সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
পড়ন্ত বেলাতেই এসে উপস্থিত হলাম অতীতের মহানগরী ‘মুক্সুবাদ’-এ। নগরীর বাঁ দিক দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী নদী, এই নগরের উত্থান তাকে ঘিরেই। নদীপথে ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা হেতুই মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব নিযুক্ত তৎকালীন বাঙলা, বিহার আর উড়িষ্যার সুবেদার (পরবর্তীকালে ‘নবাব নাজিম’) মুর্শিদকুলী খাঁ ঢাকা থেকে ভাগীরথীর উপকণ্ঠে মুক্সুবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, তাঁর নামানুসারে নগরের নাম পরিবর্তিত হয়ে হল মুর্শিদাবাদ, সূচনা হল ভারতবর্ষের এক নতুন ইতিহাসের। ইতিহাসের সেই চরিত্ররা আজ আর নেই, রয়ে গিয়েছে তাঁদের স্থাপত্য, লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে তাঁদের উদার কর্মযজ্ঞ, বন্দিত হয়েছেন তাঁরা আবার কখনও বা নিন্দিত হয়েছেন ঘৃণ্য অপরাধের জন্যে, লোভ লালসার উন্মত্ততা নিজের অজান্তেই রাজাকে পর্যবসিত করেছে দাসে। ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গেছে লোককথা, বিশ্বাস; ইতিহাস কখনও হয়েছে অতিরঞ্জিত আবার কখনও বা বিকৃত।
এই ভ্রমণ কাহিনী ইতিহাসকেন্দ্রিক আর তাই ইতিহাসের পথ অনুসরণ করাটাই শ্রেয় মনে হয় অতএব এ রচনা অতীতের ঘটনাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ; ঘোরার সুবিধের জন্যে উল্লেখিত দ্রষ্টব্য স্থানগুলির পর্যায়ক্রম পরিবর্তন করা যেতেই পারে। এখানে উল্লেখ্য, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণকাহিনী (গবেষণাধর্মী বা গবেষণা নির্ভর ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়) যার অন্যতম উপাদান স্থানীয় গাইডদের প্রদত্ত তথ্য, প্রচলিত লোককথা, বিশ্বাস ইত্যাদি।
জন্মসূত্রে (১৬৬০) দাক্ষিণাত্যের এক ব্রাহ্মণ সন্তান দশ বছর বয়সে হাজি শাফি নামে একজন পার্সি (ইরানী)-র নিকট বিক্রিত হয়। হাজি সাহেব তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং তাঁর নামকরণ করেন মহম্মদ হাদি। ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে হাজি শাফি মহম্মদ হাদিকে নিয়ে মোঘল রাজদরবারের কাজ পরিত্যাগপূর্বক পারস্যদেশে (বর্তমানে ইরান) চলে যান। পরবর্তীকালে হাজি-র মৃত্যুর পর পুনরায় হাদি ভারতবর্ষে ফিরে আসেন এবং মোঘল সাম্রাজ্যের অধীন বিদর্ভ নগরের দেওয়ান আবদুল্লা খুরাসানির অধীনে কাজ শুরু করেন। তাঁর কর্মনিষ্ঠায় প্রসন্ন হয়ে ঔরঙ্গজেব তাঁকে বাঙলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। ঔরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ সময়ে মারাঠারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাঁদের আক্রমণ মোঘল সম্রাটের আর্থিক স্থিতি দুর্বল করে দিয়েছিল। এমতাবস্থায় নবনিযুক্ত দেওয়ান মহম্মদ হাদি রাজস্বস্বরূপ অনেক টাকা দিল্লির সম্রাটকে পাঠিয়েছিলেন এবং মুর্শিদকুলী খাঁ উপাধি লাভ করেন, এর কিছুকালের মধ্যে ‘নাজিম’ উপাধিও লাভ করেন। ১৭০১ থেকে ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দ অবধি রাজত্ব করেন মুর্শিদকুলী খাঁ । মৃত্যুর পর তাঁরই ইচ্ছানুসারে কাটরা মসজিদে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। জীবৎকালে বিভিন্ন কৃতকর্মের জন্য বৃদ্ধ মুর্শিদকুলী খাঁ অনুতপ্ত হন, সেইজন্যে সকল মানুষের পদধূলি তাঁর পাপস্খলন ঘটাবে এই উদ্দেশ্যে নিজেকে সোপানের নীচে সমাধিস্থ করার আদেশ প্রদান করেন। মুর্শিদাবাদের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত এই কাটরা মসজিদ আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য। মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশনের অনতিদূরেই রেল লাইন পার করে দেখা যায় কাটরা মসজিদ। মসজিদের দুই প্রান্তে ৭০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দুইটি গম্বুজ রয়েছে।মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে অনেকগুলি ছোট আয়তনের প্রকোষ্ঠ আর অতি বৃহদাকার চত্বর যেখানে প্রায় সহস্রাধিক মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারেন। বর্তমানে মসজিদটি ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ (Archeological Survey of India) দ্বারা সংরক্ষিত। প্রকোষ্ঠ গুলিতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। পাথরের যোগান পর্যাপ্ত না থাকা আর ভাগীরথীর তীরে এঁটেল মাটি অপরিযাপ্ত, সম্ভবত এই দুইকারণেই এখানকার স্থাপত্য পোড়া ইটের, ইটগুলি আকারে বর্তমানের থেকে অনেকটাই ছোট বলে মনে হয়। কাটরা মসজিদের স্থাপত্যে কোন করি-বরগার ব্যবহার দেখা যায়না।
মুর্শিদকুলী খাঁ-র একপুত্র আর দুই কন্যা। এক কন্যার নাম আজিমুন্নেশা। আজিমুন্নেশা-র বিবাহ সম্পন্ন হয় সুজা খাঁ-র (সুজাউদ্দিন মহম্মদ খাঁ) সহিত। সুজা খাঁ-ই হলেন মুর্শিদকুলী পরবর্তী বাঙলার নবাব (১৭২৭-১৭৩৯)। উদার চিত্ত আর ন্যায় পরায়নতা জন্মসূত্রে তুর্কী মুসলিম সুজাউদ্দিন-কে একজন আদর্শ শাসক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। হাজি আহমেদ (আলীবর্দি খাঁ-র বড়ভাই যার আসল নাম মির্জা আহমেদ), আলমচাঁদ প্রমুখ তাঁর শাসনকালে রাজ্যের প্রধান পদে আসীন হন এবং বেগম আজিমুন্নেশার ইচ্ছানুসারে আলীবর্দি খাঁ-কে পাটনার নায়েব নিযুক্ত করা হয়। ১৭৩৯ সালে মৃত্যুর পর সুজাউদ্দিন-কে ভাগীরথীর পশ্চিমপারে রোশনিবাগে সমাধিস্থ করা হয়। রোশনিবাগ (‘বাগ’ কথাটির অর্থ ‘বাগিচা’ বা ‘বাগান’) সুজা খাঁ-ই নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন যেন মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় রোশনিবাগেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। আজ রোশনিবাগে যে পথটি দিয়ে পর্যটকরা প্রবেশ করেন সেটি আসলে বাগের পশ্চাৎভাগ, অতীতের প্রধান সম্মুখ ফটকটি এর ঠিক সোজা মধ্যের বিশ্রামাগার (যা পরবর্তীকালের সুজা খাঁ-র সমাধি)-র আগে একই সরলরেখায় অবস্থিত। মূল ফটকটি দিয়ে প্রবেশ করলে ডান দিকে রয়েছে নবাব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, সম্মুখে ফোয়ারা আর তারপর বিশ্রামাগার। সমগ্র অঞ্চলটি ছিল ফুলের বাগান। রোশনিবাগের অনতিদূরেই সুজা খাঁ প্রতিষ্ঠা করেন অপর একটি মনরম বাগানবাড়ি যা ‘ফারহাবাগ’ বা সুখকানন নামে পরিচিত ছিল, যদিও বর্তমানে একটি জলাশয় ছাড়া এর বিশেষ কোন অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়না।
আজিমুন্নেশা সম্পর্কিত নানান লোককথা আজও প্রচলিত যেমন তাঁর পুরুষ আসক্তি, শারীরিক অসুস্থতা, আরোগ্যলাভ হেতু মনুষ্য আন্তরযন্ত্রীয় অঙ্গ সেবন এবং সেইহেতু পিতার (মতান্তরে স্বামীর) আদেশে তাঁর জীবন্ত সমাধি ইত্যাদি। যদিও এসবের ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুপস্থিত বরং ঐতিহাসিকগণের ধারণা আজিমুন্নেশার মৃত্যু তাঁর পিতার এবং পতির মৃত্যুর পরবর্তীতেই হয়। তাঁর সমাধি রয়েছে ভাগীরথীর পূর্বপারে, এটিও বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত। পিতার মৃত্যুর পর সুজা খাঁ আর আজিমুন্নেশার সন্তান সরফরাজ খাঁ সিংহাসন আরোহণ করেন (১৭৩৯-১৭৪০)। অধিক নারী সংসর্গ, আলস্য, ভোগ বিলাসিতা এবং মন্ত্রীবর্গের উপর অধিক নির্ভরতা রাজ্য পরিচালনায় বাঁধা হয়ে উঠল। অচিরেই মন্ত্রীবর্গের আর নবাবের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় আর তারই পরিণতিতে ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে গিরিয়ার যুদ্ধে আলীবর্দি খাঁ-র কাছে পরাজিত হয়েছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করেন। অবসান হয় এক বংশের। এ ইতিহাস বিষাদের, কখনও বিশ্বাসঘাতকতার। ফৌতি মসজিদের স্থাপনা তাঁর আমলেই শুরু হয় কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুর পর এটির স্থাপনা শেষ হয়নি। এই ফৌতি মসজিদ-ই বর্তমানে ফুটি মসজিদ নামে পরিচিত।
সেই সময়ে অনবরত মারাঠাদের (যারা বর্গী নামে তৎকালীন বাঙলাতে পরিচিত ছিল) আক্রমণে বাঙলা, বিহার আর উড়িষ্যা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বর্গী আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত। রোশনিবাগের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভাস্কর পণ্ডিত ভগবান শিবের মন্দির স্থাপন করেন। এরূপ অবস্থায় কিছুটা বাধ্য হয়েই ভাস্কর পণ্ডিতকে মানকরা নামক জায়গায় নিজের শিবিরে আমন্ত্রণ করে নবাব আলীবর্দি খাঁ তাঁদের হত্যা করেন। এ ইতিহাস এক বিশ্বাসঘাতকের কালিমালিপ্ত ইতিহাস হয়েই থেকে যেত যদিনা আলীবর্দি নিজেকে একজন দক্ষ আর প্রজাদরদী নবাব হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হতেন। আলীবর্দি-র ধারণা ছিল হয়ত এরপর বর্গী আক্রমণের হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষা করা যাবে কিন্তু তা হয়নি। কিছুকাল বর্গী আক্রমণ বন্ধ ছিল, আর তারপরেই তাঁরা আবার এসেছিল আরও বিক্রমে।
নবাব আলীবর্দি খাঁ-র অধিক স্নেহপরায়ণতাই যে কনিষ্ঠা কন্যা আমিনার পুত্র মির্জা মহম্মদ (যিনি ইতিহাসে সিরাজদউল্লা নামে পরিচিত)-র সিংহাসন আরোহণের অন্যতম প্রধান কারণ সে নিয়ে বিশেষ দ্বিমত নেই। নবাব আলীবর্দি-র মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজ নবাব পদে অভিষিক্ত হন। বড়ই কণ্টকাকীর্ণ ছিল সিংহাসন আরোহণের সেই পথ। তার উপর কখনও সিরাজের দূরদৃষ্টিহীনতা আর ভুল সিদ্ধান্তগ্রহণ পরিস্থিতিকে অনেকটাই প্রতিকূল তৈরি করে দেয়। এইসকলের সন্মিলিত ফলশ্রুতি বাঙলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের করুন পরিণতি আর বাঙলা তথা ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে সূর্যাস্ত। শেষ হল পলাশির যুদ্ধ, রাজমহলের নিকট ধরা পরলেন সিরাজ। বন্দী সিরাজকে কয়েদ করে রাখা হল মন্সুরগঞ্জের প্রাসাদে। মীর জাফর পুত্র মীরণ মহম্মদি বেগকে নির্দেশ দিলেন সিরাজকে হত্যা করার, বারংবার ছুরিকাঘাতে লুটিয়ে পড়লেন সিরাজ। মৃত্যুর পর সিরাজের দেহ নিয়ে আসা হয় খোসবাগে। লোকবিশ্বাস সিরাজের দেহ খোসবাগে আনা মাত্র নবাব আলীবর্দির সমাধি দু’ভাগ হয়ে যায়, শুরু হয় রক্তপ্রবাহ। এ শুধুই কল্পিত কাহিনী যার ভিত্তি দাদামশাই আর পৌত্রের বাস্তব অপত্য স্নেহ আর প্রেম। অবশ্যই সিরাজের ব্যক্তিগত জীবন সমালোচনার উর্দ্ধে নয় কিন্তু তাঁর শৌর্য, বীরত্ব, রাজ্যের স্বায়ত্তের দায়বদ্ধতা, অগ্রজের উপদেশ গ্রহণ এবং স্বয়ং সংশোধন কোন প্রকারেই ক্ষুদ্র নয়। মাতামহ আলীবর্দি খাঁ-র সমাধির পাশেই সমাধিস্থ হন সিরাজ।
কিন্তু হত্যালীলা স্তব্ধ হয়না। লোভ লালসা অর্থমোহ অত্যাচারী শাসককে হত্যার যন্ত্রে পরিণত করে। খোসবাগে রাখা আছে সেই সকল সমাধি। ‘খোসবাগ’ কথাটি ‘খুশবাগ’-র (আনন্দ উদ্যান) অপভ্রংশমাত্র।নবাব আলীবর্দি এই খুশবাগ তৈরি করান, শতাধিক গোলাপ ফুলের গাছ রোপণ করেছিলেন এবং তার সৌন্দর্য্য ও সুবাসের জন্যেই বাগ বা বাগিচার নামকরণ করেন খুশবাগ বা আনন্দ উদ্যান। বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধীনে সংরক্ষিত খোসবাগের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর সর্বপ্রথম যে সমাধিটি দেখা যায় সেটি নাফিসা খানম বেগমের, নবাব আলীবর্দি খাঁ-র পত্নী। বিচক্ষণা বেগমের পরামর্শ বৃদ্ধ নবাবের কাছে অপরিহার্য ছিল। বেগমের সমাধির অনতিদূরেই রয়েছে তাঁর দুই কন্যার সমাধি যথাক্রমে সিরাজের বড় মাসি ঘসেটি বেগম আর মা আমিনা বেগমের, নবাব আলীবর্দির মধ্যম কন্যার সমাধি রয়েছে বিহারে।
এখানে রয়েছে একটি মসজিদ, আজ আর নামাজ পড়া হয়না সেখানে,
আজান দেওয়া হয়না কখনই, মসজিদের সম্মুখের জলাশয়টি আজ শুষ্ক। মৃত্যুর
এই মহামিছিলের কাহিনী শুনতে শুনতে চোখের জলও এই জলাশয়ের মতন শুকিয়ে যায়। এক অদ্ভুত
শান্তি রয়েছে এই খোসবাগে। যেন আজও লুৎফুন্নেশা অপেক্ষা করে আছেন সিরাজের, হয়ত তিনি
প্রত্যক্ষ করছেন তাঁর প্রিয় সিরাজকে, স্বহস্তে সিরাজের প্রিয় ফুলের গাছ রোপণ
করছেন, জল দিচ্ছেন।
মার্চ, ২০১৮










কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন