সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
আমরা আমাদের খাদ্যের দিকে একটু তাকাই, দেখবো খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে, তা ব্যবহার হচ্ছে এবং অব্যবহৃত অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা সরলরেখার ন্যায় (Linear economy)। উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste)। কিন্তু এই যে অংশটি ব্যবহার হচ্ছে না, তা উৎপাদন করতেও তো পয়সা লেগেছে। শুধু যে পয়সা লেগেছে, এমনটা নয়, জমি লেগেছে, জল লেগেছে, সার লেগেছে, আবার সেই অতিরিক্ত সার পরিবেশের উপর ঋণাত্মক প্রভাবও ফেলেছে - এ সকলই তো বৃথা গেলো, কোনো উপকার তো হলোই না, বরং অপকার হলো। কাজেই, এই উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste) মডেলটি কার্যকরী হচ্ছে না। তবে কি করতে হবে? এই সরলরৈখিক সম্পর্কটিকে বৃত্তাকার সম্পর্কে (Circular economy) পরিণত করতে হবে। অর্থাৎ কিছু নষ্ট করা চলবে না, পুনর্ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য দিতে হবে। এই বৃত্তের তিনটি অংশ, যথা- সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী উৎপাদন (Sustainable production), সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী ব্যবহার (Sustainable use), এবং পুনর্ব্যবহার (Recycle)।
সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী উৎপাদন হলো এমন এক উৎপাদন পদ্ধতি যাতে প্রকৃতির উপর অধিক চাপ পড়বে না, প্রাকৃতিক সম্পদের (ভূমি, জল ইত্যাদি) অতিরিক্ত শোষণ হবে না, আবার অতিরিক্ত মাত্রায় ইনপুট (রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হার্বিসাইড ইত্যাদি) প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করবে না। এর প্রধান উপাদান হলো সাস্টেনেবল কৃষি অনুশীলন, যেমন অর্গানিক ফার্মিং, অ্যাগ্রোফরেষ্ট্রী, ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (Integrated Pest Management), উপযোগী সেচ ব্যবস্থা, বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি, অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার না করা ইত্যাদির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা (অনুগ্রহ করে পড়ুন বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা)। একথা সঠিক যে, এর জন্যে গবেষণা এবং পরিকাঠামোর প্রয়োজন। পেস্ট কীটের জীবন চক্র পর্যালোচনা করে, যাকে ফেনোলজি বলা হয়, কোন সময়ে আধিক্য হবে তা সহজেই নিরূপণ করা যায় এবং রাসায়নিকের উপযুক্ত মাত্রা নির্ধারণ করাও কঠিন নয়, কাজেই এর মাধ্যমে অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সহজেই হ্রাস করা যায়, এবং প্রকৃতির উপর এর কুপ্রভাবগুলিকে এড়ানো সম্ভব। আজ অনেক অঞ্চলে অতিরিক্ত সারের ব্যবহারের ফলে মৃত্তিকার অবনমন ঘটেছে, এরূপ ঘটতে থাকলে ভবিষ্যতের খাদ্য উৎপাদন প্রশ্নের সামনে পড়বে। কৃষিক্ষেতে যেমন জলের প্রয়োজন, ঠিক তেমনই অতিরিক্ত জল অপ্রয়োজনীয়। তাই যতটুকু জল প্রয়োজন ঠিক ততটুকু জলই ব্যবহার করা উচিত, এই কারণে উন্নত সেচের ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন, এতে ফলনের কোনো ঘাটতি হবে না আবার জলের অপচয়ও বন্ধ হবে। এই সকল কার্যসাধনের জন্যে নীতি (Policy) নির্ধারণ প্রয়োজন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন কৃষি নীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় এই বিষয়ে আমাদের দেশ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীতি প্রণয়ন করেছে যার মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চাই যোজনা, ক্ষুদ্র সেচ তহবিল গঠন ইত্যাদি।
আরবান কৃষি (Urban agriculture) একটি খুবই উপযোগী পদ্ধতি, এর মাধ্যমে খাদ্য তথা পুষ্টি নিশ্চয়তা যেমন একাধারে বৃদ্ধি পায় তেমনই পরিবেশের কার্বন সিকোয়েস্ট্রেট (Carbon sequestrate) করতেও গাছগুলি সাহায্য করে। সাস্টেনেবল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন। কৃষক কোঅপারেটিভ গড়ে তুলে কিংবা কমিউনিটি সমর্থিত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলে সাস্টেনেবল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
এর পর আসি সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী ব্যবহারে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এক্ষেত্রে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে আর সব কিছুর সাথে সাথে খাদ্যেরও বিশ্বায়ন হয়েছে, যদিও আমাদের খাদ্য তালিকায় যেরূপ পিজ্জা বা বার্গার প্রবেশ করেছে সেরূপ বিদেশে কোনো স্থানে আমাদের খিচুড়ি, বা নলেন গুড় পরিবেশিত হতে আমি দেখিনি (অনুগ্রহ করে পড়ুন আমাদের খাদ্যের পশ্চিমায়ন)। যাইহোক, সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। এখন ক্রেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুষম আহার বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ অবহিত হয়েছেন বা ধীরে ধীরে অবহিত হচ্ছেন। যদিও এর গতি আরও একটু বৃদ্ধি পেলে ভালো হয়। খাদ্যে সকল প্রকার নিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতি নিয়ে মানুষ সচেতন হলে খাদ্যের বৈচিত্র্য বাড়বে, যা প্রকারান্তরে পুষ্টির নিশ্চয়তাকে বৃদ্ধি তো করবেই এবং জীব বৈচিত্র্যকেও সমর্থন করবে। আজ ক্রেতারা অনেক বেশি সচেতন সে কথা পূর্বেই বলেছি, এই সচেতনতা যে কেবল মাত্র খাদ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে তা নয়, খাদ্যটি কিরূপে উৎপন্ন হয়েছে সেটি নিয়েও সচেতনতা রয়েছে। আজকাল আমরা প্রায়ই বিভিন্ন প্রোডাক্টের লেবেলে 'অর্গানিক' কথাটি লিখে থাকতে দেখি, অনেকে একটু দাম বেশি হলেও সেটি ক্রয় করেন কারণ খাদ্যটির মধ্যে রাসায়নিক দূষণ যেমন তাঁরা পছন্দ করেন না তেমন পরিবেশের দূষণও সচেতন মানুষ পছন্দ করছেন না। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ক্রেতাদের সচেতনতার পাশাপাশি কিন্তু বিক্রেতাদেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমি যখন আমার দেশে বাজার করতে যাই প্রয়োজন মতন শাক-সব্জি কিনতে পারি, কোনোটা সাড়ে সাতশো গ্রাম, কোনটা দেড় কেজি, আবার কোনটা দেড়শো গ্রাম; অর্থাৎ যেটা যতটা লাগে। কিন্তু আমি যখন অন্য একটি উন্নত দেশে বিশাল এক শপিং মার্টে বাজার করার জন্যে উপস্থিত হই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিক্রেতার হিসেবে পূর্ব নির্ধারিত ওজনের দ্রব্যই কিন্তু আমাকে কিনতে হয়, নিজের প্রয়োজন মতন নয়। এতে কোনো দ্রব্য হয়তো ৫০০ গ্রাম প্রয়োজন কিন্তু আমি ১ কেজি নিয়েছি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ব্যবহার না হাওয়ায় সেটি পচে নষ্ট হয়েছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের মতন দেশগুলির খাদ্যদ্রব্য যেটুকু নষ্ট হয় তার অধিকাংশ হয় ফসল তোলার সময়ে। দেশের বাড়িতে বেগুনে পোকা পাওয়া যায় বৈকি, তবে সব্জি ঘরে থেকে পচে যায়না, কারণ বাজার প্রয়োজন অনুযায়ী করা হয়। কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে ফসল তোলার সময়ে নষ্ট হয় না, তা মূলত নষ্ট হয় এইভাবে।
কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যে একটি বৃত্তাকার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য হ্রাস পরিবেশের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে পুনর্ব্যবহার করার একটি উদাহরণ হল অন্যান্য প্রক্রিয়ার জন্য মূল্যবান ইনপুট তৈরি করতে কৃষি উপ-পণ্যের ব্যবহার। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, শস্য সংগ্রহ থেকে অবশিষ্ট উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ, যেমন ডালপালা এবং পাতা, কম্পোস্টিং এর মাধ্যমে জৈব সার তৈরি করার জন্য পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি শুধুমাত্র ল্যান্ডফিল থেকে এই উপাদানগুলিকে সরিয়ে দেয় না তবে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলিকে মাটিতে ফিরিয়ে দিয়ে পুষ্টির ঘাটতি বন্ধ করে দেয়। ফলস্বরূপ, এটি স্বাস্থ্যকর এবং আরও উর্বর কৃষি জমিকে উন্নীত করে, কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্থায়ী এবং বৃত্তাকার পদ্ধতির সমর্থন করে। এই ধরনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য অনুশীলনগুলিকে বৃদ্ধি করে, শিল্প পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস, সম্পদ সংরক্ষণ এবং আরও স্থিতিস্থাপক এবং সুস্থায়ী খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরিতে অবদান রাখতে পারে।
