পৃষ্ঠাসমূহ

Travel লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Travel লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh) 

রাজমহল: পর্ব-১ -র পর-

ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের জানলা বাষ্পে পূর্ণ, কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, অবশেষে জানলা খুলে কুচকাওয়াজ দেখছিলাম। তারপর প্রস্তুত হয়ে আমরা আমরা বেরোলাম স্থানীয় বিভিন্ন দ্রষ্টব্যস্থান গুলির উদ্দেশ্যে। গতকাল ছিল ঐতিহাসিক ভ্রমণ, আর আজ আমরা সাক্ষী থাকবো প্রাগৈতিহাসিক কালের কিছু নিদর্শনের। 

আজকে আমাদের প্রধান দ্রষ্টব্য সাহিবগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৫৫-৬০ কিলোমিটার দূরত্বে মান্দ্রতে অবস্থিত জীবাশ্ম উদ্যান [বোলপুর শান্তিনিকেতন ভ্রমণের সময় আমরা আমখই গ্রামে অবস্থিত ওপর একটি জীবাশ্ম উদ্যান দেখেছিলাম।]। সকাল ৯ টা নাগাদ আমরা রওনা হলাম, পথেই প্রাতঃরাশ সারব। কিছুক্ষন গিয়ে শহরের কিছুটা বাইরে পথের ধারে একটি দোকানে দাঁড়ালাম। দোকানি চা, তেলেভাজা, মুড়ি, ছোলাভাজা, আরো হরেক ধরণের খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় করছেন। আমাদের ফরমায়েশ মতন কারও দুধ দেওয়া চিনি ছাড়া চা, কারও দুধ চিনি ছাড়া চা, আবার কারও দুধ চিনি দেওয়া চা বানিয়ে পরিবেশন করলেন। আজকাল শহুরে মানুষরা মধুমেহ (ডায়াবেটিস), হার্টের নানান সমস্যায় জর্জরিত। গ্রামের দোকানিও সম্ভবত তা জানেন, তিনি দেখলাম মনের আনন্দেই খাবার পরিবেশন করলেন, কারও শুধু মুড়ি, কারও মশলা-মুড়ি, কারও বা নানা স্বাদের বিস্কুট ইত্যাদি। চা যে কি সুস্বাদু, তা বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে কাপগুলি অত্যন্ত ছোট ছোট, কাজেই দুই-তিনবার করে সকলে চা নিলেন। আমি আমাদের দেশের মতন অন্য কোথাও এতো ছোট চায়ের কাপ বা খুড়ি দেখিনি (বড়ো পাওয়া যায়, তবে ছোটোগুলির চলই বেশি), কেন যে সেগুলি এতো ছোট হয় তা আমি জানিনা। যাইহোক, প্রাতঃরাশ সারা হলো। এই দোকানটির পাশেই একটা মিষ্টির দোকান ছিল, সেখান থেকে রসগোল্লা কিনে নেওয়া হলো, এবার আমরা আবার রওনা হলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। 

মান্দ্রো ফসিল মিউজিয়ামটি প্রাচীন উদ্ভিদ জীবনের উপর গবেষণা প্রচারের এবং জনসাধারণের সচেতনতাবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে পাওয়া জীবাশ্মগুলি প্রায় ৬৮ থেকে ১৪৫ মিলিয়ন বছর পুরানো জুরাসিক এবং ক্রিটেসিয়াস যুগের। অর্থাৎ যখন পৃথিবীতে ডাইনোসর ঘুরে বেড়াতো এই জীবাশ্মগুলি সেই সময়কার। 

জাদুঘরটি শুধুমাত্র একটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেই কাজ করে না বরং ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভিদ জীবনের বিবর্তন অধ্যয়নরত জীবাশ্মবিদ এবং ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণা কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। প্রদর্শনীগুলি এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস এবং প্যালিওবোটানির বিশ্বব্যাপী জ্ঞানে অবদান রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা বলাই বাহুল্য।

যে সকল বিজ্ঞানী এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের পরিচয় রয়েছে।

মান্দ্রোর ফসিল মিউজিয়ামে বেশ কিছু প্রদর্শনী রয়েছে যা রাজমহল পাহাড়ের অনন্য প্যালিওবোটানিকাল ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। মূল প্রদর্শনীর অন্তর্ভুক্ত:

জীবাশ্মকৃত উদ্ভিদের নমুনা: যাদুঘরটি বিলুপ্ত ফার্ন, সাইক্যাড এবং কনিফারের জীবাশ্মাবশেষ সহ উদ্ভিদের জীবাশ্মের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহালয়।   এই নমুনাগুলি লক্ষ লক্ষ বছর আগে বিদ্যমান উদ্ভিদের প্রকারের বিষয়ে ধারণা প্রদান করে।

পেট্রিফাইড কাঠ: যাদুঘরের প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে একটি হল এর পেট্রিফাইড কাঠের সংগ্রহ, যেখানে প্রাচীন গাছগুলি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে খনিজকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাথরে পরিণত হয়েছে। এই নমুনাগুলি গাছের গুঁড়ির বিশদ গঠন প্রদর্শন করে, যার মধ্যে বৃদ্ধির রিং এবং বাকলের ধরণ রয়েছে।

পাতার ছাপ এবং বীজের জীবাশ্ম: জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের পাতার ছাপ এবং বীজের জীবাশ্ম রয়েছে, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগের জলবায়ু পরিস্থিতি এবং উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের মূল সূচক। এই জীবাশ্মগুলি বিজ্ঞানীদের সময়ের সাথে উদ্ভিদ প্রজাতির বিবর্তন অধ্যয়ন করতে সহায়তা করে।

ভূতাত্ত্বিক এবং প্যালিওবোটানিকাল ডিসপ্লে: জাদুঘরে রাজমহল পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস, জীবাশ্মায়নের প্রক্রিয়া এবং এই অঞ্চলে পাওয়া জীবাশ্মের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বিস্তারিত প্রদর্শন রয়েছে। তথ্য প্যানেল এবং চার্ট দর্শকদের এই অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশের বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করে।  

সমগ্র উদ্যানটির পরিধি বৃহৎ, আমি প্রথমে হেঁটে হেঁটে ঘুরবো ঠিক করলেও সকলের পরামর্শে আমরা ব্যাটারিচালিত গাড়ি রিসার্ভ করে ঘুরেছিলাম, এতে ঠিকভাবে সমগ্র উদ্যানটি ঘোরা যায়, অন্যথায় অনাবশ্যক অধিক সময় ব্যয় হতে পারে। উদ্যানটি ঘুরে আমাদের বেরোতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিলো। প্রায় ২ টো নাগাদ আমরা নিকটবর্তী একটি বাজারে এক ভাতের হোটেলে এসে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। সত্যি বলতে এই অঞ্চলের রান্নার স্বাদ আমাদের খুবই ভালো লেগেছিলো। 

এবার আমাদের গন্তব্য শিবগাদি ধাম, যা প্রায় এখন থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে বোরহেট নামক স্থানে অবস্থিত। 

এখানে রয়েছেন ভগবান শিব, শ্রাবণ মাসে এই ধামে খুব ভক্তসমাগম হয়ে থাকে। শিবগাদি ধাম দর্শন করে আমাদের বেরোতে বেরোতে বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা উপস্থিত হলো।  আসলে শীতকালের বিকেল খুবই ক্ষণস্থায়ী। আমরা এবার যাবো বিন্দুবাসিনী মন্দির দর্শন করতে। সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে, আমি ভেবেছিলাম গতকাল আমরা মতি ঝর্ণা যখন পৌঁছেছিলাম তখন বেলা গড়িয়ে গিয়েছিলো, তাই আজকে আবার সেই স্থান দেখে আসবো।  কিন্তু বিন্দুবাসিনী মন্দির দর্শন করে তা আর সম্ভব হলো না। সন্ধ্যা ৭ টার সময় আমরা যখন ফিরছিলাম তখন ঘড়ি না দেখলে অনায়াসে মধ্যরাত বলে মনে হতে পারে, রাস্তাঘাট এতোটাই শুনশান, আর অন্ধকার, গাড়ির হেড লাইটই একমাত্র ভরসা। এমন সময় গাড়ি একটি রেল গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো, সামনে মালট্রেন, কাজেই মালট্রেন না সরলে আমরা আর এগোতে পারবো না। আমি ড্রাইভার দাদা কে জিজ্ঞেস করলাম, অন্য পথ রয়েছে কিনা কারণ মালট্রেন যে কখন সরবে তা অজানা। উনি বললেন রাস্তা একখানা রয়েছে তবে তা অনেক কিলোমিটার ঘুরে, আমরা বিচলিত হলেও তিনি মোটেই চিন্তিত নন। ক্রমাগত হর্ন বাজাতে লাগলেন। আমরা তো অবাক, হর্ন বাজিয়ে রাস্তায় অন্য গাড়ীকে জায়গা দেওয়ার কথা বলা গেলেও এ যে মালট্রেন, সামান্য গাড়ীর হর্নে সে সরবে কেন ! আমাদের অবাক করে দিয়ে দেখলাম মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর মালট্রেনটি ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে চলতে শুরু করলো, কিছুটা সরে গিয়ে সে আমাদের যাওয়ার পথ করে দিলো। আমরা অবাক হয়ে গেলাম, ড্রাইভার দাদা বললেন, এ অঞ্চলে এটাই রীতি। এই অভিজ্ঞতা আমাদের প্রথম।  

এবার হোটেলে ফিরে রাত্রিকালীন আহার সেরে আজকের মতন বিশ্রাম। 

পরদিন, 

সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো। স্নান সেরে এবার আমরা রওনা হবো মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। তবে বাকি থেকে গেলো অনেক স্থান, আবার আসবো কখনও। যথা সময়ে গাড়ি এসে পৌঁছলো। পথে প্রাতঃরাশ সারলাম, চা, বিস্কুট, মিষ্টি, মুড়ি-তেলেভাজা নানান কিছু সহযোগে। প্রজাতন্ত্র দিবসের এবং সপ্তাহান্তের ছুটির কারণে মুর্শিদাবাদে হোটেল রিসার্ভ করা বেশ মুশকিল হয়ে গিয়েছিলো, তবে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়েছিল। এবার মুর্শিদাবাদের কাহিনী (অনুগ্রহ করে পড়ুন মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ, মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের পরবর্তী পর্ব) [মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের এই কাহিনী কিন্তু এইবারের নয়, পূর্বের, তবে আশা করি পাঠক-পাঠিকার ভালো লাগবে। ] 

জানুয়ারী, ২০২৪

রাজমহল: পর্ব-১ (Rajmahal: Part-1)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh) 



মালদার নিকট মানিকচক ঘাট থেকে ভেসেলে গঙ্গা পার হয়ে আমরা পৌঁছলাম রাজমহল ঘাটে, তখন প্রায় ১'টা বাজে। মালদা ভ্রমণের পর এবার আমরা রাজমহল ঘুরব। ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাহিবগঞ্জ জেলায় রাজমহল অবস্থিত, যা একদা মাল-পাহাড়িয়া উপজাতির গোষ্ঠী মাল রাজা শাসন করতেন। সকালে হোটেল থেকে প্রাতঃরাশ সেরেই বেরিয়েছিলাম আমরা। ঘাটের কাছেই একটি হোটেলে গরম গরম ভাত, ধোঁয়া ওঠা ডাল, ভাজা, সব্জি সহযোগে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। এবার রাজমহল ঘুরে দেখা। এখান থেকেই সম্রাট আকবরের বাংলা দখল, কালাপাহাড়ের প্রবল পরাক্রম সত্ত্বেও বিফল হওয়া, আবার এই রাজমহলের পাহাড়েই পাহাড়িয়া, মাঝ-পাহাড়িয়াদের বাস, প্রণম্য তিলক মাঝির জন্ম, তাঁর দূরদৃষ্টি - কত ইতিহাস এই স্থানকে ঘিরে। দুপুরের খাওয়া সারতে সারতে একবার অতীতের নগরী রাজমহলের ইতিহাস সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক, তাহলে ঘুরতে সুবিধা হবে। 

[এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণকাহিনী (গবেষণাধর্মী বা গবেষণা নির্ভর ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়) যার অন্যতম উপাদান স্থানীয় গাইডদের  বা মানুষের প্রদত্ত তথ্য, সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান, প্রচলিত লোককথা, বিশ্বাস ইত্যাদি। তবে আমি স্থানগুলিতে যে ফলকগুলি রয়েছে তার চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছি, সেগুলি থেকে পাঠক-পাঠিকা তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।]

হুসেন শাহী বংশের শেষ সুলতান ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ [অনুগ্রহ করে পড়ুন মালদা: পর্ব-২ এবং মালদা: পর্ব-১]। মোঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বাদশাহ হুমায়ুন গৌড় দখল করেছিলেন কিন্তু তা অতি স্বল্প সময়ের জন্যে।  হুমায়ুন চৌসার যুদ্ধে শের শাহ সুরি-র নিকট পরাজিত হলে দিল্লী তথা বাংলা শের শাহ সুরি-র অধীনে আসে। এরপর সুরি বংশের অবসান হলে বাংলায় মহম্মদ শাহ বংশ (১৫৫৪-১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং এর অবসানে কারনানি বংশের (১৫৬৪ -১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ) সূচনা হয়। এই কারনানি বংশের শেষ সুলতান ছিলেন দাউদ খান কারনানি। এই সময় বাংলা জয়ের জন্যে সম্রাট আকবর সেনাপতি মুনিম খানকে প্রেরণ করেন, টুকরোই-এর যুদ্ধে তিনি দাউদ খান-কে পরাজিত করেন এবং তাঁর কাছ থেকে বাংলা, আর বিহার অধিকার করেন। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কারণ বাংলার বারো ভূইঁয়াদের অন্যতম ঈশা খান মোঘলদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। এদিকে, আকবরের সেনাপতি মুনিম খানের মৃত্যুর পর দাউদ খান পুনরায় বাংলা দখল করতে সচেষ্টা হন।  

অবশেষে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি, রাজা মান সিং, ওড়িশা জয়ের পর প্রথম রাজমহলে আসেন এবং ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে সুবে বাংলার রাজধানী হিসাবে রাজমহল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার রাজধানী মালদা থেকে রাজমহলে স্থানান্তরিত হলো, এই স্থানান্তর ছিল অনেকটা কৌশলগত, কারণ এটি গঙ্গার তীরে এবং এখান থেকে  বিহার ও বাংলা উভয় স্থানেই সহজ পৌঁছনো যায় কারণ এই নগর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। মান সিংয়ের আমলে, রাজমহল একটি সমৃদ্ধ প্রশাসনিক ও সামরিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অতীতের আগমহল, মুঘল সাম্রাজ্যের 'দামান-ই-কোহ' পরিচিত হলো নতুন নামে আকবরনগর। এখানে নির্মিত হয় প্রাসাদ, প্রশাসনিক ভবন, এবং দূর্গ। পরবর্তী মুঘল গভর্নরদের অধীনেও মসজিদ, বাগান এবং দূর্গ নির্মাণের মাধ্যমে শহরের গুরুত্ব অব্যাহত ছিল যা এখনও তার অতীত গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে। বাংলার রাজধানী হিসেবে রাজমহলের প্রাধান্য সুবাহদার ইসলাম খান দ্বারা তাঁর শাসনকালের মধ্যে (১৬০৮ থেকে ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ) রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত করা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। যদিও তখন রাজমহল একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ফাঁড়ি এবং বাণিজ্য শহর হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহল তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করে যখন সুবে বাংলার গভর্নর এবং সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজা কর্তৃক  রাজমহলে বাংলার রাজধানী পুনর্স্থাপিত হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীতে, রাজমহল স্থানীয় ক্ষমতার উত্থান, মারাঠা অনুপ্রবেশ এবং মুঘল সাম্রাজ্য এবং নতুন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে দ্বন্দ্বের সাথে অশান্তি এবং আনুগত্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, মুর্শিদাবাদ ক্ষমতার কেন্দ্র রূপে গিরে ওঠে, যা মুর্শিদকুলী খানের অধীনে বাংলার নতুন রাজধানী হয়ে ওঠে। ওই শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা পর্বে রাজমহলের তাৎপর্য  আরও হ্রাস পায়। বাংলা ও বিহারের অন্যান্য অংশে ব্রিটিশ প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপনের ফলে শহরটিকে একটি ছোট প্রশাসনিক ইউনিটে পরিণত করা হয়। যাইহোক, এটি একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যের স্থান হিসাবে অব্যাহত ছিল এবং এর সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্য ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

মধ্যাহ্নভোজন সারতেই আমাদের গাড়ী এসে উপস্থিত হলো। এবার আমরা এই নগরের ইতিহাসকে প্রতক্ষ্য করবো। প্রথম গন্তব্য সাঙ্গি দালান। 

সাঙ্গি দালান বা মার্বেল প্যাভিলিয়ন ঝাড়খণ্ডের রাজমহলের ঐতিহাসিক শহরের মধ্যে অবস্থিত একটি মার্জিত মুঘল যুগের কাঠামো। এই সুন্দর মণ্ডপটি মান সিং কর্তৃক বা মতান্তরে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার, যিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সময়ে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সাঙ্গি দালান নির্মাণে প্রতিসাম্য নকশার ব্যবহার করা হয়েছে - মুঘল স্থাপত্যের একটি বৈশিষ্ট্য। মণ্ডপটিতে খিলানযুক্ত একটি বড় কেন্দ্রীয় হল রয়েছে, যাতে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করতে পারে এবং বায়ুচলাচল করে। এখান থেকে গঙ্গা নদী এবং মনোরম রাজমহল পাহাড়ের একটি অপরূপ দৃশ্য উপভোগ্য। আগে এখান থেকে দাঁড়িয়ে গঙ্গায় শুশুক দেখা যেত বলে শুনেছি, জানি না এখন তাদের দেখা যায় কিনা। কাঠামোটি মুঘল আভিজাতদের জন্য একটি আনন্দ মণ্ডপ বা অভ্যর্থনা হল হিসাবে ব্যবহার করা হতো বলে মনে করা হয়। আবার, সমাবেশ, আলোচনা এবং মনোরম পরিবেশ উপভোগ করার জন্যও ব্যবহৃত হতো বলে মনে করা হয়। মার্জিত নকশা এবং কৌশলগত অবস্থান থেকে বোঝা যায় যে এটি নান্দনিক এবং কার্যকরী উভয় উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল।

এই প্রাঙ্গনেই রয়েছে অপূর্ব ভাস্কর্যের কয়েকটি নিদর্শন, একটা ছোট উদ্যান। মণ্ডপের মধ্যে দেখলাম ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল শতরঞ্চি বিছিয়ে আঁকছে। অনেক মানুষ উদ্যানটিতে বেড়াতে এসেছেন। 'ঝাড়ো কে দেশ' ('ঝাড়' শব্দটির অর্থ জঙ্গল, অর্থাৎ জঙ্গলের দেশ) এই ঝাড়খন্ড। অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় যথা সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, সাওরিয়া পাহাড়িয়া, বিরহর, করওয়া, মাহলি, কারমালি ইত্যাদি। জীবনধারণের উদ্দেশ্যে কোনো সম্প্রদায় চাষাবাদ করেন, আবার কোনো সম্প্রদায় কারিগরী শিল্পে নিপুণ। চাষাবাদ আবার প্রধানত দুই ধরণের, যেমন সেটলড কৃষিকাজ আবার কোথাও কোথাও ঝুমচাষ হয়ে থাকে।  

ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে মুঘল আমলে রাজা মান সিং কর্তৃক নির্মিত আকবরী দূর্গটি রাজমহলের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নিদর্শন,আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য। রাজমহল যখন সুবে (সুবাহ) বাংলার রাজধানী ছিল সেই সময়ে এই দূর্গটি নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে দূর্গের অধিকাংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এটি আজও অতীত নগরের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এবং এই অঞ্চলের স্থাপত্যের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। আকবরী দূর্গের নিকটেই অবস্থিত জামি মসজিদটি রাজমহলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপত্য। রাজা মান সিংয়ের শাসনামলে নির্মিত, মসজিদটি তার গঠন, গম্বুজ এবং মিনারগুলির সাথে চমৎকার মুঘল স্থাপত্যশৈলীকে প্রতিফলিত করে। এটি একটি উপাসনার স্থান এবং একটি মুঘল প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে শহরের প্রাক্তন তাৎপর্যের  একটি প্রমাণ হিসাবে রয়ে গেছে।




জামি মসজিদ এবং আকবরী দূর্গ দেখে এবার আমরা চললাম বারাদারি-র উদ্দেশ্যে। রাজমহলের বারাদারি-র অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক আকর্ষণ এবং স্থাপত্যটির উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক মূল্য রয়েছে। "বারাদারি" শব্দটির অর্থ "বারো দরজা" (ফার্সী শব্দ বারাহ থেকে যার অর্থ বারোটি এবং দার মানে দরজা) এবং এটি সাধারণত একটি মণ্ডপ বা ভবনকে বোঝায় যা বারোটি দরজা দিয়ে চারদিকে খোলা থাকে। রাজমহলের বারাদারি মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল, সম্ভবত সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার শাসনকালে।


শাহ সুজা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং রাজমহলকে তার বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করেন। কাঠামোটি রাজপরিবারের জন্য একটি আনন্দের মণ্ডপ হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল এবং এটি অবসর, সমাবেশ এবং সভাকার্যের জন্য একটি স্থান ছিল। এখান থেকে কিছুক্ষনের জন্যে হলেও আশেপাশের এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং গঙ্গা নদীর দৃশ্য উপভোগ করা যেতে পারে।




বারাদারি মুঘল স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন যার প্রতিসাম্য নকশা এবং মার্জিত খিলান রয়েছে। যদিও কাঠামোটি সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষিত নয়, তবে এর অবশিষ্ট উপাদানগুলি সেই সময়ের চমৎকার কারুকার্য প্রদর্শন করে। বারাদারি-র মূল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে: উন্মুক্ত কাঠামো: বারোটি খিলান বা দরজা দিয়ে বারোটি খিলান সহ বারাদারিটি খোলা নকশা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে যা চারপাশের একটি অবাধ দৃশ্য প্রদান করে। কেন্দ্রীয় হল: প্যাভিলিয়নের কেন্দ্রীয় হল সম্ভবত সামাজিক জমায়েত বা অফিসিয়াল মিটিং-এর জন্য ব্যবহার করা হত। আলংকারিক উপাদান: এমনকি বর্তমান জীর্ণ অবস্থায়ও, খিলান ও স্তম্ভগুলি মুঘল স্থাপত্যের শৈল্পিক সূক্ষ্মতাকে প্রতিফলিত করে।

এরপর কানহাইয়াস্থান মন্দির দর্শন করে আমরা গিয়েছিলাম মতি ঝর্ণা দেখতে। 


তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। দেখলাম সেই স্থানে কয়েকটি দোকান রয়েছে, সেখান থেকে বিকেলের চা, কেক ইত্যাদি খেয়ে আমরা ফিরলাম সাহিবগঞ্জে হোটেলে। একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরোলাম রাতের খাওদাওয়ার উদ্দেশ্যে। এখানে লোডশেডিংয়ের কারণে রাস্তাঘাট বেশ অন্ধকার। যাইহোক, অনতিদূরে একটি রেস্তোরাঁতে আমরা রাতের আহার সারলাম। খাওয়াদাওয়া সেরে হোটেলে ফিরে আজকের মতন বিশ্রাম।

জানুয়ারী, ২০২৪

মালদা: পর্ব-৩ (Malda: Part-3)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

মালদা: পর্ব-২ -র পর [পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে অনুগ্রহ করে ক্লিক করুন মালদা: পর্ব-১, মালদা: পর্ব-২

হাবশী বংশের পরে বাংলার শাসনভার ন্যস্ত হয় হুসেন শাহী বংশের (১৪৯৪ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ) উপর। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা।  বড়ো সোনা মসজিদ বা বারদুয়ারী মসজিদের নির্মাণ কার্য আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময়কালে আরম্ভ হলেও নির্মাণকার্যটি শেষ হয় নাসিরুদ্দিন নসরৎ শাহের আমলে। 


বড় সোনা মসজিদটি বারোদোয়ারী মসজিদ বলে পরিচিত হলেও এতে রয়েছে এগারোটি দরজা। মূল প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশ করে ডানদিকে মসজিদটি অবস্থিত।



সুলতান নসরৎ শাহের শাসনকালেই নির্মাণ হয় কদম রসুল মসজিদটি।    


এক গম্বুজ বিশিষ্ট চতুস্কোণ এই গৃহেই রয়েছে হজরত মহম্মদের পদচিহ্ন। শুনলাম পদচিহ্নটি দিনের বেলায় এই গৃহে থাকলেও প্রতিদিন নাকি সেটি রাত্রিবেলায় অন্যকোনো নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষিত থাকে। এই প্রাঙ্গনটিতেই রয়েছে ফতে খাঁ-র সমাধি। দোচালা বিশিষ্ট সমাধিটি যে গৃহে সংরক্ষিত রয়েছে এটি গ্রাম বাংলার দো-চালা গৃহের ন্যায়।


কদম রসুল মসজিদের নিকটে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লুকোচুরি দরওয়াজা, আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য, অবস্থিত। শাহ সুজা ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে সালে মোঘল  স্থাপত্য শৈলীতে এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। লুকোচুরির রাজকীয় খেলা থেকে এই নামের উৎপত্তি হয়েছে যেটি সুলতান তার বেগমদের সাথে খেলতেন। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এটি ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এই দ্বিতল দরওয়াজাটি প্রাসাদের প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল।



আজ এই পর্যন্ত। পরবর্তী পর্বে আসবো রামকেলী দর্শনের বর্ণনা নিয়ে।

জানুয়ারী, ২০২৪


মালদা: পর্ব-২ (Malda: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

মালদা ভ্রমণের প্রথম পর্বটি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন মালদা: পর্ব-১

গতকাল রেডিওতে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে। হোটেলে প্রাতঃরাশ সকাল ৮ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত। আমরা পৌনে ন'টার মধ্যে প্রাতঃরাশ সেরে ন'টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। গতকালই আমি অটো-র জন্যে বলে রেখেছিলাম। সঠিক সময়ে আমাদের অটো চালক দাদা এসে গিয়েছিলেন। বর্তমানে মালদা শহরের দক্ষিণে গৌড় এবং উত্তরে রয়েছে পাণ্ডুয়া। আমরা সকালে প্রথমে গৌড় ঘুরে মধ্যাহ্নভোজন সেরে পাণ্ডুয়া ঘুরতে যাবো। ঐতিহাসিক স্থানের বর্ণনা দিতে গেলে একটা কালানুক্রম বজায় রাখা প্রয়োজন, তবেই পারম্পর্য বোঝা যায়, নচেৎ স্থানটিকে অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যায়, তবে ঘোরা তো আর সেইভাবে হয় না, যে স্পটটি আগে পরে সেটি আগে ঘুরে নিতে নয়। তাই আমি এখানে আমার বেড়ানো অনুযায়ী নয় বরং ইতিহাসের হাত ধরে পাঠক-পাঠিকাকে আমাদের বেড়ানোটির বর্ণনা করবো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক স্থাপত্যটির সম্বন্ধে যে বর্ণনা পুরাতত্ত্ব বিভাগের বোর্ডে লেখা রয়েছে তার চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করবো যাতে পাঠক পাঠিকা তথ্য সম্বন্ধে সেখান থেকেও অবগত হতে পারেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণকাহিনী (গবেষণাধর্মী বা গবেষণা নির্ভর ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়) যার অন্যতম উপাদান স্থানীয় গাইডদের প্রদত্ত তথ্য, সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান, প্রচলিত লোককথা, বিশ্বাস ইত্যাদি।

যে গৌড়ের প্রতি অসীম আগ্রহে আমরা এসে পৌঁছলাম, তখন সেখানে লক্ষণাবতী নামে এক নগর ছিল। কাশী জয় করে প্রবল পরাক্রমী লক্ষণ সেন নৌ-পথে এসে পৌঁছলেন মহানগরে। তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্যে পিতা বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ বল্লালবাটী তো বটেই সেজে উঠেছিল সমগ্র নগর। আজ আমরা যে ধ্বংসাবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, তাই অতীতের বল্লালবাটী, বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ। জানিনা আর কতদিন এই অবশেষটুকু টিঁকবে, বিশেষ কোনো সংরক্ষণ চোখে পড়েনি। 


প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের নিকটেই রয়েছে জাহাজঘাটা, এখানেই নাকি জাহাজ এসে নোঙ্গর করতো সেই সময়ে। 

এই সেই সেন বংশ (১৭৭০-১২৩০ খ্রিস্টাব্দ) যার প্রবল পরাক্রমে পাল বংশের রাজা গোপালদেব ত্যাগ করলেন বঙ্গদেশ। পরাজিত হৃতসর্বস্ব রাজা গোপালদেব আশ্রয় গ্রহণ করলেন মগধে। পাল বংশের রাজত্ব অস্তমিত হলো, ধন-সম্পত্তি বিলুপ্ত হলো, কামরূপ থেকে প্রয়াগ পর্যন্ত একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো সেন বংশের, কিন্তু পাল বংশের উদারতা, শিক্ষা-দীক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা, উন্নত সমাজচেতনা- এসব কিন্তু আজও প্রশংসিত, সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারলো না পরবর্তী শাসক। এর একটি নিদর্শন রয়েছে মালদা জেলার হাবিবপুর ব্লকের জগজ্জীবনপুর আর্কিওলজিক্যাল সাইটটিতে। সময়ের অভাবে আমরা যেতে পারিনি তবে পর্যটকরা দেখে আসতে পারেন। সাইটটি মালদা শহরের কেন্দ্র ইংরেজ বাজার থেকে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই স্থান থেকে পাওয়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে পাল সম্রাট মহেন্দ্রপালদেবের একটি তাম্র-ফলক শিলালিপি এবং নবম শতাব্দীর একটি বৌদ্ধ বিহারের কাঠামোগত অবশেষ যা নন্দদীর্ঘিকা-উদ্রাঙ্গ মহাবিহার নামে পরিচিত।

এরপর অনেক দিন অতিবাহিত হয়েছে। কালের নিয়ম মেনেই একের পর এক শাসক এসেছেন, প্রবল পরাক্রমে নিজেকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠা করেছেন, আবার কালের নিয়মেই সে যুগের সমাপ্তি হয়েছে। বাংলায় সেন বংশের পরে বখতিয়ার খিলজির হাতে গড়ে উঠেছে খিলজি সাম্রাজ্য, তারপর দিল্লি সালতানাত মামলুক এবং তুঘলক সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলায় গভর্নর নিযুক্ত হন। তুঘলক সাম্রাজ্যের মাঝামাঝি সময় থেকে ইলিয়াস শাহী বংশের হাত ধরে বাংলার স্বাধীন সুলতানী যুগের আরম্ভ হয়।

বাংলায় তখন ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্ব (১৩৫২ থেকে ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ) চলছে। ইলিয়াস শাহী বংশের দ্বিতীয় সুলতান সিকান্দার শাহের (১৩৫৮ থেকে ১৩৯০ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকালে নির্মিত হয় এই আদিনা মসজিদ। দিল্লীর সুলতানী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দুই বার জয়লাভের (যথাক্রমে ১৩৫৩ এবং ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দ) এই মসজিদটি ছিল এই বংশের উচ্চাশার একপ্রকার প্রকাশ। মসজিদটির দেওয়ালের লিপিতে সুলতান সিকান্দার শাহকে একজন 'মহিমান্বিত সুলতান' বা 'বিশ্বস্থতার খলিফা' বলে বর্ণিত হয়েছে।





ইলিয়াস শাহী বংশের পরে আসে রাজা গণেশের বংশ (১৪১৪ থেকে ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দ)। রাজা গণেশের পুত্র সুলতান জালাউদ্দিন মুহম্মদ শাহ, জন্মগত ভাবে হিন্দু হলেও পরবর্তীকালে উনি মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, নির্মাণ করেন এই একলাখি মাজারটি। কথিত রয়েছে এই মাজারটি তৈরী করতে তৎকালীন সময়ের এক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল, তাই সমাধিসৌধটির নাম হয় একলাখি মাজার।


মাজারটির প্রবেশপথের ভাস্কর্য, টেরাকোটার কাজ, আট দিক বিশিষ্ট স্তম্ভ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।


রাজা গণেশের হাতে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন হলেও, রাজা গনেশের বংশ অধিক কাল যাবৎ স্থায়ী হয়নি। ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা গনেশ প্রথমবারের জন্যে সিংহাসন আরোহন করেন আর এই বংশের রাজত্বকাল চলে ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। অতঃপর নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের হাত ধরে পুনরায় বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের পুত্র রুকুনুদ্দিন বরবক শাহের আমলে বাইশ গাজি প্রাচীরের নির্মাণ হয়। বাইশ গজ উচ্চতার জন্যে এর নাম বাইশ গাজি হয়েছে। বহিঃশত্রুর হাত থেকে নগরকে সুরক্ষিত রাখার জন্যেই এর প্রাচীর নির্মাণ করা হয় বলে মনে হয়। বর্তমানে প্রাচীরের অনেকাংশ ভগ্নপ্রায় এবং এর সংরক্ষণের প্রয়োজন।



নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের পৌত্র শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (রুকুনুদ্দীন বরবক শাহের পুত্র)-র শাসনকালে চামকাটী মসজিদটিও নির্মিত হয়।


চমকাটী বা চিকা মসজিদের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত গুমটি দরওয়াজা। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই তোরণটি নির্মাণ করান, যা গৌড়ের পূর্বদিকের প্রবেশ পথ ছিল। 


এখনও কয়েকটি টালির গাত্রে রঙ বিদ্যমান রয়েছে, তবে আর কতদিন এগুলি স্থায়ী হবে তা জানিনা।


এর পরের গন্তব্য দাখিল দরওয়াজা, লক্ষণাবর্ত বা পরবর্তীকালের লাখনৌটির দুর্গের প্রবেশদ্বার এই দাখিল দরওয়াজা। ইলিয়াস শাহী বংশের দ্বিতীয় পর্বে (১৪৩৫ থেকে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ) নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের এই প্রবেশদ্বার নির্মিত হয়। তবে এই প্রবেশদ্বারের নির্মাণ এবং পুনঃনির্মাণ  নিয়ে ঐতিহাসিক মতান্তর রয়েছে।  মনে করা হয়, দাখিল দরওয়াজার  বর্তমান রূপটি হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হুসেন শাহী নির্মাণ করান।



ফিরোজ মিনারটি স্থাপন করেন সুলতান সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ। ইলিয়াস শাহী বংশের দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তির পর বাংলার শাসনভার এসেছিলো হাবশী বংশের (১৪৮৭ থেকে ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ) হাতে। সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন এই বংশের দ্বিতীয় সুলতান। এই মিনারটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় এটি একটি পাঁচ তলা বিশিষ্ট মিনার। প্রথম তিনটি তলা ১২ টি দিক বিশিষ্ট (Dodecagon) এবং উপরিস্থিত দুইটি তলা গোলাকার। এটি দিল্লীর কুতুব মিনার সদৃশ। কথিত আছে যে মিনারটির উচ্চতা সুলতানকে খুশি করতে না পারায় মিনারটির প্রধান আর্কিটেক্টকে সুলতান উপর থেকে নিচে ফেলে দেন, যদিও এই বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য আমার জানা নেই। মিনারটির বাইরের দেওয়ালে বেশ কয়েকটি মৌচাক হয়েছে দেখলাম। মনে হয় এগুলি জায়ান্ট মৌমাছির (Giant honey bee: Apis dorsata) চাক, তারা এরূপ চাক তৈরী করে। 



হাবশী বংশের পরে বাংলার শাসনভার ন্যস্ত হয় হুসেন শাহী বংশের (১৪৯৪ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ) উপর, সেই বিষয়ে আসছি পরবর্তী পর্বে।


জানুয়ারী, ২০২৪

মালদা: পর্ব-১ (Malda: Part-1)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

সকাল ন'টায় কলকাতা স্টেশন থেকে রওনা হয়ে ১২৩৬৩ কলকাতা-হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট সঠিক সময় বিকাল ৩টে-তে মালদা টাউন পৌঁছলো। আর আমরা এসে পৌঁছলাম অতীতের মহানগর গৌড়ে। ১ নম্বর প্লাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে পাওয়া যায় টোটো, সেই বাহনই আমাদের পৌঁছে দিলো হোটেলে। রেলওয়ে স্টেশন থেকে যে রাস্তাটি রথবাড়ি মোড়ের দিকে চলে যাচ্ছে, সেই রাস্তার উপরেই হোটেল। রেলগাড়িতে ঝালমুড়ি, পেয়ারা মাখা (বেশ কয়েক বৎসর হলো বিভিন্ন ফল মেখে বিক্রয় করার প্রচলন হয়েছে। পূর্বে, আমার ছোটবেলায়, সাধারণত দোকানী পেয়ারা কেটে তাতে নুন, কখনও বিট নুন, দিয়ে ঠোঙায় করে দিতেন। এখন দেখি, পেয়ারা কেটে তাতে কাসুন্দি, নুন, বিট নুন, লঙ্কার গুঁড়ো ইত্যাদি দিয়ে মেখে কাগজের প্লেটে করে দেয়। খেতে ভালোই লাগে, তবে অন্যান্য উপকরণের প্রাধান্যে পেয়ারার স্বাদের গুরুত্ব কমে যায়।), চা, কেক ইত্যাদি টুকিটাকি খাওয়া চললেও দুপুরের খাওয়া হয়নি, কাজেই হোটেলে পৌঁছে প্রথম গন্তব্য হোটেলের রেস্তোরাঁ। খাওয়া-দাওয়া সারার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা শহরটা একটু ঘুরতে বেরোলাম। মালদা ভ্রমণ আমাদের এই প্রথম, এমনিতে কর্মব্যস্ততার কারণে খুব একটা ঘোরা হয়ে ওঠেনা আমার, যা ঘোরা সম্ভব হয় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্মসূত্রে। আমাদের হোটেলটির নিকটে রয়েছে একাধিক আধুনিক রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, হোটেল, ব্যাঙ্কের এটিএম, মন্দির, দোকান-বাজার; সব মিলিয়ে বেশ শহর, তবে কোলাহল কিছুটা কম। এদিকটা ঘুরে এবার চললাম রথবাড়ি মোড়ের উদ্দেশ্যে। এটি মালদা শহরের  একটি  গুরুত্বপূর্ণ স্থান, কলকাতা থেকে শিলিগুড়ির বাসগুলি এই মোড় হয়েই যায়। এখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার বাস বা গাড়ি ছাড়ে, এমনকি শহরটির দর্শনীয়স্থানগুলি ঘোরার জন্যে এখন থেকেই গাড়ি রিসার্ভ করা যায়। হাঁকডাক, কোলাহল, মানুষের ব্যস্ততা সব মিলিয়ে স্থানটি নিজের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে। বাঙালী জীবনে চা একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমরা সাধারণত দিনে অল্প অল্প পরিমানে অনেক বার চা খাই। বর্তমানে সেই চায়ের আবার বিভিন্ন রূপ, কেউ খান দুধ-চিনি সহযোগে, কেউ দুধ ছাড়া চিনি দিয়ে, কেউ দুধ দিয়ে চিনি ছাড়া, আবার কেউ দুধ এবং চিনি উভয় উপকরণই বর্জন করে শুধু চা। দোকানী কিন্তু বেশ মনে রেখে চা তৈরী করে পরিবেশন করে যান। কোলাহল প্রিয় আমাদের আনন্দটা আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিলো এক কাপ চা, ভালো লাগলে আরও এক কাপ। 

জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহ, এখনও বেশ ঠান্ডা রয়েছে এখানে। এ বৎসর পশ্চিমবঙ্গে ঠান্ডাটা বেশ জমিয়ে পড়েছে, এটা উপভোগ্য। গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে শীত আমার কাছে অনেক প্রিয়। ছোটবেলায় কোনো এক ছোটদের পত্রিকায় কুয়াশার মধ্যে দিয়ে খেঁজুরের রসের বাঁক হাতে ক্ষেতের আল বেয়ে এক ব্যক্তি আসছেন আর এক দোকানী গ্রাম্য রাস্তার ধারে উনুন ধরিয়ে চা তৈরীর আয়োজন করছেন- এরূপ একটি চিত্র দেখেছিলাম। এই ছবিটি এখনও আমার মনে গেঁথে রয়েছে এবং আমার প্রিয় শীতকালের রূপ আজও ওই ছবিটির আধারেই আধারিত। আর শুধু কি তাই ! পৌষ পার্বনের পিঠে-পুলি, জয়নগরের মোয়া, পাটালি গুড়, পিকনিক, চিড়িয়াখানা ঘোরা, ভোরবেলা কাঁপতে কাঁপতে স্নান করে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি দেওয়া কি ছিল না ছোটবেলার শীতকালে। তবে ধূলোর প্রকোপ দেখলাম বেশ বেড়েছে, কুয়াশার সাথে মিশে স্মগ তৈরী করছে। দূষণের মাত্রা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের একটা ধারণা রয়েছে যে গ্রামে বোধহয় শহরের মতন দূষণের প্রকোপ নেই, কিন্তু বাস্তবে তা মনে হলো না, এই ভ্রমণের সময় সর্বত্রই, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে দূষণের চিত্রটা একই রকম দেখলাম। এটা নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত প্রয়োজনীয় বলেই মনে হয়, অন্যথায় মানুষের জীবনে এর নেতিবাচক পরিনাম পড়বে এবং তা নিয়ন্ত্রণ যে সহজ হবে না তা বলাই বাহুল্য।  

রথবাড়ি থেকে হোটেলে ফিরে স্নান সেরে দেখি আমার বড়ো পিসির এক আত্মীয় আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন, আমার সাথে প্রথম পরিচয়, পূর্বে কখনও পরিচয় হয়েছে তা মনে পড়ে না। এঁরা মালদা-র বাসিন্দা, আমাদের জন্যে এখানকার আম-কাসুন্দির আচার নিয়ে এসেছিলেন। সেই আচারের বোতলটি আমরা ফেরার সময়  সাথে করে নিয়ে এসেছি। এখন যখন এই ভ্রমণ কাহিনীটি লিখছি, সেই আঁচারের স্বাদ আমি গ্রহণ করেছি, অপূর্ব স্বাদ। পরবর্তী ব্লগে মালদার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলির ভ্রমণের বর্ণনা করার চেষ্টা করবো।

সপ্তাহান্তে বা ছোট কোনো ছুটিতে ঐতিহাসিক স্থান মালদা ঘুরে আসা যেতে পারে।

 

জানুয়ারী, ২০২৪

থাইল্যান্ড: পর্ব-৬ (Thailand: Part-6)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ থাইল্যান্ড: পর্ব-৪ থাইল্যান্ড: পর্ব-৫

আজ একটু বেলা করেই উঠলো সবাই। গত কয়েকদিন ধরে বেশ ভোর ভোরই উঠতে হচ্ছিলো সকলকে, আজ একটু বেশিক্ষন বিছানায় কাটানো যাচ্ছে, বেশ লাগছে। গতকাল একটি ফটো আমরা গাড়িতে ফেলে এসেছিলাম, তাই রুডিকে ফোন করে অনুরোধ করলাম সে যেন গতকালের গাড়িটিই আমাদের জন্যে আজকে পাঠায়, সেটিতেই আমরা যাবো পাটায়া। সকালে উঠে চা-বিস্কুট খেয়ে গল্পগুজব চলতে লাগলো। আজকের প্রাতঃরাশও ছিল নুডলস। সাড়ে দশটার মধ্যে আমরা তৈরী হয়ে গিয়েছিলাম, কথা-বার্তা চলছিল। হঠাৎ আমার ঘরের ফোন বেজে উঠলো, ফোনের ওপারে টনি, আমাদের গাড়ির চালক তথা আমাদের ব্যাঙ্কক ভ্রমণের গাইড। তিনি সময়ের পূর্বেই এসে হাজির হয়েছেন। আমরাও দেখলাম অযথা দেরি করে লাভ নেই, কাজেই আমরা লবিতে নেমে এলাম। প্রথমেই নমস্কার করে এক গাল হেসে আমাদের ফেলে আসা ছবিটি তিনি দিলেন। এদেশে আমাদের দেশের মতন দিনের প্রথম সাক্ষ্যাতে  হাত জোর করে প্রণাম করার সংস্কার রয়েছে। আমরা আগেই আজকের বেড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলাম, আমাদের আজকের প্রথম দ্রষ্টব্য স্যাংচুয়ারি অফ ট্রুথ। 

ব্যাঙ্কক ছেড়ে পাটায়ার দিকে চলতে চলতে সহজেই চোখে পড়বে রাস্তার পাশে ছবিগুলি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। গগনচুম্বী অট্টালিকা, বিরাট বিরাট মানব স্থাপত্য কখন অদৃশ্য হয়ে এখন শুধু প্রকৃতি। যখন স্যাংচুয়ারী অফ ট্রুথে পৌঁছলাম তখন প্রায় বেলা ১ টা। আমাদের সকলেই বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিলো। টনি গিয়ে টিকিট আর প্রত্যেকের জন্যে হাতে বাঁধার ব্যান্ড এনে দিলেন, এটি দেখালেই প্রবেশ করা যাবে অভ্যন্তরে।  ভিতরেই একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। আমরা গিয়ে সাগর দেখা যায় এমন একটি টেবিলে বসলাম। এবার খাবার অর্ডার দেওয়ার, সেখানে বিশেষ পরিবর্তন হলো না। তবে পানীয়ের ক্ষেত্রে যে যার পছন্দ মতন অর্ডার দিলো, আমি নিয়েছিলাম ডাব, ভিতরের শাঁসটাও বেশ ভালো ছিল।   

কাষ্ঠ নির্মিত এক বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদের অভ্যন্তরের প্রতিটি ভাস্কর্য কাঠ নির্মিত। প্রচুর পুরুষ-মহিলা একাগ্র চিত্তে হাতুড়ি আর ছেনির সাহায্যে ফুটিয়ে তুলছেন তাঁদের শিল্পকর্ম।  


এরপর আমরা গিয়েছিলাম আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে। এখানে বিশালাকায় একোয়ারিয়ামে রয়েছে বিভিন্ন জলচর প্রাণী। খুব ভালো লাগবে এটি দেখতে। 

এরপর আমরা গিয়েছিলাম পাটায়ার ভিউ পয়েন্টে, পাখির চোখে অপূর্ব পাটায়ার সৌন্দর্য ছিল মনোমুগ্ধকর। 


এর পরের পাহাড়টিতে এই শহরের বিগ বুদ্ধা স্থাপত্যটি রয়েছে তবে সেখানে আমরা এবার যেতে পারিনি, কাজেই এবার আমাদের গন্তব্য আজকের হোটেল, আমরা ছিলাম তেভান জমিতেনে। জমিতেন সমুদ্রসৈকত এখান থেকে হাঁটা পথে প্রায় ১৫-২০ মিনিট। একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। সকলের বেশ খিদে পেয়েছিলো, সৈকতের নিকটেই একটি রেস্তোরাঁ আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল, এর বিশেষত্ব ছিল এটি একটি মাল্টি-কুইসিন রেস্তোরাঁ, এখানে ভারতীয়, বাঙালি, থাই এবং ইউরোপিয়ান সকল ধরণের কুইসিন পাওয়া যায়। রেস্তোরাঁর এম্বিয়েন্সও আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল।  শেফের সাথে আমাদের পরিচয় হলো, উনি বাঙালী, ওঁনার স্ত্রী থাই, পুরো পরিবার একসাথে এই রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করেন। তন্দুরি রুটি, জিরা রাইস, মাছের কারী, চিকেন কারী, আমের লস্যি সব দিয়ে আমাদের ডিনারটা বেশ জমে উঠেছিল। অনেক গল্পও হলো, ওঁদের জীবন, থাইল্যান্ডের জীবন, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।  বারবার উঠে এসেছিলো করোনা-র সময়কালের কথা, সে সত্যই এক সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার কাহিনী।

আজকের মতন বিশ্রাম। আমরা ঠিক করেছিলাম ঘরে গিয়ে সবাই গল্প করবো, কিন্তু তা আর হল না। সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আবার আগামীকাল ভোর ভোর ওঠা ছিল, কারণ আগামীকাল আমাদের এই ভ্রমণের অন্তিম দিন। 

আজ আমরা সবাই সকাল সকাল উঠে পড়েছিলাম। এবার প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যাবো সমুদ্রে স্নান করতে। গত কাল রাত্রে ফেরার পথে সকলের জন্যে নিজ নিজ পছন্দ অনুসারে প্রাতঃরাশ কিনে আনা হয়েছিল। চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আগেই আমাদের আজকের দুপুরের খাবার আলু পরোটা অর্ডার দেওয়াই ছিল, সমুদ্রে স্নান করে ফেরার পথে সেটা নিয়ে আসার কথা। বেরোনোর আগে আমরা খেয়ে বেরোবো।  

এবার ফেরার পালা। সবথেকে বেশি আমরা প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞ। কয়েক মাস আগে যখন পরিকল্পনা করেছিলাম তখন আমাদের মনে বৃষ্টির একটা ভয় ছিল, জুলাই মাসে বৃষ্টি হওয়াটা একেবারেই আশ্চর্য নয়। এমনকি বেড়াতে আসার পূর্বের সপ্তাহটিতে আমাদের ওখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল, তবে প্রকৃতি আমাদের মনোস্কামনা শুনেছিলেন, খুব সুন্দর রৌদ্র ঝলমল আবহাওয়া আমাদের বেড়ানোটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল। বেলা ১২ টার সময়ে আমরা হোটেল ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, নিৰ্দিষ্ট সময়েই বির গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন হোটেলে। গাড়িতে মালপত্র সব তুলে দেওয়া হলো।  পাটায়াকে বিদায় জানিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য ব্যাঙ্ককে সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে অবস্থিত সিয়াম প্রিমিয়াম আউটলেট (Siam Premium Outlet), সবাই জিনিসপত্র দেখা কেনার জন্যে উৎসাহী, কাজেই আমরা এই স্থানে ঘন্টা তিনেক কাটালাম। দোকানগুলিতে ঘোরাঘুরির মাঝে বিভিন্ন ধরণের ফ্রাইড রাইস, আর থাই টি দিয়ে খাওয়াদাওয়া সারলাম। আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ হলে আমরা চললাম সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে, এখান থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ গাড়িতে। 

মা-বাবা দের যে বিমান সংস্থার টিকিট ছিল দেখলাম সেই সংস্থা তাদের বিমান বাতিল করেছে এবং কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থাও করেনি। এরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বড়ই আশ্চর্য করে আমাদের, তবে কি আর করা ! আমরা ওপর একটি বিমানের টিকিট কিনে নিলাম। ওঁদের বিমান ছিল রাত্রি ১১ টা বেজে ৩০ মিনিটে। আমাদের পরের দিনই ভোর ১ টা বেজে ৪৫ মিনিটে। বোর্ডিং, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি সবই ওঁদের আমাদের আগে হয়ে গিয়েছিলো। আমরা তখনও বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে আমাদের প্রক্রিয়া শুরু হলো, যখন ভিতরে গিয়ে মা-বাবা দের সাথে দেখা হলো ততক্ষনে ওঁদের বিমানের সময় প্রায় হয়ে গিয়েছিলো। ওঁরা এয়ারপোর্টে কোনো খাবার খেলো না, ফ্লাইটে ডিনার করবে বললো। একসাথে কিছুক্ষন কাটিয়ে ওঁদের বিমানে ওঠার পর আমরা আমাদের গেটের দিকে এগিয়ে চললাম, পথে একটি দোকানে ডিনার সেরে নিলাম। 

এবার ফিরে চলা, মাথায় ভিড় করে আসছে একের পর এক কাজ। গিয়েই সামনের সপ্তাহে আমাকে যেতে হবে একটি আন্তর্জাতিক ইকোলজি বিষয়ক সম্মেলনে, সেই সংক্রান্ত বেশ কিছু কাজ রয়েছে। বেশ ভালো বেড়ানো হলো। শেষ মুহূর্তে মা-বাবা দের জিজ্ঞেস করেছিলাম এর পর তাঁরা কোথায় যেতে পছন্দ করবে? উত্তর এখনো নিশ্চিত হয়নি, যদি কোথাও যাই নিশ্চয় তা ভবিষ্যতে আমার ব্লগে লেখার চেষ্টা করবো।  

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-৫ (Thailand: Part-5)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ থাইল্যান্ড: পর্ব-৪

আজ আমাদের ব্যাঙ্কক ঘোরার প্রথম দিন। প্রথমে আমরা যাবো ম্যাকলং রেলস্টেশনে (Maeklong Station)। রেললাইনের দু'পাশে পসরা সাজিয়ে বাজার বসেছে।  ট্রেনটি যখন আসে দোকানগুলির উপর থেকে চাঁদোয়াগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়, সংকীর্ণ লাইনটি বেয়ে রেলগাড়িটি স্টেশনে আসে। এই দৃশ্য দেখার জন্যে প্রত্যহ সকালে পর্যটকরা ভিড় করেন, যেমন আমরাও এসেছি আজ। কথা মতন নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ সকাল ৭টায় রুডি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর এক ভাইপোকেও পাঠিয়েছিলেন, আগে থেকে দর্শনীয় স্থানগুলির টিকিট কেটে আমাদের সাহায্য করার জন্য। স্থানীয় বাজারটি ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগে, বেশিরভাগ সব্জি পরিচিত হলেও বেশ কিছু সব্জি, ফল অচেনাও থাকতে পারে। ট্রেন আসার পূর্বেই আমরা যথাস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। স্টেশনের পাশেই রয়েছে সারি সারি রেস্তোরাঁ। চা-বিস্কুট আমরা খেয়েই বেরিয়েছিলাম। এখানে যে যার মতন পানীয় পছন্দ করে কিনলো, কেউ ডাব আবার কেউ ম্যাংগো স্মুদি। ডাব আমার বড়োই প্রিয়, জল তো বটেই, ভিতরের শাঁস টাও ততোধিক প্রিয়। তবে দক্ষিণ কোরিয়াতে ডাব খুব একটা পাওয়া যায় না, কখনও টিনে ডাবের জল পাওয়া যায় বটে কিন্তু তা আমার ভালো লাগে না, কাজেই এই পুরো ঘোরাতেই আমি মন ভরে ডাব খেয়েছিলাম। এবার ট্রেনটি ঢুকছে, লাইনের উপর পর্যটকদের ভিড়, নিজ নিজ দোকানের চাঁদোয়াগুলি দোকানিরা সরিয়ে নিচ্ছেন আর ট্রেনটি এগিয়ে আসছে। বেশ উপভোগ্য এ দৃশ্য। 

ক্রমাগত লাইন থেকে পর্যটকদের সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ বার্তা বাজতে লাগলো, ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করলো। এতক্ষণ ট্রেন আসার ছবি বা ভিডিও তুলতে ব্যস্ত পর্যটকরা এবার ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বলাই বাহুল্য, আমরাও এ আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করিনি। 

এখন থেকে আমরা যাবো দামনেন সাদুকে (Damnoen Saduak)। শহরের মধ্যে দিয়ে কয়েক কিলোমিটার ব্যাপী বয়ে চলেছে একটি খাল, তার দু'পাশে স্থানীয় মানুষের ঘর-বাড়ি, দোকান, আবার কোথাও নৌকা করে বাজারের পসরা সাজিয়ে চলেছে বেচা কেনা, অনেক ভেনিসের মতন। আমরা এখানে নৌকাবিহার করবো। তবে যাওয়ার পথে প্রথমে যাবো নারকেল থেকে গুড় প্রস্তুত করা দেখতে। আঁখি গুড়ের সাথে আমরা ভারতবাসীরা পরিচিত, শীতকালে খেঁজুরের রস থেকে যে গুড় বা পাটালি তৈরী হয় তা তো বাঙালির প্রেম, আবার তালের পাটালিও হয়ে থাকে, তবে নারকেল থেকে গুড় প্রস্তুত করা হয় তা আমি পূর্বে জানলেও  চেখে দেখার সুযোগ এই প্রথম বার, বেশ সুস্বাদু। 

এইবার চললাম দামনেন সাদুকের উদ্দেশ্যে। গাড়ি থেকে নেমে যে পথ দিয়ে নৌকার কাছে পৌঁছলাম তার দু'পাশে কাষ্ঠনির্মিত অনেক ভাস্কর্য রাখা রয়েছে, অধিকাংশই ভগবান বুদ্ধের এবং বৌদ্ধ ধর্মের নানান চরিত্রের। 

একটি নৌকায় ছয়জন, কাজেই আমাদের একটি নৌকা লেগেছিলো। নৌকার পশ্চাদভাগে ইঞ্জিন রয়েছে, নৌকার চালক সেখান থেকে নৌকাটিকে চালাচ্ছেন। সরু খাল বেয়ে অত্যন্ত দ্রুতবেগে চলে এই নৌকাগুলি আর পর্যটকরা তা উপভোগ করেন, নৌকায় যেতে যেতে দেখেন আশপাশের ঘর বাড়ি, বাগান ইত্যাদি, এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আবার প্রতিটি বাঁকের সময় নৌকার গতি ধীর হয়ে যায়, বাঁক ঘুরেই আবার সে গতি বৃদ্ধি করে। নৌকা যাত্রা সব মিলিয়ে প্রায় ২০ মিনিট মতন। 

নৌকা এসে যে স্থানে নামিয়ে দেয়, সেটা বাজার। নৌকা থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে আমরা যখন উঠে আসলাম, তখন দোকানিদের ডাকাডাকি, তাদের পসরা দেখানোর ধুম লেগে যায়। 

একটু এগিয়ে আসতেই দেখলাম, এক ব্যক্তি কয়েকটি বাঁধানো ছবি আমাদের সামনে এসে আমাদের বিক্রি করতে চাইছেন, ছবি দেখে তো আমরা আশ্চর্য। এতো আমাদেরই নৌকাবিহারের ছবি ! নৌকা ছাড়ার একটু পরেই এক ব্যক্তি পাড় থেকে আমাদের ছবি তুলেছিলেন, মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে তা প্রিন্ট করে বাঁধিয়ে বিক্রি করতে এসেছেন। ছবিগুলি আমরা কিনেছিলাম, এক একটা ১৫০ থাই বাত করে নিয়েছিলেন। কাপড়, বিভিন্ন দ্রব্যাদি ইত্যাদির পাশাপাশি এখানে একের পর এক রেস্তোরাঁ রয়েছে। নিজেদের পছন্দের মতন একটি দোকানে গিয়ে বসলাম। সি ফুড ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাইড রাইস, প্রন ফ্রাইড রাইস, স্যুপ ইত্যাদি ছাড়াও এখানে যে জিনিসটা আমাদের সর্বাধিক রসনাতৃপ্তকারক ছিল তা হলো ডাব আইসক্রিম। ডাবের নরম শাঁসের মধ্যে আইসক্রিম, তার উপর চীনাবাদাম, নীল রঙের অল্প ভাত আর একটি ফুল দিয়ে গার্নিশ করা।

এবার আমরা ফিরে চললাম। প্রথম গন্তব্য ব্যাঙ্ককের গ্র্যান্ড প্যালেস। এটি পর্যটকদের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য। মহান গ্র্যান্ড প্যালেস প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে অবস্থিত মহিমান্বিত ভবনগুলির স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ। রাজা প্রথম রামা দ্বারা রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ব্যাঙ্ককে প্রতিষ্ঠান করার সময় ১৭৮২ সালে এই প্যালেসটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ২১৮০০০ বর্গ মিটার ব্যাপৃত প্যালেস প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে রয়েছে রাজসিংহাসনের বাড়ি, প্রসিদ্ধ এমারাল্ড বুদ্ধ মন্দির (The Temple of the Emerald Buddha) সহ অনেকগুলি সরকারি দফতর। 

প্রথম পর্বে এই দেশটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনার সময় উল্লেখ করেছিলাম চাকরি রাজবংশের কথা, যা ইতিহাসে রাত্তানাকসিন রাজত্ব (Rattanakosin Kingdom) নাম পরিচিত। ব্যাঙ্ককের হৃদয়ে অবস্থিত এই মহান প্যালেসটি রাজা চাও ফ্রায়া (Phra Phutthayotfa Chulalok Maharaj) যিনি রাজা প্রথম রামা নাম পরিচিত, থেকে রাজা রামা পঞ্চম পর্যন্ত রাজাদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এই স্থানটি রাজপরিবারের অনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় এবং রাজার অতিথিদের, রাষ্ট্রের অতিথিদের এবং অন্যান্য বিদেশী বিশেষাধিকারীদের স্বাগতের জন্য ব্যবহৃত হয়। গ্র্যান্ড প্যালেসের প্রবেশ পথে অনেক গাইড রয়েছেন, তাঁরা নিজেরাই এগিয়ে আসবেন, তবে কথা বলে গাইডের পারিশ্রমিক ঠিক করে নেওয়া বাঞ্চনীয়। একা একাও এস্থান ঘুরে দেখা যায়, তবে সাথে গাইড থাকলে বুঝে নিতে সাহায্য হয়।   

 

প্রথম পর্বে আমি উল্লেখ করেছিলাম রামাকিয়েন-র কথা। এই কাহিনী রামায়ণের হলেও কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণের রাজা রাম রামাকিয়েনে ফ্রা রামা (Phra Rama), সীতা এখানে নাং সিদা (Nang Sida), দশরথ এখানে থোৎসারথ (Thotsaroth), রাবণ এখানে তৎসাকান (Totsakan) ইত্যাদি। রামাকিয়েনের কাহিনী অনুসারে মাতা সীতা রাবণের কন্যা, হনুমান বিবাহিত পুরুষ, হনুমান নিজেকে প্রসারিত করে সেতু নির্মাণ করেন ইত্যাদি বেশ কয়েকটি স্থানে বৈসাদৃশ্য লক্ষ্যিত হয়। এই কাহিনী প্রসঙ্গান্তরে সুযোগ পেলে কখনও বিস্তারিত আলোচনা করবো। এই কাহিনীগুলি শিল্পীর কল্পনায় প্যালেসের দেওয়ালে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

এরপর আমাদের দ্রষ্টব্য ওয়াট ফো, যার অফিসিয়াল নাম ওয়াট ফ্রা চেতুফন উইমন মংখলারাম রাজওয়ারমহাভিহান (Wat Phra Chetuphon Wimon Mangkhalaram Rajwaramahawihan)। রাজা রামা প্রথম পূর্ববর্তী মন্দিরটিকে পুনর্নির্মাণ করেন এবং পরবর্তীকালে রাজা রামা তৃতীয় মন্দিরটিকে সম্প্রসারণ এবং সংস্কার করেন। ব্যাঙ্কক শহরের প্রাচীনতম মন্দিরটির নাম ওয়াট ফো এসেছে ওয়াট ফোতারাম (Wat Photaram) বা ওয়াট ফোধারাম (Wat Phodharam) কথাটি থেকে, যা ভারতবর্ষের বোধ গয়ায় অবস্থিত বোধিবৃক্ষের মঠ কে নির্দেশ করে। থাইল্যান্ডের সাথে ভারতবর্ষের দর্শন একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, ভ্রমণের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের মাধ্যমে তা সহজেই অনুভব হয়। চোখে পড়বে চাও ফ্রায়া নদীর ওপর তীরে অবস্থিত অন্য একটি বৌদ্ধ মন্দির হলো ওয়াট অরুন। যখন আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য বার্মিজ আক্রমণে অস্তমিত তখন রাজা তাকসিন থোনবুরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং বৌদ্ধ মন্দির অরুনের পাশে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান। পরবর্তীকালে রাত্তানাকসিন রাজবংশের সূচনায় রাজা রামা প্রথম থোনবুরি থেকে ব্যাঙ্ককে রাজধানী স্থানান্তরিত করলে তিনি বৌদ্ধ মন্দির ফো-র পাশে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান।  

৮০ বর্গমিটার বিস্তৃত মন্দির প্রাঙ্গনটিতে রয়েছে ফ্রা উবসত (Phra Ubosot), ফ্রা রাবিয়াং (Phra Rabiang), ফ্রা মহা চেদি সি রাজকর্ণ (Phra Maha Chedi Si Rajakarn), এবং রিক্লাইনিং বুদ্ধ (Reclining Buddha) মূর্তি। ফ্রা উবসত (ফ্রা উপোসাথা) বা বট হল  হল, বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত প্রধান অর্ডিনেশন গৃহ এবং প্রাঙ্গণটির সর্বাধিক পবিত্র ভবন। এটি আয়ুথায়-শৈলীতে রাজা প্রথম রাম দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, এবং পরে রাম তৃতীয় দ্বারা রত্নকোসিন-শৈলীতে এটিকে প্রসারিত ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।  ফ্রা উবসত ফ্রা রাবিয়াং দ্বারা ঘেরা প্রাঙ্গনের মধ্যভাগে অবস্থিত।

এই ডাবল ক্লোস্টারে উত্তর থাইল্যান্ডের বুদ্ধের প্রায় ৪০০ টি মূর্তি রয়েছে যা মূলত রাজা রাম প্রথম দ্বারা আনা ১২০০ টির মধ্যে নির্বাচিত হয়েছে। এই বুদ্ধ মূর্তিগুলির মধ্যে ১৫০ টি ডাবল ক্লোস্টারের ভিতরের দিকে, অন্য ২৪৪ টি মূর্তি বাইরের দিকে রয়েছে। এই বুদ্ধের মূর্তিগুলো, কিছু দাঁড়িয়ে আছে এবং কিছু উপবিষ্ট, সমানভাবে সোনালি পাদদেশে মাউন্ট করা হয়েছে। এই মূর্তিগুলি সিয়ামের বিভিন্ন স্থান থেকে আনীত এবং ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালের, যেমন চিয়াংসেন (Chiang Saen), সুখোথাই (Sukhothai), ইউ-থং (U-Thong) এবং আয়ুত্থায়া (Ayutthaya) সময়কালের। মূর্তিগুলিকে রামা প্রথম সংস্কার করেছিলেন এবং এগুলিকে সোনার পাতা দিয়ে আবৃত করে দেওয়া হয়েছিল।      

রিক্লাইনিং বুদ্ধ (ফ্রা বুদ্ধসাইয়াস/ Phra Buddhasaiyas) ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামা তৃতীয় দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এই হেলান দেওয়া বুদ্ধমূর্তি ভগবান বুদ্ধের নির্বাণে প্রবেশ এবং সমস্ত পুনর্জন্মের সমাপ্তির প্রতিনিধিত্ব করে।



ভগবান বুদ্ধ কে নতজানু হয়ে প্রণাম করে এবার আমাদের আজকের মতন ফেরা। অনেক সকালে আমরা বেরিয়েছিলাম। ঘরে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সারাদিনের গল্প, দিনটিকে ফিরে দেখা, এইভাবেই কেটে গেলো সন্ধ্যেটা। ফেরার পথে একটু বৃষ্টি হয়েছিল তবে তা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি। আজ আমরা সন্ধ্যার জলখাবার, রাতের খাওয়া-দাওয়া ঘরেই সেরেছিলাম। চা-বিস্কুট, নুডলস, কেক, মিষ্টি ছিল খাদ্যের তালিকায়। কাল ব্যাঙ্কক থেকে আমরা যাবো পাটায়া। সেই গল্প আসবে আগামী পর্বে। 

জুলাই, ২০২৩

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...