সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
পূর্বের পর্বটি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন পর্ব-১
ভারতবর্ষ ২০২৩ সালকে আন্তর্জাতিক মিলেট বৎসর হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেছিল, যা ফুড এবং এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (Food and Agriculture Organisation of United Nations) ও জাতিসংঘের (United Nations) সাধারণ পরিষদ অনুমোদন করেছে (FAO events)। আমরা এই পর্বে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মিলেট নিয়ে আলোচনা করবো।
মিলেটের ব্যবহার ভারতবর্ষে কিন্তু আজকে নতুন নয়,বরং খাদ্যশস্য হিসেবে এর ব্যবহার প্রায় ৫০০০ বছর পুরোনো। খাদ্য হিসেবে এর ব্যবহারের উল্লেখ সিন্ধু সভ্যতার সময়কালের বিভিন্ন পর্যায়ে পাওয়া যায়, বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে তা আমাদের সামনে উঠে এসেছে। তৎকালে গম এবং বাৰ্লির ব্যবহার যে হতো তা ভালোভাবে নথিভুক্ত, কিন্তু মিলেট ব্যবহারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি প্রথম পর্যায়ে ভালোভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি, কিন্তু বর্তমানে জানা যায় মিলেট শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ শস্যই ছিল না বরং কোনো কোনো অঞ্চলে তা প্রধান শস্যদানা হিসেবে বিবেচিত হতো (Weber and Kashyap, 2016)।প্রারম্ভিক হরপ্পা সভ্যতা থেকে পরিণত এবং পরবর্তীতে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে হরপ্পা সভ্যতার নানান স্থানে জোয়ার সহ নানান মিলেটের ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায় (Pokharia et al., 2014)।
মিলেট উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে এগুলির ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। মূলত যে সকল মিলেট ভারতবর্ষে পাওয়া যায় সেগুলি হলো জোয়ার (Sorghum), বাজরা (Pearl millet), রাগি (Finger millet), কোদো (Kodo millet), কুটকি (Little millet), কাকুম (Foxtail millet), সাংবা (Barnyard millet), চিনা (Proso millet) ইত্যাদি (Rao et al., 2018)। ভারতবর্ষে এইসকল মিলেটকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার রীতি রয়েছে। মধ্যপ্রদেশে অধ্যাপনাকালে গবেষণার কাজে বাইগা (Baiga) এবং গোন্ড (Gond) জাতির কয়েকটি গ্রামে ঘুরেছিলাম। কোদো এবং কুটকি তাঁদের প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। বাইগা মানুষ হাল দিয়ে মাটি কর্ষণ করেন না কারণ তাঁরা ভূমিকে মাতা রূপে গণ্য করেন, কাজেই মায়ের গায়ে আঘাত লাগে (হলকর্ষণে ভূমি মাতা আঘাত পাবেন) এমন কিছু করেন না। ভূমি পরিষ্কার করে তাঁরা বীজ ছড়িয়ে দেন, আর তা থেকে গাছ হয়, এরূপ চাষাবাদ 'বেওয়ার' ('Bewar') নামে পরিচিত (Guha, 1996)।
Table 1: ভারতবর্ষে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকার মিলেট শস্য
|
ইংলিশ নাম |
বিজ্ঞানসম্মত নাম |
বাংলা/স্থানীয় নাম |
|
Barnyard millet |
Echinochloa
frumentacea |
সাংবা/ |
|
Finger millet |
Eleusine coracana |
রাগি/মারবা |
|
Foxtail millet |
Setaria italica |
কাকুম/কাওন |
|
Kodo millet |
Paspalum
scrobiculatum |
কোদো |
|
Little millet |
Panicum sumatrense |
কুটকি/সামা |
|
Pearl millet |
Pennisetum
glaucum |
বাজরা |
|
Proso millet |
Panicum miliaceum |
চিনা |
|
Sorghum |
Sorghum bicolor |
জোয়ার |
সত্তরের দশকে ভারতবর্ষে সবুজ বিপ্লব সংগঠিত হয়। বলাই বাহুল্য এর ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল অনেকটাই। আজ যে ভারত তার প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেই উৎপাদন করতে পারে আর এ ব্যাপারে অন্য দেশের উপর বিশেষ নির্ভরশীল নয় তা অবশ্যই দেশের অগ্রগতিকেই প্রকাশ করে। তবে সবুজ বিপ্লব অধিক উৎপাদনশীল শস্য-র উপর মনোনিবেশ করায় ধান, গমের চাষ এবং উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, অপরপক্ষে জোয়ার, বাজরা (Pearl millet), রাগি (Finger millet), স্মল মিলেট, বাৰ্লি ইত্যাদির চাষ অনেকটাই কমে যায় (Nelson et al., 2019)। ১৯৬১ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত কৃষি জমির আয়তনের দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে, ধান, গম আর ভুট্টার চাষের জমির আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে, অপরপক্ষে বার্লি, মিলেট আর জোয়ারের চাষের জমি হ্রাস পেয়েছে (Figure 1)। উৎপাদনের তথ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেও দেখা যাবে বাৰ্লি বা জোয়ারের উৎপাদন ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে, মিলেটের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা খুব বেশি নয়, এবং উৎপাদনের স্থিতিশীলতাও লক্ষ্যণীয় নয়। অপরপক্ষে সহজ কারণেই চাল, গম এবং ভুট্টার উৎপাদন দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে (Figure 2)।
Figure 1: ১৯৬১ টি ২০২০ পর্যন্ত ফসল (Cereals) অনুসারে কৃষিজমি আয়তনের হিসাব (Food and Agriculture Organisation হইতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে Source: FAOSTAT)
Figure 2: ১৯৬১ টি ২০২০ পর্যন্ত ফসল (Cereals) অনুসারে উৎপাদনের হিসাব (Food and Agriculture Organisation হইতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে Source: FAOSTAT)
এবার মিলেটের পুষ্টিগুণ লক্ষ্য করা যাক। Table 2-র মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার মিলেটের পুষ্টি উপাদানের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হল। সাধারণভাবে দেখা যায়, মিলের চালের থেকে প্রোটিন, স্নেহ জাতীয় পদার্থ, ফাইবার এবং অ্যাশের মাত্রা প্রায় সকল ধরণের মিলেটে অধিক পরিমানে বিদ্যমান। গমের প্রোটিনের মাত্রা বেশ কয়েকটি মিলেটের যেমন কোদো, কুটকি, রাগি বা সাংবা থেকে অধিক থাকলেও, ফাইবার তুলনামূলকভাবে কম পরিমানে থাকে। ডায়েটারি ফাইবার (Dietary fiber) অধিক থাকার সুবাদে মিলেটের গ্লাইসেমিক ইনডেক্সও (Glycemic index) কম হয়, যা পুষ্টিগুণের দৃষ্টিকোণ থেকে খুব উপকারী। তুলনামূলকভাবে চাল অধিক শর্করা জাতীয় পদার্থ ধারণ করে এবং ডায়েটারি ফাইবার থাকে অত্যন্ত কম।
Table 2: বিভিন্ন প্রকার মিলেটের পুষ্টিগুণের তালিকা (g/100g) এবং প্রতি ১০০গ্রাম খাদ্য প্রাপ্ত শক্তির পরিমান (Kcal) (Data obtained from Nutritive value of Indian Foods, National Institute of Nutrition, Hyderabad, 2007; Source: Rao et al., 2016)
|
Millet |
C |
P |
F |
CF |
M |
E |
|
Barnyard millet (সাংবা) |
65.5 |
6.2 |
2.2 |
9.8 |
4.4 |
307 |
|
Finger millet (রাগি) |
72.0 |
7.3 |
1.3 |
3.6 |
2.7 |
328 |
|
Foxtail millet (কাকুম) |
60.9 |
12.3 |
4.3 |
8.0 |
3.3 |
331 |
|
Kodo millet (কোদো) |
65.9 |
8.3 |
1.4 |
9.0 |
2.6 |
309 |
|
Little millet (কুটকি) |
67.0 |
7.7 |
4.7 |
7.6 |
1.5 |
341 |
|
Pearl millet (বাজরা) |
67.5 |
11.6 |
5.0 |
1.2 |
2.3 |
361 |
|
Proso millet (চিনা) |
70.4 |
12.5 |
1.1 |
2.2 |
1.9 |
341 |
|
Sorghum (জোয়ার) |
72.6 |
10.4 |
1.9 |
1.6 |
1.6 |
349 |
|
Rice (Raw, Milled) (চাল) |
78.2 |
6.8 |
0.5 |
0.2 |
0.6 |
345 |
|
Wheat (Whole)(গম) |
71.2 |
11.8 |
1.5 |
1.2 |
1.5 |
346 |
পুষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে যে সকল খনিজ (Minerals) আবশ্যক সেগুলি প্রায় সকল প্রকার মিলেটে বিদ্যমান এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালের থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক (Table 3)। যেমন রাগি অধিক পরিমানে ক্যালশিয়াম ধারণ করে যার মাত্রা ৩৪৪ মিলিগ্রাম প্রতি ১০০ গ্রাম রাগিতে, যেখানে প্রতি ১০০ গ্রাম চালে মাত্র ১০ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম থাকে। একইভাবে ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদির মাত্রাও তুলনামূলকভাবে অধিক থাকায় রাগির পুষ্টিগুণ অধিক। কুটকি, বাজরা, সাংবা ইত্যাদি মিলেটে লোহার পরিমান অনেক বেশি থাকে, খাদ্য হিসেবে যা গ্রহণ করলে লোহার অভাবে যে এনিমিয়া হয়, যার প্রাবল্য দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতবর্ষে বিশেষত মহিলাদের মধ্যে অধিক প্রকট, তার প্রকোপ কমানো যেতে পারে।
Table 3: বিভিন্ন প্রকার মিলেটে খনিজের
পরিমান (mg/100g)
|
Millet |
Ca |
P |
Mg |
K |
Na |
Fe |
Cu |
Mn |
Zn |
|
Barnyard millet (সাংবা) |
20 |
280 |
82 |
-- |
-- |
5.0 |
0.60 |
0.96 |
3.0 |
|
Finger millet (রাগি) |
344 |
283 |
137 |
408 |
11.0 |
3.9 |
0.47 |
5.49 |
2.3 |
|
Foxtail millet (কাকুম) |
31 |
290 |
81 |
250 |
4.6 |
2.8 |
1.40 |
0.60 |
2.4 |
|
Kodo millet (কোদো) |
27 |
188 |
147 |
144 |
4.6 |
0.5 |
1.60 |
1.10 |
0.7 |
|
Little millet (কুটকি) |
17 |
220 |
133 |
129 |
8.1 |
9.3 |
1.00 |
0.68 |
3.7 |
|
Pearl millet (বাজরা) |
42 |
296 |
137 |
307 |
10.9 |
8.0 |
1.06 |
1.15 |
3.1 |
|
Proso millet (চিনা) |
14 |
206 |
153 |
113 |
8.2 |
0.8 |
1.60 |
0.60 |
1.4 |
|
Sorghum (জোয়ার) |
25 |
222 |
171 |
131 |
7.3 |
4.1 |
0.46 |
0.78 |
1.6 |
|
Rice (Raw, Milled) (চাল) |
10 |
160 |
90 |
-- |
-- |
0.7 |
0.14 |
0.59 |
1.4 |
|
Wheat (Whole) (গম) |
41 |
306 |
138 |
284 |
17.1 |
5.3 |
0.68 |
2.29 |
2.7 |



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন