পৃষ্ঠাসমূহ

Animal লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Animal লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

অ-পতঙ্গ পরাগায়নকারী (Non-insect pollinators)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী ব্লগে পরাগসংযোগকারী কীট-পতঙ্গ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলাম (অনুগ্রহ করে পড়ুন খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তায় পরাগ-সংযোগকারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা)। বর্তমান ব্লগটিতে কীট-পতঙ্গ ছাড়া অন্য কয়েকটি প্রাণী নিয়ে আলোচনা করবো যারাও পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অ-পতঙ্গ পরাগায়নকারীদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পাখি (Birds), স্তন্যপায়ী প্রাণী (Mammals) এবং সরীসৃপ (Reptiles) । এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে:

পাখি

হামিংবার্ড (Hummingbird): আমেরিকাতে, হামিংবার্ডগুলি নলাকার ফুলের (Tubular flowers) উল্লেখযোগ্য পরাগায়নকারী, যেমন ট্রাম্পেট ভাইন (Trumpet vine), ফুসিয়া (Fuchsia) এবং অনেক অর্কিড। তারা ফুলের উপর ঘোরাফেরা করে এবং তাদের লম্বা চঞ্চু এবং জিহ্বা ব্যবহার করে নেক্টর (Nectar) আহরণ করে এবং  ফুল থেকে ফুলে পরাগ বহন করে।

সানবার্ড (Sunbirds) এবং হানিইটার (Honeyeaters): আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায়, সানবার্ড এবং হানিইটাররা হামিংবার্ডের মতো একই ভূমিকা পালন করে। তারা নলাকার আকার এবং উজ্জ্বল রঙের ফুলের পরাগায়ন করে, যেমন প্রোটিয়া (Protea) এবং গ্রেভিলিয়া (Grevillea)।

হানিক্রিপার (Honeycreepers) এবং লরিকিটস (Lorikeets): এই পাখিগুলি, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয়, গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফুলের পরাগায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

স্তন্যপায়ী প্রাণী 

বাদুড় (Bats): বাদুড়, বিশেষ করে ফল-খাওয়া বাদুড় এবং নেক্টর-খাওয়া বাদুড়, গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং মরুভূমি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ পরাগায়নকারী। তারা গাছের পরাগায়ন করে যেমন অ্যাগাভ (Agave) (টাকিলার (Tequila) জন্য ব্যবহৃত হয়), সাগুয়ারো ক্যাকটাস (Saguaro cactus), দুরিয়ান (Durian) এবং অনেক গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল। বাদুড় ফ্যাকাশে রঙের, তীব্র গন্ধযুক্ত ফুলের প্রতি আকৃষ্ট হয় যা রাতে ফোটে।

প্রাইমেট (Primates): কিছু প্রাইমেট, যেমন মাদাগাস্কারের কালো-সাদা রাফড লেমুর (Black-and-white ruffed lemur), তারা নেক্টর পান করার সময় তাদের মুখে লেগে থাকা পরাগ স্থানান্তর করে বড় ফুলের, যেমন ট্রাভেলার'স পাম (Traveler’s palm),  পরাগায়নকারী হিসাবে কাজ করে।

রোডেন্ট (Rodents): কিছু রোডেন্ট, যেমন ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালি, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রোটিয়া-র মতো  ফুলের পরাগায়ন করতে সাহায্য করে কারণ তারা ফুলের নেক্টর বা পরাগরেণু খায়।

মারসুপিয়ালস (Marsupials): অস্ট্রেলিয়ায়, হানি পোসাম (Honey possum) এবং সুগার গ্লাইডারের (Sugar glider) মতো কিছু মার্সুপিয়াল নেক্টর খায় এবং ইউক্যালিপটাস (Eucalyptus) এবং ব্যাঙ্কসিয়াসের (Banksias) মতো ফুলের পরাগায়ন করে ।

সরীসৃপ

লিজার্ড এবং গেকোস (Lizards and Geckos): কিছু দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রে, লিজার্ড এবং গেকো গুরুত্বপূর্ণ পরাগায়নকারী। তারা নেক্টর খাওয়ার জন্য ফুল পরিদর্শন করে এবং পরাগ স্থানান্তর করে। উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে স্কিনক (Skinks) এবং গেকো (Gecko) যা নিউজিল্যান্ড, হাওয়াই এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদের ফুলের পরাগায়ন করে।

এই অ-পতঙ্গ পরাগায়নকারীরা প্রায়শই নির্দিষ্ট উদ্ভিদের সাথে অভিযোজিত হয় যেগুলি তাদের আকর্ষণ করার জন্য অনন্য ফুলের আকার, রঙ এবং প্রস্ফুটিত সময় বিকশিত হয়েছে। এই অভিযোজনগুলি ইকোসিস্টেমের সফল পরাগায়ন নিশ্চিত করে যেখানে পরাগসংযোগকারী কীট-পতঙ্গ কম বা অনুপস্থিত। 

[স্তন্যপায়ী এবং সরীসৃপ প্রাণীদের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনার জন্যে অনুগ্রহ করে যথাক্রমে পড়ুন আনদং-র জু-টোপিয়াম: পর্ব-১: স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একটি সংক্ষিপ্ত সরল বর্ণনা, আনদং-র জু-টোপিয়াম: পর্ব-২: সরীসৃপ প্রাণীদের একটি সংক্ষিপ্ত সরল বর্ণনা]

খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তায় পরাগ-সংযোগকারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা (The Crucial Role of Pollinators in Food and Nutrition Security)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্বের একটি ব্লগে (Photographs of some insects) আমি কয়েকটি কীট-পতঙ্গের ছবি দিয়েছি। ছবি তুলতে আমি ভালোবাসি, তবে ব্লগে এই ছবিগুলি প্রকাশ করার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র কয়েকটি ছবির প্রদর্শন করা নয়, আশা করি এই ছবিগুলি (বাস্তবে খালি চোখে দেখলে আরও ভালো লাগে) এই কীট-পতঙ্গগুলি সম্বন্ধে পাঠক-পাঠিকাদের মনে কৌতূহল উদ্রেক করবে। আসলে অনেক সময় আমরা বিস্মৃত হই আমাদের বাস্তুতন্ত্রটি কি প্রকারে আমাদের সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলি আমাদের প্রদান করে চলেছে, সেই বিষয়ে (অনুগ্রহ করে পড়ুন বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য)। 

কীট-পতঙ্গ, বিশেষত পরাগ বহনকারী বা পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গ (Pollinator), আমাদের খাদ্য উৎপাদনের জন্যে অপরিহার্য। যে সকল খাদ্যশস্য আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি তার প্রায় ৭৫% পরাগ-সংযোগকারী প্রাণীদের উপর নির্ভর করে, এই সকল পরাগ-সংযোগকারী প্রাণীদের মধ্যে কীট-পতঙ্গ উল্লেখযোগ্য (About 75% of global food crop types depend on pollinators)। যদি কোনো কারণে এরা প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয় বা এদের বৈচিত্র্য বা সংখ্যা কমে যায়, তবে তার ফলে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পাবে, যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান ফসলগুলি থেকে আসত, ফলন হ্রাস পাওয়ায় পুষ্টি উপাদানগুলির সরবারহ স্বাভাবিক কারণেই সংকুচিত হয়ে পড়বে। এর ফলে আমাদের খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরা যে কেবলমাত্র উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে তা নয়, ফসলের গুণমানও বৃদ্ধি পায়। 

একদিকে পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গদের সংখ্যা হ্রাস পেলে ফসল উৎপাদন হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং এরফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর পাশাপাশি এরফলে পুষ্টি উপাদানগুলির পরিমাণও কিন্তু হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং তা মানব স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বলি, ধরা যাক, কোনো এক স্থানে কুমড়ো চাষ করা হয়। এই ফসলটি উৎপাদনের জন্যে পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গদের প্রয়োজন হয়। এখন যদি এই পরাগবাহকদের বৈচিত্র বা সংখ্যা যে কোনো কারণেই কমে যায় তবে তার ফলে কুমড়ো গাছের পরাগ সংযোগ ব্যাহত হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন কম হবে। কম উৎপাদন হলে কৃষকের আয় কমে যাবে তা বলাই বাহুল্য। ১০০ গ্রাম কুমড়ো একটি নির্দিষ্ট পরিমান ভিটামিন এ (Vitamin A) ধারণ করে, সেই হিসেবে থেকে যত উৎপাদনের পরিমাণ ততই পুষ্টি উপাদানগুলির (যেমন, ভিটামিন এ) পরিমাণও হ্রাস পাবে। 

এ স্থানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরাগসংযোগকারী কীট-পতঙ্গের কথা উল্লেখ করি, তবে বিষয়টি একটু সহজ হবে।  

প্রথমেই মনে আসে মৌমাছি (Honey bee- Apis spp.) - আমাদের দেশে কিন্তু বেশ কয়েক প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায় যেমন Apis mellifera, Apis cerana, Apis dorsata, Apis laboriosa ইত্যাদি। ফসলের মধ্যে এরা প্রধানত আপেল, আমন্ড (Almond), ব্লুবেরী (Blueberries), অ্যাভোকাডো (Avocado), শশা, কুমড়ো, মেলন (Melon), সর্ষে, তিল, লিচু, ক্রেনবেরি (Craneberry), ধোনে ইত্যাদির পরাগ সংযোগে সাহায্য করে। মৌমাছিরা সাধারণ পরাগায়নকারী (Generalist), মোটামুটি সকল প্রকার ফল, বাদাম এবং সবজি ফসলের পরাগসংযোগে অংশগ্রহণ করে , ফসলের ফলন এবং গুণমানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। 

এরপর আসি বাম্বেল বি-র (Bumble bee- Bombus spp.) কথায়, যাকে আমরা ভ্রমর বলে চিনি। প্রধানত টম্যাটো, লঙ্কা, স্ট্রবেরী (Strawberries), ব্লুবেরী (Blueberries), লবঙ্গ (Clove) ইত্যাদি ফসলের পরাগসংযোগে ভ্রমর খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বাম্বেল বি (Bumble bee) বিশেষভাবে "বাজ পরাগায়ন" (Buzz pollination) এ কার্যকরী, এরা যখন উড়ে বেড়ায়, কান পাতলে একটা বুউজজ জজজ  বুউজজ জজজ শব্দ শোনা যায়, এর ফলে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তারফলে গাছের যেমন টম্যাটো এবং লঙ্কার পরাগ নির্গত হয়। তাদের দৃঢ় দেহ (Robust body) এবং দীর্ঘ জিহ্বা (Proboscis) তাদের গভীর ফুলে প্রবেশ করতে দেয়। 

ম্যাসন বি (Mason bee- Osmia spp.) ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ পরাগ সংযোগকারী, এরা আপেল, নাসপাতি, চেরি (Cherries), আমন্ড, পিচ ইত্যাদি ফলের পরাগসংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ম্যাসন বি-রা প্রারম্ভিক ঋতুর পরাগায়নকারী এবং উচ্চ পরাগায়ন দক্ষতার কারণে ফল বাগানের পরাগায়নের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। 

কার্পেন্টার বি (Carpenter bee- Xylocopa spp.) মূলত প্যাশনফ্রুট (Passionfruit), বেগুন এবং লেগুম জাতীয় ফসলের পরাগ সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কার্পেন্টার বি আকারে বড়, সলিটারি অর্থাৎ মৌমাছির মতন এরা সমাজবদ্ধ নয়, এরা বিশেষত বড় পাপড়ি (Large petals) এবং নলাকার আকৃতির (Tubular shape) বিভিন্ন ধরনের ফুলের পরাগায়ন করে।

প্রজাপতি (Butterfly) তো আমরা সকলেই দেখেছি, ফুলের উপর এরা যখন উড়ে বেড়ায় তখন তা বড়ই ভালো লাগে। এরাও কিন্তু পরাগায়নে সাহায্য করে, মূলত গাজর, পেঁয়াজ, বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ (Herb), এবং বন্য ফুল এদের দ্বারা উপকৃত হয়। প্রজাপতি হল গৌণ পরাগায়নকারী কিন্তু ভেষজ এবং ফুলের উদ্ভিদের পরাগায়নে অবদান রাখে, বিশেষ করে যাদের সমতল (Flat) বা গুচ্ছ ফুল (Clustered) রয়েছে। অপরপক্ষে বিভিন্ন মথ (Moth, Sphingidae পরিবারভুক্ত) তামাক, ইভিনিং প্রাইমরোজ (Evening primrose), ইয়ুক্কা (Yucca) এবং নানান ধরণের ফলের পরাগায়নে অংশগ্রহণ করে। মথ সাধারণত রাতে সক্রিয় থাকে এবং যে ফুলগুলি সন্ধ্যায় বা রাতে ফোটে তাদের পরাগায়ন করে। এগুলি নির্দিষ্ট রাত্রে প্রস্ফুটিত উদ্ভিদের পরাগায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আমি নিশ্চিত যে আমাদের মধ্যে অনেকেই হোভারফ্লাই (Hoverfly, Family: Syrphidae) চেনেন। এরা গাজর, ধোনে, সেলেরি (Celery), মৌরি ইত্যাদির পরাগায়নে সাহায্য করে।  হোভারফ্লাই ছোট ফুল এবং ছাতার আকৃতির ফুলের গুচ্ছ (Umbel-shaped flower clusters) বিশিষ্ট উদ্ভিদের পরাগায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারা এফিডের (Aphid) প্রাকৃতিক শিকারী (Natural predators)।  

লিফকাটার বি (Leafcutter bee- Megachile spp.) বা মেগাচিলিড বি (Megachilid bee) আলফালফা (Alfalfa), বিন (Beans), মেলন (Melon), বেরী (Berries) ইত্যাদির পরাগায়নে সাহায্য করে। বিটলদের মধ্যে, বিশেষত Nitidulidae পরিবারভুক্ত স্যাপ বিটল (Sap beetle), ম্যাগনোলিয়া (Magnolia), ওয়াটার লিলি (Water lilies), পপ (Pawpaw), কোকো (Cocoa) ইত্যাদির পরাগায়ন করে। 

এছাড়াও আরও অনেক প্রজাতির কীট-পতঙ্গ (যেমন পিঁপড়ে, Halictidae পরিবারভুক্ত সোয়েট বি (Sweat bee) ইত্যাদি) রয়েছে, আর শুধু কীট -পতঙ্গ-ই নয়, অন্যান্য প্রাণী যেমন পাখি, বাদুড়, কয়েক প্রজাতির রোডেন্ট, ইত্যাদিরাও কিন্তু বিভিন্ন উদ্ভিদের পরাগায়নে সাহায্য করে। সেই বিষয়ে পরে কখনও বিশদে উল্লেখ করবো। 

বর্তমানে নানান কারণে, যেমন অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এই সকল পতঙ্গদের বাসস্থানের অবক্ষয় (Habitat degradation), নিবিড় কৃষিকাজ (ফসলের বৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত পরিমানে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার ইত্যাদি) (Intensive agriculture), প্যাথোজেন এবং পরজীবীদের আক্রমণ (Pathogen and parasite burden), এবং জলবায়ুর পরিবর্তন (Climate change) ইত্যাদি, এই সকল উপকারী অপরিহার্য কীট-পতঙ্গরা অনেক স্থানে কমে যাচ্ছে। এদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া একান্তভাবে অপরিহার্য, অন্যথায় আমাদের খাদ্য এবং পুষ্টির সংকট দেখা দেবে। কাজেই এদের সংরক্ষণ বাঞ্চনীয়। 

স্থানীয় পরাগ সংযোগকারী কীট-পতঙ্গগুলিকে চিহ্নিতকরণ, তাদের পর্যবেক্ষণ করা এবং প্ল্যান্ট-পলিনেটর নেটওয়ার্ক গঠনের (Plant-Pollinator network) মাধ্যমে তাদের গুরুত্ব অধ্যয়ন, সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সেই বিষয়গুলির সমাধানের জন্যে গবেষণা করা একান্ত প্রয়োজনীয়। এর পাশাপাশি এই সকল উপকারী পতঙ্গগুলির বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষত স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম এবং নাগরিক বিজ্ঞান প্রকল্পগুলির মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করে, এমনকি তাঁদের পর্যবেক্ষণকে ডেটাবেসে অন্তর্ভুক্ত করে এদের সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় মানুষের  অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।     

Photographs of some Insects: Capturing Nature's Beauty with a Mobile Camera

সম্পত ঘোষ (Photographer: Sampat Ghosh)


I captured photographs of some fascinating insects using my mobile phone. Previously, I wrote a blog to highlight the importance of wildlife in an ecosystem. These photographs illustrate how insects contribute to the pollination of wild plants. I invite you to enjoy these images. Please note, while these photos are not intended for any commercial use without the photographers' written permission, they may be available for academic purposes only with proper credit to the photographers and this blog.

শঙ্করপুর (Shankarpur)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে গিয়েছিলাম তাজপুর-শঙ্করপুর-দীঘা বেড়াতে। তাজপুর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একটি ব্লগ আমি পূর্বে লিখেছি। আজকের ব্লগে আমি শঙ্করপুর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা লিখবো। 

ভ্রমণপিপাসু বাঙালীর কাছে কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থিত দীঘার সমুদ্র সৈকত একটি নস্টালজিয়া।সপ্তাহান্তে চলে আসাই যায়। অনেকে এখন একটু অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে পছন্দ করেন, আমার কিন্তু আজও দীঘা অত্যন্ত প্রিয়। 

ছোটবেলার দীঘার স্মৃতি আজও উজ্জ্বল, তখনও বঙ্গোপসাগরের সৈকতে আজকের মতন মেরিন ড্রাইভ গড়ে ওঠেনি, ঝাউবন হারিয়ে যায়নি, ট্রেন লাইন পাতা হয়নি, নতুন দীঘা গড়ে ওঠেনি, আসে পাশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলিও আজকের মতন বিকশিত হয়নি। তখন হাওড়া বা ধর্মতলা থেকে বাসে করে দীঘা পৌঁছতে হতো, যা এখন পুরোনো দীঘা বলে পরিচিত। মোবাইল এবং ইন্টারনেট নির্ভর জীবনযাত্রা তখনও গড়ে ওঠেনি, কাজেই বাস স্ট্যান্ডে নেমে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন হোটেল দেখেশুনে ঘর নেওয়াই ছিল প্রচলিত প্রথা, সৈকতের উপরে হলে তো কথাই ছিল না। তবে অনেকে আগে থাকতেই ঘর রিসার্ভ করেও আসতেন। তারপরেই সমুদ্রে ছোটা, সমুদ্রস্নান সেরে, রেস্তোরাঁগুলিতে খাওয়া বা কখনও মনের মতন মাছ রাঁধিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারা, একটু দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রাম, আবার সমুদ্রপাড়ে বসে উপভোগ করা, রাত্রে ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে যে সরুপথ চলে গেছে তা ধরে হোটেল থেকে সমুদ্রপাড়ের রেস্তোরাঁতে খেতে আসা, এইভাবে দিন দু'য়েক কাটিয়ে আবার ফিরে আসা দৈনন্দিন ব্যস্তময় জীবনে। তারপর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, দীঘার পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছে, সৈকত কেন্দ্রিক এই পর্যটন বর্তনীটি (দীঘা-শঙ্করপুর-তাজপুর-জুনপুট-মন্দারমনি) আজ খুবই জনপ্রিয়। এখন দীঘা গেলে বেশিরভাগ মানুষ শংকরপুর, মন্দারমণি, তালসারি, তাজপুর, উদয়পুর সৈকত ইত্যাদি স্থানগুলো ঘুরে আসেন। 

আমরাও তাজপুর থেকে গিয়েছিলাম শঙ্করপুরে। তাজপুর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শংকরপুর সমুদ্র সৈকতে পৌঁছতে সময় লাগে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। আর সেখান থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দীঘা। শঙ্করপুর পশ্চিমবঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য মৎস বন্দর কেন্দ্র। শঙ্করপুর সৈকত তুলনামূলকভাবে এখনও কম জনবহুল।
 

সমুদ্র সৈকতে রয়েছে কয়েকটি দোকান, দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসেছেন, ঝিনুক দিয়ে বানানো বিভিন্ন দ্রব্য, চাবির রিং, শঙ্খ, কাঠের গাড়ি, পুতুল ইত্যাদি আরও হরেক জিনিস। পায়ে পায়ে মৎস বন্দরের দিকে এগিয়ে এলাম, অনেক ট্রলার দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি, এগুলি মাছ ধরার ট্রলার। ট্রলার থেকে পাটাতন নামিয়ে রাখা হয়েছে তীরে, সেই পাটাতন বেয়ে বিরাট বিরাট বরফের চাই মাথায় নিয়ে কর্মীরা উঠে যাচ্ছেন ট্রলারে। অত্যন্ত ব্যস্ত দিন, কয়েক হাজার মানুষ এই মাছ ধরার কাজে যুক্ত, এতেই তাঁদের জীবনধারণ হয়। বছরে প্রায় ১০ মাস চলে মাছ ধরার কাজ, দুই মাস এপ্রিল মাসের মধ্যবর্তী সময় থেকে জুন মাসের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ওই সময় মাছের সংখ্যা যেন বৃদ্ধি পেতে পারে সেইজন্যে মাছ ধরা বন্ধ থাকে। 


এবার এই মৎস বন্দরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাছের প্রজাতির উল্লেখ করি (আমি পূর্বের একটি ব্লগ 'বাঙালির আহারে মাছ'-এর উপরে লিখছি)। এখানে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই বলি কন্ড্রিকথিস (Condrichthyes: যে সকল মাছের দেহে অস্থি অনুপস্থিত, এদের দেহে তরুনাস্থি (Cartilage) বর্তমান) শ্রেণীর কথা। এই শ্রেণীর অন্তর্গত উপশ্রেণী হলো এলাসমব্র্যাংকি (Elasmobranchii)। এদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এদের পাঁচ থেকে সাত জোড়া গিল বর্তমান যা বাইরের দিকে উন্মুক্ত, পৃষ্ঠদেশের পাখনা দৃঢ় হয়ে থাকে, এবং দেহে ছোট ছোট প্ল্যাকোয়েড আঁশ উপস্থিত। এই উপশ্রেণীর অন্তর্গত মাছের দেহে সুইম ব্লাডার থাকে না। এদের মুখের অভ্যন্তরে দাঁতের একাধিক সিরিজ রয়েছে। হাঙ্গর, রে ইত্যাদি এই উপশ্রেণীর অন্তর্গত প্রজাতি। ব্ল্যাকটিপ হাঙ্গর (Carcharhinus limbatus), স্পেডনোজ হাঙ্গর (Scoliodon laticaudus), দুধ হাঙ্গর (Rhizoprionodon acutus), ধূসর স্টিং রে (Dasyatis zugei), হানিকোম্ব স্টিং রে (Himantura uarnak) ইত্যাদি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।হাঙ্গর বা রে বাঙালির পাতে খুব উপাদেয় বলে গণ্য না হলেও বাইরে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। হাঙ্গরের লিভার থেকে প্রাপ্ত তৈলের ঔষধিগুণ রয়েছে, যা ফার্মাসিউটিকাল শিল্পে ব্যবহৃত হয়। কয়েক প্রকার হাঙ্গর এবং রে মাছের লিভার থেকে প্রাপ্ত তৈলের ব্যবহার চর্মশিল্পেও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও মাছের খাদ্য বা ফিশমিল (Fishmeal) এবং সার (Manure) প্রস্তুতিকরণে এই মাছগুলি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এরপর আসি অস্থিযুক্ত মাছের কথায়, যা অস্থিকথিস (Osteichthyes) শ্রেণীর অন্তর্গত। এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত একটি উপশ্রেণী হলো একটিনটেরিজি (Actinopterygii), যাদের রে-ফিন্ড ফিশ (Ray-finned fish) বলা হয়। ইল (Eel) হলো এই প্রকার মাছ, যা এই বন্দরের একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক মাছ। ইলের জীবনচক্র খুব কৌতূহলোদ্দীপক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের জীবনচক্রে ক্যাটাড্রোমাস (Catadromous) প্রকার লক্ষিত হয়, অর্থাৎ মিঠা জল (Fresh water) থেকে স্পনিং (Spawn) এবং ডিম পাড়ার জন্যে এরা সমুদ্রের নোনা জলে স্থানান্তরিত হয়। ডিম ফুটে যে চ্যাপ্টা এবং স্বচ্ছ লার্ভা বের হয় তার মাধ্যমে ইলের জীবন শুরু হয়, এদের লেপ্টোসেফালি (Leptocephali) বলা হয়। এরা সাধারণত সমুদ্রের পৃষ্ঠতলের ভাসমান জৈব পদার্থের কণা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।  এর পর এরা গ্লাস ইলে (Glass eel) রূপান্তরিত হয়, এই পর্যায়ে তারা মিঠা জলের দিকে ধাবিত হয়। এরপর যথাক্রমে এলভার (Elver), হলুদ ইল (Yellow Eel) হয়ে তারা পরিণত সিলভার ইলে (Silver Eel) রূপান্তরিত হয়। পরিণত সিলভার ইল স্পনিং এবং ডিম পাড়ার জন্যে আবার সমুদ্রের নোনা জলে ফিরে যায়। একটিনটেরিজি (Actinopterygii)-র অন্তর্ভুক্ত ওপর একটি ফ্যামিলি ক্লুপেডি (Clupeidae)। বাঙালির রসনা তৃপ্ত করে যে ইলিশ তা এর অন্তর্গত। বিভিন্ন প্রজাতির ইলিশ (Hilsa ilisha, H. toli, Ilisha kampeni, I. megaloptera ইত্যাদি) এই বন্দরের উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক মাছ। এদের জীবন চক্রে কিন্তু ইলের বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এরা এনাড্রোমাস (Anadromous) প্রকৃতির, অর্থাৎ স্পনিং-র জন্যে এরা সমুদ্রের নোনা জল থেকে মিঠা জলে স্থানান্তরিত হয়। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমানে এনকোভি (Anchovy; Family- Engraulidae), সামুদ্রিক ক্যাট ফিশ (Sea Catfish), উল্ফ হেরিং (Wolf Herring; Family- Chirocentridae) ইত্যাদি। এখানে উল্লেখযোগ্য লোটে বা লোইট্যা (Harpadon nehereus), বাঙালির আর এক রসনা তৃপ্তকারক এই মাছ। এর প্রচলিত নাম বোম্বে ডাক (Bombay Duck/Bombay Daak)। এই নামকরণের পিছনের কাহিনীটি বেশ মজার। তখন বোম্বের (বর্তমানের মুম্বাই) মৎসবন্দরগুলোতে বিপুল পরিমানে এই লোটে উঠতো। লোটে বাঙালির খুবই উপাদেয়।  রেলগাড়ি চালু হওয়ার পর মেল ট্রেনের (Mail train) মাধ্যমে তা সুদূর বোম্বে থেকে কলকাতায় এসে হাজির হতো। বাংলায় 'মেল/Mail' শব্দটির অর্থ ডাক, অতএব এর নাম হয়ে গেলো বোম্বে ডাক। এখানে অপর দু'টো উপাদেয় মাছ ব্ল্যাক পমফ্রেট (Black pomfret, Parastromateus niger; Family- Carangidae) এবং সিলভার পমফ্রেটও (Silver pomfrets, Pampus argenteus, P. chinensis) উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায়।

বেশ কিছুক্ষন শঙ্করপুরে কাটিয়ে আমরা রওনা হয়েছিলাম দীঘার উদ্দেশ্যে। 

অক্টোবর, ২০১৭

কাঁকড়া: একটি উপাদেয় খাদ্য (Crab: A delicacy)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

কাঁকড়া বাঙালির কাছে বরাবরই উপাদেয় খাদ্যবস্তু হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। সমকালীন সাহিত্যেও উঠে এসেছে কাঁকড়ার কথা। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অনতিকালের মধ্যে আসে ভয়াবহ বন্যা। বাংলার মানুষ, বিশেষত নিম্নবিত্ত মানুষ, আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পরে। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলশ্রুতিতে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, যা তেতাল্লিশের (১৯৪৩) বাংলার মন্বন্তর নামে পরিচিত। জগডুমুর সেদ্ধ, কচুর লতির ঝোলের মাধ্যমে ক্ষুধা নিবৃত্তি, বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটকের চরিত্র মাখন যখন এই সকল খাদ্যের বিরূদ্ধে তীব্র অনীহা প্রকাশ করে, বিনোদিনী ঝাঁজিয়ে উঠেন মাখনের উদ্দেশ্যে, বলেন সে ভালো মন্দ কিছু খুঁজে আনলেই পারে, ঠিক তখন প্রধান সমাদ্দার কিছু কাঁকড়া সংগ্রহ করে নিয়ে প্রবেশ করেন। কাঁকড়া বেশ ভালো অর্থাৎ উপাদেয় বলেই গণ্য হয়েছিল চরিত্রগুলির কাছে। তবে কোনো যাত্রার প্রাক্কালে কাঁকড়া দর্শন কিন্তু আবার অলুক্ষণে চিহ্ন বলে বিবেচনা করা হয়। সমরেশ বসুর উপন্যাস 'গঙ্গা'-তে দেখি নিবারণ আর পাঁচু মাছ ধরতে যাওয়ার পূর্বে কচ্ছপ দেখে বেশ সন্দিহান হয়ে পড়েছিল; কচ্ছপ, কাঁকড়া আর কলা, এই তিন বস্তু অলুক্ষণে চিহ্ন বলেই মনে করা হয়। কেন তা আমার অজানা।

কাঁকড়া (Crab) অনেকের পছন্দ হলেও ছাড়ানো বেশ কঠিন বলে খাওয়া হয়ে ওঠে না। বেশ কয়েক বৎসর পূর্বে তাজপুর সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে কাঁকড়া খেয়েছিলাম, তবে তা খুব সুস্বাদু ছিল এমনটা বলা যায়না। আবার ইয়ংদক ক্র্যাব ভিলেজের (Yeongdeok crab village) বাজারে অনেক প্রকার কাঁকড়া দেখে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করলেও রেস্তোরাঁতে এক একটি কাঁকড়ার দাম ছিল প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার, কাজেই তা দিয়ে রসনা তৃপ্ত করা আমার সাধ্যের অতীত ছিল। কাজেই বাজার থেকে কিনে বাড়িতে এনে রান্না করে কাঁকড়া খাওয়া, এটিই হলো সহজ পথ। আমাদের দেশে নানান প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২০টি প্রজাতির কাঁকড়া খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।এদের মধ্যে রয়েছে  Scylla serrata, S. tranquebarica (এদের মূলত ম্যানগ্রোভ, খাড়ি বা নোনাজলের ভেড়িতে পাওয়া যায় বা চাষ করা হয়), Protonus pelagicus, P. sanguinolentus, P. argentatus, P. latipesCharybdis feriata, C. helleri, C. affinis, C. lucifera, C. quadrimaculata, C. acutifrons (এদের সাধারণত কর্দমাক্ত অঞ্চলে কাদার নিচে পাওয়া যায়), Varuna litterata (মিঠা জলের পুকুর, নোনা জলাশয়, খাড়ি সকল স্থানেই এরা বাস করে), Episesarma mederi, Muradium tetragonum (কাদা অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়), Sartoriana spinigera, Spiralothelphusa hydroma (বিল, বাওর, মিঠা জলের পুকুর ইত্যাদিতে পাওয়া যায়), Diogenes milesMatuta planipes, M. lunaris (সমুদ্র উপকূলে বেলে অঞ্চলে পাওয়া যায়)। আবার বেশ কয়েক প্রজাতির কাঁকড়া, যেমন Charybdis rostrata, C. orientalis, C. helleri ইত্যাদি মাছের খাদ্য (Fishmeal) প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

প্রতিটি প্রজাতির কাঁকড়া দেখতে একটু আলাদা হলেও তাদের মূল গঠন একই রকমের। দক্ষিণ কোরিয়াতেও ভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের কাঁকড়ার মধ্যে কিং ক্র্যাব (King crab), স্নো ক্র্যাব (Snow crab), নীল কাঁকড়া (Blue crab), লাল কাঁকড়া (Red crab) উল্লেখযোগ্য। 

আমি বাজার থেকে নীল কাঁকড়া কিনে এনেছিলাম, এটি হিমায়িত (Frozen) অবস্থায় ছিল। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাজারে টাটকা কাঁকড়া পাওয়া যায়। সেটি কিনে এনে ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে (গায়ে শ্যাওলা থাকলে তা ঘষে তুলে দিতে হবে) নিতে হবে। এবার কাঁকড়াগুলিকে ঘন্টা খানেক রেফ্রিজারেটরের শূণ্য (০) ডিগ্রী তাপমাত্রায় রেখে দিলেই এরা নিস্তেজ হয়ে মরে যাবে, অন্যথায় গরমজলে একটু ফুটিয়ে নিলেও হবে। এবার কাটাকাটি করতে সুবিধা হবে। অন্যথায় জীবন্ত অবস্থায় কাটতে গেলে কাঁকড়াটিও যন্ত্রণাভোগ করবে আবার যিনি কাটবেন তিনিও আহত হতে পারেন। 

কাঁকড়া একটি খোলার (Exoskeleton) আবরণে থাকে, এই খোলাটি ছাড়িয়ে তবে তা রেঁধে খাওয়ার উপযোগী হয়। এই খোলাটি কাইটিনের (Chitin) সাথে বেশ কিছু খনিজ পদার্থ মিলিত (Mineralized) হয়ে সৃষ্টি হয়। তবে যতটা শক্ত বলে মনে হয় সেটা ততটা শক্ত নয়। জীবজগতে কাঁকড়ার স্থান লক্ষ্য করলে দেখা যায় এটি আর্থ্রোপোড (Arthropod/সন্ধিপদ) পর্বের ক্রাস্টেশিয়া (Crustacea) উপ-পর্বের (Subphylum) অন্তর্গত ম্যালাকোস্ট্রাকা (Class- Malacostraca) শ্রেণীভুক্ত প্রাণী। এই ম্যালাকোস্ট্রাকা শব্দটিকে একটি ভাঙলে দাঁড়ায় গ্রীক শব্দ 'ম্যালাকস' (Malakos) অর্থাৎ নরম (Soft) এবং 'অস্ট্রাকন' (Ostracon)-র অর্থ খোলা (Shell), কাজেই ম্যালাকোস্ট্রাকা-র মানে হলো নরম খোলা আবৃত প্রাণী। প্রন (Prawn), শ্রিম্প (Shrimp), লবস্টার (Lobster), কাঁকড়া (Crab) সকলেই এই শ্রেণীভুক্ত। কাঁকড়ার পৃষ্ঠীয় দেশের (Dorsal) খোলাটিকে ক্যারাপেস (Carapace) বলা হয়। পৃষ্ঠীয় (Dorsal) এবং অঙ্কীয় (Ventral) দেশের সন্ধিস্থলে ছুরি একটু ঢুকিয়ে উপরের দিকে চাপ দিতেই ক্যারাপেসটি উঠে আসবে। এই কাজটিকেই মনে হয় সবথেকে কঠিন, আসলে কিন্তু তা নয়।  এমনকি চাপ একটু বেশি লাগলে ক্যারাপেসটি ভেঙে যায়, তখন সহজেই বোঝা যায় এটি বাস্তবে খোলাটি অতটা শক্ত নয়। 

এই ম্যালাকোস্ট্রাকা শ্রেণীর মধ্যে আবার কাঁকড়া ডেকাপোডা অর্ডারের (Order- Decapoda) অন্তর্গত। শব্দটি থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, ডেকা (Deca) অর্থাৎ দশ আর পোডা (Poda) শব্দটির অর্থ পদ বা পা। মানে কাঁকড়ার পায়ের সংখ্যা পাঁচ জোড়া বা দশটি। সাধারণত বেশির ভাগ কাঁকড়ার ক্ষেত্রে, এই পাঁচ জোড়া পায়ের মধ্যে প্রথম জোড়া পা বেশ বড় আকারের এবং বাকি চার জোড়া পা তুলনামূলকভাবে ছোট হয়। প্রতিটি পা কাঁকড়ার দেহ থেকে আলাদা করা প্রয়োজন। পা গুলি যে স্থানে শরীরের সাথে সংযুক্ত সেই স্থানে একটু ঘোরাতেই এগুলি সহজেই আলাদা হয়ে যায়। বড় আকারের পা দুটি ছাড়া বাকিগুলি ফেলে দেওয়াই বাঞ্চনীয়, তবে ইচ্ছে হলে এগুলো ব্যবহারও করতে পারেন। বড় আকারের পা দুটির খোলা একটু ভেঙে নিতে হবে যাতে রান্নার সময় ভিতরের মাংস সহজে সিদ্ধ হতে পারে এবং রান্নার মশলার উপকরণগুলি পৌঁছতে পারে।

এইবার ক্যারাপেস উঠিয়ে নেওয়ার পর যা চোখে পড়বে তা হলো গিল (Gills), জলচর কাঁকড়ার দেহে গিলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ডান ও বাম গিলের সংযোগস্থলে রয়েছে হৃৎপিণ্ড (Heart)। গিলের নিচে থেকে অন্যান্য অন্তরযন্ত্ৰীয় অঙ্গগুলি, যেমন পাচক গ্রন্থিসমূহ (Digestive glands), ডিম্বাশয় (Ovary, স্ত্রী কাঁকড়ার ক্ষেত্রে), ম্যান্ডিবুলার পেশী (Mandibular muscle) ইত্যাদি থাকে। তবে এগুলি আলাদা করে চিহ্নিতকরণের প্রয়োজন নেই কারণ আমরা এখানে খাদ্য হিসেবে বর্ণনা করছি। এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য, সেটা হলো কিভাবে স্ত্রী এবং পুরুষ কাঁকড়া চিহ্নিত করা যায়। কাঁকড়ার অঙ্কীয়দেশের নিচের দিকে অ্যাবডোমেন (Abdomen) অংশটি (প্লেটটি এপ্রোন (Apron) বলেও পরিচিত) লক্ষ্য করতে হয়, যদি এটি ত্রিভুজের ন্যায় এবং আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট বা সরু হয় তবে কাঁকড়াটি পুরুষ কাঁকড়া, আর যদি এবডোমেনটি আকারে বৃহৎ হয় তবে সেটি স্ত্রী কাঁকড়া হয়ে থাকে। যাই হোক, এইবার কাঁকড়ার দেহের আকার অনুযায়ী একে দু'টি বা চারটি টুকরো করে নিতে হবে।  ব্যাস, কাঁকড়া কাটার কাজ শেষ।

এবার টুকরো গুলোকে ভোজ্য তেলে ভেজে নিয়ে রান্না করতে হবে। বিভিন্ন অঞ্চলে রান্নার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন ধরণের। কোনো অঞ্চলে আদা-পেঁয়াজ-রসুন-লঙ্কা বাটা দিয়ে, ধনে-জিরের গুঁড়ো সহযোগে কাঁকড়াকে কষিয়ে রান্না করা হয়। আবার কারোর কাছে নারিকেলের দুধ দিয়ে কাঁকড়া রান্না উপাদেয়। কেউ কাঁকড়ার পদে আলু ব্যবহার পছন্দ করেন আবার কেউ করেন না, কাজেই এটি ইচ্ছে অনুসারে।

এবার উপভোগ করুন সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাদ্যবস্তুটিকে।

পরিশেষে একটি কথা উল্লেখ্য। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব কিন্তু কাঁকড়ার উপর পড়ছে। বসবাসের উপযোগী পরিবেশ যেমন, জলের pH, লবণাক্ততা (Salinity), তাপমাত্রা ইত্যাদির পরিবর্তন কাঁকড়ার জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অণুজীবের (Microbes pathogens- Virus, Bacteria, Fungus) প্রভাব বাড়তে পারে, এর ফলে কাঁকড়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। আর পরিবেশগত দূষণ তো আছেই, যার মাধ্যমে বিষাক্ত যৌগ দূষণ বাড়াতে এবং কাঁকড়ার বাসস্থান ও শরীরকে দূষিত করতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে খাদ্যতালিকা থেকে শুধুমাত্র একটি পুষ্টিকর খাদ্য হারিয়ে যাবে তা নয়, যে সকল মানুষ কাঁকড়া ধরা এবং চাষের মাধ্যমে জীবনযাপন করেন তাঁদের জন্যেও প্রতিকূল অবস্থা তৈরী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই এই বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

বন্য প্রাণীর গুরুত্ব (Importance of wildlife)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


পূর্বে একটি ব্লগে আমি বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের সংরক্ষিত স্থান, বিভিন্ন প্রকারের জঙ্গলের বিষয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আজ আলোচনা করবো এই জঙ্গলের বন্য প্রাণ নিয়ে। একসময় কত রাজা মহারাজার শিকারের গল্প পড়ে বা শুনে আমরা শিহরিত হয়েছি, কিন্তু এই শিকার আজ অতীত। পিছনের কয়েক দশকে মানুষ বন্য প্রাণীর গুরুত্বের কথা বুঝেছে তাই শিকার আজ বন্ধ হয়েছে। তবে মাঝে মাঝেই সংবাদ পত্রে বিভিন্ন চোরা শিকারের কথা কিংবা বন্য প্রাণী আটক হওয়ার কথা জানতে পারি, ভেবে দুঃখ পাই কিভাবে জীবগুলিকে অনৈতিক এবং অমানবিক ভাবে হত্যা করা হয়েছে বা হচ্ছে ! এই প্রকার বন্যপ্রাণী হত্যা আটকানোর জন্যে সরকার বাহাদুর নানান আইন প্রণয়ন করেছেন, বনবিভাগ সদা সর্বদা সজাগ রয়েছে এ ধরণের ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্যে। এর পাশাপাশি আরও নানান ভাবে কিন্তু বনের ক্ষতি হতে পারে বা হচ্ছে। যেমন, বনভূমি কেটে ফেলে, সেখানে মানুষের বসতি, কল কারখানা, ইত্যাদি গড়ে বা বনভূমিকে কৃষিভূমিতে পরিণত করলেও কিন্তু তা বনের ক্ষতিসাধন করে। আবার পরিবেশ বদলের প্রতিফলনও বনের উপর পড়ছে। আমরা জানি বন্য প্রাণী বা উদ্ভিদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বাস্তুতন্ত্রে তারা কত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এবং তারা বিলুপ্ত হয়ে গেলে মনুষ্য সমাজেও কিন্তু দুর্ভোগ নেমে আসবে, তা বলাই বাহুল্য। আজ আমাদের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় এটি, বন্য প্রাণীর গুরুত্ব।  

ইকোলজি (Ecology) বা বাস্তুশাস্ত্রের যে শাখা জীব বৈচিত্র নিয়ে অধ্যয়ন করে তা কমিউনিটি ইকোলজি (Community ecology) নামে পরিচিত। কোনো একটি ভৌগোলিক স্থান জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর (যেমন ট্রপিক্যাল চিরহরিৎ রেন ফরেস্ট) আবার কোনো স্থান জীব বৈচিত্র্যে তুলনামূলকভাবে দৈন (যেমন বোরিয়াল ফরেস্ট)। এর আবহাওয়া-জলবায়ু জনিত, বাস্তুতন্ত্র জনিত অনেক কারণ বর্তমান এবং তা সহজেই বোধ্য। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে মানুষ ধীরে ধীরে লক্ষ্য করলো যে বেশ কিছু প্রাণী অবলুপ্ত হয়ে গেছে বা যাচ্ছে এবং এ যদি অনবরত ঘটতে থাকে তবে তা মনুষ্য সমাজকে বিপর্যস্ত করবে। একটি বাস্তুতন্ত্রে অনেক জীব এবং উদ্ভিদ থাকে, তারা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল (সবাই তো খাদ্য শৃঙ্খল, খাদ্য জাল (Food chain, Food web), বাস্তুতন্ত্রের পিরামিড যেমন এনার্জি পিরামিড (Energy pyramid), বায়োমাস পিরামিড (Biomass pyramid) ইত্যাদি বিষয়ে জানে), একটির অবলুপ্তি অন্য একটির অবলুপ্তিকে ডেকে আনতে পারে, এইভাবে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রটির (এক্ষেত্রে যেমন জঙ্গল) বিপর্যয় ঘটতে পারে। এখন মানুষ সকল প্রাণীর থেকে সরাসরি উপকৃত হয় এমন নয়, তবে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের থেকে তো উপকৃত হয়। একটু সহজ করে বলি, একটি জঙ্গল অনেক প্রাণী যেমন পোকা-মাকড়, মোলাস্কা, সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী ইত্যাদির এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের বাসস্থান। মানুষ এদের প্রত্যেকের থেকে স্বতন্ত্রভাবে সরাসরি উপকৃত (মৌমাছি মধু প্রস্তুত করে, পরাগ বাহক পতঙ্গরা পরাগযোগে সাহায্য করে এবং তার ফলে ফুল-ফল-শস্য উৎপাদন হয়, ঔষধি গাছের রোগ নিরাময়ক ক্ষমতার জন্যে সংগৃহিত হয়, গাছের ফল-ফুল-পাতা, এগুলি সরাসরি উপকারের কয়েকটি উদাহরণ) নাও হতে পারে, তবে জঙ্গল সার্বিকভাবে কার্বন-ডাই -অক্সাইডকে শোষণ করে, মাটির উর্বরতাকে রক্ষা করে, জল ধরে রেখে, মাটির ক্ষয় প্রতিরোধ করে, বন্যা প্রতিরোধ করে, ইত্যাদিতে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করে, যেগুলি মানব সভ্যতাকে সাহায্য করে। কাজেই বোঝা গেলো বন্য জীবের অবলুপ্তিতে জঙ্গল বাস্তুতন্ত্রটির অবলুপ্তি আর তার ফলশ্রুতিতে মানব সভ্যতার উপর বিপর্যয় নেমে আসতে পারেকাজেই জঙ্গলকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। এর অর্থ বন্য প্রাণী এবং উদ্ভিদকে রক্ষা করতে হবে। আর রক্ষা করতে হলে এদের সম্বন্ধে আমাদের প্রথমে অবগত হতে হবে। এখন ছোট বড়ো আকারে এতো প্রাণী, এতো উদ্ভিদ, সকলের সম্বন্ধে জানব কিরূপে? একটি বাস্তুতন্ত্রে এতো জৈব উপাদান (প্রাণী, উদ্ভিদ, শৈবাল, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস), সকলের গুরুত্ব কি এক ! না কি কেউ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কেউ তুলনামূলকভাবে কম ! এ এক বিরাট প্রশ্ন আবির্ভূত হলো মানুষের সামনে।

প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হলো। প্রথম ধাপ হলো পর্যবেক্ষণ। বিংশ শতকের ষাটের দশকে চার্লস এলটন (Charles Elton) প্রস্তাব করলেন যে জীব বৈচিত্র্য (প্রজাতির সংখ্যা) আর স্থায়িত্ব (যা বৈচিত্র্য-স্থায়িত্ব প্রকল্প (Diversity-Stability hypothesis) নামে পরিচিত) একটি সরলরৈখিক (সমানুপাতিক) সম্পর্ক মেনে চলে। অর্থাৎ একটি কমিউনিটিতে যত বেশি প্রজাতি, তত বেশি স্থায়িত্ব। ব্যাপারটা বোঝা গেলো। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেলো ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রাণী অবলুপ্ত হয়েছে কিন্তু তাদের বাসস্থান যে বাস্তুতন্ত্রে সেগুলি কিন্তু টিঁকে আছে, অবলুপ্তি ঘটেনি। কাজেই তবে কি সকলে বাস্তুতন্ত্রে সকলে সমান ভূমিকা পালন করছে? এবার একটা নতুন তত্ত্ব এলো, নব্বইয়ের দশকের প্রথমভাগে পল (Paul) এবং অরলিখ (Anne Ehrlich) রিভেট প্রকল্পের (Rivet hypothesis) অবতারণা করলেন। রিভেট (Rivet) কথার অর্থ ছোট পিন যা দিয়ে ধাতুর প্লেট আটকানো থাকে। একটি বাস্তুতন্ত্র এরূপ অনেকগুলি ধাতুর প্লেট দিয়ে নির্মিত আর এই রিভেটগুলি দিয়ে একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের সাথে যুক্ত রাখে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী জীব বৈচিত্র্য অনেকটা রিভেটের মতন, প্রত্যেকেই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখন একটি রিভেট যদি নষ্ট হয়ে যায় বা তবে তার সাথে যুক্ত প্লেটগুলি কিন্তু নড়বড় হয়ে যায়, অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্রে একটু অসুবিধা হয়, কিন্তু বাস্তুতন্ত্রটি সেটা মানিয়ে নেয়, কয়েকটি রিভেটের ক্ষতি হলেও অনেকসময় বাস্তুতন্ত্রটি হয়তো মানিয়ে নিতে সমর্থ হয় তবে তার বেশি রিভেটের ক্ষতি হলে কিন্তু বাস্তুতন্ত্রটির পক্ষে সেটা মানিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হয়না। পরবর্তী দশকে ব্রায়ান ওয়াকার (Brian Walker)  রিডানডেন্সি প্রকল্পের (Redundancy hypothesis) অবতারণা করলেন। এটি বোঝা কিন্তু একটু সহজ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো একটি বাস্তুতন্ত্রে অনেক জীবের মধ্যে সকলের ভূমিকা এক নয়। যেমন ধরো জাহাজ বা উড়োজাহাজ একটি বাস্তুতন্ত্র, এখানে পাইলট বা নাবিকের ভূমিকা, জাহাজ এটেন্ডেন্টদের ভূমিকা, যাত্রীদের ভূমিকা আলাদা আলাদা। এবার বোঝা যাচ্ছে, যে এই বাস্তুতন্ত্রে, মানে জাহাজ চালানোতেনাবিকের ভূমিকা অনেক বেশি। এছাড়াও আর একটি প্রকল্প রয়েছে যা ইডিওসিনক্রেটিক প্রকল্প (Idiosyncratic hypothesis) নামে পরিচিত (তবে এ ব্যাপারে এখানে বলে ব্লগটিকে অধিক দীর্ঘ করবো না)

কাজেই বোঝা যাচ্ছে একটি বাস্তুতন্ত্রের সকল প্রজাতির ভূমিকা আলাদা। এবার গুরুত্বের বিচারে প্রজাতিগুলিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। প্রথমেই আসি এক ধরণের প্রজাতির দিকে যাদের কীস্টোন প্রজাতি (Keystone species) বলা হয়। আমরা যখন বিভিন্ন জঙ্গল বেড়াতে যাই তখন এরূপ কীস্টোন প্রজাতির দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করি। যেমন লঞ্চে করে সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া হয় তখন বাঘ দেখতে পেলে আনন্দের সীমা থাকে না, মনে হয় বেড়ানোটা সার্থক হলো। আবার গুজরাতের গির অরণ্যে গিয়ে সিংহ, আসামের কাজিরাঙা অভয়ারণ্যে গিয়ে গন্ডার, পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া বা গরুমারাতে হাতি বা গন্ডার দর্শন প্রধান লক্ষ্য বা আকর্ষণ হয়ে থাকে। কীস্টোন প্রজাতি একটি সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করে, এর অর্থ, বাস্তুতন্ত্রটি ওই প্রজাতির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং কীস্টোন প্রজাতি ব্যতীত বাস্তুতন্ত্রটি উল্লেখযোগ্য ভিন্ন হবে বা সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। এই সকল কীস্টোন প্রজাতির উপর বাস্তুতন্ত্রটি বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল। কীস্টোন প্রজাতি কিন্ত সাধারণভাবে তিন প্রকার হয়ে থাকে। যেমন শিকারী (Predator) প্রজাতি, মিউচুয়ালিস্ট বা পারস্পরিক উপকারপ্রাপ্ত প্রজাতি (Mutualist) প্রজাতি এবং ইকোলজিকাল ইঞ্জিনিয়ার (Ecological engineer) যেমন বাঘ একটি শীর্ষ শিকারী (Apex pyramid) প্রাণী, এনার্জি বা খাদ্য পিরামিডের উপরিভাগে অবস্থান করে, এর উপর নির্ভর করে ওই জঙ্গলের শিকারের (যেমন হরিণের) সংখ্যা, এবং সম্পর্কিত বাস্তুতন্ত্র। এনার্জি পিরামিডের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাস্তুতন্ত্রে যথাক্রমে প্রথমে ডিকম্পোজার (Decomposer, যারা পচনে সাহায্য করে), এর উপরে প্রোডিউসার বা অটোট্রফ (Producer-Autotroph, যারা সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে যেমন উদ্ভিদ), এর উপর প্রাইমারি কনসিউমার (Primary consumer, যারা প্রোডিউসারকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যেমন তৃণভোজী প্রাণী হরিণ ইত্যাদি), এর উপর সেকেন্ডারি কনসিউমার (Secondary consumer, যারা প্রাইমারি কনসিউমারকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে যেমন মাংসাশী প্রাণী), এর উপর টার্শিয়ারি কনসিউমার (Tertiary consumer, যারা অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে), এবং সবথেকে উপরে শীর্ষ শিকারী (Apex predator, যারা প্রাইমারি, সেকেন্ডারি বা টার্শিয়ারি কনসিউমারকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যেমন বাঘ, সিংহ, ঈগল, হাঙ্গর) কাজেই বোঝা গেলো কোনো একটি বাস্তুতন্ত্র একেবারে শীর্ষ শিকারীর উপর নির্ভর করে। আবার গন্ডার বা হাতি ইকোলজিকাল ইঞ্জিনিয়ারের উদাহরণ, এরা নরম মাটিতে গর্ত করে, তাতে  জল জমে এবং সেগুলি অন্যান্য জীবের জন্যে পানীয় জলের উৎস হয়, হাতি গাছ বা গাছের ডাল ভেঙে বাস্তুতন্ত্রকে রূপ প্রদান করে, এইভাবে বাস্তুতন্ত্রটি এই প্রজাতির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। আবার মিউচুয়ালিস্ট-র প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মৌমাছিরা, এরা ফুল থেকে নেক্টর, পরাগ সংগ্রহ করে এবং উদ্ভিদের পরাগসংযোগে সাহায্য করে। যাইহোক, জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র বোঝাতে অনেকটা বিষয়ভিত্তিক (যদিও প্রাথমিক) আলোচনা করে ফেললাম। তবে আরও কয়েকটি প্রজাতির কথা না বললেই নয়। যেমন আমব্রেলা প্রজাতি (Umbrella species, এই প্রজাতিরা অনেকটা কীস্টোন প্রজাতির মতোই, তবেএরা একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত থাকে, যেমন সাইবেরিয়ান বাঘ), ফাউন্ডেশন প্রজাতি (Foundation species, এদের মধ্যেই রয়েছে ইকোলজিকাল ইঞ্জিনিয়াররা যার উল্লেখ আমি আগেই করেছি এই প্রজাতিরা বাসস্থান গড়ে তুলতে বা তাকে বজায় রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করে, যেমন কোরাল (Coral) যা আন্দামানের কোরাল রিফ (Coral reef) গঠন করেছে), ইনডিকেটর প্রজাতি (Indicator species, এই সকল প্রজাতির বৃদ্ধি বা হ্রাস বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশগত (দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি) পরিবর্তনের সূচনা দেয়, যেমন মেফ্লাই (Mayfly)-এর হ্রাস পাওয়া জলাশয়ের দূষণকে চিহ্নিত করে, মোনার্ক বাটারফ্লাই (Monarch butterfly)-এর হ্রাস পাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের, আবার লাইকেনের (Lichen) হ্রাস পাওয়া বাতাসের গুণমানের হ্রাস পাওয়াকে চিহ্নিত করে), ফ্ল্যাগশিপ প্রজাতি (Flagship species, এই প্রজাতিরা একটি অঞ্চলের সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে মাসকটের মতন রিপ্রেজেন্ট করে, অনেক সময় এরা পরিবেশ বা সংরক্ষণের বিভিন্ন ক্যাম্পেন বা আলোচনার প্রতীক হিবেসেও বিবেচিত হয়, যেমন জায়েন্ট পান্ডা)  

স্বাভাবিকভাবেই এই সকল প্রজাতির, যাদের উপর একটা বাস্তুতন্ত্র উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভরশীল, উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, এদের সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয় যাতে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রটিকে সংরক্ষণ করা যায়। সাস্টেনেবেল ট্যুরিজম কিন্ত ওয়াইল্ড লাইফ এবং জীব বৈচিত্র্যের উপকার করে থাকে। তবে সে বিষয়ে বিশদে অন্য কখনও আলোচনা করবো। আপাতত এই পর্যন্ত।

বিশদে জানার জন্যে References:

Stiling, P. 2002. Ecology Theories and Application. Fourth Edition, Prentice Hall, NJ, USA.

Higginbottom, K. (Ed.) 2004. Wildlife Tourism Impacts, Management and Planning. Common Ground, CRC for Sustainable Tourism, Australia.

Cottee-Jones, H.E.W.; Whittaker, R.J. 2012. The keystone species concept: a critical appraisal. Frontiers of Biogeography 4(3): 117- 127. https://doi.org/10.21425/F5FBG12533 

Hale, S.L.; Koprowski, J.L. 2018. Ecosystem-level effects of keystone species reintroduction: a literature review. Restoration Ecology. https://doi.org/10.1111/rec.12684 


জঙ্গল বিষয়ে কিছু কথা (A few words about Forest)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)



আমাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা জঙ্গলকে (ফরেস্ট/Forest) খুব ভালোবাসেন, প্রকৃতির হাতছানিতে, জীবজন্তু কিংবা উদ্ভিদের আকর্ষণে প্রায়ই, বা সপ্তাহান্তে, বেরিয়ে পড়েন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আমার এই ব্লগের উদ্দেশ্য জঙ্গল সম্বন্ধে প্রাথমিক আলোচনা করা, বিভিন্ন প্রকার সংরক্ষিত স্থান (মূল উদ্দেশ্য- সংরক্ষণ), বিভিন্ন প্রকার জঙ্গলের (পরিবেশগত ভাবে) আলাদা আলাদা চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে একটু চর্চা করা। প্রথমেই সংরক্ষিত স্থান হিসেবে জঙ্গলকে দেখা যাক। সংরক্ষিত স্থানকে আমরা প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি। যেমন ন্যাশনাল পার্ক (National Park)ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি (Wildlife Sanctuary), এবং বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ (Biosphere Reserve)। পশ্চিমবঙ্গে সংরক্ষিত স্থান বা প্রোটেক্টেড এরিয়ার (Protected area) মধ্যে রয়েছে ছয়টি ন্যাশনাল পার্ক (সিঙ্গালিলা, নেওরা ভ্যালি, গরুমারা, বক্সা, সুন্দরবন, জলদাপাড়া), ষোলোটি স্যাংচুয়ারি (সেঞ্চল, মহানন্দা, চাপড়ামারি, বক্সা, সজনেখালি, হ্যালিডে, লোথিয়ান, রায়গঞ্জ, চিন্তামণি কর, বিভূতিভূষণ, জোড়পোখরি, বল্লভপুর, রমনাবাগান, পশ্চিম সুন্দরবন, পাখি বিতান), দু'টি করে বাঘ রিজার্ভ (বক্সা, সুন্দরবন) আর হাতি রিজার্ভ (ময়ূরঝর্ণা, পূর্ব ডুয়ার্স), এবং একটি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ (সুন্দরবন) কাজেই বোঝা যাচ্ছে হাতের কাছেই রয়েছে অনেক পছন্দ, সময় সুযোগ মতন বেছে নিলেই হলো।

ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি, বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ-র মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। একটু সহজ করে এদের মধ্যে পার্থক্যটা বলা যাক।  ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ হেতু প্রতিষ্ঠিত। তুলনামূলকভাবে এর আয়তন কম হয়ে থাকে, অনেক সময় সীমানা খুব একটা নির্দিষ্ট করা থাকে না। সীমাবদ্ধতা থাকলেও কিছু কার্যকলাপ করা যেতে পারে, যেমন পশু চারণ, ঔষধি গাছ গাছড়া সংগ্রহ, কিছু সময় জ্বালানি শুকনো কাঠ, পাতা সংগ্রহ ইত্যাদি, তবে কোনো মতেই শিকার বা বন্য প্রাণীর ক্ষতি করা নয়। 

ন্যাশনাল পার্ক কিন্তু শুধুমাত্র বন্যপ্রাণী নয়, তার সাথে উদ্ভিদ, ঐতিহাসিক কোনো প্রকার স্থাপত্য ইত্যাদি সকল অর্থাৎ প্রাণী, উদ্ভিদ, এবং নির্জীব পদার্থ সহ সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে সংরক্ষণ করে। ন্যাশনাল পার্কের সীমানা অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং এখানে মানুষের কার্যকলাপ একেবারেই সীমাবদ্ধ। 

এবার আসি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের কথায়। বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ কিন্তু উপরোক্ত দুই প্রকার সংরক্ষিত স্থান বা প্রোটেক্টেড এরিয়া থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বড় হয়। এটি সম্পূর্ণ জীব বৈচিত্রকে সংরক্ষণ হেতু স্থাপন করা হয় এবং এটি কিন্তু ওই অঞ্চলে বসবাসকারী জনজাতিদের উন্নতিকল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ন্যাশনাল পার্কের মতন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের সীমানাও কিন্তু অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং এর মধ্যে কিন্তু  ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি থাকতে পারে। যেমন পাঁচমাড়ি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের মধ্যে সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক, এবং কয়েকটি স্যাংচুয়ারি যথা বরি স্যাংচুয়ারি, পাঁচমাড়ি স্যাংচুয়ারি রয়েছে।  আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে রয়েছে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। এই বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভকে কয়েকটি অঞ্চল বা জোনে (Zone) ভাগ করা যায়। যেমন একেবারে কেন্দ্রে থাকে কোর অঞ্চল (Core zone), এখানে কিন্তু কোনো প্রকার মনুষ্য কার্যকলাপ করা যায়না, এটি অন্ত্যন্ত গভীর বন। এর পর থাকে বাফার অঞ্চল (Buffer zone), এই অঞ্চলে পশুচারণ, পর্যটন ইত্যাদি কিছু মনুষ্য কার্যকলাপ সম্ভব। এর পরবর্তী অঞ্চলটি হলো ট্রানজিশন অঞ্চল (Transition zone), এখানে মানুষের বসতি, চাষবাস দেখা যায়। 


এ তো গেলো সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে জঙ্গলের বিবরণ। এবার আসি পরিবেশগত ভাবে বিভিন্ন ধরণের জঙ্গলের বর্ণনায়। যদি আপনি জঙ্গলের প্রকৃতির দিকে তাকান তবে প্রত্যেক জঙ্গলের প্রকৃতি আপনার কিন্তু একই রকম লাগবে না, প্রকৃতির বৈচিত্র আপনার চোখে পড়বে।  একটু সহজ ভাবে বলি, উত্তরবঙ্গ বেড়াতে গিয়ে জলদাপাড়া, গরুমারা কিংবা নেওরা ভ্যালি ঘুরে এলেন আবার দক্ষিণবঙ্গের  সুন্দরবন বেড়ালেন, দু'টো তো আর এক হলো না, সেটাই বলছি। এই যে পার্থক্য সেটা নির্ভর করে ওই স্থানের জলবায়ুর উপর, অর্থাৎ ওই স্থানের তাপমাত্রা কত, বছরে বৃষ্টিপাত কেমন হয় ইত্যাদি, যা আবার স্থানটির ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে। এই বিভিন্ন আবহাওয়া, জলবায়ু, মৃত্তিকার প্রকৃতি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সেই স্থানের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ জন্ম নেয়, এই উদ্ভিদ কিন্তু জঙ্গল বাস্তুতন্ত্রের প্রধান উপাদান।   

জঙ্গল প্রধানত তিন প্রকার, যেমন বোরিয়াল ফরেস্ট (Boreal forest), টেম্পারেট ফরেস্ট (Temperate forest) এবং ট্রপিক্যাল ফরেস্ট (Tropical forest)। বোরিয়াল ফরেস্ট তাইগা (Taiga) নামেও পরিচিত, এই প্রকার ফরেস্ট সাবআর্কটিক অঞ্চলে দেখা যায়। সাবআর্কটিক অঞ্চলটি হলো উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত আর্কটিক সার্কেলের (Arctic circle) দক্ষিণ অংশ। উত্তরের তুন্দ্রা (Tundra) অঞ্চল থেকে দক্ষিণের টেম্পারেট অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে এই প্রকার ফরেস্ট দেখা যায়। আলাস্কা, কানাডা, স্ক্যান্ডেনেভিয়া, সাইবেরিয়া স্থানগুলিতে এই প্রকার জঙ্গল দেখা যায়। রাশিয়াতে পৃথিবীর বৃহত্তম তাইগা রয়েছে। এই জঙ্গলের উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্প্রুস (Spruce), পাইন (Pine), ফার (Fir) ইত্যাদি কনিফেরাস (Coniferous) উদ্ভিদগুলি (যাদের পাতাগুলি সুচের মতন সরু, পাতানো বৃহৎ নয়)। প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন ধরণের রোডেন্ট (Rodents), বড়ো প্রজাতির হরিণ (Deer), মুস (Moose), ভাল্লুক (Bear), লিনক্স (Lynx), আর সাইবেরিয়ান বাঘের (Siberian tiger) কথা তো সকলেরই জানা, পাখিদের মধ্যে রয়েছে ঈগল (Eagle), পেঁচা (Owl) ইত্যাদি। এই তাইগা আবার দু'ধরণের হয়ে থাকে, সাধারণত উচ্চ অক্ষাংশে পাওয়া যায় ওপেন ক্যানোপি বোরিয়াল ফরেস্ট (Open canopy boreal forest; 'ক্যানোপি' কথাটির অর্থ ছাউনি) যা আবার লাইকেন জঙ্গল বলেও পরিচিত।  ঠান্ডা অধিক হওয়ার দরুন এখানে জীব বৈচিত্র কম হয়ে থাকে। নিম্ন অক্ষাংশে রয়েছে ক্লোস্ড ক্যানোপি বোরিয়াল ফরেস্ট (Closed canopy boreal forest), এখানে আবহাওয়া একটু কম রুক্ষ, কাজেই জীব বৈচিত্র তুলনামূলক ভাবে বেশি।

এর পর আসি টেম্পারেট ফরেস্টে। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই প্রকার ফরেস্ট টেম্পারেট অঞ্চলে পাওয়া যায়। সাধারণভাবে নিম্ন অক্ষাংশে (উত্তর গোলার্ধে ৬৬.৫ ডিগ্রী থেকে ২৩.৫ ডিগ্রী, আবার দক্ষিনে গোলার্ধেও তাই) অবস্থিত টেম্পারেট অঞ্চল, এখানে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়ে কাজেই তাপমাত্রা কমের দিকে থাকে এবং বছরে চারটি ঋতু যথাক্রমে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, এবং বসন্ত পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। টেম্পারেট ফরেস্টে আবার তিন প্রকার, পর্ণমোচী বা ডেসিডুয়াস ফরেস্ট (Deciduous forest), কনিফেরাস ফরেস্ট (Coniferous forest) এবং টেম্পারেট রেন ফরেস্ট (Temperate rain forest)। ডেসিডুয়াস ফরেস্টের উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদগুলি হলো ম্যাপেল (Maple), ওক (Oak), চেস্টনাট (Chestnut), গিংগো বাইলোবা (Ginkgo biloba) ইত্যাদি। ডেসিডুয়াস উদ্ভিদগুলি শীতকালে তাদের সমস্ত পাতা ঝরিয়ে দেয়। বাতাসে আর্দ্রতা এতটাই কম হয় যে পাতা গুলি শুকিয়ে ঝরে পরে যায়, আবার শীতকাল অতিক্রমিত হলে বসন্তের শুরুতে আবার নতুন পাতায় ভরে ওঠে, বড়ই দৃষ্টিনন্দন হয় সেই সময়। এই সময় পৃথিবীর অনেক শহরের মতন আমাদের (বর্তমান বসবাসের) শহর আনদং -এও চেরি ব্লসম (Cherry blossom) হয়ে থাকে, রাস্তার দু'পাশে গাছ গুলি ফুলে ভরে ওঠে। অসাধারণ সুন্দর লাগে এ দৃশ্য। 

অপরপক্ষে কনিফেরাস উদ্ভিদগুলির পাতা সূঁচের ন্যায় হয়ে থাকে, এই অভিযোজন নিজের প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং এদের বীজগুলি কাষ্ঠল কোণের (Cone) ভিতরে থাকে। আগেই উল্লেখ করেছি এই জাতীয় উদ্ভিদ হলো পাইন (Pine), ফার (Fir), সিডার (Cedar), হেমলক (Hemlock), জুনিপার (Juniper), স্প্রুস (Spruce), লার্চ (Larch) ইত্যাদি। এছাড়াও টেম্পারেট অঞ্চলের কিছু জায়গায় বছর বেশ বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে যে ফরেস্ট গড়ে ওঠে তা হলো টেম্পারেট রেন ফরেস্ট। এর উদাহরণ উত্তর আমেরিকার আপালাচিয়ান রেন ফরেস্ট (Appalachian temperate rain forest), দক্ষিণ আমেরিকার ভালদিভিয়ান (Valdivian temperate rain forest)  এবং ম্যাগেলানিক রেন ফরেস্ট (Magellanic temperate rain forest), ইউরোপের কোলচিয়ান রেন ফরেস্ট (Colchian temperate rain forest) ইত্যাদি। এবার আসি নিজেদের দেশে। আমাদের পূর্ব হিমালয়ান যে ব্রডলিফ ফরেস্ট (East Himalayan broadleaf forest) রয়েছে তাও কিন্তু এই রেন ফরেস্টের উদাহরণ। বিভিন্ন ধরণের ওক (Oak), রোডোডেনড্রন (Rhododendron), ম্যাগনোলিয়া (Magnolia), সিনামোন (Cinnamon), হিমালয়ান ম্যাপেল (Himalayan maple), হিমালয়ান বার্চ (Himalayan birch), বার্চ (Birch), পার্সিয়ান ওয়ালনাট (Persian walnut) ইত্যাদি উদ্ভিদ এই জঙ্গলে দেখা যায়। গোল্ডেন লাঙ্গুর (Gee's Golden langur), সাদা পেট বিশিষ্ট ইঁদুর (Brahma white-bellied rat), জায়ান্ট ফ্লাইং স্কুইরেল (Hodgson's giant flying squirrel, Namdapha flying squirrel), টাকিন (Takin), হিমালয়ান শিরো (Himalayan serow), ম্যাকাক বাঁদর (Macaque), লাল পান্ডা (Red panda), ক্লাউডেড লেপার্ড (Clouded leopard) ইত্যাদি এই জঙ্গলের প্রাণী। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরণের পাখি। কাজেই এদের দেখতে যেতে পারেন অরুণাচল প্রদেশের ঈগল নেস্ট ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Eagle nest Wildlife Sanctuary), মৌলিং ন্যাশনাল পার্ক (Mouling National Park)), কামলাং ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Kamlang Wildlife Sanctuary), নামদাফা ন্যাশনাল পার্ক (Namdapha National Park), পশ্চিমবঙ্গের নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক (Neora valley National Park) ইত্যাদি।

এই প্রসঙ্গে স্তন্যপায়ী এবং সরীসৃপ প্রাণীদের বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনার জন্যে ক্লিক করুন।

অবশেষে আসি ট্রপিক্যাল ফরেস্টে। আমাদের সকলেরই জানা আছে পৃথিবীর ট্রপিক্যাল অঞ্চলটি, ক্যান্সার (Cancer) এবং ক্যাপ্রিকর্ন (Capricorn) অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চল হলো ট্রপিক্যাল অঞ্চল। আমাদের দেশ ভারতবর্ষের অধিকাংশই এর মধ্যে অবস্থান করে। সূর্যালোক অধিক পরিমানে প্রাপ্ত হওয়ায় এই অঞ্চল উষ্ণ হয় আর জীব বৈচিত্রে পূর্ণ। এই প্রকার জঙ্গলের সান্নিধ্যেই আমি জীবনের অনেকটা অতিবাহিত করেছি, কখনও উত্তর-পূর্বে, আবার কখনও মধ্য ভারতে। জঙ্গলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় মানুষের জীবন। সে জ্বালানির শুকনো কাঠ কুড়োয়, পাতা কুড়িয়ে আনে, গৃহপালিত পশু চড়ায়, ফল-মূল-মধু সংগ্রহ করে। সে ঔষধি গাছ গাছড়া চেনে, রোগের উপশমে প্রাকৃতিক উপাদানগুলিকে ব্যবহার করার বিপুল তথ্য রয়েছে তাঁর জ্ঞানভাণ্ডারে, বিভিন্ন ফসলের স্থানীয় ভ্যারাইটি (Variety) সংরক্ষণ করে, জিন পুল (Gene pool) কে ক্ষয় হতে দেয় না। জঙ্গলের সাহচর্যে বেড়ে ওঠা মানুষ অনুভব করতে পারেন জঙ্গলকে, বনভূমির সাথে তাঁর আত্মার যোগাযোগ, সে তাঁর জীবনযাত্রার মধ্যে দিয়েই পরিচর্যা করে প্রকৃতির। তাঁদের থেকে আমরা শিখি, শেখার চেষ্টা করি। বর্তমানে যে পরিবেশের ধারণক্ষমতার (Environmental Sustainability) উপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করি, তা কিন্তু এই সকল জনজাতি সহস্র বছর ধরে তাঁদের জীবনধারণের মধ্যে দিয়ে অনুশীলন করে আসছেন। এই বিপুল অমূল্য জ্ঞান ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। ট্রপিক্যাল ফরেস্টকে আমরা প্রধানত চারভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন চিরহরিৎ রেন ফরেস্ট (Evergreen rain forest), ট্রপিক্যাল আর্দ্র ফরেস্ট (Tropical moist forest), ট্রপিক্যাল শুষ্ক ফরেস্ট (Tropical dry forest), এবং পরিশেষে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (Mangrove forest)। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপে, উত্তর-পূর্বে, পশ্চিমঘাটে (যে স্থানগুলিতে বছরে ২৩০ সেন্টিমিটারের মতন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে) যে বনভূমি রয়েছে তা চিরহরিৎ ফরেস্ট। রাবার (Rubber), সিঙ্কোনা (Cinchona), রোজউড (Rosewood), মেহগনি (Mahogany), এবনি (Ebony), টিক (Teak), ইন্ডিয়ান লরেল (Indian Laurel) ইত্যাদি এই জঙ্গলে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে বছরে প্রায় ২০০ সেন্টিমিটারের বা বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। ট্রপিক্যাল আর্দ্র ফরেস্ট (বৃষ্টিপাতের পরিমান বছরে ১০০ থেকে ২০০ সেন্টিমিটার), এবং শুষ্ক ফরেস্ট (বৃষ্টিপাতের পরিমান বছরে ৭০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার) নির্ভর করে ওই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমানের উপর। চন্দন (Sandalwood), বাঁশ (Bamboo), শাল (Sal), কুসুম (Kusum), খয়ের (Khoir), মালবেরি (Mulberry), শিশু (Shishu), কেন (Cane), অর্জুন (Arjun) ইত্যাদি আর্দ্র বনভূমিতে পাওয়া যায়। পশ্চিমঘাটের পূর্ব ঢাল, ছোটনাগপুর মালভূমি, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং উত্তর পূর্বের কিছু অংশে এই প্রকার বনাঞ্চল দেখা যায়। অপরপক্ষে টিক (Teak), নিম (Neem), পিপল (Peepal), শাল (Sal), খয়ের (Khoir), বেল (Bel), পলাশ (Palash), লরেল (Laurel) ইত্যাদি শুষ্ক বনভূমিতে পাওয়া যায়। বিহার, উত্তর প্রদেশ, উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের কিছু অঞ্চলের বনভূমি এই প্রকার। উপকূল অঞ্চলে যে বনভূমি দেখা যায়, সেটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।  এখানকার উদ্ভিদগুলি লবনাক্ত মাটি এবং খাড়ির জলে বেঁচে থাকার জন্যে উপযোগী অভিযোজন করেছে, যেমন শ্বাসমূল। সুন্দরী (Sundari)গরান (Garan), গেঁওয়া (Genwa), গোলপাতা (Golpata), হেঁতাল (Hental), গর্জন (Garjan), ধুঁধুল (Dhundhul), পশুর (Pashur), হোয়া (Hoya), কেওড়া (Keora) ইত্যাদি এই বনভূমিতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন (Sundarbans), ওড়িশার ভিতরকণিকা (Bhitarkanika) ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের উদাহরণ।

আশা করি, জঙ্গল সম্বন্ধে আমি একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে পেরেছি। বেড়াতে যাওয়ার পূর্বে সহজেই বুঝে নিন সেই জঙ্গলের প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য, বেড়ানোর পরিকল্পনা করুন সেই মতন। 

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...