সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
করোনা (Coronavirus/ Covid-19 pandemic) মহামারীর ধাক্কা
সামলে পৃথিবীতে আবার ধীরে ধীরে সব কিছু স্বাভাবিক হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন
হয়েছে,
যেমন মাস্ক এখন সর্বক্ষণের সঙ্গী, একটা
ছোট স্যানিটাইজার ব্যাগের পকেটে সর্বক্ষণের জন্যে রেখে দেওয়া, আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সময় করোনা পরীক্ষার প্রমাণপত্র রাখা ইত্যাদি। তবে আর
একটা পরিবর্তন আমি নিজের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি, বাইরে
না বেরোনোটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে, এটা বিশেষ স্বাস্থ্যকর
নয়। প্রায় দু'
বছর বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্র এবং কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি, এছাড়া
আর কোথাও বিশেষ বেরোইনি,
বেশিরভাগ কনফারেন্সে অনলাইন বক্তব্য রেখেছি, আত্মীয়-পরিজন
আমার এদেশে কেউ নেই কাজেই যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি, একান্ত কর্মক্ষেত্রের
দরকার ছাড়া বাইরে অন্য শহরে যায়নি। এ বছর চুসকের (Chuseok; Thanks
giving ceremony of Korea) সময় সোলে (Seoul, দক্ষিণ
কোরিয়ার রাজধানী) একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে খেতে যাবো ঠিক
করলাম। আনদং (Andong) থেকে ট্রেনে যাব বলেই ঠিক করেছিলাম কিন্তু
স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম ট্রেনের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। অগত্যা বাস-ই ভরসা। রেলপথে
সোলে পৌঁছতে লাগে ২ ঘন্টা ৪ মিনিট আর যাত্রাপথটিও বেশ উপভোগ্য। অপরপক্ষে বাসে সময় লাগে
সাড়ে তিন ঘন্টার একটু বেশি। আনদং থেকে সাড়ে ন'টার
বাসে রওনা হয়ে পূর্ব সোলে (Dong Seoul) এসে পৌঁছলাম প্রায় দুপুর সোয়া এক'টায়। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রেস্তোরাঁ।
আমরা ভারতীয় থালি অর্ডার দিলাম। প্রথমেই তাঁরা লস্যি পরিবেশন করলেন। বেশ খিদেও পেয়েছিল, কাজেই খাবারে মনোনিবেশ করলাম। সাথে সাথে একটু এই সুস্বাদু পদগুলির আবির্ভাব আর বিবর্তন দিকেও মন দিলাম। এই ব্যাপারটা বেশ মজাদার। এই বিষয়টি এখানে উল্লেখ করব। লস্যির সাথে সকল ভারতীয় পরিচিত। এরপর এলো সামোসা (বাংলায় যা সিঙ্গাড়া বা সিঙাড়া নামে পরিচিত)। খুবই উপাদেয় আর সুস্বাদু এই আলু, পেঁয়াজ, কড়াইশুঁটির পুর দিয়ে প্রস্তুত সিঙ্গাড়া। বাংলা তথা ভারতবাসীর অতি পরিচিত এই পদটির জন্মস্থান কিন্তু ভারতবর্ষ নয় বরং মধ্য প্রাচ্য। পার্সিয়ান ঐতিহাসিক আবুল ফজল বেহাকি (Abu’l-Fadl Bayhaqi) তাঁর বই তারিখ-ই-বেহাঘি (Tarikh-e Beyhaghi) তে 'সাম্বোসা' র উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে আমির খসরু (Amir Khusrau) মাংস, ঘি আর পেঁয়াজ উপকরন সাহায্যে প্রস্তুত সামোসার উল্লেখ করেছেন। পর্যটক ইবন বতুতা (Ibn Battuta) 'সাম্বুসাগ' বলে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজসভায় যে রাজকীয় ভোজের একটি পদের উল্লেখ করেছেন যা মাংসের কিমা, আখরোট, পেস্তা, আলমন্ড এবং স্পাইস বানানো সামোসা। মোগলাই পদগুলি নিয়ে পঞ্চদশ শতাব্দীতে সংকলিত গ্রন্থ ‘নি’মতনামা’-তে (Ni’matnama) বিভিন্ন প্রকার 'সাম্বুসার' রন্ধনপ্রনালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। 'আইন-ই-আকবরী'তে (Ain-i-Akbari) 'সাংবুসহ' বা সামোসার উল্লেখ রয়েছে। মাংসের সামোসা উপাদেয় তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজ সামোসা বা সিঙ্গাড়ার ভিতরে পুর হিসেবে আলু ব্যবহার করা হয়। এই আলু পর্তুগিজদের হাত ধরে ষোড়শ শতকে ভারতবর্ষে আসে।
পরবর্তী পদ চিকেন কাবাব। খুব সুস্বাদু ছিল এই পদটি। মাংসের টুকরোগুলি বেশ নরম, উপযুক্তভাবে
সিদ্ধ হয়েছিল এবং ব্যবহৃত মশলা গুলি ভিতরে ঢুকেছিলো। কাবাবগুলি একেবারেই শুকনো ছিল
না। চিকেন খাওয়ার প্রচলন প্রথমে মোঘলদের হাত ধরে আর তারপর বৃটিশদের হাত ধরে এদেশে
আসে। পূর্বে যে সকল ভারতবাসী আমিষ খাদ্য গ্রহণ করতেন, মাংসের
মধ্যে ছিল মূলত খাসি বা পাঁঠা। দু'পুরুষ আগে ঠাকুমা দিদিমাদের কাছ থেকে জানতে পারা যায় মুরগির মাংস বা ডিম তখন
খাওয়ার প্রচলন ছিল না,
যদি একান্ত কেউ খেতেন তবে বা হেঁসেলের বাইরে উঠোনে রান্না
করে খেতে হতো। ফাউল কাটলেট ইত্যাদি যে খাদ্যগুলি বাঙালির রসনাতৃপ্ত করতে ঊনবিংশ
শতকের শেষভাগে বা বিংশ শতকের প্রথমভাগে আবির্ভূত হয়েছিল তা মূলত বৃটিশদের হাত ধরে।
আর এই কাবাব কিন্তু তুর্কিদের আবিষ্কার বলে মনে করা হয়। ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত Kyssa-i Yusuf নামক তুর্কিশ বইতে কাবাব কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়, সম্ভবত
এটিই একটি গ্রন্থ যাতে সর্বপ্রথম এই শব্দটি পাওয়া যায়। ‘নি’মতনামা’-তে
(Ni’matnama) কাবাবের উল্লেখও পাওয়া যায়।
এর পর ছিল তন্দুর নান। আজকের যে তন্দুর ভারতবর্ষ, ইরান, মধ্য
এশিয়া, তুর্কি,
ককেশীয়দের মধ্যে প্রচলিত তার উৎপত্তি প্রাচীন মেসোপটেমীয়
সভ্যতায় বলে ধারণা করা হয়। নান একটি প্রাচীন পার্সিয়ান শব্দ, এর
অর্থ রুটি। সম্ভবত মিশর থেকে ইস্ট ভারতবর্ষে
আসে এবং তা এই নান প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়।
আমির খসরু-র লেখায় নানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্রাট শাহজাহানের রন্ধনশালায় যে সকল খাদ্য প্রস্তুত
হতো তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ‘নুস্কা-ই- শাহজাহানী’
(Nushka-i-Shahjahani) বা ‘নুস্কা-উ-নমক’ (Nushka-u-Namak) বইটিতে। এখানে নান এবং
রোটি-র উল্লেখ পাওয়া যায়।
এছাড়াও কারীর মধ্যে আমরা দু'টি পদ নিয়েছিলাম। আমিষের মধ্যে মটন কারী এবং নিরামিষের মধ্যে পনির বাটার মশলা।
আমার বিদেশী বন্ধুদের মুখ থেকে ভারতীয় রান্নার পদের মধ্যে কারীর কথা অনেকবার শুনেছি, তাঁরা ভারতীয় খাবার বলে কারী-কে বেশ উল্লেখযোগ্য বলে মনে করে। এর উপকরণে টমেটো,
লঙ্কা কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইউরোপ এবং সেই স্থান থেকে
এশিয়া তথা ভারতবর্ষে আগত। আর পেঁয়াজ পশ্চিম
এশিয়া থেকে এসে পৌঁছেছিল আমাদের দেশে।
এবার খাওয়া শেষ। ভারতীয় রেস্তোরাঁয় অনেক দিন পরে খেয়ে বেশ ভালো লাগলো। পৃথিবীর
বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত উপকরণ বা খাদ্যগুলি কিন্তু একই প্রকার রয়ে যায়নি বরং উল্লেখযোগ্যভাবে
সেগুলির কিন্তু রূপান্তর ঘটেছে। ভারতীয় মশলার সহযোগে, ভারতীয়
স্বাদ ও রন্ধন প্রণালী অনুযায়ী রেসিপিগুলি সমৃদ্ধ হয়েছে,
তা বলাই বাহুল্য।
সেপ্টেম্বর ২০২২
সম্পর্কিত রচনাটি পড়ার জন্যে খাদ্য, পুষ্টি এবং খাদ্যের রূপান্তর ক্লিক করুন।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন