পৃষ্ঠাসমূহ

Dietary transition লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Dietary transition লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

ভারতের ট্রাইবাল খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ (Exploring Tribal Food Systems of India)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী ব্লগটিতে (ভারতের স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ) আমি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় খাদ্য এবং রন্ধনপ্রণালীর উল্লেখ করেছি । অবশ্যই তা একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ, বলাই বাহুল্য যে তার বাইরে অনেক উপাদেয় পদ রয়েছে, কয়েকটি আইকনিক পদ ও প্রণালীকে তুলে ধরেছি মাত্র। আশা করি কর্মসূত্রে বা বেড়াতে গেলে পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয়ই ওই সকল স্থানীয় খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ করবেন। আজকের এই ব্লগটিতে আমি আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপজাতিদের বিভিন্ন খাদ্য পদ নিয়ে আলোচনা করব, অন্যথা আমাদের দেশের খাদ্য বৈচিত্র্য সম্বন্ধে যে আলোচনা আমি শুরু করেছি তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। 

ভারতবর্ষ অসংখ্য আদিবাসী বা উপজাতির আবাসস্থল। দেশের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই উপজাতিরা তাদের অনন্য রীতিনীতি, ভাষা এবং উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছেন বা করে চলেছেন। এই ব্লগে, আমরা ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য ভান্ডারের অন্বেষণ করব যা এই সম্প্রদায়গুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রেখেছে। আমার জীবনের দীর্ঘ সময়কাল ভারতেবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে, কাজেই কিছু ক্ষেত্রে এই লেখা আমার কাছে অনেকটা নস্টালজিয়ার মতন। বাংলা সাহিত্যেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের খাদ্যের বা খাদ্যরীতির কথা উঠে এসেছে। এই মুহুর্তে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পালামৌ' এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের 'আরণ্যক' উপন্যাসটির কথা মনে আসছে। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পালামৌ’ ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকেও উক্ত অঞ্চলের কোল জাতির মধ্যে খাদ্য হিসেবে মহুয়া ফুলের ব্যবহারের কথা জানা যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'আরণ্যক' উপন্যাসে লিখেছেন- 'আমাদের এ জঙ্গল-মহালের পূর্বে-দক্ষিণ সীমানা হইতে সাত-আট ক্রোশ দূরে অর্থাৎ সদর কাছারি হইতে প্রায় চৌদ্দ-পনের ক্রোশ দূরে ফাল্গুন মাসে এক প্রসিদ্ধ মেলা বসে। ....... মেলার এক অংশে তরিতরকারির বাজার বসিয়াছে, কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় শুঁটকি কুচো চিংড়ি ও লাল পিঁপড়ের ডিম বিক্রয় হইতেছে। লাল পিঁপড়ের ডিম এখানকার একটি সুখাদ্য। তাছাড়া আছে কাঁচা পেঁপে, শুকনো কুল, কেঁদ-ফুল, পেয়ারা ও বুনো শিম।'

সত্যজিত রায় মহাশয়ের পরিচালিত 'আগুন্তুক' ছায়াছবিটি আমার অন্যতম প্রিয় সিনেমা। ছায়াছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মনমোহন মিত্র আদিবাসীদের কৃষি, বুনন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ঔষধি, স্থাপত্য, শিল্পকলা ইত্যাদির কথা সাধারণ শহুরে মানুষদের প্রতিনিধি অনিলা দেবীর পরিবার এবং পারিবারিক বন্ধুর সামনে তুলে ধরেন, যদিও তাঁরা সেগুলির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না। এখানে একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কাটে, মনমোহন বলেন তিনি আদিবাসী নন বলেই তাঁর ফিল্ড নোট (Field notes) নেওয়ার প্রয়োজন হয়। সত্যি, আজ পৃথিবী যখন স্থায়িত্বের (Sustainability) জন্যে লড়ে যাচ্ছে, তখন আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমাজ থেকেই নেওয়া ফিল্ড নোটগুলি উল্টাতে হয় বইকি, তাতেই যে রয়েছে স্থায়িত্বের চাবিকাঠি ।

ভারতে উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালী ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত, জমি, ঋতু এবং আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ উপাদানগুলি ব্যবহার করেন। উত্তর-পূর্বের জঙ্গল থেকে শুরু করে রাজস্থানের শুষ্ক মরুভূমি পর্যন্ত, প্রতিটি অঞ্চল ভূগোল, জলবায়ু এবং সাংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত স্বতন্ত্র রন্ধনসম্পর্কীয় পরিচয় নিয়ে গর্ব করে। 

ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, আদিবাসী উপজাতিদের আবাসস্থল, খাদ্য শুধুমাত্র ভরণ-পোষণ নয় বরং জীবনের একটি উদযাপন। ভাত, মাছ, শুঁটকি মাছ এবং বাঁশের আগা (Bamboo shoot) এই অঞ্চলের অনেক উপজাতীয় খাদ্যের ভিত্তি। নাগাল্যান্ডের নাগা উপজাতিরা তাদের ঝাল ঝাল সুস্বাদু মাংসের খাবারের জন্য বিখ্যাত, প্রায়শই শক্তিশালী 'ভুত ঝোলোকিয়া' মরিচ দিয়ে রান্না করা হয়। মেঘালয়ের গারো এবং খাসি উপজাতিরা সুস্বাদু আচার এবং চাটনি তৈরি করতে বাঁশের আগা ফার্মেন্ট করেন, যা খুবই উপাদেয়। উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় বিভিন্ন কীট-পতঙ্গকে খাদ্য (Edible insects) হিসেবে ব্যবহার করেন। অরুণাচল প্রদেশে বিভিন্ন উৎসবে মিথুনের মাংস (Bos frontalis) মানুষের রসনা তৃপ্ত করে। এখানে মুরগি বা মাটনের থেকে শুয়োরের মাংসের ধিক্য দেখা যায়। পানীয়ের মধ্যে অরুণাচলের আপং (Apong-rice beer), নাগাল্যান্ডের জুথো (Zutho), সিকিমের ছাঙ (Chang) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আবার মিজোদের স্থানীয় ডেলিকেসি জাওলাইদি- আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত ওয়াইন (Zawlaidi- Grape wine) এক প্রেমের গল্প বলে। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পানীয় গ্রহণে কোনো বৈষম্য আমি দেখিনি, স্থানীয় মানুষকে মাতলামি করতেও আমার বিশেষ চোখে পড়েনি।

মধ্য ভারত বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল, প্রত্যেকের নিজস্ব রন্ধন ঐতিহ্য রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের গোন্ড এবং বাইগা উপজাতিরা মহুয়া ফুল, তেন্দু পাতা ইত্যাদি বনজ পণ্যের দক্ষতার সাথে ব্যবহারের জন্য পরিচিত। মহুয়া, বিশেষ করে, উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালীতে একটি বিশেষ স্থান রাখে, যা আলকোহলিক পানীয় (Alcoholic beverages) এবং মিষ্টি খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আদিবাসীদের বিভিন্ন মিলেটের, যেমন কোদো, কুটকি ইত্যাদির ব্যবহার (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট), বীজ সংরক্ষণ, কৃষি পদ্ধতি ইত্যাদি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়িত্ব এবং পুষ্টির নিশ্চয়তার দৃষ্টিকোণ খুবই প্রাসঙ্গিক। ছত্তিশগড়ের লাল পিঁপড়ের চাটনী, ঊড়িষ্যার G.I. ট্যাগ প্রাপ্ত 'কাই-চাটনী' (লাল পিঁপড়ের চাটনী- watery semi-solid paste of red weaver ant), মধ্য ভারতের স্থানীয় আদিবাসীদের খাদ্য হিসেবে শামুকের (Edible snails) ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। 

সবুজ পশ্চিম ঘাটের মাঝখানে অবস্থিত, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং কেরালার উপজাতি সম্প্রদায়গুলি রন্ধনসম্পর্কীয় আনন্দের একটি আকর্ষণীয় সম্ভার অফার করে। মহারাষ্ট্রের ওয়ারলি উপজাতি, তাদের শিল্পের জন্য পরিচিত, এছাড়াও রন্ধনশিল্পে পারদর্শী, পিঠলা-ভাকড়ি (Pithla-Bhakri- খামিরবিহীন রুটির সাথে বেসনের তরকারি) এর মতো হৃদয়গ্রাহী খাবার তৈরি করে। দক্ষিণ ভারতে কুরিচিয়া এবং কুরুম্বা মতো আদিবাসী উপজাতিরা বনের সবুজ শাক (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক), মিঠা পানির মাছ এবং বন্য মাংস দিয়ে রান্নার শিল্প আয়ত্ত করেছে, এমন খাবার তৈরি করেন যা যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর।

পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের কেন্দ্রস্থলে, রন্ধন প্রথাগুলি প্রকৃতি উপাসনা এবং পূর্বপুরুষদের আচারের সাথে গভীরভাবে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল উপজাতি ফসল কাটার মরসুম উদযাপন করে সোহরাই নামে পরিচিত একটি জমকালো ভোজের সাথে, যেখানে 'ধুসকা' (Dhuska- ডিপ-ফ্রাইড রাইস প্যানকেক) এবং পিঠা-র মতো খাবার রয়েছে। এদিকে, ওডিশার বোন্ডা উপজাতি বন্য মাশরুম, কন্দ এবং সবুজ শাক তাদের প্রতিদিনের খাবারে অন্তর্ভুক্ত করে।

আধুনিকীকরণ (?) এবং পরিবেশগত অবক্ষয় দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ভারতের সমৃদ্ধ উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য প্রচেষ্টা চলছে। ঐতিহ্যগত জ্ঞান (Traditional Knowledge) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রজম্নের পর প্রজন্ম মুখে মুখেই প্রচলিত, লিখিত ভাবে না থাকার জন্যে তা অবক্ষয়িত, এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তাই আমাদের সেই ফিল্ড নোটগুলিকেই ভরসা করতে হয়। 'আগুন্তুক' ছবিতে নিজের চিকিৎসার জন্যে মনমোহন মিত্র এমন এক ওঝাকে ডেকেছিলেন যাঁর নখদর্পনে ছিল ৫০০ ঔষধি গাছ-গাছড়ার গুণাবলীর তথ্য, এ কিন্তু নেহাত কল্পনা নয়, এরূপ উদাহরণ আমি দেখেছি। তবে স্থানান্তর (Migration), স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় (Ecosystem degradation), জীব বৈচিত্রের হ্রাস (Biodiversity loss) পাওয়া ইত্যাদির ফলে এই জ্ঞানভাণ্ডার আজ ক্ষয়িষ্ণু। এই মূল্যবান জ্ঞান ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা আবশ্যক। আদিবাসী সমাজের এই কম কার্বণ ফুটপ্রিন্ট (Low carbon footprint) বৈশিষ্টযুক্ত খাদ্য ব্যবস্থা পরিবেশের স্থায়িত্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে। সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে খাদ্য উৎসব, রন্ধনসম্পর্কীয় কর্মশালা এবং ডকুমেন্টেশন প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলি দেশীয় খাবার এবং ঐতিহ্যগত রান্নার পদ্ধতির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে। উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য উৎযাপন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে, আমরা শুধুমাত্র ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করি না বরং ভবিষ্যত প্রজন্মকে লালন করার জন্য আমাদের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকেও রক্ষা করি।

উপসংহারে, ভারতের উপজাতীয় খাবারগুলি প্রকৃতির সাথে গভীর সংযোগের প্রমাণ যা সারা দেশে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। উত্তর-পূর্বের কুয়াশা-ঢাকা পাহাড় থেকে মধ্য ভারতের রৌদ্রে ভেজা সমভূমি পর্যন্ত, এই সকল খাদ্যের প্রতিটি কামড় স্থিতিস্থাপকতা (Resilience), ঐতিহ্য (Tradition) এবং খাদ্য ও সংস্কৃতির (Food culture) মধ্যে স্থায়ী বন্ধনের গল্প বলে। পরিশেষে উল্লেখ করি, এছাড়াও অনেক পদ বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে, সমস্ত পদের বর্ণনা একটি সংক্ষিপ্ত ব্লগে সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি আইকনিক পদের বর্ণনা এই ব্লগটিতে করলাম।

আমাদের খাদ্যের পশ্চিমায়ন (Westernization of the Our Diet)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


ইতিপূর্বে খাদ্যের রূপান্তরের সম্বন্ধে একটি ব্লগে আমি সবিস্তারে আলোচনা করেছি। বর্তমানেও এর ধারা অব্যাহত। এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যেমন অর্থনৈতিক উন্নতি বা আয় বৃদ্ধি, নগরায়ন, এবং অবশ্যই বিশ্বায়ন। বর্তমান আলোচনাটি আমি সীমাবদ্ধ রাখবো খাদ্য ব্যবস্থার উপরে বিশ্বায়নের প্রভাবের বিষয়ে।  

বিশ্বায়নের প্রভাব আজকের জীবনে সর্বত্র। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক, পাঠক-পাঠিকা দেখুন তো বিষয়টি পরিচিত কিনা !

দৃশ্য ১- এই তো সেদিন দুর্গাপুজোর শিরনামা (বা ব্যানার) নিয়ে আলোচনার সময়ে জনৈক ব্যক্তি শিরনামাটি বাংলা ভাষায় তৈরী করতে বললেন, তবে মত ভারী হলো ইংরেজী ভাষায় ব্যানারটি লেখার পক্ষে। 

দৃশ্য ২- জনৈক ব্যক্তি তাঁর নিকট এক আত্মীয়র বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন কিন্তু রাস্তায় গাড়ির ভিড় অত্যন্ত বেশি থাকায় দেরি হয়ে যাচ্ছে।  বারবার মুঠোফোনটি বেজে উঠছে, সবাই যে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে, সে গেলে তবে কেক কাটা হবে। 

দৃশ্য ৩- বাড়িতে আজ অনেক বন্ধু-বান্ধব এসেছে। অনেক দিন পরে দেখা-সাক্ষ্যাতের  সুযোগ পেয়েছে সবাই। সবাই ঠিক করলো পিজ্জা আর কোক অর্ডার দেওয়া হবে। 

এরূপ বিভিন্ন দৃশ্য আজ চতুর্দিকে দৃশ্যমান। তবে এর মধ্যে থেকে খাদ্যের বিষয়টিতে আলোকপাত করা আমার উদ্দেশ্য। আজকের নগরকেন্দ্রিক ভারতে পশ্চিমা খাদ্য সংস্কৃতি বেশ চোখে পরে। মানুষের মধ্যে অধিক প্রক্রিয়াজাত খাবার (Ultra-processed foods) এবং পানীয়ের পছন্দ উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ছে। বিশ্বায়নের ফলে দেশগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্য আর সব কিছুর সাথে রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যেরও ভাগাভাগি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, টেলিভিশন শো এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পশ্চিমা খাবারের এক্সপোজার (Exposure) ভারতীয় জনমানসে পশ্চিমা খাবারের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহে অবদান রেখেছে। নগরায়ন এবং যৌথ পরিবারের স্থানে ক্ষুদ্র পরিবারের (Nuclear family) উত্থান ঐতিহ্যগত খাদ্যাভ্যাস (Traditional food habit) পরিবর্তন করেছে। ব্যস্ত শহুরে জীবনধারা প্রায়শই দ্রুত এবং সুবিধাজনক খাবারের (Convenient food) জন্য অগ্রাধিকার দেয়, যার মধ্যে পশ্চিমা-স্টাইলের ফাস্ট ফুড এবং প্যাকেটজাত খাবার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। রেস্তোরাঁ এবং ফাস্ট-ফুড চেইন (Fast food chain) সহ আতিথেয়তা শিল্প (Hospitality industry) পশ্চিমা স্বাদগুলি প্রবর্তন এবং জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা বলাই বাহুল্য। ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি এবং পিৎজা হাট-এর মতো আন্তর্জাতিক ফাস্ট-ফুড চেইনগুলির ভারত জুড়ে শহুরে কেন্দ্রগুলিতে উপস্থিতি রয়েছে। এখানে দু'টি তথ্য উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ভারতে প্রথম ম্যাকডোনাল্ডস রেস্তোরাঁটি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে মুম্বইয়ের বান্দ্রাতে খুলেছিলো। বর্তমানে (২০২২ খ্রিস্টাব্দের কোম্পানিটির রিপোর্ট অনুযায়ী) ভারতে ৫১২ টি ম্যাকডোনাল্ডস রেস্তোরাঁ রয়েছে। অন্যদিকে ভারতবর্ষের ৩৭১ টি শহরে ডোমিনোসের ১৭০১ টি রেস্তোরাঁ রয়েছে (২০২২ খ্রিস্টাব্দ)। এতো শুধু এই কয়েকটি  আন্তর্জাতিক ফাস্ট-ফুড চেইনের পরিসংখ্যান। এর পাশাপাশি বিভিন্ন রাস্তার ধারের স্টলে (Street food stall) বা স্থানীয় রেস্তোরাঁতেও এই সকল খাদ্যগুলি সুলভ। এখানে উল্লেখ্য, ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁগুলিতেও (Fine dining restaurant) প্রায়শই ফিউশন উপাদানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য রন্ধনশৈলীকে মিশ্রিত করে বিভিন্ন স্বাদের জন্য। পাশ্চাত্য উপাদান (Western ingredients/Recipes) এবং রান্নার কৌশলগুলি (Culinary) ক্রমবর্ধমানভাবে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় রেসিপিগুলিতে একত্রিত হচ্ছে। 

ফিউশন রন্ধনপ্রণালী (Fusion culinary), যা ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উভয় রান্নার উপাদানকে একত্রিত করে, জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আজকে "বাটার চিকেন পিজ্জা" বা "ভারতীয় মশলা সহ মশলাদার পাস্তা" এর মতো খাবারগুলিতে প্রায় প্রতিটা শহরেই সুলভ এবং তা আমাদের রসনা তৃপ্ত করে।

এখন প্রশ্ন হলো এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসলাম কেন ? বিশ্বায়ন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় তো ভালো, তবে সমস্যা কোথায় ? আসলে আমার মনে হয় বিশ্বায়নের মূল সূত্রটি গাঁথা 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে'- তে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে')। এখন যদি শুধু নেওয়ার দিক ভারী হয় তবে তা ভারসাম্য হারায়। আহারের বৈচিত্র সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এক প্রকারের আহার্যের ক্রমবর্ধমান চাপে যেন অন্য আহার্য বস্তুগুলি ক্রমে হারিয়ে না যায়, সেটা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। যে প্রকারে আমরা পশ্চিমের খাদ্যবস্তুগুলিকে আপন করে নিয়েছি, এমনকি বেশ কিছুক্ষেত্রে আমাদের স্বাদ অনুসারে মেটামর্ফোস (Metamorphose) করেছি সেই প্রকারে আজ পর্যন্ত কিন্তু আমাদের খাদ্যগুলিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। আমাদের খিচুড়ি, ইডলি, দোসা, নারকেলের তক্তি, চন্দ্রপুলি, পিঠা, আঁচার ইত্যাদি একান্ত আমাদের খাদ্যগুলি নিজেদের মধ্যেই যে শুধু সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে তা নয়, বরং অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন অধিক প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলির সাথে প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়েই পড়ছে। কাজেই এক্ষেত্রে বিশ্বায়নের থেকে পশ্চিমায়নের পাল্লাটি অধিক ভারী হয়ে পড়েছে। এটি সম্ভাব্যভাবে ঐতিহ্যগত রন্ধনপ্রণালীকে (Traditional culinary) ক্ষয় করা এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের সাথে যুক্ত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলিতে অবদান রাখার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। আমাদেরও আমাদের নিজস্ব খাদ্যগুলিকে বিশ্বের সামনে আরও অধিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।

কিচেন গার্ডেন (Kitchen Garden)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


ছোটবেলায় দিদাকে দেখছি কাঁচা রান্নাঘর সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত আর্দ্র অঞ্চল থেকে থানকুনি পাতা তুলে আনতে। পেটের রোগে ভুগলে থানকুনি পাতা পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো, হয়তো এখনও হয়। পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হলেও থানকুনি পাতা বাটা খুবই সুস্বাদু একটি খাদ্য। আবার গ্রামাঞ্চলে মানুষ ক্ষেত, খামার, পুকুর ঘাট, খালবিলের আশপাশ থেকে শাকপাতা তুলে আনতো, আমিও এক আধবার মামাবাড়িতে গেলে দিদির সাথে কালীপুজোর  আগের দিন চোদ্দ শাক তুলতে গিয়েছি। 'কিচেন গার্ডেন' কথাটির বিশেষ ব্যবহার তখন হতো না। আসলে কোনো কিছুর অনুপস্থিতি তার গুরুত্ব বোঝায়। তখনও নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা আজকের অবস্থায় পৌঁছয়নি। সকলেরই বাড়িতে একটু আধটু জায়গা, উঠোন ছিল, মানুষ তাতে বিভিন্ন ধরণের সব্জি লাগাতেন, বেশিরভাগ সময়ে তা এমনিই ফেলে দেওয়া সব্জি বা ফলের বীজ থেকে জন্মাতো, পরিচর্যা বিশেষ লাগতও না। ঘরের চালে কুমড়ো, চালকুমড়ো, লাউ, কিংবা উঠোনে লঙ্কা, লেবু, এমনকি বাড়ির পিছনে কচু, বিভিন্ন ফলের গাছ যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল, বেল, নারিকেল ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যেত। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতেও নানান ফলের গাছ ছিল। যেহেতু, এই সকল সুবিধে সহজেই প্রাপ্ত হতো, এর গুরুত্ব তখন অতটা উপলদ্ধি হয়নি। এখন শহরাঞ্চলে এক চিলতে মাটি সহজে পাওয়া যায় না, শহর কেন্দ্রিক সভ্যতায় আজ বড়ো বড়ো গগনচুম্বি অট্টালিকাগুলি আজ মুখ্য ভূমিকায়, মাটি কংক্রিটাবৃত। বাড়ির উঠোন, বাগান আজ অমিল আর তাই 'কিচেন গার্ডেন'-র গুরুত্ব এখন উপলব্ধি হচ্ছে। বাড়ির সংলগ্ন এই বাগানগুলি হারিয়ে যাওয়ার রেশ কিন্তু মানুষের পুষ্টির উপর এসে পড়ছে। যেমন বাড়ির চালে হয়ে থাকা কুমড়ো ভিটামিন A প্রদান করে, বেড়ার গায়ে যে লাউটা হয়ে থাকে তাতে প্রচুর পরিমানে ফোলেট বা ফলিক অ্যাসিড (Folate/ ভিটামিন B9) থাকে, আবার ওল বা কচুতে রয়েছে অনেক ক্যালসিয়াম (Calcium), এগুলো কিন্তু এমনিতেই পাওয়া যেত। পুকুর ধারে হয়ে থাকা নানান শাকগুলোতে মিনারেল আর ভিটামিনের প্রাচুর্য্য উল্লেখযোগ্য (অনুগ্রহ করে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক পড়ুন)।

চাল, গম, মূলত শর্করা জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে; ডাল, মাছ, মাংস প্রোটিন সরবারহ করে; তৈলবীজগুলি তেল বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে। এই হলো তিন প্রকার বৃহৎ জাতীয় পুষ্টি উপাদান যা ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Macro-nutrient) নামে পরিচিত। অপরপক্ষে, শাক-সব্জি, ফল হলো মিনারেল এবং ভিটামিনের অন্যতম প্রধান উৎস, এরা মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Micro-nutrient) নামে পরিচিত। এই সকল অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলি পুষ্টি নিশ্চয়তার জন্যে একান্ত প্রয়োজন, যা অনেক সহজেই গৃহ সংলগ্ন বাগান থেকে পাওয়া যেত এবং এগুলি বাজার থেকে ব্যয় করে ক্রয় করার প্রয়োজন হতো না। কাজেই ব্যবহারিক জীবনে বিনামূল্যে পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ খাবার পাতে এসে পৌঁছতো।    

সাধারণভাবে, সভ্যতায় নগরকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পেলে অধিক মানুষ গ্রাম থেকে নগরে বসবাস শুরু করে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ চিত্র বর্তমান। কৃষক, পশুপালক, কামার, কুমোর, ছুঁতোর সকলে যারা গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদন্ড ছিল, তারা ক্রমে 'ভালোভাবে' বাঁচার আশায় কর্মসংস্থানের সন্ধানে শহরে আসতে শুরু করেন, গ্রামের অপেক্ষাকৃত খোলামেলা বাগান, উঠোন সহ ঘরের পরিবর্তে শহরের ছোট ছোট গায়ে গায়ে লাগানো ঘর। সকল কিছুই সেখানে বাজার থেকে পয়সা খরচ করে আহরণ করতে হয়। এদিকে শহরও আয়তনে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তার আশেপাশের ভূমির তথা বাস্তুতন্ত্রের চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বনাঞ্চল পরিষ্কার করে নগর আয়তনে বৃদ্ধি পায়। বনের শুকনো কাঠ জ্বালানির জন্যে, বনের ঘাস পশুখাদ্যের জন্যে, পাতা সারের জন্যে, বাঁশ, গোলপাতা ঘর বানানোর জন্যে, বনের ফল-মূল-মধু খাওয়ার জন্যে - এসকলের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করে একটা পরিবর্ত পরিস্থিতিতে উপনীত হয়, অনিবার্যভাবে এঁদেরও আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে নগর। এতদিন যখন সকলেই কিছুটা কিছুটা খাদ্য নিজ নিজ পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করতো আজ সকলেই সম্পূর্ণটার জন্য বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে। অনিবার্যভাবেই পূর্বের সাধারণ চাষী বর্তমানে পরিণত হয়েছেন বাজার-চালিত কৃষকে, সেই সকল উৎপাদনে মানব সভ্যতা মনোনিবেশ করেছে যা অধিক মুনাফা দেয়, মাত্র কয়েকটি খাদ্যের উপর আজ জোর দেওয়া হচ্ছে, ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে খাদ্য বৈচিত্র।     

আজকে যখন আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে খাদ্যের বৈচিত্র পুষ্টি নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে অপরিহার্য, ততদিনে অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। একসময় যা সহজলভ্য ছিল, উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে যা হেলায় হারিয়েছি তা আজ প্রকৃতই দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এই বিষয়ে বর্তমানে অনেকগুলি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্কুল কিচেন গার্ডেন। প্রধানত এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য স্কুল কিচেন গার্ডেন স্থাপন করার মাধ্যমে, ছাত্র-ছাত্রীদের এর ফলে উৎপন্ন সব্জি ফল ইত্যাদি খাওয়ার ফলে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাব পূরণ হবে, তাঁদের শাক-সব্জি ফলানোর অভিজ্ঞতা লাভ হবে, এবং শাক-সব্জি ইত্যাদির পুষ্টি বিষয়ে তাঁরা জ্ঞানলাভ করবেন এবং জাঙ্ক-ফুডের (Junk food)  ক্ষতিকারক দিকগুলি সম্বন্ধে সচেতন হবেন। কিচেন গার্ডেনের প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজ্য ভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।বাড়িতে কিচেন গার্ডেন করলে তা যেমন খাদ্যের বৈচিত্র বাড়াবে, পুষ্টির অনিশ্চয়তা দূর করার হাতিয়ার হবে, তেমনি এটা অতিরিক্ত আয়ের একটা পথও হয়ে উঠতে পারে।

পুষ্টি সুরক্ষা ও আমাদের সমাজের কিছু চিত্র (Nutrition Security and Society)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আমি পূর্বে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-১: সূচনা ব্লগটিতে বর্তমান ভারতবর্ষে পুষ্টি বিষয়ক চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমান ব্লগে ব্যবহারিক জীবনে খাদ্য বা পুষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা অংশ তুলে ধরার একটা প্রয়াস করবো। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন চিত্র। তা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাহিনী নয়। চরিত্র নামকরণ অপ্রয়োজনীয় কারণ এটি কোনো গল্প বা উপন্যাস নয়, বাস্তবের উপর ভিত্তি করে কিছু কাল্পনিক কাহিনী/ ভাবনা/ সংলাপ, যা থেকে সহজে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য এবং পুষ্টির স্থান অনুমান করা যাবে। আসলে খাদ্য এবং পুষ্টির সুরক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির পাশাপাশি আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কিছু সচেতনতা ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পুষ্টির সুরক্ষাকে দ্রুততর করে।  সেই রকম কয়েকটি দিক তুলে ধরতেই আমি এই কাল্পনিক সমাজচিত্রটির অবতারণা করলাম এই ব্লগে।

-------------------------------------------------------

'আগে বললেই পারতে, কিছুটা তুলে রাখতে বলতাম, অতটা খাবার নষ্ট হতো না'

অশীতিপর বৃদ্ধ বক্তার উদ্দেশ্যে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকায় বছর ত্রিশের অতিথি যুবক। গৃহের অন্য সদস্যরা হা হা করে ওঠেন, 'আরে না না, কি হয়েছে! আগে থেকে কি ঠিক বোঝা যায়, তুমি কিছু মনে করো না বাবা, ওনার তো বয়স হয়েছেইত্যাদি।

যুবক মনে মনে ভাবলেন, বৃদ্ধ বড়ই খিট্খিটে, কারোর বাড়িতে এলে এরকম কথা কেউ অতিথির উদ্দেশ্যে বলে নাকি! যাইহোক, আমতা আমতা করে প্লেটটি সরিয়ে রাখলেন। আবার গল্প গুজব চলতে থাকে। নানান কথা, ছুঁয়ে যায় একটার পর একটা বিষয়, চলচ্চিত্র-রাজনীতি-খেলা-সমাজ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি কি নেই সেখানে। একের মুখ থেকে কেড়ে আরেক মুখ কথা বলে ওঠে, সেখানে তথ্য-তত্ত্ব কিছুমাত্রায় ঠাঁই পায় বটে, তবে কল্পনা, ধারণা, নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার এক রমরমা আজকাল বড়ই চলছে। অতিথি নির্দিষ্ট সময় পার করে চলে যান, সবাই খুব ব্যস্ত আজকাল, তারমধ্যে সময় বের করে সকলের খোঁজ নিতে এসেছে সে, সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় অতিথির। এর মধ্যে কেউ একজন অর্ধেক খাবার পূর্ণ প্লেটটি টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।  রান্না ঘরের পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় গোটা দুয়েক তরকারি লেগে যাওয়া লুচিঅবশিষ্ট তরকারি আর দেড়খানা রসগোল্লা। বৃদ্ধ তাঁকিয়ে দেখেন। এমন ভাববেন না বৃদ্ধ গরীব, সে আর তাঁর পরিবার উচ্চ মধ্যবিত্ত। একটু বাদে আহ্নিক সেরে বৃদ্ধ তাঁর ঘরের ইজি চেয়ারটায় এসে বসবেন, চিনি ছাড়া চা আর দু'টো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট আসবে তাঁর জন্যে। দিনে দু'বার চা খান বৃদ্ধ, সকালে গ্রিন টি আর সন্ধ্যায় এমনি প্রচলিত চা, যাকে ব্ল্যাক টি বলে। তবে এই যে স্বাচ্ছন্দ্য, বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যায়ে পৌঁছনো সেই দীর্ঘ পথ কিন্তু মসৃন নয়, সেখানে অগণিত না খাওয়া রাত রয়েছে, আক্ষরিক অর্থে দু'মুঠো ভাত খেয়ে দিনাতিপাত রয়েছে, মুখ ফুটে খাবার চেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে বসে থাকার মুহূর্তগুলো রয়েছে, খাবারের আশায় ক্রোশের পর ক্রোশ পথ চলা আছে, আবার এর মাঝে কখনও জুটে যাওয়া কিছু ভালো খাবার আর তা নিয়ে উল্লাস রয়েছে। বৃদ্ধ ভাবেন, সেই সময়কার কথা, তাঁদের জীবনধারণের কথা, সে অনেকটা সংগ্রামের মতন শোনায়, বৃদ্ধ অনেক গল্প বলেন তাঁর নাতি নাতিনীদের, সবই আবর্তিত হয় নিজের জীবনের  কথা, তাঁর শৈশব, বড়ো হওয়া, কর্ম জীবন, ইত্যাদি। সবাই যে বোঝে তা নয় আবার বোঝে যে না তাও নয়। তবে কারা ভালো বোঝে, সে বোঝা দায় ! 

এই যে মেয়েটি প্রত্যেকদিন ঘরের কাজ করতে আসেন ওঁর মেয়েকে স্কুলে দিয়েছে, দাদার সাথে সেও যায়, রোজ স্কুলে খেতে দেয়, ও বলছিলো একবেলার জন্যে ও নিশ্চিন্ত। আবার পুজোর ফুল বাজারে যার কাছ থেকে নেওয়া হয়, ও বলছিলো ছেলেটাকে স্কুল পাঠিয়ে পড়াশুনা আর দুপুরের খাওয়াটা দু'টি বিষয়েই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। এঁরা হয়তো বোঝেন।

এই চিত্র আবার বৃদ্ধের প্রতিবেশী বাড়িটির ক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা। ওঁদের থেকে বৃদ্ধ কথায় কথায় শুনেছে ওঁদের বাড়ির ছেলেটা রোজ স্কুলের মিড ডে মিলের খাবারটা খায়না, মাঝে মাঝে খায়, ডিম দিলে সেটা নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। ওঁরা কেক, চিপস এসব দিয়ে দেন টিফিনে।

বাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার করতে এসেছে একটা লোক, দুপুরে বৃদ্ধের বাড়িতে খেতে দেওয়া হয়েছিল, সাধারণত এসকল লোককে নিরামিষই দেওয়া হয় কিন্তু সেদিন বাড়িতে মুরগির মাংস একটু বেশি পরিমানেই রান্না হয়েছিল, দু'টুকরো লোকটাকে দেওয়ায় তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, তা বৃদ্ধ লক্ষ্য করেছিলেনখাবারের অভাব এও হয়তো বোঝে।

'তোমার ঘরে কে কে আছে?'

'বৌ, এক ছেলে আর এক মেয়ে বাবু'

'ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়াশুনো করাচ্ছ তো?'

'আজ্ঞে!' একটু আমতা আমতা করে বলে 'আসলে গত দু'বছরে তেমন কিছু রোজগারপাতি ছেলো না, তাই মেয়েটা মায়ের সাথে কাজের বাড়ি যায়।

বৃদ্ধ বলে ওঠেন, 'বলো কি ! স্কুল ছাড়িয়ে দিলে?'

'না বাবু, আবার যাবেখন, মানে স্কুল ও তো বন্ধ ছেলো, তাই ......, তা যাবেখন আবার, গেলি তো খাওন টাও পায়।'

বৃদ্ধ বোঝে, কিন্তু কি বলতে হবে সেটা বোঝেন না !    

বাড়িতে হৈ হৈ পরে যায়। বৃদ্ধের বড়ো নাতি এসেছে, কর্মসূত্রে সে প্রবাসীকাজেই সকলে ঠিক করলো বাইরে খাবে। তবে এখন বাইরে বেড়ানোটা বেশ অসুবিধাজনক, প্যানডেমিকের কারণে একটা উদ্বেগ থেকেই যায়। অবশেষে ঠিক হলো খাবার আনিয়ে নেওয়া হবে যার যা ভালো লাগে, সবাই নিজের নিজের মতন অর্ডার দিলো, বিরাট আয়োজন। কেউ ফ্রাইড রাইস, কেউ বাসন্তী পোলাও, কেউ সাদা ভাত, আবার কেউ বিরিয়ানি। কেউ মাটন কষা, কেউ রেজালা, কেউ চিকেন বাটার মশালা, আবার কেউ পনির মশালা। আরও কত কি! কেউ কিন্তু নিজের সমস্ত খাবার এবেলায় শেষ করতে পারলো না। বৃদ্ধকে সকলে কথা দিলো, রাতে অবশিষ্টাংশ খেয়ে নেবে তবে তা আর হয়নি, অবেলায় এতো কিছু খেয়ে রাতে কেউ খাবার মুখেই তুলতে পারলো না। আগেরবার, মানে দু'বছর আগে কিন্তু এমনটা হয়নি, সেবার সবাই মিলেমিশে অর্ডার দিয়েছিলো, মানে এক প্লেট পোলাও দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, আবার এক প্লেট মাটন দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, এতে পুরোটাই খেতে পেরেছিলো, নষ্ট হয়নি         

বৃদ্ধ কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন। সেখানে একাধিকবার সে বিভিন্ন পার্টিতে যোগ দিয়েছে, ওখানে অনেকটা খাবারের এমন রীতি, অনেক খাবারের আয়োজন হয়। রেঁস্তোরা থেকে যখন বেরোয় কত খাবার পাতেই পড়ে থাকে।  বৃদ্ধের, তখন সে যুবক, মুখ থেকে কতবার আক্ষেপ সূচক বাক্য নিঃসৃত হয়েছেএকবার সাহেব বন্ধু বলেছিলেন, 'আরে এই খাবার বাঁচলে কি পৃথিবীর খাদ্য সংকট মিটে যাবে নাকি?' যুবক কিছু বলেননি, শুধু তাঁকিয়ে থেকেছেন আর ভেবেছেন কয়েক বৎসর পূর্বের তাঁর জীবনের কথা। এখানে এতো খাবার নষ্ট হয় আর এমন মানুষও আমাদের সমাজে ছিলেন যারা ফসল তোলার পর মিনতি করতে আসতেন, বাবু যদি তাঁদের আজ্ঞা দেন তবে তাঁরা মাঠে পরে থাকা শস্য সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে পারেন। প্রবাস জীবনে বাজার করতে গিয়েও তিনি অভিজ্ঞতা করেছেন সেদেশে সকল বস্তুই নির্দিষ্ট ওজন করা প্যাকেটে বন্দী, ঠিক যতটা লাগবে ততটা কেউ ওজন করে নিতে পারবেন না (আমাদের দেশের বাজারের মতন), কাজেই অধিকাংশ সময়ে অতিরিক্ত পরিমান বস্তু বাজার থেকে নিয়ে আসতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে তা পচে নষ্ট হয়।  

কি রে ওটা কি রাখলি? এক খানা ডিম নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’ কাজের মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন গৃহকত্রী।

‘আর বোলো না গো মা, ছেলেটা মোটে নিরিমিষ মুখে তুলতে চায় না, তাই আর কি করি, এই এক খান ডিম নিয়ে যাচ্ছি, ভেজে দেবোখন, ভাত দু'টি খাবে।’ উত্তর দেয় মেয়েটি।

তা এক খানা নিলি যে বড় ! বোনটার জন্যে নিলি না ?’

না গো, ও বড় লক্ষ্মী, ও খেয়ে নেয় যা জোটে।’ 

আচ্ছা, বুঝেছি, বলে এক খানা ডিম ফ্রিজ থেকে এনে দেন মেয়েটির হাতে, বলেন দুই ভাইবোনকেই ভেজে দিস।

বৃদ্ধ দেখছিলেন। ভাবছিলেন কয়েক দশক আগের কথা, যখন রাত্রের আহারে তিনি একা মাছের টুকরো খেতেন, বিধবা মা আর স্ত্রী খেতেন ভাত-ডাল আর যেদিন যা তরকারী থাকতো তাই। বাইরে কাজের জন্যে কোন সকালে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন রাত্রে, তাই টানাটানির সংসারে দু'বেলা যা কিছু উত্তম জুটতো তা তাঁর পাতেই জায়গা পেতো। এই নিয়ে অবশ্য মা বা স্ত্রীর কোনো আফসোস ছিল না। তাঁরা তো বাড়িতেই থাকতেন, সমস্ত ঘর পরিষ্কার, রান্না করা, কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া, ইত্যাদি কত শত কাজ, তবে সবটাই বাড়িতে, কাজেই তাঁরা 'অধিক' পরিশ্রম করে যিনি সংসার টানছেন বলে মনে করতেন তাঁকেই ভালোটা পরিবেশনের জন্যে সচেষ্ট থাকতেন।  

তবে প্রথমবার যখন তাঁর স্ত্রী মা হয়েছিলেন, তখন মা এবং সন্তান বেশ ভুগেছিলেন। মেয়ে সন্তানের ওজন হয়েছিল অনেক কম, জ্বর, ডায়রিয়া ইত্যাদির সাথে লড়তে লড়তে বাচ্চাটা প্রায় বিছানায় মিশেই গিয়েছিলো। ডাক্তার অনেক বাকাবকি করেছিলেন। এই সকল ভোগান্তি অপুষ্টিজনিত বলেছিলেন, বৃদ্ধ (তখন যুবক) বুঝেছিলেন কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস ততদিনে পদোন্নতি হয়েছিল তাইতো অনেক ডাক্তার হসপিটাল করে কোনো মতে মা মেয়েকে সুস্থ্য করে ঘরে এনেছিলেন। সে প্রায় বছর পঞ্চাশের আগের কথা, এখন তো খুকীর ছেলেই কত বড় হয়ে গেছে ! তারপর তো মা চলে গেলেন। অফিস থেকে তাঁকে পশ্চিমে পাঠালো। জীবনে এক ধাক্কায় অনেকটা পরিবর্তন এলো। খুকী খুবই ঘ্যান ঘ্যান করতো ছোটবেলায়, সে ওই দেশে কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া শুরু করলো, দিদিমণিদের পরামর্শে খুকীকে কাউন্সেলিং করানো হলো, ধীরে ধীরে বেশ চনমনে হয়ে উঠলো  সে। তারপর তাঁদের একটি ছেলে হলো, ডাক্তার স্ত্রীর মেডিকেল হিস্ট্রিতে সিজার দেখে একটু চিন্তিত হলেন।  যাইহোক এবার পূর্বের ন্যায় পরিস্থিতি হলো না, তবে সেবারও স্ত্রী সিজারের মাধ্যমেই পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।

এসকল ভাবছিলেন বৃদ্ধ, তখন নাতি ঘরে প্রবেশ করলেন। বৃদ্ধ তাকালেন, দৃষ্টিটা একটু পরিষ্কার হলে প্রশ্ন করলেন, 'হ্যাঁ রে তুই যে দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছিস' ! নাতি হেসে উত্তর দিলো 'সেডেন্টারি লাইফ গো দাদু, সারাদিন বসে বসে কাজ, জগৎ সংসার এগিয়ে চলছে আর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে উৎপন্ন করছে এই অপুষ্টিগত পরিনাম' বলে থামে সে।

তা কতদিন ছুটি পেলি?

আর ছুটি..’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে পেয়েছি দু'দিনের, তার সাথে রবিবার 

বাব্বা, কাজের তো বড্ড চাপ ! তা খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকে করিস তো?

হ্যাঁ সেটা করি, বেশিরভাগ দিন দুপুরে অফিসেই বিরিয়ানি না হয় সিজওয়ান ফ্রাইড রাইসের একটা প্লেট আনিয়ে নিই, বাড়িতে রাতে হালকা কিছু ধরো রুটি আর মাংস বা পনিরের কিছু একটা আর টক দই। খাওয়া নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা নেই

নাতি আরো বলে ও যেখানে বাসা ভাড়া নিয়েছে, তার সামনে বেশ কতগুলো দোকান রয়েছে, পিজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, মোমো, পাস্তা সব কিছুই সেখানে সহজলভ্য। নাতির মধ্যে কি যেন খোঁজে বৃদ্ধ, হয়তো নিজের তরুণ অবস্থাকে, নাতিকে দেখতে পুরো তাঁরই মতন। এই বয়সে তাঁর নিজের কি অবস্থা ছিল, কিভাবে যে বেঁচেছিল অসহায় মাকে নিয়ে সেটাই সে বুঝতে পারে না। দিনের পর দিন ভাত, এখান-ওখান তুলে আনা কলমি শাক ভাজা খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া, এই ছিল তাঁদের দিনাতিপাত। ডাল-ভাত-তরকারি-মাছ সহযোগে পরিপূর্ণ আহার তাঁদের কাছে তখন ছিল চাঁদ হাতে পাওয়ার মতন, তা সম্ভব হতো যদি কেউ নিমন্ত্রণ করতেন তবে মা'র মুখে কোনোদিন তেমন সুখাদ্য তুলে দিতে পারেননি বৃদ্ধ। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে নাতির ডাকে, দাঁড়াও আমি আসছি বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক বাদে, হাতে তখন আলুর চিপস আর এক গ্লাস কোল্ড ড্রিঙ্কস। নাতিকে খেতে বারণ করে বৃদ্ধ, পরক্ষণে কি মনে হয় আবার বলে আসলে একটু এসব কম খাস মনে মনে হিসেব করে, পয়সা যখন ছিল না আর যখন হলো আসলে ঠিক কতটা পার্থক্য হলো ?  

কাজের মেয়েটি আবার আসে পড়ন্ত বিকেল বেলায়। ও রেশন নিয়ে কার্ড ফেরত দিতে এসেছে। গৃহকত্রী রান্না ঘর থেকে বলেন দাদুর কাছে রেখে যেতে। বৃদ্ধ হাসিমুখে কার্ডগুলো রেখে দেয়। 'দাদু কি হয়েছে? হাসছ যে'! 'না রে, আসলে ভাবছি কত মানুষের মুখে অন্ন উঠছে, একি আর মুখের কথা রে দিদিভাই' 

দাদু ওঁকে বলেন নাতিকে ডেকে দিতে। মেয়েটি নাতিকে ডেকে দিয়ে চলে যায়। দাদু বলে তোর ল্যাপটপ টা আন তো, দু'জনে মিলে একটা সিনেমা দেখি, আজ দেখবো মৃনাল সেন পরিচালিত 'আকালের সন্ধানে' আর কাল দেখবো সত্যজিৎ রায় পরিচালিতগুপী গাইন বাঘা বাইন'

এই দু'টো বাছলে কেন?

আচ্ছা.....তবে তুই বল। না থাক, আছে তো আরও তবে আগে এই দুটোই দেখি

বাঙালীর আহারে মাছ (Fish in Bengali's diet)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

মাছে -ভাতে বাঙালী। খাদ্য নির্বাচনের সূত্র মেনেই জলবহুল বাংলায় অনাদিকাল থেকেই মাছ বাঙালীর খাদ্য হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। মাছ চিরকালই বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করার পাশাপাশি পুষ্টি প্রদান করে এসেছে।



চন্ডীমঙ্গল কাব্যে উল্লেখ রয়েছে,

কটু তৈলে রান্ধে বামা চিথলের কোল

বুহিতে কুমুড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল।

--------------------------------------------

কটু তৈলে কই মৎস্য ভাজে গন্ডা দশ

মুঠে নিঙ্গড়িয়া তথ্য দিল আদারস।

-------------------------------------------

কথোগুলি তোলে রামা চিঙ্গড়ির বড়া

ছোট ছোট গোটা চাবি ভাজিল কুমুড়া।

আবার চন্ডীমঙ্গল কাব্যের অপর এক স্থানে পাই,

ঘৃতে ভাজে পলাকড়ি                 নট্যা সাকে ফুলবড়ি

চিঙ্গড়ি কাঁঠাল বিচি দিয়া

ঘড়িতে নলিতার শাক                  কটু তৈলে বাথুয়া পাক

খন্ডে পেলে ফুলবড়ি ভাজিয়া।

-------------------------------------

ভাজা চিতলের কোল                  কাতলা মাছের ঝোল

মান বড়ি মরিচ ভূষিত।

পশ্চিম বাংলায় ২৩৯ প্রজাতির মিষ্টিজলের মাছ রয়েছে (Barman 2007) তবে এদের মধ্যে এমন কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে যারা সামুদ্রিক বা খাড়ির মাছ হলেও মিষ্টিজলে কিছুটা জীবন অতিবাহিত করতে আসে। যেমন ইলিশ, এরা মিষ্টি জলে আসে ডিম পাড়তে। আবার কয়েকটি প্রজাতির মাছকে অন্য ভৌগোলিক স্থান থেকে পশ্চিম বাংলায় আনা হয়েছে যেমন গ্রাস কার্প (Ctenopharyngodon idella), তেলাপিয়া (Oreochromis mossambicus, O. niloticus), সিলভার কার্প (Hypophthalmichthys molitrix), কমন কার্প (Cyprinus carpio carpio) ইত্যাদি। সবগুলিকে নিখুঁতভাবে চিহ্নিতকরণ সাধারণ মানুষের পক্ষে সকল সময়ে সম্ভব হয় না। যেমন Mystus menoda এবং M. tengara দুটিই ট্যাংরা বলে পরিচিত, আবার যেমন পুঁটি, কাঞ্চন পুঁটি, স্বর্ণ পুঁটি, তিত পুঁটি, গিল্লি পুঁটি সবই পুঁটি।

 

Category

বাংলা নাম

বিজ্ঞানসম্মত নাম

কার্প

রুই

Labeo rohita

কাতলা

Catla buchanani, C. catla

মৃগেল

Cirrhinus mrigala

কালবোস

Labeo calbasu

বার্ব

পুঁটি 

Puntius sophore

কাঞ্চন পুঁটি

Puntius conchonius

স্বর্ণ পুঁটি

Puntius sarana

তিত পুঁটি

Puntius ticto

গিল্লি পুঁটি

Puntius gelius

ক্যাটফিশ

পাবদা

Ompok pabda, O. bimaculatus, O. pabo

ট্যাংরা

Mystus menoda, M. tengara

গোলশা-ট্যাংরা

Mystus cavasius

শিঙ্গি

Heteropneustes fossilis

আড়

Osteogeneiosus militaris

বোয়ারি

Wallagonia attu

মাগুর

Clarias batrachus

পাঙ্গাস

Pangasius pangasius

গাগলা

Arius sp.

কান-মাগুর

Plotosus canius

হেরিং এবং শাদ

ইলিশ

Tenualosa ilisha or Hilsa lisha

ধলা

Ilishi clongate

খয়রা

Gonialosa manmina

ফেদারব্যাক

চিতল

Chitala chitala

ফলুই

Notopterus notopterus

জিয়ল

কই

Anabas cobojius, A. testudineus

পার্চ

ভেটকি

Lates calcarifer

ব্রিম

গুজ্জালী

Polynemus sp.

তোপসে

Polynemus paradiseus

ক্রকার্স

ভোলা

Barilius barna

গ্রে-মুলেট

পার্শে

Liza parsia

খারসুল/খরসুল

Mugil corsula

স্ক্যাবার্ড

রূপা পাইত্যা/ রূপা পাতিয়া

Trichiurus pantilui

পমফ্রেট

চাঁদা

Pseudambassis baculis, P. ranga

মুরেল

শোল

Channa striata

চিংড়ি*

গলদা চিংড়ি

Palaemon sp.

চিংড়ি

Penaeus carinatus, P. indicus

     * চিংড়ি মাছ নয়, এটি Arthropod পর্বভুক্ত

এছাড়াও রয়েছে মৌরলা (Amblypharyngodon microlepis, A. mola), বানলোটে (Bombay duck: Harpadon nehereus), আমুদি, বিভিন্ন ধরনের ট্যাংরা ইত্যাদি মাছ। চুনো মাছ বলে অনেকগুলি ছোট ছোট মাছ একসাথে কখনও বিক্রী হয় বাজারগুলিতে। পুষ্টিগত দিক থেকে এই সকল চুনো মাছগুলির পুষ্টিগুণ কিন্তু অপরিসীম। মাছ প্রোটিনের পাশাপাশি অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড ধারণ করে। প্রাণী থেকে প্রাপ্ত প্রোটিনের ১২.৮% আসে মাছ থেকে (Barik, 2017) মাছ খাওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায় আমাদের দেশে ক্যাপিটা প্রতি মাছ খাওয়ার পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি খুবই আশাব্যঞ্জক। এরফলে পুষ্টিসাধনের উপায় যেমন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে তেমনই জৈববৈচিত্রের উপর লক্ষ্য রাখা সম্ভব হবে (সাস্টেনেবল মাছ চাষ বা মাছ ধরার মাধ্যমে)

বর্মন (২০০৭)-র তথ্য অনুযায়ী ৫৯ টি মাছের প্রজাতি পশ্চিমবঙ্গে threatened যাদের মধ্যে ২২ টি প্রজাতি endangered এবং ৩৭টি vulnerable।  মাছের বাজারে গেলেই দেখা যায় কয়েকটি প্রজাতির মাছের আধিক্য থাকলেও অনেক মাছ আজকে প্রায় অমিল বা কম পাওয়া যায়। যেমন ট্যাপা (Tetraodon cutcutia), খয়রা (Gonialosa manmina), কাজুলি (Ailia coila), বাচা (Eutropiichthys vacha), মুড়ি বাচা (Eutropiichthys murius) ইত্যাদি খুব একটা চোখে পড়ে না। অন্যদিকে রুই, কাতলা, ভোলা ভেটকি, চিংড়ি,বর্ষায় ইলিশ, ইত্যাদির চাহিদা বেশ বেশি, কাজেই দামও বেশ বেশির দিকেই থাকে। খাদ্য তালিকায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাখুন সকল প্রকার মাছ। স্বাদের বৈচিত্রের পাশাপাশি জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য বজায় থাকবে। 


তথ্য সূত্র (References)

Barik, N.K. 2017. Freshwater fish for nutrition security in India: Evidence from FAO data. Aquaculture Reports 7: 106. https://doi.org/10.1016/j.aqrep.2017.04.001

Barman, R.P. 2007. A review of the freshwater fish fauna of West Bengal, India with suggestions for conservation of the threatened and endemic species. Records of Zoological Survey of India. Occasional paper no. 263, 1-48. 



রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...