সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
পূর্বের পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন পর্ব-১ পর্ব-২
বর্তমান পৃথিবীতে অন্যতম একটি সমস্যা হল 'মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ডেফিসিয়েন্সি' (Micro-nutrient deficiency), যা অনেক সময় 'হিডেন হাঙ্গার' (Hidden hunger) বলেও পরিচিত। পুষ্টির উপাদানগুলির দিকে যদি আমরা তাকাই, তবে দেখব কয়েকটি পুষ্টি উপাদান, যেমন শর্করা (Carbohydrate), স্নেহ পদার্থ (Fat), আমিষ জাতীয় পদার্থ (Protein), আমাদের শরীরে দৈনিক অধিক পরিমানে আবশ্যক বা প্রয়োজন, তাই এই উপাদানগুলিকে 'ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট' (Macro-nutrient) বলা হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকটি পুষ্টি উপাদান যথা খনিজ (Minerals) এবং ভিটামিন (Vitamins) স্বল্প পরিমানে আবশ্যক, তাই এগুলিকে 'মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট' বলা হয়ে থাকে। স্বল্প পরিমানে প্রয়োজন হলেও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা খনিজ পদার্থ (Minerals) এবং ভিটামিনগুলি অত্যন্ত আবশ্যক, অন্যথায় শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়ায় সমস্যা উৎপাদন হয়ে থাকে।। উদাহরণস্বরূপ, প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষ লোহার (Iron) স্বল্পতায় ভোগেন (McLean et al., 2009), আবার প্রায় ১.০২ বিলিয়ন মানুষ ভিটামিন A-র অভাবের শিকার (Akhtar et al., 2013)।
এই ‘হিডেন হাঙ্গার’ কে প্রতিরোধ করার অন্যতম একটি পথ হল আহারে শাকের ব্যবহার কারণ এর মধ্যে খনিজ, ভিটামিন উপযুক্ত পরিমানে বিদ্যমান এবং নানান কার্যকরী বৈশিষ্ট্যসম্পূর্ণ রাসায়নিক উপাদানও এর মধ্যে পাওয়া যায়। বাঙালির পাতে শাক নতুন নয়। কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আহারের বর্ণনায় শাকের উল্লেখ রয়েছে। কবি লিখেছেন:
"প্রথমে শুকুতা ঝোল দিল ঘন্ট
শাক
প্রশংসা করয়ে সাধু বেঞ্জনের
পাক।
ঘৃতে জবজব খায় মীন মাংস বড়ি
বাদ কর্যা খায় ভাজা কই দুই কুড়ি।
অম্বল খাইয়া পিঠা জল ঘটী ঘটী
দধি খায় ফেনি তায় শুনি মটমটী।"
আবার বিভিন্ন প্রকার শাক এবং তাদের রন্ধন প্রক্রিয়ারও উল্লেখ রয়েছে চন্ডীমঙ্গল কাব্যে:
"সাক তুলিতে দুয়া ফিরে বাড়ি বাড়ি
ক'খে করা নিল দুষা রঙ্গিন চুপড়ি।
নট্যা রাঙ্গা তোলে পাট পালঙ্গ-নলিতা
তিত পলতার পাতা ডগা তুলিল পলতা।
সাজ্যাতা পাজ্যাতা বন-পুই তুলে
বলা
হিনচা কলমী শাক তোলে ডানিকলা।
কড়্যা সাক তোলে দুয়া ফিরে খেতি খেত
মহরি সোলপা ধন্যা খিরপাই বেত।
বাড়ি বাড়ি ফিরে দুয়া দিয়া বাহুনাড়া
ডগী ডগী তোলে পুই পুনুকা কাঁচড়া।
কোমল কাঁকুড়ি-ডগা তুলিল করেলা
নাউডগা তোলে কিছু কচি কচি বলা।
বাছা ধুয়্যা শাক দুয়া করিল
সাঁচনা
লতা পাতা শাক আগে রন্ধিল লহনা।
রন্ধন করেন রামা করি বড় ত্বরা
ঘন্টে পুর্যা এড়ে রামা কুড়িয়া পাথরা।
ঘৃতে জবজব রান্ধে নলিতার শাক
কটু তৈলে বাথুয়া করিল দৃঢ় পাক।
রহিত কুমুড়া -বড়ি আলু দিয়া ঝোল
বদরী শকুল মীন আম্রে মুসুরি
পান দুই ভাজে রামা সরল সফরি।
পঞ্চাশ বেঞ্জন অন্ন করিল রন্ধন
থালায় ওদন বাটী ভরিয়া বেঞ্জন।
সাধ খান খুল্লনা নারীজন
অভয়ামঙ্গল গান শ্রীকবিকঙ্কন।"
কয়েক দশক পূর্বে খাদ্য তালিকার দিকে দৃষ্টিপাত করলে যে সকল আহার্য বস্তু দৃষ্টিগোচর হবে তা আজ আর হয়না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাঙালির শাক জাতীয় খাদ্যের তালিকাটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে, অনেক শাক-ই আজ হারিয়ে গেছে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম কালীপুজো, আর তার আগের দিনটিতে চোদ্দ প্রকারের শাক খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। কেন বা কিভাবে এই প্রচলন হলো, তা আমি বিশেষ জানিনা। তবে বেশ মনে পড়ে, ছোটবেলায় কখনও মামারবাড়ি গেলে দিদির সাথে ভোরবেলা যেতাম শাক তুলতে, যা সব শাক পাওয়া যায় গ্রামের ক্ষেতের পাশে, জলা জায়গায়, সবগুলো চিনতাম না। পরবর্তীকালে চোদ্দশাক কিনতে বাজারে গেলে লালশাক সহযোগে অনেকটা পাতা দিয়ে দিতে দেখেছি, এটাই এখন চোদ্দশাক বলে পরিচিত। কিন্তু একাধিকবার চোদ্দরকমের শাক বাজারে আলাদা আলাদা খোঁজ করে দেখেছি তা জোগাড় করা খুব সহজ নয়। বর্তমান বাজার পালং, পুঁই, লাল, এবং কিছু সময় লাউ, মুলো, পাট শাকেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কলমি, সাঞ্চে, বেতো, ঘেঁটু , শুশনি, হেলেঞ্চা ইত্যাদি ধীরে ধীরে সংকোচনের আওতায়, বিশেষত শহর বা শহরতলিতে, এসে পড়ছে। এই সংকোচন কিন্তু আমাদের পুষ্টিকেও সংকুচিত করছে। নিচের টেবিল-১ -এ দেখে নিই
প্রচলিত কয়েকটি শাক যা আমরা আমাদের আহারে ব্যবহার করে থাকি।
Table 1: বাংলায়
তথা ভারতবর্ষে খাদ্য সিহেবে ব্যবহৃত কতগুলি শাকের তালিকা
Table 2: বিভিন্ন প্রকার প্রচলিত শাকের খনিজের পরিমান (mg/100g) (Source: Longvah et al., 2017)
Table 3: বিভিন্ন প্রকার প্রচলিত শাকের
থেকে প্রাপ্ত ক্যারোটিন (Carotene) এবং ভিটামিনের (mg/100g; Vitamin B7, B9, Vitamin K1: µg/100g) পরিমান
বিটা ক্যারোটিন থেকে ভিটামিন-A সংশ্লেষিত হয়। কাজেই খাদ্যের মাধ্যমে বিটা ক্যারোটিন গ্রহণ ভিটামিন A-র অভাব দূরীকরণে সাহায্য করবে। বেশিরভাগ শাকের ক্ষেত্রে বিটা ক্যারোটিন বেশ অধিক পরিমানে পাওয়া যায় (Akhtar et al., 2012)। যেমন প্রতি ১০০ গ্রাম লাল শাকে ৮৪৫৭ মাইক্রোগ্রাম, বেথুয়া শাকে ১০৭৫ মাইক্রোগ্রাম, মেথি শাকে ৯২৪৫ মাইক্রোগ্রাম, কচু শাকে ৫৭৫৮ মাইক্রোগ্রাম, সরিষা শাকে ২৬১৯ মাইক্রোগ্রাম, কুমড়ো শাকে ১৪৫৫ মাইক্রোগ্রাম, মুলো শাকে ২৫৯১ মাইক্রোগ্রাম, পালং শাকে ২৬০৫ মাইক্রোগ্রাম বিটা ক্যারোটিন পাওয়া যায়। ক্যারোটিন আবার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Anti-oxidant) হিসেবেও কাজ করে। কাজেই শাক অধিক মাত্রায় ক্যারোটিন ধারণ করে বলে এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এক্টিভিটিও বেশ অধিক হয়, যা মানবদেহের জন্যে উপকারী।
অধিকাংশ শাকে, বিশেষত কচু শাক, পালং শাক, সরিষা শাক ইত্যাদিতে ভিটামিন B9-র পরিমান অধিক হয়ে থাকে। ভিটামিন B9 ফলিক অ্যাসিড বা ফোলেট নামে পরিচিত। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান। লোহিত রক্ত কণিকা (Red blood corpuscle) নির্মাণে এবং এর ফল অনুসারে এনিমিয়া (Anemia) প্রতিরোধ করতে ফোলেটের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও DNA সংশ্লেষণে (DNA synthesis) এবং মেরামতে (DNA repair) ফোলেট প্রয়োজনীয়। ফোলেটের অভাবে নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (Neural tube defect) হয়ে থাকে। ফ্যাট মেটাবলিসম (Fat metabolsim)-র ক্ষেত্রেও ফোলেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ওবেসিটি (Obesity) কমাতে এর গুরুত্ব রয়েছে (da Silva et al., 2014)। অস্টিওব্লাস্ট (Osteoblast/হাড় গঠনে প্রয়োজনীয় কোষ) এবং অস্টিওক্যালসিন (Osteocalcin/নন-কোলজিনীয় প্রোটিন হরমোন) মেটাবোলিজমে ভিটামিন K1-র গুরুত্ব অনেক। যেহেতু শাক অধিক পরিমানে ভিটামিন K1 ধারণ করে তাই শাক খেলে হাড় গঠনের উন্নতি হয় (Sim et al., 2020)। আবার ক্যালসিয়ামের পরিমানও শাকে অধিক থাকে যা মানবদেহের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী।
কাজেই এই ছোট একটি আলোচনার মাধ্যমে বোঝা গেল শাকের গুরুত্ব। প্রতিদিন আহারের পাতে শাক অবশ্যই থাকুক, এর ফলে আবশ্যক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলি যেমন শরীরে প্রবেশ করবে তেমনই চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে এই উন্নত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন শাকগুলি অমিল বা অবলুপ্ত হয়ে যাবে না।
তথ্য সহায়তা (References)
Akhtar, S.; Ahmed, A.; Randhawa, M.A.; Atukorala, S.; Arlappa, N.; Ismail, T.; Ali, Z. 2013. Prevalence of vitamin A deficiency in South Asia: causes, outcomes, and possible remedies. Journal of Health Population and Nutrition 31(4), 413-423. https://doi.org/10.3329/jhpn.v31i4.19975
Akhtar, S.; Karak, C.; Biswas, P.; Chattopadhyay, A.; Hazra, P. 2012. Indigenous leafy vegetable: A potential source of β-carotene and ascorbic acid. International Journal of Vegetable Science 18(4), 370-375. https://doi.org/10.1080/19315260.2011.649163
da Silva, R.P.; Kelly, K.B.; Rajabi, A.A.; Jacobs, R.L. 2014. Novel insights on interactions between folate and lipid metabolism. Biofactors 40(3), 277-283. https://doi.org/10.1002/biof.1154
Konsam, S.; Thongam, B.; Handique, A.K. 2016. Assessment of wild leafy vegetables traditionally consumed by the ethnic communities of Manipur, northeast India. Journal of Ethnobiology and Ethnomedicine 12, 9. https://doi.org/10.1186/s13002-016-0080-4
Longvah, T.; Ananthan, R.; Bhaskaracharya, K.; Venkaiah, K. 2017. Indian Food Composition Tables. National Institute of Nutrition (Indian Council of Medical Research), Hyderabad, India.
McLean, E.; Cogswell, M.; Egil, I.; Wojdyla, D.; de Benoist, B. 2009. Worldwide prevalence of anaemia, WHO vitamin and mineral nutrition information system, 1993-2005. Public Health Nutrition 12(4), 444-454. https://doi.org/10.1017/S1368980008002401
Mishra, S.; Maikhuri, R.K.; Kala, C.P.; Rao, K.S.; Saxena, K.G. 2008. Wild leafy vegetables: A study of their subsistence dietetic support to the inhabitants of Nanda Devi Biosphere Reserve, India. Journal of Ethnobiology and Ethnomedicine 4, 15. https://doi.org/10.1186/1746-4269-4-15
Sim, M.; Lewis, J.R.; Prince, R.L.; Levinger, I. et al. 2020. The effect of vitamin K-rich green leafy vegetables on bone metabolism: A 4-week randomised controlled trial in middle-aged and older individuals. Bone Reports 12, 100271. https://doi.org/10.1016/j.bonr.2020.100274
Timoshnikov, V.A.; Kobzeva, T.V.; Polyakov, N.E.; Kontoghiorghes, G.J. 2020. Redox interactions of vitamin C and iron: inhibition of the Pro-Oxidant activity by Deferiprone. International Journal of Molecular Science 21(11), 3367. http://doi.org/10.3390/ijms21113967




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন