পৃষ্ঠাসমূহ

ঊড়িষ্যার কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদ: আমার অভিজ্ঞতা (Some special food items in Orissa: My experience)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পড়াশুনা বা কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে থাকার সুযোগ আমার হয়েছে, সেই সুবাদে বিভিন্ন স্থানের খাদ্যবস্তুগুলির স্বাদ গ্রহণ আমি করেছি। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এমনকি কখনও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন রকমের খাদ্য গ্রহণের প্রচলন রয়েছে। এই ব্লগটিতে আমি আমার অভিজ্ঞতার ঊড়িষ্যার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থানীয় খাদ্যের কথা বলবো।

জীবনের কয়েক বৎসর আমি ঊড়িষ্যা রাজ্যে কাটিয়েছি, সে প্রায় বছর পনেরো-কুড়ি আগের কথা। অনেক মানুষ জগন্নাথদেব দর্শনের উদ্দেশ্যে পুরী বেড়াতে যান, তাঁরা নিশ্চয়ই ভগবানের মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেছেন। পুরী শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁতে উড়িষ্যার খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করেছেন। কলকাতা শহরে অনেক পাইস হোটেল রয়েছে যেখানে ওড়িয়া ঠাকুর রান্না করেন। রান্নার কাজে ওড়িয়া ঠাকুর বেশ দক্ষ, ক্যাটারিঙে বা হোটেলে রান্নার জন্যে তাঁদের চাহিদা বেশ। বাংলা সাহিত্যেও এর অনেক উল্লেখ রয়েছে। যাইহোক, আমি থাকতাম গঞ্জাম (Ganjam) জেলার ব্রহ্মপুর বা বেরহামপুর (Berhampur) শহরে, দক্ষিণ ঊড়িষ্যার একটি শহর। বিভিন্ন ধরণের আচার আর পাঁপড়ের জন্যে এ শহর প্রসিদ্ধ। তবে যতদিন সেই শহরে আমি থেকেছি, কোনোদিনই আমি তা কিনিনি। পরে যখন সেই শহরে কোনো কাজে গিয়েছি তখন তা কিনেছি, এবং সেগুলির স্বাদ গ্রহণ করে পরিচিত মহলে যথেষ্ট প্রসংশা করেছি। বেরহামপুর বসবাসের সময় অধিকাংশ দিনই প্রাতঃরাশ করা হতো না, ছুটির দিনে যেদিন তা সম্ভব হতো তা ছিল পাড়ার দোকানের শালপাতার ঠোঙ্গায় তিনটি ছোট আকারের আটার পুরি, আলুর তরকারী, আর এক হাতা উপ্মা। এর দাম ছিল পাঁচ টাকা। যদি কেউ উপ্মা না নিতেন তবে দোকানি তাঁকে পাঁচটি পুরি দিতেন। কখনও দোকানে বসে খেয়ে আসতাম আবার কখনও যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেখানে জেঠিমা যদি তাঁদের বাড়ির জন্যে আনতে দিতেন তবে আমিও আমার খাবার নিয়ে বাড়িতেই আসতাম। তবে দোকানে দাঁড়িয়ে খাওয়ার একটা সুবিধা ছিল, ক্রেতা চাইলে দোকানি আরও একবার তরকারী দিতেন। প্রাতঃরাশের অন্যান্য পদও ছিল যেমন ইডলি, বড়া ইত্যাদি। তবে স্থানীয় মানুষ অধিকাংশ সময়ে 'পাখালা' দিয়ে প্রাতঃরাশ সারেন। ঊড়িষ্যার প্রচন্ড গরমে এই 'পাখালা' খুবই কার্যকারী। পাখালা ছাড়া ওড়িশার খাবার অসম্পূর্ণ। আমাদের যেমন পান্তাভাত ঠিক তেমনই ওড়িশার মানুষের 'পাখালা ভাত'। যদিও আমি এই পদটি ওড়িশাতে কখনও খাইনি তবে আমার বন্ধুদের মুখে শুনেছি, আমাদের ভাড়া বাড়ির জেঠিমাদেরও খেতে দেখছি। পাখালা প্রধানত দুই রকমের হয়, ১. ভাতে জল এবং টক দই দিয়ে  সারারাত ধরে রাখা হয়, এতে খাবারটি ফার্মেন্ট (Ferment) হয়, একে বাসি পাখালা বা কখনও দই পাখালা বলা হয়; ২. অপরটি হলো সাজা পাখালা, এ ক্ষেত্রে ফার্মেন্ট করা হয় না, ভাতে টকদই আর জল যোগ করে পেঁয়াজ, লঙ্কা  এবং বড়ি সহযোগে খাওয়া হয়।

চা আমি সেই সময় বিশেষ খেতাম না, তবে বিকেলে একটি পাড়ার চায়ের দোকানে নিয়মিত বন্ধুদের সাথে যেতাম, অধিকাংশ দিনই আমি কিছু স্থানীয় বেকারির বিস্কুট কিনে খেতাম। সান্ধ্যকালীন খাবারের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল ব্রেড চপ, বাঁধাকপির কাটলেট, সিঙ্গাড়া ইত্যাদি। এখানে প্রতিটি পদের সাথে তরকারি পরিবেশন করা হয়। চপগুলি ভেঙে তরকারী দিয়ে মেখে খাওয়াটাই এখানে রীতি।

দুপুরে বেশিরভাগ দিন কলেজে থাকার কারণে দুপুরের খাবার প্রায় হতোই না বলা চলে, তবে বিকেলের দিকে বেশ খিদে পেতো, তখন বেশ ভারি কিছু খাবার খেতাম। পাড়ার মোড়ের কাছে একটি রেস্তোরাঁ ছিল, সেখানে সাত টাকায় একটি মশলা দোসা পাওয়া যেত সেই সময়ে, এটা বেশ উপাদেয় ছিল আমার কাছে। সেই দোকানটির সামনে দিয়ে বড়ো রাস্তাটি গিয়েছে, রাস্তার অপর পাড়ে একটি মিষ্টির দোকান ছিল সেখানে দশ টাকায় একটি বড়ো গ্লাস লস্যি পাওয়া যেত, দোকানি লস্যির উপরে নারিকেল কুড়োনো, কাজু-কিশমিশ-আলমন্ডের টুকরো ইত্যাদি দিতেন, এটা সুস্বাদু তো ছিলই এবং উদরপূর্তিও করতো। এখানে একটা কথা বলি, দোকানি লস্যির গ্লাসে শুকনো ফলের টুকরোর সাথে লাল রঙের চেরীও দিতেন, তখন যেটি চেরী বলে জানতাম তা বোধ করি করমচা-কে চিনির রস আর লাল রং সহযোগে প্রস্তুত করা এক ধরণের বস্তু। আমি প্রকৃত চেরী নামক ফল কখনও আমার দেশে দেখিনি (পাওয়া যায় নিশ্চয় তবে আমার চোখে তা পড়েনি), তা দেখছি বাইরের দেশে। চেরী ফল আর যা আমাদের দেশে চেরী বলে কেক, সন্দেশ বা লস্যিতে দেওয়া হয় তাদের মধ্যে কোনোরূপ সাদৃশ্য নেই, তা বলাই বাহুল্য। পানীয়র কথা যখন উঠলোই, একখানি ঘটনা উল্লেখ করি। 

একবার রেলগাড়িতে চলেছি বেরহামপুরে, রেলস্টেশনের নাম ব্রহ্মপুর। সকাল ৭ টা ২০ তে হাওড়া ছেড়ে সন্ধ্যে সাড়ে ৫ টা নাগাদ নামিয়ে দেবে গন্তব্যে। গরমকাল, তাপমাত্রা প্রায় ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আশেপাশে। রেলের কামড়া-র পাখাগুলো চললেও তা যে খুব যুৎসই হচ্ছে তা না, তারপরে এটি অনারক্ষিত কামড়া, কাজেই বেশ ভিড়। চিল্কা হ্রদটি ছাড়িয়ে একটু পরে ট্রেনটি পড়ল দাঁড়িয়ে, এ ঘটনা ভারতীয় রেলের জন্যে বিছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা যাত্রীরাও এটি অভ্যেস করে নিয়েছি। এমনকি  নিত্য যাত্রীরা তো জানেন ঠিক কোনখানে ট্রেনটি দাঁড়াবে বা ধীরে চলবে, সেই মতন তাঁরা নামার পরিকল্পনাও করে রাখেন।  যাইহোক, এই ঘটনাটি সেই বর্ণনা নয়। ট্রেন তো দাঁড়িয়ে পড়লো, ভুবনেশ্বরের পর ভিড়টা একটু পাতলা হয়েছে। একজন আদিবাসী বৃদ্ধা উঠে এলেন কামড়ায়, ঘোল বেচতে এসেছেন। গলা শুকিয়ে গেছিলো, এক গ্লাস ঘোল ৫ টাকায় বিক্রি করছিলেন। মাটির পাত্র করে এনেছেন, আর স্টিলের গ্লাসে দিচ্ছেন, খেয়ে সেটা ফেরত দিয়ে দিতে হবে। আমিও কিনলাম এক গ্লাস, গলায় ঢেলে প্রাণ ঠান্ডা হলো কিছুটা, আমি পয়সা দিয়ে দিলাম। বৃদ্ধা সেটি নিয়ে রেখে দিলেন, আবার আমার গ্লাসটায় ঘোল ঢেলে দিলেন কিন্তু আর পয়সা নিলেন না। আমার বুদ্ধি পরিণত হতে সময় লেগেছে, এটা আমি জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোকে দেখে বুঝতে পারি। আমি জোর করেও পয়সাটা দিতে পারতাম হয়তো, কিন্তু দু'বার বলার পরে সে যখন নিল না আমি রেখে দিলাম। এটাই ভারতবর্ষের আসল রূপ। এই রূপ আমি দেখেছি প্রতিনিয়ত, আজ অনেকটা দিন পেরিয়ে এসে পৃথিবীর অতি আধুনিক শহরের জীবনের মাঝেও তাই প্রায়ই মন চলে যায় দেশে, ফিরে পেতে চায় সেই মানুষগুলোকে, যাঁদের মানবিকতাই এই সভ্যতার ভিত্তি।

আবার অনেক দিন বিকেলে আমরা বন্ধুরা বেড়াতে বেরোতাম, কখনো পুরোনো আবার কখনো নতুন বাস স্ট্যান্ডে। সেই স্থান গুলিতে অনেক রেস্তোরাঁ ছিল, বেরহামপুর খুব যে খরচ বহুল স্থান ছিল তা একেবারেই নয়, তবে সেইটুকুও সর্বদা আমাদের সাধ্যের মধ্যে ছিল না। কাজেই রেস্তোরাঁতে প্রবেশের পূর্বেই আমরা খাবারের দাম জেনে নিতাম। পনেরো-কুড়ি টাকা প্রাতঃরাশ বা বিকেলের খাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বেশি বলেই আমরা সাধারণত গণ্য করতাম। ছুটির দিনে দুপুরে বা প্রত্যহ রাত্রির আহারের ক্ষেত্রে বারো থেকে পনেরো টাকা যথেষ্ট বলে আমরা হিসাব করতাম। প্রত্যহ রাত্রে আমরা বড়ো রাস্তার উপর একটি নির্দিষ্ট হোটেলে খেতে যেতাম, এটি 'ভাইনা'র দোকান বলেই আমাদের কাছে পরিচিত ছিল। ওড়িয়া ভাষায় বড়োভাই কে ভাইনা বলে হয়, দোকানি আমাদের বাবার বয়সী হলেও আমরা তাকে ভাইনা বলেই সম্বোধন করতাম। বারো টাকায় স্টিলের থালার উপর শালপাতায় পেট ভোরে ভাত, ডাল, কিছু একটা ভাজা (প্রধানত আলু), আর মাছের ঝোল পাওয়া যেত। ওখানে মাছের টুকরোকে ব্যাসনের প্রলেপ লাগিয়ে ভাজে যাতে মাছ ভেঙে না যায়। প্রায়ই ভাইনা ফ্রি তে মাংসের ঝোল, কখনও এক টুকরো মাংস দিয়ে যেতেন আমার বন্ধুদের, সেই সময় আমি কোনোপ্রকার মাংস খেতাম না।পনেরো টাকায় দুটি ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত পাওয়া যেত, কখনও কখনও আমি সেটি খেতাম। কুড়ি টাকায় পাওয়া যেত মাংস ভাত। তবে সকল দিন যে আমিষ পাওয়া যেত তা নয়, সপ্তাহের তিন চারদিন আমিষ পাওয়া গেলেও বাকিদিনগুলিতে নিরামিষ আহার পাওয়া যেত, দাম ছিল দশ টাকা। মাঝে মধ্যে আমি আর আমার এক বন্ধু তন্দুর রুটি, ডিমের ওমলেট আর পাহালের রসগোলা কিনে আনতাম রাত্রের খাওয়ার জন্যে। কয়েক বৎসর পূর্বে ঊড়িষ্যা আর বাংলার মধ্যে রসগোল্লার মধ্যে G.I. tag (Geographical Indications tag) নিয়ে একটি লড়াই চলেছিল। বাংলা বলল, ছানা, সুজি, আর চিনির রস উপকরণগুলির সাহায্যে ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে নবীন চন্দ্র দাস রসগোল্লা প্রথম প্রস্তুত করেন। অপরপক্ষে, ঊড়িষ্যা রসগোলার উৎপত্তি বলতে এগারোশো শতাব্দীর কথা উল্লেখ করল, পঞ্চদশ শতকের কবি বলরাম দাসের লেখায় রসগোলা-র উল্লেখ রয়েছে বলে জানালো। কথিত রয়েছে মন্দিরের পুরোহিত পাহাল গ্রামবাসীকে দুধ থেকে ছানা এবং তা দিয়ে রসগোলা সহ ভিন্নভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রস্তুত করা শেখান। আমি এই দুটি মিষ্টিই অনেকবার খেয়েছি, দুইটিই সুস্বাদু, স্বাদ স্বতন্ত্র এবং নামে একরকমের হলেও এদের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বিদ্যমান। দু'টি রাজ্যই সঠিকভাবে তাদের দু'টি মিষ্টির জন্যে G.I. tag পেয়েছে। বাংলার রসগোল্লা যেমন সাদা বর্ণের হয়, ঊড়িষ্যার রসগোলা হয় হালকা বাদামি বর্ণের। বাংলার রসগোল্লা স্পঞ্জি হয়, ঊড়িষ্যার রসগোলা হয় নরম, ভাঙলে আপনি নরম অংশটি দেখতে পারবেন এবং অনুভব করতে পারবেন, রসগোলাটি স্পঞ্জি নয়। স্বাদের দিক থেকেও পার্থক্য স্পষ্ট বোঝা যায়, বাংলার রসগোল্লা ঊড়িষ্যার রসগোলার থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক মিষ্টি হয়। যাঁরা ঊড়িষ্যায় বেড়াতে যাবেন তাঁরা পাহালের রসগোলা খেয়ে দেখলে সঠিকভাবে বুঝতে সমর্থ হবেন। তবে বাংলায় যেমন রসগোল্লা বাংলার খাদ্যের একটি অন্যতম প্রতীক বলে বিবেচিত হয়, ঊড়িষ্যায় কিন্তু রসগোলা সেরূপ নয় বরং ছানা পোড়া বা 'ছেনা পুড়ো' তুলনামূলক একটি অনেক প্রসিদ্ধ মিষ্টি। এর ইতিহাস কিন্তু অধিক প্রাচীন নয়, বিংশ শতাব্দীতে এটি আবিষ্কৃত হয়। ছানাকে, চিনি, দারুচিনি গুঁড়ো, সুজি সহযোগে শাল বা কলাপাতায় বেঁধে কয়লার উনুনে ৩ থেকে ৪ ঘন্টায় ছানা পোড়া প্রস্তুত হয়। আমি একাধিকবার পুরীতে বেড়াতে গিয়ে এর স্বাদ গ্রহণ করেছি তবে বেরহামপুরে তা কখনও খেয়েছি বলে মনে পরে না।     

বেরহামপুরের মানুষের মাতৃভাষা ওড়িয়া, তবে সেখানে অনেক তেলুগুভাষী মানুষও বাস করেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন সম্প্রদায়, ভাষার মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহজেই একে ওপরের বন্ধু পরিজন হয়ে ওঠেন আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সহপাঠীদের বাড়ির অনুষ্ঠানে, পাড়ার কোনো বাড়ির অনুষ্ঠানে তাঁরা আমাদের নিমন্ত্রণ করতেন। একাধিক অনুষ্ঠান বাড়িতে আমি গিয়েছি, বেশিরভাগই বিয়ে বাড়ি। এখানে বিয়ে বাঙালিদের মতন রাত্রে হয়না, দিনের বেলায় হয়, অনেকক্ষেত্রে আবার মন্দিরে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, বিয়েতে নিরামিষ আহার-ই হয়ে থাকে। আমি স্থানীয় বন্ধুদের থেকে শুনেছি বামুন ঠাকুর রাঁধেন অনুষ্ঠান বাড়িতে। এখানে দু'টি পদের কথা উল্লেখ করি, একটি হলো নবরত্ন কোর্মা, অপরটি 'দই- বাইগনা' (দই-বেগুন), এই দু'টি পদ-ই প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানের আহারে থাকে। নবরত্ন কোর্মা অত্যন্ত সুস্বাদু একটি পদ, আমি অনেক রেস্তোরাঁতে এই পদটি দেখেছি। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য পদের মধ্যে রয়েছে দই-ভেন্ডি (দই-ঢ্যাঁড়শ), 'খাজুরি-খাট্টা' (খেজুর, টম্যাটো দিয়ে একটি টক মিষ্টি পদ), 'আম্ব খাট্টা' (আমের টক) ইত্যাদি। এর পর আসি ওপর একটি পদের বিবরণে, এর নাম 'ডালমা'। ডাল, প্রধানত অড়হর বা তুরের ডালে বিভিন্ন প্রকার সব্জি যেমন কুমড়ো, কাঁচকলা, বেগুন, লাউ, পেঁপে ইত্যাদি ছোটছোট করে কেটে দিয়ে একসাথে রান্না করা হয়। এটি ডালমা নাম পরিচিত। এতে পাঁচ ফোড়ন ব্যবহার করা হয়। সরিষার ব্যবহার ঊড়িষ্যা রাজ্যে খুবই ব্যবহার হয়, এখানে আমি শুকনো সরিষা গুঁড়ো করে ব্যবহার করতে দেখেছি। আমি জীবনে প্রথমবার মাশরুম খেয়েছি বেরহামপুর শহরে। প্রথমদিকে আমি যে মেসটিতে থাকতাম, তার অদূরে একটি হোটেলে প্রথবার আমি এটি খেয়েছিলাম। ঊড়িষ্যায় মাশরুমকে ছাতু বলি, আমরা বাঙালিরা বলি ছাতা বা ব্যাঙের ছাতা। সরিষা দিয়ে রান্না করা মাশরুমের পদটির নাম 'ছাতু রাই'। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন শাক যেমন পালং, পুঁই, লাল, কলমি, সজনে, সরিষা, মেথি, মটর ইত্যাদি।

এবার আসি জগন্নাথ দেবের মহাপ্রসাদের বিষয়ে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে ভগবান বিষ্ণু রামেশ্বরমে স্নান সেরে, বদ্রীনাথে ধ্যান করে, দ্বারকায় বিশ্রাম নিয়ে পুরীতে আসেন আহার করতে। প্রত্যহ জগন্নাথদেবকে ৫৬ পদ দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন করতে দেওয়া হয়। আবার মকর সংক্রান্তিতে পিঠে পুলি সহযোগে এই ৫৬ পদ বেড়ে ৮৪টি পদ হয়। এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলি, ভারতবর্ষে চাষবাসের জন্যে বৃষ্টির উপর নির্ভরতা ছিল ভীষণ মাত্রায়, তখন সেচ ব্যবস্থার প্রচলন খুব বেশি ছিল না বা  এতো উন্নত হয়নি। মানুষ ইন্দ্রদেবকে বজ্রপাত, বৃষ্টি ইত্যাদির দেবতা মান্য করতেন। কোনো বৎসর যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হলে কৃষিকাজ ভালো হতো আবার বৃষ্টিপাত না হলে বা আশানুরূপ না হলে কৃষির ক্ষতি হতো এমনকি খরা পর্যন্ত হতো। সঠিক বৃষ্টিপাতের জন্যে যেমন মানুষ ইন্দ্রদেবকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে পূজা করতেন তেমনই আবার বৃষ্টিপাত না হলে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে দেবতার উদ্দেশ্যে আরাধনা করা হতো। তা এমনই এক বৎসর বৃন্দাবনে খুব ভালো বৃষ্টিপাত হলো, কৃষিকাজ বেশ হলো, ঘরে ঘরে ফসল উঠলো, সকল ব্রজবাসীর মুখে হাসি ফুটলো। সকলে ঠিক করলেন যে ইন্দ্রদেবকে ধন্যবাদ দেবেন, তাঁকে পুজো করবেন, শুরু হলো ঘরবাড়ি পরিস্কার, গ্রাম সাজানো, সুস্বাদু সব খাবার প্রস্তুত ইত্যাদি। গ্রামের ছোট বালক কৃষ্ণ এসকল প্রতক্ষ্য করে বললো, 'এ বৃষ্টির জন্যে তোমার কেন ইন্দ্র দেবতাকে পুজো করছ? আকাশের মেঘ তো গোবর্ধন পর্বতের ঢালে প্রতিহত হয়ে এই স্থানে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে। কাজেই গোবর্ধন পর্বতের পুজো করা উচিত'। সকলে কৃষ্ণের বিদগ্ধতা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, তবু যেন একটু ভীত হলেন, কিন্তু অবশেষে মেনে নিলেন। গোবর্ধন পর্বতের পুজো শুরু হলো। এদিকে এসকল দেখে ইন্দ্রদেব তো খুব ক্রুদ্ধ হলেন, বৃন্দাবনে ভয়ানক বৃষ্টিপাত শুরু হলো, ঘরবাড়ি ডুবে গেলো, চাষের জমি ডুবে গেলো। ভীত সন্ত্রস্ত ব্রজবাসী এবার কি করেন, তাঁরা কৃষ্ণের সমীপে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ বললো তাঁরা যখন গোবর্ধন পর্বতের পুজো করার কথা ভেবেছেন তিনিই তাঁদের রক্ষা করবেন। বালক কৃষ্ণ সকল ব্রজবাসীকে নিয়ে গোবর্ধন পর্বতের সামনে উপস্থিত হলো, পর্বতকে উঠিয়ে একটি মাত্র আঙুলের সাহায্যে  ধরে রাখলো, সকল ব্রজবাসী পর্বতের তলায় আশ্রয় নিলেন। কৃষ্ণ এক নাগাড়ে পর্বতকে তুলে রেখেছেন দেখে ব্রজবাসী তাঁকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করলেন, ভাবলেন কৃষ্ণের বিশ্রামের সময় নিজেরা সেই পর্বতকে অনেকগুলি লাঠির সাহায্যে তুলে রাখবেন। কৃষ্ণ তাঁর আঙ্গুল একটু সরাতেই সব লাঠি ভেঙে গেল, পর্বত ভূমিতে আবার বসে যেতে লাগলো। কৃষ্ণ স্বয়ং পুনরায় পর্বতকে ধারণ করলেন। এদিকে কিন্তু ইন্দ্রদেবের ক্রোধ কিছুতেই কমে না, ক্রোধ সর্বদা চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দেয়, এক্ষেত্রেও তাই হলো, তিনি বজ্রপাত করলেন, বৃষ্টির ধারা আরও বৃদ্ধি করলেন, সাতদিন নাগাড়ে চললো এই অবস্থা কিন্তু বুঝতে পারলেন না কোনো সাধারণ বালকের পক্ষে বিশালাকায় এই পর্বতের ভার বহন শুধুমাত্র অসম্ভব নয়, এ কার্য কল্পনারও অতীত। শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করে গেলেন সমগ্র ব্রজবাসীকে। পরিশেষে হার মানলেন ইন্দ্রদেব, বুঝতে পারলেন এই বালক এই বিশাল পর্বত একটি হাতে তুলে রেখেছেন, তিনি স্বয়ং বিষ্ণু, ভুল বুঝতে পেরে নিজের অন্যায় স্বীকার করলেন। এই সাতদিন স্বয়ং ভগবান কোনো খাদ্যগ্রহণ করেননি।  তাই প্রতিদিন তিন ঘন্টা অন্তর আটবার (৩ ঘন্টা  x ৮ বার (বা প্রহর) = ২৪ ঘন্টায় এক দিন), এবং সাতদিন প্রতিদিন আটবার করে মোট ৫৬ বার ভগবান বিষ্ণু যে খাদ্যগ্রহণ করেননি, সেই কারণে এই ৫৬ রকমের ভোগ প্রস্তুত করার প্রচলন হয়। 

ঊড়িষ্যা রাজ্যে অনেক মন্দির রয়েছে যেখানে ভগবানের উদ্দেশ্যে যে ভোগ অর্পণ করা হয় মানুষ তাকে মহাপ্রসাদ বলে গ্রহণ করেন। এই ভোগের অপূর্ব স্বাদ বর্ণনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু যে এই স্থানের তা নয়, যে কোনো স্থানের ভগবানের উদ্দেশ্যে অর্পিত ভোগের খিচুড়ির স্বাদ আমার কাছে বাড়িতে বা দোকানে প্রস্তুত খিচুড়ির থেকে অধিক সুস্বাদু লাগে, তবে এর বৈজ্ঞানিক কারণ নিরূপণে বা বিশ্লেষণে আমি কখনও উৎসাহিত হইনি। ঊড়িষ্যা রাজ্যের বেশ কয়েকটি মন্দিরে ভোগের ক্ষেত্রে দেখেছি সেখানে পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা, ইত্যাদি যে সকল সব্জি বিদেশ থেকে আগত সেগুলির ব্যবহার হয় না। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অনেক হিন্দু সনাতন ধর্মের মানুষ পেঁয়াজ, রসুন খান না। আসলে টম্যাটো, আলু, লঙ্কা সহ বর্তমানে যে সকল সব্জি আমরা ব্যবহার করি তার মধ্যে অনেকগুলিই কিন্তু পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে পশ্চিমী বিদেশী বণিকদের মাধ্যমে আমাদের দেশে পৌঁছয়। মন্দিরগুলিতে ভোগ নিবেদনের রীতি এই সকল শাকসব্জির ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব থেকেই প্রচলিত। ভারতীয় রান্নাতে তাদের ব্যবহার প্রায় অপিহার্য হয়ে উঠলেও অনেক মন্দিরে এ সকল উপকরণ আজও অব্যবহৃত (অনুগ্রহ করে পড়ুন ভারতীয় রান্নার একটি গল্প)। এই মন্দিরগুলির ভোগে ব্যবহৃত শাকসব্জি থেকে আমরা সহজেই আমাদের খাদ্যরীতির একটি ধারণা করতে পারি। 

একটি কথা পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এখানে আমি ঊড়িষ্যা রাজ্যের আমার পরিচিত কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদের কথা বিবরণ করেছি। এছাড়াও অনেক পদ সেখানে অবশ্যই রয়েছে, অন্যান্য ভারতীয় পদগুলির পাশাপাশি মোগলাই, চাইনিজ, পশ্চিমী (পিজা-বার্গার ইত্যাদি) সকলই সহজেই পাওয়া যায়। তবে যতদূর মনে পরে, সেই সময়ে আমার কোনো পিজা বা বার্গারের দোকান স্মৃতিতে আসছে না।। যেহেতু সেই সময়ে আমি মাংস খেতাম না তাই সেই ধরণের কোনো খাবারের স্বাদ আমি পাইনি, তাই তার জন্যে উল্লেখ করিনি। বেরহামপুর তথা ঊড়িষ্যায় অনেক আদিবাসী মানুষ বসবাস করেন, দৈনিক বাজারে, রাস্তায় আমি তাঁদের দেখেছি, কথা বলেছি, একসাথে বাসে চড়ে যাতায়াত করেছি। তবে তাঁদের খাদ্যরীতির বিষয়ে আমার কোনো গবেষণার বা পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়নি, কোনো সুযোগ পেলে অবশ্যই আমি তা জানার চেষ্টা করবো। আশা করি, যাঁরা ওই রাজ্যে কর্মসূত্রে বা পর্যটনের উদ্দেশ্যে যাবেন তাঁরা নিশ্চয় ওই স্থানের খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ করবেন। 

প্রদত্ত চিত্রখানি আমাদের বাড়ির পান্তা ভাত, তবে আমরা খাওয়ার পূর্বে পান্তার সাথে ডাল মেখেছিলাম আর টক দই ব্যবহার করিনি। পাখালা ভাতের সাথে এর সাদৃশ্য থাকলেও এটি প্রকৃত পাখালা নয়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...