল দেশ আমি ভ্রমণ করেছি তা সর্বদা কর্মসূত্রে। প্রায় দীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর পর কয়েকদিনের ছুটিতে সপরিবারে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ড। আগামী কয়েকটি পর্বে আমি আমাদের এই ভ্রমণ কাহিনীটি বিস্তারিত লিখব।
প্রথমে থাইল্যান্ড দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত প্রায় ৫১৩১২০ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্রফলের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র এই দেশটির জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭০ মিলিয়ন। দেশটির উত্তরে রয়েছে মায়ানমার এবং লাওস, পূর্বে লাওস এবং কম্বোডিয়া, পশ্চিমে মায়ানমার, দক্ষিণে দেশটির লম্বা একটি উপদ্বীপীয় (Peninsula) অঞ্চল রয়েছে আর তারপর রয়েছে মালেশিয়া। উপদ্বীপীয় অঞ্চলটির পশ্চিমে রয়েছে আন্দামান সাগর।
আমরা, আমি আর আমার স্ত্রী, যাব দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Incheon International Airport) থেকে। ১ নম্বর টার্মিনাল থেকে রাত্রি ৮ টা বেজে ৪০ মিনিটে (কোরিয়া সময়) থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (Suvarnabhumi International Airport) উদ্দেশ্যে আমাদের বিমান যাত্রা শুরু করলো। প্রায় ৫ ঘন্টা ১০ মিনিটের বিমান যাত্রা, থাইল্যান্ড সময় পরদিন ভোর সাড়ে ১২ টায় আমাদের অবতরণ সঠিক সময়ানুসারেই হয়েছিল। এই বিমানবন্দর দিয়ে অগণিত বার আমি যাতায়াত করেছি বটে তবে এই দেশটা দেখার সুযোগ এইবার প্রথম।
বিদেশে ভ্রমণের প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়টির অবতারণা হয় তা হলো ভিসা। এই ভিসা বা অনুমতি পেতে আবেদনকারীকে উপযুক্ত সময়ে সেই দেশের নিয়ম অনুযায়ী ভ্রমণের কারণ, যাতায়াত এবং থাকবার ব্যবস্থা, নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে প্রমাণ সহ বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হয়, এবং সকল বিষয় সেই দেশের নিয়মাবলীকে পরিতৃপ্ত করলে ভিসা পাওয়া যায়। কয়েকটি দেশ আবার ভারতবাসীকে পৌঁছনোর পর ভিসার জন্যে আবেদনের সুযোগ দিয়ে থাকে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড অন্যতম। দেশটি ভারতীয় নাগরিকদের পর্যটনের উদ্দেশ্যে ১৫ দিনের জন্যে 'Visa on Arrival' প্রদান করে থাকে। যদি কোনো ভারতীয় পর্যটক ১৫ দিনের অধিক থাইল্যান্ডে থাকতে চান তবে তাকে পূর্বেই ভিসার জন্যে আবেদন করতে হবে। থাইল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর 'Visa on Arrival' ফর্মটি পূরণ করতে হয়। এই জন্যে কয়েকটি ডকুমেন্টের প্রয়োজন হয়, তা এখানে উল্লেখ করলাম।
(১) থাইল্যান্ডের থেকে ফেরার বিমানের টিকিট,
(২) থাকবার স্থানের (পর্যটকদের ক্ষেত্রে হোটেলের) সংরক্ষনের প্রমান,
(৩) জনপ্রতি ১০,০০০ থাই বাত (Thai Baht) (পরিবার প্রতি ২০,০০০ থাই বাত),
(৪) নিজের একটি ফোটোগ্রাফ (৬ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪ সেন্টিমিটার প্রস্থ) প্রয়োজন।
বিমানবন্দরে অবতরণের পর চলার পথে লক্ষ্য করলেই দিক নির্দেশ চোখে পড়বে, দিক নির্দেশ অনুসরণ করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় "Visa on Arrival' স্থানটিতে। অতএব বিমান থেকে অবতরণের পর প্রথম কর্তব্য 'Visa on Arrival' ফর্মটি সঠিকভাবে পূরণ করে কাউন্টারে সেটি জমা করা, অফিসার ফর্মটি পরীক্ষা করে ভিসা আবেদনের মূল্য (আমাদের জন প্রতি ২২০০ থাই বাত লেগেছিলো) জমা করতে বলবেন। তারপর ঐদেশের ইমিগ্রেশন নিয়মানুসারে আঙুলের ছাপ এবং চোখের স্ক্যান করে পাসপোর্টে ভিসা স্ট্যাম্প এবং অনুমতি সাপেক্ষে দিনসংখ্যা উল্লেখ করে স্ট্যাম্প করে দিলেই আপনি দেশটিতে প্রবেশ করতে পারবেন।
ভিসা পাওয়ার পর আমরা মোবাইল ফোনের সিম নেওয়ার জন্যে আবেদন করেছিলাম, পদ্ধতিটি খুবই সহজ, একাধিক কাউন্টার রয়েছে সিম নেওয়ার, যে কোনো একটিতে গিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী (৮ দিনের জন্যে ১৫ GB ২০০ থাই বাত, আর আনলিমিটেড ইন্টারনেটের জন্যে ৪৯৯ থাই বাত) সিম নেওয়া যায়, পাসপোর্টের ফটোকপি এবং আবেদনকারীর চিত্র দুই-ই দোকানের কর্মী তুলে নেবেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা এই কাজ দু'টি সপন্ন করে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করার স্থানে পৌঁছলাম। আমার এবং আমার স্ত্রীর মা-বাবা আসবেন কলকাতা থেকে, তাঁদের বিমান পৌঁছনোর সময় ভোর ৪ টে বেজে ১০ মিনিটে। এবার অপেক্ষা, বিমানবন্দরে অপেক্ষা করার স্থানটিতে পৌঁছে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্যে।
তবে এই অবসরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নিই।
'সুবর্ণভূমি' নামের অর্থ স্বর্ণের ভূমি বা সোনার দেশ। শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ থেকে। শুধু এই শব্দটি নয়, এখানে প্রচলিত অনেক শব্দ কিন্তু ভারতীয় ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়, কখনও উচ্চারণ রীতিটি একটু আলাদা। যেমন মনুষ্য (Manushyo) এখানে মানুথ (Manuth), গজ (Gaja) এখানে খজ (Khaja), দেবী (Devi) এখানে তেয়ি (The yi), চাঁদ (Chand) এখানে চান (Chan), তারা (Tara) হলো দারা (Dara), রাজা (Raja) হয়েছে রাচা (Ra chaa), ভাষা (Bhasha) হয়েছে পাষা (Pa sha) ইত্যাদি। থাই মানুষের অভিবাদন 'স্বাদিকাম' আর ভারতীয়দের 'স্বাগতম'-র ভাষাগত নৈকট্য কিন্তু লক্ষ্যণীয়। কোথাও বেশ ভালো লাগছে না ! বেশ নিজ নিজ অনুভূতি, আর হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় আছে কাজেই এই দেশের ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যেতেই পারে। কোনো স্থান সম্বন্ধে জানতে হলে তার ইতিহাস, সংস্কৃতি জানা অপরিহার্য বলেই আমার মনে হয়। এখানে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক যা আমাদের এই ভ্রমণের সাথে বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।
বর্তমান থাইল্যান্ডের পূর্বের নাম ছিল শ্যামদেশ। এই 'শ্যাম' নামটির উৎপত্তি খুঁজতে গেলে দেখা যায় শব্দটি সংস্কৃত বা পালি ভাষা থেকে এসেছে বলে বোধ হয়। দেশটির ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ইত্যাদির উপর ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে নান চাওয়ের 'তাই' (Tai) জনজাতির মানুষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূখণ্ডে আসেন এবং খমের সাম্রাজ্যের (Khmer Empire) অধীনে তাঁদের বসতি স্থাপন করেন। ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রী ইন্দ্রাদিত্য খমের সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে সুখোথাই (Sukhothai Kingdom) রাজত্ব গঠন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটিই প্রথম থাই রাজত্ব বলে বিবেচিত হয়। 'থাই' কথাটির অর্থ এখানে 'মুক্ত' (Free), আবার 'তাই' জনগোষ্ঠীর নামানুসারেও 'থাই' নামটি আসে। এর পরবর্তী কালে সুখতাই রাজত্বের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তা ছড়িয়ে পরে লাওস, বার্মা এবং মালাক্কা উপদ্বীপে, মূলত সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি হয়েছিল ভ্যাসাল স্টেট (Vassal state: একটি ভাসাল রাষ্ট্র এমন যে কোনো রাষ্ট্র যার একটি উচ্চতর রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের প্রতি পারস্পরিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে) গঠনের মাধ্যমে। সুখোথাই রাজত্বের রাজারা বিদেশী শক্তির (যেমন চীনের ইউয়ান রাজবংশের সাথে) সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এরপর সুখোথাই রাজত্বের ভ্যাসাল স্টেটগুলি যখন বিদ্রোহ শুরু করে তা আর পুনর্গঠন করা এই রাজত্বের পক্ষে সম্ভব হয়নি, বরং আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে বিরোধী শক্তির কাছে। এর মধ্যে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য (Ayutthaya Empire) গড়ে ওঠে। ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমগ্র সুখোতাই রাজত্বের অবসান ঘটে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য ওই অঞ্চলের বৃহৎ শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সুখোথাই যেমন ভ্যাসাল স্টেট গঠনের মাধ্যমে নিজের পরিধি এবং শক্তি বৃদ্ধি করেছিল, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য কিন্তু তা করেনি, বরং এই সাম্রাজ্য ছিল সামগ্রিকভাবে রাজতন্ত্র নির্ভর। এই 'আয়ুত্থায়া' নামটির সাথে ভারতবর্ষের 'অযোধ্যা' নামটির সাদৃশ্য রয়েছে। শুধু অযোধ্যা নামের সাদৃশ্য নয়, ভারতবর্ষের মহাকাব্য রামায়ণ এখানে 'রামাকিয়েন', থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ। আমাদের 'রাজা রাম' এখানে 'ফ্রা রামা'। 'রামাকিয়েন' শব্দটির অর্থ 'রামের গৌরব' (Glory of Rama)। এই সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পর্তুগালের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। পর্তুগিজদের উচ্চারণে 'শ্যাম' পরিণত হলো 'সিয়াম' (Siam) এ। তখন পর্তুগাল মালাক্কা উপদ্বীপ দখল করেছে এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের স্থানীয় থাই রাজত্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। থাই রাজত্বও এর ফলে উপকৃত হতো, কাজেই ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। এর ফলে একাধিক ট্রিটি (Treaty) স্থাপন হয়েছিল, যেমন ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং পর্তুগালের মধ্যে, আবার বেশ কয়েক দশক পরে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জাপানের সাথেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, মিশনারীদের আগমনে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব লক্ষ্যিত হলে পরবর্তী প্রায় দেড় শতাব্দী ইচ্ছানুসারে থাই সাম্রাজ্য বিদেশী সম্পর্ক থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখেন।
১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলো বার্মিজ-সিয়ামিজ যুদ্ধ, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয় এই যুদ্ধে, রাজধানী আয়ুত্থায়া ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বার্মিজদের হাতে। আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের কমান্ডার ফ্রায়া তাকসিন (Phraya Taksin) বার্মিজদের অবরোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করেন এবং নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। থনবুরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং চীনের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। তবে তাকসিন যে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া রাজত্বের অন্যতম কমান্ডার জেনারেল চাও ফ্রায়া চাকরি (Chao Phraya Chakri) রাজসিংহাসন থেকে রাজা তাকসিনকে অপসারণ করে চাকরি রাজবংশের (Chakri Kingdom) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় তাঁরা রাজধানী ব্যাঙ্ককে স্থানান্তরিত করেন। আজও থাইল্যান্ডে চাকরি বংশ রাজত্ব করছেন এবং রাজধানী ব্যাঙ্কক। পরবর্তীতে অনেক কাল অতিবাহিত হয়েছে, ঘটনার পরম্পরা এই দেশকে আজ উন্নত দেশে পরিণত করেছে, তবে সে ইতিহাস সবিস্তারে এই ভ্রমণ কাহিনীতে বিশেষ প্রাসঙ্গিক নয়।
আমাদের সারা রাত বিমানবন্দরের অপেক্ষার স্থানে পার হলো, দেখলাম মা-বাবা'দের বিমান সঠিক সময়ে অবতরণ করেছে। এবার ওঁরা বিমানবন্দরের সব কাজ শেষ করে বাইরে আসবে। এখানে একটু কিছু প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যাবো অন্তর্দেশীয় বহির্গমনের উদ্দেশ্যে। আমাদের বিমান সকাল ৮ টা ৫ মিনিটে, ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেট।
জুলাই, ২০২৩


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন