পৃষ্ঠাসমূহ

দক্ষিণ কোরিয়ার ফরেস্ট অ্যালবাম (South Korean Forest Album)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


পূর্বের ব্লগটিতে আমি বিভিন্ন প্রকার ফরেস্ট বা জঙ্গলের বর্ণনা করেছি। এই ব্লগটিতে আমি দক্ষিণ কোরিয়ার ফরেস্টের কয়েকটি ছবি দিলাম, বছরের বিভিন্ন সময় টেম্পারেট ফরেস্টের বিভিন্ন রূপ। দেশটি টেম্পারেট অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় জঙ্গলের বৈশিষ্ট্যও অনুরূপ। কর্মোপলক্ষ্যে বিভিন্ন এক্সকারসনের সময় বা অবসরে আমি ছবিগুলি তুলেছি। এই জঙ্গলের গাছগুলি বেশিরভাগই পর্ণমোচী এবং কনিফেরাস বৃক্ষের। শীতকালে সব পাতা  ঝরে গিয়ে একেবারে রুক্ষ ও শুষ্ক রূপ ধারণ করে, আবার বসন্তে নতুন কচি পাতা ধরে ও ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে ওঠে।  তখন এর আরেক রূপ।

নামওন (Namwon-si) শহরের অনতিদূরে  তোলা জঙ্গলের ছবি (জুলাই, ২০২০)। জঙ্গলের দৃশ্য গ্রীষ্মে একেবারেই আলাদা। ঘন সবুজ জঙ্গল। 


নামওন (Namwon-si) শহরের অনতিদূরে অবস্থিত ছোনানজেসুজি রিজার্ভার-র (Cheonunjeosuji Reservoir) সামনে তোলা ছবিটি (জুলাই, ২০২০)। বর্ষাতে জঙ্গলের দৃশ্য এইরকম ঘন সবুজ থাকে।


জেজু দ্বীপের (Jeju island) হালাসান (Halasan mountain) পর্বতে তোলা ছবি (জুন, ২০১৬)। দক্ষিণ কোরিয়ার একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত এই দ্বীপটির কিন্তু আর্দ্র সাব ট্রপিক্যাল (Humid sub tropical region) অঞ্চলের অন্তর্গত।


পিয়ংচান-এ (Pyeongchang) তোলা এই ছবি (অক্টোবর, ২০১৯)। শরৎ কাল, শীতের প্রারম্ভ। পাতাগুলি রঙিন হয়ে উঠছে, পর্ণমোচীদের পাতাগুলি ধীরে ধীরে আর্দ্রতা হারাবে। টেম্পারেট অঞ্চলে চারটি ঋতু যথা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, এবং বসন্ত খুব পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়। তবে বর্ষার শেষে, বৃষ্টি হচ্ছে না, বাতাসে আর্দ্রতা কমছে, এবং হালকা একটা শীতের আমেজ রয়েছে কিন্তু পুরোপুরি শীত পড়েনি, এমন একটা সময় শরৎ এসেছে বলে বোঝা যায়। এই সময় তাপমাত্রা থাকে ৫ থেকে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে, এটা আমাদের পশ্চিমবঙ্গে শীত বলে বিবেচিত হলেও এখানে শীত বলে মনে হয়না, শীতে এখানে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রীর থেকে বেশ কিছুটা নেমে যায়।



আনদং মাস্ক মিউজিয়াম (Andong Mask Museum) থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে হাওয়ে গ্রামে বিয়ংসান সুয়োন কনফুসিয়াস একাডেমি-র (Byeongsanseowon Confucian Academy) পথে তোলা এই ছবি (জানুয়ারী, ২০১৮)। শীতে গাছের সকল পাতা ঝরে গিয়ে প্রায় ন্যাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি যে পাতাগুলি রয়েছে সেগুলিও শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় আর্দ্রতা হারিয়ে শুকনো হয়ে গেছে। 



আনদং বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে যে জঙ্গল রয়েছে সেখানে তোলা ছবি (ডিসেম্বর, ২০১৭)। জঙ্গল এখন পুরোই বরফে ঢাকা, সাদা।

সোবেকসানের (Sobaeksan) ট্রেকিং পথে তোলা ছবি (ডিসেম্বর, ২০১৯)। বরফের পুরু চাদরে আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছে পুরো পথটাই। ল্যান্ডস্কেপটি এখন সাদা-কালো।

শীতকালের শেষে আসে বসন্ত। চারিদিকে গাছগুলি আবার নব সবুজ পাতায় ভোরে ওঠে। প্রকৃতি সেজে ওঠে ফুলে, রঙে। মৌমাছিরা চাক থেকে বেরিয়ে আসে, আবার শুরু করে ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ, পরাগ মিলন হয় তার ফলে। সে বিষয়ে পরে কোনো ব্লগে লিখবো।

নিচের ফোটোটির বাম পাশে যে চেরী ব্লসমের ছবি সেটি ২০২০ সালের এপ্রিলে তোলা এবং ডান পাশের রবিনিয়ার (বা সিউডোএকাশিয়া) ছবি সেটি ওই বছরের মে মাসে তোলা।


এগুলি এপ্রিল (২০২০, ২০২২) ও মে (২০২১, মাঝের ছবিটি) মাসের তোলা বিভিন্ন ফুলের ছবি। আমাদের ক্যাম্পাসের আসে পাশে থেকে এই ছবিগুলি তুলেছি।

উপরের সারির ফুলের ছবি গুলি এপ্রিল মাসে (২০২০) তোলা আর নিচের সারির ফুলের ছবিগুলি জুন মাসে তোলা (২০১৮)।


আশা করি গত পর্বের জঙ্গলের বৃত্তান্ত পড়ার পর এই ছবিগুলির মাধ্যমে টেম্পারেট ফরেস্টের অনেকটা দৃশ্যায়িত হবে। আপনি যদি আমাদের দেশে কাশ্মীর, উত্তরাঞ্চল, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম বা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং বেড়াতে যান, তবে পাইন, দেবদারু, সিডার, ওক, লরেল, রোডোডেনড্রনের টেম্পারেট ফরেস্ট উপভোগ করতে পারেন।

জঙ্গল বিষয়ে কিছু কথা (A few words about Forest)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)



আমাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা জঙ্গলকে (ফরেস্ট/Forest) খুব ভালোবাসেন, প্রকৃতির হাতছানিতে, জীবজন্তু কিংবা উদ্ভিদের আকর্ষণে প্রায়ই, বা সপ্তাহান্তে, বেরিয়ে পড়েন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আমার এই ব্লগের উদ্দেশ্য জঙ্গল সম্বন্ধে প্রাথমিক আলোচনা করা, বিভিন্ন প্রকার সংরক্ষিত স্থান (মূল উদ্দেশ্য- সংরক্ষণ), বিভিন্ন প্রকার জঙ্গলের (পরিবেশগত ভাবে) আলাদা আলাদা চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে একটু চর্চা করা। প্রথমেই সংরক্ষিত স্থান হিসেবে জঙ্গলকে দেখা যাক। সংরক্ষিত স্থানকে আমরা প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি। যেমন ন্যাশনাল পার্ক (National Park)ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি (Wildlife Sanctuary), এবং বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ (Biosphere Reserve)। পশ্চিমবঙ্গে সংরক্ষিত স্থান বা প্রোটেক্টেড এরিয়ার (Protected area) মধ্যে রয়েছে ছয়টি ন্যাশনাল পার্ক (সিঙ্গালিলা, নেওরা ভ্যালি, গরুমারা, বক্সা, সুন্দরবন, জলদাপাড়া), ষোলোটি স্যাংচুয়ারি (সেঞ্চল, মহানন্দা, চাপড়ামারি, বক্সা, সজনেখালি, হ্যালিডে, লোথিয়ান, রায়গঞ্জ, চিন্তামণি কর, বিভূতিভূষণ, জোড়পোখরি, বল্লভপুর, রমনাবাগান, পশ্চিম সুন্দরবন, পাখি বিতান), দু'টি করে বাঘ রিজার্ভ (বক্সা, সুন্দরবন) আর হাতি রিজার্ভ (ময়ূরঝর্ণা, পূর্ব ডুয়ার্স), এবং একটি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ (সুন্দরবন) কাজেই বোঝা যাচ্ছে হাতের কাছেই রয়েছে অনেক পছন্দ, সময় সুযোগ মতন বেছে নিলেই হলো।

ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি, বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ-র মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। একটু সহজ করে এদের মধ্যে পার্থক্যটা বলা যাক।  ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ হেতু প্রতিষ্ঠিত। তুলনামূলকভাবে এর আয়তন কম হয়ে থাকে, অনেক সময় সীমানা খুব একটা নির্দিষ্ট করা থাকে না। সীমাবদ্ধতা থাকলেও কিছু কার্যকলাপ করা যেতে পারে, যেমন পশু চারণ, ঔষধি গাছ গাছড়া সংগ্রহ, কিছু সময় জ্বালানি শুকনো কাঠ, পাতা সংগ্রহ ইত্যাদি, তবে কোনো মতেই শিকার বা বন্য প্রাণীর ক্ষতি করা নয়। 

ন্যাশনাল পার্ক কিন্তু শুধুমাত্র বন্যপ্রাণী নয়, তার সাথে উদ্ভিদ, ঐতিহাসিক কোনো প্রকার স্থাপত্য ইত্যাদি সকল অর্থাৎ প্রাণী, উদ্ভিদ, এবং নির্জীব পদার্থ সহ সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে সংরক্ষণ করে। ন্যাশনাল পার্কের সীমানা অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং এখানে মানুষের কার্যকলাপ একেবারেই সীমাবদ্ধ। 

এবার আসি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের কথায়। বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ কিন্তু উপরোক্ত দুই প্রকার সংরক্ষিত স্থান বা প্রোটেক্টেড এরিয়া থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বড় হয়। এটি সম্পূর্ণ জীব বৈচিত্রকে সংরক্ষণ হেতু স্থাপন করা হয় এবং এটি কিন্তু ওই অঞ্চলে বসবাসকারী জনজাতিদের উন্নতিকল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ন্যাশনাল পার্কের মতন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের সীমানাও কিন্তু অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং এর মধ্যে কিন্তু  ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি থাকতে পারে। যেমন পাঁচমাড়ি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের মধ্যে সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক, এবং কয়েকটি স্যাংচুয়ারি যথা বরি স্যাংচুয়ারি, পাঁচমাড়ি স্যাংচুয়ারি রয়েছে।  আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে রয়েছে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। এই বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভকে কয়েকটি অঞ্চল বা জোনে (Zone) ভাগ করা যায়। যেমন একেবারে কেন্দ্রে থাকে কোর অঞ্চল (Core zone), এখানে কিন্তু কোনো প্রকার মনুষ্য কার্যকলাপ করা যায়না, এটি অন্ত্যন্ত গভীর বন। এর পর থাকে বাফার অঞ্চল (Buffer zone), এই অঞ্চলে পশুচারণ, পর্যটন ইত্যাদি কিছু মনুষ্য কার্যকলাপ সম্ভব। এর পরবর্তী অঞ্চলটি হলো ট্রানজিশন অঞ্চল (Transition zone), এখানে মানুষের বসতি, চাষবাস দেখা যায়। 


এ তো গেলো সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে জঙ্গলের বিবরণ। এবার আসি পরিবেশগত ভাবে বিভিন্ন ধরণের জঙ্গলের বর্ণনায়। যদি আপনি জঙ্গলের প্রকৃতির দিকে তাকান তবে প্রত্যেক জঙ্গলের প্রকৃতি আপনার কিন্তু একই রকম লাগবে না, প্রকৃতির বৈচিত্র আপনার চোখে পড়বে।  একটু সহজ ভাবে বলি, উত্তরবঙ্গ বেড়াতে গিয়ে জলদাপাড়া, গরুমারা কিংবা নেওরা ভ্যালি ঘুরে এলেন আবার দক্ষিণবঙ্গের  সুন্দরবন বেড়ালেন, দু'টো তো আর এক হলো না, সেটাই বলছি। এই যে পার্থক্য সেটা নির্ভর করে ওই স্থানের জলবায়ুর উপর, অর্থাৎ ওই স্থানের তাপমাত্রা কত, বছরে বৃষ্টিপাত কেমন হয় ইত্যাদি, যা আবার স্থানটির ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে। এই বিভিন্ন আবহাওয়া, জলবায়ু, মৃত্তিকার প্রকৃতি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সেই স্থানের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ জন্ম নেয়, এই উদ্ভিদ কিন্তু জঙ্গল বাস্তুতন্ত্রের প্রধান উপাদান।   

জঙ্গল প্রধানত তিন প্রকার, যেমন বোরিয়াল ফরেস্ট (Boreal forest), টেম্পারেট ফরেস্ট (Temperate forest) এবং ট্রপিক্যাল ফরেস্ট (Tropical forest)। বোরিয়াল ফরেস্ট তাইগা (Taiga) নামেও পরিচিত, এই প্রকার ফরেস্ট সাবআর্কটিক অঞ্চলে দেখা যায়। সাবআর্কটিক অঞ্চলটি হলো উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত আর্কটিক সার্কেলের (Arctic circle) দক্ষিণ অংশ। উত্তরের তুন্দ্রা (Tundra) অঞ্চল থেকে দক্ষিণের টেম্পারেট অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে এই প্রকার ফরেস্ট দেখা যায়। আলাস্কা, কানাডা, স্ক্যান্ডেনেভিয়া, সাইবেরিয়া স্থানগুলিতে এই প্রকার জঙ্গল দেখা যায়। রাশিয়াতে পৃথিবীর বৃহত্তম তাইগা রয়েছে। এই জঙ্গলের উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্প্রুস (Spruce), পাইন (Pine), ফার (Fir) ইত্যাদি কনিফেরাস (Coniferous) উদ্ভিদগুলি (যাদের পাতাগুলি সুচের মতন সরু, পাতানো বৃহৎ নয়)। প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন ধরণের রোডেন্ট (Rodents), বড়ো প্রজাতির হরিণ (Deer), মুস (Moose), ভাল্লুক (Bear), লিনক্স (Lynx), আর সাইবেরিয়ান বাঘের (Siberian tiger) কথা তো সকলেরই জানা, পাখিদের মধ্যে রয়েছে ঈগল (Eagle), পেঁচা (Owl) ইত্যাদি। এই তাইগা আবার দু'ধরণের হয়ে থাকে, সাধারণত উচ্চ অক্ষাংশে পাওয়া যায় ওপেন ক্যানোপি বোরিয়াল ফরেস্ট (Open canopy boreal forest; 'ক্যানোপি' কথাটির অর্থ ছাউনি) যা আবার লাইকেন জঙ্গল বলেও পরিচিত।  ঠান্ডা অধিক হওয়ার দরুন এখানে জীব বৈচিত্র কম হয়ে থাকে। নিম্ন অক্ষাংশে রয়েছে ক্লোস্ড ক্যানোপি বোরিয়াল ফরেস্ট (Closed canopy boreal forest), এখানে আবহাওয়া একটু কম রুক্ষ, কাজেই জীব বৈচিত্র তুলনামূলক ভাবে বেশি।

এর পর আসি টেম্পারেট ফরেস্টে। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই প্রকার ফরেস্ট টেম্পারেট অঞ্চলে পাওয়া যায়। সাধারণভাবে নিম্ন অক্ষাংশে (উত্তর গোলার্ধে ৬৬.৫ ডিগ্রী থেকে ২৩.৫ ডিগ্রী, আবার দক্ষিনে গোলার্ধেও তাই) অবস্থিত টেম্পারেট অঞ্চল, এখানে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়ে কাজেই তাপমাত্রা কমের দিকে থাকে এবং বছরে চারটি ঋতু যথাক্রমে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, এবং বসন্ত পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। টেম্পারেট ফরেস্টে আবার তিন প্রকার, পর্ণমোচী বা ডেসিডুয়াস ফরেস্ট (Deciduous forest), কনিফেরাস ফরেস্ট (Coniferous forest) এবং টেম্পারেট রেন ফরেস্ট (Temperate rain forest)। ডেসিডুয়াস ফরেস্টের উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদগুলি হলো ম্যাপেল (Maple), ওক (Oak), চেস্টনাট (Chestnut), গিংগো বাইলোবা (Ginkgo biloba) ইত্যাদি। ডেসিডুয়াস উদ্ভিদগুলি শীতকালে তাদের সমস্ত পাতা ঝরিয়ে দেয়। বাতাসে আর্দ্রতা এতটাই কম হয় যে পাতা গুলি শুকিয়ে ঝরে পরে যায়, আবার শীতকাল অতিক্রমিত হলে বসন্তের শুরুতে আবার নতুন পাতায় ভরে ওঠে, বড়ই দৃষ্টিনন্দন হয় সেই সময়। এই সময় পৃথিবীর অনেক শহরের মতন আমাদের (বর্তমান বসবাসের) শহর আনদং -এও চেরি ব্লসম (Cherry blossom) হয়ে থাকে, রাস্তার দু'পাশে গাছ গুলি ফুলে ভরে ওঠে। অসাধারণ সুন্দর লাগে এ দৃশ্য। 

অপরপক্ষে কনিফেরাস উদ্ভিদগুলির পাতা সূঁচের ন্যায় হয়ে থাকে, এই অভিযোজন নিজের প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং এদের বীজগুলি কাষ্ঠল কোণের (Cone) ভিতরে থাকে। আগেই উল্লেখ করেছি এই জাতীয় উদ্ভিদ হলো পাইন (Pine), ফার (Fir), সিডার (Cedar), হেমলক (Hemlock), জুনিপার (Juniper), স্প্রুস (Spruce), লার্চ (Larch) ইত্যাদি। এছাড়াও টেম্পারেট অঞ্চলের কিছু জায়গায় বছর বেশ বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে যে ফরেস্ট গড়ে ওঠে তা হলো টেম্পারেট রেন ফরেস্ট। এর উদাহরণ উত্তর আমেরিকার আপালাচিয়ান রেন ফরেস্ট (Appalachian temperate rain forest), দক্ষিণ আমেরিকার ভালদিভিয়ান (Valdivian temperate rain forest)  এবং ম্যাগেলানিক রেন ফরেস্ট (Magellanic temperate rain forest), ইউরোপের কোলচিয়ান রেন ফরেস্ট (Colchian temperate rain forest) ইত্যাদি। এবার আসি নিজেদের দেশে। আমাদের পূর্ব হিমালয়ান যে ব্রডলিফ ফরেস্ট (East Himalayan broadleaf forest) রয়েছে তাও কিন্তু এই রেন ফরেস্টের উদাহরণ। বিভিন্ন ধরণের ওক (Oak), রোডোডেনড্রন (Rhododendron), ম্যাগনোলিয়া (Magnolia), সিনামোন (Cinnamon), হিমালয়ান ম্যাপেল (Himalayan maple), হিমালয়ান বার্চ (Himalayan birch), বার্চ (Birch), পার্সিয়ান ওয়ালনাট (Persian walnut) ইত্যাদি উদ্ভিদ এই জঙ্গলে দেখা যায়। গোল্ডেন লাঙ্গুর (Gee's Golden langur), সাদা পেট বিশিষ্ট ইঁদুর (Brahma white-bellied rat), জায়ান্ট ফ্লাইং স্কুইরেল (Hodgson's giant flying squirrel, Namdapha flying squirrel), টাকিন (Takin), হিমালয়ান শিরো (Himalayan serow), ম্যাকাক বাঁদর (Macaque), লাল পান্ডা (Red panda), ক্লাউডেড লেপার্ড (Clouded leopard) ইত্যাদি এই জঙ্গলের প্রাণী। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরণের পাখি। কাজেই এদের দেখতে যেতে পারেন অরুণাচল প্রদেশের ঈগল নেস্ট ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Eagle nest Wildlife Sanctuary), মৌলিং ন্যাশনাল পার্ক (Mouling National Park)), কামলাং ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Kamlang Wildlife Sanctuary), নামদাফা ন্যাশনাল পার্ক (Namdapha National Park), পশ্চিমবঙ্গের নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক (Neora valley National Park) ইত্যাদি।

এই প্রসঙ্গে স্তন্যপায়ী এবং সরীসৃপ প্রাণীদের বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনার জন্যে ক্লিক করুন।

অবশেষে আসি ট্রপিক্যাল ফরেস্টে। আমাদের সকলেরই জানা আছে পৃথিবীর ট্রপিক্যাল অঞ্চলটি, ক্যান্সার (Cancer) এবং ক্যাপ্রিকর্ন (Capricorn) অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চল হলো ট্রপিক্যাল অঞ্চল। আমাদের দেশ ভারতবর্ষের অধিকাংশই এর মধ্যে অবস্থান করে। সূর্যালোক অধিক পরিমানে প্রাপ্ত হওয়ায় এই অঞ্চল উষ্ণ হয় আর জীব বৈচিত্রে পূর্ণ। এই প্রকার জঙ্গলের সান্নিধ্যেই আমি জীবনের অনেকটা অতিবাহিত করেছি, কখনও উত্তর-পূর্বে, আবার কখনও মধ্য ভারতে। জঙ্গলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় মানুষের জীবন। সে জ্বালানির শুকনো কাঠ কুড়োয়, পাতা কুড়িয়ে আনে, গৃহপালিত পশু চড়ায়, ফল-মূল-মধু সংগ্রহ করে। সে ঔষধি গাছ গাছড়া চেনে, রোগের উপশমে প্রাকৃতিক উপাদানগুলিকে ব্যবহার করার বিপুল তথ্য রয়েছে তাঁর জ্ঞানভাণ্ডারে, বিভিন্ন ফসলের স্থানীয় ভ্যারাইটি (Variety) সংরক্ষণ করে, জিন পুল (Gene pool) কে ক্ষয় হতে দেয় না। জঙ্গলের সাহচর্যে বেড়ে ওঠা মানুষ অনুভব করতে পারেন জঙ্গলকে, বনভূমির সাথে তাঁর আত্মার যোগাযোগ, সে তাঁর জীবনযাত্রার মধ্যে দিয়েই পরিচর্যা করে প্রকৃতির। তাঁদের থেকে আমরা শিখি, শেখার চেষ্টা করি। বর্তমানে যে পরিবেশের ধারণক্ষমতার (Environmental Sustainability) উপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করি, তা কিন্তু এই সকল জনজাতি সহস্র বছর ধরে তাঁদের জীবনধারণের মধ্যে দিয়ে অনুশীলন করে আসছেন। এই বিপুল অমূল্য জ্ঞান ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। ট্রপিক্যাল ফরেস্টকে আমরা প্রধানত চারভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন চিরহরিৎ রেন ফরেস্ট (Evergreen rain forest), ট্রপিক্যাল আর্দ্র ফরেস্ট (Tropical moist forest), ট্রপিক্যাল শুষ্ক ফরেস্ট (Tropical dry forest), এবং পরিশেষে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (Mangrove forest)। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপে, উত্তর-পূর্বে, পশ্চিমঘাটে (যে স্থানগুলিতে বছরে ২৩০ সেন্টিমিটারের মতন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে) যে বনভূমি রয়েছে তা চিরহরিৎ ফরেস্ট। রাবার (Rubber), সিঙ্কোনা (Cinchona), রোজউড (Rosewood), মেহগনি (Mahogany), এবনি (Ebony), টিক (Teak), ইন্ডিয়ান লরেল (Indian Laurel) ইত্যাদি এই জঙ্গলে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে বছরে প্রায় ২০০ সেন্টিমিটারের বা বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। ট্রপিক্যাল আর্দ্র ফরেস্ট (বৃষ্টিপাতের পরিমান বছরে ১০০ থেকে ২০০ সেন্টিমিটার), এবং শুষ্ক ফরেস্ট (বৃষ্টিপাতের পরিমান বছরে ৭০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার) নির্ভর করে ওই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমানের উপর। চন্দন (Sandalwood), বাঁশ (Bamboo), শাল (Sal), কুসুম (Kusum), খয়ের (Khoir), মালবেরি (Mulberry), শিশু (Shishu), কেন (Cane), অর্জুন (Arjun) ইত্যাদি আর্দ্র বনভূমিতে পাওয়া যায়। পশ্চিমঘাটের পূর্ব ঢাল, ছোটনাগপুর মালভূমি, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং উত্তর পূর্বের কিছু অংশে এই প্রকার বনাঞ্চল দেখা যায়। অপরপক্ষে টিক (Teak), নিম (Neem), পিপল (Peepal), শাল (Sal), খয়ের (Khoir), বেল (Bel), পলাশ (Palash), লরেল (Laurel) ইত্যাদি শুষ্ক বনভূমিতে পাওয়া যায়। বিহার, উত্তর প্রদেশ, উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের কিছু অঞ্চলের বনভূমি এই প্রকার। উপকূল অঞ্চলে যে বনভূমি দেখা যায়, সেটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।  এখানকার উদ্ভিদগুলি লবনাক্ত মাটি এবং খাড়ির জলে বেঁচে থাকার জন্যে উপযোগী অভিযোজন করেছে, যেমন শ্বাসমূল। সুন্দরী (Sundari)গরান (Garan), গেঁওয়া (Genwa), গোলপাতা (Golpata), হেঁতাল (Hental), গর্জন (Garjan), ধুঁধুল (Dhundhul), পশুর (Pashur), হোয়া (Hoya), কেওড়া (Keora) ইত্যাদি এই বনভূমিতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন (Sundarbans), ওড়িশার ভিতরকণিকা (Bhitarkanika) ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের উদাহরণ।

আশা করি, জঙ্গল সম্বন্ধে আমি একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে পেরেছি। বেড়াতে যাওয়ার পূর্বে সহজেই বুঝে নিন সেই জঙ্গলের প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য, বেড়ানোর পরিকল্পনা করুন সেই মতন। 

ইতিহাসের পটভূমিতে রাজগীর: ফিরে দেখা (Rajgir in the Background of History: A travelogue )

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

সৌজন্য: সায়ন্তিকা নাথ

এ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আমার ছোটবেলার, আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। বাবার এক বন্ধুর পরিবারের সাথে আমরা গিয়েছিলাম রাজগীর। বাবাকে কখনওই বেড়ানোর দীর্ঘ পরিকল্পনা করতে দেখিনি, হঠাৎ করেই ঠিক করে ফেলতেন, কখনও টিকিট কেটে এনে বাড়িতে এসে আমাদের নিয়ে রওনা হতেন। কাজেই এবারের রাজগীর যাওয়াও এর বিশেষ ব্যতিক্রম হলো না, দুই-তিন দিনের মধ্যেই বেরোনো। বলাই বাহুল্য বর্তমান সময়ের মতন দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা তখনকার দিনে ছিল না, বড়ো কোনো রেলওয়ে স্টেশনে, যেমন শিয়ালদা বা হাওড়া, লাইন দিয়ে টিকিট কাটা, লোক জনের মাধ্যমে খোঁজ খবর নিয়ে হোটেল ঠিক করা, হাতের কাছে উপযুক্ত কোনো অফিস বা দোকানে গিয়ে তা রিজার্ভ করার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। অনেক সময় তো আগে থাকতে হোটেল রিজার্ভ না করতে পারলে সেই স্থানে পৌঁছে আমাদের কোথাও দাঁড় করিয়ে বাবাকে হোটেল খুঁজে তারপর আমাদের নিয়ে গিয়ে তুলতেন তবে তারও একটা মজা ছিল, জায়গাটা কেমন হবে, লোকজন কেমন, খাওয়া-থাকা-ঘোরা ইত্যাদি পুরো বিষয়টা কল্পনা করতে করতে যাত্রার পূর্বের দিনগুলি কাটতো। উৎসাহ, আনন্দ আর উত্তেজনা মিলে একটা অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হতো বড়ো মামার একটি ভ্রমণসঙ্গীছিল, সেটি নিয়ে আসা হলো, তখন ভ্রমণসঙ্গীর হাত ধরেই মানুষ দেশটাকে চিনতো, এই বইটি ছিল ভ্রমণের অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান। কিছুদিন আগে যখন কোভিড-১৯ মহামারীর জন্যে লক-ডাউন হয়েছিল, শুনলাম বড়মামা সকাল থেকে সেই ভ্রমণসঙ্গীর একখানি আধুনিক সংস্করণ নিয়ে একটার পর একটা ভ্রমণ পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন। যাইহোক, আমি ফিরি সেই রাজগীর ভ্রমণের কাহিনীতে। মোবাইল ফোন তখন ছিলোনা, কাজেই হাওড়া স্টেশনের বড়ো ঘড়ির তলার খুব গুরুত্ব ছিল, সবাই সবাইকে ওই জায়গাটার কথা বলে রাখতো সাক্ষাৎ-এর স্থান হিসেবে। এখন বোধহয় এই স্থানটির গুরুত্ব এই প্রসঙ্গে কিছুটা কমেছে। আমরাও পূর্ব নির্দেশিত স্থানটিতে যথা সময়ে পৌঁছে গেছিলাম। দূরপাল্লার রেল গাড়িগুলি ছিল লাল রঙের, আমাদেরও লাল রঙের পূর্বা এক্সপ্রেস সকাল ৮ টায় রওনা হলো। এই রেল ভ্রমণ আরও একটা কারণে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে আমার কাছে। আমাদের গন্তব্য বক্তিয়ারপুর, সেখান থেকে গাড়িতে করে যাওয়ার কথা রাজগীর। ঠিক মনে করতে পারিনা কোন স্টেশন, তবে তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে, গাড়ি স্টেশনে দাঁড়ালে লোকজন অসংরক্ষিত টিকিট নিয়ে সংরক্ষিত কামরাতেও উঠে পড়ছেন, দেখতে দেখতে খুবই ভিড় হয়ে গেলো কামরাটা। যে সকল যাত্রী শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তাঁদেরও উঠে বসতে হলো, আসনগুলি তো পূর্ণ হলই, এমনকি চলাচলের রাস্তাতেও মানুষ বসে পড়লেন। মুহূর্তে সংরক্ষিত কামরাটি অসংরক্ষিত কামরাতে পরিণত হলো। কিন্তু অবাক হওয়ার কিছুটা তখনও বাকি ছিল।  কিছুক্ষণ পর দেখলাম লোকজন গাড়ির চেন টেনে টেনে মাঝে মাঝেই নেমে যাচ্ছেন, বোঝা গেলো এইভাবে যাতায়াত করতে তাঁরা অভ্যস্ত। কিন্তু আমরা এই প্রকার চিত্রে অভ্যস্ত ছিলাম না, কাজেই অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম। বৃহৎ ভারতের একটি চিত্র এইভাবে আমার সামনে উঠে এসেছিলো, তখন হয়তো তা আমি বুঝতে পারিনি তবে আজ তা আমি উপলব্ধি করতে পারি। যাইহোক নির্ধারিত সময়ের থেকে একটু দেরি করেই গন্তব্যে পৌঁছলো গাড়ি, লোকজন কাটিয়ে, ব্যাগ পত্র নিয়ে আমরা হুড়মুড় করে নামলাম বক্তিয়ারপুর জংশন স্টেশনে বক্তিয়ার খিলজির নামে এই স্টেশন, এ কথায় কিছুক্ষণ পরে আসছি। এবার গাড়ি ঠিক করতে হবে। চারিদিকে হাঁকডাক, স্টেশনেই উঠে এসেছেন গাড়ির চালক, হোটেলের দালাল সবাই। আমাদের এক সহযাত্রী একটি গাড়িতে উঠে বসলেন, উনিও যাবেন রাজগীরে, উনিই আমাদের ডাকলেন সেই গাড়িতে। এই সহযাত্রীটির একটি হোটেল রয়েছে রাজগীরে, এটা আমাদের জন্যে বেশ ভালো হলো, আমরা ওখানেই উঠলাম। হোটেলের দোতলায় আমাদের দু'টি ঘর দেওয়া হয়েছিল। দোতলায় মেঝেতে এক জায়গায় বড় একটা অংশে কোনো ঢালাই নেই, সুন্দর কতকগুলি লোহার রড বেড়ার মতন করে শোয়ানো রয়েছে, সেখান থেকে একতলায় রিসেপশন-র জায়গাটি দেখা যায়, এটি ছিল আমার আকর্ষণের একটি কেন্দ্র। প্রায়ই সেই স্থানের পাশে গিয়ে আমি দাঁড়াতাম আর বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। যখন রাজগীরে এসে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে হয়েছে, আমরাও ক্লান্ত, কাজেই ঐদিনের মতন রাত্রিকালীন আহার সেরে বিশ্রাম।

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙলো। আজকে বেড়াতে বেরোবো। প্রাতঃরাশ সেরে একটি টাঙ্গা ঠিক করা হলো। ঘোড়ায় টানা টাঙ্গাগুলিতে পিঠোপিঠি মোট চারটি করে আসন ছিল, দুটি সামনের দিকে মুখ করা আর দু'টি পিছন দিকে মুখ করা। এই টাঙ্গা ছিল আমাদের রাজগীর ভ্রমণের অপর একটি আকর্ষণ। এই বাহনটিতে চড়েই আড়াই হাজার বছর পূর্বের ইতিহাসের অন্দরে আমাদের প্রবেশ, কান পাতা রাজগৃহের গল্পে, নিজেদেরই ইতিহাসের সাথে আরো একবার নিজেদের পরিচয় করানো ষোড়শ মহাজনপদের এক জনপদ মগধ। বর্তমানের এই রাজগীর, অতীতের 'রাজগৃহ', সেই মগধের বৃহদ্রথ, প্রদ্যোৎ এবং তারপর হার্যঙ্ক বংশের রাজধানী। প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সাইক্লোপিয়ান দেওয়ালটি বহিঃশত্রুর হাত থেকে নগরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রাজা বৃহদ্রথ নির্মাণ করেছিলেন। রাজা বৃহদ্রথের পুত্র জরাসন্ধ, মহাকাব্য মহাভারতে উল্লেখিত একটি বহু পরিচিত চরিত্র। শক্তি, সামর্থ্য এবং পরাক্রমে অতুল জরাসন্ধের জন্ম ও জীবনের কাহিনী আজও লোকমুখে প্রচলিত। স্থানীয় বিশ্বাস এই স্থানে তিনি শারীরিক কসরত করতেন, তাই এই স্থান জরাসন্ধের আখড়া বলে পরিচিত। এখানে ইতিহাস মিশে গেছে মহাকাব্যে। স্রষ্টার কল্পনা, দর্শন, ইতিহাস একত্রেই প্রবাহিত হয়ে চলেছে।

বৃহদ্রথ বংশের (১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) পর মগধ শাসন করেছিলেন প্রদ্যোৎ (Pradyota) বংশের রাজারা (৬৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তারপর মগধের সিংহাসন আরোহন করেন রাজা বিম্বিসার (৫৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৯১খ্রিস্টপূর্বাব্দ), হার্যঙ্ক (Haryanka) বংশের প্রতিষ্ঠাতা। আজকের রাজগীর, রাজা বিম্বিসারের রাজধানী তখন পরিচিত ছিল গিরিব্রজ নামে। বিম্বিসার ছিলেন পরাক্রমী এবং কূটনীতি বিষয়ক জ্ঞানী একজন রাজা। নানা প্রদেশের সাথে বৈবাহিক সূত্রে তিনি বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী কোশালা দেবী ছিলেন কোশলের রাজকুমারী, বিবাহ সূত্রে বিম্বিসার উপহার হিসেবে কাশী লাভ করেন। এই বিবাহের ফলে মগধ আর কোশলের মধ্যে যে দীর্ঘ শত্রুতা ছিল তা বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হয়। রাজা বিম্বিসারের দ্বিতীয় স্ত্রী চেল্লানা ছিলেন বৈশালীর রাজা চেতকের কন্যা তথা লিচ্ছবী বংশের রাজকন্যা। বলাই বাহুল্য এই বিবাহ সূত্রে দু'টি প্রদেশের মধ্যে সখ্যতা দৃঢ় হয়েছিল।  বিম্বিসারের তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন পাঞ্জাবের মদ্র বংশীয় কন্যা ক্ষেমা। এইভাবে রাজা বিম্বিসার বিভিন্ন শক্তিশালী প্রদেশের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। অঙ্গ প্রদেশটিও তিনি যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করেছিলেন এবং পুত্র অজাতশত্রুকে সেই স্থানের  প্রধান (Governor/ গভর্নর) নিযুক্ত করেন। অঙ্গ প্রদেশ দখলের মাধ্যমে গঙ্গা নদীপথের উপর যে বন্দর ছিল, তিনি তার দখল পান এই জয় রাজা বিম্বিসারকে প্রভাবশালী করে তোলে। রাজা বিম্বিসারের সমকালীন এক বিদগ্ধ চিকিৎসক ছিলেন জীবক। যিনি স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের এবং রাজা বিম্বিসারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। জীবক তক্ষশীলায় ঋষি আত্রেয় পুনর্বসুর নিকট সাত বৎসর চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। প্রাচীন ভারতবর্ষে উচ্চ শিক্ষার উৎকর্ষতার বহু নিদর্শন রয়েছে। ভারতবর্ষ যে উচ্চ শিক্ষার অন্যতম উর্বর পীঠস্থান ছিল তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বিদ্বান ব্যক্তিবর্গ এবং তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে বোঝা যায়। টাঙ্গা আপনাকে নিয়ে চলবে রাজা বিম্বিসারের ধনরাশি ভান্ডারের উদ্দেশ্যে, যা স্বর্ণ ভান্ডার বলে পরিচিত কত লোককথা প্রচলিত রয়েছে এই বিষয়ে। কথিত আছে, আজ পর্যন্ত এই বিপুল ধনরাশি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পথে দর্শন করে নিতে পারেন  মনিয়ার মঠ।  

অজাতশত্রু সিংহাসন আরোহন করে রাজত্ব করেন ৪৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কাল পর্যন্ত। তিনি রানী কোশালার পুত্র না রানী চেল্লানার পুত্র তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। অজাতশত্রুর জন্ম নিয়েও নানান কাহিনী বা লোককথা আজও প্রচলিত রয়েছে। রাজা বিম্বিসারের অন্তিম পরিণতি ছিল মর্মবিদারক। বৌদ্ধ মতে, পুত্র অজাতশত্রু তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করেন, বন্দী করেন এবং হত্যা করেন। এই কারাগার, যা বিম্বিসার কারাগার বলে পরিচিত, আজ একটি দ্রষ্টব্য। বিজয়ীর অহংকারের অট্টহাস্য, বিজিতের লাঞ্ছনার নানা কাহিনী আজও গুঞ্জরিত হয় তার প্রাচীরে, প্রকোষ্ঠে। শোনা যায়, কারাগারে অবরুদ্ধ রাজা বিম্বিসার গৃদ্ধকুট শিখরে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধদেব-কে প্রত্যক্ষ করে শান্তিলাভ করতেন। রোপওয়ে থেকে এই শিখরটি দেখা যায়, কেউ যদি শান্তিস্তূপ ট্রেল ধরে হেঁটে বিশ্বশান্তিস্তূপে যান তবে চলার পথে দেখে নিতে পারেন গৃদ্ধকুট শিখর হয়তো এই বেদনাদায়ক ঘটনার জন্যেই অজাতশত্রুর জন্মসংক্রান্ত অগৌরবের কাহিনী প্রচলিত। তবে আবার জৈন মতে রাজা বিম্বিসার আত্মহত্যা করেছিলেন। অজাতশত্রুর শাসনকালে হার্যঙ্ক বংশের সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃতিলাভ করে। তিনি সমগ্র গণ সংঘের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন, বৈশালী রাজ্য দখল করেন, প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে পরাস্ত করেন। অজাতশত্রুর দুর্গের স্থানটি আজ দ্রষ্টব্য। অজাতশত্রু রাজগৃহের পরিবর্তে রাজধানী চম্পাতে স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পাটুলিপুত্র নগরী নির্মাণ করেছিলেন, এই নগরী হয়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক প্রাণকেন্দ্র। রাজা অজাতশত্রু যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন, তবে কতটা আদর্শবাদী বা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন তা দ্বিধার অবকাশ রাখে। ৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাদে হার্যঙ্ক বংশের অবসানের পরে শিশুনাগ বংশ এবং তার পরবর্তী সময়ে নন্দ বংশের উৎপত্তি হবে। তবে তা আবর্তিত হবে পাটলিপুত্র বা বর্তমানে যে স্থান পাটনা নামে পরিচিত তাকে কেন্দ্র করে।   

গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর জৈন ছিলেন হার্যঙ্ক বংশের সমসাময়িক। বর্তমান রাজগীর শহরের থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সপ্তপর্ণী গুহা। ভগবান বুদ্ধ নির্বাণের পূর্বে কিছুকাল এই স্থানে অতিবাহিত করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধের পরনির্বাণের পর প্রথম বুদ্ধিস্ট কাউন্সিল এই স্থানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধের দুই শিষ্য আনন্দ এবং উপালীকে উক্ত কাউন্সিলে বুদ্ধদেবের বাণী ও শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে সংকলন করার অনুরোধ করা হয়। এখানে আসার পথে পড়বে জরাসন্ধের বৈঠকখানা, শ্বেতাম্বর জৈন মন্দির রাজগীর ভ্রমণের আর একটি আকর্ষণ রোপওয়ে, এর আকর্ষণ এতটাই ছিল যে আমরা দু'দিন রোপওয়ে-তে চড়েছিলাম রোপওয়ে-তে করে পৌঁছতে হয় রত্নগিরিতে অবস্থিত বিশ্বশান্তিস্তূপে। তখন সব ক'টি আসন ঘেরা এবং সামনে ধরবার হাতল ছিল না। কয়েকটি মাত্র ছিল এরূপ নিরাপদ। বাকি আসনগুলি ঘেরা ছিল না, একপাশে কেবলমাত্র একটি লোহার হাতল ছিল।  

এছাড়াও ঘুরে নিতে পারেন রাজগীর হেরিটেজ মিউজিয়াম, বেণুবন, মাখদুম কুন্ড, শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির, ব্রহ্মা কুন্ড, সূর্য কুন্ড, দিগম্বর জৈন মন্দির ইত্যাদি। যাঁরা বন্য প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী ভালোবাসেন, তাঁদের জন্যে রাজগীরে রয়েছে বেশ কয়েকটি সাফারি, সময় ও সুযোগ মতন দেখে নিতে পারেন পন্ত ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিটিও। তবে সেই যাত্রায় আমরা এগুলি দর্শন করিনি। পর্যটনস্থান হওয়ার দরুন রাজগীর শহরে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে অনেক ট্যুরিস্ট সার্ভিসের দোকান। এখন থেকেই পেয়ে যাবেন পাওয়াপুরী কিংবা নালন্দা ঘোরার বাস। আমরাও সেই মতন বাসে করেই ঘুরেছিলাম এই দু'টি স্থান। রাজগীর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত নালন্দা মহাবিহার, প্রাচীন ভারতবর্ষের উৎকর্ষতার এক অন্যতম উন্নত নিদর্শন। নন্দ (Nanda), মৌর্য (Maurya), শুঙ্গ (Shunga), কাণ্ব (Kanwa) ইত্যাদি বংশের অবসানের পর শুরু হয় গুপ্ত (Gupta) সাম্রাজ্য। শ্রীগুপ্ত এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। গুপ্ত সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য রাজন্যবর্গের মধ্যে রয়েছেন সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্য। বিক্রমাদিত্য পশ্চিমের ক্ষাত্রপদের পরাজিত করেন। পশ্চিমে সিন্ধু নদ থেকে পূর্বে বাংলা, উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। শুধুমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তার নয়, ইতিহাস তাঁকে স্মরণ করে একজন শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও, তাঁর রাজসভা অলংকৃত করে যে নবরত্ন ছিলেন তা সর্বজন বিদিত। বিক্রমাদিত্যের পরে সিংহাসন আরোহন করেন প্রথম কুমারগুপ্ত।  প্রথম কুমারগুপ্ত পঞ্চম শতকে এই নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন। আজকের এই ধ্বংসাবশেষ ছিল সেই যুগের একটি প্রধান অধ্যয়ন কেন্দ্র। পৃথিবীর ভিন্ন প্রান্ত থেকে পন্ডিত, শিক্ষাবিদরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন, থাকতেন এবং অধ্যয়ন করতেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চীন থেকে ফা হিয়েন (৩৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১২ খ্রিস্টাব্দ ), হিউ  এন সাং (৬৩৭ থেকে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দ), ইজিং (৬৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ), কোরিয়া থেকে হিয়ন জো (সপ্তম শতকের মধ্যভাগে), তিব্বত থেকে থন্মি সাম্ভটা (সপ্তম শতক) প্রমুখ। তাঁদের বর্ণিত এবং লিখিত দলিল থেকে এই মহাবিহার সম্বন্ধে জানা যায়।

বাংলায় তখন সেন বংশ (Sen) প্রবল পরাক্রমে রাজত্ব করছে। পাল বংশের (Pal) শেষ রাজা গোপালদেব পরাজিত হয়েছেন, রাজ্য থেকে পলায়ন করেছেন কিন্তু হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছেন। বল্লাল সেনের কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তনে, ব্রাহ্মণ্য প্রথার বাড়বাড়ন্তে সমাজ কুসংস্কারের পঙ্কিলতায় ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শ্রমণদের উপর নেমে আসছে অনাদর, বৌদ্ধমহাবিহারগুলি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।  মগধে অবস্থিত এই ওদন্তপুরী মহাবিহারে তখন বসেছে আলোচনা, তাতে উপস্থিত মাত্র তিনজন; বজ্রাচার্য, বৈশ্য বল্লভানন্দ শ্রেষ্টী আর বিজিত রাজা গোপালদেব। এ বর্ণনা শক্তিপদ রাজগুরুর 'লক্ষণাবতী' উপন্যাসে পাওয়া যায়। না, সেই যাত্রায় ওদন্তপুরী যাওয়া হয়নি আমাদের, তবে আশা করি, ভবিষ্যতে অবশ্যই কখনও সেই স্থান পরিদর্শন করার সুযোগ পাব। বাংলা পুনরুদ্ধার পাল বংশের আর সম্ভব হয়নি। ঘুরী সাম্রাজ্যের তুর্ক-আফগান সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি এগিয়ে চলেছেন বাংলার দিকে, তিব্বত পর্যন্ত দখল করবেন তিনি, এমনই মনোবাসনা তাঁর। পথে ধ্বংস করে চলেছেন একের পর এক বৌদ্ধ মহাবিহারগুলি, ওদন্তপুরী, নালন্দা কেউই রেহাই পাইনি বিজয়ীর অন্ধ অহংকারে। স্থাপত্যগুলি মুহূর্তে পরিণত হয়েছে ধ্বংসাবশেষে, হাজার হাজার পুঁথি, প্রামাণ্য দলিল অগ্নির লেলিহান শিখায় মুহূর্তে পর্যবসিত হয়েছে ভস্মতে ভারতবর্ষের অমূল্য দলিলগুলি শেষ হয়ে গিয়েছে। ওদিকে লক্ষণ সেন পলায়ন করেছেন, বাংলায় স্থাপিত হয়েছে খিলজি বংশ।

তবে আমাদের ফেরাটা আর বক্তিয়ারপুর জংশন হয়ে নয়, আমরা গিয়েছিলাম বুদ্ধগয়া। ভগবান বুদ্ধের পাদপদ্ম স্পর্শ করে আমরা বিকেলে এসে পৌঁছেছিলাম গয়াতে। মনে পরে স্টেশনের বাইরে ছোট ছোট হোটেলগুলি; তাদের ভাত, রুটির পসরা, খদ্দের ধরার হাঁকডাক চোখ টেনেছিল, তবে আমরা তা খাইনি। গয়া স্টেশনে অপেক্ষারত অবস্থায় দেখলাম রাজধানী এক্সপ্রেস পাস করছে, দূরপাল্লার সব রেলগাড়ী লাল রঙের হয় না, রাজধানীর রঙ কমলা। রেলগাড়ির জন্যে অপেক্ষা করা, স্টেশনে বসে মুড়ি খাওয়া, বারবার রেলগাড়ির দেরীর ঘোষণায় ক্লান্ত হয়ে পড়া, অবশেষে অনেক রাত্রে রেলগাড়িতে চড়া এবং পরদিন হাওড়া পৌঁছনো, এভাবেই সেই যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে।

পরিশেষে উল্লেখ করি, ইতিহাসের হাত ধরে এই স্থানটিকে তুলে ধরা আমার উদ্দেশ্য ছিলকাজেই সময়ানুসারে আমি দ্রষ্টব্যগুলি বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। সময় ও সুযোগ অনুযায়ী পর্যটকরা তা পরিবর্তন করতেই পারেন। যেমন সাইক্লোপিয়ান দেওয়ালটি দেখে একটু হেঁটে অনতিদূরে অজাতশত্রুর দুর্গের স্থানটি দেখে নেওয়াই যায়, ইতিহাসের সময়কাল অনুযায়ী আমি এর পর যে জরাসন্ধের আখড়ার কথা উল্লেখ করেছি তা কিন্তু সাইক্লোপিয়ান দেওয়ালটির থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। আর একটি দুঃখ প্রকাশ, আমি সর্বদা ব্লগে নিজের তোলা (সময় বিশেষে নিজেদের তোলা) ছবি ব্যবহার করে থাকি, উক্ত ভ্রমণের সময় আমাদের কোনো ক্যামেরা না থাকার দরুন কোনো ছবি আমার কাছে নেই। সেই কারণে ভ্রমণের কোনো ছবি দিতে পারলাম না। আশা করি নিকট ভবিষ্যতে এই স্থানে যাওয়ার সুযোগ হলে আমি ছবি দিতে পারবো। এখানে প্রদত্ত ভগবান বুদ্ধের চিত্রটি আমার স্ত্রী-র আঁকা।

১৯৯৫

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...