পৃষ্ঠাসমূহ

আনদং-র জু-টোপিয়াম: পর্ব-১: স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একটি সংক্ষিপ্ত সরল বর্ণনা (Andong Zootopium: Part-1: A brief, simple description of mammals)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আনদং-এ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে, ১০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই একটি ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে। আমরা সপ্তাহান্তে (সপ্তাহান্তে বেড়ানো-র কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা পড়ার জয়ে ক্লিক করুন সপ্তাহান্তে বেড়ানো) প্রায়ই সেখানে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগে যে বাৎসরিক কীট-পতঙ্গ, ও অন্যান্য ছোট প্রাণীদের নিয়ে প্রদর্শনী আয়োজিত হয়, সেখানে প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে কিছু প্রাণী এখান থেকে কখনও নেওয়া হয়। অনেক প্রাণী রয়েছে এখানে যেগুলি আমি আগে কখনো দেখনি আবার অনেকগুলি বেশ পূর্বপরিচিত। এই স্থানটিতে শুধুই যে ক্যাপটিভিটিতে (Captivity) রাখা কিছু প্রাণীর প্রদর্শনী তা নয়, সেগুলি সম্বন্ধে মানুষকে, বিশেষত বাচ্চাদের অবহিত করেন এখানকার কর্মীবৃন্দ।এখানে আমি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিষয়ে একটি বিবরণ লিখছি, এবং এখানে রাখা কয়েকটি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ছবি দিচ্ছি। American Society of Mammalogists-র ম্যামাল ডাইভার্সিটি ডাটাবেস (Mammal Diversity Database) অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে ৬৪৯৫ টি জীবিত প্রজাতির (Species) স্তন্যপায়ী প্রাণী (মোট ৬৫৯৬ প্রজাতি, অবলুপ্ত হয়ে গেছে ১০১ টি প্রজাতি) রয়েছে। বলাইবাহুল্য প্রতিটি প্রজাতি সম্বন্ধে এক এক করে জানা অল্পসময়ে অসম্ভব, কাজেই এদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে এদের কয়েকটি বিজ্ঞানসম্মত ভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। এতে সহজে এদের সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যায়। 

কর্ডাটা (Chordata) পর্বভূক্ত স্তন্যপায়ী (Mammals; Class: Mammalia) প্রাণী আমাদের সকলের পরিচিত।  যেমন মানুষ, গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বিড়াল যা আমরা প্রত্যহ আমাদের আশেপাশে দেখে থাকি, এরা সকলেই স্তন্যপায়ী প্রাণী।  সাধারণভাবে যাদের দেহে লোম বর্তমান, এবং স্তন গ্রন্থি বিদ্যমান তাহারা সকলে স্তন্যপায়ী ক্লাসভুক্ত প্রাণী। স্তন্যপায়ী ক্লাসটিকে দু'টি সাবক্লাসে বিভক্ত করা হয়, যথাক্রমে প্রোটোথেরিয়া (Prototheria) এবং থেরিয়া (Theria)যেসকল স্তন্যপায়ী প্রাণী ডিম পাড়ে তাহারা প্রোটোথেরিয়ার (অর্ডার-মনোট্রিমাটা (Monotremata)) অন্তর্গত, যেমন Ornithorhynchus, Tachyglossus, Echidnaঅপরপক্ষে যে সকল স্তন্যপায়ী প্রাণী বাচ্চা প্রসব করে তাহারা থেরিয়া সাবক্লাসভুক্ত। থেরিয়া দু'টি ইন্ফ্রাক্লাসে বিভক্ত, যথা মেটাথেরিয়া (Metatheria) এবং ইউথেরিয়া (Eutheria)মেটাথেরিয়ারা অপরিণত বাচ্চা প্রসব করে যারা প্রসবের পরে মায়ের দেহে মারসুপিয়ামের (Marsupium: বাচ্চা ধারন করার থলি) মধ্যে পরিণত হয়। মেটাথেরিয়া ইন্ফ্রাক্লাসের একটি অর্ডার রয়েছে, যা মার্সুপিলিয়া (Marsupilia) নামে পরিচিত। ক্যাঙ্গারু (Kangaroo), উম্ব্যাট (Wombat), কোয়ালা (Koala bear), ব্যান্ডেড এন্ট ইটার (Banded ant eater), অপসাম (Opossum) ইত্যাদি এই অর্ডারভুক্ত প্রাণী। এরপর আসি ইউথেরিয়া-তে, এরা পরিণত বাচ্চা প্রসব করে, এটি বৃহৎ ইন্ফ্রাক্লাস যা সাধারণত চারটি কোহর্ট-এ বিভক্ত। কোহর্টগুলি যথাক্রমে আঙ্গুইকিউল্যাটা (Unguiculata: যাদের আঙুলে নখ বা ক্ল’ (Claw) বর্তমান), গ্লাইআরিস (Glires: যাদের দাঁত চিবানোর উপযোগী, হাতে পাঁচটি আঙ্গুল বর্তমান), মিউটিকা (Mutica: এদের ভোকাল কর্ড অনুপস্থিত, এবং জলে জীবন অতিবাহিত করে, যেমন তিমি), এবং ফেরুঙ্গুল্যাটা (Ferungulata: মাংসাশী এবং খুরযুক্ত প্রাণী)।

এবার একটু বিভিন্ন কোহর্ট-র অন্তর্গত অর্ডারগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। সব থেকে বড় অর্ডারটি হলো রোডেনশিয়া (Rodentia), যা Glires কোহর্ট-এর অন্তর্গত। এদের উপর এবং নিচের মাড়িতে এক জোড়া তীক্ষ্ণ ইনসিজার (Incisors) দাঁত রয়েছে, এটিই এই অর্ডার-এর প্রাণীদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ইঁদুর (Rat, Mouse), কাঠবেড়ালি (Squirrel), চিপমাঙ্ক (Chipmunk), প্যাটাগোনিয়া মারা (Patagonian mara)  ইত্যাদি এর অন্তর্গত। 


এছাড়াও প্রেইরি ডগও (Prairie Dog) এই অর্ডারের অন্তর্গত।

প্যাটাগোনিয়ান মারা (Patagonian mara: Dolichotis patagonum) এদের সংগ্রহে ছিল, যদিও এবারে তাদের দেখলাম না, হয়তো ভিতরের দিকে থাকবে। প্যাটাগোনিয়ান মারা -র বাসস্থান আর্জেন্টিনা। এরা বিভিন্ন ধরণের ঘাস, ফল, ইত্যাদি খায়।

এই কোহর্ট-র অপর অর্ডারটি হলো লোগোমর্ফ (Logomorph), এদের উপরের মাড়িতে দুইজোড়া (অসমান) ইনসিজার দাঁত রয়েছে, কিন্তু নিচের মাড়িতে একজোড়া ইনসিজার দাঁত রয়েছে। খরগোশ এই অর্ডারভুক্ত প্রাণীদের উদাহরণ।      

দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্ডারটি হলো Unguiculata কোহর্টভুক্ত  কাইরোপটেরা (Chiroptera), এদের সামনের বাহুদুটি ডানায় অভিযোজিত হয়েছে, বাঁদুড় এই অর্ডারভুক্ত প্রাণী। সরিকোমরফা (Soricomorpha), যা পূর্বে ইনসেক্টিভোরা (Insectivora: এদের খাদ্য কীট পতঙ্গ) নামে পরিচিত ছিল। এই অর্ডারটির প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শৃউ (Shrew), মোল (Mole), হেজহগ (Hedgehog) ইত্যাদি। হেজহগ রয়েছে এঁদের সংগ্রহে, প্রাণীটিকে হাতে নিয়ে আদর করতে করতে তার ছবিটি তুলতেই ভুলে গেছিলাম। কাজেই এখানে ছবিটা দিতে পারলাম না। হেজহগের একাধিক গণ রয়েছে, যেমন Atelerix, Erinaceus, Hemiechinus, Mesechinus, Parachinusএরা প্রধানত নিশাচর। এরা  কীট -পতঙ্গশামুক, ব্যাঙ, সাপ, পাখির ডিম, মাশরুম, ঘাস, গাছের মূল, মেলন, তরমুজ, বেরী ইত্যাদি খাদ্য খায়। 

এছাড়াও এই কোহর্ট-র অন্তর্গত রয়েছে ডার্ম্পটেরা (Dermoptera; Derme = চামড়া, Pteron = ডানা; ফ্লাইং লেমুর (Flying Lemur) এর উদাহরণ), এডেনটাটা (Edentata; E/Ex = ব্যাতি/ ছাড়া, Den= দাঁত; আর্মাডিলো (Armadillo), শ্লথ (Sloth) এর উদাহরণ), ফলিডোটা (Pholidota; Pholis = স্কেল/আঁশ; প্যাঙ্গোলিন (Pangolin) এর উদাহরণ), প্রাইমেট (Primate; মানুষ, বাঁদর, গরিলা, শিম্পান্জী ইত্যাদি এর উদাহরণ)

ফেরুঙ্গুল্যাটা কোহর্ট-টি আবার পাঁচটি সুপার অর্ডার-এ ভাগ করা যায়। যেমন ফেরে (Ferae), প্রোটাঙ্গুল্যাটা (Protungulata; তৃণভোজী এবং খুরযুক্ত), পিনাঙ্গুল্যাটা (Paenungulata; তৃণভোজী এবং নখযুক্ত ডিজিট বা আঙ্গুল রয়েছে), মেস্যাক্সনিয়া (Mesaxonia), প্যারাক্সনিয়া (Paraxonia) Ferae-র অন্তর্গত কার্নিভোরা (Carnovira; Carno = মাংস,  Vorvo = খাওয়া; কুকুর, শিয়াল, বিড়াল, বাঘ, সিংহ, লেপার্ড, জাগুয়ার, ওয়ালরাস (Walrus), সি-লায়ন (Sea lion), রাকুন (Racoon), পান্ডা (Panda), মঙ্গুস (Mongoose), মির্ক্যাট (Meerkat) ইত্যাদি এর উদাহরণ)  

এখানে রয়েছে রাকুন। কাচের নির্মিত খাঁচায় রাখা রয়েছে। সাদা রঙের রাকুনও রয়েছে চিড়িয়াখানাটিতে।রাকুনের (Procyon lotor) মূল বাসভূমি উত্তর আমেরিকা। এরা নিশাচর এবং ওমনিভর (Omnivore = আমিষ, নিরামিষ সকল প্রকার খাদ্য খায়)


চোখ টানবে মিরক্যাট। দক্ষিণ আফ্রিকা এদের মূল বাসস্থান। মিরক্যাট (Suricata suricatta) সমাজবদ্ধ অবস্থায় বিচরণ করে। এক একটি দলে প্রায় ত্রিশটি পর্যন্ত মিরক্যাট সদস্য থাকে। 

এছাড়াও এখানে ছিল মার্বেল ফক্স (Marble fox), একেবারে দুধ সাদা রঙের। এই ব্রিডটি কিন্তু প্রকৃতিতে হয় না, রেড (Red fox) আর সিলভার ফক্স-র (Silver fox) মিলনে মার্বেল ফক্স হয়।  

প্রোটাঙ্গুল্যাটা-র অন্তর্গত অর্ডার টুবুলিডেন্টাটা (Tubulus = ছোট টিউব, Dens = দাঁত; আৰ্দ্ভাক (Ardvark) এর উদাহরণ) পিনাঙ্গুল্যাটা-র অন্তর্গত হাইরাকয়দি (Hyracoidea; Hyrax = শৃউ/ Shrew, Eides = form; Hyrax এর উদাহরণ), প্রোবোসিডি  (Proboscidea; স্থলে বসবাসকারী সব থেকে বৃহৎ প্রাণী, হাতি এর উদাহরণ), সিরেনিয়া (Sirenia; Siren = sea nymph; সি কাউ (Sea cow) এর উদাহরণ)

মেস্যাক্সনিয়া, প্যারাক্সনিয়া -র অন্তর্গত অর্ডার দু'টি যথাক্রমে পেরিসোড্যাকটাইলা (Perissodactyla; Perissos = odd; Daktylos = finger; Odd-toed hoofed mammals; তাপির, গন্ডার, ঘোড়া, গাধা, জেব্রা এর উদাহরণ) এবং আরটিওড্যাকটাইলা (Artiodactyla; Artios = even; Daktylos = finger; Even-toed hoofed mammals; জলহস্তী, শুয়োর, উট, হরিণ, ছাগল, গরু, ভেড়া, ইত্যাদি এর উদাহরণ)

চিড়িযাখানটিতে প্রবেশের সাথে সাথেই চোখে পড়বে আলপাকা। দক্ষিণ আমেরিকায় আলপাকা-র (Alpaca: Lama pacos) বাসভূমি, এদের আদি বাসস্থান পেরুতে। এরা আরটিওড্যাকটাইলা-র অন্তর্গত। প্রধানত উঁচু টেম্পারেট অঞ্চলে এদের বাস। এদের খাদ্যবস্তু মূলত ঘাস।  ভেড়ার লোম থেকে যেমন পশমের বস্তু প্রস্তুত করা হয়, ঠিক তেমন আলপাকা-র লোম থেকেও নানা পোশাক প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।

আশা করি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সম্বন্ধে একটা সাধারণ ধারণা দেওয়া গেলো।

কৃতজ্ঞতা: এই বিবরণে ব্যবহৃত ছবিগুলির অধিকাংশ আমার স্ত্রীর তোলা, তাঁর থেকে সেগুলি আমি সংগ্রহ করেছি। 

সেপ্টেম্বর, ২০২১

ভারতীয় রান্নার একটি গল্প (A story of Indian cuisine)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)



করোনা (Coronavirus/ Covid-19 pandemic) মহামারীর ধাক্কা সামলে পৃথিবীতে আবার ধীরে ধীরে সব কিছু স্বাভাবিক হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে, যেমন মাস্ক এখন সর্বক্ষণের সঙ্গী, একটা ছোট স্যানিটাইজার ব্যাগের পকেটে সর্বক্ষণের জন্যে রেখে দেওয়া, আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সময় করোনা পরীক্ষার প্রমাণপত্র রাখা ইত্যাদি। তবে আর একটা পরিবর্তন আমি নিজের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি, বাইরে না বেরোনোটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে, এটা বিশেষ স্বাস্থ্যকর নয়। প্রায় দু' বছর বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্র এবং কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি, এছাড়া আর কোথাও বিশেষ বেরোইনি, বেশিরভাগ কনফারেন্সে অনলাইন বক্তব্য রেখেছি, আত্মীয়-পরিজন আমার এদেশে কেউ নেই কাজেই যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি, একান্ত কর্মক্ষেত্রের দরকার ছাড়া বাইরে অন্য শহরে যায়নি। এ বছর চুসকের (Chuseok; Thanks giving ceremony of Korea) সময় সোলে (Seoul, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী) একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে খেতে যাবো ঠিক করলাম। আনদং (Andong) থেকে ট্রেনে যাব বলেই ঠিক করেছিলাম কিন্তু স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম ট্রেনের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। অগত্যা বাস-ই ভরসা। রেলপথে সোলে পৌঁছতে লাগে ২ ঘন্টা ৪ মিনিট আর যাত্রাপথটিও বেশ উপভোগ্য। অপরপক্ষে বাসে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘন্টার একটু বেশি। আনদং থেকে সাড়ে ন'টার বাসে রওনা হয়ে পূর্ব সোলে (Dong Seoul) এসে পৌঁছলাম প্রায়  দুপুর সোয়া এক'টায়।  সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রেস্তোরাঁ।

আমরা ভারতীয় থালি অর্ডার দিলাম। প্রথমেই তাঁরা লস্যি পরিবেশন করলেন। বেশ খিদেও পেয়েছিল, কাজেই খাবারে মনোনিবেশ করলাম।  সাথে সাথে একটু এই সুস্বাদু পদগুলির আবির্ভাব আর বিবর্তন দিকেও মন দিলাম। এই ব্যাপারটা বেশ মজাদার। এই বিষয়টি এখানে উল্লেখ করব। লস্যির সাথে সকল ভারতীয় পরিচিত। এরপর এলো সামোসা (বাংলায় যা সিঙ্গাড়া বা সিঙাড়া নামে পরিচিত) খুবই উপাদেয় আর সুস্বাদু এই আলু, পেঁয়াজ, কড়াইশুঁটির পুর দিয়ে প্রস্তুত সিঙ্গাড়া। বাংলা তথা ভারতবাসীর অতি পরিচিত এই পদটির জন্মস্থান কিন্তু ভারতবর্ষ নয় বরং মধ্য প্রাচ্য। পার্সিয়ান ঐতিহাসিক আবুল ফজল বেহাকি (Abu’l-Fadl Bayhaqi) তাঁর বই তারিখ-ই-বেহাঘি (Tarikh-e Beyhaghi) তে 'সাম্বোসা' র উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে আমির খসরু (Amir Khusrau) মাংস, ঘি আর পেঁয়াজ উপকরন সাহায্যে প্রস্তুত সামোসার উল্লেখ করেছেন। পর্যটক ইবন বতুতা (Ibn Battuta) 'সাম্বুসাগ' বলে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজসভায় যে রাজকীয় ভোজের একটি পদের উল্লেখ করেছেন যা মাংসের কিমা, আখরোট, পেস্তা, আলমন্ড এবং স্পাইস  বানানো সামোসা। মোগলাই পদগুলি নিয়ে পঞ্চদশ শতাব্দীতে সংকলিত গ্রন্থ নিমতনামা-তে (Ni’matnama) বিভিন্ন প্রকার 'সাম্বুসার' রন্ধনপ্রনালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। 'আইন-ই-আকবরী'তে (Ain-i-Akbari) 'সাংবুসহ' বা সামোসার উল্লেখ রয়েছে। মাংসের সামোসা উপাদেয় তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আজ সামোসা বা সিঙ্গাড়ার ভিতরে পুর হিসেবে আলু ব্যবহার করা হয়। এই আলু পর্তুগিজদের হাত ধরে ষোড়শ শতকে ভারতবর্ষে আসে।  

পরবর্তী পদ চিকেন কাবাব। খুব সুস্বাদু ছিল এই পদটি। মাংসের টুকরোগুলি বেশ নরম, উপযুক্তভাবে সিদ্ধ হয়েছিল এবং ব্যবহৃত মশলা গুলি ভিতরে ঢুকেছিলো। কাবাবগুলি একেবারেই শুকনো ছিল না। চিকেন খাওয়ার প্রচলন প্রথমে মোঘলদের হাত ধরে আর তারপর বৃটিশদের হাত ধরে এদেশে আসে। পূর্বে যে সকল ভারতবাসী আমিষ খাদ্য গ্রহণ করতেন, মাংসের মধ্যে ছিল মূলত খাসি বা পাঁঠা। দু'পুরুষ আগে ঠাকুমা দিদিমাদের কাছ থেকে জানতে পারা যায় মুরগির মাংস বা ডিম তখন খাওয়ার প্রচলন ছিল না, যদি একান্ত কেউ খেতেন তবে বা হেঁসেলের বাইরে উঠোনে রান্না করে খেতে হতো। ফাউল কাটলেট ইত্যাদি যে খাদ্যগুলি বাঙালির রসনাতৃপ্ত করতে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে বা বিংশ শতকের প্রথমভাগে আবির্ভূত হয়েছিল তা মূলত বৃটিশদের হাত ধরে। আর এই কাবাব কিন্তু তুর্কিদের আবিষ্কার বলে মনে করা হয়। ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত Kyssa-i Yusuf নামক তুর্কিশ বইতে কাবাব কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়, সম্ভবত এটিই একটি গ্রন্থ যাতে সর্বপ্রথম এই শব্দটি পাওয়া যায়। নিমতনামা-তে (Ni’matnama) কাবাবের উল্লেখও পাওয়া যায়।

এর পর ছিল তন্দুর নান। আজকের যে তন্দুর ভারতবর্ষ, ইরান, মধ্য এশিয়া, তুর্কি, ককেশীয়দের মধ্যে প্রচলিত তার উৎপত্তি প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতায় বলে ধারণা করা হয়। নান একটি প্রাচীন পার্সিয়ান শব্দ, এর অর্থ রুটি।  সম্ভবত মিশর থেকে ইস্ট ভারতবর্ষে আসে এবং তা এই নান প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়।  আমির খসরু-র লেখায় নানের উল্লেখ পাওয়া যায়।  সম্রাট শাহজাহানের রন্ধনশালায় যে সকল খাদ্য প্রস্তুত হতো তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় নুস্কা-ই- শাহজাহানী’ (Nushka-i-Shahjahani) বা  নুস্কা-উ-নমক’ (Nushka-u-Namak) বইটিতে। এখানে নান এবং রোটি-র উল্লেখ পাওয়া যায়।

এছাড়াও কারীর মধ্যে আমরা দু'টি পদ নিয়েছিলাম। আমিষের মধ্যে  মটন কারী এবং নিরামিষের মধ্যে পনির বাটার মশলা। আমার বিদেশী বন্ধুদের মুখ থেকে ভারতীয় রান্নার পদের মধ্যে কারীর কথা অনেকবার শুনেছি, তাঁরা ভারতীয় খাবার বলে কারী-কে বেশ উল্লেখযোগ্য বলে মনে করে। এর উপকরণে টমেটো, লঙ্কা কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইউরোপ এবং সেই স্থান থেকে এশিয়া তথা ভারতবর্ষে আগত।  আর পেঁয়াজ পশ্চিম এশিয়া থেকে এসে পৌঁছেছিল আমাদের দেশে।

এবার খাওয়া শেষ। ভারতীয় রেস্তোরাঁয় অনেক দিন পরে খেয়ে বেশ ভালো লাগলো। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত উপকরণ বা খাদ্যগুলি কিন্তু একই প্রকার রয়ে যায়নি বরং উল্লেখযোগ্যভাবে সেগুলির কিন্তু রূপান্তর ঘটেছে। ভারতীয় মশলার সহযোগে, ভারতীয় স্বাদ ও রন্ধন প্রণালী অনুযায়ী রেসিপিগুলি সমৃদ্ধ হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

সেপ্টেম্বর ২০২২

সম্পর্কিত রচনাটি পড়ার জন্যে খাদ্য, পুষ্টি এবং খাদ্যের রূপান্তর ক্লিক করুন। 

বাঙালীর আহারে মাছ (Fish in Bengali's diet)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

মাছে -ভাতে বাঙালী। খাদ্য নির্বাচনের সূত্র মেনেই জলবহুল বাংলায় অনাদিকাল থেকেই মাছ বাঙালীর খাদ্য হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। মাছ চিরকালই বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করার পাশাপাশি পুষ্টি প্রদান করে এসেছে।



চন্ডীমঙ্গল কাব্যে উল্লেখ রয়েছে,

কটু তৈলে রান্ধে বামা চিথলের কোল

বুহিতে কুমুড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল।

--------------------------------------------

কটু তৈলে কই মৎস্য ভাজে গন্ডা দশ

মুঠে নিঙ্গড়িয়া তথ্য দিল আদারস।

-------------------------------------------

কথোগুলি তোলে রামা চিঙ্গড়ির বড়া

ছোট ছোট গোটা চাবি ভাজিল কুমুড়া।

আবার চন্ডীমঙ্গল কাব্যের অপর এক স্থানে পাই,

ঘৃতে ভাজে পলাকড়ি                 নট্যা সাকে ফুলবড়ি

চিঙ্গড়ি কাঁঠাল বিচি দিয়া

ঘড়িতে নলিতার শাক                  কটু তৈলে বাথুয়া পাক

খন্ডে পেলে ফুলবড়ি ভাজিয়া।

-------------------------------------

ভাজা চিতলের কোল                  কাতলা মাছের ঝোল

মান বড়ি মরিচ ভূষিত।

পশ্চিম বাংলায় ২৩৯ প্রজাতির মিষ্টিজলের মাছ রয়েছে (Barman 2007) তবে এদের মধ্যে এমন কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে যারা সামুদ্রিক বা খাড়ির মাছ হলেও মিষ্টিজলে কিছুটা জীবন অতিবাহিত করতে আসে। যেমন ইলিশ, এরা মিষ্টি জলে আসে ডিম পাড়তে। আবার কয়েকটি প্রজাতির মাছকে অন্য ভৌগোলিক স্থান থেকে পশ্চিম বাংলায় আনা হয়েছে যেমন গ্রাস কার্প (Ctenopharyngodon idella), তেলাপিয়া (Oreochromis mossambicus, O. niloticus), সিলভার কার্প (Hypophthalmichthys molitrix), কমন কার্প (Cyprinus carpio carpio) ইত্যাদি। সবগুলিকে নিখুঁতভাবে চিহ্নিতকরণ সাধারণ মানুষের পক্ষে সকল সময়ে সম্ভব হয় না। যেমন Mystus menoda এবং M. tengara দুটিই ট্যাংরা বলে পরিচিত, আবার যেমন পুঁটি, কাঞ্চন পুঁটি, স্বর্ণ পুঁটি, তিত পুঁটি, গিল্লি পুঁটি সবই পুঁটি।

 

Category

বাংলা নাম

বিজ্ঞানসম্মত নাম

কার্প

রুই

Labeo rohita

কাতলা

Catla buchanani, C. catla

মৃগেল

Cirrhinus mrigala

কালবোস

Labeo calbasu

বার্ব

পুঁটি 

Puntius sophore

কাঞ্চন পুঁটি

Puntius conchonius

স্বর্ণ পুঁটি

Puntius sarana

তিত পুঁটি

Puntius ticto

গিল্লি পুঁটি

Puntius gelius

ক্যাটফিশ

পাবদা

Ompok pabda, O. bimaculatus, O. pabo

ট্যাংরা

Mystus menoda, M. tengara

গোলশা-ট্যাংরা

Mystus cavasius

শিঙ্গি

Heteropneustes fossilis

আড়

Osteogeneiosus militaris

বোয়ারি

Wallagonia attu

মাগুর

Clarias batrachus

পাঙ্গাস

Pangasius pangasius

গাগলা

Arius sp.

কান-মাগুর

Plotosus canius

হেরিং এবং শাদ

ইলিশ

Tenualosa ilisha or Hilsa lisha

ধলা

Ilishi clongate

খয়রা

Gonialosa manmina

ফেদারব্যাক

চিতল

Chitala chitala

ফলুই

Notopterus notopterus

জিয়ল

কই

Anabas cobojius, A. testudineus

পার্চ

ভেটকি

Lates calcarifer

ব্রিম

গুজ্জালী

Polynemus sp.

তোপসে

Polynemus paradiseus

ক্রকার্স

ভোলা

Barilius barna

গ্রে-মুলেট

পার্শে

Liza parsia

খারসুল/খরসুল

Mugil corsula

স্ক্যাবার্ড

রূপা পাইত্যা/ রূপা পাতিয়া

Trichiurus pantilui

পমফ্রেট

চাঁদা

Pseudambassis baculis, P. ranga

মুরেল

শোল

Channa striata

চিংড়ি*

গলদা চিংড়ি

Palaemon sp.

চিংড়ি

Penaeus carinatus, P. indicus

     * চিংড়ি মাছ নয়, এটি Arthropod পর্বভুক্ত

এছাড়াও রয়েছে মৌরলা (Amblypharyngodon microlepis, A. mola), বানলোটে (Bombay duck: Harpadon nehereus), আমুদি, বিভিন্ন ধরনের ট্যাংরা ইত্যাদি মাছ। চুনো মাছ বলে অনেকগুলি ছোট ছোট মাছ একসাথে কখনও বিক্রী হয় বাজারগুলিতে। পুষ্টিগত দিক থেকে এই সকল চুনো মাছগুলির পুষ্টিগুণ কিন্তু অপরিসীম। মাছ প্রোটিনের পাশাপাশি অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড ধারণ করে। প্রাণী থেকে প্রাপ্ত প্রোটিনের ১২.৮% আসে মাছ থেকে (Barik, 2017) মাছ খাওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায় আমাদের দেশে ক্যাপিটা প্রতি মাছ খাওয়ার পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি খুবই আশাব্যঞ্জক। এরফলে পুষ্টিসাধনের উপায় যেমন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে তেমনই জৈববৈচিত্রের উপর লক্ষ্য রাখা সম্ভব হবে (সাস্টেনেবল মাছ চাষ বা মাছ ধরার মাধ্যমে)

বর্মন (২০০৭)-র তথ্য অনুযায়ী ৫৯ টি মাছের প্রজাতি পশ্চিমবঙ্গে threatened যাদের মধ্যে ২২ টি প্রজাতি endangered এবং ৩৭টি vulnerable।  মাছের বাজারে গেলেই দেখা যায় কয়েকটি প্রজাতির মাছের আধিক্য থাকলেও অনেক মাছ আজকে প্রায় অমিল বা কম পাওয়া যায়। যেমন ট্যাপা (Tetraodon cutcutia), খয়রা (Gonialosa manmina), কাজুলি (Ailia coila), বাচা (Eutropiichthys vacha), মুড়ি বাচা (Eutropiichthys murius) ইত্যাদি খুব একটা চোখে পড়ে না। অন্যদিকে রুই, কাতলা, ভোলা ভেটকি, চিংড়ি,বর্ষায় ইলিশ, ইত্যাদির চাহিদা বেশ বেশি, কাজেই দামও বেশ বেশির দিকেই থাকে। খাদ্য তালিকায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাখুন সকল প্রকার মাছ। স্বাদের বৈচিত্রের পাশাপাশি জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য বজায় থাকবে। 


তথ্য সূত্র (References)

Barik, N.K. 2017. Freshwater fish for nutrition security in India: Evidence from FAO data. Aquaculture Reports 7: 106. https://doi.org/10.1016/j.aqrep.2017.04.001

Barman, R.P. 2007. A review of the freshwater fish fauna of West Bengal, India with suggestions for conservation of the threatened and endemic species. Records of Zoological Survey of India. Occasional paper no. 263, 1-48. 



রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...