পৃষ্ঠাসমূহ

খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তায় পরাগ-সংযোগকারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা (The Crucial Role of Pollinators in Food and Nutrition Security)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্বের একটি ব্লগে (Photographs of some insects) আমি কয়েকটি কীট-পতঙ্গের ছবি দিয়েছি। ছবি তুলতে আমি ভালোবাসি, তবে ব্লগে এই ছবিগুলি প্রকাশ করার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র কয়েকটি ছবির প্রদর্শন করা নয়, আশা করি এই ছবিগুলি (বাস্তবে খালি চোখে দেখলে আরও ভালো লাগে) এই কীট-পতঙ্গগুলি সম্বন্ধে পাঠক-পাঠিকাদের মনে কৌতূহল উদ্রেক করবে। আসলে অনেক সময় আমরা বিস্মৃত হই আমাদের বাস্তুতন্ত্রটি কি প্রকারে আমাদের সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলি আমাদের প্রদান করে চলেছে, সেই বিষয়ে (অনুগ্রহ করে পড়ুন বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য)। 

কীট-পতঙ্গ, বিশেষত পরাগ বহনকারী বা পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গ (Pollinator), আমাদের খাদ্য উৎপাদনের জন্যে অপরিহার্য। যে সকল খাদ্যশস্য আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি তার প্রায় ৭৫% পরাগ-সংযোগকারী প্রাণীদের উপর নির্ভর করে, এই সকল পরাগ-সংযোগকারী প্রাণীদের মধ্যে কীট-পতঙ্গ উল্লেখযোগ্য (About 75% of global food crop types depend on pollinators)। যদি কোনো কারণে এরা প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয় বা এদের বৈচিত্র্য বা সংখ্যা কমে যায়, তবে তার ফলে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পাবে, যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান ফসলগুলি থেকে আসত, ফলন হ্রাস পাওয়ায় পুষ্টি উপাদানগুলির সরবারহ স্বাভাবিক কারণেই সংকুচিত হয়ে পড়বে। এর ফলে আমাদের খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরা যে কেবলমাত্র উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে তা নয়, ফসলের গুণমানও বৃদ্ধি পায়। 

একদিকে পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গদের সংখ্যা হ্রাস পেলে ফসল উৎপাদন হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং এরফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর পাশাপাশি এরফলে পুষ্টি উপাদানগুলির পরিমাণও কিন্তু হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং তা মানব স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বলি, ধরা যাক, কোনো এক স্থানে কুমড়ো চাষ করা হয়। এই ফসলটি উৎপাদনের জন্যে পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গদের প্রয়োজন হয়। এখন যদি এই পরাগবাহকদের বৈচিত্র বা সংখ্যা যে কোনো কারণেই কমে যায় তবে তার ফলে কুমড়ো গাছের পরাগ সংযোগ ব্যাহত হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন কম হবে। কম উৎপাদন হলে কৃষকের আয় কমে যাবে তা বলাই বাহুল্য। ১০০ গ্রাম কুমড়ো একটি নির্দিষ্ট পরিমান ভিটামিন এ (Vitamin A) ধারণ করে, সেই হিসেবে থেকে যত উৎপাদনের পরিমাণ ততই পুষ্টি উপাদানগুলির (যেমন, ভিটামিন এ) পরিমাণও হ্রাস পাবে। 

এ স্থানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরাগসংযোগকারী কীট-পতঙ্গের কথা উল্লেখ করি, তবে বিষয়টি একটু সহজ হবে।  

প্রথমেই মনে আসে মৌমাছি (Honey bee- Apis spp.) - আমাদের দেশে কিন্তু বেশ কয়েক প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায় যেমন Apis mellifera, Apis cerana, Apis dorsata, Apis laboriosa ইত্যাদি। ফসলের মধ্যে এরা প্রধানত আপেল, আমন্ড (Almond), ব্লুবেরী (Blueberries), অ্যাভোকাডো (Avocado), শশা, কুমড়ো, মেলন (Melon), সর্ষে, তিল, লিচু, ক্রেনবেরি (Craneberry), ধোনে ইত্যাদির পরাগ সংযোগে সাহায্য করে। মৌমাছিরা সাধারণ পরাগায়নকারী (Generalist), মোটামুটি সকল প্রকার ফল, বাদাম এবং সবজি ফসলের পরাগসংযোগে অংশগ্রহণ করে , ফসলের ফলন এবং গুণমানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। 

এরপর আসি বাম্বেল বি-র (Bumble bee- Bombus spp.) কথায়, যাকে আমরা ভ্রমর বলে চিনি। প্রধানত টম্যাটো, লঙ্কা, স্ট্রবেরী (Strawberries), ব্লুবেরী (Blueberries), লবঙ্গ (Clove) ইত্যাদি ফসলের পরাগসংযোগে ভ্রমর খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বাম্বেল বি (Bumble bee) বিশেষভাবে "বাজ পরাগায়ন" (Buzz pollination) এ কার্যকরী, এরা যখন উড়ে বেড়ায়, কান পাতলে একটা বুউজজ জজজ  বুউজজ জজজ শব্দ শোনা যায়, এর ফলে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তারফলে গাছের যেমন টম্যাটো এবং লঙ্কার পরাগ নির্গত হয়। তাদের দৃঢ় দেহ (Robust body) এবং দীর্ঘ জিহ্বা (Proboscis) তাদের গভীর ফুলে প্রবেশ করতে দেয়। 

ম্যাসন বি (Mason bee- Osmia spp.) ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ পরাগ সংযোগকারী, এরা আপেল, নাসপাতি, চেরি (Cherries), আমন্ড, পিচ ইত্যাদি ফলের পরাগসংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ম্যাসন বি-রা প্রারম্ভিক ঋতুর পরাগায়নকারী এবং উচ্চ পরাগায়ন দক্ষতার কারণে ফল বাগানের পরাগায়নের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। 

কার্পেন্টার বি (Carpenter bee- Xylocopa spp.) মূলত প্যাশনফ্রুট (Passionfruit), বেগুন এবং লেগুম জাতীয় ফসলের পরাগ সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কার্পেন্টার বি আকারে বড়, সলিটারি অর্থাৎ মৌমাছির মতন এরা সমাজবদ্ধ নয়, এরা বিশেষত বড় পাপড়ি (Large petals) এবং নলাকার আকৃতির (Tubular shape) বিভিন্ন ধরনের ফুলের পরাগায়ন করে।

প্রজাপতি (Butterfly) তো আমরা সকলেই দেখেছি, ফুলের উপর এরা যখন উড়ে বেড়ায় তখন তা বড়ই ভালো লাগে। এরাও কিন্তু পরাগায়নে সাহায্য করে, মূলত গাজর, পেঁয়াজ, বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ (Herb), এবং বন্য ফুল এদের দ্বারা উপকৃত হয়। প্রজাপতি হল গৌণ পরাগায়নকারী কিন্তু ভেষজ এবং ফুলের উদ্ভিদের পরাগায়নে অবদান রাখে, বিশেষ করে যাদের সমতল (Flat) বা গুচ্ছ ফুল (Clustered) রয়েছে। অপরপক্ষে বিভিন্ন মথ (Moth, Sphingidae পরিবারভুক্ত) তামাক, ইভিনিং প্রাইমরোজ (Evening primrose), ইয়ুক্কা (Yucca) এবং নানান ধরণের ফলের পরাগায়নে অংশগ্রহণ করে। মথ সাধারণত রাতে সক্রিয় থাকে এবং যে ফুলগুলি সন্ধ্যায় বা রাতে ফোটে তাদের পরাগায়ন করে। এগুলি নির্দিষ্ট রাত্রে প্রস্ফুটিত উদ্ভিদের পরাগায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আমি নিশ্চিত যে আমাদের মধ্যে অনেকেই হোভারফ্লাই (Hoverfly, Family: Syrphidae) চেনেন। এরা গাজর, ধোনে, সেলেরি (Celery), মৌরি ইত্যাদির পরাগায়নে সাহায্য করে।  হোভারফ্লাই ছোট ফুল এবং ছাতার আকৃতির ফুলের গুচ্ছ (Umbel-shaped flower clusters) বিশিষ্ট উদ্ভিদের পরাগায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারা এফিডের (Aphid) প্রাকৃতিক শিকারী (Natural predators)।  

লিফকাটার বি (Leafcutter bee- Megachile spp.) বা মেগাচিলিড বি (Megachilid bee) আলফালফা (Alfalfa), বিন (Beans), মেলন (Melon), বেরী (Berries) ইত্যাদির পরাগায়নে সাহায্য করে। বিটলদের মধ্যে, বিশেষত Nitidulidae পরিবারভুক্ত স্যাপ বিটল (Sap beetle), ম্যাগনোলিয়া (Magnolia), ওয়াটার লিলি (Water lilies), পপ (Pawpaw), কোকো (Cocoa) ইত্যাদির পরাগায়ন করে। 

এছাড়াও আরও অনেক প্রজাতির কীট-পতঙ্গ (যেমন পিঁপড়ে, Halictidae পরিবারভুক্ত সোয়েট বি (Sweat bee) ইত্যাদি) রয়েছে, আর শুধু কীট -পতঙ্গ-ই নয়, অন্যান্য প্রাণী যেমন পাখি, বাদুড়, কয়েক প্রজাতির রোডেন্ট, ইত্যাদিরাও কিন্তু বিভিন্ন উদ্ভিদের পরাগায়নে সাহায্য করে। সেই বিষয়ে পরে কখনও বিশদে উল্লেখ করবো। 

বর্তমানে নানান কারণে, যেমন অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এই সকল পতঙ্গদের বাসস্থানের অবক্ষয় (Habitat degradation), নিবিড় কৃষিকাজ (ফসলের বৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত পরিমানে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার ইত্যাদি) (Intensive agriculture), প্যাথোজেন এবং পরজীবীদের আক্রমণ (Pathogen and parasite burden), এবং জলবায়ুর পরিবর্তন (Climate change) ইত্যাদি, এই সকল উপকারী অপরিহার্য কীট-পতঙ্গরা অনেক স্থানে কমে যাচ্ছে। এদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া একান্তভাবে অপরিহার্য, অন্যথায় আমাদের খাদ্য এবং পুষ্টির সংকট দেখা দেবে। কাজেই এদের সংরক্ষণ বাঞ্চনীয়। 

স্থানীয় পরাগ সংযোগকারী কীট-পতঙ্গগুলিকে চিহ্নিতকরণ, তাদের পর্যবেক্ষণ করা এবং প্ল্যান্ট-পলিনেটর নেটওয়ার্ক গঠনের (Plant-Pollinator network) মাধ্যমে তাদের গুরুত্ব অধ্যয়ন, সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সেই বিষয়গুলির সমাধানের জন্যে গবেষণা করা একান্ত প্রয়োজনীয়। এর পাশাপাশি এই সকল উপকারী পতঙ্গগুলির বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষত স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম এবং নাগরিক বিজ্ঞান প্রকল্পগুলির মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করে, এমনকি তাঁদের পর্যবেক্ষণকে ডেটাবেসে অন্তর্ভুক্ত করে এদের সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় মানুষের  অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।     

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...