পৃষ্ঠাসমূহ

থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ (Thailand: Part-3)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্ব দু'টি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২

আজ খুব ভোরে, প্রায় ৫ টা নাগাদ, ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। বাইরে তখনও অন্ধকার, বারান্দায় এসে বসলাম, একটু পরে আলো ফুটবে। বেশ ভালো লাগে ভোর হওয়া দেখতে। ৬টা নাগাদ সবাইকে ডেকে দিলাম, প্রাত্যহিক কাজ সেরে ফ্রেশ হয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সাড়ে সাতটায় গাড়ি এলো আমাদের নিয়ে যেতে। আজ আমরা অনেকগুলি দ্বীপ ঘুরে দেখবো, সমুদ্র যাত্রা, সমুদ্রস্নান সবই হবে, কাজেই বাড়ি থেকে স্নান সেরে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।  

ভ্যান আমাদের নিয়ে আরও পর্যটক তুলতে তুলতে ফুকেট মেরিনা বে-তে (Phuket Marina Bay) উপস্থিত হলো। আমাদের নাম পূর্বেই অন্তর্ভুক্ত করা ছিল, গাইড তা পরীক্ষা করে নিয়ে আমাদের প্রাতঃরাশ সেরে নিতে বললেন। প্রাতঃরাশের জন্যে সেখানে নানান ধরণের কেক, বিস্কুট, চা, কফি, ক্যান্ডি ইত্যাদি ছিল। প্রায় আধ ঘন্টা পর আমাদের নির্দিষ্ট স্পিডবোটে ওঠানো হলো। গাইড ইংরাজিতে মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলেন। তিনি প্রথমেই যাত্রীদের স্বাগত করে আমাদের যাত্রার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন।

প্রথমেই আমরা এলাম খই দ্বীপপুপুঞ্জে বা 'কোহ খই'-তে (Koh Khai)। ফুকেটের পূর্বের উপকূল থেকে প্রায় ২৫ মিনিট দূরত্বে এই 'কোহ খই' (থাই ভাষায় 'কোহ' (Koh) কথাটির অর্থ দ্বীপ ) দ্বীপপুঞ্জটি তিনটি দ্বীপ, যথা কোহ খই নাই (Koh Khai Nai), কোহ খই নুই (Koh Khai Nui), এবং কোহ খই নোক (Koh Khai Nok) নিয়ে গড়ে উঠেছে। দ্বীপগুলি তাদের দুর্দান্ত শুভ্র বালুকাময় সৈকত এবং অবিশ্বাস্যভাবে স্বচ্ছ জলের জন্য জনপ্রিয়। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন এখানে রঙিন মাছের একটি ঝাঁক আপনার চারপাশে সাঁতার কাটতে এসেছে। প্রকৃতির এরূপ সাহচর্যে দিনের শুরুতেই মন ভরে উঠবে আনন্দে, গলা ছেড়ে গানও ধরতে পারেন।


ঘন্টা খানেক পর আমরা যাত্রা শুরু করলাম কোহ মাই ফাই-র (Koh Mai Phai) উদ্দেশ্যে, এটি ব্যাম্বু দ্বীপ (Bamboo island) নামে পরিচিত। পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্যগুলির একটি এই ব্যাম্বু দ্বীপ। দ্বীপটির জঙ্গলে ঝরা পাতার মধ্যে বাঁশ গাছ রয়েছে, যা থেকে এই দ্বীপের নামকরণ, তবে এখানে প্রচুর অন্যান্য গাছও রয়েছে। এটির চতুর্দিকে বেলাভূমি, সমুদ্রের স্বচ্ছ জলরাশি আপনাকে স্পর্শ করার জন্যে হাতছানি দেবে। আমরাও নেমে পড়লাম, কোহ খই তে সমুদ্রকে স্পর্শ করেছিলাম মাত্র, তবে এখানে সম্পূর্ণ সমুদ্রস্নান। এই জলে বালি নেই, এরূপ অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের জন্যে নতুন ছিল।  

এই দ্বীপের অন্যতম প্রধান কার্যকলাপ অবশ্যই স্নরকেলিং (Snorkeling)!  তবে সমগ্র ফি ফি দ্বীপ জুড়ে স্নরকেলিং উপভোগ্য। কাজেই সাথে স্নরকেলিং মাস্ক রাখা উপযোগী, লাইফ জ্যাকেট স্পীডবোট থেকে পাওয়া যায়। ফি ফি দ্বীপগুলির আরও কিছু হাইলাইট হল আশ্চর্যজনক পিলেহ লেগুন, মায়া উপসাগর এবং একে অপরের পাশে অবস্থিত ভাইকিং গুহা, দ্বীপ কোহ ফি ফি ডন এবং কোহ ফি ফি লেহ, মানকি বিচ এবং অবশ্যই, প্রধান আকর্ষণ হল সাদা বালি এবং স্বচ্ছ জল যা সুন্দর দ্বীপগুলোকে ঘিরে রেখেছে। 

ব্যাম্বু দ্বীপের পর আমাদের স্পিডবোটটি রওনা হলো ফি ফি ডন দ্বীপের (Koh Phi Phi Don) উদ্দেশ্যে, ফি ফি ডন ফি ফি দ্বীপপুঞ্জের (Phi Phi archipelago) মধ্যে সর্ববৃহৎ। এখানে আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজন।মধ্যাহ্ন ভোজনে ছিল বাফেটের আয়োজন, কত কি খাবার, সি-ফুড, পাস্তা, ভাত, ফ্রাইড রাইস, চিকেন, নুডলস, স্যুপ; ডেসার্টে ছিল বিভিন্ন ধরণের ফল, কেক, টার্ট; আর চা-কফি তো ছিলই।  

সারি সারি লং টেল (Long tail boat) বোট দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্রের কিনারে। লং টেল বোটেও ঘোরা যায় দ্বীপগুলি। অনেক পর্যটক ক্র্যাবি থেকে এই বোটগুলি নিয়ে বেড়াতে আসেন। একটু সময় হাতে থাকলে ক্র্যাবি ঘুরে যেতে পারেন।


মধ্যাহ্ন ভোজনের পর কোমর পর্যন্ত জল ভেঙ্গে আমরা স্পিডবোটে চড়লাম। ভাটার কারণে জল কমে যাওয়ায় স্পিডবোটটি একেবারে সমুদ্রের কিনারে আসতে পারেনি। আমাদের গন্তব্য মানকি বিচ (Monkey beach)। এখানে বোটটি সমুদ্রের মধ্যেই দাঁড়িয়েছিল, আর বোট থেকেই সবাই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে নামছিলো। এখনই চোখে পড়বে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন মাছ, স্বচ্ছ জলের মধ্যে ঝাঁক বেঁধে তাদের দ্রুত চলাফেরা লক্ষ্য করতে করতেই সময় কেটে যাবে। 


প্রায় ৪০ মিনিট মতন এই স্থানে থাকার পর স্পিডবোট রওনা হলো মায়া বে-র (Maya Bay) উদ্দেশ্যে। কার্স্ট ক্লিফ, সাদা বালু এবং পান্না সবুজ রঙের জলের মায়া বে বাস্তবিকই ট্রপিক্যাল স্বর্গ। উপসাগরটির সৌন্দর্যের জন্য এখানে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও অভিনীত হলিউড চলচ্চিত্র 'দ্য বিচ'-র (The Beach) শ্যুটিং হয়েছিল।



প্রায় প্রতিটি দ্বীপেই পর্যটকদের জন্য শৌচাগার রয়েছে ৷ সৈকতে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আপনাকে এটি পরিষ্কার রাখতে হবে। সৈকতের সাথে এমন আচরণ বাঞ্চনীয় যেমন আপনি আপনার নিজের বাড়ির সাথে করে থাকেন কারণ প্রকৃতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের, আর এটাই সাস্টেনেবল ট্যুরিজম (Sustainable tourism)।

প্রায় সাড়ে ৫ টা নাগাদ ফুকেট বে-তে আমরা ফিরলাম। ফেরার সময় বোটে সবাইকে আনারস আর তরমুজ খেতে দিয়েছিলো। বোটে সর্বক্ষণ ছিল প্রচুর কোল্ড ড্রিঙ্কস, ভিটামিন সি ওয়াটার, আর ঠান্ডা জল। পর্যটকরা যত ইচ্ছে ব্যবহার করতে পারেন। সকালে যে ভাবে গিয়েছিলাম সেই একই ভ্যানে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হলো আমাদের রিসর্টে। দুর্দান্ত কাটলো আজকের দিনটা। 

আজও আমরা রাতের খাবার তৈরী করবো, আর হাতের কাছেই রয়েছে সুপার মার্কেট, কাজেই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বেড়িয়ে ফিরে এসে আমরা প্রথমে গেলাম মার্কেটে। লাউ, চিংড়ি, কোয়েলের ডিম, বাসমতি চাল কেনা হলো, রুটি (বা টর্টিলা) তো ছিলই। আজকের খাবার সাদা ভাত (বা রুটি), লাউ-চিংড়ি, আর ডিমের কষা। গতকাল বাজার দেখে আমাদের তো মন ভরে গিয়েছিলো, এতো সব্জি যে কতকাল দেখিনি, ঢ্যাঁড়শ, লাউ, কাঁচা পেঁপে, উচ্ছে বিভিন্ন ধরণের শাক, কচু, কি নেই ! কতদিন যে এসকল সব্জি আমরা খাইনি, সবই কিনতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু একদিনে তো সব কিছু কিনে রান্না করা সম্ভব নয়। বাজার করে এসে গতকালের মতন সব কেটে পরিষ্কার করে, রান্নার জন্যে প্রস্তুত করে আমরা আজও সুইমিং পুলে ঘন্টা খানেক কাটালাম। তারপর বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে চা বানানো হলো, চা-বিস্কুট দিয়ে সন্ধ্যেটা পার হলো। বেশিরভাগ সময়টাই কাটলো সারাদিনের নানান ঘটনা স্মৃতিচারণ করে।ইতিমধ্যে রান্না চড়িয়ে দেওয়াও হয়েছে, ঢিমে আঁচে তা পাঁকছে। একটু বেশি করেই সবকিছু রান্না করা হয়েছিল, আগামীকাল আমরা ফুকেট থেকে ব্যাঙ্কক রওনা হবো, আমাদের বিমান বেলা ৪ টে বেজে ৩০ মিনিটে, কাজেই আমরা মধ্যাহ্নভোজন করেই রওনা হবো। 

আর কি ! এবার আজকের মতন বিশ্রাম। পরের পর্বে আসবে আগামীকালের গল্প।

জুলাই, ২০২৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...