সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
পূর্বের পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙালীর ইতিহাস' গ্রন্থে প্রাচীন বাংলায় বাঙালির খাদ্যতালিকায় ডালের
অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। নদী মাতৃক জল-বহুল বাংলায় মাছের আধিক্যের কারণে মানুষের প্রয়োজনীয়
প্রোটিনের চাহিদা মাছের মাধ্যমে মিটে যাওয়ায় ডালের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়নি। আবার বাংলায় ডাল
খাওয়ার ভিন্ন রীতি দেখা যায়। যেমন ফরিদপুর এবং বরিশালের (অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত)
মানুষ ভাত, তরকারী, এমনকি আমিষ পদ গ্রহণের পর ডাল গ্রহণ করতেন। আবার কিছু মানুষের, যাঁদের পূর্বপুরুষের আদি বাসস্থান কুমিল্লা জিলায় (অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত), কাছ থেকে জানতে পেরেছি তাঁরাও ডাল সব পদ খাওয়ার পরেই খেয়ে থাকেন। সময় বদলেছে, বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডাল খাদ্যতালিকায় একটি
প্রধান পদ বলেই বিবেচিত হচ্ছে।
তবে সমগ্র ভারতবর্ষের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা
যাবে ডাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য, তা সে ভাত-ডাল- তরকারী
হোক বা ডাল-রোটি। ডাল পুষ্টি উপাদান বিশেষত প্রোটিনের উৎস। তথ্য পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ভারতবর্ষের
প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষ নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন (Maurya et
al., 2022)। কাজেই ডালের গুরুত্ব সেক্ষেত্রে (নিরামিষ আহারের
ক্ষেত্রে) আরো বৃদ্ধি পায় কারণ নিরামিষ আহারের তালিকায় এটি একটি প্রধান প্রোটিনের উৎস। এবার আমাদের দেশে প্রচলিত
কয়েকটি প্রধান ডালের তালিকা দেখে নিই। যদিও এর মধ্যে সয়াবিনের ব্যবহার ডাল হিসেবে ভারতবর্ষে
খুব একটা বেশি হয় না। প্রধানত খাদ্যোপযোগী তেল উৎপাদনের জন্যে এর ব্যবহার অধিক হয়ে
থাকে। তবে সোয়া চাঙ্ক বা সোয়া বড়ির চল বেশ আছে।
Table 1: ভারতবর্ষে প্রচলিত কয়েকটি ডাল
|
বাংলা/স্থানীয় নাম |
ইংলিশ নাম |
বিজ্ঞানসম্মত নাম |
|
অড়হর/তুর |
Pigeon pea |
Cajanus cajan |
|
কুলথি |
Horse gram |
Dolichos
uniflorus Macrotyloma
uniflorum |
|
খেসারি |
Grass pea |
Lathyrus sativus |
|
ছোলা/চানা |
Chick pea |
Cicer arietinum |
|
মটর/কড়াইশুঁটি |
Pea |
Pisum sativum |
|
মথ/মাটকি |
Moth bean |
Vigna
aconitifolia |
|
মসুর/মুসুরি |
Lentil |
Lens culinaris |
|
মাসকলাই/উর্দ |
Black gram |
Vigna mungo |
|
মুগ |
Green gram/Mung |
Vigna radiata |
|
রাজমা |
Kidney bean |
Phaseolus
vulgaris |
|
লোবিয়া/চৌলি |
Cow pea |
Vigna unguiculata |
|
বাকলা |
Faba bean |
Vicia faba |
|
সয়াবিন |
Soybean |
Glycine max |
|
সেম/ভাল |
Lablab bean |
Lablab purpureus |
ডালের ব্যবহার যে প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে চলে
আসছে তা ঋগবেদ বা পরবর্তী বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে ডালের উল্লেখ থেকে বোঝা যায়। যেমন ঋগবেদে এবং পরবর্তী কালে যজুর্বেদে 'খালওয়া' ('Khalva') কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে 'কালায়া' ('Kalaya') এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রে 'চানাকা' ('Chanaka') বলে যা উল্লেখিত হয়েছে তা চানা ডাল। আবার তুর
বা অড়হর ডালকে চরক এবং সুশ্রুত 'আধাকি' ('Adhaki') বলে উল্লেখ করেছেন, বৌদ্ধসাহিত্যেও এর উল্লেখ রয়েছে। কৌটিল্য 'অর্থশাস্ত্রে'
একে ‘উদারা’ ('Udaara') বলে উল্লেখ করেছেন (Nene, 2006)
ডালের ব্যবহার এদেশে অত্যন্ত প্রাচীন হলেও সকল প্রকার ডালের উৎপত্তি ভারত বা ভারতীয় উপমহাদেশে নয়। যেমন চানা বা ছোলার ডালের উৎপত্তিস্থল তুর্কি-সিরিয়া অঞ্চল, মসুর বা মুসুরির ডালের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, মটর এবং খেসারির ডালের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ ইউরোপ। বাকলা পশ্চিম এশিয়া, আবার লোবিয়া বা চৌলি পশ্চিম আফ্রিকাতে উৎপন্ন হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে। অন্যদিকে অড়হর, কুলথি, মথ বা মাটকি, মুগ ইত্যাদি ডালের উৎপত্তিস্থল ভারতীয় উপমহাদেশ (Nene, 2006; Fuller and Harvey, 2006)। Fuller and Harvey (2006) বৈজ্ঞানিক আর্টিকেলটিতে বিভিন্ন সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকার ডালের নিদর্শনের তালিকা উপস্থাপিত হয়েছে।
এই পর্যন্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেলো যে ডাল খাওয়ার প্রবণতা প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে রয়েছে। এবার বর্তমান সময়কালের প্রতি দৃকপাত করা যাক।
যদি বর্তমানে ভারতবর্ষের ডালের উৎপাদনের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তবে দেখা যায়, গত দুই দশক ধরে বিভিন্ন ডাল উৎপাদনের কৃষিজমি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও মুসুরির ডালের ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয় (Figure 1)।
Figure 1: ২০০০ টি ২০২০ পর্যন্ত ফসল (Pulses ) অনুসারে কৃষিজমি আয়তনের হিসাব (Food and Agriculture Organisation হইতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে Source: FAOSTAT)
অন্যদিকে, চানা, মটর, অড়হর ডালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও মুসুরির ডালের উৎপাদন খুব একটা বৃদ্ধি পায়নি (Figure 2)। সয়াবিনের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা বিভিন্ন সময় উপর-নিচ হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ডালের (যা উল্লেখিত হয়নি আলাদাভাবে) সমগ্রভাবে উৎপাদন খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি।
Figure 2: ২০০০ টি ২০২০ পর্যন্ত ফসল (Pulses ) অনুসারে উৎপাদনের হিসাব (Food and Agriculture Organisation হইতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে Source: FAOSTAT)
ডাল উৎপাদনে ভারতবর্ষ অগ্রগণ্য, এমনকি সর্বাধিক উৎপাদনশীল হলেও, উৎপাদন থেকে চাহিদা অধিক হাওয়ায় আমদানি করতে হচ্ছে (John et al., 2021; Mishra et al., 2021)। যদি উৎপাদন বৃদ্ধি না পায় তবে উত্তরোত্তর চাহিদা আর উৎপাদনের এই ফাঁক বৃদ্ধি পেতে পারে তা বলাই বাহুল্য। পরবর্তী অধ্যায়ে ডালের পুষ্টি গুণ সম্বন্ধে আলোচনা করবো।
তথ্য সহায়তা (References)
Fuller, D.Q.; Harvey,
E.L. 2006. The archaeobotany of Indian pulses: identification, processing and
evidence for cultivation. Environmental Archaeology 11: 219-246. https://doi.org/10.1179/17963106x123232
John, A.T.; Makkar,
S.; Swaminathan, S.; Minocha, S.; Webb, P.; Kurpad, A.V.; Thomas, T. 2021.
Factors influencing household pulse consumption in India: A multilevel model
analysis. Global Food Security 29: 100534. https://doi.org/10.1016/j.gfs.2021.100534
Maurya, S.; Tripathy,
A.K.; Verma, S.P.; Ali, W.; Shukla, S. 2022. Assessment of baseline nutritional
status, vitamin B12, and folate levels in patients with acute leukemia and
their effect on initial treatment outcome: A prospective observational study.
Indian Journal of Medical and Paediatric Oncology 43(2): 171-176. https://doi.org/10.1055/s-0042-1742665
Mishra, P.; Yonar, A.; Yonar, H.; Kumari, B.; Abotaleb, M.; Das, S.S.; Patil, S.G. 2021. State of the art in total pulse production in major states of India using ARIMA techniques. Current Research in Food Science 4: 800-806. https://doi.org/10.1016/j.crfs.2021.10.009
Nene, Y.L. 2006.
Indian pulses through millennia. Asian Agri-History 10(3): 179-202.
নীহাররঞ্জন রায় (বাংলা ১৩৫৬)। বাঙ্গালীর ইতিহাস। দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা।




















