সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
এর আগের পর্বে আমি আনদং-র জু-টোপিয়াম এবং স্তন্যপায়ী প্রাণী সম্বন্ধে একটু সরলীকৃত বিবরণ দিয়েছি। সেটি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন পর্ব-১।
এবার একটু সরীসৃপ (Reptiles; class: Reptilia) প্রাণীদের দিকে দৃষ্টিপাত
করা যাক। আনদং-র চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাঁদের সংগ্রহে অনেক সরীসৃপ প্রাণী এখানে প্রদর্শনের
জন্যে রেখেছেন। সরীসৃপ বলতে সাধারণভাবে কচ্ছপ, টিকটিকি, গিরগিটি, সাপ, কুমির
এসকল প্রাণীকে বোঝায়। বর্তমানে অবলুপ্ত ডাইনোসরও
কিন্তু এই সরীসৃপ শ্রেণীর অন্তৰ্ভূক্ত প্রাণীই ছিল। এই শ্রেণীর প্রাণীরা প্রথম সম্পূর্ণভাবে
স্থলে বসবাস করতে শুরু করে। একটু পরিষ্কার
করে বলি, এর পূর্বে উভচর শ্রেণীর প্রাণীরা জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে কোনো পর্যায়
জলে আবার কোনো পর্যায় স্থলে অতিবাহিত করে।
কিন্তু সরীসৃপ শ্রেণীর অন্তর্গত প্রাণীরা
এবার জল ছেড়ে স্থলে বসবাস করতে শুরু করে,
এবং এ জন্যে প্রয়োজনীয় শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনও তাদের দেহে লক্ষ্য
করা যায়। এরা ঠান্ডা রক্তের প্রাণী আর তাই সাধারণত একটু উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে এদের দেখা
যায়। এদের শরীরের চামড়ায় কোনো গ্রন্থি নেই,
কারোর কারোর লিম্ব (Limb;
হাত/পদ) থাকে,
আবার কারোর কারোর থাকে না। যে সকল সরীসৃপের লিম্ব থাকে, তা
সংখ্যায় দুই জোড়া এবং প্রতিটি পদ পাঁচটি আঙ্গুল বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এদের কানের জায়গায়
একটি ছোট ছিদ্র দেখতে পাওয়া যায়,
যা টিমপ্যানাম (Tympanum) নাম পরিচিত, এবং
সাধারণত এদের দেহে আঁশ (Scale) বর্তমান (তবে তা নানা প্রকারের)। আশা করি সরীসৃপ সম্বন্ধে একটা সহজ ধারণা দিতে পারলাম। এই সকল
সরীসৃপ ক্লাসটিকে বোঝার সুবিধার্থে কয়েকটি সাবক্লাসে বিভক্ত করা হয়ে থাকে, যা
মূলত খুলির (Skull) গঠনের উপর ভিত্তি করে। এস্থানে আমরা
জটিল বিষয়ের অবতারণা না করে সরলভাবে বোঝার চেষ্টা করবো এবং এই শ্রেণীর বহু প্রাণী বর্তমানে
অবলুপ্ত,
কাজেই সেই সকল প্রাণীর অবতারণা করে বিবরণটিকে দীর্ঘ করবো না। প্রথম সাবক্লাসটি হলো
এন্যাপসিডা (Anapsida) যার অন্তর্গত অর্ডারটি চেলোনিয়া
(Chelonia),
গ্রিক শব্দ 'Chelone'-র অর্থ
tortoise বা কচ্ছপ। কচ্ছপ বললেই সবাই ধারণা করতে পারে এদের শরীর
একটি শক্ত খোলার মধ্যে থাকে (উপরের ডরসাল (Dorsal) দিকটি যে শিল্ড
দিয়ে আবৃত তা ক্যারাপেস (Carapace) এবং ভেন্ট্রাল দিকটি যে প্লেট
দিয়ে আবৃত তা প্লাসট্রন (Plastron) নাম পরিচিত), দেহটি
উপবৃত্তাকার,
দুই জোড়া পা বর্তমান আর তাতে পাঁচটি করে আঙ্গুল
(Digits) আছে,
জলচর (সামুদ্রিক) কচ্ছপের ক্ষেত্রে সামনের পা দু'টি
প্যাডেলে অভিযোজিত হয়েছে,
এদের দাঁত নেই কিন্তু চোয়ালে একধরণের হর্নি প্লেট বর্তমান, খুব
ছোট একটি লেজ বর্তমান। শীতপ্রধান অঞ্চলে এরা ঠান্ডায় শীতঘুমে যায়।
এর পর আসি সাবক্লাস লেপিডোসাউরিয়া-য় (Lepidosauria)। ‘Lepis’ কথার অর্থ Scale বা আঁশ আর ‘Squaros’ কথাটির অর্থ Lizard/ লিজার্ড। এই সাবক্লাসের অন্তর্গত দু'টি প্রধান অর্ডার হলো রিনকোসেফালিয়া (Rhynchocephalia) এবং স্কোয়ামাটা (Squamata)। ‘Rhychos’ কথাটির অর্থ Beak বা চঞ্চু আর ‘Kephala’ কথাটির অর্থ মাথা। এর উদাহরণ হলো স্ফেনোডন/ টুয়াটারা (Sphenodon/ Tuatara)। এবার আসি স্কোয়ামাটা অর্ডারে। এর অর্থ আঁশযুক্ত, সকল লিজার্ড, আর সাপ এই অর্ডারভুক্ত প্রাণী। বৃহৎ এই অর্ডারটিকে কয়েকটি সাব-অর্ডারে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন ল্যাসেরটিলিয়া (Lacertilia), 'Lacerta' কথাটির অর্থ লিজার্ড। কাজেই সহজেই অনুমান করা যায় গেকো (Gekko), ড্রাকো (Draco), ক্যামেলিওন (Chamaeleon), মাবুয়া (Mabuya), ফ্যারিনোসোমা (Pharynosoma), হেমিড্যাকটাইলাস (Hemidactylus) ইত্যাদি এই সাব-অর্ডারের অন্তর্গত।
এরপর সাব-অর্ডার অফিডিয়া (Ophidia) বা সারপেন্টেস (Serpentes), সকল প্রকার সাপ এই বিভাগের অন্তর্গত। পরবর্তী সাব-অর্ডারটি হলো এমফিসবেনিয়া (Amphisbaenia), ওয়ার্ম লিজার্ড (Worm lizard) এর উদাহরণ।
উষ্ণ প্রধান হওয়ার দরুন আমাদের দেশে সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতন। গ্রাম বাংলায় সাপে কাটা, সাপে কাটায় মৃত্যু কথা প্রায়ই শোনা যেত, এখনও যায় তবে স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিকাঠামোর কিছুটা উন্নতি হওয়ায় কিছুটা কমেছে। এই সাপ নিয়ে প্রচুর কাহিনীও প্রচলিত রয়েছে , বলাই বাহুল্য অনেকাংশে তা অসত্য। যেমন সাপের মাথায় কোনো মণি থাকে না, এ কেবলমাত্র কল্পনা। যাইহোক, এ প্রসঙ্গ যখন উত্থাপিত হলো তখন কয়েকটি তথ্য এখানে পরিবেশন করি। আমাদের পৃথিবীতে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে এর মধ্যে কিন্তু অধিকাংশ নির্বিষ সাপ, বিষধর সাপ রয়েছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির। এই নির্বিষ সাপগুলি আবার সব সময় ক্ষতিকর নয় এমনটা কিন্তু নয়, যেমন পাইথন (Python), বিষ না থাকলেও শিকারকে এরা পেঁচিয়ে দম বন্ধ করে মেরে ফেলে গিলে নেয়। আর যেগুলি বিষধর সাপ সেগুলির মধ্যে প্রায় ২০০ টি সাপ রয়েছে যাদের কামড়ে মানুষের ক্ষতি এমনকি মৃত্যু হতে পারে। কাজেই সাপে কাটলে সময় নষ্ট না করে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছনো উচিত।
আমরা প্রায়ই সাপকে তার দুইভাগে বিভক্ত জিহ্বাকে বার করতে দেখি, কেন
তারা এটা করে?
সাপের নাসারন্ধ্র (Nostril) বর্তমান। এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে
এবং গন্ধ অনুভবের জন্যে ব্যবহৃত হয়। বারবার জিহ্বাকে বার করে সাপ আশপাশের বায়ুমণ্ডল
থেকে রাসায়নিক পদার্থের কণা সংগ্রহ করে, তারা যখন জিহ্বাকে মুখের
ভিতরে ঢোকায় তখন তাতে লেগে থাকে কণাগুলি অলফ্যাক্টরি
(Olfactory) সেন্টারে,
যা জ্যাকবসন'স অর্গান (Jacobson’s organ) নাম পরিচিত, যায়
এবং বিশ্লেষিত হয়। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা আশেপাশে কোনো খাদ্য রয়েছে কিনা বা পরিবেশ
নিরাপদ কিনা তা বুঝতে পারে। চোখের সামনে অবস্থিত পিট হোলের
(Pit holes) মাধ্যমে উষ্ণ রক্তের প্রাণী থেকে বেরিয়ে আসা উষ্ণ তরঙ্গকে
অনুভব করতে পারে। আবার নিচের চোয়াল স্থিত হাড়গুলি ছোট স্তন্যপায়ী রোডেন্ট ইত্যাদি প্রাণীদের
চলাফেরায় যে কম্পন উৎপন্ন হয় তা উপলব্ধি করতে পারে। এইভাবে তারা শিকার ধরে। সাপের কানের পর্দা (Eardrum) নেই, তবে
তাদের অন্তঃকর্ণের (Inner ear) সুগঠিত, ককলিয়া
(Cochlea) বর্তমান এবং অন্তঃকর্ণ চোয়ালের হাড়গুলির সাথে সংযুক্ত। কম্পন অনুভবের মাধ্যমে এরা শুনতে পায়।
এবার একটু সাপের বিষদাঁতের (Fang) কথায় আসা যাক। সাপেদের প্রায় ১৫ টি ফ্যামিলি রয়েছে কিন্তু তার
মধ্যে বিষধর সাপের মাত্র পাঁচটি ফ্যামিলির অন্তর্গত। এরা ভাইপারিডি
(Viperidae),
এট্রাকটাসপিডিডি (Atractaspididae),
ইলাপিডি (Elapidae),
কলুব্রিডি (Colubridae) এবং হোমালোপসিডি (Homalopsidae)। ভাইপারিডি (রাটেল স্নেক
(Rattlesnake),
ভাইপার (Viper),
পিট্ ভাইপার (Pit viper)) এবং এট্রাকটাপিডিডি (মোল ভাইপার
(Mole viper),
স্টিলেটো স্নেক (Stiletto
snakes)) ফ্যামিলির সাপেদের বিষদাঁতটি বেশ লম্বা নলাকার, এবং
এর আগায় একটি ছিদ্র থাকে যা দিয়ে বিষ শিকারের শরীরে প্রবেশ করে। ইলাপিডি ফ্যামিলির
সাপেদের, যাদের মধ্যে রয়েছে কোবরা,
মাম্বা,
সামুদ্রিক স্নেক,
বিষদাঁতটি তুলনায় একটু ছোট, নলাকার এবং চোয়ালের সাথে
ভালোভাবে যুক্ত, এবং এর আগায় ছিদ্র থাকে যা দিয়ে বিষ শিকারের
উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়। কলুব্রিডি (সর্ববৃহৎ ফ্যামিলি, বুমস্ল্যাং
(Boomslang),
ট্রি-স্নেক (Tree sanke) এদের
উদাহরণ) এবং হোমালোপসিডি (ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান জলের সাপগুলি এদের উদাহরণ) ফ্যামিলিভুক্ত
সাপগুলির বিষদাঁত মুখের পিছনের দিকে থাকে এবং এতে একটি গ্ৰুভ দেখা যায়। এবার যদি বিষের
রাসায়নিক ক্রিয়ার উপর দৃষ্টিপাত করা যায়, তবে দেখা যাবে সাপের বিষ
সাধারণত তিন প্রকারের হয়ে থাকে। সাধরণত, কিছু
ব্যতিক্রম থাকলেও,
ভাইপারিডি,
এট্রাকটাপিডিডি সাইটোটক্সিক (Cytotoxic;
কোষের জন্যে বিষাক্ত),
ইলাপিডি নিউরোটক্সিক (Neurotoxic; নার্ভের জন্য বিষাক্ত),
কলুব্রিডি এবং হোমালোপসিডি হিমোটক্সিক (Hemotoxic;
রক্তের কোষের জন্যে বিষাক্ত) বিষ নির্গত করে।
অপর গুরুত্বপূর্ণ সাব-ক্লাসটি হলো আর্কোসাউরিয়া (Archosauriya) যার অন্তর্গত অর্ডারটি ক্রোকোডিলিয়া (Crocodilia) বা
লোরিক্যাটা (Loricata)। কুমির (Crocodile),
ঘড়িয়াল (Ghorial),
এলিগ্যাটার (Alligator) এর উদাহরণ। এই ছোট চিড়িয়াখানাটিতে
কোনো কুমির বা এলিগ্যাটার রাখা নেই, তবে আমাদের দেশে এদের প্রাচুর্য্য
রয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: এই বিবরণেও ব্যবহৃত ছবিগুলির অধিকাংশ আমার স্ত্রীর তোলা, তাঁর থেকে সেগুলি আমি সংগ্রহ করেছি।
সেপ্টেম্বর, ২০২১





কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন