পৃষ্ঠাসমূহ

Ecology and Environment লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Ecology and Environment লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

জলবায়ু সংকট থেকে পুষ্টির স্থিতিশীলতা: সুস্থায়ী পদক্ষেপের আহ্বান (From Climate Crisis to Nutritional Stability: A Call for Sustainable Action)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

রেমাল (Remal cyclone) কি তাণ্ডব করে তা নিয়ে এক গভীর উৎকণ্ঠায় কয়েক মাস আগে টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের উপর অনবরত দৃষ্টি রেখে চলেছিলাম। সাইক্লোন (Cyclone) বা  ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ফল। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ নিয়ে জনসাধারণের খুব একটা আলোচনা শোনা যায় না। জলবায়ু পরিবর্তন আর দূরবর্তী কোনো বিষয় নয়, এটি ইতিমধ্যে আমাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কাজেই এর হাত থেকে রক্ষা পেতে এই বিষয় সম্বন্ধে অবহিত হতে হবে এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমেই বলি, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনে কতটা বিপর্যয় বা বিপদ নিয়ে আসতে পারে তা কিন্তু আমাদের উপরেই নির্ভর করে। এই প্রবন্ধে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরব, বিশেষত কৃষিতে এর প্রভাবের দিকে নজর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মতো অঞ্চলে, যা এই পরিবর্তনের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।

উচ্চ তাপমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান পরিণতি এবং এটি সরাসরি ফসলের উৎপাদনের উপর নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে গমের উৎপাদন ৪-৬% এবং ধানের উৎপাদন ৩-১০% কমে যেতে পারে (Welch et al., 2010; Liu et al., 2016; Zhao et al., 2017)। পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি রাজ্যের জন্য, যেখানে ধান একটি অন্যতম প্রধান ফসল, এটি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ফসলের উৎপাদন হ্রাস খাদ্য নিরাপত্তা এবং লক্ষ লক্ষ কৃষকের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলতে পারে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হল বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন। চরম বৃষ্টিপাতের ঘটনা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে (Saha and Sateesh 2022; Chaubey et al. 2022)। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত খরা এবং বন্যা উভয়ের কারণ হতে পারে, যা কৃষি কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। বন্যা ফসল ও অবকাঠামো ধ্বংস করতে পারে, খরা জলের অভাব ঘটাতে পারে, যা সেচ ব্যবস্থা এবং উৎপাদন হ্রাসে প্রভাব ফেলে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি উদ্বেগজনক পরিণতি হল ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা বৃদ্ধি। বঙ্গোপসাগরের উষ্ণতর সমুদ্র তাপমাত্রা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম দেয়। ২০২০ সালের মে মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এর ফলে প্রায় ১৭ লাখ হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে (Sarkar and Chakravorty 2021; Bonyopadhyay and Jana 2024; Islam et al. 2024)। ঘূর্ণিঝড় শুধু ফসল ধ্বংস করে না, এটি উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা বাড়িয়ে তোলে, যার ফলে কৃষি উৎপাদনশীলতা কমে যায়।

[এখানে উল্লেখ্য যে, আমি প্রধান সাইক্লোনগুলিকে গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করেছি মাত্র, এটা একটা সংক্ষিপ্ত চিত্রকে প্রকাশ করে। তবে এই সংখ্যার বিভিন্ন উৎস এবং মানদণ্ড অনুসারে কিছু ভিন্নতা থাকতে পারে।]

জলবায়ু পরিবর্তন জলপ্রাপ্যতা এবং মাটির স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে, যা সুস্থায়ী কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বাষ্পীভবনের হার বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তনের ফলে জলাভাব দেখা দিতে পারে (Pathak et al. 2014)। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নদী অববাহিকার সেচের জন্য জলপ্রাপ্যতা কমে যেতে পারে, যা কৃষিকার্যে ঋণাত্মক প্রভাব বৃদ্ধি করতে পারে। উচ্চতর সমুদ্রের স্তর (Rising sea level) এবং ঘন ঘন ঝড়ের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়, যা মাটির উর্বরতাকে হ্রাস করে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের মতো উপকূলীয় জেলাগুলিতে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা ধান, শাক-সবজি এবং অন্যান্য ফসলের চাষকে প্রভাবিত করে (Sarkar et al., 2021; Das et al. 2024)। এছাড়াও, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে মাটির ক্ষয় হয়, যা মাটির স্বাস্থ্যকে আরও খারাপ করে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা কমায়।

কাজেই সহজেই বোধগম্য যে জলবায়ু পরিবর্তনের ঋণাত্মক প্রভাব কৃষিকার্যে পড়ছে, এরফলে খাদ্য উৎপাদন যে ব্যাহত হচ্ছে বা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। আবহাওয়া এবং মৃত্তিকা জনিত কারণে ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেলে বাজারে তার মূল্যবৃদ্ধি হবে, অধিক মূল্যের কারণে তা অনেক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করবে - তা সহজেই বোধ্য। এরূপ অবস্থায় হয়তো প্রথম দিকে পুষ্টির চিত্রটির করুন অবস্থাটি ধরা না পড়লেও, বারংবার যদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করতে আমরা ব্যর্থ হই, তবে তা আমাদের খাদ্য এবং পুষ্টি অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি করবে। 

পদক্ষেপের প্রয়োজন:

কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর প্রভাবের কারণে, সুস্থায়ী এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় নিম্নলিখিত কৌশলগুলি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে:

১. কৃষি পদ্ধতির উন্নতি: জলবায়ু সহনশীল ফসল গ্রহণ করা, সেচের দক্ষতা বাড়ানো এবং টেকসই চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করতে পারে।

[অনুগ্রহ করে পড়ুন বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা ]

২. অবকাঠামোর উন্নতি: ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী কাঠামো এবং দক্ষ জলব্যবস্থাপনা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: জলবায়ু পরিবর্তন জনসাধারণের আলোচনার একটি প্রধান বিষয় হওয়া উচিত, যার মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক এবং নির্বাচনী প্রচারণা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধি সম্মিলিত পদক্ষেপ এবং নীতিগত পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

৪. গবেষণা এবং উন্নয়নে বিনিয়োগ: জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর কৃষির ওপর প্রভাব নিয়ে চলমান গবেষণা নতুন প্রযুক্তি এবং পদ্ধতির উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে, যা সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার জন্য একটি বড় হুমকি (Threat) হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মাটির স্বাস্থ্যের অবনতি - এই সকল সমস্যার জরুরি সমাধান প্রয়োজন। যদি আমরা পদক্ষেপ নিতে দেরী করি, এর পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। নীতিনির্ধারক, বিজ্ঞানী, কৃষক এবং জনসাধারণের একসাথে এসে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই বা সুস্থায়ী উন্নয়ন (Sustainable Development) নিশ্চিত করতে পারি। 

তথ্যসূত্র (References) [বিশদে জানার জন্যে করে গবেষণাপত্রগুলি পড়তে পারেন ]

Bondyopadhyay, S.; Jana, M.S. 2024. Precursors of hazard due to super cyclone AMPHAN for Kolkata, India from surface observation. Mausam 75(2): 373-380. https://doi.org/10.54302/mausam.v75i2.6259

Chaubey, P.K.; Mall, R.K.; Jaiswal, R.; Payra, S. 2022. Spatio-temporal changes in extreme rainfall events over different Indian river basins. Earth and Space Science 9(3): e2021EA001930. https://doi.org/10.1029/2021EA001930

Das, S.; Bandyopadhyay, J.; Acharyya, N.; Jana, M.; Maity, S. 2024. Chapter 7- Impact of soil salinity on the increasing trends of aqua farming in the coastal blocks of Purba Medinipur districts: a geospatial approach. Developments in Environmental Science 16: 153-181. https://doi.org/10.1016/B978-0-443-23665-5.00007-7 

Islam, A.; Chakraborty, D.; Rahaman, A.; Pal, S.C.; Islam, A.R.M.T.; Ghosh, S.; Chowdhuri, I. 2024. Spatial heterogeneity of cyclone induced social psychology in the Indian Sundarbans using empirical data and geospatial techniques. International Journal of Disaster Risk Reduction 111: 104665. https://doi.org/10.1016.j.iidrr.2024.104665

Liu, B.; Asseng, S.; Müller, C.; Ewert, F.; Elliot, J.; et al. 2016. Similar estimates of temperature impacts on global wheat yield by three independent methods. Nature Climate Change 6: 1130-1136. https://doi.org/10.1038/nclimate3115

Pathak, H.; Pramanik, P.; Khanna, M.; Kumar, A. 2014. Climate change and water availability in Indian agriculture: Impacts and adaptation. Indian Journal of Agricultural Sciences 84(6): 671-679. https://doi.org/10.56093/ijas.v84i6.41421 

Saha, U.; Sateesh, M. 2022. Rainfall extremes on the rise: Observations during 1951-2020 and bias-corrected CMIP6 projections for near- and late 21st Century over Indian landmass. Journal of Hydrology 608: 127682. https://doi.org/10.1016/j.hydrol.2022.127682 

Sarkar, B.; Islam, A.; Majumder, A. 2021. Seawater intrusion into groundwater and its impact on irrigation and agriculture: Evidence from the coastal region of West Bengal, India. Regional Studies in Marine Science 44: 101751. https://doi.org/10.1016/j.rsma.2021.101751 

Sarkar, C.S.; Chakraborty, A. 2021. Historical trend of cyclone over the Bay of Bengal and people's perception about coping with cyclone in Kakdwip block of South 24 Pargonas, West Bengal, India. Turkish Online Journal of Qualitative Inquiry 12(7): 2904-2924.

Welch, J.R.; Vincent, J.R.; Auffhammer, M.; Moya, P.F.; Dobermann, A.; Dawe, D. 2010. Rice yields in tropical/subtropical Asia exhibit large but opposing sensitivities to minimum and maximum temperatures. The Proceedings of the National Academy of Sciences 107 (33): 14562-14567. https://doi.org/10.1073/pnas.1001222107

Zhao, C.; Liu, B.; Wang, X.; Lobell, D.B. Huang, Y. et al. 2017. Temperature increase reduces global yields of major crops in four independent estimates. The Proceedings of the National Academy of Sciences 114 (35): 9326-9331. https://doi.org/10.1073/pnas.1701762114 

কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় বৃত্তাকার অর্থনীতি (Circular Economy in Agro-food System)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আমরা আমাদের খাদ্যের দিকে একটু তাকাই, দেখবো খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে, তা ব্যবহার হচ্ছে এবং অব্যবহৃত অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা সরলরেখার ন্যায় (Linear economy)। উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste)। কিন্তু এই যে অংশটি ব্যবহার হচ্ছে না, তা উৎপাদন করতেও তো পয়সা লেগেছে। শুধু যে পয়সা লেগেছে, এমনটা নয়, জমি লেগেছে, জল লেগেছে, সার লেগেছে, আবার সেই অতিরিক্ত সার পরিবেশের উপর ঋণাত্মক প্রভাবও ফেলেছে - এ সকলই তো বৃথা গেলো, কোনো উপকার তো হলোই না, বরং অপকার হলো। কাজেই, এই উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste) মডেলটি কার্যকরী হচ্ছে না। তবে কি করতে হবে? এই সরলরৈখিক সম্পর্কটিকে বৃত্তাকার সম্পর্কে (Circular economy) পরিণত করতে হবে। অর্থাৎ কিছু নষ্ট করা চলবে না, পুনর্ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য দিতে হবে। এই বৃত্তের তিনটি অংশ, যথা- সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী উৎপাদন (Sustainable production), সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী ব্যবহার (Sustainable use), এবং পুনর্ব্যবহার (Recycle)।  

সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী উৎপাদন হলো এমন এক উৎপাদন পদ্ধতি যাতে প্রকৃতির উপর অধিক চাপ পড়বে না, প্রাকৃতিক সম্পদের (ভূমি, জল ইত্যাদি) অতিরিক্ত শোষণ হবে না, আবার অতিরিক্ত মাত্রায় ইনপুট (রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হার্বিসাইড ইত্যাদি) প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করবে না। এর প্রধান উপাদান হলো সাস্টেনেবল কৃষি অনুশীলন, যেমন অর্গানিক ফার্মিং, অ্যাগ্রোফরেষ্ট্রী, ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (Integrated Pest Management), উপযোগী সেচ ব্যবস্থা, বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি, অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার না করা ইত্যাদির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা (অনুগ্রহ করে পড়ুন বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা)। একথা সঠিক যে, এর জন্যে গবেষণা এবং পরিকাঠামোর প্রয়োজন। পেস্ট কীটের জীবন চক্র পর্যালোচনা করে, যাকে ফেনোলজি বলা হয়, কোন সময়ে আধিক্য হবে তা সহজেই নিরূপণ করা যায় এবং রাসায়নিকের উপযুক্ত মাত্রা নির্ধারণ করাও কঠিন নয়, কাজেই এর মাধ্যমে অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সহজেই হ্রাস করা যায়, এবং প্রকৃতির উপর এর কুপ্রভাবগুলিকে এড়ানো সম্ভব। আজ অনেক অঞ্চলে অতিরিক্ত সারের ব্যবহারের ফলে মৃত্তিকার অবনমন ঘটেছে, এরূপ ঘটতে থাকলে ভবিষ্যতের খাদ্য উৎপাদন প্রশ্নের সামনে পড়বে। কৃষিক্ষেতে যেমন জলের প্রয়োজন, ঠিক তেমনই অতিরিক্ত জল অপ্রয়োজনীয়। তাই যতটুকু জল প্রয়োজন ঠিক ততটুকু জলই ব্যবহার করা উচিত, এই কারণে উন্নত সেচের ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন, এতে ফলনের কোনো ঘাটতি হবে না আবার জলের অপচয়ও বন্ধ হবে। এই সকল কার্যসাধনের জন্যে নীতি (Policy) নির্ধারণ প্রয়োজন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন কৃষি নীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় এই বিষয়ে আমাদের দেশ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীতি প্রণয়ন করেছে যার মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চাই যোজনা, ক্ষুদ্র সেচ তহবিল গঠন ইত্যাদি।

আরবান কৃষি (Urban agriculture) একটি খুবই উপযোগী পদ্ধতি, এর মাধ্যমে খাদ্য তথা পুষ্টি নিশ্চয়তা যেমন একাধারে বৃদ্ধি পায় তেমনই পরিবেশের কার্বন সিকোয়েস্ট্রেট (Carbon sequestrate) করতেও গাছগুলি সাহায্য করে। সাস্টেনেবল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন। কৃষক কোঅপারেটিভ গড়ে তুলে কিংবা কমিউনিটি সমর্থিত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলে সাস্টেনেবল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। 

এর পর আসি সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী ব্যবহারে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এক্ষেত্রে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে আর সব কিছুর সাথে সাথে খাদ্যেরও বিশ্বায়ন হয়েছে, যদিও আমাদের খাদ্য তালিকায় যেরূপ পিজ্জা বা বার্গার প্রবেশ করেছে সেরূপ বিদেশে কোনো স্থানে আমাদের খিচুড়ি, বা নলেন গুড় পরিবেশিত হতে আমি দেখিনি (অনুগ্রহ করে পড়ুন আমাদের খাদ্যের পশ্চিমায়ন)। যাইহোক, সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। এখন ক্রেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুষম আহার বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ অবহিত হয়েছেন বা ধীরে ধীরে অবহিত হচ্ছেন। যদিও এর গতি আরও একটু বৃদ্ধি পেলে ভালো হয়। খাদ্যে সকল প্রকার নিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতি নিয়ে মানুষ সচেতন হলে খাদ্যের বৈচিত্র্য বাড়বে, যা প্রকারান্তরে পুষ্টির নিশ্চয়তাকে বৃদ্ধি তো করবেই এবং জীব বৈচিত্র্যকেও সমর্থন করবে। আজ ক্রেতারা অনেক বেশি সচেতন সে কথা পূর্বেই বলেছি, এই সচেতনতা যে কেবল মাত্র খাদ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে তা নয়, খাদ্যটি কিরূপে উৎপন্ন হয়েছে সেটি নিয়েও সচেতনতা রয়েছে।  আজকাল আমরা প্রায়ই বিভিন্ন প্রোডাক্টের লেবেলে 'অর্গানিক' কথাটি লিখে থাকতে দেখি, অনেকে একটু দাম বেশি হলেও সেটি ক্রয় করেন কারণ খাদ্যটির মধ্যে রাসায়নিক দূষণ যেমন তাঁরা পছন্দ করেন না তেমন পরিবেশের দূষণও সচেতন মানুষ পছন্দ করছেন না। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ক্রেতাদের সচেতনতার পাশাপাশি কিন্তু বিক্রেতাদেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমি যখন আমার দেশে বাজার করতে যাই প্রয়োজন মতন শাক-সব্জি কিনতে পারি, কোনোটা সাড়ে সাতশো গ্রাম, কোনটা দেড় কেজি, আবার কোনটা দেড়শো গ্রাম; অর্থাৎ যেটা যতটা লাগে। কিন্তু আমি যখন অন্য একটি উন্নত দেশে বিশাল এক শপিং মার্টে বাজার করার জন্যে উপস্থিত হই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিক্রেতার হিসেবে পূর্ব নির্ধারিত ওজনের দ্রব্যই কিন্তু আমাকে কিনতে হয়, নিজের প্রয়োজন মতন নয়। এতে কোনো দ্রব্য হয়তো ৫০০ গ্রাম প্রয়োজন কিন্তু আমি ১ কেজি নিয়েছি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ব্যবহার না হাওয়ায় সেটি পচে নষ্ট হয়েছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের মতন দেশগুলির খাদ্যদ্রব্য যেটুকু নষ্ট হয় তার অধিকাংশ হয় ফসল তোলার সময়ে। দেশের বাড়িতে বেগুনে পোকা পাওয়া যায় বৈকি, তবে সব্জি ঘরে থেকে পচে যায়না, কারণ বাজার প্রয়োজন অনুযায়ী করা হয়। কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে ফসল তোলার সময়ে নষ্ট হয় না, তা মূলত নষ্ট হয় এইভাবে। 

কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যে একটি বৃত্তাকার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য হ্রাস পরিবেশের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে পুনর্ব্যবহার করার একটি উদাহরণ হল অন্যান্য প্রক্রিয়ার জন্য মূল্যবান ইনপুট তৈরি করতে কৃষি উপ-পণ্যের ব্যবহার। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, শস্য সংগ্রহ থেকে অবশিষ্ট উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ, যেমন ডালপালা এবং পাতা, কম্পোস্টিং এর মাধ্যমে জৈব সার তৈরি করার জন্য পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি শুধুমাত্র ল্যান্ডফিল থেকে এই উপাদানগুলিকে সরিয়ে দেয় না তবে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলিকে মাটিতে ফিরিয়ে দিয়ে পুষ্টির ঘাটতি বন্ধ করে দেয়। ফলস্বরূপ, এটি স্বাস্থ্যকর এবং আরও উর্বর কৃষি জমিকে উন্নীত করে, কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্থায়ী এবং বৃত্তাকার পদ্ধতির সমর্থন করে। এই ধরনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য অনুশীলনগুলিকে বৃদ্ধি করে, শিল্প পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস, সম্পদ সংরক্ষণ এবং আরও স্থিতিস্থাপক এবং সুস্থায়ী খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরিতে অবদান রাখতে পারে।       

বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা (Ecosystem-based-Adaptation and Food Security)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্বের একটি ব্লগে আমি (বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য) বাস্তুতন্ত্র কিরূপে আমাদের খাদ্য সংস্থান বিষয়ে পরিষেবা প্রদান করে সেই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। এই ব্লগটিতে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে খাদ্য সংকট উৎপন্ন হচ্ছে তার মোকাবিলা বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভর করে কিরূপে করা সম্ভব তার উপর আলোচনা করবো। 

বর্তমান পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তারফলে উত্থিত সমস্যাগুলিকে মোকাবিলা করা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যাগুলির অন্যতম সমস্যা হলো খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া। এখন প্রথম প্রশ্ন জলবায়ু পরিবর্তন কেন হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনভূমি হ্রাসপ্রাপ্ত হওয়া, জলাশয়গুলি বুজিয়ে ফেলা, প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত শোষণ (Overexploitation), স্ট্রিপ মাইনিং, ফ্র্যাকিং ইত্যাদি। এই সকল কারণের ফলে আজ আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। পরবর্তী প্রশ্ন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কি হচ্ছে ? এর ফলে (১) তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে (Increasing temperature), (২) বৃষ্টিপাতের ধরণে পরিবর্তন আসছে (Changing precipitation pattern), (৩) চরম আবহাওয়া জনিত ঘটনাগুলির তীব্রতা এবং সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে (Increasing intensity and frequency of extreme weather events), (৪) জলবায়ুর পরিবর্তনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত (Increasing unanticipated climate variability)। এই যে পরিবর্তন এর প্রভাব কিন্তু আমাদের জীবনের সর্বত্র পড়ছে। আজ এই ব্লগটিতে আমরা আলোচনা করবো খাদ্য নিরাপত্তার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি এবং কিরূপে তার মোকাবিলা করা যায়।  

প্রথমেই উল্লেখ করেছি তাপমাত্রা বৃদ্ধির কথা। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাব্য ফলগুলি হলো ফসলের ফলন কমে যাওয়া, গবাদিপশুর মধ্যে হিট স্ট্রেস, পরাগসংযোগকারী কীট পতঙ্গের ব্যাঘাত ঘটা, ক্ষতিকারক পেস্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, ফসল ও গবাদি পশুর রোগ বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে কিন্তু আবার জলস্তরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কাজেই পৃথিবীর অনেক অঞ্চল আজ জলের তলায় নিমজ্জিত হচ্ছে বা অদূরেই হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। এবার বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তনের ফলে কি কি হচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে অতিবৃষ্টির কথা শুনছি, কখনো অতিবৃষ্টি আর তার ফলে বন্যা তো আবার কখনো অনাবৃষ্টি তথা খরা সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানের কৃষিব্যবস্থা কিন্তু বৃষ্টিনির্ভর (Rainfed agriculture), এখন এই বৃষ্টিপাত যদি সঠিক সময়ে এবং সঠিক পরিমানে না হয় তবে তা যে কৃষিকাজ এবং অবশ্যই ফলনে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে তা বলাই বাহুল্য। পূর্বের তুলনায় চরম আবহাওয়া জনিত ঘটনাগুলির তীব্রতা এবং সংখ্যা বৃদ্ধি প্রতি বছরই চোখে পড়ছে। আর এর ফলে মানুষ ঘরবাড়ি, চাষজমি, গবাদিপশু সবই হারাচ্ছে।  এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। এই যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপদ (Natural hazard) সেগুলি যে বর্তমানে প্রায়ই বিপর্যয়ে (Disaster) পরিণত হচ্ছে তার পিছনেও কিন্তু আমাদের অপরিকল্পিত এবংঅনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাগুলিই দায়ী, যেগুলির উল্লেখ আমি জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছি। এই পরিবর্তনগুলির ধরণ এতটাই অপ্রত্যাশিত হয়ে পড়ছে যে তা আগে থেকে অনুধাবন করা বা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। আশা করি বোঝা গেলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের খাদ্যে তা কি মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে বা ভবিষ্যতে আরও বেশি করতে চলেছে। কাজেই সচেতনতার প্রয়োজনই যে শুধু রয়েছে তাই নয়, উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় এসে গেছে। 

এই ব্যবস্থাগুলি কিরূপ বা প্রশ্ন করা ভালো, এই ব্যবস্থাগুলির ভিত্তি কি? এর ভিত্তি হলো প্রকৃতির ধারণক্ষমতার (Sustainability) উপর সর্বাগ্রে গুরুত্ব আরোপ করা। অর্থাৎ এমন ব্যবস্থা প্রয়োজন যা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করার পাশাপাশি প্রকৃতির ধারণক্ষমতাকেও বিপর্যস্ত করবে না। যেমন ধরো, বনভূমি ধ্বংস করে কৃষিজমি প্রস্তুত হবে না, এমন কৃষিব্যবস্থা যাকে আমরা নিবিড় কৃষি (Intensive agriculture) বলে অভিহিত করে থাকি যা ফলন বা ফসলের উৎপাদনশীলতাকে (Yield) সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় এরূপ ব্যবস্থার থেকে সাস্টেনেবল কৃষিব্যবস্থার (Sustainable agriculture) উপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে, ফসলের স্থানীয় ভ্যারাইটিগুলিকে (Local variety) সংরক্ষণ করা ইত্যাদি। এই প্রকার ব্যবস্থাগুলিকে কিরূপে প্রয়োগ করা যেতে পারে, সেই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় বাস্তুতন্ত্র ভিত্তিক অভিযোজন (Ecosystem-based-adaptation/EbA) খুবই উপযোগী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষকে সাহায্য করার জন্য একটি সামগ্রিক অভিযোজন কৌশলের অংশ হিসাবে জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্র পরিষেবার (পড়ুন বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য) ব্যবহার হলো EbA-র মূল ভিত্তি।


এস্থানে EbA-র কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।       

উদাহরণ ১

যেমন ধরো, কোনো অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই হ্রাস পেয়েছে এর ফলে ওই অঞ্চলের যদি বা জলাশয়গুলিতে জলের পরিমাণ বৎসরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হচ্ছে, এবং এই পরিমাণের পার্থক্য খুবই বেশি হচ্ছে। আগে যেখানে সারা বৎসর মোটামুটি জল থাকতো এবং এর উপর ভিত্তি করে মানুষের জীবন-জীবিকা গড়ে উঠেছিল এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে আবার ওই অঞ্চলের জমি ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পাহাড়ের ঢালগুলি ধীরে ধীরে ভ্রান্ত জমি ব্যবহারের (Inappropriate land management practice) ফলে ধীরে ধীরে অবনমিত (Degradation) হয়ে গেছে, প্রচুর পরিমানে বনাঞ্চল ধ্বংস এবং তার ফলে ভূমিক্ষয় (Soil erosion) এর পিছনে দায়ী। এর মধ্যে আবার ওই অঞ্চলের জমি ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পাহাড়ের ঢালগুলি ধীরে ধীরে ভ্রান্ত জমি ব্যবহারের (Inappropriate land management practice) ফলে ধীরে ধীরে অবনমিত (Degradation) হয়ে গেছে, প্রচুর পরিমানে বনাঞ্চল ধ্বংস এবং তার ফলে ভূমিক্ষয় (Soil erosion) এর পিছনে দায়ী। আবার জনসংখ্যাও দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে, তার একটা চাপ প্রকৃতির উপরে পড়েছে। অপরিকল্পিত ভাবে বসতি অঞ্চল গড়ে উঠায় প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে, যথেচ্ছ জলের ব্যবহার হচ্ছে, বন কেটে বসতি জমি গড়ে উঠছে ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই ওই অঞ্চল বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠছে। বর্ষাকালের সময় অতিবৃষ্টির কারণে প্রায়ই বন্যা হয়, আশপাশের সব ঘর বাড়ি, গবাদি পশু, চাষজমি সব ভাসিয়ে দেয়, তারপর কিছুদিন পর থেকে বৎসরের বাকি সময়ে আর বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না, ধীরে ধীরে জলাশয়গুলো শুকোতে থাকে। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জল পাওয়া যায় না, পাম্প লাগিয়ে ভূগর্ভস্থ জল তুলে তা ব্যবহার করতে হয়, আগে ১০ মিনিট পাম্প চালিয়ে যতটা জল তোলা যেত এখন সেই পরিমান জল তুলতে প্রায় আধ ঘন্টা লাগে। আগে মাছ ধরে যে সকল মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করতো তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাজেই জীবিকাতে একটা পরিবর্তন হয়েছে, কৃষিকাজ ছেড়ে অনেকেই বড়ো শহরে চলে যাচ্ছেন অন্য কর্মসন্ধানে। পূর্বে যারা মৎস্যজীবি ছিলেন তাঁরাও এখন এই পথই অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।  স্বাভাবিকভাবেই ওই অঞ্চল বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠছে। এবার উপায় ? 

উপায় একটা হলো, ওই অঞ্চলের যে সকল কৃষক ছিলেন, তাঁরা এগিয়ে এলেন। প্রথমেই পাহাড়ের ঢালগুলিতে বৃক্ষ রোপণ করা হলো। গাছগুলির মধ্যে স্থানীয় গাছের প্রজাতিগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া হলো। ধীরে ধীরে এগ্রোফরেস্ট্রি সিস্টেম (Agroforestry system) গড়ে তুললেন, ফসলের সাথে সাথে বৃক্ষ রোপণের অনুশীলনের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেলো, জল ধারণ ক্ষমতা বাড়লো,এর প্রভাব ফলনের উপর পড়লো, ফলন বৃদ্ধি পেলো। আর ওই যে পাহাড়ের ঢাল গুলিতে পুনর্বনায়নের (Reforestation) মাধ্যমে ভূমিক্ষয় তো রোধ হয়েই ছিল, এখন অতিবৃষ্টিতে সহজেই ধ্বস নেমে প্রাকৃতিক বিপদ বিপর্যয়ে পরিণত হয় না। তারপর তাঁরা বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করলেন, ফলে ভূগর্ভস্থ জলের প্রয়োজনীয়তা কমল। এই যে স্থানীয় মানুষ নিজেদের সহায়তায় বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবা কে ব্যবহার করে আনসাস্টেনেবল অবস্থা থেকে একটা সাস্টেনেবল অবস্থায় ফিরিয়ে আনলেন, এবং ক্ষয়প্রাপ্ত একটি অঞ্চলকে পুনর্জীবন প্রদান করলেন, এই ব্যবস্থাটাই হলো বাস্তুতন্ত্র ভিত্তিক অভিযোজন।     

উদাহরণ ২

আবার ধরো, একটি ম্যানগ্রোভ অঞ্চল। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যথেচ্ছ বন কেটে ফেলে বাসভূমি গড়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি বেশ কয়েক বৎসরে ধরে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে, পূর্বে পাঁচ দশ বৎসরে একটা প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা হতো, আজকাল প্রতি বৎসরই কোনো না কোনো ঝঞ্ঝা হয়, স্থানীয় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, সব ঠিকঠাক হওয়ার আগেই আবার একটি ঝড় এসে উপস্থিত হয়। এ অঞ্চলে মানুষের জীবিকা বলতে প্রধানত কৃষিকাজ, মাছ ধরা এবং গৃহপালিত পশুপালন ছিল। কৃষিকাজ  ছিল মূলত বৃষ্টি নির্ভর।  জ্বালানির কাঠ-কুটো, ঘর ছাওয়ার পাতা, গাছের খুঁটি ইত্যাদি জঙ্গল থেকেই আসত, গবাদি পশুরাও চড়তো  মাঠে ঘাটে। মৎস্যজীবিরাও স্থানীয় প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখন খুব বৃষ্টি হওয়ার দরুন প্রচুর জমি জলের তলায় চলে গেছে, পশু চারণের স্থান প্রায় নেই বললেও হয়।  তাদের রোগের প্রাদুর্ভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় মানুষ এখন আর পশুপালন করতে পারছেন না, আগে গৃহপালিত গরু, বা ছাগল থেকে দুধ পাওয়া যেত সহজেই, এখন তা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অধিক বৃষ্টিপাত  এবং ঝড় ঝঞ্ঝায় চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, বন্যা হয়ে মাটির চরিত্রে পরিবর্তন ঘটেছে, লবনাক্ত হয়ে পড়েছে, কৃষিকাজও খুব ভালো হচ্ছে না, ফলন কমেছে। এর প্রভাব জন জীবনে পড়েছে, বিশেষ করে তাঁদের খাদ্য ব্যবস্থায়। এখন কি উপায় ? 

একটি সংস্থা এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় একসাথে ৬০ জন স্থানীয় নারী পুরুষকে ম্যানগ্রোভ বনের উপযোগিতা সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ প্রদান করলো। তাঁরা ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গুরুত্ব পরিষেবা সম্পর্কে বিশদে অবহিত হলেন, এর পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বৃক্ষ প্রজাতিগুলির চারা গাছ তৈরী করলেন। সেই চারা গাছ রোপণ করা হলো, ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধার সম্ভব হলো। উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার (Mangrove restoration) ও সংরক্ষণ ঝড়ের জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করলো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলির বিরুদ্ধে একটি বাফার প্রদান করলো, যেমন বন্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করলো, এখন আর এগুলির ফলে কৃষিজমি জলে নিমজ্জিত হয় না, ফসল নষ্ট হয়না ইত্যাদি। এটি মৎস্য চাষকেও সমর্থন করে। বাস্তুতন্ত্র নির্ভর মৎস চাষ এবং কাঁকড়া চাষ সম্পর্কে প্রচার এবং প্রশিক্ষণের ফলে সেগুলি প্রোটিনের উৎস হলো এবং এই চাষগুলি স্থানীয় মানুষদের জীবিকার সাথে যুক্ত হয়ে তাঁদের অর্থ উপার্জনের অন্যতম একটি পথ হয়ে উঠলো। 

উদাহরণ ৩

একটি জলাভূমি অধ্যুষিত অঞ্চল। কিন্তু সম্প্রতি কিছু  বৎসর যাবৎ বৃষ্টিপাতের ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে, বৃষ্টিপাত এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে খরা সৃষ্টি হচ্ছে, জলাশয়গুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আবার প্রায় শুকিয়ে যাওয়া জলাগুলি বুজিয়ে বাসজমি তৈরী হচ্ছে। এইবার জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে এখন বৃষ্টিপাত হলেই বন্যা হয়ে যায় কিন্তু সেই জল ধরে রাখা যায় না। কয়েক বৎসর পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলের মানুষ কৃষিকাজ ও পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন আর সেই ফলন নেই, কৃষিজমিতে প্রয়োজনও পরিমানে জলের জোগান নেই। আবার তাপপ্রবাহের ফলে ফসল নষ্ট হচ্ছে। পশুচারণের মাঠগুলিরও অবস্থা খারাপ, পশুখাদ্যের প্রয়োজনীয় ঘাস তেমন একটা উৎপন্ন হয়না। হিট স্ট্রেসের কারণে গবাদি পশুও মারা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় মানুষের খাদ্য সংস্থানের উপর প্রশ্নচিহ্ন দেখা যাচ্ছে।  এরূপ চলতে থাকলে অচিরেই যে পুষ্টির নিরাপত্তা ব্যাহত হবে তা বলাই বাহুল্য। তবে এখন কি উপায়?

উপায় হলো জলাভূমি পুনরুদ্ধার (Wetland restoration) করা। জলাভূমি পুনর্বাসন জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে, জলের গুণমান উন্নত করতে এবং জলজ প্রজাতির জন্য বাসস্থান সরবরাহ করতে সহায়তা করতে পারে। জলাভূমি বন্যার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক বাফার হিসেবেও কাজ করে এবং কৃষি ও মৎস্য চাষে সহায়তা করতে পারে। জলাশয়গুলো পুনর্নির্মাণের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন অবশ্যই তবে তা ধরে রাখতে কি করা যায়। স্থানীয় মানুষজন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের বিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা করে  ঠিক করলেন এই অঞ্চলে স্থানীয় গাছ লাগাতে হবে, এই গাছগুলিই একদিকে যেমন কার্বন সিকোয়েস্ট্রেট (Carbon sequestrate) করে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকে ব্যালান্স করবে, আবার মাটিতে জল ধরে রাখার কাজও করবে। এর ফলে জলাভূমিগুলি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে, জীব বৈচিত্র আবার ফিরে আসবে আশা করা যায়। খাদ্য সংস্থান সম্ভব হবে।

আশা করি বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন কিরূপে জলবায়ু পরিবর্তনকে সামলে খাদ্য সংস্থান কে নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে তা কিছুটা বোঝা গেলো।

ঊড়িষ্যার কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদ: আমার অভিজ্ঞতা (Some special food items in Orissa: My experience)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পড়াশুনা বা কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে থাকার সুযোগ আমার হয়েছে, সেই সুবাদে বিভিন্ন স্থানের খাদ্যবস্তুগুলির স্বাদ গ্রহণ আমি করেছি। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এমনকি কখনও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন রকমের খাদ্য গ্রহণের প্রচলন রয়েছে। এই ব্লগটিতে আমি আমার অভিজ্ঞতার ঊড়িষ্যার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থানীয় খাদ্যের কথা বলবো।

জীবনের কয়েক বৎসর আমি ঊড়িষ্যা রাজ্যে কাটিয়েছি, সে প্রায় বছর পনেরো-কুড়ি আগের কথা। অনেক মানুষ জগন্নাথদেব দর্শনের উদ্দেশ্যে পুরী বেড়াতে যান, তাঁরা নিশ্চয়ই ভগবানের মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেছেন। পুরী শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁতে উড়িষ্যার খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করেছেন। কলকাতা শহরে অনেক পাইস হোটেল রয়েছে যেখানে ওড়িয়া ঠাকুর রান্না করেন। রান্নার কাজে ওড়িয়া ঠাকুর বেশ দক্ষ, ক্যাটারিঙে বা হোটেলে রান্নার জন্যে তাঁদের চাহিদা বেশ। বাংলা সাহিত্যেও এর অনেক উল্লেখ রয়েছে। যাইহোক, আমি থাকতাম গঞ্জাম (Ganjam) জেলার ব্রহ্মপুর বা বেরহামপুর (Berhampur) শহরে, দক্ষিণ ঊড়িষ্যার একটি শহর। বিভিন্ন ধরণের আচার আর পাঁপড়ের জন্যে এ শহর প্রসিদ্ধ। তবে যতদিন সেই শহরে আমি থেকেছি, কোনোদিনই আমি তা কিনিনি। পরে যখন সেই শহরে কোনো কাজে গিয়েছি তখন তা কিনেছি, এবং সেগুলির স্বাদ গ্রহণ করে পরিচিত মহলে যথেষ্ট প্রসংশা করেছি। বেরহামপুর বসবাসের সময় অধিকাংশ দিনই প্রাতঃরাশ করা হতো না, ছুটির দিনে যেদিন তা সম্ভব হতো তা ছিল পাড়ার দোকানের শালপাতার ঠোঙ্গায় তিনটি ছোট আকারের আটার পুরি, আলুর তরকারী, আর এক হাতা উপ্মা। এর দাম ছিল পাঁচ টাকা। যদি কেউ উপ্মা না নিতেন তবে দোকানি তাঁকে পাঁচটি পুরি দিতেন। কখনও দোকানে বসে খেয়ে আসতাম আবার কখনও যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেখানে জেঠিমা যদি তাঁদের বাড়ির জন্যে আনতে দিতেন তবে আমিও আমার খাবার নিয়ে বাড়িতেই আসতাম। তবে দোকানে দাঁড়িয়ে খাওয়ার একটা সুবিধা ছিল, ক্রেতা চাইলে দোকানি আরও একবার তরকারী দিতেন। প্রাতঃরাশের অন্যান্য পদও ছিল যেমন ইডলি, বড়া ইত্যাদি। তবে স্থানীয় মানুষ অধিকাংশ সময়ে 'পাখালা' দিয়ে প্রাতঃরাশ সারেন। ঊড়িষ্যার প্রচন্ড গরমে এই 'পাখালা' খুবই কার্যকারী। পাখালা ছাড়া ওড়িশার খাবার অসম্পূর্ণ। আমাদের যেমন পান্তাভাত ঠিক তেমনই ওড়িশার মানুষের 'পাখালা ভাত'। যদিও আমি এই পদটি ওড়িশাতে কখনও খাইনি তবে আমার বন্ধুদের মুখে শুনেছি, আমাদের ভাড়া বাড়ির জেঠিমাদেরও খেতে দেখছি। পাখালা প্রধানত দুই রকমের হয়, ১. ভাতে জল এবং টক দই দিয়ে  সারারাত ধরে রাখা হয়, এতে খাবারটি ফার্মেন্ট (Ferment) হয়, একে বাসি পাখালা বা কখনও দই পাখালা বলা হয়; ২. অপরটি হলো সাজা পাখালা, এ ক্ষেত্রে ফার্মেন্ট করা হয় না, ভাতে টকদই আর জল যোগ করে পেঁয়াজ, লঙ্কা  এবং বড়ি সহযোগে খাওয়া হয়।

চা আমি সেই সময় বিশেষ খেতাম না, তবে বিকেলে একটি পাড়ার চায়ের দোকানে নিয়মিত বন্ধুদের সাথে যেতাম, অধিকাংশ দিনই আমি কিছু স্থানীয় বেকারির বিস্কুট কিনে খেতাম। সান্ধ্যকালীন খাবারের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল ব্রেড চপ, বাঁধাকপির কাটলেট, সিঙ্গাড়া ইত্যাদি। এখানে প্রতিটি পদের সাথে তরকারি পরিবেশন করা হয়। চপগুলি ভেঙে তরকারী দিয়ে মেখে খাওয়াটাই এখানে রীতি।

দুপুরে বেশিরভাগ দিন কলেজে থাকার কারণে দুপুরের খাবার প্রায় হতোই না বলা চলে, তবে বিকেলের দিকে বেশ খিদে পেতো, তখন বেশ ভারি কিছু খাবার খেতাম। পাড়ার মোড়ের কাছে একটি রেস্তোরাঁ ছিল, সেখানে সাত টাকায় একটি মশলা দোসা পাওয়া যেত সেই সময়ে, এটা বেশ উপাদেয় ছিল আমার কাছে। সেই দোকানটির সামনে দিয়ে বড়ো রাস্তাটি গিয়েছে, রাস্তার অপর পাড়ে একটি মিষ্টির দোকান ছিল সেখানে দশ টাকায় একটি বড়ো গ্লাস লস্যি পাওয়া যেত, দোকানি লস্যির উপরে নারিকেল কুড়োনো, কাজু-কিশমিশ-আলমন্ডের টুকরো ইত্যাদি দিতেন, এটা সুস্বাদু তো ছিলই এবং উদরপূর্তিও করতো। এখানে একটা কথা বলি, দোকানি লস্যির গ্লাসে শুকনো ফলের টুকরোর সাথে লাল রঙের চেরীও দিতেন, তখন যেটি চেরী বলে জানতাম তা বোধ করি করমচা-কে চিনির রস আর লাল রং সহযোগে প্রস্তুত করা এক ধরণের বস্তু। আমি প্রকৃত চেরী নামক ফল কখনও আমার দেশে দেখিনি (পাওয়া যায় নিশ্চয় তবে আমার চোখে তা পড়েনি), তা দেখছি বাইরের দেশে। চেরী ফল আর যা আমাদের দেশে চেরী বলে কেক, সন্দেশ বা লস্যিতে দেওয়া হয় তাদের মধ্যে কোনোরূপ সাদৃশ্য নেই, তা বলাই বাহুল্য। পানীয়র কথা যখন উঠলোই, একখানি ঘটনা উল্লেখ করি। 

একবার রেলগাড়িতে চলেছি বেরহামপুরে, রেলস্টেশনের নাম ব্রহ্মপুর। সকাল ৭ টা ২০ তে হাওড়া ছেড়ে সন্ধ্যে সাড়ে ৫ টা নাগাদ নামিয়ে দেবে গন্তব্যে। গরমকাল, তাপমাত্রা প্রায় ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আশেপাশে। রেলের কামড়া-র পাখাগুলো চললেও তা যে খুব যুৎসই হচ্ছে তা না, তারপরে এটি অনারক্ষিত কামড়া, কাজেই বেশ ভিড়। চিল্কা হ্রদটি ছাড়িয়ে একটু পরে ট্রেনটি পড়ল দাঁড়িয়ে, এ ঘটনা ভারতীয় রেলের জন্যে বিছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা যাত্রীরাও এটি অভ্যেস করে নিয়েছি। এমনকি  নিত্য যাত্রীরা তো জানেন ঠিক কোনখানে ট্রেনটি দাঁড়াবে বা ধীরে চলবে, সেই মতন তাঁরা নামার পরিকল্পনাও করে রাখেন।  যাইহোক, এই ঘটনাটি সেই বর্ণনা নয়। ট্রেন তো দাঁড়িয়ে পড়লো, ভুবনেশ্বরের পর ভিড়টা একটু পাতলা হয়েছে। একজন আদিবাসী বৃদ্ধা উঠে এলেন কামড়ায়, ঘোল বেচতে এসেছেন। গলা শুকিয়ে গেছিলো, এক গ্লাস ঘোল ৫ টাকায় বিক্রি করছিলেন। মাটির পাত্র করে এনেছেন, আর স্টিলের গ্লাসে দিচ্ছেন, খেয়ে সেটা ফেরত দিয়ে দিতে হবে। আমিও কিনলাম এক গ্লাস, গলায় ঢেলে প্রাণ ঠান্ডা হলো কিছুটা, আমি পয়সা দিয়ে দিলাম। বৃদ্ধা সেটি নিয়ে রেখে দিলেন, আবার আমার গ্লাসটায় ঘোল ঢেলে দিলেন কিন্তু আর পয়সা নিলেন না। আমার বুদ্ধি পরিণত হতে সময় লেগেছে, এটা আমি জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোকে দেখে বুঝতে পারি। আমি জোর করেও পয়সাটা দিতে পারতাম হয়তো, কিন্তু দু'বার বলার পরে সে যখন নিল না আমি রেখে দিলাম। এটাই ভারতবর্ষের আসল রূপ। এই রূপ আমি দেখেছি প্রতিনিয়ত, আজ অনেকটা দিন পেরিয়ে এসে পৃথিবীর অতি আধুনিক শহরের জীবনের মাঝেও তাই প্রায়ই মন চলে যায় দেশে, ফিরে পেতে চায় সেই মানুষগুলোকে, যাঁদের মানবিকতাই এই সভ্যতার ভিত্তি।

আবার অনেক দিন বিকেলে আমরা বন্ধুরা বেড়াতে বেরোতাম, কখনো পুরোনো আবার কখনো নতুন বাস স্ট্যান্ডে। সেই স্থান গুলিতে অনেক রেস্তোরাঁ ছিল, বেরহামপুর খুব যে খরচ বহুল স্থান ছিল তা একেবারেই নয়, তবে সেইটুকুও সর্বদা আমাদের সাধ্যের মধ্যে ছিল না। কাজেই রেস্তোরাঁতে প্রবেশের পূর্বেই আমরা খাবারের দাম জেনে নিতাম। পনেরো-কুড়ি টাকা প্রাতঃরাশ বা বিকেলের খাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বেশি বলেই আমরা সাধারণত গণ্য করতাম। ছুটির দিনে দুপুরে বা প্রত্যহ রাত্রির আহারের ক্ষেত্রে বারো থেকে পনেরো টাকা যথেষ্ট বলে আমরা হিসাব করতাম। প্রত্যহ রাত্রে আমরা বড়ো রাস্তার উপর একটি নির্দিষ্ট হোটেলে খেতে যেতাম, এটি 'ভাইনা'র দোকান বলেই আমাদের কাছে পরিচিত ছিল। ওড়িয়া ভাষায় বড়োভাই কে ভাইনা বলে হয়, দোকানি আমাদের বাবার বয়সী হলেও আমরা তাকে ভাইনা বলেই সম্বোধন করতাম। বারো টাকায় স্টিলের থালার উপর শালপাতায় পেট ভোরে ভাত, ডাল, কিছু একটা ভাজা (প্রধানত আলু), আর মাছের ঝোল পাওয়া যেত। ওখানে মাছের টুকরোকে ব্যাসনের প্রলেপ লাগিয়ে ভাজে যাতে মাছ ভেঙে না যায়। প্রায়ই ভাইনা ফ্রি তে মাংসের ঝোল, কখনও এক টুকরো মাংস দিয়ে যেতেন আমার বন্ধুদের, সেই সময় আমি কোনোপ্রকার মাংস খেতাম না।পনেরো টাকায় দুটি ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত পাওয়া যেত, কখনও কখনও আমি সেটি খেতাম। কুড়ি টাকায় পাওয়া যেত মাংস ভাত। তবে সকল দিন যে আমিষ পাওয়া যেত তা নয়, সপ্তাহের তিন চারদিন আমিষ পাওয়া গেলেও বাকিদিনগুলিতে নিরামিষ আহার পাওয়া যেত, দাম ছিল দশ টাকা। মাঝে মধ্যে আমি আর আমার এক বন্ধু তন্দুর রুটি, ডিমের ওমলেট আর পাহালের রসগোলা কিনে আনতাম রাত্রের খাওয়ার জন্যে। কয়েক বৎসর পূর্বে ঊড়িষ্যা আর বাংলার মধ্যে রসগোল্লার মধ্যে G.I. tag (Geographical Indications tag) নিয়ে একটি লড়াই চলেছিল। বাংলা বলল, ছানা, সুজি, আর চিনির রস উপকরণগুলির সাহায্যে ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে নবীন চন্দ্র দাস রসগোল্লা প্রথম প্রস্তুত করেন। অপরপক্ষে, ঊড়িষ্যা রসগোলার উৎপত্তি বলতে এগারোশো শতাব্দীর কথা উল্লেখ করল, পঞ্চদশ শতকের কবি বলরাম দাসের লেখায় রসগোলা-র উল্লেখ রয়েছে বলে জানালো। কথিত রয়েছে মন্দিরের পুরোহিত পাহাল গ্রামবাসীকে দুধ থেকে ছানা এবং তা দিয়ে রসগোলা সহ ভিন্নভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রস্তুত করা শেখান। আমি এই দুটি মিষ্টিই অনেকবার খেয়েছি, দুইটিই সুস্বাদু, স্বাদ স্বতন্ত্র এবং নামে একরকমের হলেও এদের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বিদ্যমান। দু'টি রাজ্যই সঠিকভাবে তাদের দু'টি মিষ্টির জন্যে G.I. tag পেয়েছে। বাংলার রসগোল্লা যেমন সাদা বর্ণের হয়, ঊড়িষ্যার রসগোলা হয় হালকা বাদামি বর্ণের। বাংলার রসগোল্লা স্পঞ্জি হয়, ঊড়িষ্যার রসগোলা হয় নরম, ভাঙলে আপনি নরম অংশটি দেখতে পারবেন এবং অনুভব করতে পারবেন, রসগোলাটি স্পঞ্জি নয়। স্বাদের দিক থেকেও পার্থক্য স্পষ্ট বোঝা যায়, বাংলার রসগোল্লা ঊড়িষ্যার রসগোলার থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক মিষ্টি হয়। যাঁরা ঊড়িষ্যায় বেড়াতে যাবেন তাঁরা পাহালের রসগোলা খেয়ে দেখলে সঠিকভাবে বুঝতে সমর্থ হবেন। তবে বাংলায় যেমন রসগোল্লা বাংলার খাদ্যের একটি অন্যতম প্রতীক বলে বিবেচিত হয়, ঊড়িষ্যায় কিন্তু রসগোলা সেরূপ নয় বরং ছানা পোড়া বা 'ছেনা পুড়ো' তুলনামূলক একটি অনেক প্রসিদ্ধ মিষ্টি। এর ইতিহাস কিন্তু অধিক প্রাচীন নয়, বিংশ শতাব্দীতে এটি আবিষ্কৃত হয়। ছানাকে, চিনি, দারুচিনি গুঁড়ো, সুজি সহযোগে শাল বা কলাপাতায় বেঁধে কয়লার উনুনে ৩ থেকে ৪ ঘন্টায় ছানা পোড়া প্রস্তুত হয়। আমি একাধিকবার পুরীতে বেড়াতে গিয়ে এর স্বাদ গ্রহণ করেছি তবে বেরহামপুরে তা কখনও খেয়েছি বলে মনে পরে না।     

বেরহামপুরের মানুষের মাতৃভাষা ওড়িয়া, তবে সেখানে অনেক তেলুগুভাষী মানুষও বাস করেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন সম্প্রদায়, ভাষার মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহজেই একে ওপরের বন্ধু পরিজন হয়ে ওঠেন আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সহপাঠীদের বাড়ির অনুষ্ঠানে, পাড়ার কোনো বাড়ির অনুষ্ঠানে তাঁরা আমাদের নিমন্ত্রণ করতেন। একাধিক অনুষ্ঠান বাড়িতে আমি গিয়েছি, বেশিরভাগই বিয়ে বাড়ি। এখানে বিয়ে বাঙালিদের মতন রাত্রে হয়না, দিনের বেলায় হয়, অনেকক্ষেত্রে আবার মন্দিরে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, বিয়েতে নিরামিষ আহার-ই হয়ে থাকে। আমি স্থানীয় বন্ধুদের থেকে শুনেছি বামুন ঠাকুর রাঁধেন অনুষ্ঠান বাড়িতে। এখানে দু'টি পদের কথা উল্লেখ করি, একটি হলো নবরত্ন কোর্মা, অপরটি 'দই- বাইগনা' (দই-বেগুন), এই দু'টি পদ-ই প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানের আহারে থাকে। নবরত্ন কোর্মা অত্যন্ত সুস্বাদু একটি পদ, আমি অনেক রেস্তোরাঁতে এই পদটি দেখেছি। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য পদের মধ্যে রয়েছে দই-ভেন্ডি (দই-ঢ্যাঁড়শ), 'খাজুরি-খাট্টা' (খেজুর, টম্যাটো দিয়ে একটি টক মিষ্টি পদ), 'আম্ব খাট্টা' (আমের টক) ইত্যাদি। এর পর আসি ওপর একটি পদের বিবরণে, এর নাম 'ডালমা'। ডাল, প্রধানত অড়হর বা তুরের ডালে বিভিন্ন প্রকার সব্জি যেমন কুমড়ো, কাঁচকলা, বেগুন, লাউ, পেঁপে ইত্যাদি ছোটছোট করে কেটে দিয়ে একসাথে রান্না করা হয়। এটি ডালমা নাম পরিচিত। এতে পাঁচ ফোড়ন ব্যবহার করা হয়। সরিষার ব্যবহার ঊড়িষ্যা রাজ্যে খুবই ব্যবহার হয়, এখানে আমি শুকনো সরিষা গুঁড়ো করে ব্যবহার করতে দেখেছি। আমি জীবনে প্রথমবার মাশরুম খেয়েছি বেরহামপুর শহরে। প্রথমদিকে আমি যে মেসটিতে থাকতাম, তার অদূরে একটি হোটেলে প্রথবার আমি এটি খেয়েছিলাম। ঊড়িষ্যায় মাশরুমকে ছাতু বলি, আমরা বাঙালিরা বলি ছাতা বা ব্যাঙের ছাতা। সরিষা দিয়ে রান্না করা মাশরুমের পদটির নাম 'ছাতু রাই'। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন শাক যেমন পালং, পুঁই, লাল, কলমি, সজনে, সরিষা, মেথি, মটর ইত্যাদি।

এবার আসি জগন্নাথ দেবের মহাপ্রসাদের বিষয়ে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে ভগবান বিষ্ণু রামেশ্বরমে স্নান সেরে, বদ্রীনাথে ধ্যান করে, দ্বারকায় বিশ্রাম নিয়ে পুরীতে আসেন আহার করতে। প্রত্যহ জগন্নাথদেবকে ৫৬ পদ দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন করতে দেওয়া হয়। আবার মকর সংক্রান্তিতে পিঠে পুলি সহযোগে এই ৫৬ পদ বেড়ে ৮৪টি পদ হয়। এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলি, ভারতবর্ষে চাষবাসের জন্যে বৃষ্টির উপর নির্ভরতা ছিল ভীষণ মাত্রায়, তখন সেচ ব্যবস্থার প্রচলন খুব বেশি ছিল না বা  এতো উন্নত হয়নি। মানুষ ইন্দ্রদেবকে বজ্রপাত, বৃষ্টি ইত্যাদির দেবতা মান্য করতেন। কোনো বৎসর যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হলে কৃষিকাজ ভালো হতো আবার বৃষ্টিপাত না হলে বা আশানুরূপ না হলে কৃষির ক্ষতি হতো এমনকি খরা পর্যন্ত হতো। সঠিক বৃষ্টিপাতের জন্যে যেমন মানুষ ইন্দ্রদেবকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে পূজা করতেন তেমনই আবার বৃষ্টিপাত না হলে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে দেবতার উদ্দেশ্যে আরাধনা করা হতো। তা এমনই এক বৎসর বৃন্দাবনে খুব ভালো বৃষ্টিপাত হলো, কৃষিকাজ বেশ হলো, ঘরে ঘরে ফসল উঠলো, সকল ব্রজবাসীর মুখে হাসি ফুটলো। সকলে ঠিক করলেন যে ইন্দ্রদেবকে ধন্যবাদ দেবেন, তাঁকে পুজো করবেন, শুরু হলো ঘরবাড়ি পরিস্কার, গ্রাম সাজানো, সুস্বাদু সব খাবার প্রস্তুত ইত্যাদি। গ্রামের ছোট বালক কৃষ্ণ এসকল প্রতক্ষ্য করে বললো, 'এ বৃষ্টির জন্যে তোমার কেন ইন্দ্র দেবতাকে পুজো করছ? আকাশের মেঘ তো গোবর্ধন পর্বতের ঢালে প্রতিহত হয়ে এই স্থানে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে। কাজেই গোবর্ধন পর্বতের পুজো করা উচিত'। সকলে কৃষ্ণের বিদগ্ধতা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, তবু যেন একটু ভীত হলেন, কিন্তু অবশেষে মেনে নিলেন। গোবর্ধন পর্বতের পুজো শুরু হলো। এদিকে এসকল দেখে ইন্দ্রদেব তো খুব ক্রুদ্ধ হলেন, বৃন্দাবনে ভয়ানক বৃষ্টিপাত শুরু হলো, ঘরবাড়ি ডুবে গেলো, চাষের জমি ডুবে গেলো। ভীত সন্ত্রস্ত ব্রজবাসী এবার কি করেন, তাঁরা কৃষ্ণের সমীপে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ বললো তাঁরা যখন গোবর্ধন পর্বতের পুজো করার কথা ভেবেছেন তিনিই তাঁদের রক্ষা করবেন। বালক কৃষ্ণ সকল ব্রজবাসীকে নিয়ে গোবর্ধন পর্বতের সামনে উপস্থিত হলো, পর্বতকে উঠিয়ে একটি মাত্র আঙুলের সাহায্যে  ধরে রাখলো, সকল ব্রজবাসী পর্বতের তলায় আশ্রয় নিলেন। কৃষ্ণ এক নাগাড়ে পর্বতকে তুলে রেখেছেন দেখে ব্রজবাসী তাঁকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করলেন, ভাবলেন কৃষ্ণের বিশ্রামের সময় নিজেরা সেই পর্বতকে অনেকগুলি লাঠির সাহায্যে তুলে রাখবেন। কৃষ্ণ তাঁর আঙ্গুল একটু সরাতেই সব লাঠি ভেঙে গেল, পর্বত ভূমিতে আবার বসে যেতে লাগলো। কৃষ্ণ স্বয়ং পুনরায় পর্বতকে ধারণ করলেন। এদিকে কিন্তু ইন্দ্রদেবের ক্রোধ কিছুতেই কমে না, ক্রোধ সর্বদা চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দেয়, এক্ষেত্রেও তাই হলো, তিনি বজ্রপাত করলেন, বৃষ্টির ধারা আরও বৃদ্ধি করলেন, সাতদিন নাগাড়ে চললো এই অবস্থা কিন্তু বুঝতে পারলেন না কোনো সাধারণ বালকের পক্ষে বিশালাকায় এই পর্বতের ভার বহন শুধুমাত্র অসম্ভব নয়, এ কার্য কল্পনারও অতীত। শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করে গেলেন সমগ্র ব্রজবাসীকে। পরিশেষে হার মানলেন ইন্দ্রদেব, বুঝতে পারলেন এই বালক এই বিশাল পর্বত একটি হাতে তুলে রেখেছেন, তিনি স্বয়ং বিষ্ণু, ভুল বুঝতে পেরে নিজের অন্যায় স্বীকার করলেন। এই সাতদিন স্বয়ং ভগবান কোনো খাদ্যগ্রহণ করেননি।  তাই প্রতিদিন তিন ঘন্টা অন্তর আটবার (৩ ঘন্টা  x ৮ বার (বা প্রহর) = ২৪ ঘন্টায় এক দিন), এবং সাতদিন প্রতিদিন আটবার করে মোট ৫৬ বার ভগবান বিষ্ণু যে খাদ্যগ্রহণ করেননি, সেই কারণে এই ৫৬ রকমের ভোগ প্রস্তুত করার প্রচলন হয়। 

ঊড়িষ্যা রাজ্যে অনেক মন্দির রয়েছে যেখানে ভগবানের উদ্দেশ্যে যে ভোগ অর্পণ করা হয় মানুষ তাকে মহাপ্রসাদ বলে গ্রহণ করেন। এই ভোগের অপূর্ব স্বাদ বর্ণনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু যে এই স্থানের তা নয়, যে কোনো স্থানের ভগবানের উদ্দেশ্যে অর্পিত ভোগের খিচুড়ির স্বাদ আমার কাছে বাড়িতে বা দোকানে প্রস্তুত খিচুড়ির থেকে অধিক সুস্বাদু লাগে, তবে এর বৈজ্ঞানিক কারণ নিরূপণে বা বিশ্লেষণে আমি কখনও উৎসাহিত হইনি। ঊড়িষ্যা রাজ্যের বেশ কয়েকটি মন্দিরে ভোগের ক্ষেত্রে দেখেছি সেখানে পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা, ইত্যাদি যে সকল সব্জি বিদেশ থেকে আগত সেগুলির ব্যবহার হয় না। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অনেক হিন্দু সনাতন ধর্মের মানুষ পেঁয়াজ, রসুন খান না। আসলে টম্যাটো, আলু, লঙ্কা সহ বর্তমানে যে সকল সব্জি আমরা ব্যবহার করি তার মধ্যে অনেকগুলিই কিন্তু পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে পশ্চিমী বিদেশী বণিকদের মাধ্যমে আমাদের দেশে পৌঁছয়। মন্দিরগুলিতে ভোগ নিবেদনের রীতি এই সকল শাকসব্জির ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব থেকেই প্রচলিত। ভারতীয় রান্নাতে তাদের ব্যবহার প্রায় অপিহার্য হয়ে উঠলেও অনেক মন্দিরে এ সকল উপকরণ আজও অব্যবহৃত (অনুগ্রহ করে পড়ুন ভারতীয় রান্নার একটি গল্প)। এই মন্দিরগুলির ভোগে ব্যবহৃত শাকসব্জি থেকে আমরা সহজেই আমাদের খাদ্যরীতির একটি ধারণা করতে পারি। 

একটি কথা পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এখানে আমি ঊড়িষ্যা রাজ্যের আমার পরিচিত কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদের কথা বিবরণ করেছি। এছাড়াও অনেক পদ সেখানে অবশ্যই রয়েছে, অন্যান্য ভারতীয় পদগুলির পাশাপাশি মোগলাই, চাইনিজ, পশ্চিমী (পিজা-বার্গার ইত্যাদি) সকলই সহজেই পাওয়া যায়। তবে যতদূর মনে পরে, সেই সময়ে আমার কোনো পিজা বা বার্গারের দোকান স্মৃতিতে আসছে না।। যেহেতু সেই সময়ে আমি মাংস খেতাম না তাই সেই ধরণের কোনো খাবারের স্বাদ আমি পাইনি, তাই তার জন্যে উল্লেখ করিনি। বেরহামপুর তথা ঊড়িষ্যায় অনেক আদিবাসী মানুষ বসবাস করেন, দৈনিক বাজারে, রাস্তায় আমি তাঁদের দেখেছি, কথা বলেছি, একসাথে বাসে চড়ে যাতায়াত করেছি। তবে তাঁদের খাদ্যরীতির বিষয়ে আমার কোনো গবেষণার বা পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়নি, কোনো সুযোগ পেলে অবশ্যই আমি তা জানার চেষ্টা করবো। আশা করি, যাঁরা ওই রাজ্যে কর্মসূত্রে বা পর্যটনের উদ্দেশ্যে যাবেন তাঁরা নিশ্চয় ওই স্থানের খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ করবেন। 

প্রদত্ত চিত্রখানি আমাদের বাড়ির পান্তা ভাত, তবে আমরা খাওয়ার পূর্বে পান্তার সাথে ডাল মেখেছিলাম আর টক দই ব্যবহার করিনি। পাখালা ভাতের সাথে এর সাদৃশ্য থাকলেও এটি প্রকৃত পাখালা নয়। 

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...