পৃষ্ঠাসমূহ

থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ (Thailand: Part-3)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্ব দু'টি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২

আজ খুব ভোরে, প্রায় ৫ টা নাগাদ, ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। বাইরে তখনও অন্ধকার, বারান্দায় এসে বসলাম, একটু পরে আলো ফুটবে। বেশ ভালো লাগে ভোর হওয়া দেখতে। ৬টা নাগাদ সবাইকে ডেকে দিলাম, প্রাত্যহিক কাজ সেরে ফ্রেশ হয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সাড়ে সাতটায় গাড়ি এলো আমাদের নিয়ে যেতে। আজ আমরা অনেকগুলি দ্বীপ ঘুরে দেখবো, সমুদ্র যাত্রা, সমুদ্রস্নান সবই হবে, কাজেই বাড়ি থেকে স্নান সেরে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।  

ভ্যান আমাদের নিয়ে আরও পর্যটক তুলতে তুলতে ফুকেট মেরিনা বে-তে (Phuket Marina Bay) উপস্থিত হলো। আমাদের নাম পূর্বেই অন্তর্ভুক্ত করা ছিল, গাইড তা পরীক্ষা করে নিয়ে আমাদের প্রাতঃরাশ সেরে নিতে বললেন। প্রাতঃরাশের জন্যে সেখানে নানান ধরণের কেক, বিস্কুট, চা, কফি, ক্যান্ডি ইত্যাদি ছিল। প্রায় আধ ঘন্টা পর আমাদের নির্দিষ্ট স্পিডবোটে ওঠানো হলো। গাইড ইংরাজিতে মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলেন। তিনি প্রথমেই যাত্রীদের স্বাগত করে আমাদের যাত্রার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন।

প্রথমেই আমরা এলাম খই দ্বীপপুপুঞ্জে বা 'কোহ খই'-তে (Koh Khai)। ফুকেটের পূর্বের উপকূল থেকে প্রায় ২৫ মিনিট দূরত্বে এই 'কোহ খই' (থাই ভাষায় 'কোহ' (Koh) কথাটির অর্থ দ্বীপ ) দ্বীপপুঞ্জটি তিনটি দ্বীপ, যথা কোহ খই নাই (Koh Khai Nai), কোহ খই নুই (Koh Khai Nui), এবং কোহ খই নোক (Koh Khai Nok) নিয়ে গড়ে উঠেছে। দ্বীপগুলি তাদের দুর্দান্ত শুভ্র বালুকাময় সৈকত এবং অবিশ্বাস্যভাবে স্বচ্ছ জলের জন্য জনপ্রিয়। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন এখানে রঙিন মাছের একটি ঝাঁক আপনার চারপাশে সাঁতার কাটতে এসেছে। প্রকৃতির এরূপ সাহচর্যে দিনের শুরুতেই মন ভরে উঠবে আনন্দে, গলা ছেড়ে গানও ধরতে পারেন।


ঘন্টা খানেক পর আমরা যাত্রা শুরু করলাম কোহ মাই ফাই-র (Koh Mai Phai) উদ্দেশ্যে, এটি ব্যাম্বু দ্বীপ (Bamboo island) নামে পরিচিত। পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্যগুলির একটি এই ব্যাম্বু দ্বীপ। দ্বীপটির জঙ্গলে ঝরা পাতার মধ্যে বাঁশ গাছ রয়েছে, যা থেকে এই দ্বীপের নামকরণ, তবে এখানে প্রচুর অন্যান্য গাছও রয়েছে। এটির চতুর্দিকে বেলাভূমি, সমুদ্রের স্বচ্ছ জলরাশি আপনাকে স্পর্শ করার জন্যে হাতছানি দেবে। আমরাও নেমে পড়লাম, কোহ খই তে সমুদ্রকে স্পর্শ করেছিলাম মাত্র, তবে এখানে সম্পূর্ণ সমুদ্রস্নান। এই জলে বালি নেই, এরূপ অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের জন্যে নতুন ছিল।  

এই দ্বীপের অন্যতম প্রধান কার্যকলাপ অবশ্যই স্নরকেলিং (Snorkeling)!  তবে সমগ্র ফি ফি দ্বীপ জুড়ে স্নরকেলিং উপভোগ্য। কাজেই সাথে স্নরকেলিং মাস্ক রাখা উপযোগী, লাইফ জ্যাকেট স্পীডবোট থেকে পাওয়া যায়। ফি ফি দ্বীপগুলির আরও কিছু হাইলাইট হল আশ্চর্যজনক পিলেহ লেগুন, মায়া উপসাগর এবং একে অপরের পাশে অবস্থিত ভাইকিং গুহা, দ্বীপ কোহ ফি ফি ডন এবং কোহ ফি ফি লেহ, মানকি বিচ এবং অবশ্যই, প্রধান আকর্ষণ হল সাদা বালি এবং স্বচ্ছ জল যা সুন্দর দ্বীপগুলোকে ঘিরে রেখেছে। 

ব্যাম্বু দ্বীপের পর আমাদের স্পিডবোটটি রওনা হলো ফি ফি ডন দ্বীপের (Koh Phi Phi Don) উদ্দেশ্যে, ফি ফি ডন ফি ফি দ্বীপপুঞ্জের (Phi Phi archipelago) মধ্যে সর্ববৃহৎ। এখানে আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজন।মধ্যাহ্ন ভোজনে ছিল বাফেটের আয়োজন, কত কি খাবার, সি-ফুড, পাস্তা, ভাত, ফ্রাইড রাইস, চিকেন, নুডলস, স্যুপ; ডেসার্টে ছিল বিভিন্ন ধরণের ফল, কেক, টার্ট; আর চা-কফি তো ছিলই।  

সারি সারি লং টেল (Long tail boat) বোট দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্রের কিনারে। লং টেল বোটেও ঘোরা যায় দ্বীপগুলি। অনেক পর্যটক ক্র্যাবি থেকে এই বোটগুলি নিয়ে বেড়াতে আসেন। একটু সময় হাতে থাকলে ক্র্যাবি ঘুরে যেতে পারেন।


মধ্যাহ্ন ভোজনের পর কোমর পর্যন্ত জল ভেঙ্গে আমরা স্পিডবোটে চড়লাম। ভাটার কারণে জল কমে যাওয়ায় স্পিডবোটটি একেবারে সমুদ্রের কিনারে আসতে পারেনি। আমাদের গন্তব্য মানকি বিচ (Monkey beach)। এখানে বোটটি সমুদ্রের মধ্যেই দাঁড়িয়েছিল, আর বোট থেকেই সবাই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে নামছিলো। এখনই চোখে পড়বে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন মাছ, স্বচ্ছ জলের মধ্যে ঝাঁক বেঁধে তাদের দ্রুত চলাফেরা লক্ষ্য করতে করতেই সময় কেটে যাবে। 


প্রায় ৪০ মিনিট মতন এই স্থানে থাকার পর স্পিডবোট রওনা হলো মায়া বে-র (Maya Bay) উদ্দেশ্যে। কার্স্ট ক্লিফ, সাদা বালু এবং পান্না সবুজ রঙের জলের মায়া বে বাস্তবিকই ট্রপিক্যাল স্বর্গ। উপসাগরটির সৌন্দর্যের জন্য এখানে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও অভিনীত হলিউড চলচ্চিত্র 'দ্য বিচ'-র (The Beach) শ্যুটিং হয়েছিল।



প্রায় প্রতিটি দ্বীপেই পর্যটকদের জন্য শৌচাগার রয়েছে ৷ সৈকতে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আপনাকে এটি পরিষ্কার রাখতে হবে। সৈকতের সাথে এমন আচরণ বাঞ্চনীয় যেমন আপনি আপনার নিজের বাড়ির সাথে করে থাকেন কারণ প্রকৃতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের, আর এটাই সাস্টেনেবল ট্যুরিজম (Sustainable tourism)।

প্রায় সাড়ে ৫ টা নাগাদ ফুকেট বে-তে আমরা ফিরলাম। ফেরার সময় বোটে সবাইকে আনারস আর তরমুজ খেতে দিয়েছিলো। বোটে সর্বক্ষণ ছিল প্রচুর কোল্ড ড্রিঙ্কস, ভিটামিন সি ওয়াটার, আর ঠান্ডা জল। পর্যটকরা যত ইচ্ছে ব্যবহার করতে পারেন। সকালে যে ভাবে গিয়েছিলাম সেই একই ভ্যানে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হলো আমাদের রিসর্টে। দুর্দান্ত কাটলো আজকের দিনটা। 

আজও আমরা রাতের খাবার তৈরী করবো, আর হাতের কাছেই রয়েছে সুপার মার্কেট, কাজেই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বেড়িয়ে ফিরে এসে আমরা প্রথমে গেলাম মার্কেটে। লাউ, চিংড়ি, কোয়েলের ডিম, বাসমতি চাল কেনা হলো, রুটি (বা টর্টিলা) তো ছিলই। আজকের খাবার সাদা ভাত (বা রুটি), লাউ-চিংড়ি, আর ডিমের কষা। গতকাল বাজার দেখে আমাদের তো মন ভরে গিয়েছিলো, এতো সব্জি যে কতকাল দেখিনি, ঢ্যাঁড়শ, লাউ, কাঁচা পেঁপে, উচ্ছে বিভিন্ন ধরণের শাক, কচু, কি নেই ! কতদিন যে এসকল সব্জি আমরা খাইনি, সবই কিনতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু একদিনে তো সব কিছু কিনে রান্না করা সম্ভব নয়। বাজার করে এসে গতকালের মতন সব কেটে পরিষ্কার করে, রান্নার জন্যে প্রস্তুত করে আমরা আজও সুইমিং পুলে ঘন্টা খানেক কাটালাম। তারপর বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে চা বানানো হলো, চা-বিস্কুট দিয়ে সন্ধ্যেটা পার হলো। বেশিরভাগ সময়টাই কাটলো সারাদিনের নানান ঘটনা স্মৃতিচারণ করে।ইতিমধ্যে রান্না চড়িয়ে দেওয়াও হয়েছে, ঢিমে আঁচে তা পাঁকছে। একটু বেশি করেই সবকিছু রান্না করা হয়েছিল, আগামীকাল আমরা ফুকেট থেকে ব্যাঙ্কক রওনা হবো, আমাদের বিমান বেলা ৪ টে বেজে ৩০ মিনিটে, কাজেই আমরা মধ্যাহ্নভোজন করেই রওনা হবো। 

আর কি ! এবার আজকের মতন বিশ্রাম। পরের পর্বে আসবে আগামীকালের গল্প।

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-২ (Thailand: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বটি পড়ার জন্য ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১

অন্তর্দেশীয় বহির্গমন বিমানবন্দরের তিনতলায় অবস্থিত। পূর্বেই বলেছি এবার আমাদের যাত্রা ফুকেটের উদ্দেশ্যে। বিমানবন্দরে নির্দিষ্ট বিমানের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে, নিরাপত্তা পরীক্ষার পর যখন নির্দিষ্ট দ্বারের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন হাতে বেশ কিছুটা সময় ছিল। মা বাবা'রা কলকাতা থেকে অনেক মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন, কয়েকটির সদ্গতি করে বিমানে চড়লাম। আমাদের সিটগুলি ছিল একেবারে পিছনে। এতে একটা সুবিধা হয়েছিল যে শৌচাগারটি ছিল কাছেই, যদিও তা আমাদের এবারের যাত্রায় বিশেষ প্রয়োজন হয়নি তবে সাথে বয়স্ক লোক থাকলে শৌচাগার হাতের কাছে থাকলে ভালো হয়। মাত্র দেড় ঘন্টার বিমান যাত্রা ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেট। বিমান কর্তৃপক্ষ সংক্ষিপ্ত প্রাতঃরাশ হিসেবে একটি মিষ্টি বান রুটি আর কফি (অথবা চা) দিয়েছিলেন। সাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বিমান প্রায় সমুদ্রকে স্পর্শ করে তার রানওয়েতে সঠিক সময়ে বেলা ৯ টা বেজে ৩৫ মিনিটে অবতরণ করলো।  

ফুকেট পর্বতময় রেনফরেস্টে ঘেরা থাইল্যান্ডের দক্ষিণভাগে আন্দামান সাগরে অবস্থিত দেশটির সর্ববৃহৎ দ্বীপ যা তার সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এই সমুদ্রসৈকত উপভোগ করতে এখানে আসেন। বিমানবন্দরের বাইরে এসে দেখা মিললো এক মহিলার সাথে, আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ১০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের ভ্যান এসে হাজির হলো এবং সাথে আমাদের গাইড বন্ধু পান্যা। মালপত্র যথাস্থানে উঠিয়ে আজ এই ফুকেট শহর ঘুরে দেখবো আমরা। আমাদের প্রথম গন্তব্য পুরাতন ফুকেট শহর। পূর্বের ব্লগে এই দেশটির ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছিলাম আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের সময়ে এদেশের সাথে বৈদেশিক বিশেষত পর্তুগিজদের ব্যবসায়িক  সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। পুরাতন নগরের স্থাপত্যে সেই পর্তুগিজ ঘরানা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। শুধু তাই নয়, এখানে পর্তুগিজ স্থাপত্যের পাশাপাশি চৈনিক স্থাপত্যরীতিও কিন্তু চোখে পড়ার মতন। অসংখ্য ক্যাফে, আর চাইনিজ রেস্তোরাঁ রয়েছে এই স্থানে। আমি যখন চীনে গিয়েছিলাম তখন ফলের দোকানে দুরিয়ান (Durian) দেখেছি, বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার যে শহরে আমি থাকি সেখানে একটি এশিয়ান মার্ট গড়ে ওঠায় সেখানেও এই ফলটি প্রায়ই পাওয়া যায় তবে কখনও তা খাইনি। পুরাতন ফুকেট নগরের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে প্রথবারের জন্যে এই ফলটির স্বাদগ্রহণ করলাম আমরা। এটি খেতে ভালো বা মন্দ কিরূপ, তা আমি এস্থানে উল্লেখ করবো না কারণ প্রতিটা ফল তার স্বাদে স্বতন্ত্র এবং স্থানীয় মানুষদের কাছে তা খুবই উপাদেয়। প্রায় ঘন্টা দেড়েক কোথা থেকে কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না। 


এবার আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে হবে। বেলা প্রায় ১ টা বাজে। আমাদের গাইডবন্ধুটি একটি রেস্তোরাঁয় আমাদের খাওয়ানোর জন্যে নিয়ে যাওয়ার স্থির করেছিলেন।  কিন্তু আমার মনে হলো গতরাতে সবাই জেগে বিমানযাত্রা করেছে, দুই জায়গায় প্রাতঃরাশ হয়েছে বটে কিন্তু ভারতীয় খাবার সবাই আজকে পছন্দ করবে, থাই খাবার পেট ভরে কতটা খেতে পারবে তা নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম না। তাই আমি তাঁকে ভালো একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলাম। একটু দুঃখ পেলেও উনি ব্যাপারটা বুঝলেন। আমরা একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে পৌঁছলাম। আমাদের খাবার ছিল খুবই সাধারণ, ভাত, ডাল, মাছের ঝোল (কারি), পেঁয়াজ-টোম্যাটো-ঢ্যাঁড়শ ভাজা, বাড়িতে পাতা দই- এই দিয়ে সবাই খাওয়া-দাওয়া সারলো। রেস্তোরাঁটি একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের। গল্প করছিলেন কোভিড প্যানডেমিকের (Covid pandemic) ফলে কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পর্যটন নির্ভর শিল্প। 

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'ওয়াট চালং' (Wat Chalong) বা চালং মন্দির (থাই ভাষায় 'ওয়াট' (Wat) শব্দটির অর্থ মন্দির)। এর প্রকৃত নাম 'ওয়াট চাইয়াথারারাম' (Wat Chaiyathararam)। ঊনবিংশ শতকে নির্মিত এই বুদ্ধ মন্দিরটি ফুকেটের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান। ভগবান বুদ্ধের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকরা লুয়াং ফো চাম (Luang Pho Cham) এবং লুয়াং ফো চুয়াং (Luang Pho Chuang) নামক দুইজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে মন্দিরটি দর্শন করতে আসেন। ঔষধি গাছ সম্পর্কিত এঁদের জ্ঞানভাণ্ডার ছিল অপরিসীম এবং এঁরা স্থানীয় মানুষকে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে চাইনিজ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন, তাই আজও এ দেশের  মানুষের কাছে পূজনীয়। সাম্প্রতিকতম মন্দিরটি ৬০ মিটার উঁচু এবং এই মন্দিরটিতে ভগবান বুদ্ধের দেহের একটি হাড় সংরক্ষিত রয়েছে। একেবারে উপরের তলায় পৌঁছলে ছাদ থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণটির একটি অপরূপ ছবি দেখা যায়। 


তিনতলা এই মন্দিরটিতে প্রবেশ করে সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে দেখা যায় দেওয়ালের গাত্রে একের পর এক চিত্র নির্মিত হয়েছে। ভগবান বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন কাহিনী শিল্পী তাঁর কল্পনায় তুলে ধরেছেন। একটি চিত্র আমার চোখকে আকৃষ্ট করেছিল, চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধের ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবৃত্তির জন্যে একটি বানর জঙ্গল থেকে মধুপূর্ণ মৌচাক আহরণ করে এনেছে আর একটি হাতি বাঁশের পাত্রে জল এনেছে (নিম্নের একেবারে ডানদিকের নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন)।

একেবারে উপরের তলায় পৌঁছলে ছাদ থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণটির একটি অপরূপ ছবি দেখা যায়। 

প্রাঙ্গণে একটি ইট নির্মিত চুল্লীর ন্যায় আবদ্ধ স্থান রয়েছে (নিম্নের একেবারে ডানদিকের নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন), ভগবানের উদ্দেশ্যে যে শব্দবাজি ফাটানো হয় তা এর মধ্যে ফাটাতে হয়, উন্মুক্ত পরিবেশে নয়। এর ফলে বাজির আগুন অন্যত্র ছড়িয়ে পরে দুর্ঘটনা ঘটে না, আবার পরিবেশের দূষণও কিয়দংশ কম হয়। 

এ স্থান থেকে চোখ পড়বে দূরে পাহাড়ের উপরে ধ্যানমগ্ন শাক্যমুনি যা 'বিগ বুদ্ধা' (Big Buddha) বলে পরিচিত, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।


চালং মন্দিরের ছাদ থেকে দূরে নাকার্ড (Nakkerd hill) বা নাগাকার্ড (Nagakerd hill) পাহাড়ের উপরে ভগবান বুদ্ধের যে মূর্তিটি দেখেছিলাম তার উচ্চতা ৪৫ মিটার এবং প্রস্থ ২৫.৪৫ মিটার। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে এই ধ্যানমগ্ন ভগবান বুদ্ধের মূর্তিটির নির্মাণ কার্য শুরু হয় এবং আজও এটি চলছে। শুনলাম এটি থাইল্যান্ডের তৃতীয় উচ্চতম বুদ্ধমূর্তি। 


প্রাঙ্গনে রয়েছে অনেক ভাস্কর্য। ভগবান বুদ্ধের শায়িত, দণ্ডায়মান এবং উপবেশন অবস্থানের ভাস্কর্য , এছাড়াও রয়েছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মূর্তি, ধরিত্রী মাতার মূর্তি ইত্যাদি। 


আর দেখলাম গরুড়ের মূর্তি, ভারতীয় মহাকাব্য এবং পুরাণাদিতে বিষ্ণুর বাহন গরুড়, থাই ভাষায় 'খ্র্রুট' (Khrut) নামে পরিচিত, 'খ্র্রুট' এদেশের জাতীয় প্রতীক। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন 'Visa on Arrival' ফর্মটির উপরে এই প্রতীকটি রয়েছে। 


এবার কারোণ (Karon beach) এবং কাটা (Kata beach) সমুদ্রসৈকতের ভিউ পয়েন্ট দেখে আজকের মতন আমরা রিসর্টে পৌঁছলাম। আমরা উঠেছিলাম কাটা ট্রানকুইল ভিলা-তে, রিসর্টটি থেকে কারোণ বিচের দূরত্ব ছিল পায়ে হেঁটে ৫-৭ মিনিট মতন।

আমরা ঠিক করলাম আজ আমরা নিজেরা রাত্রিকালীন আহারের বন্দোবস্ত করবো। আমাদের রিসোর্টটির সামনে ৪০০-৫০০ মিটারের মধ্যেই ছিল শপিং মার্ট 'ম্যাক্রো' (Makro), সবাই মিলে সেখানে গেলাম বাজার করতে। চিকেন, পেঁয়াজ, আদা, শশা, ধনে পাতা, জিরে-ধনের গুঁড়ো, চিকেন মশলা, তেল, নুন, কাঁচা লঙ্কা ইত্যাদি কিনে আনলাম। এবার আর কি? খুব পরিশ্রান্ত আমরা কেউই ছিলাম না, যেটুকু ছিলাম তাও কেটে গিয়েছিলো সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে।  রাতের খাদ্যতালিকায় ছিল রুটি (আমরা টর্টিলা নিয়ে গিয়েছিলাম), চিকেন, স্যালাড, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা আঁচার আর মিষ্টি । 

এবার বিশ্রাম, আগামীকাল আমাদের আন্দামান সাগরের বিভিন্ন দ্বীপ ঘোরার কথা।

জুলাই, ২০২৩ 

থাইল্যান্ড: পর্ব-১ (Thailand: Part-1)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

ইতিপূর্বে ভুটান (এ বিষয়ে আমি একটি ভ্রমণ কাহিনী 'দিন তিনেকের ভুটান' লিখেছিলাম যেটি 'আমাদের ছুটি' অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল) ছাড়া যে সকল দেশ আমি ভ্রমণ করেছি তা সর্বদা কর্মসূত্রে। প্রায় দীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর পর কয়েকদিনের ছুটিতে সপরিবারে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ড। আগামী কয়েকটি পর্বে আমি আমাদের এই ভ্রমণ কাহিনীটি বিস্তারিত লিখব। 

প্রথমে থাইল্যান্ড দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত প্রায় ৫১৩১২০ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্রফলের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র এই দেশটির জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭০ মিলিয়ন। দেশটির উত্তরে রয়েছে মায়ানমার এবং লাওস, পূর্বে লাওস এবং কম্বোডিয়া, পশ্চিমে মায়ানমার, দক্ষিণে দেশটির লম্বা একটি উপদ্বীপীয় (Peninsula) অঞ্চল রয়েছে আর তারপর রয়েছে মালেশিয়া। উপদ্বীপীয় অঞ্চলটির পশ্চিমে রয়েছে আন্দামান সাগর।   

আমরা, আমি আর আমার স্ত্রী, যাব দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Incheon International Airport) থেকে। ১ নম্বর টার্মিনাল থেকে রাত্রি ৮ টা বেজে ৪০ মিনিটে (কোরিয়া সময়) থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (Suvarnabhumi International Airport) উদ্দেশ্যে আমাদের বিমান যাত্রা শুরু করলো। প্রায় ৫ ঘন্টা ১০ মিনিটের বিমান যাত্রা, থাইল্যান্ড সময় পরদিন ভোর সাড়ে ১২ টায় আমাদের অবতরণ সঠিক সময়ানুসারেই হয়েছিল। এই বিমানবন্দর দিয়ে অগণিত বার আমি যাতায়াত করেছি বটে তবে এই দেশটা দেখার সুযোগ এইবার প্রথম।  


বিদেশে ভ্রমণের প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়টির অবতারণা হয় তা হলো ভিসা। এই ভিসা বা অনুমতি পেতে আবেদনকারীকে উপযুক্ত সময়ে সেই দেশের নিয়ম অনুযায়ী ভ্রমণের কারণ, যাতায়াত এবং থাকবার ব্যবস্থা, নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে প্রমাণ সহ বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হয়, এবং সকল বিষয় সেই দেশের নিয়মাবলীকে পরিতৃপ্ত করলে ভিসা পাওয়া যায়। কয়েকটি দেশ আবার ভারতবাসীকে পৌঁছনোর পর ভিসার জন্যে আবেদনের সুযোগ দিয়ে থাকে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড অন্যতম। দেশটি ভারতীয় নাগরিকদের পর্যটনের উদ্দেশ্যে ১৫ দিনের জন্যে 'Visa on Arrival' প্রদান করে থাকে। যদি কোনো ভারতীয় পর্যটক ১৫ দিনের অধিক থাইল্যান্ডে থাকতে চান তবে তাকে পূর্বেই ভিসার জন্যে আবেদন করতে হবে। থাইল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর 'Visa on Arrival' ফর্মটি পূরণ করতে হয়। এই জন্যে কয়েকটি ডকুমেন্টের প্রয়োজন হয়, তা এখানে উল্লেখ করলাম।

(১) থাইল্যান্ডের থেকে ফেরার বিমানের টিকিট, 

(২) থাকবার স্থানের (পর্যটকদের ক্ষেত্রে হোটেলের) সংরক্ষনের প্রমান, 

(৩) জনপ্রতি ১০,০০০ থাই বাত (Thai Baht) (পরিবার প্রতি ২০,০০০ থাই বাত), 

(৪) নিজের একটি ফোটোগ্রাফ (৬ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪ সেন্টিমিটার প্রস্থ) প্রয়োজন। 

বিমানবন্দরে অবতরণের পর চলার পথে লক্ষ্য করলেই দিক নির্দেশ চোখে পড়বে, দিক নির্দেশ অনুসরণ করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় "Visa on Arrival' স্থানটিতে। অতএব বিমান থেকে অবতরণের পর প্রথম কর্তব্য 'Visa on Arrival' ফর্মটি সঠিকভাবে পূরণ করে কাউন্টারে সেটি জমা করা, অফিসার ফর্মটি পরীক্ষা করে ভিসা আবেদনের মূল্য (আমাদের জন প্রতি ২২০০ থাই বাত লেগেছিলো) জমা করতে বলবেন। তারপর ঐদেশের ইমিগ্রেশন নিয়মানুসারে আঙুলের ছাপ এবং চোখের স্ক্যান করে পাসপোর্টে ভিসা স্ট্যাম্প এবং অনুমতি সাপেক্ষে দিনসংখ্যা উল্লেখ করে স্ট্যাম্প করে দিলেই আপনি দেশটিতে প্রবেশ করতে পারবেন। 

ভিসা পাওয়ার পর আমরা মোবাইল ফোনের সিম নেওয়ার জন্যে আবেদন করেছিলাম, পদ্ধতিটি খুবই সহজ, একাধিক কাউন্টার রয়েছে সিম নেওয়ার, যে কোনো একটিতে গিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী (৮ দিনের জন্যে ১৫ GB ২০০ থাই বাত, আর আনলিমিটেড ইন্টারনেটের জন্যে ৪৯৯ থাই বাত) সিম নেওয়া যায়, পাসপোর্টের ফটোকপি এবং আবেদনকারীর চিত্র দুই-ই দোকানের কর্মী তুলে নেবেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা এই কাজ দু'টি সপন্ন করে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করার স্থানে পৌঁছলাম। আমার এবং আমার স্ত্রীর মা-বাবা আসবেন কলকাতা থেকে, তাঁদের বিমান পৌঁছনোর সময় ভোর ৪ টে বেজে ১০ মিনিটে। এবার অপেক্ষা, বিমানবন্দরে অপেক্ষা করার স্থানটিতে পৌঁছে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্যে।  

তবে এই অবসরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নিই।

'সুবর্ণভূমি' নামের অর্থ স্বর্ণের ভূমি বা সোনার দেশ। শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ থেকে। শুধু এই শব্দটি নয়, এখানে প্রচলিত অনেক শব্দ কিন্তু ভারতীয় ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়, কখনও উচ্চারণ রীতিটি একটু আলাদা। যেমন মনুষ্য (Manushyo) এখানে মানুথ (Manuth), গজ (Gaja) এখানে খজ (Khaja), দেবী (Devi) এখানে তেয়ি (The yi), চাঁদ (Chand) এখানে চান (Chan), তারা (Tara) হলো দারা (Dara), রাজা (Raja) হয়েছে রাচা (Ra chaa), ভাষা (Bhasha) হয়েছে পাষা (Pa sha) ইত্যাদি। থাই মানুষের অভিবাদন 'স্বাদিকাম' আর ভারতীয়দের 'স্বাগতম'-র  ভাষাগত নৈকট্য কিন্তু লক্ষ্যণীয়। কোথাও বেশ ভালো লাগছে না ! বেশ নিজ নিজ অনুভূতি, আর হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় আছে কাজেই এই দেশের ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যেতেই পারে। কোনো স্থান সম্বন্ধে জানতে হলে তার ইতিহাস, সংস্কৃতি জানা অপরিহার্য বলেই আমার মনে হয়। এখানে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক যা আমাদের এই ভ্রমণের সাথে বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। 

বর্তমান থাইল্যান্ডের পূর্বের নাম ছিল শ্যামদেশ। এই 'শ্যাম' নামটির উৎপত্তি খুঁজতে গেলে দেখা যায় শব্দটি সংস্কৃত বা পালি ভাষা থেকে এসেছে বলে বোধ হয়। দেশটির ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ইত্যাদির উপর ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে নান চাওয়ের 'তাই' (Tai) জনজাতির মানুষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূখণ্ডে আসেন এবং খমের সাম্রাজ্যের (Khmer Empire) অধীনে তাঁদের বসতি স্থাপন করেন। ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রী ইন্দ্রাদিত্য খমের সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে সুখোথাই (Sukhothai Kingdom) রাজত্ব গঠন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটিই প্রথম থাই রাজত্ব বলে বিবেচিত হয়। 'থাই' কথাটির অর্থ এখানে 'মুক্ত' (Free), আবার 'তাই' জনগোষ্ঠীর নামানুসারেও 'থাই' নামটি আসে। এর পরবর্তী কালে সুখতাই রাজত্বের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তা ছড়িয়ে পরে লাওস, বার্মা এবং মালাক্কা উপদ্বীপে, মূলত সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি হয়েছিল ভ্যাসাল স্টেট (Vassal state: একটি ভাসাল রাষ্ট্র এমন যে কোনো রাষ্ট্র যার একটি উচ্চতর রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের প্রতি পারস্পরিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে) গঠনের মাধ্যমে। সুখোথাই রাজত্বের রাজারা বিদেশী শক্তির (যেমন চীনের ইউয়ান রাজবংশের সাথে) সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এরপর সুখোথাই রাজত্বের ভ্যাসাল স্টেটগুলি যখন বিদ্রোহ শুরু করে তা আর পুনর্গঠন করা এই রাজত্বের পক্ষে সম্ভব হয়নি, বরং আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে বিরোধী শক্তির কাছে। এর মধ্যে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য (Ayutthaya Empire) গড়ে ওঠে। ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমগ্র সুখোতাই রাজত্বের অবসান ঘটে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য ওই অঞ্চলের বৃহৎ শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সুখোথাই যেমন ভ্যাসাল স্টেট গঠনের মাধ্যমে নিজের পরিধি এবং শক্তি বৃদ্ধি করেছিল, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য কিন্তু তা করেনি, বরং এই সাম্রাজ্য ছিল সামগ্রিকভাবে রাজতন্ত্র নির্ভর। এই 'আয়ুত্থায়া' নামটির সাথে ভারতবর্ষের 'অযোধ্যা' নামটির সাদৃশ্য রয়েছে। শুধু অযোধ্যা নামের সাদৃশ্য নয়, ভারতবর্ষের মহাকাব্য রামায়ণ এখানে 'রামাকিয়েন', থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ। আমাদের 'রাজা রাম' এখানে 'ফ্রা রামা'। 'রামাকিয়েন' শব্দটির অর্থ 'রামের গৌরব' (Glory of Rama)। এই সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পর্তুগালের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। পর্তুগিজদের উচ্চারণে 'শ্যাম' পরিণত হলো 'সিয়াম' (Siam) এ। তখন পর্তুগাল মালাক্কা উপদ্বীপ দখল করেছে এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের স্থানীয় থাই রাজত্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। থাই রাজত্বও এর ফলে উপকৃত হতো, কাজেই ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। এর ফলে একাধিক ট্রিটি (Treaty) স্থাপন হয়েছিল, যেমন ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং পর্তুগালের মধ্যে, আবার বেশ কয়েক দশক পরে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জাপানের সাথেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, মিশনারীদের আগমনে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব লক্ষ্যিত হলে পরবর্তী প্রায় দেড় শতাব্দী ইচ্ছানুসারে থাই সাম্রাজ্য বিদেশী সম্পর্ক থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখেন। 

১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলো বার্মিজ-সিয়ামিজ যুদ্ধ, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয় এই যুদ্ধে, রাজধানী আয়ুত্থায়া ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বার্মিজদের হাতে। আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের কমান্ডার ফ্রায়া তাকসিন (Phraya Taksin) বার্মিজদের অবরোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করেন এবং নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। থনবুরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং চীনের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। তবে তাকসিন যে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া রাজত্বের অন্যতম কমান্ডার জেনারেল চাও ফ্রায়া চাকরি (Chao Phraya Chakri) রাজসিংহাসন থেকে রাজা তাকসিনকে অপসারণ করে চাকরি রাজবংশের (Chakri Kingdom) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় তাঁরা রাজধানী ব্যাঙ্ককে স্থানান্তরিত করেন। আজও থাইল্যান্ডে চাকরি বংশ রাজত্ব করছেন এবং রাজধানী ব্যাঙ্কক। পরবর্তীতে অনেক কাল অতিবাহিত হয়েছে, ঘটনার পরম্পরা এই দেশকে আজ উন্নত দেশে পরিণত করেছে, তবে সে ইতিহাস সবিস্তারে এই ভ্রমণ কাহিনীতে বিশেষ প্রাসঙ্গিক নয়।

আমাদের সারা রাত বিমানবন্দরের অপেক্ষার স্থানে পার হলো, দেখলাম মা-বাবা'দের বিমান সঠিক সময়ে অবতরণ করেছে। এবার ওঁরা বিমানবন্দরের সব কাজ শেষ করে বাইরে আসবে। এখানে একটু কিছু প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যাবো অন্তর্দেশীয় বহির্গমনের উদ্দেশ্যে। আমাদের বিমান সকাল ৮ টা ৫ মিনিটে, ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেট।

জুলাই, ২০২৩

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...