পৃষ্ঠাসমূহ

বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য (Ecosystem services and Foods)

সম্পত ঘোষ  (Sampat Ghosh)

'আঃ বড্ড দাম নিচ্ছ, তরকারীতে তো হাত দেওয়ার উপায় নেই গো'খদ্দেরের অভিযোগ শুনে বিক্রেতা একগাল হেসে, 'আমরাও তো দাম দিয়ে কিনে আনি বাবু, কতটুকু আর লাভ থাকে! তবে মাল আমার এখানে এক্কেবারে টাটকা' এই বলে প্রয়োজনীয় সব্জিগুলি খদ্দেরকে গুছিয়ে দিয়ে দেয়। খদ্দেরবাবু মনে মনে একটু খুশি হয়, অতিরিক্ত দামের জন্যে মনের মধ্যে যে ক্ষতটা সৃষ্টি হচ্ছিলো, টাটকা সব্জি কিনতে পেরে সেই ক্ষতে মলম পড়ে।

এই যে খাবারগুলি প্রত্যহ আমরা খাই, তা উৎপাদন করতে আমাদের একটা খরচ হয়, যেমন ধরা যাক চারা বা বীজ কিনে আনা, রোপন করা, উপযুক্ত পরিমানে জল (সেচের মাধ্যমে বা ভূগর্ভস্থ জল তুলে), সার (পরিপূরক হিসেবে), কীটনাশক (প্রয়োজন অনুযায়ী) সরবারহ করা, ফসল তোলা, এবং বাজারজাত করা; প্রত্যেকটি ধাপে কিন্তু খরচ হয় আর এই সমগ্র খরচের উপর বিক্রয়মূল্য নির্ভর করে। মনে রাখা প্রয়োজন, এখানে কিন্তু প্রকৃতি আমাদের থেকে কোনো দাম নেয় না। একটু সহজ ভাষায় বলি, এই যে কৃষি বাস্তুতন্ত্রটি (Agro-ecosystem) প্রকৃতি প্রদান করছে, যেমন ভূগর্ভস্থ বা পৃষ্ঠদেশের জলভাণ্ডার, মাটি যেখানে পুষ্টি উপাদানগুলি রয়েছে যা উদ্ভিদকে জীবনধারণে সাহায্য করে, পরাগবহনকারী প্রাণী (Pollinators) বিশেষত পতঙ্গ (Insects) যা পরাগ সংযোগের জন্যে অপরিহার্য, সেই সকল প্রাণী (যারা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল (Biological control) বলে পরিচিত) যারা শস্যের জন্যে ক্ষতিকারক পতঙ্গগুলিকে ধ্বংস করে; এই তাবৎ সেবা কিন্তু বিনামূল্যেই (বাজার অর্থনীতির বাইরে) প্রাপ্ত হচ্ছে। যদি প্রকৃতি এর জন্যে বাজারমূল্য ধার্য করতো তবে কি হতো একবার ভেবে দেখো !  

এই প্রকার বিভিন্ন সেবা আমরা প্রকৃতি থেকে পেয়ে থাকি। হয়তো বিনামূল্যে পাই বলেই গুরুত্ব আরোপে বিলম্ব হয়। পঁচিশ বৎসর পূর্বে রবার্ট কনস্টানজা (Robert Constanza) তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন যে বাস্তুতন্ত্র যে সকল সুবিধা মানুষকে প্রদান করে তার বাজারমূল্য বার্ষিক প্রায় ৩৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য (Constanza et al. 1997)এর মধ্যে খাদ্য উৎপাদনের জন্যে ক্রপল্যান্ড (Cropland) বাস্তুতন্ত্রটি যে সেবা প্রদান করে তার মূল্য পৃথিবীব্যাপী বার্ষিক ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য (Constanza et al. 1997)কাজেই সহজেই বোধগম্য হয় যে এই মূল্য যদি মানুষকে বাজারমূল্যের ন্যায় চোকাতে হতো তবে খাদ্যের দাম কিরূপ হতো !  

[পরবর্তী কোনো ব্লগে আমি বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করবো।]

অতএব প্রকৃতির কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। মনে রাখা দরকার এই সকল সেবা ব্যতীত শস্য উৎপাদন কিন্তু অসম্ভব আর প্রকৃতি এইসকল সুবিধা প্রদান করবে যতদিন মানুষ প্রকৃতিকে তার ধারণক্ষমতার (Sustainability) মধ্যে থাকতে দেবে। এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কিরূপে সম্ভব? আমাদের প্রকৃতির ধারণক্ষমতাকে বুঝতে হবে, সেই ধারণক্ষমতা বিঘ্নিত হয় এহেন কার্যের থেকে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন। 

প্রথমেই আমাদের মৃত্তিকার কথা মনে আসে কারন মাটিতেই আমাদের খাদ্যের সিংহ ভাগ উৎপন্ন হয়ে থাকে। মাটিতে যে জীব বৈচিত্র থাকে, ব্যাকটেরিয়া থেকে কেঁচো, এরা মাটিকে সতেজ এবং উর্বর রাখে। মৃত্তিকার প্রধান কয়েকটি উল্লেখ্য সেবা হলো, মাটি বিভিন্ন পুষ্টিউপাদান বিশেষত খনিজ ধারণ করে যা উদ্ভিদকে জীবনধারণ করতে সাহায্য করে, মাটি  জল পরিশ্রুত করে, বন্যা এবং খরা প্রতিরোধ করে, এমনকি কার্বণকে সঞ্চিত রেখে জলবায়ু পরিবর্তনকে রোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। মাটিতে উপস্থিত অণুজীব (Microbes) পচন (Decompose) তথা রিসাইকেল (Recycle) প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, এরা গুরুত্বপূর্ণ এন্টিবায়োটিকের উৎসও বটে।। দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বব্যাপী মাটির বা ভূমির অধঃপতিত (Degrade) হওয়ার হিসাব প্রায় ১ থেকে ৬ বিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে (Gibbs and Salmon, 2015; Global Land Outlook by United Nations 2017), বিভিন্ন কারণ যথা নগরায়ন, খনি, শক্তি উৎপাদন ইত্যাদির সাথে মূলত বর্তমান নিবিড় চাষ (Intensive agriculture) পদ্ধতি ভূমির অধঃপতনের জন্যে অনেকাংশে দায়ী। 

জলের সংকট বর্তমান সময়ের একটি চ্যালেঞ্জ। যত জল আমরা তুলে থাকি তার প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে। ফসলের মধ্যে ডাল জাতীয় শস্যের জন্য জল তুলনামূলক কম পরিমানে লাগে, তাও ১ কিলোগ্রাম মশুর ডাল উৎপাদনের জন্যে প্রায় ১২৫০ লিটার জল ব্যবহৃত হয়, আর ১ কিলোগ্রাম বিফের জন্যে লাগে প্রায় ১৩০০০ লিটার জল (FAO)। কাজেই ভেবে দেখা যায় কি পরিমান জল খাদ্য উৎপাদনের জন্যে লাগে ! আবার চাষের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিকের দ্বারা অনেক সময়েই এই জল দূষিত হয় এবং সম্পর্কিত অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রগুলিকেও প্রভাবিত করে থাকে। মনে রাখা দরকার বর্তমানে বিপুল জনসংখ্যা, প্রায় ২.২. বিলিয়ন মানুষ পরিশুদ্ধ পানীয় জলে থেকে বঞ্চিত।তাহলে বোঝা গেলো, এই জলের ব্যবহার এবং সংরক্ষণের বিষয়েও যত্নবান হতে হবে।

আবার বিভিন্ন গবেষণায় পরাগবহনকারী পতঙ্গদের, বিশেষত মৌমাছিদের, স্বাস্থ্য, সংখ্যা এবং বিস্তারের যে চিত্র উঠে আসছে তাও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রায় এক তৃতীয়াংশ খাদ্য উৎপাদন (প্রায় ৭০ টি ফসল/ শস্য) পরাগবহনকারী পতঙ্গদের উপর নির্ভরশীল, যদি এই উপকারী বন্ধু পতঙ্গগুলির সংখ্যা হ্রাস পায় তবে নিঃসন্দেহে তা ফলনের উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে এবং খাদ্য তথা পুষ্টি নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে (Eilers et al., 2011; Smith et al., 2015; Ghosh and Jung, 2018) এই হ্রাস পাওয়ার পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান, যথা, পরাগবাহক পতঙ্গদের বাসস্থান ধ্বংস, ল্যান্ডস্ক্যাপের (Landscape) পরিবর্তন, নিবিড় চাষের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি মনোক্রপিং (Mono-cropping), অতিরিক্ত পরিমান কীটনাশকের (Insecticides) ব্যবহার, উপযুক্ত পুষ্টির অভাব, বিভিন্ন পেস্ট (Pest) এবং প্যাথোজেনের (Pathogen) বৃদ্ধি, এবং অবশ্যই জলবায়ুর পরিবর্তন (Climate change) ইত্যাদি। ঠিক কতটা ক্ষতি হতে পারে তা নিরুপন করা সম্ভব, বিশ্বব্যাপী চিত্রের পাশাপাশি রাষ্ট্র বা অঞ্চল ভিত্তিক চিত্রও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ 

অতএব এই সকল অধঃপতন বা অবনমন (Degradation) প্রতিরোধ করা একান্ত প্রয়োজন, অন্যথা মানবসভ্যতা বিপর্যয়ের সামনে এসে পড়তে পারে। মানুষ বিষয়গুলি অনুধাবন করেছে এবং প্রতিটি বিষয়েই যত্নবান হয়েছে, তবে আরও অনেকটা এগোনো প্রয়োজন। 

তথ্যসূত্র (Reference):

Costanza, R.; d'Arge, R.; de Groot, R.; Farber, S.; Grasso, M.; Hannon, B.; Limburg, K.; Naeem, S.; O'Neill, R.V.; Paruelo, J.; Raskin, R.G.; Sutton, P.; van den Belt, M. 1997. The value of the world's ecosystem services and natural capital. Nature 387, 253–260. https://doi.org/10.1038/387253a0

FAO (Food and Agriculture Organization of the United Nations), Water scarcity- One of the greatest challenges of our time.  https://www.fao.org/fao-stories/article/en/c/1185405/ (accessed on 23rd March 2023)

Ghosh, S.; Jung, C. 2018. Contribution of insect pollination to nutritional security of minerals and vitamins in Korea. Journal of Asia-Pacific Entomology 21, 598-602. https://doi.org/10.1016/j.aspen.2018.03.014 

Eilers, E.J.; Kremen, C.; Smith Greenleaf, S.; Garber, A.K., Klein, A-M. 2011. Contribution of Pollinator-Mediated Crops to Nutrients in the Human Food Supply. PLoS ONE 6, e21363. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0021363

Gibbs, H.K.; Salmon, J.M. 2015. Mapping the world's degraded lands. Applied Geography 57, 12-21. https://doi.org/10.1016/j.apgeog.2014.11.024 

Global Land Outlook, First Edition, United Nations Convention to Combat Desertification, 2017. Bonn, Germany.

Smith, M.R.; Singh, G.M.; Mozaffarian, D.; Myers, S. 2015. Effects of decreases of animal pollinators on human nutrition and global health: a modeling analysis. Lancet 386: 1964-1972. https://dx.doi.org/10.1016/S0140-6736(15)61085-6 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...