পৃষ্ঠাসমূহ

রাজমহল: পর্ব-১ (Rajmahal: Part-1)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh) 



মালদার নিকট মানিকচক ঘাট থেকে ভেসেলে গঙ্গা পার হয়ে আমরা পৌঁছলাম রাজমহল ঘাটে, তখন প্রায় ১'টা বাজে। মালদা ভ্রমণের পর এবার আমরা রাজমহল ঘুরব। ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাহিবগঞ্জ জেলায় রাজমহল অবস্থিত, যা একদা মাল-পাহাড়িয়া উপজাতির গোষ্ঠী মাল রাজা শাসন করতেন। সকালে হোটেল থেকে প্রাতঃরাশ সেরেই বেরিয়েছিলাম আমরা। ঘাটের কাছেই একটি হোটেলে গরম গরম ভাত, ধোঁয়া ওঠা ডাল, ভাজা, সব্জি সহযোগে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। এবার রাজমহল ঘুরে দেখা। এখান থেকেই সম্রাট আকবরের বাংলা দখল, কালাপাহাড়ের প্রবল পরাক্রম সত্ত্বেও বিফল হওয়া, আবার এই রাজমহলের পাহাড়েই পাহাড়িয়া, মাঝ-পাহাড়িয়াদের বাস, প্রণম্য তিলক মাঝির জন্ম, তাঁর দূরদৃষ্টি - কত ইতিহাস এই স্থানকে ঘিরে। দুপুরের খাওয়া সারতে সারতে একবার অতীতের নগরী রাজমহলের ইতিহাস সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক, তাহলে ঘুরতে সুবিধা হবে। 

[এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণকাহিনী (গবেষণাধর্মী বা গবেষণা নির্ভর ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়) যার অন্যতম উপাদান স্থানীয় গাইডদের  বা মানুষের প্রদত্ত তথ্য, সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান, প্রচলিত লোককথা, বিশ্বাস ইত্যাদি। তবে আমি স্থানগুলিতে যে ফলকগুলি রয়েছে তার চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছি, সেগুলি থেকে পাঠক-পাঠিকা তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।]

হুসেন শাহী বংশের শেষ সুলতান ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ [অনুগ্রহ করে পড়ুন মালদা: পর্ব-২ এবং মালদা: পর্ব-১]। মোঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বাদশাহ হুমায়ুন গৌড় দখল করেছিলেন কিন্তু তা অতি স্বল্প সময়ের জন্যে।  হুমায়ুন চৌসার যুদ্ধে শের শাহ সুরি-র নিকট পরাজিত হলে দিল্লী তথা বাংলা শের শাহ সুরি-র অধীনে আসে। এরপর সুরি বংশের অবসান হলে বাংলায় মহম্মদ শাহ বংশ (১৫৫৪-১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং এর অবসানে কারনানি বংশের (১৫৬৪ -১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ) সূচনা হয়। এই কারনানি বংশের শেষ সুলতান ছিলেন দাউদ খান কারনানি। এই সময় বাংলা জয়ের জন্যে সম্রাট আকবর সেনাপতি মুনিম খানকে প্রেরণ করেন, টুকরোই-এর যুদ্ধে তিনি দাউদ খান-কে পরাজিত করেন এবং তাঁর কাছ থেকে বাংলা, আর বিহার অধিকার করেন। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কারণ বাংলার বারো ভূইঁয়াদের অন্যতম ঈশা খান মোঘলদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। এদিকে, আকবরের সেনাপতি মুনিম খানের মৃত্যুর পর দাউদ খান পুনরায় বাংলা দখল করতে সচেষ্টা হন।  

অবশেষে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি, রাজা মান সিং, ওড়িশা জয়ের পর প্রথম রাজমহলে আসেন এবং ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে সুবে বাংলার রাজধানী হিসাবে রাজমহল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার রাজধানী মালদা থেকে রাজমহলে স্থানান্তরিত হলো, এই স্থানান্তর ছিল অনেকটা কৌশলগত, কারণ এটি গঙ্গার তীরে এবং এখান থেকে  বিহার ও বাংলা উভয় স্থানেই সহজ পৌঁছনো যায় কারণ এই নগর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। মান সিংয়ের আমলে, রাজমহল একটি সমৃদ্ধ প্রশাসনিক ও সামরিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অতীতের আগমহল, মুঘল সাম্রাজ্যের 'দামান-ই-কোহ' পরিচিত হলো নতুন নামে আকবরনগর। এখানে নির্মিত হয় প্রাসাদ, প্রশাসনিক ভবন, এবং দূর্গ। পরবর্তী মুঘল গভর্নরদের অধীনেও মসজিদ, বাগান এবং দূর্গ নির্মাণের মাধ্যমে শহরের গুরুত্ব অব্যাহত ছিল যা এখনও তার অতীত গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে। বাংলার রাজধানী হিসেবে রাজমহলের প্রাধান্য সুবাহদার ইসলাম খান দ্বারা তাঁর শাসনকালের মধ্যে (১৬০৮ থেকে ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ) রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত করা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। যদিও তখন রাজমহল একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ফাঁড়ি এবং বাণিজ্য শহর হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহল তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করে যখন সুবে বাংলার গভর্নর এবং সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজা কর্তৃক  রাজমহলে বাংলার রাজধানী পুনর্স্থাপিত হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীতে, রাজমহল স্থানীয় ক্ষমতার উত্থান, মারাঠা অনুপ্রবেশ এবং মুঘল সাম্রাজ্য এবং নতুন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে দ্বন্দ্বের সাথে অশান্তি এবং আনুগত্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, মুর্শিদাবাদ ক্ষমতার কেন্দ্র রূপে গিরে ওঠে, যা মুর্শিদকুলী খানের অধীনে বাংলার নতুন রাজধানী হয়ে ওঠে। ওই শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা পর্বে রাজমহলের তাৎপর্য  আরও হ্রাস পায়। বাংলা ও বিহারের অন্যান্য অংশে ব্রিটিশ প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপনের ফলে শহরটিকে একটি ছোট প্রশাসনিক ইউনিটে পরিণত করা হয়। যাইহোক, এটি একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যের স্থান হিসাবে অব্যাহত ছিল এবং এর সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্য ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

মধ্যাহ্নভোজন সারতেই আমাদের গাড়ী এসে উপস্থিত হলো। এবার আমরা এই নগরের ইতিহাসকে প্রতক্ষ্য করবো। প্রথম গন্তব্য সাঙ্গি দালান। 

সাঙ্গি দালান বা মার্বেল প্যাভিলিয়ন ঝাড়খণ্ডের রাজমহলের ঐতিহাসিক শহরের মধ্যে অবস্থিত একটি মার্জিত মুঘল যুগের কাঠামো। এই সুন্দর মণ্ডপটি মান সিং কর্তৃক বা মতান্তরে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার, যিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সময়ে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সাঙ্গি দালান নির্মাণে প্রতিসাম্য নকশার ব্যবহার করা হয়েছে - মুঘল স্থাপত্যের একটি বৈশিষ্ট্য। মণ্ডপটিতে খিলানযুক্ত একটি বড় কেন্দ্রীয় হল রয়েছে, যাতে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করতে পারে এবং বায়ুচলাচল করে। এখান থেকে গঙ্গা নদী এবং মনোরম রাজমহল পাহাড়ের একটি অপরূপ দৃশ্য উপভোগ্য। আগে এখান থেকে দাঁড়িয়ে গঙ্গায় শুশুক দেখা যেত বলে শুনেছি, জানি না এখন তাদের দেখা যায় কিনা। কাঠামোটি মুঘল আভিজাতদের জন্য একটি আনন্দ মণ্ডপ বা অভ্যর্থনা হল হিসাবে ব্যবহার করা হতো বলে মনে করা হয়। আবার, সমাবেশ, আলোচনা এবং মনোরম পরিবেশ উপভোগ করার জন্যও ব্যবহৃত হতো বলে মনে করা হয়। মার্জিত নকশা এবং কৌশলগত অবস্থান থেকে বোঝা যায় যে এটি নান্দনিক এবং কার্যকরী উভয় উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল।

এই প্রাঙ্গনেই রয়েছে অপূর্ব ভাস্কর্যের কয়েকটি নিদর্শন, একটা ছোট উদ্যান। মণ্ডপের মধ্যে দেখলাম ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল শতরঞ্চি বিছিয়ে আঁকছে। অনেক মানুষ উদ্যানটিতে বেড়াতে এসেছেন। 'ঝাড়ো কে দেশ' ('ঝাড়' শব্দটির অর্থ জঙ্গল, অর্থাৎ জঙ্গলের দেশ) এই ঝাড়খন্ড। অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় যথা সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, সাওরিয়া পাহাড়িয়া, বিরহর, করওয়া, মাহলি, কারমালি ইত্যাদি। জীবনধারণের উদ্দেশ্যে কোনো সম্প্রদায় চাষাবাদ করেন, আবার কোনো সম্প্রদায় কারিগরী শিল্পে নিপুণ। চাষাবাদ আবার প্রধানত দুই ধরণের, যেমন সেটলড কৃষিকাজ আবার কোথাও কোথাও ঝুমচাষ হয়ে থাকে।  

ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে মুঘল আমলে রাজা মান সিং কর্তৃক নির্মিত আকবরী দূর্গটি রাজমহলের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নিদর্শন,আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য। রাজমহল যখন সুবে (সুবাহ) বাংলার রাজধানী ছিল সেই সময়ে এই দূর্গটি নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে দূর্গের অধিকাংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এটি আজও অতীত নগরের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এবং এই অঞ্চলের স্থাপত্যের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। আকবরী দূর্গের নিকটেই অবস্থিত জামি মসজিদটি রাজমহলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপত্য। রাজা মান সিংয়ের শাসনামলে নির্মিত, মসজিদটি তার গঠন, গম্বুজ এবং মিনারগুলির সাথে চমৎকার মুঘল স্থাপত্যশৈলীকে প্রতিফলিত করে। এটি একটি উপাসনার স্থান এবং একটি মুঘল প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে শহরের প্রাক্তন তাৎপর্যের  একটি প্রমাণ হিসাবে রয়ে গেছে।




জামি মসজিদ এবং আকবরী দূর্গ দেখে এবার আমরা চললাম বারাদারি-র উদ্দেশ্যে। রাজমহলের বারাদারি-র অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক আকর্ষণ এবং স্থাপত্যটির উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক মূল্য রয়েছে। "বারাদারি" শব্দটির অর্থ "বারো দরজা" (ফার্সী শব্দ বারাহ থেকে যার অর্থ বারোটি এবং দার মানে দরজা) এবং এটি সাধারণত একটি মণ্ডপ বা ভবনকে বোঝায় যা বারোটি দরজা দিয়ে চারদিকে খোলা থাকে। রাজমহলের বারাদারি মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল, সম্ভবত সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার শাসনকালে।


শাহ সুজা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং রাজমহলকে তার বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করেন। কাঠামোটি রাজপরিবারের জন্য একটি আনন্দের মণ্ডপ হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল এবং এটি অবসর, সমাবেশ এবং সভাকার্যের জন্য একটি স্থান ছিল। এখান থেকে কিছুক্ষনের জন্যে হলেও আশেপাশের এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং গঙ্গা নদীর দৃশ্য উপভোগ করা যেতে পারে।




বারাদারি মুঘল স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন যার প্রতিসাম্য নকশা এবং মার্জিত খিলান রয়েছে। যদিও কাঠামোটি সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষিত নয়, তবে এর অবশিষ্ট উপাদানগুলি সেই সময়ের চমৎকার কারুকার্য প্রদর্শন করে। বারাদারি-র মূল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে: উন্মুক্ত কাঠামো: বারোটি খিলান বা দরজা দিয়ে বারোটি খিলান সহ বারাদারিটি খোলা নকশা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে যা চারপাশের একটি অবাধ দৃশ্য প্রদান করে। কেন্দ্রীয় হল: প্যাভিলিয়নের কেন্দ্রীয় হল সম্ভবত সামাজিক জমায়েত বা অফিসিয়াল মিটিং-এর জন্য ব্যবহার করা হত। আলংকারিক উপাদান: এমনকি বর্তমান জীর্ণ অবস্থায়ও, খিলান ও স্তম্ভগুলি মুঘল স্থাপত্যের শৈল্পিক সূক্ষ্মতাকে প্রতিফলিত করে।

এরপর কানহাইয়াস্থান মন্দির দর্শন করে আমরা গিয়েছিলাম মতি ঝর্ণা দেখতে। 


তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। দেখলাম সেই স্থানে কয়েকটি দোকান রয়েছে, সেখান থেকে বিকেলের চা, কেক ইত্যাদি খেয়ে আমরা ফিরলাম সাহিবগঞ্জে হোটেলে। একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরোলাম রাতের খাওদাওয়ার উদ্দেশ্যে। এখানে লোডশেডিংয়ের কারণে রাস্তাঘাট বেশ অন্ধকার। যাইহোক, অনতিদূরে একটি রেস্তোরাঁতে আমরা রাতের আহার সারলাম। খাওয়াদাওয়া সেরে হোটেলে ফিরে আজকের মতন বিশ্রাম।

জানুয়ারী, ২০২৪

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...