সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
সময়ের অপ্রতুলতা জীবনধারণের সবক্ষেত্রে উপলব্ধি করলেও, বোধহয় সর্বাধিক প্রকট হয়ে ওঠে দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনের মধ্যে ভ্রমণের সময় অনুসন্ধানে। পাঁচমাড়ি ভ্রমণের সময়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মধ্যপ্রদেশের বালাঘাটে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতাম কিছুকাল, সেই সময়েই এক ডিসেম্বরের শেষদিকে দিন দুয়েকের জন্যে পাঁচমাড়ি ভ্রমণ। বালাঘাট থেকে সিওনি, ছিন্দওয়াড়া হয়ে হোসাঙ্গাবাদ জেলায় (বর্তমান নর্মদাপুরম জেলা) অবস্থিত পাঁচমাড়ির দূরত্ব ২৬৫-৭০ কিলোমিটার, গাড়িতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে রাতের আহার শেষে যাত্রা শুরু, ঘড়িতে তখন ১০ টা। একখানি ইনোভা গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল, চালক ছাড়া আমরা পাঁচজন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাপ্টেন জেমস ফরসিথ আবিষ্কৃত পাঁচমাড়ি হিল স্টেশনটিতে যখন পৌঁছলাম তখন ভোর সাড়ে চার-টে। আকাশে লালচে আভা, পাখিদের জেগে ওঠা, শীতল হাওয়ার স্পর্শ, ঊষাকালের পবিত্রতা, এক অসাধারণ অনুভূতির উপলব্ধি, সাতপুরার রানী জেগে উঠছেন।
হোটেলে ওঠা, একটু বিশ্রাম আর প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রতিটা পর্যটন স্থানের মতন পাঁচমাড়িতেও কিছু স্থানীয় নিয়ম রয়েছে। যেমন বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখার জন্যে স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করাটাই এখানে প্রচলিত। আসলে পর্যটন নির্ভর স্থানীয় অধিবাসীদের আর্থিক উন্নতিসাধনের একটি পথ। আমরাও একটি গাড়িভাড়া করে চললাম। প্রথম দ্রষ্টব্য 'পান্ডব গুহা'। বেলেপাথর নির্মিত পাঁচটি গুহা যা 'পাণ্ডব গুহা' নামে পরিচিত, যা থেকে এই স্থানের নাম পাঁচমাড়ি ('পাঁচ' = পাঁচ, 'মাড়ি' = গুহা), বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী পান্ডবগণ নির্বাসনকালের অজ্ঞাতবাসের সময়ে গুহাগুলিতে বসবাস করেছিলেন। হয়তো এই বিশ্বাসের সঙ্গেই সামঞ্জস্য রেখে, বৃহৎ এবং সর্বাপেক্ষা অধিক বায়ু চলাচলের উপযোগী গুহাটি দ্রোপদীর, সর্বাপেক্ষা অন্ধকারময় গুহাটি মহাবলশালী ভীমের গুহা বলে বর্ণনা করা হয়।
প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিকগণের মতানুসারে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালে বৌদ্ধ সাধুগণ বিহার রূপে এই গুহাগুলি নির্মাণ করেন। অপর পণ্ডিতগণ আবার গুহার উপরিভাগে অবস্থিত ইষ্টকনির্মিত গঠনগুলিকে বৌদ্ধস্তূপ বলে ধারণা করেন এবং মৌর্য সম্রাট অশোকের শাসনকালে এগুলি নির্মিত হয়েছিল বলে মত প্রদান করেন।
এরপরের দ্রষ্টব্য 'হান্ডি খো', আর বিশ্রাম। হান্ডি খো একটি অশ্বক্ষুরাকৃতি গিরিখাত। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এ স্থলে পূর্বে একটি হ্রদ ছিল যা কোনো এক দৈত্যের অগ্নিসম শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে শুকিয়ে যায়। অজস্র লোককথা, বিশ্বাস প্রচলিত এ স্থানে; প্রতিটি প্রস্তর, প্রতিটি শৈল শ্রেণী, প্রতিটি গুহা এখানে অতীতের কাহিনী শোনায়। দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে ভগ্নদশাগ্রস্থ, পোড়া বেগম মহল এবং তৎসংলগ্ন মাতা অম্বা-র মন্দির দর্শন।
স্থানীয় জৈব সম্পদ এখানে উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ার মতন, যেমন কন্দমূল যা রাম কন্দমূল নাম পরিচিত, স্থানীয় একধরণের বৃহদাকার পেঁয়াজের প্রজাতি ইত্যাদি। এইগুলি স্থানীয় দোকানগুলিতে বিক্রী হয়।
এ অঞ্চলে পাহাড়ের ক্লিফ গুলিতে প্রচুর মৌচাক রয়েছে, আন্দাজ করা যায় ঐগুলি জায়েন্ট (Giant) /রক (Rock) মৌমাছির চাক। ওই মধুও দোকানগুলিতে বিক্রি হতে দেখেছি। এই অঞ্চলটিতে একটি মৌমাছি কেন্দ্রিক পর্যটন (Api-tourism) কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে, পাহাড়ের ক্লিফগুলি তে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ক প্রদর্শনীশালা গড়ে তোলা ইত্যাদি এই পর্যটনের কেন্দ্র হতে পারে। এরূপ মৌমাছি কেন্দ্রিক পর্যটন ইউরোপের একাধিক দেশে রয়েছে যা স্থানীয় মৌমাছি পালনকে তথা প্রাকৃতিক সংস্থানের বিকাশে সাহায্য করে এবং এর মাধ্যমে যে স্থানীয় আর্থিক বিকাশলাভ হতে পারে তা বলাই বাহুল্য।













কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন