সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
বর্তমানে সর্বাধিক মূল্যবান যদি কিছু থাকে তবে তা হলো সময়। তাই দৈনন্দিন ব্যস্ততার থেকে কয়েকটি দিন ছুটি নিয়ে কিংবা সপ্তাহান্তের দুইদিন বা কখনও তারসাথে সম্ভব হলে শুক্রবারের আধা বেলাটা যোগ করে নিয়ে কোথাও বেরিয়ে পড়া যেতেই পারে। এবার প্রশ্ন কোথায় যাব, কেমন করে যাব, কোথায় থাকব, কত খরচ হবে ইত্যাদি। আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো এই ব্লগটিতে।
প্রথমেই স্থির করুন আপনার পছন্দ, অর্থাৎ আপনি কি প্রকৃতির সাহচর্য চান, ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যেতে চান, অথবা শহুরে ভাইব্স আপনাকে সতেজ করে, ইত্যাদি। এর উত্তর আপনাকে আপনার পছন্দের জায়গা নির্বাচনে সাহায্য করবে। প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে এবার অগ্রসর হন আর একটু ভিতরে। যেমন ধরুন, যদি আপনার প্রাকৃতিক সাহচর্য পছন্দ হয় তবে সেটা কি সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল, গ্রাম, কোনটি? উত্তরের সাথে সাথে আপনার কাছে কয়েকটি বিকল্প উঠে আসবে, এর মধ্যে একটি নির্বাচন করতে হবে। এখানে আমি পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি পর্যটন স্থানের উল্লেখ করলাম।
সমুদ্র
দিঘা-শংকরপুর-তালসারি, মন্দারমণি, তাজপুর, বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ
পাহাড়
দার্জিলিং, কালিম্পঙ-কার্শিয়াং,
লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ, মিরিক, সান্দাকফু, পুরুলিয়া-অযোধ্যা
অরণ্য/ জঙ্গল
ডুয়ার্স, গরুমারা-জলদাপাড়া-চাপড়ামাড়ি, রাজাভাতখাওয়া, সুন্দরবন, পারমাদান,
বেথুয়াডহরী
ঐতিহাসিক স্থান/ ঐতিহ্য/ সাংস্কৃতিক পীঠভূমি
মুর্শিদাবাদ-১, ২, মালদা, বিষ্ণুপুর, বোলপুর শান্তিনিকেতন, কোচবিহার, নবদ্বীপ
এছাড়াও আরো একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে।
এবারের প্রশ্ন, কি উপায়ে যাবেন? ভ্রমণের খরচের একটা বড়ো অংশ যাতায়াতে, তারপর আর একটা বড়ো অংশ থাকবার জন্যে ব্যয় হয়। এবার এই যাতায়াত খরচ নির্ভর করে অনেক গুলি বিষয়ের উপর। সাধারণত গণ পরিবহন, যেমন বাস, ট্রেন ইত্যাদি, ব্যবহার করলে খরচ অনেক কমে যায়, এবং অপরপক্ষে ব্যক্তিগত পরিবহন ব্যবহার করলে যেমন ধরুন গাড়ি বুক করে ঘুরতে গেলে অনেক বেশি খরচ হবে তা বলাই বাহুল্য। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু কিছু সুবিধা এবং কিছু অসুবিধা আছে। যেমন গণ পরিবহন ব্যবহার করলে খরচ কম হবে ঠিকই তবে তার স্বাচ্ছন্দ্য ব্যক্তিগত পরিবহন থেকে অনেকটাই কম। আবার ব্যক্তিগত পরিবহনের খরচ বেশ বেশি হয়ে যায়। এমত অবস্থায় আপনি স্থানীয় ট্যুর অপারেটরের সাহায্য নিতে পারেন। যেহেতু তাঁরা প্যাকেজেড ট্যুরে (Packaged tour) অনেক মানুষ একত্রিত করে নিয়ে যান, এটা একটা মধ্যবর্তী ব্যবস্থা হতে পারে। যেমন খরচটা নাগালের মধ্যে থাকলো আবার গণ পরিবহনের ভিড়ও এড়ানো গেলো।
এর পরের বিষয় থাকার জায়গা নির্বাচন। দেখুন,
খুবই সাধারণ কারণে দর্শনীয় স্থানের কেন্দ্রস্থলে সর্বদাই হোটেলের
দাম অধিক হয়ে থাকে,
তাই পকেট বাঁচাতে তুলনামূলক ভাবে একটু দূরে ঘরের ভাড়া কম হয়।
যেমন, উদাহরণস্বরূপ দেখুন,
দিঘায় সমুদ্রমূখী হোটেলের ঘরের দাম অধিক, আবার
বাজারের কাছে ঘরের দাম কিন্তু অনেকটা কম,
তবে সেখান থেকে সমুদ্র দেখতে আপনাকে মিনিট কয়েক হেঁটে আসতে হবে, ঘরে
বসে দেখতে পাবেন না। তাইবলে আবার এতটা দূরে ঘর ভাড়া নেওয়াটা আবার ঠিক নয় যেখান থেকে
প্রতিমুহূর্তে সমুদ্রের বীচে আসতে আপনাকে অটো বা টোটো গাড়ি ভাড়া করতে হয়। এখন বেড়ানোর
স্থানগুলিতে থাকবার জন্যে বিভিন্ন আয়োজন রয়েছে। হোটেল বা হলিডে হোমের পাশাপাশি গড়ে
উঠেছে হোম-স্টে। প্রত্যেকটির স্বাচ্ছন্দ্য এবং উদ্দেশ্য কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। হোটেলের
পেশাদারিত্ব আর স্বাচ্ছন্দ্য আলাদা, উন্নত পরিষেবাযুক্ত হোটেলগুলি আপনাকে অনেক হালকা হয়ে ঘুরতে সাহায্য করবে। যেমন, স্নানের
জন্যে সাবান,
শ্যাম্পু,
লোশন,
গা মোছার তোয়ালে,
দাঁত মাজার ব্রাশ-পেস্ট, ব্লাঙ্কেট, প্রয়োজনে
ঘরে চা বা কফির ব্যবস্থা ইত্যাদি নানান উপকরণ আপনি এই হোটেলগুলি থেকে পেতে পারেন, কাজেই
এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি বহন করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার ব্যাগ হালকা হয়ে গেলো।
যদি আপনি বাজেটেড হোটেলে থাকেন তবে হয়তো এই জিনিসগুলি নাও পেতে পারেন, সেক্ষেত্রে
আপনি
তোয়ালের পরিবর্তে গামছা, শ্যাম্পু বা লোশনের বোতলের
পরিবর্তে ইউস এন্ড থ্রো স্যাশে,
ইত্যাদি নিতে পারেন,
এতে ব্যাগ অনেকটা হালকা
হয়ে যাবে। হালকা ব্যাগ ভ্রমণের সময় আপনাকে সাহায্য করবে। হলিডে
হোমে আপনি আপনার মতন নিজেরা নিজেদের রান্না-বান্না করে খেতে পারেন, অনেকে মিলে বেড়াতে গেলে বা গেট টুগেদারের ক্ষেত্রে এটি বেশ উপযোগী। আবার হোম-স্টে
তে আপনি স্থানীয় মানুষের সাহচর্য,
তাদের সংস্কৃতি,
খাদ্য ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হতে পারেন। আজকের দৈনন্দিন
জীবনে ইন্টারনেটের গুরুত্ব অপরিহার্য,
কাজেই যদি আপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হয় তবে Wi-Fi-র সংযোগ হোটেল বা হোম-স্টেতে রয়েছে কিনা তার খোঁজ নিয়ে রিসার্ভ করুন।
এবার আসি বেড়ানোর কথায়। প্রাণ আর মন ভরে বেড়ান। সমুদ্র, নদী
ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন,
যেকোন বীচে নেমে পড়বেন না, দেখুন সেটি ঘোষিত বীচ কিনা, জোয়ার-ভাঁটার
সময় সম্বন্ধে অবহিত থাকুন,
বাচ্চাদের বিষয়ে সতর্ক থাকুন, অযথা ঝুঁকি নেবেন না। পাহাড়ে
গেলে ট্রেকিং পথ সম্বন্ধে ভালোভাবে অবহিত হন,
প্রয়োজনে স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিন। ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণের
সময় দ্রষ্টব্য বিষয়ে জানার জন্যে স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিতে পারেন, তবে
মনে রাখবেন তথ্যগুলি সবসময় যে সম্পূর্ণভাবে ইতিহাস নির্ভর তা নাও হতে পারে, বিভিন্ন
লোককথা, বিশ্বাস এগুলি সব মিশে থাকতে পারে বর্ণনায়। কাজেই উৎসাহ থাকলে ইতিহাস বই বা জার্নালের
সাহায্য নিতে পারেন তথ্যগুলি দেখে নেওয়ার জন্য। বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলিতে তার
বর্ণনা লেখা থাকে বোর্ডে,
সেগুলিও ভালোভাবে পড়ে নিতে পারেন। ছবি তুলুন মন ভরে, তবে
দেখে নিন কিছুক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য স্থানে ছবি তোলা নিষেধ থাকতে পারে, সেই
নির্দেশ মান্য করুন। স্থানীয় মানুষদের সাথে মেলামেশা করুন, তাঁদের
সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানুন,
সংস্কৃতির আদান-প্রদান করুন।
এবার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা যাক যা যেকোনো ভ্রমণের ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য,
প্রথমত,
কোনোভাবেই স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির সাথে আপোস করবেন না।
অপরিচ্ছন্ন কোনো স্থানে থাকবেন না,
এবং সেই স্থানে খাওয়া দাওয়া করবেন না। স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব
কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে,
যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। স্যানিটাইজার আর মাস্ক হাতের কাছেই
রাখুন, প্রয়োজনে তা অবশ্যই ব্যবহার করুন। স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সকল নিয়ম পালন করুন।
দ্বিতীয়ত,
পানীয় জলের বিষয়ে সচেতন থাকবেন। যে কোনো জায়গার জল পান করবেন
না, আগে নিশ্চিন্ত হবেন সেখানকার জল পানযোগ্য কিনা। বেশিরভাগ স্থানে আপনি পানীয় জলের
সুবিধা পাবেন,
একান্ত যদি না পান তবে পানীয় জল কিনে খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
তৃতীয়ত,
রাস্তার খোলা খাবার লোভনীয় হলেও সংযমী হতে হবে, বেড়াতে
গিয়ে অধিকাংশ সময়ে পেট খারাপ হয়ে থাকে উপযুক্ত গুণমানের খাবারের অভাবে আর অনুপযুক্ত
খাবারের প্রাচুর্যে। শুকনো খাবার (শুকনো ফল, বিস্কুট, কেক
ইত্যাদি),
ফল (পরিষ্কার করে ধোয়া) ইত্যাদি
সুযোগ করে কিনে নিন আর খান।
চতুর্থত এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ, মনে রাখবেন যে স্থানে আপনি
বেড়াতে গিয়েছেন সেটির রক্ষণাবেক্ষণের কিছুটা দায়িত্ব কিন্তু আপনারও। প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি যেখানে সেখানে ফেলবেন না; আবর্জনা
ডাস্টবিনে ফেলবেন,
ডাস্টবিন না পেলে তা ব্যাগে করে হোটেলে নিয়ে আসুন, সেখানে
ডাস্টবিন পাবেন,
তাতে ফেলুন; গাছের ডাল ভাঙবেন না, ফলমূল, ফুল
তুলবেন না;
জলাশয়ে কিছু ফেলে অপরিষ্কার করবেন না; অকারণে
শব্দ দূষণ করবেন না;
খেয়াল রাখবেন আপনার আনন্দ যেন কোনো অবস্থাতেই অপরের (মানুষ বা
কোনো প্রাণীর)দুঃখের কারণ না হয়ে ওঠে। এই জায়গাটিতে আবার যদি কখনো আসেন, যেন
সেটি এরূপ সুন্দর অবস্থাতেই ফিরে পান,
সেটির খেয়াল রাখবেন।
আর দেরি কেন ! এবার ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়ুন।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন