পৃষ্ঠাসমূহ

Nutrition status of India লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Nutrition status of India লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

ভারতের স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ (Exploring Local Food Systems of India)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

ভারতবর্ষের বাইরে কোনো স্থানে গেলে সেখানে যদি কোনো ভারতীয় রেস্তোরাঁ চোখে পরে তবে আনন্দের সীমা থাকে না। তবে সেখানে যে সকল প্রকার ভারতীয় খাবারের সম্ভার থাকে এমনটা কিন্তু নয়। কয়েকটি পদ-ই সেখানে প্রস্তুত করা হয় এবং ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী পরিবেশন করা হয়ে থাকে।  এই বিষয়ে আমি পূর্বে একটি ব্লগে বিস্তারিত লিখেছি [অনুগ্রহ করে পড়ুন ভারতীয় রান্নার একটি গল্প ]।  এই ব্লগে আমার উদ্দেশ্য এমন কিছু আইকনিক খাবারের পদ উল্লেখ করা যাতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্য বৈচিত্র্যের একটা ধারণা পাওয়া যায়। 

ভারত বিভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং রন্ধনপ্রণালীর দেশ। এ দেশ দেশীয় খাদ্য ব্যবস্থার সমৃদ্ধ টেপেস্ট্রি নিয়ে গর্ব করে। ইতিহাস ও ভূগোলের গভীরে প্রোথিত এই রন্ধন প্রথা উপমহাদেশের অনন্য ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। হিমালয়ের তুষারময় শিখর থেকে ভারত মহাসাগরের গ্রীষ্মমন্ডলীয় উপকূল পর্যন্ত, প্রতিটি অঞ্চল ভারতীয় খাবারের প্রাণবন্ত উপাদান, স্বাদ এবং রান্নার কৌশলগুলির নিজস্ব অবদান রাখে। এই ব্লগে, আমরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ করার জন্য একটি যাত্রা শুরু করব, সারা দেশে বিভিন্ন রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যের ঐতিহ্যবাহী অভ্যাস, উপাদান এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের সন্ধান করব। এই অন্বেষণের মাধ্যমে, আমরা এই প্রাচীন খাদ্যপথের অন্তর্নিহিত স্থিতিস্থাপকতা (Resilience), বৈচিত্র্য (Diversity) এবং স্থায়িত্বের (Sustainability) দিকে লক্ষ্য রাখব।

উত্তর ভারত

প্রথমেই উত্তর ভারতের পাঞ্জাবের দিকে তাকানো যাক। পাঞ্জাবকে প্রায়শই "ভারতের রুটির ঝুড়ি" (Breadbasket of India) হিসাবে উল্লেখ করা হয়, পাঞ্জাব এমন একটি রন্ধনপ্রণালীর গর্ব করে যা হৃদয়গ্রাহী, সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যে ভরপুর। পাঞ্জাব সমভূমির উর্বর মাটি প্রচুর পরিমাণে শস্য, শাকসবজি এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপন্ন করে, যা পাঞ্জাবি খাবারের মূল ভিত্তি। পাঞ্জাবি খাবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তন্দুরি রান্নার (Tandoori cooking) উপর জোর দেওয়া। তন্দুর, একটি নলাকার (Cylindrical) মাটির চুলা, মাংস গ্রিল করতে, এবং রুটি বেক করতে ব্যবহৃত হয়, যা খাবারে একটি অনন্য ধোঁয়াটে স্বাদ (Smoky flavour) দেয়। তন্দুরি চিকেন (Tandoori chicken), তন্দুরে রান্না করার আগে দই এবং মশলার মিশ্রণে ম্যারিনেট (Marinate) করা হয়, পাঞ্জাবি রান্নার একটি ক্লাসিক কুইসিন। পাঞ্জাবের আরেকটি আইকনিক খাবার হল সর্ষ দা সাগ’ (Sarson da saag) এবং মাক্কি দি রোটি’ (Makkai di roti), সরিষার শাক এবং কর্নমিল ফ্ল্যাটব্রেডের (Cornmeal flatbread- ভুট্টার আটার রুটি) একটি উপাদেয় মিল। এই খাবারটি ঐতিহ্যগতভাবে শীতের মাসগুলিতে উপভোগ করা হয় যখন সরিষার শাক মরশুমি এবং প্রায়শই বাড়িতে তৈরি মাখন বা ঘি (Ghee) দিয়ে পরিবেশিত হয়ে থাকে। সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি, পাঞ্জাব তার মিষ্টি খাবারের জন্যও বিখ্যাত, যেমন 'পিন্নি' (Pinni), ময়দা, ঘি এবং গুড় দিয়ে তৈরি একটি ঘন এবং বাদামের মিষ্টি। এই মিষ্টিগুলি প্রায়শই উৎসব এবং বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়।

এবার আসি উত্তরপ্রদেশের কথায়। উত্তর প্রদেশ, ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য, মুঘলাই ঘরানা-র সুস্বাদু খাবার থেকে আওয়াধি ঘরানা পর্যন্ত রন্ধনসম্পর্কীয় সমৃদ্ধ টেপেস্ট্রির (Tapestry) আবাসস্থল। উত্তরপ্রদেশের রন্ধনপ্রণালী তার সমৃদ্ধ এবং সুগন্ধযুক্ত গ্রেভি (Aromatic gravies), ধীরে-ধীরে রান্না করা মাংস (Slow-cooked meat) এবং সূক্ষ্ম মশলার মিশ্রণ (Delicate spice blends) দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। উত্তর প্রদেশের সবচেয়ে আইকনিক খাবারগুলির মধ্যে একটি হল বিরিয়ানি (Biryani), একটি সুগন্ধি চাল, কোমল মাংস, সুগন্ধি মশলা এবং ক্যারামেলাইজড পেঁয়াজ দিয়ে প্রস্তুত এই ডিশ। লখনউই বিরিয়ানি (Lucknowi biryani), বিশেষ করে, জাফরান, কেশর এবং গোলাপ জল দিয়ে মিশ্রিত মাংসের সূক্ষ্ম স্বাদ এবং কোমল টুকরার জন্য বিখ্যাত। উত্তরপ্রদেশ কুইসিনের আর একটি রত্ন হল কাবাব, একটি রসালো মাংসের প্রস্তুতি যা আওধের রাজকীয় রান্নাঘরে উদ্ভূত হয়েছিল। আপনার মুখের গলে যাওয়া 'গালোটি কাবাব' হোক (Galouti kebab) বা রসালো 'শিক কাবাব' (Seekh kebab), উত্তরপ্রদেশ কাবাব উৎসাহীদের জন্য প্রচুর ধরণ সরবরাহ করে।নিরামিষ রন্ধনপ্রণালীতেও উত্তর প্রদেশে সমৃদ্ধ, নিরামিষ খাদ্যের মধ্যে 'পনির টিক্কা' (Paneer tikka), 'ডাল মাখানি' (Dal makhani) এবং 'ছোলে ভাটুরে'র (Chole bhature) মত খাবারগুলি উল্লেখযোগ্য। উত্তর ভারতীয় খাবারের প্রধান উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে গম, চাল, মসুর, শাকসবজি, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং সুগন্ধি মশলা যেমন জিরা, ধনে, হলুদ এবং গরম মসলা।

দক্ষিণ ভারত

এবার আসি দক্ষিণ ভারতে। কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং অন্ধ্র প্রদেশের প্রত্যেকেরই নিজস্ব অনন্য রন্ধন ঐতিহ্য রয়েছে, যা অঞ্চলের ভূগোল, ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক দ্বারা প্রভাবিত। "মশলার দেশ" (Land of Spices) হিসাবে পরিচিত কেরালা তার নারকেল-ভরা তরকারি, সামুদ্রিক খাবারের (Seafood) উপাদেয় এবং কলা পাতায় পরিবেশিত ঐতিহ্যবাহী 'সাধ্য মিল'- (Sadhya meal) জন্য বিখ্যাত। কেরালার রন্ধনপ্রণালী নারকেল, মশলা এবং তাজা সামুদ্রিক খাবারের উদার ব্যবহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। 'মীন কারি' (Meen curry- মাছের কারি), 'অ্যাভিয়াল' (Avial- মিশ্র তরকারি), এবং 'আপাম' (Appam- গাঁজানো চালের প্যানকেক) এর মতো খাবারগুলি কেরালার সুস্বাদু খাবারের উদাহরণ দেয়।

তামিলনাড়ু একটি সমৃদ্ধ রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যের গর্ব করে, যেখানে চেটিনাড রন্ধনপ্রণালী (Chettinad cuisine) তার জ্বলন্ত স্বাদ এবং শক্তিশালী মশলার মিশ্রণের জন্য আলাদা। 'ইডলি' (Idli), 'দোসা' (Dosa) এবং 'সাম্বার' (Sambar) হল তামিল রন্ধনপ্রণালীর প্রধান পদ, যা সমগ্র অঞ্চল জুড়ে উপভোগ করা হয়। তামিলনাড়ুর চেটিনাড রন্ধনপ্রণালী তার জ্বলন্ত স্বাদ এবং দুর্দান্ত মশলার মিশ্রণের জন্য পরিচিত। সিগনেচার ডিশের মধ্যে রয়েছে 'চেটিনাদ চিকেন' (Chettinad chicken), প্রন মাসালা (Prawn masala), এবং 'কুঝি পানিয়ারম' (Kuzhi Paniyaram), প্রতিটি অঞ্চলের সাহসী এবং সুগন্ধি স্বাদকে তুলে ধরে।

কর্ণাটক ম্যাঙ্গালোরিয়ান রন্ধনপ্রণালী- (Mangalorean cuisine) সুস্বাদু চালের ডাম্পলিং (Rice dumpling) থেকে শুরু করে মহীশূর অঞ্চলের সুগন্ধি 'বিসি বেলে বাথ' (Bisi Bele Bath) পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের খাবার প্রদান করে। রাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলগুলি তাদের সামুদ্রিক খাবারের প্রস্তুতির জন্য বিখ্যাত, যখন অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলি অনন্য নিরামিষ বিশেষত্ব প্রদর্শন করে। কর্ণাটকের রন্ধনপ্রণালী তার অঞ্চল জুড়ে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যাঙ্গালোরিয়ান ফিশ কারি-র মতো সামুদ্রিক খাবারের বিশেষত্ব রয়েছে, যখন অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে 'বিসি বেলে বাথ' এবং 'রাগি মুদ্দে(Ragi Mudde-ফিঙ্গার মিলেটের বল) মতো নিরামিষ খাবারগুলি অফার করা হয়।

হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি (Hyderabadi biryani), 'গোঙ্গুরা পাচাদি' (Gongura pachadi) এবং 'পেসারাত্তু'-র (Pesarattu) মতো খাবারগুলি স্থানীয় এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করে অন্ধ্রপ্রদেশ তার মশলাদার এবং টক স্বাদের (ট্যাঙ্গি-Tangy) খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ। অন্ধ্রপ্রদেশের রন্ধনশৈলী তার সাহসী এবং মশলাদার স্বাদের জন্য বিখ্যাত, যার মধ্যে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, 'গোঙ্গুরা পাচাদি' (সারা পাতার চাটনি) এবং মিরচি ভাজি (মরিচের ভাজা) মতো খাবারগুলি এই অঞ্চলের রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে৷

পূর্ব ভারত

পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মাছ [অনুগ্রহ করে পড়ুন বাঙালী আহারে মাছ] এবং ভাতের প্রতি ভালোবাসার জন্য বিখ্যাত। মাছের ঝোল (মাছের তরকারি)চিংড়ি মালাই কারি (চিংড়ির তরকারি), সরিষা ইলিশ, এবং ভাপা ইলিশ- এর মতো উপাদেয় পদ যেমন এখানে রয়েছে তেমনই রাস্তার খাবারের সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত, যেখানে কাঠি রোলফুচকা ('পানি পুরি'), এবং ঝাল মুড়ি (মশলাদার পাফড রাইস) এর মতো সুস্বাদু খাবারগুলি পাওয়া যায়। মিষ্টির মধ্যে এখানে উল্লেখযোগ্য রসগোল্লা, সন্দেশ, মিষ্টি দই

ওড়িশার রন্ধনপ্রণালীতে পাঁচ ফোরোন (পাঁচ-মশলার মিশ্রণ), সরিষার তেল এবং বিভিন্ন সবজি ব্যবহার করা হয়। 'ডালমা' (মসুর ডাল এবং সবজি দিয়ে প্রস্তুত পদ), 'ছেনা পোড়া' (ক্যারামেলাইজড কটেজ পনির কেক), এবং 'রসবালি' (ঘন দুধে মিষ্টি কটেজ পনির বল) এর মতো খাবারগুলি স্থানীয় এবং পর্যটকদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়। [অনুগ্রহ করে পড়ুন ঊড়িষ্যার কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদ: আমার অভিজ্ঞতা]

বিহারের রন্ধনপ্রণালী তার সরলতা এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত উপাদান ব্যবহারের জন্য পরিচিত। 'লিট্টি চোখা', একটি সুস্বাদু গমের ডাম্পলিং যা ভাজা বেসন দিয়ে ভরা হয় এবং আলু এবং বেগুনের ভর্তার সাথে পরিবেশন করা হয়, এটি এই অঞ্চলের একটি প্রিয় খাবার। অন্যান্য বিশেষত্বের মধ্যে রয়েছে 'ছাতু পরাঠা', 'ঠেকুয়া' (মিষ্টি ভাজা কুকিজ), এবং 'পুয়া' (মিষ্টি প্যানকেক)।

আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা এবং অরুণাচল প্রদেশ সহ ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলি উপজাতীয় সংস্কৃতি এবং বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত একটি সমৃদ্ধ রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে। প্রতিটি রাজ্যে কচি বাঁশের আগা (Bamboo shoot), ফার্মেন্টেড মাছ (Fermented fish) এবং স্থানীয় রান্নায় বিশিষ্টভাবে সুগন্ধযুক্ত ভেষজ উপাদানের মতো উপাদান সহ খাবারের একটি অনন্য বিন্যাস রয়েছে।

আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি পূর্ব ভারতের রন্ধনপ্রণালীকে নানানভাবে প্রভাবিত করেছে। আদিবাসী উপাদান, রান্নার কৌশল এবং রন্ধন প্রথার অবদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যা প্রজন্মের মাধ্যমে চলে আসছে। উদাহরণ স্বরূপ, ওডিশায়, সাঁওতাল (Santal) এবং কোন্ধের (Kondh) মতো উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলি স্থানীয় রন্ধনপ্রণালীতে বাজরা, বুনো মাশরুম (Wild mushroom), কচি বাঁশের আগা (Bamboo shoot)ফার্মেন্টেড মাছ (Fermented fish), সুগন্ধি ভেষজ এবং বন্য সবুজ শাক-সবজির মতো উপাদানগুলি প্রবর্তন করেছে, এমন খাবার তৈরি করেছে যা পুষ্টিকর এবং স্বাদযুক্ত উভয়ই। একইভাবে, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, নাগা এবং খাসিদের মতো উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলি স্মোকিং (Smoking), শুকানো (Drying) এবং ফার্মেন্ট (Ferment) করার মতো প্রাচীন খাদ্য সংরক্ষণের কৌশলগুলি সংরক্ষণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গে, মাছকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করার জন্য প্রায়শই শুকানো হয়। শুঁটকি মাছ এক ধরণের ডেলিকেসি (Delicacy)।

একইভাবে, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, কচি বাঁশের আগা এবং ফার্মেন্টেড মাছের মতো উপাদানগুলি সাধারণত 'অ্যাক্সোন' (Axone- গাঁজানো সয়াবিন) এবং 'এরোম্বা' (Eromba- গাঁজানো মাছের তরকারি) এর মতো খাবারগুলিতে গভীরতা এবং উমামি স্বাদ যোগ করতে ব্যবহৃত হয়। এই সংরক্ষণ কৌশলগুলি শুধুমাত্র উপাদানগুলির শেলফ লাইফকে প্রসারিত করে না বরং পূর্ব ভারতীয় রন্ধনশৈলীর অনন্য স্বাদ প্রোফাইল এবং রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যগুলিতে অবদান রাখে, এটিকে গ্যাস্ট্রোনমিক (Gastronomic) আনন্দের ভান্ডারে পরিণত করে।

পশ্চিম ভারত

ভারতের ব্যস্ততম আর্থিক রাজধানী মুম্বাইয়ের আবাসস্থল মহারাষ্ট্র, তার বৈচিত্র্যময় এবং স্বাদযুক্ত খাবারের জন্য পরিচিত। মুম্বাইয়ের মশলাদার রাস্তার খাবার, যেমন 'বড়া পাও' (Vada Pav) এবং 'পাও ভাজি' (Pav Bhaji) থেকে শুরু করে মালভানি অঞ্চলের সমৃদ্ধ এবং সুগন্ধযুক্ত কারি পর্যন্ত, মহারাষ্ট্রে সব রকম স্বাদের খাবারের সম্ভার রয়েছে।

গুজরাট, প্রায়শই "নিরামিষাশীদের দেশ" হিসাবে উল্লেখ করা হয়, এমন একটি রন্ধনপ্রণালী রয়েছে যা নিরামিষ-বান্ধব এবং স্বাদে সমৃদ্ধ। গুজরাটি থালি, একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার যা স্টেইনলেস স্টিলের থালায় পরিবেশন করা হয়, এতে ডাল, 'কাড়ি' (Kadhi), শাকসবজি, ভাত এবং রুটির মতো খাবারের ভাণ্ডার রয়েছে, যা এই অঞ্চলের স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবারের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করে।

রাজস্থান, তার শুষ্ক ল্যান্ডস্কেপ এবং রাজকীয় দুর্গের জন্য পরিচিত, একটি রন্ধনপ্রণালী অফার করে যা তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মতোই সমৃদ্ধ এবং প্রাণবন্ত। রাজস্থানী রন্ধনপ্রণালীর বৈশিষ্ট্য হল এর মশলা, শুকনো ফল এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যের ব্যবহার, যেখানে 'ডাল বাটি চুরমা' (Dal Baati Churma), 'গাত্তে কি সবজি' (Gatte ki Sabzi) এবং 'লাল মাস'-র (Laal Maas) মতো খাবারগুলি এই অঞ্চলের রন্ধনসম্পর্কীয় দক্ষতা প্রদর্শন করে।

গোয়া, এর আদিম সমুদ্র সৈকত এবং শান্ত পরিবেশ সহ, সামুদ্রিক খাবারের সুস্বাদু এবং পর্তুগিজ-অনুপ্রাণিত খাবারের জন্য বিখ্যাত। গোয়ান রন্ধনপ্রণালীতে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক তরকারি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আইকনিক ফিশ কারি রাইস, পাশাপাশি 'গোয়ান সসেজ পোলাও' (Goan Sausage Pulao) এবং 'বেবিঙ্কা'-র (Bebinca) মতো ফিউশন খাবার, নারকেল দুধ এবং ডিম দিয়ে তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী গোয়ান ডেজার্ট। গোয়ান রন্ধনপ্রণালীতে, সামুদ্রিক খাবার একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, এই অঞ্চলের উপকূলীয় অবস্থান এবং প্রচুর সামুদ্রিক সম্পদের জন্য ধন্যবাদ। মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া এবং গলদা চিংড়ি সাধারণত গোয়ান খাবারে ব্যবহার করা হয়, যা তাদের সাহসী স্বাদ, ট্যাঙ্গি সস (Tangy sauce) এবং হলুদ, মরিচ এবং তেঁতুলের মতো মশলার উদার ব্যবহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, 'ফিশ কারি রাইস' (Fish Curry Rice): গোয়ান রন্ধনপ্রণালীর একটি প্রধান খাবার, এই থালাটিতে একটি ট্যাঙ্গি নারকেল তরকারিতে সিদ্ধ করা মাছ, ভাপানো ভাত এবং ভাজা মাছের সাথে পরিবেশন করা হয়; 'প্রন বালচাও' (Prawn Balchão): চিংড়িগুলি ভিনেগার, মরিচ এবং মশলা দিয়ে তৈরি একটি মশলাদার এবং ট্যাঞ্জি মসলায় মেরিনেট করা হয়, তারপরে সিদ্ধ করা হয়।

রাজস্থানে, যেখানে জলের ঘাটতি একটি চ্যালেঞ্জ, বাজরা দীর্ঘকাল ধরে তাদের স্থিতিস্থাপকতা (Resilience) এবং পুষ্টির মূল্যের কারণে একটি প্রধান খাদ্য উৎস। বাজরা, জোয়ার এবং রাগি দিয়ে প্রস্তুত রুটি বা চাপাটি (ফ্ল্যাটব্রেড), পোরিজ (Porridge) এবং ডেজার্ট (Dessert) সহ বিভিন্ন ধরণের খাবার তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, বাজরা রুটি (Bajra Roti): পার্ল মিলেটের (Pearl millet- বাজরা) আটা দিয়ে তৈরি একটি পুষ্টিকর রুটি, প্রায়শই ঘি বা দই দিয়ে পরিবেশন করা হয় এবং এর সাথে মশলাদার চাটনি বা তরকারি দেওয়া হয়; 'রাগি মুদ্দে' (Ragi Mudde): ফিঙ্গার মিলেটের (Finger millet- রাগি) আটা এবং জল দিয়ে তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা বল আকারে তৈরি করা হয় এবং ডাল বা সবজির তরকারি দিয়ে পরিবেশন করা হয়।

আশা করি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানীয় খাদ্যসম্ভারের একটা চিত্র তুলে ধরতে পারলাম। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে, এছাড়াও অনেক পদ বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে, সমস্ত পদের বর্ণনা একটি সংক্ষিপ্ত ব্লগে সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি আইকনিক পদের বর্ণনা এই ব্লগটিতে করলাম। 

কিচেন গার্ডেন (Kitchen Garden)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


ছোটবেলায় দিদাকে দেখছি কাঁচা রান্নাঘর সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত আর্দ্র অঞ্চল থেকে থানকুনি পাতা তুলে আনতে। পেটের রোগে ভুগলে থানকুনি পাতা পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো, হয়তো এখনও হয়। পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হলেও থানকুনি পাতা বাটা খুবই সুস্বাদু একটি খাদ্য। আবার গ্রামাঞ্চলে মানুষ ক্ষেত, খামার, পুকুর ঘাট, খালবিলের আশপাশ থেকে শাকপাতা তুলে আনতো, আমিও এক আধবার মামাবাড়িতে গেলে দিদির সাথে কালীপুজোর  আগের দিন চোদ্দ শাক তুলতে গিয়েছি। 'কিচেন গার্ডেন' কথাটির বিশেষ ব্যবহার তখন হতো না। আসলে কোনো কিছুর অনুপস্থিতি তার গুরুত্ব বোঝায়। তখনও নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা আজকের অবস্থায় পৌঁছয়নি। সকলেরই বাড়িতে একটু আধটু জায়গা, উঠোন ছিল, মানুষ তাতে বিভিন্ন ধরণের সব্জি লাগাতেন, বেশিরভাগ সময়ে তা এমনিই ফেলে দেওয়া সব্জি বা ফলের বীজ থেকে জন্মাতো, পরিচর্যা বিশেষ লাগতও না। ঘরের চালে কুমড়ো, চালকুমড়ো, লাউ, কিংবা উঠোনে লঙ্কা, লেবু, এমনকি বাড়ির পিছনে কচু, বিভিন্ন ফলের গাছ যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল, বেল, নারিকেল ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যেত। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতেও নানান ফলের গাছ ছিল। যেহেতু, এই সকল সুবিধে সহজেই প্রাপ্ত হতো, এর গুরুত্ব তখন অতটা উপলদ্ধি হয়নি। এখন শহরাঞ্চলে এক চিলতে মাটি সহজে পাওয়া যায় না, শহর কেন্দ্রিক সভ্যতায় আজ বড়ো বড়ো গগনচুম্বি অট্টালিকাগুলি আজ মুখ্য ভূমিকায়, মাটি কংক্রিটাবৃত। বাড়ির উঠোন, বাগান আজ অমিল আর তাই 'কিচেন গার্ডেন'-র গুরুত্ব এখন উপলব্ধি হচ্ছে। বাড়ির সংলগ্ন এই বাগানগুলি হারিয়ে যাওয়ার রেশ কিন্তু মানুষের পুষ্টির উপর এসে পড়ছে। যেমন বাড়ির চালে হয়ে থাকা কুমড়ো ভিটামিন A প্রদান করে, বেড়ার গায়ে যে লাউটা হয়ে থাকে তাতে প্রচুর পরিমানে ফোলেট বা ফলিক অ্যাসিড (Folate/ ভিটামিন B9) থাকে, আবার ওল বা কচুতে রয়েছে অনেক ক্যালসিয়াম (Calcium), এগুলো কিন্তু এমনিতেই পাওয়া যেত। পুকুর ধারে হয়ে থাকা নানান শাকগুলোতে মিনারেল আর ভিটামিনের প্রাচুর্য্য উল্লেখযোগ্য (অনুগ্রহ করে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক পড়ুন)।

চাল, গম, মূলত শর্করা জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে; ডাল, মাছ, মাংস প্রোটিন সরবারহ করে; তৈলবীজগুলি তেল বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে। এই হলো তিন প্রকার বৃহৎ জাতীয় পুষ্টি উপাদান যা ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Macro-nutrient) নামে পরিচিত। অপরপক্ষে, শাক-সব্জি, ফল হলো মিনারেল এবং ভিটামিনের অন্যতম প্রধান উৎস, এরা মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Micro-nutrient) নামে পরিচিত। এই সকল অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলি পুষ্টি নিশ্চয়তার জন্যে একান্ত প্রয়োজন, যা অনেক সহজেই গৃহ সংলগ্ন বাগান থেকে পাওয়া যেত এবং এগুলি বাজার থেকে ব্যয় করে ক্রয় করার প্রয়োজন হতো না। কাজেই ব্যবহারিক জীবনে বিনামূল্যে পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ খাবার পাতে এসে পৌঁছতো।    

সাধারণভাবে, সভ্যতায় নগরকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পেলে অধিক মানুষ গ্রাম থেকে নগরে বসবাস শুরু করে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ চিত্র বর্তমান। কৃষক, পশুপালক, কামার, কুমোর, ছুঁতোর সকলে যারা গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদন্ড ছিল, তারা ক্রমে 'ভালোভাবে' বাঁচার আশায় কর্মসংস্থানের সন্ধানে শহরে আসতে শুরু করেন, গ্রামের অপেক্ষাকৃত খোলামেলা বাগান, উঠোন সহ ঘরের পরিবর্তে শহরের ছোট ছোট গায়ে গায়ে লাগানো ঘর। সকল কিছুই সেখানে বাজার থেকে পয়সা খরচ করে আহরণ করতে হয়। এদিকে শহরও আয়তনে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তার আশেপাশের ভূমির তথা বাস্তুতন্ত্রের চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বনাঞ্চল পরিষ্কার করে নগর আয়তনে বৃদ্ধি পায়। বনের শুকনো কাঠ জ্বালানির জন্যে, বনের ঘাস পশুখাদ্যের জন্যে, পাতা সারের জন্যে, বাঁশ, গোলপাতা ঘর বানানোর জন্যে, বনের ফল-মূল-মধু খাওয়ার জন্যে - এসকলের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করে একটা পরিবর্ত পরিস্থিতিতে উপনীত হয়, অনিবার্যভাবে এঁদেরও আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে নগর। এতদিন যখন সকলেই কিছুটা কিছুটা খাদ্য নিজ নিজ পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করতো আজ সকলেই সম্পূর্ণটার জন্য বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে। অনিবার্যভাবেই পূর্বের সাধারণ চাষী বর্তমানে পরিণত হয়েছেন বাজার-চালিত কৃষকে, সেই সকল উৎপাদনে মানব সভ্যতা মনোনিবেশ করেছে যা অধিক মুনাফা দেয়, মাত্র কয়েকটি খাদ্যের উপর আজ জোর দেওয়া হচ্ছে, ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে খাদ্য বৈচিত্র।     

আজকে যখন আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে খাদ্যের বৈচিত্র পুষ্টি নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে অপরিহার্য, ততদিনে অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। একসময় যা সহজলভ্য ছিল, উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে যা হেলায় হারিয়েছি তা আজ প্রকৃতই দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এই বিষয়ে বর্তমানে অনেকগুলি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্কুল কিচেন গার্ডেন। প্রধানত এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য স্কুল কিচেন গার্ডেন স্থাপন করার মাধ্যমে, ছাত্র-ছাত্রীদের এর ফলে উৎপন্ন সব্জি ফল ইত্যাদি খাওয়ার ফলে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাব পূরণ হবে, তাঁদের শাক-সব্জি ফলানোর অভিজ্ঞতা লাভ হবে, এবং শাক-সব্জি ইত্যাদির পুষ্টি বিষয়ে তাঁরা জ্ঞানলাভ করবেন এবং জাঙ্ক-ফুডের (Junk food)  ক্ষতিকারক দিকগুলি সম্বন্ধে সচেতন হবেন। কিচেন গার্ডেনের প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজ্য ভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।বাড়িতে কিচেন গার্ডেন করলে তা যেমন খাদ্যের বৈচিত্র বাড়াবে, পুষ্টির অনিশ্চয়তা দূর করার হাতিয়ার হবে, তেমনি এটা অতিরিক্ত আয়ের একটা পথও হয়ে উঠতে পারে।

পুষ্টি সুরক্ষা ও আমাদের সমাজের কিছু চিত্র (Nutrition Security and Society)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আমি পূর্বে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-১: সূচনা ব্লগটিতে বর্তমান ভারতবর্ষে পুষ্টি বিষয়ক চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমান ব্লগে ব্যবহারিক জীবনে খাদ্য বা পুষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা অংশ তুলে ধরার একটা প্রয়াস করবো। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন চিত্র। তা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাহিনী নয়। চরিত্র নামকরণ অপ্রয়োজনীয় কারণ এটি কোনো গল্প বা উপন্যাস নয়, বাস্তবের উপর ভিত্তি করে কিছু কাল্পনিক কাহিনী/ ভাবনা/ সংলাপ, যা থেকে সহজে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য এবং পুষ্টির স্থান অনুমান করা যাবে। আসলে খাদ্য এবং পুষ্টির সুরক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির পাশাপাশি আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কিছু সচেতনতা ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পুষ্টির সুরক্ষাকে দ্রুততর করে।  সেই রকম কয়েকটি দিক তুলে ধরতেই আমি এই কাল্পনিক সমাজচিত্রটির অবতারণা করলাম এই ব্লগে।

-------------------------------------------------------

'আগে বললেই পারতে, কিছুটা তুলে রাখতে বলতাম, অতটা খাবার নষ্ট হতো না'

অশীতিপর বৃদ্ধ বক্তার উদ্দেশ্যে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকায় বছর ত্রিশের অতিথি যুবক। গৃহের অন্য সদস্যরা হা হা করে ওঠেন, 'আরে না না, কি হয়েছে! আগে থেকে কি ঠিক বোঝা যায়, তুমি কিছু মনে করো না বাবা, ওনার তো বয়স হয়েছেইত্যাদি।

যুবক মনে মনে ভাবলেন, বৃদ্ধ বড়ই খিট্খিটে, কারোর বাড়িতে এলে এরকম কথা কেউ অতিথির উদ্দেশ্যে বলে নাকি! যাইহোক, আমতা আমতা করে প্লেটটি সরিয়ে রাখলেন। আবার গল্প গুজব চলতে থাকে। নানান কথা, ছুঁয়ে যায় একটার পর একটা বিষয়, চলচ্চিত্র-রাজনীতি-খেলা-সমাজ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি কি নেই সেখানে। একের মুখ থেকে কেড়ে আরেক মুখ কথা বলে ওঠে, সেখানে তথ্য-তত্ত্ব কিছুমাত্রায় ঠাঁই পায় বটে, তবে কল্পনা, ধারণা, নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার এক রমরমা আজকাল বড়ই চলছে। অতিথি নির্দিষ্ট সময় পার করে চলে যান, সবাই খুব ব্যস্ত আজকাল, তারমধ্যে সময় বের করে সকলের খোঁজ নিতে এসেছে সে, সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় অতিথির। এর মধ্যে কেউ একজন অর্ধেক খাবার পূর্ণ প্লেটটি টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।  রান্না ঘরের পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় গোটা দুয়েক তরকারি লেগে যাওয়া লুচিঅবশিষ্ট তরকারি আর দেড়খানা রসগোল্লা। বৃদ্ধ তাঁকিয়ে দেখেন। এমন ভাববেন না বৃদ্ধ গরীব, সে আর তাঁর পরিবার উচ্চ মধ্যবিত্ত। একটু বাদে আহ্নিক সেরে বৃদ্ধ তাঁর ঘরের ইজি চেয়ারটায় এসে বসবেন, চিনি ছাড়া চা আর দু'টো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট আসবে তাঁর জন্যে। দিনে দু'বার চা খান বৃদ্ধ, সকালে গ্রিন টি আর সন্ধ্যায় এমনি প্রচলিত চা, যাকে ব্ল্যাক টি বলে। তবে এই যে স্বাচ্ছন্দ্য, বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যায়ে পৌঁছনো সেই দীর্ঘ পথ কিন্তু মসৃন নয়, সেখানে অগণিত না খাওয়া রাত রয়েছে, আক্ষরিক অর্থে দু'মুঠো ভাত খেয়ে দিনাতিপাত রয়েছে, মুখ ফুটে খাবার চেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে বসে থাকার মুহূর্তগুলো রয়েছে, খাবারের আশায় ক্রোশের পর ক্রোশ পথ চলা আছে, আবার এর মাঝে কখনও জুটে যাওয়া কিছু ভালো খাবার আর তা নিয়ে উল্লাস রয়েছে। বৃদ্ধ ভাবেন, সেই সময়কার কথা, তাঁদের জীবনধারণের কথা, সে অনেকটা সংগ্রামের মতন শোনায়, বৃদ্ধ অনেক গল্প বলেন তাঁর নাতি নাতিনীদের, সবই আবর্তিত হয় নিজের জীবনের  কথা, তাঁর শৈশব, বড়ো হওয়া, কর্ম জীবন, ইত্যাদি। সবাই যে বোঝে তা নয় আবার বোঝে যে না তাও নয়। তবে কারা ভালো বোঝে, সে বোঝা দায় ! 

এই যে মেয়েটি প্রত্যেকদিন ঘরের কাজ করতে আসেন ওঁর মেয়েকে স্কুলে দিয়েছে, দাদার সাথে সেও যায়, রোজ স্কুলে খেতে দেয়, ও বলছিলো একবেলার জন্যে ও নিশ্চিন্ত। আবার পুজোর ফুল বাজারে যার কাছ থেকে নেওয়া হয়, ও বলছিলো ছেলেটাকে স্কুল পাঠিয়ে পড়াশুনা আর দুপুরের খাওয়াটা দু'টি বিষয়েই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। এঁরা হয়তো বোঝেন।

এই চিত্র আবার বৃদ্ধের প্রতিবেশী বাড়িটির ক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা। ওঁদের থেকে বৃদ্ধ কথায় কথায় শুনেছে ওঁদের বাড়ির ছেলেটা রোজ স্কুলের মিড ডে মিলের খাবারটা খায়না, মাঝে মাঝে খায়, ডিম দিলে সেটা নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। ওঁরা কেক, চিপস এসব দিয়ে দেন টিফিনে।

বাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার করতে এসেছে একটা লোক, দুপুরে বৃদ্ধের বাড়িতে খেতে দেওয়া হয়েছিল, সাধারণত এসকল লোককে নিরামিষই দেওয়া হয় কিন্তু সেদিন বাড়িতে মুরগির মাংস একটু বেশি পরিমানেই রান্না হয়েছিল, দু'টুকরো লোকটাকে দেওয়ায় তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, তা বৃদ্ধ লক্ষ্য করেছিলেনখাবারের অভাব এও হয়তো বোঝে।

'তোমার ঘরে কে কে আছে?'

'বৌ, এক ছেলে আর এক মেয়ে বাবু'

'ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়াশুনো করাচ্ছ তো?'

'আজ্ঞে!' একটু আমতা আমতা করে বলে 'আসলে গত দু'বছরে তেমন কিছু রোজগারপাতি ছেলো না, তাই মেয়েটা মায়ের সাথে কাজের বাড়ি যায়।

বৃদ্ধ বলে ওঠেন, 'বলো কি ! স্কুল ছাড়িয়ে দিলে?'

'না বাবু, আবার যাবেখন, মানে স্কুল ও তো বন্ধ ছেলো, তাই ......, তা যাবেখন আবার, গেলি তো খাওন টাও পায়।'

বৃদ্ধ বোঝে, কিন্তু কি বলতে হবে সেটা বোঝেন না !    

বাড়িতে হৈ হৈ পরে যায়। বৃদ্ধের বড়ো নাতি এসেছে, কর্মসূত্রে সে প্রবাসীকাজেই সকলে ঠিক করলো বাইরে খাবে। তবে এখন বাইরে বেড়ানোটা বেশ অসুবিধাজনক, প্যানডেমিকের কারণে একটা উদ্বেগ থেকেই যায়। অবশেষে ঠিক হলো খাবার আনিয়ে নেওয়া হবে যার যা ভালো লাগে, সবাই নিজের নিজের মতন অর্ডার দিলো, বিরাট আয়োজন। কেউ ফ্রাইড রাইস, কেউ বাসন্তী পোলাও, কেউ সাদা ভাত, আবার কেউ বিরিয়ানি। কেউ মাটন কষা, কেউ রেজালা, কেউ চিকেন বাটার মশালা, আবার কেউ পনির মশালা। আরও কত কি! কেউ কিন্তু নিজের সমস্ত খাবার এবেলায় শেষ করতে পারলো না। বৃদ্ধকে সকলে কথা দিলো, রাতে অবশিষ্টাংশ খেয়ে নেবে তবে তা আর হয়নি, অবেলায় এতো কিছু খেয়ে রাতে কেউ খাবার মুখেই তুলতে পারলো না। আগেরবার, মানে দু'বছর আগে কিন্তু এমনটা হয়নি, সেবার সবাই মিলেমিশে অর্ডার দিয়েছিলো, মানে এক প্লেট পোলাও দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, আবার এক প্লেট মাটন দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, এতে পুরোটাই খেতে পেরেছিলো, নষ্ট হয়নি         

বৃদ্ধ কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন। সেখানে একাধিকবার সে বিভিন্ন পার্টিতে যোগ দিয়েছে, ওখানে অনেকটা খাবারের এমন রীতি, অনেক খাবারের আয়োজন হয়। রেঁস্তোরা থেকে যখন বেরোয় কত খাবার পাতেই পড়ে থাকে।  বৃদ্ধের, তখন সে যুবক, মুখ থেকে কতবার আক্ষেপ সূচক বাক্য নিঃসৃত হয়েছেএকবার সাহেব বন্ধু বলেছিলেন, 'আরে এই খাবার বাঁচলে কি পৃথিবীর খাদ্য সংকট মিটে যাবে নাকি?' যুবক কিছু বলেননি, শুধু তাঁকিয়ে থেকেছেন আর ভেবেছেন কয়েক বৎসর পূর্বের তাঁর জীবনের কথা। এখানে এতো খাবার নষ্ট হয় আর এমন মানুষও আমাদের সমাজে ছিলেন যারা ফসল তোলার পর মিনতি করতে আসতেন, বাবু যদি তাঁদের আজ্ঞা দেন তবে তাঁরা মাঠে পরে থাকা শস্য সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে পারেন। প্রবাস জীবনে বাজার করতে গিয়েও তিনি অভিজ্ঞতা করেছেন সেদেশে সকল বস্তুই নির্দিষ্ট ওজন করা প্যাকেটে বন্দী, ঠিক যতটা লাগবে ততটা কেউ ওজন করে নিতে পারবেন না (আমাদের দেশের বাজারের মতন), কাজেই অধিকাংশ সময়ে অতিরিক্ত পরিমান বস্তু বাজার থেকে নিয়ে আসতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে তা পচে নষ্ট হয়।  

কি রে ওটা কি রাখলি? এক খানা ডিম নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’ কাজের মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন গৃহকত্রী।

‘আর বোলো না গো মা, ছেলেটা মোটে নিরিমিষ মুখে তুলতে চায় না, তাই আর কি করি, এই এক খান ডিম নিয়ে যাচ্ছি, ভেজে দেবোখন, ভাত দু'টি খাবে।’ উত্তর দেয় মেয়েটি।

তা এক খানা নিলি যে বড় ! বোনটার জন্যে নিলি না ?’

না গো, ও বড় লক্ষ্মী, ও খেয়ে নেয় যা জোটে।’ 

আচ্ছা, বুঝেছি, বলে এক খানা ডিম ফ্রিজ থেকে এনে দেন মেয়েটির হাতে, বলেন দুই ভাইবোনকেই ভেজে দিস।

বৃদ্ধ দেখছিলেন। ভাবছিলেন কয়েক দশক আগের কথা, যখন রাত্রের আহারে তিনি একা মাছের টুকরো খেতেন, বিধবা মা আর স্ত্রী খেতেন ভাত-ডাল আর যেদিন যা তরকারী থাকতো তাই। বাইরে কাজের জন্যে কোন সকালে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন রাত্রে, তাই টানাটানির সংসারে দু'বেলা যা কিছু উত্তম জুটতো তা তাঁর পাতেই জায়গা পেতো। এই নিয়ে অবশ্য মা বা স্ত্রীর কোনো আফসোস ছিল না। তাঁরা তো বাড়িতেই থাকতেন, সমস্ত ঘর পরিষ্কার, রান্না করা, কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া, ইত্যাদি কত শত কাজ, তবে সবটাই বাড়িতে, কাজেই তাঁরা 'অধিক' পরিশ্রম করে যিনি সংসার টানছেন বলে মনে করতেন তাঁকেই ভালোটা পরিবেশনের জন্যে সচেষ্ট থাকতেন।  

তবে প্রথমবার যখন তাঁর স্ত্রী মা হয়েছিলেন, তখন মা এবং সন্তান বেশ ভুগেছিলেন। মেয়ে সন্তানের ওজন হয়েছিল অনেক কম, জ্বর, ডায়রিয়া ইত্যাদির সাথে লড়তে লড়তে বাচ্চাটা প্রায় বিছানায় মিশেই গিয়েছিলো। ডাক্তার অনেক বাকাবকি করেছিলেন। এই সকল ভোগান্তি অপুষ্টিজনিত বলেছিলেন, বৃদ্ধ (তখন যুবক) বুঝেছিলেন কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস ততদিনে পদোন্নতি হয়েছিল তাইতো অনেক ডাক্তার হসপিটাল করে কোনো মতে মা মেয়েকে সুস্থ্য করে ঘরে এনেছিলেন। সে প্রায় বছর পঞ্চাশের আগের কথা, এখন তো খুকীর ছেলেই কত বড় হয়ে গেছে ! তারপর তো মা চলে গেলেন। অফিস থেকে তাঁকে পশ্চিমে পাঠালো। জীবনে এক ধাক্কায় অনেকটা পরিবর্তন এলো। খুকী খুবই ঘ্যান ঘ্যান করতো ছোটবেলায়, সে ওই দেশে কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া শুরু করলো, দিদিমণিদের পরামর্শে খুকীকে কাউন্সেলিং করানো হলো, ধীরে ধীরে বেশ চনমনে হয়ে উঠলো  সে। তারপর তাঁদের একটি ছেলে হলো, ডাক্তার স্ত্রীর মেডিকেল হিস্ট্রিতে সিজার দেখে একটু চিন্তিত হলেন।  যাইহোক এবার পূর্বের ন্যায় পরিস্থিতি হলো না, তবে সেবারও স্ত্রী সিজারের মাধ্যমেই পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।

এসকল ভাবছিলেন বৃদ্ধ, তখন নাতি ঘরে প্রবেশ করলেন। বৃদ্ধ তাকালেন, দৃষ্টিটা একটু পরিষ্কার হলে প্রশ্ন করলেন, 'হ্যাঁ রে তুই যে দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছিস' ! নাতি হেসে উত্তর দিলো 'সেডেন্টারি লাইফ গো দাদু, সারাদিন বসে বসে কাজ, জগৎ সংসার এগিয়ে চলছে আর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে উৎপন্ন করছে এই অপুষ্টিগত পরিনাম' বলে থামে সে।

তা কতদিন ছুটি পেলি?

আর ছুটি..’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে পেয়েছি দু'দিনের, তার সাথে রবিবার 

বাব্বা, কাজের তো বড্ড চাপ ! তা খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকে করিস তো?

হ্যাঁ সেটা করি, বেশিরভাগ দিন দুপুরে অফিসেই বিরিয়ানি না হয় সিজওয়ান ফ্রাইড রাইসের একটা প্লেট আনিয়ে নিই, বাড়িতে রাতে হালকা কিছু ধরো রুটি আর মাংস বা পনিরের কিছু একটা আর টক দই। খাওয়া নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা নেই

নাতি আরো বলে ও যেখানে বাসা ভাড়া নিয়েছে, তার সামনে বেশ কতগুলো দোকান রয়েছে, পিজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, মোমো, পাস্তা সব কিছুই সেখানে সহজলভ্য। নাতির মধ্যে কি যেন খোঁজে বৃদ্ধ, হয়তো নিজের তরুণ অবস্থাকে, নাতিকে দেখতে পুরো তাঁরই মতন। এই বয়সে তাঁর নিজের কি অবস্থা ছিল, কিভাবে যে বেঁচেছিল অসহায় মাকে নিয়ে সেটাই সে বুঝতে পারে না। দিনের পর দিন ভাত, এখান-ওখান তুলে আনা কলমি শাক ভাজা খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া, এই ছিল তাঁদের দিনাতিপাত। ডাল-ভাত-তরকারি-মাছ সহযোগে পরিপূর্ণ আহার তাঁদের কাছে তখন ছিল চাঁদ হাতে পাওয়ার মতন, তা সম্ভব হতো যদি কেউ নিমন্ত্রণ করতেন তবে মা'র মুখে কোনোদিন তেমন সুখাদ্য তুলে দিতে পারেননি বৃদ্ধ। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে নাতির ডাকে, দাঁড়াও আমি আসছি বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক বাদে, হাতে তখন আলুর চিপস আর এক গ্লাস কোল্ড ড্রিঙ্কস। নাতিকে খেতে বারণ করে বৃদ্ধ, পরক্ষণে কি মনে হয় আবার বলে আসলে একটু এসব কম খাস মনে মনে হিসেব করে, পয়সা যখন ছিল না আর যখন হলো আসলে ঠিক কতটা পার্থক্য হলো ?  

কাজের মেয়েটি আবার আসে পড়ন্ত বিকেল বেলায়। ও রেশন নিয়ে কার্ড ফেরত দিতে এসেছে। গৃহকত্রী রান্না ঘর থেকে বলেন দাদুর কাছে রেখে যেতে। বৃদ্ধ হাসিমুখে কার্ডগুলো রেখে দেয়। 'দাদু কি হয়েছে? হাসছ যে'! 'না রে, আসলে ভাবছি কত মানুষের মুখে অন্ন উঠছে, একি আর মুখের কথা রে দিদিভাই' 

দাদু ওঁকে বলেন নাতিকে ডেকে দিতে। মেয়েটি নাতিকে ডেকে দিয়ে চলে যায়। দাদু বলে তোর ল্যাপটপ টা আন তো, দু'জনে মিলে একটা সিনেমা দেখি, আজ দেখবো মৃনাল সেন পরিচালিত 'আকালের সন্ধানে' আর কাল দেখবো সত্যজিৎ রায় পরিচালিতগুপী গাইন বাঘা বাইন'

এই দু'টো বাছলে কেন?

আচ্ছা.....তবে তুই বল। না থাক, আছে তো আরও তবে আগে এই দুটোই দেখি

পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-১: সূচনা (Nutrition Security and Food - Part-1: Introduction)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

বর্তমান ভারতবর্ষের তথা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো অপুষ্টি। ভারতবর্ষের দিকে দৃকপাত করলে, ক্ষুধা এবং পুষ্টি সংক্রান্ত সমসাময়িক কালে যে সকল প্রতিবেদন উঠে আসছে তার কোনোটিই যে অতি আশাপ্রদ নয় এ কথা বলাই বাহুল্য। স্বাধীন ভারতবর্ষে দেশবাসীর খাদ্য সুরক্ষা হেতু একাধিক প্রকল্পের প্রবর্তন হয়েছে। ক্রমে বোঝা গেছে খাদ্যের পরিমান থেকেও পুষ্টির বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, আশা করা যায় হয়তো আরও প্রকল্প প্রবর্তন করা হবে। তবে এ কথা সঠিক নয় যে এই প্রকল্পগুলির ফলাফল আমরা পাইনি, অবশ্যই এগুলির মাধ্যমে কাজ হয়েছে তবে তা পর্যাপ্ত নয়, যদি হতো তবে আজ সমীক্ষাগুলিতে এই রকম হৃদয় বিদারক চিত্র উঠে আসত না। ২০২১ গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (Global Hunger Index) স্কোর গণনা করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য বা ডেটা (Data) সহ ১১৬ টি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষ ১০১ তম স্থানে অবস্থান করছে ৷ গত একুশ বছরে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স স্কোর ৩৮.৮ (২০০০ সালে) থেকে ২৭.৫ (২০২১ সালে) এসেছে, এটি অবশ্যই উন্নতির লক্ষণ তবে তার গতি অতি মন্থর, আশাপ্রদ নয়। পাঁচ বছরের নীচে শিশু মৃত্যুর হার এবং পাঁচ বছরের নীচে স্টান্টিং (Stunting) শিশুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে তবে ওয়েস্টিং (Wasting) শিশু এবং অপুষ্টি জনিত জনসংখ্যার ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্রটি প্রতিভাত হচ্ছে। আবার ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভের (National Family Health Survey) মাধ্যমে যে চিত্র উঠে এসেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে শিশু এবং মহিলা দু'ক্ষেত্রেই এনিমিয়া (Anaemia), স্থূলতা (Obesity) পূর্বের (NFHS-4) তুলনায় বর্তমানে (NFHS-5) বৃদ্ধি পেয়েছে (Table 1, Figure 1) । 


Table 1: ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে অনুযায়ী নির্বাচিত কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের (%) তুলনামূলক চিত্র (Data obtained from National Family Health Survey,  http://rchiips.org/nfhs/)

Parameters

NFHS-3*

2005-2006

NFHS-4

2015-2016

NFHS-5

2019-2021

U

R

T

U

R

T

U

R

T

Children <5 years are stunted

37.4

47.2

44.9

31.0

41.2

38.4

30.1

37.3

35.5

Children <5 years are wasted

19.0

24.1

22.9

20.0

21.5

21.0

18.5

19.5

19.3

Children <5 years are underweight

30.1

43.7

40.4

29.1

38.3

35.8

27.3

33.8

32.1

Children within 6-59 months years are anemic

72.2

80.9

78.9

56.0

59.5

58.6

64.2

68.3

67.1

Women (15-49 years) anemic

51.5

58.2

56.2

51.0

54.4

53.2

54.1

58.7

57.2

Pregnant (15-49 years) anemic

54.6

59.0

57.9

45.8

52.2

50.4

45.7

54.3

52.2

Men (15-49 years) anemic

17.2

27.7

24.3

18.5

25.3

22.7

20.4

27.4

25.0

Women having BMI below normal

19.8

38.8

33.0

15.5

26.7

22.9

13.2

21.2

18.7

Men having BMI below normal

17.5

33.1

28.1

15.4

23.0

20.2

13.0

17.8

16.2

Women obese

28.9

8.6

14.8

31.3

15.0

20.6

33.2

19.7

24.0

Men obese

22.2

7.3

12.1

26.6

14.3

18.9

29.8

19.3

22.9

Women having blood sugar- high

Not Applicable

6.9

5.2

5.8

6.7

5.9

6.1

Women having blood sugar- very high

3.6

2.3

2.8

8.0

5.5

6.3

Men having blood sugar- high

8.8

7.4

8.0

7.8

7.0

7.3

Men having blood sugar- very high

4.4

3.5

3.9

8.5

6.5

7.2

U= Urban; R= Rural; T= Total

*‘3 years’ was considered instead of ‘5 years’ for children. (Data obtained from National Family Health Survey, Govt. of India)



Figure 1: ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে অনুযায়ী নির্বাচিত কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের (%) তুলনামূলক চিত্র. (1) Children <5 years are stunted, (2) Children <5 years are wasted, (3) Children <5 years are underweight, (4) Children within 6-59 months years are anemic, (5) Women (15-49 years) anemic, (6) Pregnant (15-49 years) anemic, (7) Men (15-49 years) anemic, (8) Women having BMI below normal, (9) Men having BMI below normal, (10) Women obese, (11) Men obese, (12) Women having blood sugar- high, (13) Women having blood sugar- very high, (14) Men having blood sugar- high, (15) Men having blood sugar- very high. (Graph has been created from the data obtained from National Family Health Survey, http://rchiips.org/nfhs/)

একথাও অনস্বীকার্য যে জন সচেতনতারও একটা গুরুত্ব রয়েছে, অতএব খাদ্যের গুণাগুণ সম্বন্ধে, পুষ্টির গুরুত্ব বিষয়ে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। অধিক প্রচলিত খাদ্য সামগ্রীর পাশাপাশি তুলনামূলকভাবে উপেক্ষিত খাদ্য সংস্থানগুলির দিকেও মনোনিবেশ করা আবশ্যক। একটু খোলসা করে বলার প্রয়োজন। ভারতবর্ষের কোনো কোনো জনজাতির খাদ্যের মধ্যে মিলেটের প্রাধান্য দেখা যায়, কোনো জনজাতির মধ্যে কীট-খাদ্যের (Edible insects) প্রচলন রয়েছে (Chakravorty et al., 2013), আবার কোথাও শামুক-গুঁড়ি-গুগলিকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় (Baghele et al., 2021), ইত্যাদি। এরকম উদাহরণ অনেক রয়েছে। এই উপেক্ষিত খাদ্য সংস্থানগুলির পুষ্টিগুণ, পুষ্টির সুরক্ষায় তার সম্ভাব্য ভূমিকা, এবং অবশ্যই প্রকৃতির ধারণক্ষমতা (Sustainability) নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন তবে এই বিষয়ে বিশদে আলোচনার পূর্বে খাদ্য এবং খাদ্য নির্ধারণের উপায়ের উপর একটা দৃষ্টিপাত প্রয়োজন এবং তারপরে আগামী কয়েকটি পর্বে এই প্রকার কম পরিচিত স্বল্প ব্যবহৃত খাদ্যবস্তুগুলি (Lesser-known অথবা underutilized foods) নিয়ে আলোচনা করবো। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে খাদ্য তথা পুষ্টি সুরক্ষা আজ এক বিশ্বব্যাপী সমস্যা, তবে এটাও সঠিক যে সমস্যাটির স্থানীয় ভাবে সমাধানের পথ খোঁজাটাও উল্লেখযোগ্য।

খাদ্য এবং খাদ্য নির্ধারণের উপায়

জীব যে বাস্তুতন্ত্রে বসবাস করে সেখান থেকেই তার জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপাদান, যার মধ্যে খাদ্য অন্যতম, খুঁজে নেয়।  মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। সামুদ্রিক উপকূলের মানুষজন সামুদ্রিক খাদ্যের উপর ভরসা করে, যে অঞ্চলে জলা জমির আধিক্য সেখানে মানুষ মাছ ইত্যাদি খেয়ে থাকেন, আবার জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলে যেসব জনজাতি বসবাস করেন তারা নানা ধরণের জংলী ফল মূল বা প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকেন। সাধারণভাবে বুঝতে গেলে সে সকল বস্তু আহরণে কম সময় আর শক্তি লাগে (বস্তু থেকে প্রাপ্ত শক্তি বস্তু সংগ্রহের শক্তির থেকে বেশি হওয়া প্রয়োজন) এবং যা খেলে শারীরিকভাবে ভালো থাকা যায় তাকেই খাদ্য বলে গ্রহণ করে থাকে। মানুষের ক্ষেত্রে সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই আরো অনেকগুলি স্থিতিমাপক রয়েছে যা যথাসময়ে আলোচনা করবো।

আবার খাদ্যাভ্যাসের ফল হিসেবে বিভিন্ন জনজাতির জিনগত কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়, যেমন ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশের জনজাতি যারা পশুপালন করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের মধ্যে দুগ্ধের প্রোটিন বিপাকক্রিয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় উৎসেচকের জিন ক্রিয়াশীল (Ranciaro et al., 2014; Anguita-Ruiz et al., 2020), কিংবা এস্কিমো বা ইনুইটদের (Inuit) সামুদ্রিক মাছের মাধ্যমে ভিটামিন D-র প্রয়োজনীয়তা মিটে যাওয়ায় নাতিশীতোষ্ণ (Temperate) অঞ্চলের অন্যান্য অধিবাসীদের মতন স্বল্পমাত্রায় মেলানিন সংশ্লেষের প্রয়োজন হয়না (Jablonski and Chaplin, 2000; Hanel and Carlberg, 2020), আবার যে সকল জনজাতি শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে তাদের ডিটোক্সিফিকেশনের (Detoxification) ক্ষমতা সাধারণত অধিক হয়ে থাকে (Tawe et al., 2018) সহজেই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বোঝা যায় জনজাতির জিন বিভিন্ন পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য এটি একদিনে গড়ে ওঠেনি, দীর্ঘসময়ের মাধ্যমে তা বিবর্তিত হয়েছে।

বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফল হিসেবে অনেক নেতিবাচক পরিণাম উঠে এসেছে যা থেকে ধারণা করা যায় যে পুরোনো খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা শুধুমাত্র ঐতিহ্য ধরে রাখার আকুলতা নয় বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা অত্যাবশ্যক। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি হয়তো বোঝাতে সমর্থ হবো।  যেমন আমেরিকার আরিজোনা (Arizona) অঞ্চল যেখানে কিছু ইন্ডিয়ান জনজাতির বাস। রুক্ষ অঞ্চল, জলের অভাব কাজেই অধিবাসীরা সাধারণত ক্যাকটাস জাতীয় গাছের ফল, কিছু বিন (legume) জাতীয় খাদ্য খেয়ে জীবন ধারণ করতো। পরবর্তীকালে ওই অঞ্চলে একটি খাল নির্মাণ করা হয় এবং জলের সমস্যার সমাধান হয়। এটা অনস্বীকার্য যে খাল নির্মাণ, জলের প্রাচুর্য এবং এরফলে গম চাষ, গম আর চিনি  উৎপাদন এসবই উন্নয়নের পরিমাপক ছিল কিন্তু অধিবাসীদের খাদ্যের রূপান্তরটি (কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (Glycemic Index) যুক্ত ক্যাকটাস ফল আর বিন থেকে  অধিক গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত গম আর চিনি দিয়ে প্রস্তুত খাদ্য) অনিবার্যভাবে ঘটে যার পরিণামস্বরূপ আজ মধুমেহ (Diabetes) রোগের প্রাধান্য বেড়েছে ওই জনগোষ্ঠীতে (Brand et al., 1990)। অথচ কয়েক দশক পূর্বে পর্যন্তও এই রোগের কোনো চিহ্ন ওই জনগোষ্ঠীতে লক্ষ্য করা যায়নি। দক্ষিণ ভারতের কোলিহিলসের জনজাতিরা যে মিলেট চাষ করতো তার পুষ্টিগত মাত্রা চাল বা গমের পুষ্টিমাত্রা থেকে অধিক হওয়া সত্ত্বেও মিলেট চাষ প্রতিস্থাপন করা হয় অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্যশস্যের সাথে (Ravi et al., 2010)। এরকম উদাহরণ অনেক বর্তমান এবং এর আপাত কারণও বর্তমান। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে মানব সভ্যতা অনেক খাদ্যশস্যের মধ্যে কয়েকটি মাত্র ফসলের উন্নতিতে যথাসাধ্য প্রচেষ্ট, আর এর মাধ্যমে একটা খাদ্যতালিকাগত রূপান্তর ঘটছে বা ঘটেছে। আলু এবং টমেটোর উৎপত্তি দক্ষিণ আমেরিকায়  (আন্দিজ এবং মেক্সিকোতে) হলেও আজ সমগ্র পৃথিবীতে এগুলি ব্যাপৃত (Nunn and Qian, 2010)। আবার অনেক শাকসবজি আজকে আমাদের খাদ্যতালিকা থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে এবং প্রজাতি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের উপর যত্নশীল না হলে অদূর ভবিষ্যতে আরো বেশ কিছু খাদ্যশস্য তালিকা থেকে মুছে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেন কয়েকটি মাত্র ফসলের উপর মানব সভ্যতা যত্নবান হয়েছে তার ব্যাখ্যা হয়তো রয়েছে, যেমন অধিক ফলনশীলতা, অধিক সহনশীলতা, পরিবেশ মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, সহজ চাষ ইত্যাদি, কিন্তু তারপরেও অন্যান্য খাদ্যশস্যগুলিকে প্রতিস্থাপন কিংবা বিপন্ন করা বিজ্ঞানসম্মত নয়।

মানব সভ্যতায় কৃষিকাজের (পশুপালন সহ) ইতিহাস মাত্র দশ হাজার বছরের এবং বাস্তুতন্ত্র আর পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্যতালিকাও সদা পরিবর্তনশীল। আগেই বলেছি যে প্রাপ্ত এবং ব্যবহৃত শক্তি খাদ্যবস্তু নির্ণয়ের একটি অন্যতম প্রধান পরিমাপক। কাজেই কৃষিকাজ যে প্রাধান্য পাবে সেটা বোঝা যায় কারণ খাদ্য বস্তু আহরণের জন্য যে পরিমান শক্তি প্রয়োজন তা যে অধিক হবে তা বলাই বাহুল্য কারণ সেটি সুনিশ্চিত নয়। দ্বিপ্রাহরিক বা রাত্রিকালীন ভোজনের পূর্বে কোনো জন্তুর (ধরি, হরিণ) পিছনে তাড়া করে তাকে শিকার করে কিংবা কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে ফল মুলাদি সংগ্রহ ক্ষুধা  নিবৃত্তি করা যে খুব সহজ ছিল না তার জন্য কষ্টকল্পনা করতে হয়না। ফলে কোনো সহজসাধ্য খাদ্যের প্রয়োজন ছিল, মানুষ শিখেছিল কিভাবে নিজে ফসল ফলানো যায় তথা খাদ্য উৎপাদন করা যায়। মানুষ সেই  প্রাণীকেই পালন করা শুরু করে যাকে পোষ মানানো সহজ, সেই উদ্ভিদ প্রজাতিকে কৃষির জন্যে প্রথম ব্যবহার করেছিল যেটির প্রাচুর্য সেই অঞ্চলে ছিল এ কথা মানতে কষ্ট হয়না। যেটি সহজে ফলন করা যাবে সেটির দিকেই মানুষ ঝোঁকে কারণ মূল নিম্নাবস্থিত কারণটি কিন্তু একই থাকে 'শক্তির পার্থক্য'। উদরপূর্তি ছিল প্রধান উদ্দেশ্য, পুষ্টিজ্ঞান সভ্যতার ঊষাকালে আশা করা যায়না। এমনকি বর্তমান পৃথিবীতেও খাদ্য সুরক্ষায় অধিক মননিবেশ করা হয়েছে এবং পরে তা পুষ্টি সুরক্ষায় উন্নীত হয়েছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও খাদ্য সুরক্ষায় প্রথমে উৎপাদন বাড়ানোর পক্ষেই পদক্ষেপ করা হয়েছে, সবুজ বিপ্লবের ফলশ্রুতিতেই আজ আমাদের দেশ খাদ্যের জন্যে স্বনির্ভর। তারপর ধীরে ধীরে এসেছে খাদ্যগুণ উন্নীতকরণের গবেষণা যেমন অ্যামিনো অ্যাসিড ফর্টিফায়েড খাদ্যশস্য কিংবা খনিজ এবং ভিটামিন ফর্টিফায়েড খাদ্যশস্য। যাইহোক, মূল বিষয়ে ফেরা যাক। মানব সভ্যতার মাত্র দশ হাজার বছরের কৃষিকাজের সময়কালটি পৃথিবীতে মানুষ আবির্ভাবের (বিবর্তনের মাধ্যমে) তুলনায় নিতান্তই নগণ্য অর্থাৎ হরিণের পশ্চাদ্ধাবন করে ক্ষুধা নিবৃত্তির সময়কালটি অনেক বেশি হওয়ায় মানব শরীর (দেহতত্ব) এবং জিনগত গঠন সেই অনুসারেই হয়েছে। সহজভাবে, খাদ্য থেকে প্রাপ্ত শক্তি আর খাদ্য সংগ্রহের জন্যে ব্যবহৃত শক্তির পার্থক্য অতিরিক্ত হওয়াটাও কাম্য নয় কারণ এর ফলস্বরূপ  স্থূলতা (Obesity), মধুমেহ, অন্যান্য বিপাক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত ব্যাধি জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'ফিস্ট এন্ড ফ্যামিন সাইকেল' (Feast and Famine Cycle) একটি প্রাসঙ্গিক হাইপোথিসিস (Darnton-Hill and Coyne, 1998)। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো পূর্বোল্লেখিত অপর শর্তটির উপর অর্থাৎ যা খেলে খাওয়ার পর শারীরিক ভাবে ভালো থাকা যায় তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। শুধুমাত্র উদর পূর্তি হলেই হবে না বা অতিরিক্ত শক্তিপ্রাপ্ত করলেই খাদ্যের গুণাগুণ বিচার হয় না, সমগ্র খাদ্যের মধ্যে প্রতিটি পুষ্টি উপাদান যেমন অ্যামিনো অ্যাসিড, ফ্যাটি অ্যাসিড, খনিজ এবং ভিটামিন এমন মাত্রায় থাকা উচিত যা তা দৈনিক চাহিদা কে পূরণ করে কারণ এই উপাদানগুলি আমাদের শরীর চালনার কাজ করে থাকে। এদের মধ্যে আবার কাউকে শরীর নিজে সংশ্লেষ করতে পারে, আবার কাউকে করতে পারেনা বা অতি স্বল্প মাত্রায় করে যা প্রয়োজনীয় মাত্রা থেকে কম, দ্বিতীয় প্রকারের উপাদানগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় বলে গণ্য করা হয়। যথা সময়ে বিষয়গুলি সবিস্তারে আলোচনা করা যাবে, আপাতত ফিরে আসি খাদ্য নির্ধারণের তত্ত্বের বিষয়ে। এক্ষত্রে সহজভাবে ধরা যায় প্রথম আর দ্বিতীয় শর্তটি একে অন্যকে পরিপূর্ণ করে। একটি তুলনামূলক আলোচনা বিষয়টিকে বুঝতে সাহায্য করবে।  ধরা যাক দুই ব্যক্তি, একজন প্রস্তর নির্মিত অস্ত্রের সাহায্যে হরিণ শিকার করে তার মাংস দিয়ে নিজের ক্ষুধা নিবৃত্তি করেন আর অপর জন সুপারমার্কেট থেকে একটি খাদ্যবস্তু কিনে ক্ষুধা নিবারণ করেন। বোঝার সুবিধার্থে ধরা যাক দ্বিতীয় ব্যক্তিটি যে পয়সার বিনিময়ে খাদ্য ক্রয় করেন তা আয় করতে তাকে শারীরিক পরিশ্রম প্রথম ব্যক্তির তুলনায় কম করতে হয়। এখন যদি দুজনেই একই পরিমানের খাদ্য খান তবে তা দ্বিতীয় ব্যক্তিটিকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে না কারণ তার ওই পরিমান খাদ্যের ব্যবহার হয়না ফলে কিছু অংশ শরীরে জমা হয় আর আমাদের শরীর এখনো সেই ভাবে অভিযোজিত হয়নি আর এর পরিণামে স্থূলতা বাড়ে এবং সম্পর্কিত রোগগুলি বাড়ার সম্ভাবনা দেখা যায়।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ক্ষেত্রে আরো বেশ কয়েকটি পরিমাপক রয়েছে। বাস্তুতন্ত্রের পাশাপাশি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণগুলোও খাদ্য নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে।  কি রকম তা বর্তমান বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করা যাক। ধরা যাক কোনো জনজাতি কোনো একটি বিশেষ (তা উদ্ভিদ বা প্রাণী যা কিছু জাতীয়ই হতে পারে) খাদ্য গ্রহণ করে, তারা খাদ্যটি তাদের পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে, কিন্তু তা উৎপাদন (কৃষির মাধ্যমে) করে না। এরফলে একসময় সেই  খাদ্যটির অপ্রাচুর্য অনিবার্য হয়ে পরে। জনজাতির মানুষ সংখ্যা তথা খাদ্যবস্তুটির চাহিদা বৃদ্ধি, বনাঞ্চলের আয়তন হ্রাস পাওয়া তথা জীব বা উদ্ভিদটির বাসস্থান সংকোচন, জলবায়ু পরিবর্তন, ইত্যাদি নানান কারণ দায়ী হতে পারে এই অপ্রাচুর্যের পিছনে। অনেক সময়েই এইসবের সম্মিলিত পরিণামস্বরূপ একদা বহুল পরিচিত খাদ্যবস্তুটি যোগান অনিয়মিত হয়ে যায়। আর বিশ্বায়নের যুগে যেভাবে খাদ্যতালিকার বিশ্বায়ন হচ্ছে তার চাপে অনেকসময়ই খাদ্যবস্তুটি হারিয়ে যাওয়ার পথে যায় বা হারিয়েও যায়। আধুনিক প্রযুক্তির সাথে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটানো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠেনা, আর পাঁচটা বিষয়ের মতন এই বিষয়েও উদাসীনতা গ্রাস করে। তবে এর বিপরীত চিত্রও যে অমিল তা নয় (Meyer-Rochow et al., 2019), তবে সেগুলো বেশিরভাগ দেশান্তরের ছবি, প্রসঙ্গান্তরে বিশদে আলোচনা করবো।  

তথ্য সহায়তা (Reference)

Anguita-Ruiz, A.; Aguilera, C.M.; Gil, A. 2020. Genetics of lactose intolerance: An updated review and online interactive world maps of phenotype and genotype frequencies. Nutrients 12(9): 2689. http://www.doi.org/10.3390/nu12092689

Baghele, M.; Mishra, S.; Meyer-Rochow, V.B.; Jung, C.; Ghosh, S. 2021. Utilization of snails as food and therapeutic agents by Baiga tribals of Baihar tehsil of Balaghat district, Madhya Pradesh, India. International Journal of Industrial Entomology 43(2): 78-84. http://dx.doi.org/10.7852/ijie.2021.43.2.78 

Brand, J.C.; Snow, B.J.; Nabhan, G.P.; Truswell, A.S. 1990. Plasma glucose and insulin responses to traditional Pima Indian meals. American Journal of Clinical Nutrition 51(3): 416-420. http://www.doi.org/10.1093/ajcn/51.3.416

Chakravorty, J.; Ghosh, S.; Meyer-Rochw, V.B. 2013. Comparative survey of entomophagy and entomotherapeutic practices in six tribes of eastern Arunachal Pradesh (India). Journal of Ethnobiology and Ethnomedicine 9: 50. https://www.doi.org/10.1186/1746-4269-9-50

Darnton-Hill, I.; Coyne, E. 1998. Feast and Famine: socioeconomic disparities in global nutrition and health. Public Health Nutrition 1(1): 23-31. http://www.doi.org/10.1079/PHN19980005

Global Hunger Index. https://www.globalhungerindex.org/india.html, accessed 24th April 2022.

Hanel, A.; Carlberg, C. 2020. Vitamin D and evolution: Pharmacologic implications. Biochemical Pharmacology 173: 113595. http://www.doi.org/10.1016/j.bcp.2019.07.024

Jablonski, N.G.; Chaplin, G. 2000. The evolution of human skin coloration. Journal of Human Evolution 39(1): 57-106. http://www.doi.org/10.1006/jhev.2000.0403 

Meyer-Rochow, V.B.; Ghosh, S.; Jung, C. 2019. Farming of insects for food and feed in South Korea: tradition and innovation. Berl Münch Tierärztl Wochenschr. http://www.doi.org/10.2376/0005-9366-18056

National Family Health Survey. http://rchiips.org/nfhs/, 30th April 2022.  

Nunn, N.; Qian, N. 2010. The Columbian exchange: A history of disease, food, and ideas. Journal of Economic Perspectives 24(2): 163-188.

Ravi, S. B.; Swain, S.; Sengotuvel, D.; Parida, N.R. 2010. Promoting nutritious millets for enriching income and improved nutrition: A case study from Tamil Nadu and Orissa. In: Mal, B.; Padulosi, S.; Ravi, S.B. (Eds.). Minor Millets in South Asia: Learning from OFAD-NUS Project in India and Nepal. Biodiversity International, Maccarese, Rome, Italy and M.S. Swaminathan Research Foundation, Chennai, India. 185p. pp.19-46.

Ranciaro, A.; Campbell, M.C.; Hirbo, J.B.; Ko, W-Y.; Froment, A.; Anagnostou, P.; Kotze, M.J.; Ibrahim, M.; Nyambo, T.; Omar, S.A.; Tishkoff, S.A.; 2014. Genetic origins of lactase persistence and the spread of pastoralism in Africa. American Journal of Human Genetics 94(4): 496-510. http://www.doi.org/10.1016/j.ajhg.2014.02.009

Tawe, L.; Motshoge, T.; Ramatlho, P.; Mutukwa, N.; Muthoga, C.W.; Dongho, G.B.D.; Martinelli, A.; Peloewetse, E.; Russo, G.; Quaye, I.K.; Paganotti, G.M. 2018. Human cytochrome P450 2B6 genetic variability in Botswana: a case of haplotype diversity and convergent phenotypes. Scientific Reports 8: 4912. http://www.doi.org/10.1038/s41598-018-23350-1

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...