পৃষ্ঠাসমূহ

থাইল্যান্ড: পর্ব-৬ (Thailand: Part-6)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ থাইল্যান্ড: পর্ব-৪ থাইল্যান্ড: পর্ব-৫

আজ একটু বেলা করেই উঠলো সবাই। গত কয়েকদিন ধরে বেশ ভোর ভোরই উঠতে হচ্ছিলো সকলকে, আজ একটু বেশিক্ষন বিছানায় কাটানো যাচ্ছে, বেশ লাগছে। গতকাল একটি ফটো আমরা গাড়িতে ফেলে এসেছিলাম, তাই রুডিকে ফোন করে অনুরোধ করলাম সে যেন গতকালের গাড়িটিই আমাদের জন্যে আজকে পাঠায়, সেটিতেই আমরা যাবো পাটায়া। সকালে উঠে চা-বিস্কুট খেয়ে গল্পগুজব চলতে লাগলো। আজকের প্রাতঃরাশও ছিল নুডলস। সাড়ে দশটার মধ্যে আমরা তৈরী হয়ে গিয়েছিলাম, কথা-বার্তা চলছিল। হঠাৎ আমার ঘরের ফোন বেজে উঠলো, ফোনের ওপারে টনি, আমাদের গাড়ির চালক তথা আমাদের ব্যাঙ্কক ভ্রমণের গাইড। তিনি সময়ের পূর্বেই এসে হাজির হয়েছেন। আমরাও দেখলাম অযথা দেরি করে লাভ নেই, কাজেই আমরা লবিতে নেমে এলাম। প্রথমেই নমস্কার করে এক গাল হেসে আমাদের ফেলে আসা ছবিটি তিনি দিলেন। এদেশে আমাদের দেশের মতন দিনের প্রথম সাক্ষ্যাতে  হাত জোর করে প্রণাম করার সংস্কার রয়েছে। আমরা আগেই আজকের বেড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলাম, আমাদের আজকের প্রথম দ্রষ্টব্য স্যাংচুয়ারি অফ ট্রুথ। 

ব্যাঙ্কক ছেড়ে পাটায়ার দিকে চলতে চলতে সহজেই চোখে পড়বে রাস্তার পাশে ছবিগুলি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। গগনচুম্বী অট্টালিকা, বিরাট বিরাট মানব স্থাপত্য কখন অদৃশ্য হয়ে এখন শুধু প্রকৃতি। যখন স্যাংচুয়ারী অফ ট্রুথে পৌঁছলাম তখন প্রায় বেলা ১ টা। আমাদের সকলেই বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিলো। টনি গিয়ে টিকিট আর প্রত্যেকের জন্যে হাতে বাঁধার ব্যান্ড এনে দিলেন, এটি দেখালেই প্রবেশ করা যাবে অভ্যন্তরে।  ভিতরেই একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। আমরা গিয়ে সাগর দেখা যায় এমন একটি টেবিলে বসলাম। এবার খাবার অর্ডার দেওয়ার, সেখানে বিশেষ পরিবর্তন হলো না। তবে পানীয়ের ক্ষেত্রে যে যার পছন্দ মতন অর্ডার দিলো, আমি নিয়েছিলাম ডাব, ভিতরের শাঁসটাও বেশ ভালো ছিল।   

কাষ্ঠ নির্মিত এক বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদের অভ্যন্তরের প্রতিটি ভাস্কর্য কাঠ নির্মিত। প্রচুর পুরুষ-মহিলা একাগ্র চিত্তে হাতুড়ি আর ছেনির সাহায্যে ফুটিয়ে তুলছেন তাঁদের শিল্পকর্ম।  


এরপর আমরা গিয়েছিলাম আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে। এখানে বিশালাকায় একোয়ারিয়ামে রয়েছে বিভিন্ন জলচর প্রাণী। খুব ভালো লাগবে এটি দেখতে। 

এরপর আমরা গিয়েছিলাম পাটায়ার ভিউ পয়েন্টে, পাখির চোখে অপূর্ব পাটায়ার সৌন্দর্য ছিল মনোমুগ্ধকর। 


এর পরের পাহাড়টিতে এই শহরের বিগ বুদ্ধা স্থাপত্যটি রয়েছে তবে সেখানে আমরা এবার যেতে পারিনি, কাজেই এবার আমাদের গন্তব্য আজকের হোটেল, আমরা ছিলাম তেভান জমিতেনে। জমিতেন সমুদ্রসৈকত এখান থেকে হাঁটা পথে প্রায় ১৫-২০ মিনিট। একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। সকলের বেশ খিদে পেয়েছিলো, সৈকতের নিকটেই একটি রেস্তোরাঁ আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল, এর বিশেষত্ব ছিল এটি একটি মাল্টি-কুইসিন রেস্তোরাঁ, এখানে ভারতীয়, বাঙালি, থাই এবং ইউরোপিয়ান সকল ধরণের কুইসিন পাওয়া যায়। রেস্তোরাঁর এম্বিয়েন্সও আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল।  শেফের সাথে আমাদের পরিচয় হলো, উনি বাঙালী, ওঁনার স্ত্রী থাই, পুরো পরিবার একসাথে এই রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করেন। তন্দুরি রুটি, জিরা রাইস, মাছের কারী, চিকেন কারী, আমের লস্যি সব দিয়ে আমাদের ডিনারটা বেশ জমে উঠেছিল। অনেক গল্পও হলো, ওঁদের জীবন, থাইল্যান্ডের জীবন, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।  বারবার উঠে এসেছিলো করোনা-র সময়কালের কথা, সে সত্যই এক সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার কাহিনী।

আজকের মতন বিশ্রাম। আমরা ঠিক করেছিলাম ঘরে গিয়ে সবাই গল্প করবো, কিন্তু তা আর হল না। সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আবার আগামীকাল ভোর ভোর ওঠা ছিল, কারণ আগামীকাল আমাদের এই ভ্রমণের অন্তিম দিন। 

আজ আমরা সবাই সকাল সকাল উঠে পড়েছিলাম। এবার প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যাবো সমুদ্রে স্নান করতে। গত কাল রাত্রে ফেরার পথে সকলের জন্যে নিজ নিজ পছন্দ অনুসারে প্রাতঃরাশ কিনে আনা হয়েছিল। চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আগেই আমাদের আজকের দুপুরের খাবার আলু পরোটা অর্ডার দেওয়াই ছিল, সমুদ্রে স্নান করে ফেরার পথে সেটা নিয়ে আসার কথা। বেরোনোর আগে আমরা খেয়ে বেরোবো।  

এবার ফেরার পালা। সবথেকে বেশি আমরা প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞ। কয়েক মাস আগে যখন পরিকল্পনা করেছিলাম তখন আমাদের মনে বৃষ্টির একটা ভয় ছিল, জুলাই মাসে বৃষ্টি হওয়াটা একেবারেই আশ্চর্য নয়। এমনকি বেড়াতে আসার পূর্বের সপ্তাহটিতে আমাদের ওখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল, তবে প্রকৃতি আমাদের মনোস্কামনা শুনেছিলেন, খুব সুন্দর রৌদ্র ঝলমল আবহাওয়া আমাদের বেড়ানোটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল। বেলা ১২ টার সময়ে আমরা হোটেল ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, নিৰ্দিষ্ট সময়েই বির গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন হোটেলে। গাড়িতে মালপত্র সব তুলে দেওয়া হলো।  পাটায়াকে বিদায় জানিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য ব্যাঙ্ককে সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে অবস্থিত সিয়াম প্রিমিয়াম আউটলেট (Siam Premium Outlet), সবাই জিনিসপত্র দেখা কেনার জন্যে উৎসাহী, কাজেই আমরা এই স্থানে ঘন্টা তিনেক কাটালাম। দোকানগুলিতে ঘোরাঘুরির মাঝে বিভিন্ন ধরণের ফ্রাইড রাইস, আর থাই টি দিয়ে খাওয়াদাওয়া সারলাম। আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ হলে আমরা চললাম সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে, এখান থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ গাড়িতে। 

মা-বাবা দের যে বিমান সংস্থার টিকিট ছিল দেখলাম সেই সংস্থা তাদের বিমান বাতিল করেছে এবং কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থাও করেনি। এরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বড়ই আশ্চর্য করে আমাদের, তবে কি আর করা ! আমরা ওপর একটি বিমানের টিকিট কিনে নিলাম। ওঁদের বিমান ছিল রাত্রি ১১ টা বেজে ৩০ মিনিটে। আমাদের পরের দিনই ভোর ১ টা বেজে ৪৫ মিনিটে। বোর্ডিং, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি সবই ওঁদের আমাদের আগে হয়ে গিয়েছিলো। আমরা তখনও বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে আমাদের প্রক্রিয়া শুরু হলো, যখন ভিতরে গিয়ে মা-বাবা দের সাথে দেখা হলো ততক্ষনে ওঁদের বিমানের সময় প্রায় হয়ে গিয়েছিলো। ওঁরা এয়ারপোর্টে কোনো খাবার খেলো না, ফ্লাইটে ডিনার করবে বললো। একসাথে কিছুক্ষন কাটিয়ে ওঁদের বিমানে ওঠার পর আমরা আমাদের গেটের দিকে এগিয়ে চললাম, পথে একটি দোকানে ডিনার সেরে নিলাম। 

এবার ফিরে চলা, মাথায় ভিড় করে আসছে একের পর এক কাজ। গিয়েই সামনের সপ্তাহে আমাকে যেতে হবে একটি আন্তর্জাতিক ইকোলজি বিষয়ক সম্মেলনে, সেই সংক্রান্ত বেশ কিছু কাজ রয়েছে। বেশ ভালো বেড়ানো হলো। শেষ মুহূর্তে মা-বাবা দের জিজ্ঞেস করেছিলাম এর পর তাঁরা কোথায় যেতে পছন্দ করবে? উত্তর এখনো নিশ্চিত হয়নি, যদি কোথাও যাই নিশ্চয় তা ভবিষ্যতে আমার ব্লগে লেখার চেষ্টা করবো।  

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-৫ (Thailand: Part-5)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ থাইল্যান্ড: পর্ব-৪

আজ আমাদের ব্যাঙ্কক ঘোরার প্রথম দিন। প্রথমে আমরা যাবো ম্যাকলং রেলস্টেশনে (Maeklong Station)। রেললাইনের দু'পাশে পসরা সাজিয়ে বাজার বসেছে।  ট্রেনটি যখন আসে দোকানগুলির উপর থেকে চাঁদোয়াগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়, সংকীর্ণ লাইনটি বেয়ে রেলগাড়িটি স্টেশনে আসে। এই দৃশ্য দেখার জন্যে প্রত্যহ সকালে পর্যটকরা ভিড় করেন, যেমন আমরাও এসেছি আজ। কথা মতন নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ সকাল ৭টায় রুডি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর এক ভাইপোকেও পাঠিয়েছিলেন, আগে থেকে দর্শনীয় স্থানগুলির টিকিট কেটে আমাদের সাহায্য করার জন্য। স্থানীয় বাজারটি ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগে, বেশিরভাগ সব্জি পরিচিত হলেও বেশ কিছু সব্জি, ফল অচেনাও থাকতে পারে। ট্রেন আসার পূর্বেই আমরা যথাস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। স্টেশনের পাশেই রয়েছে সারি সারি রেস্তোরাঁ। চা-বিস্কুট আমরা খেয়েই বেরিয়েছিলাম। এখানে যে যার মতন পানীয় পছন্দ করে কিনলো, কেউ ডাব আবার কেউ ম্যাংগো স্মুদি। ডাব আমার বড়োই প্রিয়, জল তো বটেই, ভিতরের শাঁস টাও ততোধিক প্রিয়। তবে দক্ষিণ কোরিয়াতে ডাব খুব একটা পাওয়া যায় না, কখনও টিনে ডাবের জল পাওয়া যায় বটে কিন্তু তা আমার ভালো লাগে না, কাজেই এই পুরো ঘোরাতেই আমি মন ভরে ডাব খেয়েছিলাম। এবার ট্রেনটি ঢুকছে, লাইনের উপর পর্যটকদের ভিড়, নিজ নিজ দোকানের চাঁদোয়াগুলি দোকানিরা সরিয়ে নিচ্ছেন আর ট্রেনটি এগিয়ে আসছে। বেশ উপভোগ্য এ দৃশ্য। 

ক্রমাগত লাইন থেকে পর্যটকদের সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ বার্তা বাজতে লাগলো, ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করলো। এতক্ষণ ট্রেন আসার ছবি বা ভিডিও তুলতে ব্যস্ত পর্যটকরা এবার ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বলাই বাহুল্য, আমরাও এ আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করিনি। 

এখন থেকে আমরা যাবো দামনেন সাদুকে (Damnoen Saduak)। শহরের মধ্যে দিয়ে কয়েক কিলোমিটার ব্যাপী বয়ে চলেছে একটি খাল, তার দু'পাশে স্থানীয় মানুষের ঘর-বাড়ি, দোকান, আবার কোথাও নৌকা করে বাজারের পসরা সাজিয়ে চলেছে বেচা কেনা, অনেক ভেনিসের মতন। আমরা এখানে নৌকাবিহার করবো। তবে যাওয়ার পথে প্রথমে যাবো নারকেল থেকে গুড় প্রস্তুত করা দেখতে। আঁখি গুড়ের সাথে আমরা ভারতবাসীরা পরিচিত, শীতকালে খেঁজুরের রস থেকে যে গুড় বা পাটালি তৈরী হয় তা তো বাঙালির প্রেম, আবার তালের পাটালিও হয়ে থাকে, তবে নারকেল থেকে গুড় প্রস্তুত করা হয় তা আমি পূর্বে জানলেও  চেখে দেখার সুযোগ এই প্রথম বার, বেশ সুস্বাদু। 

এইবার চললাম দামনেন সাদুকের উদ্দেশ্যে। গাড়ি থেকে নেমে যে পথ দিয়ে নৌকার কাছে পৌঁছলাম তার দু'পাশে কাষ্ঠনির্মিত অনেক ভাস্কর্য রাখা রয়েছে, অধিকাংশই ভগবান বুদ্ধের এবং বৌদ্ধ ধর্মের নানান চরিত্রের। 

একটি নৌকায় ছয়জন, কাজেই আমাদের একটি নৌকা লেগেছিলো। নৌকার পশ্চাদভাগে ইঞ্জিন রয়েছে, নৌকার চালক সেখান থেকে নৌকাটিকে চালাচ্ছেন। সরু খাল বেয়ে অত্যন্ত দ্রুতবেগে চলে এই নৌকাগুলি আর পর্যটকরা তা উপভোগ করেন, নৌকায় যেতে যেতে দেখেন আশপাশের ঘর বাড়ি, বাগান ইত্যাদি, এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আবার প্রতিটি বাঁকের সময় নৌকার গতি ধীর হয়ে যায়, বাঁক ঘুরেই আবার সে গতি বৃদ্ধি করে। নৌকা যাত্রা সব মিলিয়ে প্রায় ২০ মিনিট মতন। 

নৌকা এসে যে স্থানে নামিয়ে দেয়, সেটা বাজার। নৌকা থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে আমরা যখন উঠে আসলাম, তখন দোকানিদের ডাকাডাকি, তাদের পসরা দেখানোর ধুম লেগে যায়। 

একটু এগিয়ে আসতেই দেখলাম, এক ব্যক্তি কয়েকটি বাঁধানো ছবি আমাদের সামনে এসে আমাদের বিক্রি করতে চাইছেন, ছবি দেখে তো আমরা আশ্চর্য। এতো আমাদেরই নৌকাবিহারের ছবি ! নৌকা ছাড়ার একটু পরেই এক ব্যক্তি পাড় থেকে আমাদের ছবি তুলেছিলেন, মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে তা প্রিন্ট করে বাঁধিয়ে বিক্রি করতে এসেছেন। ছবিগুলি আমরা কিনেছিলাম, এক একটা ১৫০ থাই বাত করে নিয়েছিলেন। কাপড়, বিভিন্ন দ্রব্যাদি ইত্যাদির পাশাপাশি এখানে একের পর এক রেস্তোরাঁ রয়েছে। নিজেদের পছন্দের মতন একটি দোকানে গিয়ে বসলাম। সি ফুড ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাইড রাইস, প্রন ফ্রাইড রাইস, স্যুপ ইত্যাদি ছাড়াও এখানে যে জিনিসটা আমাদের সর্বাধিক রসনাতৃপ্তকারক ছিল তা হলো ডাব আইসক্রিম। ডাবের নরম শাঁসের মধ্যে আইসক্রিম, তার উপর চীনাবাদাম, নীল রঙের অল্প ভাত আর একটি ফুল দিয়ে গার্নিশ করা।

এবার আমরা ফিরে চললাম। প্রথম গন্তব্য ব্যাঙ্ককের গ্র্যান্ড প্যালেস। এটি পর্যটকদের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য। মহান গ্র্যান্ড প্যালেস প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে অবস্থিত মহিমান্বিত ভবনগুলির স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ। রাজা প্রথম রামা দ্বারা রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ব্যাঙ্ককে প্রতিষ্ঠান করার সময় ১৭৮২ সালে এই প্যালেসটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ২১৮০০০ বর্গ মিটার ব্যাপৃত প্যালেস প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে রয়েছে রাজসিংহাসনের বাড়ি, প্রসিদ্ধ এমারাল্ড বুদ্ধ মন্দির (The Temple of the Emerald Buddha) সহ অনেকগুলি সরকারি দফতর। 

প্রথম পর্বে এই দেশটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনার সময় উল্লেখ করেছিলাম চাকরি রাজবংশের কথা, যা ইতিহাসে রাত্তানাকসিন রাজত্ব (Rattanakosin Kingdom) নাম পরিচিত। ব্যাঙ্ককের হৃদয়ে অবস্থিত এই মহান প্যালেসটি রাজা চাও ফ্রায়া (Phra Phutthayotfa Chulalok Maharaj) যিনি রাজা প্রথম রামা নাম পরিচিত, থেকে রাজা রামা পঞ্চম পর্যন্ত রাজাদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এই স্থানটি রাজপরিবারের অনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় এবং রাজার অতিথিদের, রাষ্ট্রের অতিথিদের এবং অন্যান্য বিদেশী বিশেষাধিকারীদের স্বাগতের জন্য ব্যবহৃত হয়। গ্র্যান্ড প্যালেসের প্রবেশ পথে অনেক গাইড রয়েছেন, তাঁরা নিজেরাই এগিয়ে আসবেন, তবে কথা বলে গাইডের পারিশ্রমিক ঠিক করে নেওয়া বাঞ্চনীয়। একা একাও এস্থান ঘুরে দেখা যায়, তবে সাথে গাইড থাকলে বুঝে নিতে সাহায্য হয়।   

 

প্রথম পর্বে আমি উল্লেখ করেছিলাম রামাকিয়েন-র কথা। এই কাহিনী রামায়ণের হলেও কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণের রাজা রাম রামাকিয়েনে ফ্রা রামা (Phra Rama), সীতা এখানে নাং সিদা (Nang Sida), দশরথ এখানে থোৎসারথ (Thotsaroth), রাবণ এখানে তৎসাকান (Totsakan) ইত্যাদি। রামাকিয়েনের কাহিনী অনুসারে মাতা সীতা রাবণের কন্যা, হনুমান বিবাহিত পুরুষ, হনুমান নিজেকে প্রসারিত করে সেতু নির্মাণ করেন ইত্যাদি বেশ কয়েকটি স্থানে বৈসাদৃশ্য লক্ষ্যিত হয়। এই কাহিনী প্রসঙ্গান্তরে সুযোগ পেলে কখনও বিস্তারিত আলোচনা করবো। এই কাহিনীগুলি শিল্পীর কল্পনায় প্যালেসের দেওয়ালে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

এরপর আমাদের দ্রষ্টব্য ওয়াট ফো, যার অফিসিয়াল নাম ওয়াট ফ্রা চেতুফন উইমন মংখলারাম রাজওয়ারমহাভিহান (Wat Phra Chetuphon Wimon Mangkhalaram Rajwaramahawihan)। রাজা রামা প্রথম পূর্ববর্তী মন্দিরটিকে পুনর্নির্মাণ করেন এবং পরবর্তীকালে রাজা রামা তৃতীয় মন্দিরটিকে সম্প্রসারণ এবং সংস্কার করেন। ব্যাঙ্কক শহরের প্রাচীনতম মন্দিরটির নাম ওয়াট ফো এসেছে ওয়াট ফোতারাম (Wat Photaram) বা ওয়াট ফোধারাম (Wat Phodharam) কথাটি থেকে, যা ভারতবর্ষের বোধ গয়ায় অবস্থিত বোধিবৃক্ষের মঠ কে নির্দেশ করে। থাইল্যান্ডের সাথে ভারতবর্ষের দর্শন একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, ভ্রমণের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের মাধ্যমে তা সহজেই অনুভব হয়। চোখে পড়বে চাও ফ্রায়া নদীর ওপর তীরে অবস্থিত অন্য একটি বৌদ্ধ মন্দির হলো ওয়াট অরুন। যখন আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য বার্মিজ আক্রমণে অস্তমিত তখন রাজা তাকসিন থোনবুরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং বৌদ্ধ মন্দির অরুনের পাশে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান। পরবর্তীকালে রাত্তানাকসিন রাজবংশের সূচনায় রাজা রামা প্রথম থোনবুরি থেকে ব্যাঙ্ককে রাজধানী স্থানান্তরিত করলে তিনি বৌদ্ধ মন্দির ফো-র পাশে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান।  

৮০ বর্গমিটার বিস্তৃত মন্দির প্রাঙ্গনটিতে রয়েছে ফ্রা উবসত (Phra Ubosot), ফ্রা রাবিয়াং (Phra Rabiang), ফ্রা মহা চেদি সি রাজকর্ণ (Phra Maha Chedi Si Rajakarn), এবং রিক্লাইনিং বুদ্ধ (Reclining Buddha) মূর্তি। ফ্রা উবসত (ফ্রা উপোসাথা) বা বট হল  হল, বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত প্রধান অর্ডিনেশন গৃহ এবং প্রাঙ্গণটির সর্বাধিক পবিত্র ভবন। এটি আয়ুথায়-শৈলীতে রাজা প্রথম রাম দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, এবং পরে রাম তৃতীয় দ্বারা রত্নকোসিন-শৈলীতে এটিকে প্রসারিত ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।  ফ্রা উবসত ফ্রা রাবিয়াং দ্বারা ঘেরা প্রাঙ্গনের মধ্যভাগে অবস্থিত।

এই ডাবল ক্লোস্টারে উত্তর থাইল্যান্ডের বুদ্ধের প্রায় ৪০০ টি মূর্তি রয়েছে যা মূলত রাজা রাম প্রথম দ্বারা আনা ১২০০ টির মধ্যে নির্বাচিত হয়েছে। এই বুদ্ধ মূর্তিগুলির মধ্যে ১৫০ টি ডাবল ক্লোস্টারের ভিতরের দিকে, অন্য ২৪৪ টি মূর্তি বাইরের দিকে রয়েছে। এই বুদ্ধের মূর্তিগুলো, কিছু দাঁড়িয়ে আছে এবং কিছু উপবিষ্ট, সমানভাবে সোনালি পাদদেশে মাউন্ট করা হয়েছে। এই মূর্তিগুলি সিয়ামের বিভিন্ন স্থান থেকে আনীত এবং ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালের, যেমন চিয়াংসেন (Chiang Saen), সুখোথাই (Sukhothai), ইউ-থং (U-Thong) এবং আয়ুত্থায়া (Ayutthaya) সময়কালের। মূর্তিগুলিকে রামা প্রথম সংস্কার করেছিলেন এবং এগুলিকে সোনার পাতা দিয়ে আবৃত করে দেওয়া হয়েছিল।      

রিক্লাইনিং বুদ্ধ (ফ্রা বুদ্ধসাইয়াস/ Phra Buddhasaiyas) ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামা তৃতীয় দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এই হেলান দেওয়া বুদ্ধমূর্তি ভগবান বুদ্ধের নির্বাণে প্রবেশ এবং সমস্ত পুনর্জন্মের সমাপ্তির প্রতিনিধিত্ব করে।



ভগবান বুদ্ধ কে নতজানু হয়ে প্রণাম করে এবার আমাদের আজকের মতন ফেরা। অনেক সকালে আমরা বেরিয়েছিলাম। ঘরে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সারাদিনের গল্প, দিনটিকে ফিরে দেখা, এইভাবেই কেটে গেলো সন্ধ্যেটা। ফেরার পথে একটু বৃষ্টি হয়েছিল তবে তা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি। আজ আমরা সন্ধ্যার জলখাবার, রাতের খাওয়া-দাওয়া ঘরেই সেরেছিলাম। চা-বিস্কুট, নুডলস, কেক, মিষ্টি ছিল খাদ্যের তালিকায়। কাল ব্যাঙ্কক থেকে আমরা যাবো পাটায়া। সেই গল্প আসবে আগামী পর্বে। 

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-৪ (Thailand: Part-4)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩

আজও ঘুম ভাঙলো ভোর ৫ টায়। আসলে থাইল্যান্ড সময় দক্ষিণ কোরিয়ার সময়ের থেকে ২ ঘন্টা পিছিয়ে, আমার বায়োলজিক্যাল ক্লক অনুসারে আমি বাড়িতে সকাল ৭ টায় উঠি, কাজেই এখানে তাড়াতাড়ি আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।  এতে বেশ ভালোই হয়, ভোর উপভোগও করতে পারি, নিজের কিছু কাজও সারা হয়ে যায়, আবার আগে থেকে বেড়ানোর সব কিছু ঠিকঠাক করে রাখতে পারি। মা বাবা'দের ক্ষেত্রে হচ্ছে এর ঠিক বিপরীত কারণ ভারতীয় সময় থাইল্যান্ডের সময় থেকে আবার দেড় ঘন্টা পিছিয়ে। যাই হোক আজ একটু তাড়াতড়ি সবাই উঠে পড়লো। চা বা কফি, যে যা খাবে তা তৈরী হলো, সাথে বিস্কুট, কেক, মিষ্টি এসব তো ছিলই। তৈরি হয়ে আমরা পৌনে ৮ টা নাগাদ বিচের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আগেই বলেছি পায়ে হেঁটে ৫-৭ মিনিট লাগে কারোণ বিচ, পথে অনেক রেস্তোরাঁর মধ্যে একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁও চোখে পড়লো। তবে সব দোকান, রেস্তোরাঁ এখন বন্ধ, একটু বেলা হলে খুলবে। বিচে পৌঁছে আমরা সোজা সমুদ্রে নেমে পড়লাম। মাঝে মাঝে পারে এসে ঘড়ি দেখে যাওয়া, আবার নেমে পড়া। প্রাণ মন ভরে আমরা দু'ঘন্টা সমুদ্রস্নান করেছিলাম।   

১০ টায় আমরা রিসর্টে পৌঁছলাম। এবার সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি করে ভাত বসানো হলো। তরকারী, ডিমের কষা- ফ্রিজে এসব তো ছিলই, শুধু গরম করে নেওয়া হলো। 

আমাদের গাড়ি এলো বেলা ১২ টায়। এবার আমরা যাব ফুকেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, সেখান থেকে ব্যাঙ্কক। ফুকেটকে বিদায় জানিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বিমান তার যাত্রা শুরু করলো, এবং সঠিক সময়েই ব্যাঙ্ককে অবতরণ করলো। 

যখন ব্যাঙ্কক নামলাম তখনও দিনের আলো ছিল। বাইরেই আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছিলো। আমি আগেই হোটেলে ফোন করে আমাদের চেক ইন সময়টি জানিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা চললাম আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমরা থাকবো ডেস রেস হোটেল এন্ড রেসিডেন্সে। এটি সমুৎপ্রাকার্নে অবস্থিত, ব্যাঙ্ককের এই স্থানটি রেসিডেনশিয়াল অঞ্চল। পর্যটকের জনপ্রিয় অঞ্চল খাওসান রোড বা চায়না টাউন থেকে একটু দূরে এই জায়গাটি। প্রায় সাড়ে ৭ টা নাগাদ আমরা হোটেল এসে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরোলাম রাত্রের আহারের জন্যে। এস্থানে রয়েছে একাধিক খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁ, অধিকাংশ থাই, একটি জাপানিজ রেস্তোরাঁও চোখে পড়লো। আমরা একটি থাই রেস্তোরাঁতে ঢুকলাম, যেহেতু আমরা থাই খাবারের নামগুলির সাথে পরিচিত নই, শেফ এসে আমাদের সাথে আলোচনা করে তারপর অর্ডার নিলেন। আমরা নিয়েছিলাম সি ফুড ফ্রাইড রাইস, প্রন-চিকেন ফ্রাইড রাইস ইত্যাদি।   

আজকের মতন বিশ্রাম। আগামীকাল আমাদের ব্যাঙ্কক বেড়ানো, আগামী পর্বে আসবে সেই কাহিনী। 

জুলাই, ২০২৩        

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...