পৃষ্ঠাসমূহ

Bengali literature লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Bengali literature লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক (Nutrition security and food - Part-3: Green leafy vegetables)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্বের পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন  পর্ব-১ পর্ব-২ 


বর্তমান পৃথিবীতে অন্যতম একটি সমস্যা হল 'মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ডেফিসিয়েন্সি' (Micro-nutrient deficiency), যা অনেক সময় 'হিডেন হাঙ্গার' (Hidden hunger) বলেও পরিচিত। পুষ্টির উপাদানগুলির দিকে যদি আমরা তাকাই, তবে দেখব কয়েকটি পুষ্টি উপাদান, যেমন শর্করা (Carbohydrate), স্নেহ পদার্থ (Fat), আমিষ জাতীয় পদার্থ (Protein), আমাদের শরীরে দৈনিক অধিক পরিমানে আবশ্যক বা প্রয়োজন, তাই এই উপাদানগুলিকে 'ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট' (Macro-nutrient) বলা হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকটি পুষ্টি উপাদান যথা খনিজ (Minerals) এবং ভিটামিন (Vitamins) স্বল্প পরিমানে আবশ্যক, তাই এগুলিকে 'মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট' বলা হয়ে থাকে। স্বল্প পরিমানে প্রয়োজন হলেও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা খনিজ পদার্থ (Minerals) এবং ভিটামিনগুলি অত্যন্ত আবশ্যক, অন্যথায় শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়ায় সমস্যা উৎপাদন হয়ে থাকে।। উদাহরণস্বরূপ, প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষ লোহার (Iron) স্বল্পতায় ভোগেন (McLean et al., 2009), আবার প্রায় ১.০২ বিলিয়ন মানুষ ভিটামিন A-র অভাবের শিকার (Akhtar et al., 2013)।

এই হিডেন হাঙ্গার কে প্রতিরোধ করার অন্যতম একটি পথ হল আহারে শাকের ব্যবহার কারণ এর মধ্যে খনিজ, ভিটামিন উপযুক্ত পরিমানে বিদ্যমান এবং নানান কার্যকরী বৈশিষ্ট্যসম্পূর্ণ  রাসায়নিক উপাদানও এর মধ্যে পাওয়া যায়। বাঙালির পাতে শাক নতুন নয়। কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আহারের বর্ণনায় শাকের উল্লেখ রয়েছে। কবি লিখেছেন:

"প্রথমে শুকুতা ঝোল দিল ঘন্ট শাক

প্রশংসা করয়ে সাধু বেঞ্জনের পাক।

ঘৃতে জবজব খায় মীন মাংস বড়ি

বাদ কর‍্যা খায় ভাজা কই দুই কুড়ি।

অম্বল খাইয়া পিঠা জল ঘটী ঘটী

দধি খায় ফেনি তায় শুনি মটমটী।"

আবার বিভিন্ন প্রকার শাক এবং তাদের রন্ধন প্রক্রিয়ারও উল্লেখ রয়েছে চন্ডীমঙ্গল কাব্যে:

"সাক তুলিতে দুয়া ফিরে বাড়ি বাড়ি

'খে করা নিল দুষা রঙ্গিন চুপড়ি।

নট্যা রাঙ্গা তোলে পাট পালঙ্গ-নলিতা

তিত পলতার পাতা ডগা তুলিল পলতা।

সাজ্যাতা পাজ্যাতা বন-পুই তুলে বলা

হিনচা কলমী শাক তোলে ডানিকলা।

কড়্যা সাক তোলে দুয়া ফিরে খেতি খেত

মহরি সোলপা  ধন্যা খিরপাই বেত।

বাড়ি বাড়ি ফিরে দুয়া দিয়া বাহুনাড়া

ডগী ডগী তোলে পুই পুনুকা কাঁচড়া।

কোমল কাঁকুড়ি-ডগা তুলিল করেলা

নাউডগা তোলে কিছু কচি কচি বলা।

বাছা ধুয়্যা শাক দুয়া করিল সাঁচনা

লতা পাতা শাক আগে রন্ধিল লহনা।

রন্ধন করেন রামা করি বড় ত্বরা

ঘন্টে  পুর‍্যা এড়ে রামা কুড়িয়া পাথরা।

ঘৃতে জবজব রান্ধে নলিতার শাক

কটু তৈলে বাথুয়া করিল দৃঢ় পাক।

রহিত কুমুড়া -বড়ি আলু দিয়া ঝোল

বদরী শকুল মীন আম্রে মুসুরি

পান দুই ভাজে রামা সরল সফরি।

পঞ্চাশ বেঞ্জন অন্ন করিল রন্ধন

থালায় ওদন বাটী ভরিয়া বেঞ্জন।

সাধ খান খুল্লনা নারীজন

অভয়ামঙ্গল গান শ্রীকবিকঙ্কন।"

কয়েক দশক পূর্বে খাদ্য তালিকার দিকে দৃষ্টিপাত করলে যে সকল আহার্য বস্তু দৃষ্টিগোচর হবে তা আজ আর হয়না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাঙালির শাক জাতীয় খাদ্যের তালিকাটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছেঅনেক শাক-ই আজ হারিয়ে গেছে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম কালীপুজোআর তার আগের দিনটিতে চোদ্দ প্রকারের শাক খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। কেন বা কিভাবে এই প্রচলন হলোতা আমি বিশেষ জানিনা। তবে বেশ মনে পড়েছোটবেলায় কখনও মামারবাড়ি গেলে দিদির সাথে ভোরবেলা যেতাম শাক তুলতেযা সব শাক পাওয়া যায় গ্রামের ক্ষেতের পাশেজলা জায়গায়সবগুলো চিনতাম না। পরবর্তীকালে চোদ্দশাক কিনতে বাজারে গেলে লালশাক সহযোগে অনেকটা পাতা দিয়ে দিতে দেখেছিএটাই এখন চোদ্দশাক বলে পরিচিত। কিন্তু একাধিকবার চোদ্দরকমের শাক বাজারে আলাদা আলাদা খোঁজ করে দেখেছি তা জোগাড় করা খুব সহজ নয়। বর্তমান বাজার পালংপুঁইলালএবং কিছু সময় লাউমুলোপাট শাকেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কলমিসাঞ্চেবেতোঘেঁটু শুশনিহেলেঞ্চা ইত্যাদি ধীরে ধীরে সংকোচনের আওতায়, বিশেষত শহর বা শহরতলিতে, এসে পড়ছে। এই সংকোচন কিন্তু আমাদের পুষ্টিকেও সংকুচিত করছে। নিচের টেবিল-১ -এ দেখে নিই প্রচলিত কয়েকটি শাক যা আমরা আমাদের আহারে ব্যবহার করে থাকি।

Table 1: বাংলায় তথা ভারতবর্ষে খাদ্য সিহেবে ব্যবহৃত কতগুলি শাকের তালিকা


এছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে আরো বিভিন্ন শাক পাওয়া যায়। কয়েকটি উদাহরণস্বরূপ, উত্তরাখণ্ডের দুম (Allium semnovii), জংলী চউলি (Amaranthus bilatum), ঢোল কানালি (Girardinia diversifolia), পায়ুম (Rumex nepalensis), পুয়ানু (Smilacina purpurea) ইত্যাদি (Mishra et al., 2008), আবার মনিপুরের ইয়েলাং (Polygonum barbatum), থামোউ (Nelumbo nucifera), চিংইয়েঙসিল (Antidesma diandrum) ইত্যাদি (Konsam et al., 2016) উল্লেখ করা যায়। পুষ্টিগত দৃষ্টিকোণ থেকে উল্লেখযোগ্য হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শাকগুলি আশেপাশের বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্র (চাষের ক্ষেত সংলগ্ন জমি, জলাজমি ইত্যাদি) থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, বা কখনো ক্ষেতের পাশে শাকগুলি এমনিতেই হয়ে থাকে, সাধারণত চাষ করা হয় না। স্থানীয় মানুষজন সেই সকল শাক সংগ্রহ করে নানান উপায়ে প্রস্তুত করেন। যদি এই উন্নত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন শাকগুলির দিকে মনোনিবেশ করা না হয় তবে নিবিড় কৃষি পদ্ধতি (Intensive agriculture), নগরায়ন (Urbanization) ইত্যাদির চাপে এগুলি ধীরে ধীরে অবহেলিত হতে হতে হারিয়ে যাবে।

এবার শাকের পুষ্টিগুণের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। শাকের মধ্যে অধিক পরিমানে আঁশ জাতীয় পদার্থ, খনিজ (পুষ্টি গুরুত্বের) উপযুক্ত মাত্রায় বিদ্যমান থাকার জন্যে এগুলি আমাদের দেহের পুষ্টিসাধনে সহায়তা করে। আবার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে এর গুরুত্বও খুব বেশি। লাল শাক, মেথি শাক, কুমড়ো শাক তুলনামূলকভাবে অধিক লোহা ধারণ করে। আবার অধিকাংশ শাক যেহেতু ভিটামিন C (এস্করবিক অ্যাসিড) ধারণ করে, যা লোহা শোষণ করতে সহায়তা করে (Timoshnikov et al., 2020), সেইজন্যে শাকের মাধ্যমে শরীরে লোহার প্রয়োজনীয়তা বেশ কিছুটা মেটে।

Table 2: বিভিন্ন প্রকার প্রচলিত শাকের খনিজের পরিমান (mg/100g) (Source: Longvah et al., 2017)


Ca= ক্যালশিয়াম (Calcium), P= ফসফরাস (Phosphorus), Mg= ম্যাগনেশিয়াম (Magnesium), K= পটাশিয়াম (Potassium), Na= সোডিয়াম (Sodium), Fe= লোহা (Iron), Cu= তামা (Copper), Mn= ম্যাঙ্গানিজ (Manganese), Zn= দস্তা (Zinc)

Table 3: বিভিন্ন প্রকার প্রচলিত শাকের থেকে প্রাপ্ত ক্যারোটিন (Carotene) এবং ভিটামিনের (mg/100g; Vitamin B7, B9, Vitamin K1: µg/100g) পরিমান (Source: Longvah et al., 2017)


Vitamin B1= থিয়ামিন (Thiamin), Vitamin B2= রাইবোফ্লাভিন (Riboflavin), Vitamin B3= নিয়াসিন (Niacin), Vitamin B5= প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (Pantothenic acid), Vitamin B6= পাইরিডক্সিন (Pyridoxine), Vitamin B7= বায়োটিন (Biotin), Vitamin B9= ফলিক অ্যাসিড (Folic acid), Vitamin E = টোকোফেরোল (Tocopherol), Vitamin C= এস্করবিক অ্যাসিড (Ascorbic acid), Vitamin K1= ফাইলোকুইনোন (Phylloquinone)

বিটা ক্যারোটিন থেকে ভিটামিন-A সংশ্লেষিত হয়। কাজেই খাদ্যের মাধ্যমে বিটা ক্যারোটিন গ্রহণ ভিটামিন A-র অভাব দূরীকরণে সাহায্য করবে। বেশিরভাগ শাকের ক্ষেত্রে বিটা ক্যারোটিন বেশ অধিক পরিমানে পাওয়া যায় (Akhtar et al., 2012)।  যেমন প্রতি ১০০ গ্রাম লাল শাকে ৮৪৫৭ মাইক্রোগ্রাম, বেথুয়া শাকে ১০৭৫ মাইক্রোগ্রাম, মেথি শাকে ৯২৪৫ মাইক্রোগ্রাম, কচু শাকে ৫৭৫৮ মাইক্রোগ্রাম, সরিষা শাকে ২৬১৯ মাইক্রোগ্রাম, কুমড়ো শাকে ১৪৫৫ মাইক্রোগ্রাম, মুলো শাকে  ২৫৯১ মাইক্রোগ্রাম, পালং শাকে ২৬০৫ মাইক্রোগ্রাম বিটা ক্যারোটিন পাওয়া যায়। ক্যারোটিন আবার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Anti-oxidant) হিসেবেও কাজ করে। কাজেই শাক অধিক মাত্রায় ক্যারোটিন ধারণ করে বলে এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এক্টিভিটিও বেশ অধিক হয়, যা মানবদেহের জন্যে উপকারী।

অধিকাংশ শাকে, বিশেষত কচু শাক, পালং শাক, সরিষা শাক ইত্যাদিতে  ভিটামিন B9-র পরিমান অধিক হয়ে থাকে। ভিটামিন B9 ফলিক অ্যাসিড বা ফোলেট নামে পরিচিত। এটি  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান। লোহিত রক্ত কণিকা (Red blood corpuscle) নির্মাণে এবং এর ফল অনুসারে এনিমিয়া (Anemia) প্রতিরোধ করতে ফোলেটের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও DNA সংশ্লেষণে (DNA synthesis) এবং মেরামতে (DNA repair) ফোলেট প্রয়োজনীয়। ফোলেটের অভাবে নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (Neural tube defect) হয়ে থাকে। ফ্যাট মেটাবলিসম (Fat metabolsim)-র ক্ষেত্রেও ফোলেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ওবেসিটি (Obesity) কমাতে এর গুরুত্ব রয়েছে (da Silva et al., 2014)। অস্টিওব্লাস্ট (Osteoblast/হাড় গঠনে প্রয়োজনীয় কোষ) এবং অস্টিওক্যালসিন (Osteocalcin/নন-কোলজিনীয় প্রোটিন হরমোন) মেটাবোলিজমে ভিটামিন K1-র গুরুত্ব অনেক। যেহেতু শাক অধিক পরিমানে ভিটামিন K1  ধারণ করে তাই শাক খেলে হাড় গঠনের উন্নতি হয় (Sim et al., 2020)। আবার ক্যালসিয়ামের পরিমানও শাকে অধিক থাকে যা মানবদেহের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী।

কাজেই এই ছোট একটি আলোচনার মাধ্যমে বোঝা গেল শাকের গুরুত্ব। প্রতিদিন আহারের পাতে শাক অবশ্যই থাকুক, এর ফলে আবশ্যক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলি যেমন শরীরে প্রবেশ করবে তেমনই চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে এই উন্নত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন শাকগুলি অমিল বা অবলুপ্ত হয়ে যাবে না।

তথ্য সহায়তা (References)

Akhtar, S.; Ahmed, A.; Randhawa, M.A.; Atukorala, S.; Arlappa, N.; Ismail, T.; Ali, Z. 2013. Prevalence of vitamin A deficiency in South Asia: causes, outcomes, and possible remedies. Journal of Health Population and Nutrition 31(4), 413-423. https://doi.org/10.3329/jhpn.v31i4.19975 

Akhtar, S.; Karak, C.; Biswas, P.; Chattopadhyay, A.; Hazra, P. 2012. Indigenous leafy vegetable: A potential source of β-carotene and ascorbic acid. International Journal of Vegetable Science 18(4), 370-375. https://doi.org/10.1080/19315260.2011.649163 

da Silva, R.P.; Kelly, K.B.; Rajabi, A.A.; Jacobs, R.L. 2014. Novel insights on interactions between folate and lipid metabolism. Biofactors 40(3), 277-283. https://doi.org/10.1002/biof.1154 

Konsam, S.; Thongam, B.; Handique, A.K. 2016. Assessment of wild leafy vegetables traditionally consumed by the ethnic communities of Manipur, northeast India. Journal of Ethnobiology and Ethnomedicine 12, 9. https://doi.org/10.1186/s13002-016-0080-4 

Longvah, T.; Ananthan, R.; Bhaskaracharya, K.; Venkaiah, K. 2017. Indian Food Composition Tables. National Institute of Nutrition (Indian Council of Medical Research), Hyderabad, India.

McLean, E.; Cogswell, M.; Egil, I.; Wojdyla, D.; de Benoist, B. 2009. Worldwide prevalence of anaemia, WHO vitamin and mineral nutrition information system, 1993-2005. Public Health Nutrition 12(4), 444-454. https://doi.org/10.1017/S1368980008002401 

Mishra, S.; Maikhuri, R.K.; Kala, C.P.; Rao, K.S.; Saxena, K.G. 2008. Wild leafy vegetables: A study of their subsistence dietetic support to the inhabitants of Nanda Devi Biosphere Reserve, India. Journal of Ethnobiology and Ethnomedicine 4, 15. https://doi.org/10.1186/1746-4269-4-15

Sim, M.; Lewis, J.R.; Prince, R.L.; Levinger, I. et al. 2020. The effect of vitamin K-rich green leafy vegetables on bone metabolism: A 4-week randomised controlled trial in middle-aged and older individuals. Bone Reports 12, 100271. https://doi.org/10.1016/j.bonr.2020.100274 

Timoshnikov, V.A.; Kobzeva, T.V.; Polyakov, N.E.; Kontoghiorghes, G.J. 2020. Redox interactions of vitamin C and iron: inhibition of the Pro-Oxidant activity by Deferiprone. International Journal of Molecular Science 21(11), 3367. http://doi.org/10.3390/ijms21113967


খাদ্য, পুষ্টি এবং খাদ্যের রূপান্তরঃ নির্বাচিত বাঙলা সাহিত্যের ভিত্তিতে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের প্রবন্ধ (Food, Nutrition and Food Transformation: A short essay based on selected Bengali literature)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


খাদ্য থেকে পুষ্টি সংগৃহীত হয়, যার মাধ্যমে জীব প্রাণ ধারন করে। অতএব সকল জীবের ন্যায় মানুষের খাদ্য এবং পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য খাদ্য থেকে প্রাপ্ত শক্তি এবং খাদ্যগ্রহনের পর শারীরিক উপযুক্ততা জীবকে খাদ্য নির্ধারণে সহায়তা করে। আবার, আহার তালিকায় খাদ্যবস্তুর সংযোজন বা বিয়োজন হলো খাদ্যতালিকা বা আহারের রূপান্তর। এটি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া যা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই চলে আসছে (Ghosh et al., 2018)এটি মূলত নির্ভর করতো স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ যা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হতো তার সংকোচন, বা খাদ্য থেকে প্রাপ্ত শক্তি (পূর্বের খাদ্যের থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক) এবং খাদ্য সংস্থানের জন্যে ব্যয়িত শক্তির পার্থক্যের উপর তবে বর্তমান সময়ে এই রূপান্তরটি আরো অনেক ভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। অর্থনীতি এবং বাজার, বিশ্বায়ন, আন্তর্জাল ইত্যাদি প্রভাবকের কাজ করে থাকে, তাই পূর্বের তুলনায় বর্তমানের খাদ্যতালিকার রূপান্তরটি দ্রুত, তা পরিলক্ষিত হয়। এখন এই রূপান্তরটি আমাদের সমাজে ঠিক কিভাবে হচ্ছে তা দেখার জন্যে সমকালীন সাহিত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য ব্রিটিশ শাসনকালের অব্যবহিত পূর্ব থেকে বর্তমান সময়কালের মধ্যে বাঙলা এবং বাঙলা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের খাদ্যের রূপান্তর বিষয়ক আলোচনা সেই সময়ে, অর্থাৎ ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনা কালে বাংলার, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বা পরবর্তীতে বেঙ্গল প্রভিন্সের ভৌগোলিক সীমানা বর্তমান কালের থেকে ভিন্ন ছিল বা বলা ভালো তা বিস্তৃত ছিল। সেই কারণেই প্রবন্ধটিতে কয়েকটি অঞ্চলের কথা উল্লেখিত হয়েছে যা বর্তমানে পশ্চিম বাংলার ভৌগোলিক সীমানার বাইরে অবস্থিত হলেও খাদ্য বিষয়ক বর্তমান প্রবন্ধটিতে তার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

প্রকৃতির সান্নিধ্য

আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী বসবাস করেন, সেই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার (কোন প্রাণী বা উদ্ভিদের কোন অংশটি খাদ্য হিসেবে বা ঔষধি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, ব্যবহারের পদ্ধতি কিরূপ হয়, সংগ্রহ পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত ইত্যাদি) সন্মন্ধে জ্ঞানলাভ করেন, এই জ্ঞান তাঁদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে চোখে পরেতবে তাঁরা অধিকাংশ সময়ে এই সকল জ্ঞান বা পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেন না, এর ফলে যদি কখনও তাঁরা বাসস্থান হারিয়ে ফেলেন, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কিত এই বিপুল জ্ঞানরাশিও অবলুপ্ত হয়। এই প্রবন্ধটির শুরুতে তাই আদিবাসী সম্প্রদায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।  আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত সাঁওতালদের জীবন চিত্র উঠে এসেছে মহাশ্বেতা দেবী রচিত ইতিহাস ভিত্তিক 'শালগিরার ডাকে' উপন্যাসটির বিবরণ থেকে। সময়কাল ১৭৫০, মুঘল সাম্রাজ্য তখনও সম্পূর্ণভাবে অস্তমিত হয়নি। ভাগলপুর থেকে রাজমহল পর্যন্ত জঙ্গল এলাকা, সাঁওতাল, পাহাড়িয়া, মাঝ- পাহাড়িয়াদের বাসস্থান সাঁওতালদের জমিতে হত ধান, ডাল, সর্ষে আদিবাসীরা বুনত খেসারির ডাল, অন্যান্যরা বুনত ছোলা, অড়হর, মাসকলাই। সব্জির মধ্যে জমিতে ছিল লাউ, কুমড়ো, বেগুন, কচু, লঙ্কা এসব জঙ্গলে ছিল ফল, আমলকী। তিলকার (তিলকা মাঝি) বাবা সুন্দ্রার আহারে বাথুয়া শাক, ভাত, বেগুন পোড়া, খরগোশের মাংস আর করমচার আচারের উল্লেখ পাওয়া যায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আহারটির সম্মিলিত পুষ্টিগত মান যে উন্নত তা বলা বাহুল্য, তবে প্রকৃতির ধারন ক্ষমতার বিষয়টিও অত্যন্ত্ গুরুত্বপূর্ণ আদিবাসী সমাজের মধ্যে বাস করতে আসে এক কামার পরিবার কামার পরিবারের বৌ তিলকার মাকে জানায় চিড়ে কোটার কথা, মুড়ি ভাজার কথা যদিও তিলকার মা তাতে উৎসাহিত হন না, সে তাঁদের প্রচলিত আহার ব্যাবস্থার বর্ণনা করে, আর আদিবাসীদের অধিক আয়ের কোন ইচ্ছে ছিলনা বলেই তাঁরা চিড়ে, মুড়ি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করার কথা ভাবত না অপরপক্ষে আবার তিনি কামার পরিবারের বৌকে মহুয়া-র কথা বলেন। তাঁদের ব্যবহারিক জীবনে মহুয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যাখ্যা করেন, ফুলের পাঁপড়ি ভেজে খাওয়ার কথা, পুরন্ত ফুল সিদ্ধ করে খাওয়ার কথা, ফলের বীজ শুকিয়ে তা থেকে পিষে তেল নিষ্কাশন করার কথা ইত্যাদি সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পালামৌ’ ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকেও উক্ত অঞ্চলের কোল জাতির মধ্যে খাদ্য হিসেবে মহুয়া ফুলের ব্যাবহারের উল্লেখ রয়েছে। এই ফুল শুকিয়ে রাখলে তাতে সহজে পচন ধরে না এবং অনেক দিন পর্যন্ত খাওয়ার উপযোগী থাকে। বর্ষাকালে কোলেরা এই ফুল খেয়েই দুই তিন মাস অতিবাহিত করতেন, এমনকি পয়সার পরিবর্তে এই ফুল দিয়ে মজুরীও শোধ করার উল্লেখ আছেএটা স্বাভাবিক, আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিনিময় প্রথার বেশ চল ছিল তৎকালীন সমাজে। যাইহোক, এইভাবে, হয়ত একটু শ্লথ গতিতে, বিভিন্ন সমাজের মধ্যে খাদ্য সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয়ে থাকে। এর উল্লেখ ‘পালামৌ’ বইটিতে পাই, লেখক বলেছেন হিন্দুস্থানিদের কেউ কেউ শখ করে চাল ভাজার সাথে মহুয়া ফুল খেতেন 

আমিষ তথা মাংস ভক্ষণের প্রথা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং আছে, তাঁদের শিকার প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায় একাধিক গ্রন্থে এটি লক্ষণীয় যে সারা বৎসর যাবৎ শিকার উৎসব তাঁরা পালন করেতেন না, বৎসরের একটি নির্দিষ্ট সময়েই এটি পালন করা হত। এরফলে জঙ্গলের পশু-পাখি সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ পেত প্রকৃতির ধারণক্ষমতা বজায় থাকত, আদিবাসী মানুষের প্রকৃতির উপর কোনরূপ আধিপত্য কায়েম করার চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়না আদিবাসী সমাজে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রাণী-বলি প্রথার প্রচলন ছিল। সেখানে পায়রা, পাঁঠা, মোরগ বলির প্রথা ছিল উল্লেখ পাওয়া যায় পাঁঠার মাথা দিয়ে খিচুড়ি রান্নার কথা (মহাশ্বেতা দেবী রচিত 'শালগিরার ডাকে') আদিবাসী সমাজে খাদ্যে বা পানীয়তে লিঙ্গবৈষম্য অধিক প্রকট ছিলনা বা নেই, যতোটা আদিবাসী নয় এমন সমাজে প্রকট ছিল বা আছে। কেবল পুরুষ নয়, স্ত্রী রাও মদ্যপান করতেনসঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন বাঙলার ভাটিখানায় যেরূপ মাতাল দেখতে পাওয়া যেত পালামৌ পরগণায় সেরূপটি দেখেননি।  

কৃষি ব্যবস্থা মূলত বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল ছিল অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে যেমন বন্যা হত আর খেতের ফসল নষ্ট হত, আবার অনাবৃষ্টিতে ফসল উৎপাদন হত না সেইসময়ে উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষনের ব্যবস্থা বিশেষ ছিল না, তা বলাই বাহুল্য কাজেই মানুষ নিকটবর্তী জঙ্গল থেকে ফল-মূল যেমন ডুমুর ইত্যাদি সংগ্রহ করত খাদ্যাভাব মেটাতেধীরে ধীরে শিল্পায়নের সাথে সাথে নগরায়ন পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে ব্রিটিশ ভারতে ধীরে ধীরে জঙ্গল সুরক্ষার আইন প্রনয়ণ হয় এতে একটি সামগ্রিক সামাজিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়যে জঙ্গলের উপর নির্ভর করে মানুষ বিশেষত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ জীবনধারণ করতেন, তা তাঁরা হারাতে লাগেন জ্বালানির জন্যে জঙ্গলের কাঠ, পশুর খাদ্যের জন্যে ঘাস, সারের জন্যে পাতা (যা পচিয়ে সার তৈরি হত), বিড়ি বাঁধার পাতা, খাবার পরিবেশনের পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত পাতা, ঘর তৈরির জন্য গাছের কাণ্ড বা গুঁড়ি, ঘরের চাল ছাওয়ার পাতা, ধামা-ঝুড়ি তৈরির বাঁশ, এবং ঔষধি গাছ, ইত্যাদি সবকিছুরই জোগান হত জঙ্গল থেকে। জঙ্গলের অধিকার চলে যাওয়ার সাথে সাথে এইসব জীবনের অপরিহার্য জিনিসগুলির অভাব পড়ে, কখনও স্থানান্তরিত হতে হয় আর সবকিছুর প্রভাব এসে পড়ে খাদ্যের জোগানের উপর। সামাজিক বিন্যাসও এর প্রভাবমুক্ত থাকে না (Guha, 2014) চাষি, পশুপালক, কারিগর শ্রেণীর পাশাপাশি আরও কয়েকটি শ্রেণী গঠিত হন, যারা শহর বা সংলগ্ন অঞ্চলের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন চাল, ডাল, শস্য, সবজি, শিল্পের উপকর ইত্যাদি জোগান দিতেন। ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, সামাজিক বিন্যাসের পরিবর্তন, জীবনধারণের উপায়ের পরিবর্তন ইত্যাদি সামগ্রিকভাবে পুষ্টির উপর প্রভাব বিস্তার করে (Edison and Devi, 2019)।   

খাদ্য ও পুষ্টি: সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ব্রিটিশ প্রভাব                 

বাংলায় খাদ্যরীতি আলাদা। বাঙালি হিন্দু ব্রাহ্মণ, অন্য প্রদেশের ব্রাহ্মণ-র মতন, মাছ-মাংস পরিত্যাগ করেনা সেখানে এটাই রীতি। যদিও মাংসের মধ্যে ছাগ মাংস-ই প্রচলিত ছিল, মুরগির মাংস বা ডিমের ব্যবহার উচ্চবর্ণের মধ্যে ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ ভ্রমণকালে হিন্দু খাদ্যরীতি ছিল আলাদা। পিঁয়াজের ব্যাবহার হিন্দু সমাজে ছিল না, বরং তা ছিল ঘোর ধর্ম বিরোধী। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন হাজারিবাগে যে হিন্দুগৃহে তিনি আহার করেছিলেন তা ছিল তৎকালীন সময়ানুসারে হিন্দু বিরোধী কারণ সেখানে আহারে পিঁয়াজের ব্যাবহারের আধিক্য ছিল। পিঁয়াজ যাবনিক শব্দ বলে তিনি পলাণ্ডু বলে উল্লেখ করেছিলেনলেখক উল্লেখ করেন পিঁয়াজের ব্যবহার ভিন্ন বাকি আহার যথা সঘৃত আতপান্ন, আর ছাগ মাংস ছিল নির্দোষী। সুখের দিনে ব্রাহ্মণ গঙ্গাচরন চক্রবর্তীর বাড়িতে মাছ নিয়ে আসা মোটেই ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল না (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'অশনি সংকেত')। বাঙালি মাছে-ভাতে ছিল এবং আছে। ‘মনসামঙ্গল’ থেকে কবি ভারতচন্দ্র রায়গুনাকরের রচনা ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে বাঙ্গালীর মাছ খাওয়ার কথা, এমনকি ব্রাহ্মনভোজনের উদ্দেশ্যে মাছ রান্নার কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’-এ জল-বহুল বাংলায় মাছের প্রাচুর্য আর মানুষের মাছ খাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন (রায়, ১৩৫৬ (বঙ্গাব্দ)। তবে একথা উল্লেখযোগ্য যে মাংস, দুধ ইত্যাদি কেবলমাত্র উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বা কিয়দংশ আছে গরীব মানুষের ভরসা ছিল চুনোমাছ মৎসজীবি তেঁতলে বিলাসদের ঘরেও যে মাছ ভাত রোজ সহজে মিলতো তা নয় (সমরেশ বসু রচিত 'গঙ্গা') পোড়ার অভাব নেই তাদের ঘরে, মাঘ মাসে নৌকা বাঁধা পড়ে মহাজনের ঘরে; মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়ের অর্ধেক পার হয়ে যায়, অবশেষে মুচলেখা দিয়ে ছাড়াতে হয় নৌকা, চক্রাকারে বাড়ে সুদ। পৌষ মাসেই আবার শুরু হয়ে যায় পোষ-পোড়া, ঘরে একটি দানাও আর পড়ে থাকে না, কাজেই আবার ধার করতে হয় তাদের। উপন্যাসটিতে দেখা যায়, পোড়ার অভাব নেই মৎস্যজীবীদের ঘরে, পোষ-পোড়া-র পর শুরু হয় চৈত্র মাসের পোড়া, চোত-পোড়া। আউশের মোটা লাল চাল, মুসুরি, কলাই, সর্ষের তেল জোগাড় করতে নাভিশ্বাস ওঠে এই মানুষগুলোর। নিশ্চিন্দিপুরের হরিহর রায়’ (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'পথের পাঁচালি') অথবা বেচু চক্কোত্তির হোটেলের রাঁধুনি হাজারি ঠাকুর’ (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'আদর্শ হিন্দু হোটেল') ব্রাহ্মণ হলেও উচ্চবিত্ত ছিলেন না, কাজেই রামচরিত’-এর (প্রফুল্ল রায় রচিত ‘রামচরিত্র’) মতো আহার থেকে তাঁরা এবং তাঁদের পরিবার বঞ্চিত- ছিলেন তবে উচ্চবর্ণের হওয়ার দরুন খাদ্যকষ্ট থাকলেও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হতেন না তবে সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষগুলো মানুষের মতন বাঁচার অধিকার প্রায় হারিয়ে ফেলেন সময় অতিবাহিত হয়ে চলে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম কেটে যায় একইভাবে, সমাজের পাকেচক্রে কোন উন্নতির পথ দৃষ্টিগোচর হয় না, আর তখনই গোমাংস ভক্ষণে প্রান্তিক মানুষগুলি ধর্মান্তরিত হন (প্রফুল্ল রায় রচিত ‘রাম চরিত্র’) ধর্ম আচারে পর্যবসিত আর খাদ্য-ই আচার হিসেবে প্রতিভাত হয়  

আলুর বিশেষ ব্যবহার গত শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্তও গৃহস্থ বাড়িতে ততটা হতো না, এতো তারানাথ তান্ত্রিক’-এর বাল্যজীবনের কথা প্রসঙ্গে কিশোরীদের কাছে করা উক্তি থেকেও জানা যায় (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরবর্তীতে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'তারানাথ তান্ত্রিক')। তবে ইউরোপীয়ানদের তথা ব্রিটিশদের খাদ্য তালিকায় আলুর ব্যবহার স্বাভাবিক কারণেই ছিল অধিক, তাই তৎকালীন ব্যবস্থায় শ্রমিক বা মজুরদের খোরাকি হিসেবে আটা, চাল, তেল, নুনের সাথে আলু দেওয়ার উল্লেখ পাওয়ায় যায় (প্রফুল্ল রায় রচিত ‘দায়বদ্ধ’)। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে বর্তমানে বাঙালি (তথা ভারতীয়) খাদ্যে যে আলু, টমেটো, এমনকি লঙ্কা ইত্যাদির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় তা অতি প্রাচীন নয়। এইসবই ভারত ভূখণ্ডের বাইরে থেকে আসা খাদ্যবস্তু, মূলত পঞ্চদশ থেকে ষষ্ঠদশ শতকের মধ্যে ইউরোপীয়ানদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে আমদানি হয় (Nunn and Quin, 2010)বাংলায় ব্রিটিশ খাদ্যের প্রভাব বেশ পড়েছিল, এমনকি ঊনবিংশ শতকের শেষ বা বিংশ শতকের সূচনা থেকে খাদ্যের পুষ্টিগুণ ও ভেজাল নিয়েও সচেতনতা বৃদ্ধি  পায় এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয় (Ray, 2013), তবে অবশ্যই শহরাঞ্চলে আর গ্রামাঞ্চলে এই প্রভাবের পার্থক্য ছিল ১৯২০ সাল নাগাদ কলকাতায় বিভিন্ন রেস্তোরাঁ স্থাপিত হয়ে গিয়েছিলো (Ray, 2013) এর প্রতিফলন তৎকালীন সাহিত্যেও পরিলক্ষিত হয়। ১৯২৯-৩০ সালে রচিত ‘রাতারাতি’ গল্পটিতে দেখি, ছেলের খোঁজে চরণ ঘোষ যখন ধর্মতলার এংলো-মোগলাই রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করেন তখন সেখানে নানান হাঁকডাক চলেছে, কোনো টেবিলে কোর্মা, কোথাও কাটলেট, আবার কোনো টেবিলে ডেভিল ইত্যাদি। এসব দেখে চরণ ঘোষ বলেন ‘রাধামাধব, এমন জায়গায় ভদ্রলোক আসে’। অর্থাৎ তাঁর কাছে এগুলি খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি। চাটুজ্যে মশাই  প্রাচীন শাস্ত্রসম্মত, তাঁর মতানুসারে, পথ্যের উল্লেখ করেছেন বাল্যে দুগ্ধ, যৌবনে লুচি-পাঁঠা, আর বৃদ্ধাবস্থায় নিমঝোল আর প্রচুর নামসঙ্কীর্তন খাদ্যের উপাদানের মধ্যে ভিটামিন যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা উল্লেখ করেন এবং জনৈক প্রবীন ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে কাঁঠালকে তিনি সকল ভিটামিনের সমাহার বলে বর্ণনা করেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের রচিত ‘মহানগরী’ উপন্যাসে ১৯৩৭ সালে কলকাতার পার্কের মোড়ে ঘুঘনি, দইবড়া, পকড়া, গরম গরম ভাজা বেগুনি, আলুর চপ বিক্রি হতে দেখা যায়। এই সকল খাদ্যবস্তুগুলিকে মানুষ যে সাদরে গ্রহন করেছিল তা বলাই বাহুল্য। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে অতিথি আপ্যায়নের জন্যে যে নারকেলের সন্দেশ, মুগতক্তি, চিঁড়েভাজা দেওয়া হত (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিতইছামতি’), তা বিংশ শতকে শহর  বা শহরতলির পরিবারে পরিবর্তিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে রাজশেখর বসু মহাশয়ের লেখা 'রাজভোগ' গল্পটিতে কলকাতার ধর্মতলার একটি এংলো-মোগলাই রেস্তোরাঁর বিষয়ে বলা হয়েছে। তাদের বেশ লম্বা খাদ্যতালিকাটিতে ছিল তিন ধরণের পোলাও (ভেটকীর, মটনের, এবং পাঁঠার), কালিয়া, কোর্মা, কোপ্তা, মটন চপ, চিংড়ি কাটলেট, ফাউল রোস্ট, ছানার পুডিং, বিরিয়ানি ইত্যাদি। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার বাঙালি হিন্দু ব্রাহ্মণ রাইচরণ চক্কত্তিমোগলাই, ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ সকল রান্না-ই জানেন বলে খরিদ্দারের সামনে গর্ববোধ করেন। শহরাঞ্চলের এক শ্রেণীর মানুষ যে এই সকল রেস্তোরাঁগুলিতে যাতায়াত করতেন তা বলাই বাহুল্য।  

এবার আসি পানীয়ের ক্ষেত্রে সমকালীন সমাজে অতিথি আপ্যায়নে গৃহস্থ্য বাড়িতে নিজ নিজ অর্থনৈতিক ক্ষমতানুসারে কখনও জল-বাতাসা, মাঠা, বা সরবত ইত্যাদি পানীয়ের প্রচলন ছিল। দুধের প্রচলন ছিল, তবে তা দুপুর বা রাত্রের আহারের সাথে পরিবেশন করা হত। চা’য়ের প্রচলন ব্রিটিশদের হাত ধরেই আসে ভারতে। 'অশনি সংকেত’-এ গঙ্গাচরন অনঙ্গ বৌ’কে চা করতে বললে, জিজ্ঞেস করে সে চা বানাতে পারে কিনা! অনঙ্গ বৌ বলে সে কখনও চা নিজে বানালেও চা বানানোর কৌশল সে দেখেছে জনৈক এক উচ্চবিত্তের বাড়িতে (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'অশনি সংকেত') যদিও ব্যোমকেশ’-এর বাড়িতে চায়ের প্রচলন ভালভাবেই ছিল (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ)। প্রফুল্ল রায়ের রচিত ‘কেয়া পাতার নৌকা’-য় হেমনাথ মিত্র’-এর বাড়িতে ভাগ্নি-জামাই কলকাতাবাসী অবনি-র জন্য চায়ের বন্দোবস্ত শুরু হয়, তার পূর্বে চায়ের চল সে বাড়িতে ছিল না। ডাক্তার লারমরএর কাছ থেকে জানতে পারি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ভাবশিশ্য হেমনাথ চা খেতেন না। এখন তো চা বাঙালি তথা ভারতবাসীর প্রাত্যহিক জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ।

বর্ণভেদ এবং খাদ্যবৈষম্য

পূর্বে আলোচিত হয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের উপর তাঁর খাদ্য নির্ধারিত হয়েছে। ধনী ব্যক্তি যথেষ্ট পরিমানে খাদ্য গ্রহণ করতে পারেন কারণ তা তিনি উৎপাদন কিংবা ক্রয় করতে পারেন।  আবার গরীব ব্যক্তির সেই সামর্থ্য না থাকায় সে উপযুক্ত পরিমানে খাদ্য গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন এবং পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হন। আর অর্থনৈতিক সামর্থ্য নির্ভর করত বর্ণভেদ, রাজা-সুলতান-জমিদারের, পরবর্তীকালে ব্রিটিশের নীতি (সু এবং কু), ইত্যাদির উপর। তবে সেটি এই প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। তখন ভারতবর্ষ সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করেছে, প্রফুল্ল রায়ের ‘দায়বদ্ধ’ উপন্যাসের চরিত্র ধনপত, জাতে গঙ্গোতা অর্থাৎ জল-অচল অচ্ছুৎ, জমিদারের শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে এবং পরিবারের মুক্তির জন্যে গ্রাম ছাড়ে। সেই সময় তার মা বড় একটা কাপড়ের টুকরোতে বেধে দেয় বাজরার রুটি, গোটা কয়েক লিট্টি, খানিকটা মকাই ভাজা, রাঙ্গা আলু সিদ্ধ। এই ছিল তথাকথিত ‘নিচু জাতের’ মানুষের খাদ্য। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে এই খাদ্যই জুটত, তবে তাও জুটত না পেত ভরে সবসময়। এই আহার পুরটাই শর্করা জাতীয় বস্তু, প্রোটিন কিংবা ভাল স্নেহ জাতীয় বস্তুর অভাব ছিল প্রকট। তবে আহারের পুষ্টিগত এই চরিত্রটি (অধিক শর্করা, আর স্বল্প মাত্রায় প্রোটিন আর স্নেহ)আমাদের সমাজে দীর্ঘকাল যাবৎ রয়েছেতবে এই মানুষগুলোর কাছে উৎকৃষ্ট ভোজন কি ছিল? তাও দেখতে পাই উপন্যাসটিতে। কন্ট্রাক্টর মুনয়ার প্রসাদ যখন ধনপত, চাঁদিয়া এবং আরও সকল জঙ্গলকাটার শ্রমিকদের ভাত, ডাল, সবজি এবং মাংস সহযোগে ভাতকা ভোজন করিয়ে রেলগাড়িতে তুলে দেয় সেটি ছিল ধনপতদের ‘উৎকৃষ্ট’ ভোজন। প্রফুল্ল রায় রচিত ‘রামচরিত্র’ উপন্যাসে উত্তর বিহারের কোন মাঝারি শহরের উচ্চবিত্ত রামচরিতশ্বেতপাথরের গ্লাসে আঁখের রস, কালো পাথরের থালায় মেওয়া-মিছ্রি-পেস্তা-খেঁজুর সহযোগে প্রাতরাশ সারেন, বেলা একটু বাড়লে পুরি, ভাজি, লাড্ডু, বুন্দিয়া, এবং ক্ষীর দিয়ে দুপুরের আহার করেন। বাড়িতে অতিথি এলে আপ্যায়নের জন্যে চাঁদির রেকাবিতে পরিবেশিত হয় লাড্ডু, নিমকিন, প্যাঁড়া, গুলাবজামুন, এলাচ-লবঙ্গ মেশান চা। এহেন উচ্চবিত্তরা অতিরিক্ত চিনি জাতীয় খাদ্যগ্রহনহেতু বিশাল বপু হবেন এবং সেই সাথে তৎসম্পর্কিত অসুখে ভুগবেন তা স্বাভাবিক। রামচরিত-রা কেবল মাত্র নিজেরাই আহার করেন না, শিউশঙ্করের বাহন ষাঁড় কেও আহার করান চাপাটি, ভাজি, কলা, ডাল, শশা সহযোগে। এমনকি সেই সময় পথের ভিখারিদের ‘উৎপাত’ তিনি মোটেই সহ্য করেন না। সাথের পালোয়ানদের হুকুম করেন মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে। হিন্দুধর্ম রক্ষাহেতু রামচরিত-রা যখন নিজসেবায় এবং দেব-বাহন সেবায় নিয়জিত তখন সেই সমাজেরই আরেক প্রান্তে থাকা ধানোয়ার-রা ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে চলে ভাত পাবার আশায় (প্রফুল্ল রায় রচিত ‘ভাতের গন্ধ’)।

খাদ্যগ্রহনে লিঙ্গ বৈষম্য আর সুদূরপ্রসারী কুফল

খাদ্যের বিষয়ে লিঙ্গ বৈষম্য প্রকটভাবেই চোখে পড়ত, এখনো যে এই বিষয়টি চোখে পরে না তা নয় (Dey, 2020) গৃহস্থ্য বাড়ির তুলনামুলক ভাল খাবার যেমন মাছের মাথা, দুধ ইত্যাদিতে পুরুষের অধিকার কায়েম ছিল, বাড়ির মেয়েরাই সেটির চল করেছিলেন মেয়েরা না খেয়ে চুপ করে থাকলে বা খাদ্যের সংকটে (সেটি দীর্ঘ বা সাময়িক যাই হোক) তা অন্যকে দিয়ে দিলে প্রশংসিত হতেন, আর এটিই কর্তব্য বলেই হয়ত নির্ধারিত হত অনঙ্গবৌ যখন নিজের খাবার দুর্গাপণ্ডিতকে দিয়ে দেয়, সেটি গঙ্গাচরনকে গর্বিত করে (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'অশনি সংকেত') ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’ -এ লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী উল্লেখ করেছেন তাঁদের দৈনতার কথা, দেখিয়েছেন তাঁর মা গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে খাদ্যাভাবে বেঁচে থাকা গ্রাম বাঙলার একজন গৃহবধূ, এ ঘটনা বিশেষ ব্যতক্রমী ছিল না। মেয়েদের পুষ্টির অভাব যে অত্যন্ত্ প্রকট ছিল (এবং আজও আছে), তা তো সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ থেকে জানা যায় অসুবিধা হল, মায়ের উপযুক্ত পুষ্টির অভাব শিশুপুষ্টির উপরেও ঋণাত্মক প্রভাব বিস্তার করে এবং তা সমাজে পর্যায়ক্রমে চক্রাকারে চলতে থাকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত সমাজ সহজে তা উপলব্ধি করতে পারে না। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ অল্পবিস্তর চাষ করতেন বা করেন, আবার কেউ কেউ ভাগচাষের কাজ করতেন, কেউ পরের জমিতে লাঙ্গল দিয়ে তা থেকে যা মজুরি (পয়সা বা শস্য) পেতেন তা দিয়ে দিনাতিপাত করতেন। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ ছিলেন গরিব। শিক্ষার অভাব এই গরীবাস্থা কে দীর্ঘায়িত করে। মায়ের উপযুক্ত পুষ্টির অভাব শিশুদেহে প্রভাব বিস্তার করে যাকে কগনিটিভ  ইম্পাইরমেন্ট’ (cognitive impairment) বলা হয়। অপুষ্টিজনিত কারণে শিশু ঠিক মতন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না, বুদ্ধি বিকশিত হয় না আর তারফলে পড়াশুনা বেশিদূর পর্যন্ত করা হয়ে উঠে না, অনিচ্ছা এবং বুদ্ধির বৈকল্যে স্কুলের পড়া শেষ হাওয়ার আগেই এরা ছেড়ে দেয়। শিশু যদি মেয়ে হয় তবে তাঁকে তাড়াতাড়ি বিবাহ দিয়ে দেওয়া হয় আর যদি ছেলে হয় তবে সেও পিতার যৎকিঞ্চিত জমি আর চাষের কোন উন্নতি করতে পারেনা। তাঁদের জীবনে আবার একইভাবে এই চক্রটি চলতে লাগে। মানুষের কোন উন্নতি হয় না। সাহিত্যেও এই একই চিত্র প্রকাশিত হয়। বিধবা মহিলাদের ক্ষেত্রে নিয়মের পরাকাষ্ঠা এতটাই কঠিন ছিল যে পুষ্টির অভাব যে হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। ইন্দির ঠাকরুন’-এর প্রাতরাশ ছিল চাল ভাজার গুঁড়া আর কখনও বা তার সাথে বিচে কলা। বিধবার আমিষ খাওয়া বারণ, একাদশীর দিন খাদ্যগ্রহন মানা, কিভাবেই তা পুষ্টি চাহিদার পূরন হবে! এমনকি ইন্দির ঠাকরুন নোনা কিনে এনে সর্বজয়ার কাছে অপমানিত হন (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'পথের পাঁচালি')। তখনকার দিনে এসব ফল (নোনার মতন) গ্রাম বাঙলার বাজারে বিক্রি হত না, মানুষ বিশেষত বাচ্চারা কুল, শশা, জামরুল, কামরাঙ্গা, পানফল, আমের কুসী, আঁশ শেওড়ার ফল ইত্যাদি নিজেদের বাগান থেকেই পেতেন। তবে যাঁদের জমি-জমা ছিল না, তাঁদের বাজারে যা পাওয়া যেত তাতে, বা অন্যেরা যদি কোনো কারণে জমির কিছু দিতেন তার উপরেই ভরসা রাখতে হতো। যেমন হরিহর রায় উচ্চবিত্ত ছিলেন না, জমিজমাও তাঁর ছিল না, দুর্গাকখনও সামান্য কয়েকটি ফল সংগ্রহ করে আনত অন্যের বাগান থেকে, কথাও শুনতে হতো সেইকারণে আদিবাসী সমাজে জঙ্গল সমগ্র সম্প্রদায়ের জন্যে হলেও, অন্য সমাজে  জমি, বাগান এগুলি মূলত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল। কাজেই অন্যের বাগানের ফল নেওয়া চুরির সামিল বলেও কখনও কখনও ধরা হতো এবং তা অতিরিক্ততায় পৌঁছতো গরিব মানুষের জন্যে। মহাশ্বেতা দেবীর ‘শালগিরার ডাকে’ উপন্যাসে দেখি আদিবাসীরা জঙ্গল থেকে আমলকী এনে হাটে আড়তদারদের দিয়ে দেয়, বিনিময়ে কোন পয়সা নেয় না।        

খাদ্যসঙ্কট

খাদ্যসঙ্কট প্রকট হয়েছিল মন্বন্তরের সময়। মন্বন্তর ব্রিটিশ আমলেই প্রথমবার হয়নি, তার পূর্বেও মন্বন্তর হয়েছে, তবে চরিত্রগতভাবে তার কারণ এবং প্রতিহত করার উপায় ছিল ভিন্ন। ১৬৩০-৩২ সালে গুজরাতের দুর্ভিক্ষের ফলে শস্যের দাম বৃদ্ধি পায়। তা প্রতিহত করতে অর্থকরী ফসল তুলার জায়গায় খাদ্যশস্যের চাষ বেড়ে গিয়েছিল (ভদ্র, 1963)কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকাকালিন যে মন্বন্তরগুলি দেখতে পাই সেগুলি মূলত শাসকের নীতির দরুন। কোম্পানী সরকার সব ধান চাল কিনে ফেলে সেই চাল অধিক দামে পুনরায় তা মানুষের কাছে অধিক দামে বিক্রি করায় তা মানুষের সাধ্যের অতীত হয়ে পড়েছিল আর তার-ই ফলশ্রুতি হিসেবে হয়েছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, এ ছবি ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস 'শালগিরার ডাকে' তে প্রতিফলিত হয় সেই একাধিক খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল এ দেশে। অধ্যাপক সেন তার, বিশেষত ১৯৪৩-র মন্বন্তর, কারণ বিস্তারিত বিশ্লেষণ করছেন (Sen, 1977) কখনও অনাবৃষ্টি, কখনও অতিবৃষ্টি আর বন্যা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বিভিন্ন ভ্রান্ত নীতি, দূরদর্শিতার অভাব এবং ব্যর্থতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংকটে যে দুর্ভিক্ষ-মহামারীর প্রকোপ বাংলায় পড়েছিল তাকে শতগুন বারিয়ে দিয়েছিলো হারু দত্ত, কালীধন ধারা-র মতন চরিত্রগুলি (বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন') কালোবাজারী, বেয়াইনি মজুতদারি, মেয়ে পাচার, আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পরের সম্পদ হস্তগত করা কোনো কিছুই তারা বাদ দেয় না। ফলশ্রুতিতে কুঞ্জদের পশুর সঙ্গে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করে বেঁচে থাকে আবার কখনও বড়োলোকের দুয়ারে অন্ন ভিক্ষা করার মর্মবিদারক ছবি দেখা যায়। সমাজের এক বাসিন্দা মাখনরোজ রোজ জগডুমুর সিদ্ধ আর কচুর লতির ঝোল খাওয়া নিয়ে তীব্র অনিচ্ছা প্রকাশ করে, কাঁকড়া সেখানে অতি উপাদেয় এক খাদ্যবস্তু বলে পরিগণিত হয়, সেই সমাজেরই একটা অংশ এদের 'দুর্ভিক্ষের কাঙালি' বা 'দুর্ভিক্ষের পোকামাকড় সব' বলে উল্লেখ করে (বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন')। হাসান আজিজুল হক’র ‘আগুনপাখি’-তে  দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে খাদ্য সংকট প্রকট হয়েছিল, উল্লেখ রয়েছে সোনার অলংকার গয়না দিয়েও একমুঠো চাল পাওয়া যাচ্ছিল না। অধিকাংশ বাড়িতে চুলো জ্বলত না, হাড়ি চড়ত না, ছেলে-পিলের দল মাঠে-ঘাটে-পুকুরধারে ঘুরে বেড়াত, বনকুল, শেয়াকুল, কতবেল, শালুক-পদ্মের ডাঁটা এইসব খেয়েই দিন কাটাত। গ্রাম বাঙলার হেলেঞ্চা, কলমি, শুশনি, সব শাক-ই অমিল হয়ে গেছিল, এমনকি গাধাপুইনি, খইলুটি ইত্যাদি শাক যা স্বাভাবিক সময়ে মানুষ খেত না, তাও হয়ে পরেছিল দুর্লভ। যে গ্রাম বাঙলা মিলেমিশে থাকার জন্যে পরিচিত ছিল, সেখানে একটা ডুমুর বা সজনের পাতাও কেউ কাউকে দেওয়ার কথা ভাবত না। একই চিত্র প্রতিভাত হয় 'অশনি সংকেত'-এ, মানুষ ওল, মানকচু ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারন করতে বাধ্য হত। অনঙ্গবৌ ভূষণ ঘোষ’-এর বৌ-কে গেঁড়ি-গুগলি সংগ্রহ করতে দেখে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে গোয়ালারা খাদ্যাভাবে গেঁড়ি-গুগলি খেয়ে দিন কাটাচ্ছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে এমনকি রাঢ় বাঙলাতে এবং উত্তরবঙ্গের স্থানে স্থানে শামুককে খাদ্য হিসেবে গ্রহন করার রীতি রয়েছে, যদিও তা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে পড়ছে (Baghele et al., 2021) পুষ্টিগত দৃষ্টিকোণ থেকে শামুকের খাদ্যগুণ বেশ উন্নত হলেও তার পালনের খামার গড়ে উঠতে দেখা যায় না (Ghosh et al., 2017, 2022)।  

তবে কি বাংলায় বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ উন্নত পুষ্টিগুনযুক্ত খাদ্য খায়নি। তা নিশ্চয় ঠিক নয়, নিশ্চয় কিছু মানুষ সঠিক পুষ্টিগুনযুক্ত খাদ্য পেতেন এবং খেতেন, তবে শতকরার হিসেবে তা ছিল তুলনায় অনেক কম। কবিকণকন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে এবং ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে বাঙলা সমাজে খাদ্য হিসেবে গৃহীত শাকগুলির যেমন পলতা, নলিতা (পাট শাক), সাঞ্চে, নটে, বেথুয়া, সরিষার শাক ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান সময়ের বাজারে পালং, পুঁই, লাল, মুলো, মেথি, পাট, ছোলা, লাউ, কুমড়ো, কচু, থানকুনি, নটে, পলতা ইত্যাদি শাক দেখতে পাওয়া যায় যদিও ধীরে ধীরে পাতে শাকের ভাগ সঙ্কুচিত হচ্ছে বলেই পরিলক্ষিত হচ্ছে, এরফলে মানুষের পুষ্টিও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বাংলায় বেশ কয়েকটি রন্ধন প্রণালীর বই ছিল। সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইটি হলো ১৮৩১ সালে প্রকাশিত 'পাকরাজেশ্বর', সুবিজ্ঞ পাচক দ্বারা বর্ণিত রন্ধন প্রণালী সম্বন্ধিত এই বইটি নৃত্যলাল শীল মুদ্রণ এবং প্রকাশ করেন। এর পরবর্তীতে ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল 'ব্যঞ্জন রত্নাকর', ১৮৭৯ সালে 'পাকপ্রবন্ধ' সর্বাপ্রেক্ষা উল্লেখযোগ্য বইটি হলো বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় রচিত 'শৌখিন খাদ্যপাক' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৯ সালে এবং এর পরবর্তী দুটি খন্ড একত্রে 'পাক প্রণালী' নাম প্রকাশিত হয়। উক্ত বইগুলি তৎকালীন সময়ের রন্ধন পদ্ধতি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি সেই সময়ের রন্ধন উপকরণের সাথে বর্তমান সময়ের কোনো পদের উপকরণের পার্থক্য সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যায়। যেমন শুক্তো (নলতের শুক্তো) রান্নায় অন্যতম একটি উপকরণ হিসেবে পাট পাতার ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে 'পাকপ্রণালী' তে, তবে পরবর্তীতে তার উল্লেখ পাওয়া যায় না, এমনকি বর্তমানে  শুক্তো রান্নায় এটির ব্যবহার চোখে পরে না (Debnath, 2021)পরবর্তীকালেও একাধিক রান্নার বই প্রকাশিত হয়েছিল যেমন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর আমিষ ও  নিরামিষ আহার (১৯০২ সালে), লীলা মজুমদারের 'রান্নার বই' (১৯৭৯ সালে), পূর্ণিমা ঠাকুরের 'ঠাকুরবাড়ির রান্না (১৯৮৬ সালে) ইত্যাদি। তবে একথা অনস্বীকার্য যে আর্থিক অসঙ্গতির কারণে অধিকাংশ মানুষের এরূপ উন্নত খাদ্য জুটত না আর পুষ্টিও সম্পূর্ণ রূপে পেতেন না। বর্তমানে বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে খাদ্যের রূপান্তরটি অধিক দ্রুততার সাথে হচ্ছে। পশ্চিমী খাদ্যর সাথে আমাদের পরিচয় ঘটেছে নানানভাবে, সেগুলির আমাদের স্বাদ অনুযায়ী রূপান্তরিত (metamorphose) হয়ে আমাদের পাতে উঠে এসেছে অধিক প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্রাপ্ত খাদ্যবস্তুর পুষ্টিগত মান খুব উন্নত হয়না আর স্থানীয় খাদ্যের, বিশেষত শাক-সব্জি, দ্রুত সঙ্কোচন মানুষের পুষ্টিও সঙ্কুচিত হওয়ার পথ প্রসারিত করবে।           

            

গ্রন্থপঞ্জি

'শালগিরার ডাকে', মহাশ্বেতা দেবী

‘পালামৌ’, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

'অশনি সংকেত', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

'গঙ্গা', সমরেশ বসু

'পথের পাঁচালি', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

'আদর্শ হিন্দু হোটেল', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘রামচরিত্র’, প্রফুল্ল রায়

'তারানাথ তান্ত্রিক', তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

‘দায়বদ্ধ’, প্রফুল্ল রায়

‘মহানগরী’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

ইছামতি’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

'রাজভোগ', ‘পরশুরাম সমগ্র’, রাজশেখর বসু

‘রাতারাতি’, পরশুরাম সমগ্র’, রাজশেখর বসু

‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’, মনোরঞ্জন ব্যাপারী

'পথের পাঁচালি', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

'নবান্ন', বিজন ভট্টাচার্য

 

তথ্য সহায়তা (Reference)

Baghele, M.; Mishra, S.; Meyer-Rochow, V.B.; Jung, C.; Ghosh, S. 2021. Utilization of snails as food and therapeutic agents by Baiga tribals of Baihar tehsil of Balaghat district, Madhya Pradesh, India. International Journal of Industrial Entomology 43(2): 78-84. http://www.doi.org/10.7852/ijie.2021.43.2.78

Debnath, N. 2021. Reading tradition in food: An interdisciplinary study of Bengali food writing. Rupkatha Journal on Interdisciplinary Studies in Humanities 13(4): 1-9. http://www.doi.org/10.21659/rupkatha.v13n4.11

Dey, M. 2020. Gender politics and food practices in urban West Bengal. In: Mukhopadhyay, K. (Ed.), Food Power Expressions of Food-Politics in South Asia. Sage Publications India Pvt. Ltd. New Delhi, India. pp. 387-403.

Edison, E.; Devi, R. 2019. Tribal land alienation, agricultural changes and food culture transition in Attappady. South Asia Research 39(1): 61-77. http://www.doi.org/10.1177/0262728018817858

Ghosh, S.; Jung, C.; Meyer-Rochow, V.B. 2018. What governs selection and acceptance of edible insect species? In: Halloran, A.; Flore, R.; Vantomme, P.; Roos, N. (Eds.), Edible Insects in Sustainable Food Systems. Springer Publishers, Cham, Germany. pp. 331-351.

Ghosh, S.; Jung, C.; Meyer-Rochow, V.B. 2017. Snail as mini-livestock: nutritional potential of farmed Pomacea canaliculata (Ampullariidae). Agriculture and Natural Resources 51: 504-511. http://www.doi.org/10.1016/j.anres.2017.12.007

Ghosh, S.; Meyer-Rochow, V.B.; Jung, C. 2022. Farming the edible aquatic snail Pomacea canaliculata as a mini-livestock. Fishes 7: 6. http://www.doi.org/10.3390/fishes7010006

Guha, R. 2014. Environmentalism A Global History. Penguin Random House, India. 224p. pp. 14.

Nunn, N.; Qian, N. 2010. The Columbian exchange: A history of disease, food, and ideas. Journal of Economic Perspectives 24(2): 163-188.

Ray, U. 2013. The body and its purity: dietary politics in colonial Bengal. Indian Economic and Social History Review 50(4): 395-421. http://www.doi.org/10.1177/0019464613502413

Sen, A. 1977. Starvation and exchange entitlements: a general approach and its application to the great Bengal famine. Cambridge Journal of Economics 1: 33-59. http://www.doi.org/10.1093/oxfordjournals.cje.a035349 

ভদ্র, গৌতম, 1963, মুঘলযুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক-বিদ্রোহ। সুবর্ণরেখা, কলিকাতা। ২৪২ পাতা। pp. 116.

রায়, নীহাররঞ্জন ১৩৫৬ (বঙ্গাব্দ), বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব। দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা।

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...