সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের প্রথম পর্বটি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ
সিরাজের মৃত্যুতে অবসান হল আফসার বংশের, ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে নেমে এলো সূর্যাস্ত।
শুরু হল মীর জাফর বংশ, ইতিহাসে যা নাজাফী বংশ বলে পরিচিত।
২৪ শে জুন ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে যখন পলাশির যুদ্ধ শেষ হয় আর ২৯শে জুন মীর জাফর মুর্শিদাবাদের
সিংহাসনে বসেন, রবার্ট ক্লাইভ যথার্থই বলেছিলেন এই জয় তাঁর নয় বরং এই জয়
মীর জাফরের। সত্যিই সেদিন ইংরেজদের জয় সম্ভব হত না যদি মীর জাফর, ইয়ার
লতিফ খাঁ, রায়দুর্লভরা দেশরক্ষার দায়ভার গ্রহণ করে অস্ত্র তুলে নিতেন, বিফল হত জগৎ
শেঠদের ষড়যন্ত্র এবং সর্বোপরি বিস্বাসঘাতকতা
যদি না করতেন মীর জাফর। ভাগীরথীর পূর্বপাড়ে রাস্তার বাঁ পাশে অবস্থিত জাফরগঞ্জ
প্রাসাদের প্রবেশ দ্বার বর্তমানে জীর্ণদশায় উপনীত। বোন শাহখানামের জন্যে এই প্রাসাদটি তৈরি
করেছিলেন নবাব আলীবর্দি খাঁ। মীর জাফর ছিলেন শাহখানামের স্বামী অর্থাৎ নবাব
আলীবর্দি খাঁ-র ভগিনীপতি। প্রবেশ দ্বারে পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি নেই, এই
বিজ্ঞপ্তি টাঙানো রয়েছে। মীর জাফরের জীবনের পরিণতি ছিল করুণ, কুষ্ঠ
রোগগ্রস্থ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। বাঁচার অন্তিম ইচ্ছে নিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন কিরীটীশ্বরী মন্দিরের দেবীর চরণামৃত! এমনই প্রচলিত লোককথা,
এর ঐতিহাসিক প্রমাণ অজানা। সতীর
একান্ন পীঠের অন্যতম এই পীঠ। বিশ্বাস এখানে দেবীর কিরীট (‘কিরীট’ কথাটি ‘করোটি’
থেকে এসেছে) পতিত হয়েছিল। নবগ্রামের কিরীটকোনা গ্রামে অবস্থিত
সতীপীঠ কিরীটীশ্বরী মন্দির, আমাদের গন্তব্য। দেবী এখানে বিমলা নামে পূজিত হন। বর্তমানে নবনির্মিত মন্দিরটির পাশেই পুরোনো ভগ্নপ্রায়
মন্দিরটি অবস্থিত।
এবার দর্শনীয় হলো হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। মুর্শিদাবাদ বলতেই যে হাজারদুয়ারির চিত্র মানসপটে উদ্ভাসিত হয় তা ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব নাজিম হুমায়ুন জা নির্মাণ করেছিলেন। শুনলাম এর নির্মাণ কার্য ১৮২৪ থেকে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। প্রাসাদটি পরিকল্পনা করেছিলেন ডানকান ম্যাক লিওড সাহেব। বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ এটি সংরক্ষণ করে। প্রাসাদটির স্থাপত্যশৈলী সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বর্তমানে এর অভ্যন্তরে রয়েছে একটি সংগ্রহালয় যেখানে নবাব আমলে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী যথা আসবাব, চিত্র, বাসন পত্র, অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রবেশমূল্য দিয়ে হাজারদুয়ারি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। পর্যটকরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গাইডদের থেকে জেনে নিতে পারেন হাজারদুয়ারি এবং এর প্রাঙ্গণে উপস্থিত বাচ্চাওয়ালী তোপ, নিজামত ইমামবাড়া, মদিনা মসজিদ ইত্যাদি সম্পর্কিত নানান তথ্য। ইতিহাস, জনশ্রুতি, লোককথা মিশিয়ে গাইডদের পরিবেশন পর্যটকের বেশ আকর্ষণ করে।
এবার দ্রষ্টব্য জাফরগঞ্জ কবরস্থান। এখানে রয়েছে মীর জাফর, তাঁর বংশের সদস্যদের এবং উত্তরসূরিদের, নবাব নাজিম হুমায়ুন জা পর্যন্ত সকলের কবর। এখানে কিছু বই বিক্রি হচ্ছে দেখলাম, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস সম্পর্কিত ইতিহাস নির্ভর বইগুলি।
মুর্শিদাবাদের উল্লেখযোগ্য একটি দর্শনীয় স্থান জগৎ শেঠের বাড়ি। এই 'জগৎ শেঠ' কিন্তু কেবল একজন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে না, বরং এর অর্থ জগতের শেঠ (ব্যাংকার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড), বংশানুক্রমিক এঁদের সদস্যদের মধ্যে হিরানন্দ শা, মানিক চাঁদ, ফতে চাঁদ, মেহতাব চাঁদ, স্বরূপ চাঁদ প্রমুখ। ধন সম্পদের প্রাচুর্য্যের জন্যে জগৎ শেঠ দের নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। শোনা যায়, অর্থসাহায্য করার জন্যে মানিক চাঁদ কে এই উপাধি প্রদান করেন মোঘল সম্রাট ফারুখশিয়ার। নশিপুরে অবস্থিত বর্তমানে জগৎ শেঠদের বাড়িটি সংগ্রহালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে দর্শনীয় তৎকালীন সময়ের মুদ্রা, স্বর্ণ-রৌপের কারুকার্য সম্বলিত তাঁদের ব্যবহৃত বস্ত্র, বাসন ইত্যাদি। গুপ্ত সুড়ঙ্গটি পর্যটকদের দেখার জন্যে উন্মুক্ত।
এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল নশিপুর রাজবাড়ী। হাজারদুয়ারি প্রাসাদ থেকে এর দূরত্ব প্রায় আড়াই-তিন কিলোমিটার। রাজা বলে পরিচিত হলেও এঁরা ছিলেন জমিদার, ব্রিটিশ প্রশাসকের হয়ে ট্যাক্স কালেক্টর। বিরাট ছিল সেই জমিদারিরই সীমানা, বীরভূম, মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত রাজশাহী, পাবনা এবং বগুড়ার কিছু অংশ। সম্ভবত এই বিশাল জমিদারির জন্যেই এঁরা রাজা বলে পরিচিত ছিলেন। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা দেবী সিংহ রাজবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন তবে বর্তমানে যে নশিপুর রাজবাড়িটি দ্রষ্টব্য সেটি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা কীর্তি চন্দ্র সিংহ কর্তৃক হাজারদুয়ারীর আদলে নির্মিত। ব্যবসার সূত্র ধরে পানিপথ থেকে দেবী সিংহ এখানে আসেন এবং ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এই বিপুল জমিদারি গড়ে তোলেন । খাজনা দিতে অপারগ দরিদ্র প্রজাগণের প্রতি রাজার ব্যবহারের নানান গল্প আজও মানুষের মুখ মুখে ঘোরে।
এই নশিপুর রাজবাড়ীর সন্নিকটেই রয়েছে নশিপুর আখড়া। এখানে পর্যটকদের দর্শনের উদ্দেশ্যে পুরোনো গাড়ি, বাসনপত্র, রথ ইত্যাদি প্রদর্শিত রয়েছে। শুনলাম, ঝুলনযাত্রা এবং সেই উপলক্ষ্যে এখানে বড়ো মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
মুর্শিদাবাদের অন্যতম আর একটি দর্শনীয় স্থান হলো কাঠগোলা
বাগানবাড়ি। শুনলাম, ধনপত সিং দুগার এবং লক্ষ্মীপত সিং দুগার
নির্মাণ করেন। বাগান বাড়িটির প্রাঙ্গনে রয়েছে
আদিনাথ মন্দির। এই স্থানের বাড়িটির বিভিন্ন
স্থাপত্য, প্রদর্শনশালা, বাউলি, প্রাঙ্গনের মূর্তি-ভাস্কর্য, অলংকৃত দেওয়াল পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ
করে।
এবার ফিরে চলা। এই মাটির প্রতিটি কণা ইতিহাসের কথা বলে, সেই ইতিহাসকে ঘিরে গড়ে ওঠে নানান কাহিনী। সময় সংক্ষিপ্ত তাই বিদায় নিতে হয়, ইতিহাসের জ্ঞান কে সম্বল করে ফিরতে হয় বাস্তবতায়। তবে আসতে আবার হবে, বাকি রয়ে গেছে অনেক কিছু দেখার, শোনার আর বোঝার।
মার্চ, ২০১৮












কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন