পৃষ্ঠাসমূহ

ভারতের সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষা উন্নত করতে ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের ভূমিকা (Role of traditional foods in improving India's healthy food and nutrition security)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী ব্লগটিতে আমি সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যগত জ্ঞান কেন আবশ্যিক সেই বিষয়ে আলোচনা করেছি। সেখানে প্রধানত আমি কারণগুলিকে উল্লেখ করেছি, তবে বিশদে উদাহরণ সহযোগে সেগুলি বর্ণনার অবকাশ এখনও রয়েছে, সে বিষয়ে আমি পরে অবশ্যই লিখবো। বর্তমান ব্লগটিতে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কি কি উপায়ে সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষায় এই ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করবো। 

ভারত বর্তমানে পুষ্টিগত সমস্যা যেমন অপুষ্টি (Undernutrition) এবং স্থূলতার (Obesity) মতো দ্বৈত সমস্যার (Double burden) মুখোমুখি হচ্ছে। খাদ্য আসলে পুষ্টি উপাদানগুলির (Nutrients) উৎস।  প্রয়োজনের থেকে কম খাদ্য গ্রহণ করলে তার ফলে পুষ্টির ঘাটতি (Deficiency of nutrient) হয় এবং বিভিন্ন পুষ্টিউপাদানের ঘাটতি জনিত রোগ বৃদ্ধি পায়। যেমন ধরো, লোহার অভাবে এনিমিয়া, বা ভিটামিন ডি (Vitamin D), ভিটামিন বি-১২ (Vitamin B12), ভিটামিন এ (Vitamin A), ফোলিক অ্যাসিড (Folic acid) ইত্যাদির অভাব, এগুলো কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যমান। আবার অন্য দিকে প্রয়োজনাধিক খাদ্য গ্রহণ (মূলত অধিক ফ্যাট এবং শর্করা জাতীয়) এবং সেডেন্টারি জীবনযাপনের (Sedentary Lifestyle) জন্যে স্থূলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন, হার্টের রোগ বাড়ছে ইত্যাদি। কাজেই খাদ্য এবং পুষ্টির মাত্রা সঠিক থাকা প্রয়োজন, হ্রাস পাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া দুটোই কিন্তু সমস্যা। মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কাজেই খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে - এই যে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করা- এটা হলো খাদ্য সুরক্ষা (Food Security); সঠিক পরিমাণে তা গ্রহণ, কেবলমাত্র পেট ভরানো নয় বরং খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পুষ্টি উপাদানগুলির প্রয়োজনীয় মাত্রা শরীরে সুনিশ্চিত করা - এটা হলো খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষা (Food and Nutrition Security)। এখন আবার আর একটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো এই খাদ্য উৎপাদন এবং ব্যবহারের পদ্ধতি এমন হওয়া দরকার যেন তা পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে, অর্থাৎ খাদ্য পুষ্টি এবং পরিবেশের সুরক্ষা। এই তিনটি সুরক্ষাই, অর্থাৎ সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষা (Sustainable Food and Nutrition Security), নিশ্চিত করা অপরিহার্য।  

সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি (Traditional foods) গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি পুষ্টিগুণে ভরপুর (Rich in nutrients), সংস্কৃতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ (Culturally important) এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই (Environmentally sustainable)। ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শস্য, ডাল, শাক-সবজি এবং দুগ্ধজাত পণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে (অনুগ্রহ করে পড়ুন আমাদের খাদ্যের পশ্চিমায়ন, এ ছাড়াও একাধিক কারণ রয়েছে, পরবর্তীতে কখনও সেই বিষয়ে আলোচনা করবো) ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলির ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে, আর এরফলে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স হারিয়ে ফেলছি। যেমন  মিলেট - এর পুষ্টিগুণ যেমন উন্নত তেমন পরিবেশ সহায়কও বটে, কাজেই মিলেটের ব্যবহার সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে (অনুগ্রহ করে পড়ুন পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট)। ভারতবর্ষ মিলেট ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা আশাপ্রদ। যে সকল ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি আদিবাসী সম্প্রদায় ব্যবহার করেন, সেগুলির উৎপাদন পদ্ধতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায় তাদের উৎপাদন টেকসই পদ্ধতিতে হয়, প্রচলিত পদ্ধতিতে এগুলির অন্তর্ভুক্তিকরণ পরিবেশের স্থায়িত্বকে বৃদ্ধি করবে। অনেক সময় দেখা যায়, বেশ কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ (প্রাণীজ, উদ্ভিজ্জ বা ছত্রাক) তাঁরা পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে ব্যবহার করেন। এখানে গুরুত্ব প্রদান করা উচিত কারণ পূর্বে তাদের সংগ্রহ পদ্ধতিগুলি নিয়ন্ত্রিত থাকলেও, বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে (বাস্তুতন্ত্রের পরিধি হ্রাস পাওয়া, চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন ইত্যাদি) তা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে পারে। যেমন খাদ্যোপযোগী বন, জলাভূমি বা জলাশয়গুলো থেকে বিভিন্ন উদ্ভিদ, ছত্রাক, শামুক-ঝিনুক বা বিভন্ন কীট সংগ্রহ। এই সকল সম্পদগুলিকে যদি  চাষের মাধ্যমে উৎপাদন করা যায়, তবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হতে পারে যা পুষ্টি প্রদানের পাশাপাশি পরিবেশকেও সুরক্ষা প্রদান করে। শুধু তাই নয়, এটি জীবনযাত্রার অন্যতম পথও হতে পারে। 

এস্থানে কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের এবং তাদের পুষ্টিগুণ সম্বন্ধে উল্লেখ করলে বিষয়টি আর একটু সরল হবে। 

বাজরা - ডাইয়েটারি ফাইবার, প্রোটিন, লৌহ, ভিটামিন বি সমৃদ্ধ, গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। 

রাগী - ডাইয়েটারি ফাইবার, ক্যালশিয়াম, লৌহ, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। 

বাঁশের আগা -  ডাইয়েটারি ফাইবার, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ফাইটোস্টেরল সমৃদ্ধ। 

ছুরপি (চমরিগাইয়ের দুধ থেকে প্রস্তুত) - প্রোটিন, ক্যালশিয়াম সমৃদ্ধ প্রোবায়োটিক।   

গুন্দ্রুক (ফার্মেন্টেড শাক ) - ডাইয়েটারি ফাইবার, লৌহ, ল্যাক্টিক অ্যাসিড ব্যাক্টেরিয়া সমৃদ্ধ।  

চুলি - লৌহ, ক্যালশিয়াম, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। অ্যামারান্থের বীজ অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড সমৃদ্ধ। 

শামুক - প্রোটিন সমৃদ্ধ কিন্তু স্নেহ খুব কম, অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড, ক্যালশিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ। 

লাল পিঁপড়ের 'ডিম' এবং লাল পিঁপড়ে -  প্রোটিন, ক্যালশিয়াম, জিঙ্ক, লৌহ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। 

রেশমকীটের পিউপা - প্রোটিন, লৌহ, জিঙ্ক সমৃদ্ধ।      

ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলি যে কেবলমাত্র পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ তা নয়, ঐতিহ্যবাহী ফসল এবং খাবারের ব্যবহার কৃষি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং টেকসই কৃষির জন্য সহায়ক। বাজরার মতো অনেক ঐতিহ্যবাহী ফসল খরা সহনশীল এবং কম উপকরণে বেড়ে ওঠে, যা অনিশ্চিত বৃষ্টিপাতের পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ এবং স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসের সাথে গভীর সংযোগ স্থাপন করে।

এবার কি করলে এই ব্যাপারে কিছুটা উন্নতি হতে পারে, সেই বিষয়ে আলোচনা করা যাক। এখানে আমি আমার ধারণা অনুসারে কিছু পথের উল্লেখ করছি।  

১. জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তি (Inclusion in National Nutrition Program): সরকারি কর্মসূচিগুলিতে যেমন পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (PDS), মিড-ডে মিল এবং ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস (ICDS), ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন বাজরা, ডাল এবং স্থানীয় সবজির অন্তর্ভুক্তি করা উচিত। এটি পুষ্টিগত মান উন্নত করার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ফসলের চাহিদা সৃষ্টি করবে। কিছু ক্ষেত্রে চালু হলেও, যা প্রশংসাযোগ্য, এতে আরো গুরুত্ব প্রদান করা যেতে পারে। 

২. কৃষক-কেন্দ্রিক উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খল সমর্থন (Supporting Farmer-led Production and Supply Chain): কৃষকদের ঐতিহ্যবাহী ফসল চাষে প্রণোদনা (Incentive) দিতে হবে, কারণ এগুলি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হলেও বাণিজ্যিক ফসলের তুলনায় কম লাভজনক। নীতিগুলি কৃষকদের বাজার সংযোগ, ভর্তুকি এবং কারিগরী সহায়তা প্রদান করা উচিত। ঐতিহ্যবাহী ফসলের চাষের জন্য বীজ ভর্তুকি, কারিগরী প্রশিক্ষণ এবং জৈব কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগ করা- এগুলি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

৩. জৈব এবং টেকসই কৃষির প্রচার (Promotion of Organic and Sustainable Agriculture): অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবার জৈব এবং টেকসই পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়, যা মাটি স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করতে সহায়ক। জৈব চাষকে উৎসাহিত করলে এই খাবারগুলির পুষ্টিমূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং বাজারে একটি বড় সুবিধা থাকবে। "পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা" (PKVY) বা তার প্রসারণ এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারে বলে মনে হয় ।  

৪. ভোক্তা সচেতনতা তৈরি (Increasing Consumer Awareness): নাগরিকদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে শিক্ষিত করার জন্য নীতিমালা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য প্রচারণা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সম্প্রদায়-ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে, বিশেষ করে শহুরে এলাকায়। 

৫. ঐতিহ্যবাহী খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and Development in Traditional Food Processing): ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলি আরও সুস্বাদু, সুবিধাজনক এবং আধুনিক ভোক্তাদের জন্য আকর্ষণীয় করতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলির উপর ভিত্তি করে উন্নত পুষ্টিসমৃদ্ধ পণ্য তৈরি এবং প্যাকেজিং ও সংরক্ষণের উন্নতি হবে।

৬. স্থানীয় জ্ঞান সংরক্ষণ (Preservation of Indigenous Knowledge): ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং তাদের পুষ্টিগুণ সম্পর্কিত স্থানীয় জ্ঞান সংরক্ষণ এবং প্রচার করা জরুরি। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঐতিহ্যবাহী খাবারের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে সহায়ক হবে। ঐতিহ্যবাহী খাদ্যব্যবস্থার অধ্যয়নকে শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ করা এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় জ্ঞানকে সংরক্ষণ ও প্রচার করা প্রয়োজন।

৭. পরিকাঠামো উন্নতি ও বাজার অ্যাক্সেস (Improving Infrastructure and Market Access): ঐতিহ্যবাহী খাবারের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং পরিবহন পরিকাঠামো উন্নত করতে হবে। বাজার অ্যাক্সেস উন্নত করে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা হ্রাস করে কৃষকরা তাদের ফসলের জন্য ন্যায্য মূল্য পেতে পারেন। গ্রামীণ এলাকায় ঐতিহ্যবাহী ফসলের জন্য অবকাঠামো এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে।

ভারতের খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষা নীতির অংশ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচার অপুষ্টি মোকাবেলা, কৃষির টেকসই উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। কৃষক প্রণোদনা, ভোক্তা সচেতনতা, এবং গবেষণার মাধ্যমে গৃহীত নীতির মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব বলেই মনে হয়। 

সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যগত জ্ঞান কেন আবশ্যিক? (Why is traditional knowledge essential for sustainable food and nutrition security?)

সম্পত ঘোষ  (Sampat Ghosh)

বর্তমান আলোচনায় প্রথম প্রয়োজন ঐতিহ্যগত জ্ঞান (বা  Traditional Knowledge) কি সেটা বোঝা।

ঐতিহ্যগত জ্ঞান বলতে বোঝায় সঞ্চিত জ্ঞান, অনুশীলন, দক্ষতা, উদ্ভাবন এবং প্রজ্ঞাকে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কোনো সম্প্রদায় বা সমাজের মধ্যে সময়ের সাথে সাথে প্রবাহিত হয়। এটি সাধারণত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (Cultural tradition), আদিবাসী বা স্থানীয় বিশ্বাস (Indigenous belief) এবং স্থানীয় পরিবেশগত প্রেক্ষাপটে (Ecology and Ecosystem) নিহিত থাকে। [অনুগ্রহ করে পড়ুন: বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য, বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা

কিভাবে সম্প্রদায়গুলি প্রকৃতি, সম্পদ এবং সমাজের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে, ঐতিহ্যগত জ্ঞান তাকে প্রভাবিত করে। ঐতিহ্যগত জ্ঞান প্রায়ই মৌখিকভাবে বা ব্যবহারিক প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রেরিত হয় এবং কৃষি (Agriculture), স্বাস্থ্যসেবা (Healthcare), প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা (Natural resource management), খাদ্য ব্যবস্থা (Food system), আধ্যাত্মিকতা (Spirituality) এবং কারুশিল্প (Crafts) সহ জীবনের বিভিন্ন দিককে অন্তর্ভুক্ত করে।  

সমসাময়িক সময়ে, খাদ্য ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত ঐতিহ্যগত জ্ঞান বিভিন্ন কারণে সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার আলোচনায় ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বর্তমান ব্লগটিতে এই ঐতিহ্যগত জ্ঞান কোন কারণগুলির জন্যে প্রাসঙ্গিক তার উল্লেখ করবো। 

() জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ (Conservation of Biodiversity): ঐতিহ্যগত জ্ঞানে প্রায়ই এমন অনুশীলন জড়িত থাকে যা জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণকে উৎসাহিত করে। উদাহরণস্বরূপ, আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি বিভিন্ন ধরণের শস্য এবং গবাদি পশুর জাত চাষ এবং ব্যবহারের পদ্ধতি তৈরি করেছে, যা কীটপতঙ্গ, রোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে স্থিতিস্থাপকতার জন্য প্রয়োজনীয় জিনগত বৈচিত্র্যে অবদান রাখে। 

() স্থানীয় পরিবেশের সাথে অভিযোজন (Adaptation to Local Environment): ঐতিহ্যগত জ্ঞান স্থানীয় পরিবেশ এবং জলবায়ুতে গভীরভাবে প্রোথিত। এটি নির্দিষ্ট বাস্তুসংস্থানীয় অবস্থা (Ecological conditions), যেমন মাটির ধরন, বৃষ্টিপাতের ধরন এবং তাপমাত্রার তারতম্যের জন্য টেকসই চাষাবাদ (Sustainable agriculture) অনুশীলনের জ্ঞান প্রদান করে। এই জ্ঞান সম্প্রদায়গুলিকে বহিরাগত ইনপুটগুলির (Input) উপর খুব বেশি নির্ভর না করে পরিবর্তিত পরিবেশগত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম করে। 

() প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ (Conservation of Natural Resources): অনেক ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি জল, মাটি এবং বনের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেয়। কৃষি-বনায়ন (Agroforestry), ফসলের ঘূর্ণন (Crop rotation) এবং টেরেসিংয়ের (Terracing) মতো কৌশলগুলি মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে, ক্ষয় রোধ করতে এবং জলের উৎস সংরক্ষণে সহায়তা করে, যা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বে অবদান রাখে।

() সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক তাৎপর্য (Cultural and Social Significance): ঐতিহ্যগত জ্ঞান প্রায়ই সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যে স্থাপন (Embed) করা হয়। তারা শতাব্দীর সঞ্চিত জ্ঞানের প্রতিফলন করে, মৌখিক ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান এবং সম্প্রদায়ের অনুশীলনের মাধ্যমে প্রজন্মের মধ্যে চলে গেছে। এই ঐতিহ্যগুলি সংরক্ষণ এবং সম্মান করা শুধুমাত্র মূল্যবান কৃষি জ্ঞানের সংক্রমণ নিশ্চিত করে না বরং সামাজিক সংহতি এবং পরিচয়ও বৃদ্ধি করে।

() পুষ্টির বৈচিত্র্য (Nutritional Diversity): ঐতিহ্যগত খাদ্যগুলি সাধারণত বৈচিত্র্যময় এবং সুষম, স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ খাবারের বিস্তৃত পরিসরকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই বৈচিত্র্য কেবলমাত্র উন্নত পুষ্টিতে অবদান রাখে না বরং কয়েকটি প্রধান ফসলের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে, ফসলের ব্যর্থতা বা বাজারের ওঠানামার ঝুঁকি হ্রাস করে।

() স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন (Resilience and Adaptation): ঐতিহ্যগত জ্ঞান সম্প্রদায়গুলিকে স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন কৌশলগুলির সাথে সজ্জিত করে যা বহু প্রজন্ম ধরে বৈচিত্র্যময় এবং প্রায়শই চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে বসবাস করে। এই অভিযোজিত ক্ষমতাগুলি চরম আবহাওয়ার ঘটনা, কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাব বা অর্থনৈতিক ধাক্কার মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলির সাথে মোকাবিলা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

() স্থায়িত্ব (Sustainability): ঐতিহ্যগত কৃষি অনুশীলনগুলি প্রায়শই তাদের কম বাহ্যিক ইনপুট প্রয়োজনীয়তা এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরতার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। জীববৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্য এবং বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিস্থাপকতার মতো কৃষি-বাস্তবতাত্ত্বিক নীতিগুলিকে প্রচার করে, ঐতিহ্যগত জ্ঞান টেকসই খাদ্য উৎপাদনের দিকে পথ দেখায় যা নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাবগুলি হ্রাস করে।

আশা করি সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্যগত জ্ঞানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বোঝা গেলো। 

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...