সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
যখন হরিদ্বার পৌঁছলাম ‘হর কি পাউরি’ ঘাটে সন্ধ্যারতি শুরু হয়ে গিয়েছে। ব্রহ্মকুণ্ডের সামনে প্রথমে মাতা গঙ্গার বন্দনা আর তারপর পুরোহিতগণ নদীমাতৃকার উদ্দেশ্যে আরতি করেন, অগণিত ভক্ত সেই মঙ্গলারতি দর্শন করে নিজেদের ধন্য মনে করেন। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় সমুদ্র মন্থনের সময় উত্থিত অমৃত যখন গরুড় আকাশপথে নিয়ে যাচ্ছিলেন সেখান থেকে কিছুটা অমৃত এই স্থানে পড়ে যায় এবং এই স্থানের নাম হয় ব্রহ্মকুণ্ড। কৃষিপ্রধান এই দেশে গঙ্গা যে সত্যিই মাতৃরূপ তাতে সন্দেহর কোন অবকাশ নেই। গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ থেকে উৎপন্ন ভাগীরথী আর নন্দাদেবী, ত্রিশূল এবং কামেত পর্বতের হিমবাহ থেকে উৎপন্ন অলকানন্দা দেবপ্রয়াগে একত্রিত হয়ে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পথ হিমালয়ের সংকীর্ণ গিরিখাতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়ে হৃষীকেশ এবং অতঃপর হরিদ্বারে এসে সমতলে পড়েছে, তাই এই স্থানের নাম ছিল গঙ্গাদ্বার, পৌরাণিক কাহিনীগুলোতেও এই নামেই স্থানটি পরিচিত। তবে ১৮৪০ সালে বাঁধ দিয়ে গঙ্গাপ্রবাহকে কয়েকটি ভাগে (ক্যানাল) বিভক্ত করা হয়ে থাকে, মূলত কৃষিকাজের উন্নতিসাধন হেতু এই বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। এখন বর্ষাকাল, তাই গঙ্গার জল বেশ ঘোলাটে, বৃষ্টিপাতের দরুন উচ্চ অববাহিকার মাটি গুলে নদীর জল ঘোলাটে, তবে বছরের অন্যান্য সময়ে বেশ পরিষ্কার থাকে। সন্ধ্যারতির শেষ পর্যায় থেকে মানুষ নিজেদের মনোবাঞ্ছাপূরণের উদ্দেশ্যে নদীবক্ষে প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীর স্রোতে তা ভাসিয়ে দেন, বিশ্বাস প্রদীপটি যতদূর না নিভে বয়ে যাবে ততই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে, এমনই প্রচলিত লোকবিশ্বাস। শালের পাতায় পদ্ম সহযোগে বিভিন্ন ফুল আর একটি প্রদীপ।
ঘুম ভাঙ্ল বেশ ভোরে, ঘড়িতে তখন প্রায় ৬ টা। কিছুক্ষণ
বিছানায় গড়িয়ে, একটু ফ্রেশ হয়ে চা খেতে বেরলাম প্রায় ৭ টা নাগাদ। আজ যাব হৃষীকেশ।
এখান থেকে হৃষীকেশের দুরত্ব প্রায় ১৯ কিলোমিটার। প্রথমে ঠিক করেছিলাম উত্তরাখণ্ড
পরিবহনের বাসেই যাব তবে বেড়িয়ে একটি ‘বিক্রম’ (অটো) ভাড়া করে নিলাম, দাম নিল ৮২০
টাকা। সাধারণত পর্যটকরা গাড়ি ভাড়া করেই ঘোরেন, সেক্ষেত্রে দাম পরে প্রায় ১৫০০
টাকা। রাজাজী ন্যাশনাল পার্ক এবং টাইগার রিসার্ভ
পার করে চললাম হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে, পথে পড়ল স্বামী বিবেকানন্দ উদ্যান, শ্রী তিরুপতি
মন্দির, আশ্রম, বেশ কয়েকটি হোটেল। স্কন্দ পুরাণ অনুসারে হৃষীকেশের নাম
‘কুব্জাম্রক’, স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস ভগবান বিষ্ণু এখানে একটি আম গাছের নীচে
অবতীর্ণ হন। আবার এই স্থান ‘অগ্নি তীর্থ’ নামেও পরিচিত, প্রচলিত ধারণা ভগবান শিব
অগ্নি্দেবকে ক্রোধান্বিত হয়ে অভিশাপ দেওয়ার পর এই স্থানেই অগ্নিদেব শাপ মুক্তির
জন্যে ভগবান শিবের উপাসনা করেন। বেশ ঘিঞ্জি শহর হৃষীকেশ, বিক্রম থামল রাম ঝোলার
কাছে ওদের সংগঠনের অফিসের সামনে, ওখানে ৮২০ টাকা জমা করলাম, হাতে বেশি সময় না
থাকায় ৩ ঘণ্টা সময় নিলাম, শুনলাম ফেরার সময় ৮০০ টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে, এটাই
নাকি নিয়ম, ওটাই গাড়িভাড়া হিসাবে চালক নিয়ে নেবেন, আমাদের বিক্রম চালক বুঝিয়ে বললেন পদ্ধতিটি।
সকালে শুধু চা খেয়ে বেড়িয়েছিলাম তাই বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিল। আর এক দফা চা আর সাথে দোসা সহযোগে প্রাতঃরাশ সারলাম। গাড়োয়ালি দোকানের সামনে বাংলায় লেখা আছে ‘বাঙালি খাবার’, বুঝলাম এখানেও বাঙালি
পর্যটকের সংখ্যা বেশ অধিক। খাওয়া দাওয়া সারা হলে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে পৌঁছলাম লক্ষণজী-র
মন্দিরে, প্রণাম করে মন্দিরকে ডানহাতে রেখে এগিয়ে চললাম ‘লছমন ঝোলা’-র সন্মুখে। পূর্বে
এই সেতুটি দড়িনির্মিত ছিল, ১৮৮৯ সালে ঝুলন্ত সেতুটি লৌহদড়ি দ্বারা নির্মাণ করা হয়,
পরবর্তীকালে ১৯২৪ সালে বন্যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেতুটিকে বর্তমান রূপ দেওয়া
হয়। চলতে চলতে রাস্তায় পড়ল ভরত মন্দির,শত্রুঘ্ন মন্দির আর তার কাছেই ‘রাম ঝোলা’,
লছমন ঝোলা-র অনুরূপে নির্মিত আর একটি ঝুলন্ত সেতু অপেক্ষাকৃত নবীন যা ১৯৮৬ সালে
নির্মাণ করা হয়। এই মন্দিরগুলি আদি শঙ্করাচার্য্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা
যায়। হৃষীকেশের প্রকৃতির রূপ বড়ই মনমুগ্ধকর, গঙ্গা এখানে অনেকাংশেই দূষণমুক্ত। লছমন ঝোলা-র উপর দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে
উপলব্ধি করতে করতে মন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। হৃষীকেশে অনেক যোগা (Yoga) প্রশিক্ষন কেন্দ্র
চোখে পড়ল, বিদেশী পর্যটকের সংখ্যাও কম নয়। দূর থেকে দেখলাম একদল ছেলে গঙ্গার পাড়ে
স্নান করছে, সেতুর উপর একাধিক বানর রেলিঙের উপর বসে আছে, ঝুলন্ত সংকীর্ণ সেতুর উপর
দিয়েই চলেছে বাইক বা স্কুটি নিয়ে যাতায়াত- মুহূর্তের মধ্যেই দৈনন্দিন জীবনের
একখানি খণ্ডচিত্র ফুটে উঠল। আমরা এগিয়ে চললাম, ফিরতে হবে রাম ঝোলা পার হয়ে বিক্রম
স্ট্যান্ডের কাছে, সেখানেই অপেক্ষা করছে গাড়ির চালক। এখানেও দেখা পেলাম একাধিক একই
নামের দোকান, ‘চটিওয়ালা’।
জুলাই, ২০১৮



অপূর্ব বর্ণনা, মনটা ভরে গেল।
উত্তরমুছুন