সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
সকাল ন'টায় কলকাতা স্টেশন থেকে রওনা হয়ে ১২৩৬৩ কলকাতা-হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট সঠিক সময় বিকাল ৩টে-তে মালদা টাউন পৌঁছলো। আর আমরা এসে পৌঁছলাম অতীতের মহানগর গৌড়ে। ১ নম্বর প্লাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে পাওয়া যায় টোটো, সেই বাহনই আমাদের পৌঁছে দিলো হোটেলে। রেলওয়ে স্টেশন থেকে যে রাস্তাটি রথবাড়ি মোড়ের দিকে চলে যাচ্ছে, সেই রাস্তার উপরেই হোটেল। রেলগাড়িতে ঝালমুড়ি, পেয়ারা মাখা (বেশ কয়েক বৎসর হলো বিভিন্ন ফল মেখে বিক্রয় করার প্রচলন হয়েছে। পূর্বে, আমার ছোটবেলায়, সাধারণত দোকানী পেয়ারা কেটে তাতে নুন, কখনও বিট নুন, দিয়ে ঠোঙায় করে দিতেন। এখন দেখি, পেয়ারা কেটে তাতে কাসুন্দি, নুন, বিট নুন, লঙ্কার গুঁড়ো ইত্যাদি দিয়ে মেখে কাগজের প্লেটে করে দেয়। খেতে ভালোই লাগে, তবে অন্যান্য উপকরণের প্রাধান্যে পেয়ারার স্বাদের গুরুত্ব কমে যায়।), চা, কেক ইত্যাদি টুকিটাকি খাওয়া চললেও দুপুরের খাওয়া হয়নি, কাজেই হোটেলে পৌঁছে প্রথম গন্তব্য হোটেলের রেস্তোরাঁ। খাওয়া-দাওয়া সারার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা শহরটা একটু ঘুরতে বেরোলাম। মালদা ভ্রমণ আমাদের এই প্রথম, এমনিতে কর্মব্যস্ততার কারণে খুব একটা ঘোরা হয়ে ওঠেনা আমার, যা ঘোরা সম্ভব হয় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্মসূত্রে। আমাদের হোটেলটির নিকটে রয়েছে একাধিক আধুনিক রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, হোটেল, ব্যাঙ্কের এটিএম, মন্দির, দোকান-বাজার; সব মিলিয়ে বেশ শহর, তবে কোলাহল কিছুটা কম। এদিকটা ঘুরে এবার চললাম রথবাড়ি মোড়ের উদ্দেশ্যে। এটি মালদা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, কলকাতা থেকে শিলিগুড়ির বাসগুলি এই মোড় হয়েই যায়। এখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার বাস বা গাড়ি ছাড়ে, এমনকি শহরটির দর্শনীয়স্থানগুলি ঘোরার জন্যে এখন থেকেই গাড়ি রিসার্ভ করা যায়। হাঁকডাক, কোলাহল, মানুষের ব্যস্ততা সব মিলিয়ে স্থানটি নিজের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে। বাঙালী জীবনে চা একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমরা সাধারণত দিনে অল্প অল্প পরিমানে অনেক বার চা খাই। বর্তমানে সেই চায়ের আবার বিভিন্ন রূপ, কেউ খান দুধ-চিনি সহযোগে, কেউ দুধ ছাড়া চিনি দিয়ে, কেউ দুধ দিয়ে চিনি ছাড়া, আবার কেউ দুধ এবং চিনি উভয় উপকরণই বর্জন করে শুধু চা। দোকানী কিন্তু বেশ মনে রেখে চা তৈরী করে পরিবেশন করে যান। কোলাহল প্রিয় আমাদের আনন্দটা আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিলো এক কাপ চা, ভালো লাগলে আরও এক কাপ।
জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহ, এখনও বেশ ঠান্ডা রয়েছে এখানে। এ বৎসর পশ্চিমবঙ্গে ঠান্ডাটা বেশ জমিয়ে পড়েছে, এটা উপভোগ্য। গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে শীত আমার কাছে অনেক প্রিয়। ছোটবেলায় কোনো এক ছোটদের পত্রিকায় কুয়াশার মধ্যে দিয়ে খেঁজুরের রসের বাঁক হাতে ক্ষেতের আল বেয়ে এক ব্যক্তি আসছেন আর এক দোকানী গ্রাম্য রাস্তার ধারে উনুন ধরিয়ে চা তৈরীর আয়োজন করছেন- এরূপ একটি চিত্র দেখেছিলাম। এই ছবিটি এখনও আমার মনে গেঁথে রয়েছে এবং আমার প্রিয় শীতকালের রূপ আজও ওই ছবিটির আধারেই আধারিত। আর শুধু কি তাই ! পৌষ পার্বনের পিঠে-পুলি, জয়নগরের মোয়া, পাটালি গুড়, পিকনিক, চিড়িয়াখানা ঘোরা, ভোরবেলা কাঁপতে কাঁপতে স্নান করে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি দেওয়া কি ছিল না ছোটবেলার শীতকালে। তবে ধূলোর প্রকোপ দেখলাম বেশ বেড়েছে, কুয়াশার সাথে মিশে স্মগ তৈরী করছে। দূষণের মাত্রা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের একটা ধারণা রয়েছে যে গ্রামে বোধহয় শহরের মতন দূষণের প্রকোপ নেই, কিন্তু বাস্তবে তা মনে হলো না, এই ভ্রমণের সময় সর্বত্রই, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে দূষণের চিত্রটা একই রকম দেখলাম। এটা নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত প্রয়োজনীয় বলেই মনে হয়, অন্যথায় মানুষের জীবনে এর নেতিবাচক পরিনাম পড়বে এবং তা নিয়ন্ত্রণ যে সহজ হবে না তা বলাই বাহুল্য।
রথবাড়ি থেকে হোটেলে ফিরে স্নান সেরে দেখি আমার বড়ো পিসির এক আত্মীয় আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন, আমার সাথে প্রথম পরিচয়, পূর্বে কখনও পরিচয় হয়েছে তা মনে পড়ে না। এঁরা মালদা-র বাসিন্দা, আমাদের জন্যে এখানকার আম-কাসুন্দির আচার নিয়ে এসেছিলেন। সেই আচারের বোতলটি আমরা ফেরার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছি। এখন যখন এই ভ্রমণ কাহিনীটি লিখছি, সেই আঁচারের স্বাদ আমি গ্রহণ করেছি, অপূর্ব স্বাদ। পরবর্তী ব্লগে মালদার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলির ভ্রমণের বর্ণনা করার চেষ্টা করবো।
সপ্তাহান্তে বা ছোট কোনো ছুটিতে ঐতিহাসিক স্থান মালদা ঘুরে আসা যেতে পারে।
জানুয়ারী, ২০২৪

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন