সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
পূর্ববর্তী পর্বটি পড়ার জন্য ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১
অন্তর্দেশীয় বহির্গমন বিমানবন্দরের তিনতলায় অবস্থিত। পূর্বেই বলেছি এবার আমাদের যাত্রা ফুকেটের উদ্দেশ্যে। বিমানবন্দরে নির্দিষ্ট বিমানের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে, নিরাপত্তা পরীক্ষার পর যখন নির্দিষ্ট দ্বারের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন হাতে বেশ কিছুটা সময় ছিল। মা বাবা'রা কলকাতা থেকে অনেক মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন, কয়েকটির সদ্গতি করে বিমানে চড়লাম। আমাদের সিটগুলি ছিল একেবারে পিছনে। এতে একটা সুবিধা হয়েছিল যে শৌচাগারটি ছিল কাছেই, যদিও তা আমাদের এবারের যাত্রায় বিশেষ প্রয়োজন হয়নি তবে সাথে বয়স্ক লোক থাকলে শৌচাগার হাতের কাছে থাকলে ভালো হয়। মাত্র দেড় ঘন্টার বিমান যাত্রা ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেট। বিমান কর্তৃপক্ষ সংক্ষিপ্ত প্রাতঃরাশ হিসেবে একটি মিষ্টি বান রুটি আর কফি (অথবা চা) দিয়েছিলেন। সাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বিমান প্রায় সমুদ্রকে স্পর্শ করে তার রানওয়েতে সঠিক সময়ে বেলা ৯ টা বেজে ৩৫ মিনিটে অবতরণ করলো।
ফুকেট পর্বতময় রেনফরেস্টে ঘেরা থাইল্যান্ডের দক্ষিণভাগে আন্দামান সাগরে অবস্থিত দেশটির সর্ববৃহৎ দ্বীপ যা তার সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এই সমুদ্রসৈকত উপভোগ করতে এখানে আসেন। বিমানবন্দরের বাইরে এসে দেখা মিললো এক মহিলার সাথে, আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ১০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের ভ্যান এসে হাজির হলো এবং সাথে আমাদের গাইড বন্ধু পান্যা। মালপত্র যথাস্থানে উঠিয়ে আজ এই ফুকেট শহর ঘুরে দেখবো আমরা। আমাদের প্রথম গন্তব্য পুরাতন ফুকেট শহর। পূর্বের ব্লগে এই দেশটির ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছিলাম আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের সময়ে এদেশের সাথে বৈদেশিক বিশেষত পর্তুগিজদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। পুরাতন নগরের স্থাপত্যে সেই পর্তুগিজ ঘরানা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। শুধু তাই নয়, এখানে পর্তুগিজ স্থাপত্যের পাশাপাশি চৈনিক স্থাপত্যরীতিও কিন্তু চোখে পড়ার মতন। অসংখ্য ক্যাফে, আর চাইনিজ রেস্তোরাঁ রয়েছে এই স্থানে। আমি যখন চীনে গিয়েছিলাম তখন ফলের দোকানে দুরিয়ান (Durian) দেখেছি, বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার যে শহরে আমি থাকি সেখানে একটি এশিয়ান মার্ট গড়ে ওঠায় সেখানেও এই ফলটি প্রায়ই পাওয়া যায় তবে কখনও তা খাইনি। পুরাতন ফুকেট নগরের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে প্রথবারের জন্যে এই ফলটির স্বাদগ্রহণ করলাম আমরা। এটি খেতে ভালো বা মন্দ কিরূপ, তা আমি এস্থানে উল্লেখ করবো না কারণ প্রতিটা ফল তার স্বাদে স্বতন্ত্র এবং স্থানীয় মানুষদের কাছে তা খুবই উপাদেয়। প্রায় ঘন্টা দেড়েক কোথা থেকে কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না।
এবার আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে হবে। বেলা প্রায় ১ টা বাজে। আমাদের গাইডবন্ধুটি একটি রেস্তোরাঁয় আমাদের খাওয়ানোর জন্যে নিয়ে যাওয়ার স্থির করেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হলো গতরাতে সবাই জেগে বিমানযাত্রা করেছে, দুই জায়গায় প্রাতঃরাশ হয়েছে বটে কিন্তু ভারতীয় খাবার সবাই আজকে পছন্দ করবে, থাই খাবার পেট ভরে কতটা খেতে পারবে তা নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম না। তাই আমি তাঁকে ভালো একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলাম। একটু দুঃখ পেলেও উনি ব্যাপারটা বুঝলেন। আমরা একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে পৌঁছলাম। আমাদের খাবার ছিল খুবই সাধারণ, ভাত, ডাল, মাছের ঝোল (কারি), পেঁয়াজ-টোম্যাটো-ঢ্যাঁড়শ ভাজা, বাড়িতে পাতা দই- এই দিয়ে সবাই খাওয়া-দাওয়া সারলো। রেস্তোরাঁটি একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের। গল্প করছিলেন কোভিড প্যানডেমিকের (Covid pandemic) ফলে কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পর্যটন নির্ভর শিল্প।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'ওয়াট চালং' (Wat Chalong) বা চালং মন্দির (থাই ভাষায় 'ওয়াট' (Wat) শব্দটির অর্থ মন্দির)। এর প্রকৃত নাম 'ওয়াট চাইয়াথারারাম' (Wat Chaiyathararam)। ঊনবিংশ শতকে নির্মিত এই বুদ্ধ মন্দিরটি ফুকেটের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান। ভগবান বুদ্ধের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকরা লুয়াং ফো চাম (Luang Pho Cham) এবং লুয়াং ফো চুয়াং (Luang Pho Chuang) নামক দুইজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে মন্দিরটি দর্শন করতে আসেন। ঔষধি গাছ সম্পর্কিত এঁদের জ্ঞানভাণ্ডার ছিল অপরিসীম এবং এঁরা স্থানীয় মানুষকে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে চাইনিজ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন, তাই আজও এ দেশের মানুষের কাছে পূজনীয়। সাম্প্রতিকতম মন্দিরটি ৬০ মিটার উঁচু এবং এই মন্দিরটিতে ভগবান বুদ্ধের দেহের একটি হাড় সংরক্ষিত রয়েছে। একেবারে উপরের তলায় পৌঁছলে ছাদ থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণটির একটি অপরূপ ছবি দেখা যায়।
একেবারে উপরের তলায় পৌঁছলে ছাদ থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণটির একটি অপরূপ ছবি দেখা যায়।
প্রাঙ্গণে একটি ইট নির্মিত চুল্লীর ন্যায় আবদ্ধ স্থান রয়েছে (নিম্নের একেবারে ডানদিকের নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন), ভগবানের উদ্দেশ্যে যে শব্দবাজি ফাটানো হয় তা এর মধ্যে ফাটাতে হয়, উন্মুক্ত পরিবেশে নয়। এর ফলে বাজির আগুন অন্যত্র ছড়িয়ে পরে দুর্ঘটনা ঘটে না, আবার পরিবেশের দূষণও কিয়দংশ কম হয়।
এ স্থান থেকে চোখ পড়বে দূরে পাহাড়ের উপরে ধ্যানমগ্ন শাক্যমুনি যা 'বিগ বুদ্ধা' (Big Buddha) বলে পরিচিত, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।
আমরা ঠিক করলাম আজ আমরা নিজেরা রাত্রিকালীন আহারের বন্দোবস্ত করবো। আমাদের রিসোর্টটির সামনে ৪০০-৫০০ মিটারের মধ্যেই ছিল শপিং মার্ট 'ম্যাক্রো' (Makro), সবাই মিলে সেখানে গেলাম বাজার করতে। চিকেন, পেঁয়াজ, আদা, শশা, ধনে পাতা, জিরে-ধনের গুঁড়ো, চিকেন মশলা, তেল, নুন, কাঁচা লঙ্কা ইত্যাদি কিনে আনলাম। এবার আর কি? খুব পরিশ্রান্ত আমরা কেউই ছিলাম না, যেটুকু ছিলাম তাও কেটে গিয়েছিলো সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে। রাতের খাদ্যতালিকায় ছিল রুটি (আমরা টর্টিলা নিয়ে গিয়েছিলাম), চিকেন, স্যালাড, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা আঁচার আর মিষ্টি ।
এবার বিশ্রাম, আগামীকাল আমাদের আন্দামান সাগরের বিভিন্ন দ্বীপ ঘোরার কথা।
জুলাই, ২০২৩











কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন