পৃষ্ঠাসমূহ

বন্য প্রাণীর গুরুত্ব (Importance of wildlife)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


পূর্বে একটি ব্লগে আমি বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের সংরক্ষিত স্থান, বিভিন্ন প্রকারের জঙ্গলের বিষয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আজ আলোচনা করবো এই জঙ্গলের বন্য প্রাণ নিয়ে। একসময় কত রাজা মহারাজার শিকারের গল্প পড়ে বা শুনে আমরা শিহরিত হয়েছি, কিন্তু এই শিকার আজ অতীত। পিছনের কয়েক দশকে মানুষ বন্য প্রাণীর গুরুত্বের কথা বুঝেছে তাই শিকার আজ বন্ধ হয়েছে। তবে মাঝে মাঝেই সংবাদ পত্রে বিভিন্ন চোরা শিকারের কথা কিংবা বন্য প্রাণী আটক হওয়ার কথা জানতে পারি, ভেবে দুঃখ পাই কিভাবে জীবগুলিকে অনৈতিক এবং অমানবিক ভাবে হত্যা করা হয়েছে বা হচ্ছে ! এই প্রকার বন্যপ্রাণী হত্যা আটকানোর জন্যে সরকার বাহাদুর নানান আইন প্রণয়ন করেছেন, বনবিভাগ সদা সর্বদা সজাগ রয়েছে এ ধরণের ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্যে। এর পাশাপাশি আরও নানান ভাবে কিন্তু বনের ক্ষতি হতে পারে বা হচ্ছে। যেমন, বনভূমি কেটে ফেলে, সেখানে মানুষের বসতি, কল কারখানা, ইত্যাদি গড়ে বা বনভূমিকে কৃষিভূমিতে পরিণত করলেও কিন্তু তা বনের ক্ষতিসাধন করে। আবার পরিবেশ বদলের প্রতিফলনও বনের উপর পড়ছে। আমরা জানি বন্য প্রাণী বা উদ্ভিদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বাস্তুতন্ত্রে তারা কত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এবং তারা বিলুপ্ত হয়ে গেলে মনুষ্য সমাজেও কিন্তু দুর্ভোগ নেমে আসবে, তা বলাই বাহুল্য। আজ আমাদের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় এটি, বন্য প্রাণীর গুরুত্ব।  

ইকোলজি (Ecology) বা বাস্তুশাস্ত্রের যে শাখা জীব বৈচিত্র নিয়ে অধ্যয়ন করে তা কমিউনিটি ইকোলজি (Community ecology) নামে পরিচিত। কোনো একটি ভৌগোলিক স্থান জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর (যেমন ট্রপিক্যাল চিরহরিৎ রেন ফরেস্ট) আবার কোনো স্থান জীব বৈচিত্র্যে তুলনামূলকভাবে দৈন (যেমন বোরিয়াল ফরেস্ট)। এর আবহাওয়া-জলবায়ু জনিত, বাস্তুতন্ত্র জনিত অনেক কারণ বর্তমান এবং তা সহজেই বোধ্য। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে মানুষ ধীরে ধীরে লক্ষ্য করলো যে বেশ কিছু প্রাণী অবলুপ্ত হয়ে গেছে বা যাচ্ছে এবং এ যদি অনবরত ঘটতে থাকে তবে তা মনুষ্য সমাজকে বিপর্যস্ত করবে। একটি বাস্তুতন্ত্রে অনেক জীব এবং উদ্ভিদ থাকে, তারা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল (সবাই তো খাদ্য শৃঙ্খল, খাদ্য জাল (Food chain, Food web), বাস্তুতন্ত্রের পিরামিড যেমন এনার্জি পিরামিড (Energy pyramid), বায়োমাস পিরামিড (Biomass pyramid) ইত্যাদি বিষয়ে জানে), একটির অবলুপ্তি অন্য একটির অবলুপ্তিকে ডেকে আনতে পারে, এইভাবে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রটির (এক্ষেত্রে যেমন জঙ্গল) বিপর্যয় ঘটতে পারে। এখন মানুষ সকল প্রাণীর থেকে সরাসরি উপকৃত হয় এমন নয়, তবে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের থেকে তো উপকৃত হয়। একটু সহজ করে বলি, একটি জঙ্গল অনেক প্রাণী যেমন পোকা-মাকড়, মোলাস্কা, সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী ইত্যাদির এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের বাসস্থান। মানুষ এদের প্রত্যেকের থেকে স্বতন্ত্রভাবে সরাসরি উপকৃত (মৌমাছি মধু প্রস্তুত করে, পরাগ বাহক পতঙ্গরা পরাগযোগে সাহায্য করে এবং তার ফলে ফুল-ফল-শস্য উৎপাদন হয়, ঔষধি গাছের রোগ নিরাময়ক ক্ষমতার জন্যে সংগৃহিত হয়, গাছের ফল-ফুল-পাতা, এগুলি সরাসরি উপকারের কয়েকটি উদাহরণ) নাও হতে পারে, তবে জঙ্গল সার্বিকভাবে কার্বন-ডাই -অক্সাইডকে শোষণ করে, মাটির উর্বরতাকে রক্ষা করে, জল ধরে রেখে, মাটির ক্ষয় প্রতিরোধ করে, বন্যা প্রতিরোধ করে, ইত্যাদিতে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করে, যেগুলি মানব সভ্যতাকে সাহায্য করে। কাজেই বোঝা গেলো বন্য জীবের অবলুপ্তিতে জঙ্গল বাস্তুতন্ত্রটির অবলুপ্তি আর তার ফলশ্রুতিতে মানব সভ্যতার উপর বিপর্যয় নেমে আসতে পারেকাজেই জঙ্গলকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। এর অর্থ বন্য প্রাণী এবং উদ্ভিদকে রক্ষা করতে হবে। আর রক্ষা করতে হলে এদের সম্বন্ধে আমাদের প্রথমে অবগত হতে হবে। এখন ছোট বড়ো আকারে এতো প্রাণী, এতো উদ্ভিদ, সকলের সম্বন্ধে জানব কিরূপে? একটি বাস্তুতন্ত্রে এতো জৈব উপাদান (প্রাণী, উদ্ভিদ, শৈবাল, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস), সকলের গুরুত্ব কি এক ! না কি কেউ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কেউ তুলনামূলকভাবে কম ! এ এক বিরাট প্রশ্ন আবির্ভূত হলো মানুষের সামনে।

প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হলো। প্রথম ধাপ হলো পর্যবেক্ষণ। বিংশ শতকের ষাটের দশকে চার্লস এলটন (Charles Elton) প্রস্তাব করলেন যে জীব বৈচিত্র্য (প্রজাতির সংখ্যা) আর স্থায়িত্ব (যা বৈচিত্র্য-স্থায়িত্ব প্রকল্প (Diversity-Stability hypothesis) নামে পরিচিত) একটি সরলরৈখিক (সমানুপাতিক) সম্পর্ক মেনে চলে। অর্থাৎ একটি কমিউনিটিতে যত বেশি প্রজাতি, তত বেশি স্থায়িত্ব। ব্যাপারটা বোঝা গেলো। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেলো ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রাণী অবলুপ্ত হয়েছে কিন্তু তাদের বাসস্থান যে বাস্তুতন্ত্রে সেগুলি কিন্তু টিঁকে আছে, অবলুপ্তি ঘটেনি। কাজেই তবে কি সকলে বাস্তুতন্ত্রে সকলে সমান ভূমিকা পালন করছে? এবার একটা নতুন তত্ত্ব এলো, নব্বইয়ের দশকের প্রথমভাগে পল (Paul) এবং অরলিখ (Anne Ehrlich) রিভেট প্রকল্পের (Rivet hypothesis) অবতারণা করলেন। রিভেট (Rivet) কথার অর্থ ছোট পিন যা দিয়ে ধাতুর প্লেট আটকানো থাকে। একটি বাস্তুতন্ত্র এরূপ অনেকগুলি ধাতুর প্লেট দিয়ে নির্মিত আর এই রিভেটগুলি দিয়ে একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের সাথে যুক্ত রাখে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী জীব বৈচিত্র্য অনেকটা রিভেটের মতন, প্রত্যেকেই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখন একটি রিভেট যদি নষ্ট হয়ে যায় বা তবে তার সাথে যুক্ত প্লেটগুলি কিন্তু নড়বড় হয়ে যায়, অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্রে একটু অসুবিধা হয়, কিন্তু বাস্তুতন্ত্রটি সেটা মানিয়ে নেয়, কয়েকটি রিভেটের ক্ষতি হলেও অনেকসময় বাস্তুতন্ত্রটি হয়তো মানিয়ে নিতে সমর্থ হয় তবে তার বেশি রিভেটের ক্ষতি হলে কিন্তু বাস্তুতন্ত্রটির পক্ষে সেটা মানিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হয়না। পরবর্তী দশকে ব্রায়ান ওয়াকার (Brian Walker)  রিডানডেন্সি প্রকল্পের (Redundancy hypothesis) অবতারণা করলেন। এটি বোঝা কিন্তু একটু সহজ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো একটি বাস্তুতন্ত্রে অনেক জীবের মধ্যে সকলের ভূমিকা এক নয়। যেমন ধরো জাহাজ বা উড়োজাহাজ একটি বাস্তুতন্ত্র, এখানে পাইলট বা নাবিকের ভূমিকা, জাহাজ এটেন্ডেন্টদের ভূমিকা, যাত্রীদের ভূমিকা আলাদা আলাদা। এবার বোঝা যাচ্ছে, যে এই বাস্তুতন্ত্রে, মানে জাহাজ চালানোতেনাবিকের ভূমিকা অনেক বেশি। এছাড়াও আর একটি প্রকল্প রয়েছে যা ইডিওসিনক্রেটিক প্রকল্প (Idiosyncratic hypothesis) নামে পরিচিত (তবে এ ব্যাপারে এখানে বলে ব্লগটিকে অধিক দীর্ঘ করবো না)

কাজেই বোঝা যাচ্ছে একটি বাস্তুতন্ত্রের সকল প্রজাতির ভূমিকা আলাদা। এবার গুরুত্বের বিচারে প্রজাতিগুলিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। প্রথমেই আসি এক ধরণের প্রজাতির দিকে যাদের কীস্টোন প্রজাতি (Keystone species) বলা হয়। আমরা যখন বিভিন্ন জঙ্গল বেড়াতে যাই তখন এরূপ কীস্টোন প্রজাতির দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করি। যেমন লঞ্চে করে সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া হয় তখন বাঘ দেখতে পেলে আনন্দের সীমা থাকে না, মনে হয় বেড়ানোটা সার্থক হলো। আবার গুজরাতের গির অরণ্যে গিয়ে সিংহ, আসামের কাজিরাঙা অভয়ারণ্যে গিয়ে গন্ডার, পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া বা গরুমারাতে হাতি বা গন্ডার দর্শন প্রধান লক্ষ্য বা আকর্ষণ হয়ে থাকে। কীস্টোন প্রজাতি একটি সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করে, এর অর্থ, বাস্তুতন্ত্রটি ওই প্রজাতির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং কীস্টোন প্রজাতি ব্যতীত বাস্তুতন্ত্রটি উল্লেখযোগ্য ভিন্ন হবে বা সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। এই সকল কীস্টোন প্রজাতির উপর বাস্তুতন্ত্রটি বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল। কীস্টোন প্রজাতি কিন্ত সাধারণভাবে তিন প্রকার হয়ে থাকে। যেমন শিকারী (Predator) প্রজাতি, মিউচুয়ালিস্ট বা পারস্পরিক উপকারপ্রাপ্ত প্রজাতি (Mutualist) প্রজাতি এবং ইকোলজিকাল ইঞ্জিনিয়ার (Ecological engineer) যেমন বাঘ একটি শীর্ষ শিকারী (Apex pyramid) প্রাণী, এনার্জি বা খাদ্য পিরামিডের উপরিভাগে অবস্থান করে, এর উপর নির্ভর করে ওই জঙ্গলের শিকারের (যেমন হরিণের) সংখ্যা, এবং সম্পর্কিত বাস্তুতন্ত্র। এনার্জি পিরামিডের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাস্তুতন্ত্রে যথাক্রমে প্রথমে ডিকম্পোজার (Decomposer, যারা পচনে সাহায্য করে), এর উপরে প্রোডিউসার বা অটোট্রফ (Producer-Autotroph, যারা সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে যেমন উদ্ভিদ), এর উপর প্রাইমারি কনসিউমার (Primary consumer, যারা প্রোডিউসারকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যেমন তৃণভোজী প্রাণী হরিণ ইত্যাদি), এর উপর সেকেন্ডারি কনসিউমার (Secondary consumer, যারা প্রাইমারি কনসিউমারকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে যেমন মাংসাশী প্রাণী), এর উপর টার্শিয়ারি কনসিউমার (Tertiary consumer, যারা অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে), এবং সবথেকে উপরে শীর্ষ শিকারী (Apex predator, যারা প্রাইমারি, সেকেন্ডারি বা টার্শিয়ারি কনসিউমারকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যেমন বাঘ, সিংহ, ঈগল, হাঙ্গর) কাজেই বোঝা গেলো কোনো একটি বাস্তুতন্ত্র একেবারে শীর্ষ শিকারীর উপর নির্ভর করে। আবার গন্ডার বা হাতি ইকোলজিকাল ইঞ্জিনিয়ারের উদাহরণ, এরা নরম মাটিতে গর্ত করে, তাতে  জল জমে এবং সেগুলি অন্যান্য জীবের জন্যে পানীয় জলের উৎস হয়, হাতি গাছ বা গাছের ডাল ভেঙে বাস্তুতন্ত্রকে রূপ প্রদান করে, এইভাবে বাস্তুতন্ত্রটি এই প্রজাতির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। আবার মিউচুয়ালিস্ট-র প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মৌমাছিরা, এরা ফুল থেকে নেক্টর, পরাগ সংগ্রহ করে এবং উদ্ভিদের পরাগসংযোগে সাহায্য করে। যাইহোক, জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র বোঝাতে অনেকটা বিষয়ভিত্তিক (যদিও প্রাথমিক) আলোচনা করে ফেললাম। তবে আরও কয়েকটি প্রজাতির কথা না বললেই নয়। যেমন আমব্রেলা প্রজাতি (Umbrella species, এই প্রজাতিরা অনেকটা কীস্টোন প্রজাতির মতোই, তবেএরা একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত থাকে, যেমন সাইবেরিয়ান বাঘ), ফাউন্ডেশন প্রজাতি (Foundation species, এদের মধ্যেই রয়েছে ইকোলজিকাল ইঞ্জিনিয়াররা যার উল্লেখ আমি আগেই করেছি এই প্রজাতিরা বাসস্থান গড়ে তুলতে বা তাকে বজায় রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করে, যেমন কোরাল (Coral) যা আন্দামানের কোরাল রিফ (Coral reef) গঠন করেছে), ইনডিকেটর প্রজাতি (Indicator species, এই সকল প্রজাতির বৃদ্ধি বা হ্রাস বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশগত (দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি) পরিবর্তনের সূচনা দেয়, যেমন মেফ্লাই (Mayfly)-এর হ্রাস পাওয়া জলাশয়ের দূষণকে চিহ্নিত করে, মোনার্ক বাটারফ্লাই (Monarch butterfly)-এর হ্রাস পাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের, আবার লাইকেনের (Lichen) হ্রাস পাওয়া বাতাসের গুণমানের হ্রাস পাওয়াকে চিহ্নিত করে), ফ্ল্যাগশিপ প্রজাতি (Flagship species, এই প্রজাতিরা একটি অঞ্চলের সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে মাসকটের মতন রিপ্রেজেন্ট করে, অনেক সময় এরা পরিবেশ বা সংরক্ষণের বিভিন্ন ক্যাম্পেন বা আলোচনার প্রতীক হিবেসেও বিবেচিত হয়, যেমন জায়েন্ট পান্ডা)  

স্বাভাবিকভাবেই এই সকল প্রজাতির, যাদের উপর একটা বাস্তুতন্ত্র উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভরশীল, উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, এদের সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয় যাতে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রটিকে সংরক্ষণ করা যায়। সাস্টেনেবেল ট্যুরিজম কিন্ত ওয়াইল্ড লাইফ এবং জীব বৈচিত্র্যের উপকার করে থাকে। তবে সে বিষয়ে বিশদে অন্য কখনও আলোচনা করবো। আপাতত এই পর্যন্ত।

বিশদে জানার জন্যে References:

Stiling, P. 2002. Ecology Theories and Application. Fourth Edition, Prentice Hall, NJ, USA.

Higginbottom, K. (Ed.) 2004. Wildlife Tourism Impacts, Management and Planning. Common Ground, CRC for Sustainable Tourism, Australia.

Cottee-Jones, H.E.W.; Whittaker, R.J. 2012. The keystone species concept: a critical appraisal. Frontiers of Biogeography 4(3): 117- 127. https://doi.org/10.21425/F5FBG12533 

Hale, S.L.; Koprowski, J.L. 2018. Ecosystem-level effects of keystone species reintroduction: a literature review. Restoration Ecology. https://doi.org/10.1111/rec.12684 


দক্ষিণ কোরিয়ার ফরেস্ট অ্যালবাম (South Korean Forest Album)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


পূর্বের ব্লগটিতে আমি বিভিন্ন প্রকার ফরেস্ট বা জঙ্গলের বর্ণনা করেছি। এই ব্লগটিতে আমি দক্ষিণ কোরিয়ার ফরেস্টের কয়েকটি ছবি দিলাম, বছরের বিভিন্ন সময় টেম্পারেট ফরেস্টের বিভিন্ন রূপ। দেশটি টেম্পারেট অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় জঙ্গলের বৈশিষ্ট্যও অনুরূপ। কর্মোপলক্ষ্যে বিভিন্ন এক্সকারসনের সময় বা অবসরে আমি ছবিগুলি তুলেছি। এই জঙ্গলের গাছগুলি বেশিরভাগই পর্ণমোচী এবং কনিফেরাস বৃক্ষের। শীতকালে সব পাতা  ঝরে গিয়ে একেবারে রুক্ষ ও শুষ্ক রূপ ধারণ করে, আবার বসন্তে নতুন কচি পাতা ধরে ও ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে ওঠে।  তখন এর আরেক রূপ।

নামওন (Namwon-si) শহরের অনতিদূরে  তোলা জঙ্গলের ছবি (জুলাই, ২০২০)। জঙ্গলের দৃশ্য গ্রীষ্মে একেবারেই আলাদা। ঘন সবুজ জঙ্গল। 


নামওন (Namwon-si) শহরের অনতিদূরে অবস্থিত ছোনানজেসুজি রিজার্ভার-র (Cheonunjeosuji Reservoir) সামনে তোলা ছবিটি (জুলাই, ২০২০)। বর্ষাতে জঙ্গলের দৃশ্য এইরকম ঘন সবুজ থাকে।


জেজু দ্বীপের (Jeju island) হালাসান (Halasan mountain) পর্বতে তোলা ছবি (জুন, ২০১৬)। দক্ষিণ কোরিয়ার একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত এই দ্বীপটির কিন্তু আর্দ্র সাব ট্রপিক্যাল (Humid sub tropical region) অঞ্চলের অন্তর্গত।


পিয়ংচান-এ (Pyeongchang) তোলা এই ছবি (অক্টোবর, ২০১৯)। শরৎ কাল, শীতের প্রারম্ভ। পাতাগুলি রঙিন হয়ে উঠছে, পর্ণমোচীদের পাতাগুলি ধীরে ধীরে আর্দ্রতা হারাবে। টেম্পারেট অঞ্চলে চারটি ঋতু যথা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, এবং বসন্ত খুব পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়। তবে বর্ষার শেষে, বৃষ্টি হচ্ছে না, বাতাসে আর্দ্রতা কমছে, এবং হালকা একটা শীতের আমেজ রয়েছে কিন্তু পুরোপুরি শীত পড়েনি, এমন একটা সময় শরৎ এসেছে বলে বোঝা যায়। এই সময় তাপমাত্রা থাকে ৫ থেকে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে, এটা আমাদের পশ্চিমবঙ্গে শীত বলে বিবেচিত হলেও এখানে শীত বলে মনে হয়না, শীতে এখানে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রীর থেকে বেশ কিছুটা নেমে যায়।



আনদং মাস্ক মিউজিয়াম (Andong Mask Museum) থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে হাওয়ে গ্রামে বিয়ংসান সুয়োন কনফুসিয়াস একাডেমি-র (Byeongsanseowon Confucian Academy) পথে তোলা এই ছবি (জানুয়ারী, ২০১৮)। শীতে গাছের সকল পাতা ঝরে গিয়ে প্রায় ন্যাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি যে পাতাগুলি রয়েছে সেগুলিও শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় আর্দ্রতা হারিয়ে শুকনো হয়ে গেছে। 



আনদং বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে যে জঙ্গল রয়েছে সেখানে তোলা ছবি (ডিসেম্বর, ২০১৭)। জঙ্গল এখন পুরোই বরফে ঢাকা, সাদা।

সোবেকসানের (Sobaeksan) ট্রেকিং পথে তোলা ছবি (ডিসেম্বর, ২০১৯)। বরফের পুরু চাদরে আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছে পুরো পথটাই। ল্যান্ডস্কেপটি এখন সাদা-কালো।

শীতকালের শেষে আসে বসন্ত। চারিদিকে গাছগুলি আবার নব সবুজ পাতায় ভোরে ওঠে। প্রকৃতি সেজে ওঠে ফুলে, রঙে। মৌমাছিরা চাক থেকে বেরিয়ে আসে, আবার শুরু করে ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ, পরাগ মিলন হয় তার ফলে। সে বিষয়ে পরে কোনো ব্লগে লিখবো।

নিচের ফোটোটির বাম পাশে যে চেরী ব্লসমের ছবি সেটি ২০২০ সালের এপ্রিলে তোলা এবং ডান পাশের রবিনিয়ার (বা সিউডোএকাশিয়া) ছবি সেটি ওই বছরের মে মাসে তোলা।


এগুলি এপ্রিল (২০২০, ২০২২) ও মে (২০২১, মাঝের ছবিটি) মাসের তোলা বিভিন্ন ফুলের ছবি। আমাদের ক্যাম্পাসের আসে পাশে থেকে এই ছবিগুলি তুলেছি।

উপরের সারির ফুলের ছবি গুলি এপ্রিল মাসে (২০২০) তোলা আর নিচের সারির ফুলের ছবিগুলি জুন মাসে তোলা (২০১৮)।


আশা করি গত পর্বের জঙ্গলের বৃত্তান্ত পড়ার পর এই ছবিগুলির মাধ্যমে টেম্পারেট ফরেস্টের অনেকটা দৃশ্যায়িত হবে। আপনি যদি আমাদের দেশে কাশ্মীর, উত্তরাঞ্চল, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম বা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং বেড়াতে যান, তবে পাইন, দেবদারু, সিডার, ওক, লরেল, রোডোডেনড্রনের টেম্পারেট ফরেস্ট উপভোগ করতে পারেন।

জঙ্গল বিষয়ে কিছু কথা (A few words about Forest)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)



আমাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা জঙ্গলকে (ফরেস্ট/Forest) খুব ভালোবাসেন, প্রকৃতির হাতছানিতে, জীবজন্তু কিংবা উদ্ভিদের আকর্ষণে প্রায়ই, বা সপ্তাহান্তে, বেরিয়ে পড়েন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আমার এই ব্লগের উদ্দেশ্য জঙ্গল সম্বন্ধে প্রাথমিক আলোচনা করা, বিভিন্ন প্রকার সংরক্ষিত স্থান (মূল উদ্দেশ্য- সংরক্ষণ), বিভিন্ন প্রকার জঙ্গলের (পরিবেশগত ভাবে) আলাদা আলাদা চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে একটু চর্চা করা। প্রথমেই সংরক্ষিত স্থান হিসেবে জঙ্গলকে দেখা যাক। সংরক্ষিত স্থানকে আমরা প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি। যেমন ন্যাশনাল পার্ক (National Park)ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি (Wildlife Sanctuary), এবং বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ (Biosphere Reserve)। পশ্চিমবঙ্গে সংরক্ষিত স্থান বা প্রোটেক্টেড এরিয়ার (Protected area) মধ্যে রয়েছে ছয়টি ন্যাশনাল পার্ক (সিঙ্গালিলা, নেওরা ভ্যালি, গরুমারা, বক্সা, সুন্দরবন, জলদাপাড়া), ষোলোটি স্যাংচুয়ারি (সেঞ্চল, মহানন্দা, চাপড়ামারি, বক্সা, সজনেখালি, হ্যালিডে, লোথিয়ান, রায়গঞ্জ, চিন্তামণি কর, বিভূতিভূষণ, জোড়পোখরি, বল্লভপুর, রমনাবাগান, পশ্চিম সুন্দরবন, পাখি বিতান), দু'টি করে বাঘ রিজার্ভ (বক্সা, সুন্দরবন) আর হাতি রিজার্ভ (ময়ূরঝর্ণা, পূর্ব ডুয়ার্স), এবং একটি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ (সুন্দরবন) কাজেই বোঝা যাচ্ছে হাতের কাছেই রয়েছে অনেক পছন্দ, সময় সুযোগ মতন বেছে নিলেই হলো।

ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি, বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ-র মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। একটু সহজ করে এদের মধ্যে পার্থক্যটা বলা যাক।  ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ হেতু প্রতিষ্ঠিত। তুলনামূলকভাবে এর আয়তন কম হয়ে থাকে, অনেক সময় সীমানা খুব একটা নির্দিষ্ট করা থাকে না। সীমাবদ্ধতা থাকলেও কিছু কার্যকলাপ করা যেতে পারে, যেমন পশু চারণ, ঔষধি গাছ গাছড়া সংগ্রহ, কিছু সময় জ্বালানি শুকনো কাঠ, পাতা সংগ্রহ ইত্যাদি, তবে কোনো মতেই শিকার বা বন্য প্রাণীর ক্ষতি করা নয়। 

ন্যাশনাল পার্ক কিন্তু শুধুমাত্র বন্যপ্রাণী নয়, তার সাথে উদ্ভিদ, ঐতিহাসিক কোনো প্রকার স্থাপত্য ইত্যাদি সকল অর্থাৎ প্রাণী, উদ্ভিদ, এবং নির্জীব পদার্থ সহ সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে সংরক্ষণ করে। ন্যাশনাল পার্কের সীমানা অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং এখানে মানুষের কার্যকলাপ একেবারেই সীমাবদ্ধ। 

এবার আসি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের কথায়। বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ কিন্তু উপরোক্ত দুই প্রকার সংরক্ষিত স্থান বা প্রোটেক্টেড এরিয়া থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বড় হয়। এটি সম্পূর্ণ জীব বৈচিত্রকে সংরক্ষণ হেতু স্থাপন করা হয় এবং এটি কিন্তু ওই অঞ্চলে বসবাসকারী জনজাতিদের উন্নতিকল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ন্যাশনাল পার্কের মতন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের সীমানাও কিন্তু অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং এর মধ্যে কিন্তু  ন্যাশনাল পার্ক, স্যাংচুয়ারি থাকতে পারে। যেমন পাঁচমাড়ি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের মধ্যে সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক, এবং কয়েকটি স্যাংচুয়ারি যথা বরি স্যাংচুয়ারি, পাঁচমাড়ি স্যাংচুয়ারি রয়েছে।  আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে রয়েছে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। এই বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভকে কয়েকটি অঞ্চল বা জোনে (Zone) ভাগ করা যায়। যেমন একেবারে কেন্দ্রে থাকে কোর অঞ্চল (Core zone), এখানে কিন্তু কোনো প্রকার মনুষ্য কার্যকলাপ করা যায়না, এটি অন্ত্যন্ত গভীর বন। এর পর থাকে বাফার অঞ্চল (Buffer zone), এই অঞ্চলে পশুচারণ, পর্যটন ইত্যাদি কিছু মনুষ্য কার্যকলাপ সম্ভব। এর পরবর্তী অঞ্চলটি হলো ট্রানজিশন অঞ্চল (Transition zone), এখানে মানুষের বসতি, চাষবাস দেখা যায়। 


এ তো গেলো সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে জঙ্গলের বিবরণ। এবার আসি পরিবেশগত ভাবে বিভিন্ন ধরণের জঙ্গলের বর্ণনায়। যদি আপনি জঙ্গলের প্রকৃতির দিকে তাকান তবে প্রত্যেক জঙ্গলের প্রকৃতি আপনার কিন্তু একই রকম লাগবে না, প্রকৃতির বৈচিত্র আপনার চোখে পড়বে।  একটু সহজ ভাবে বলি, উত্তরবঙ্গ বেড়াতে গিয়ে জলদাপাড়া, গরুমারা কিংবা নেওরা ভ্যালি ঘুরে এলেন আবার দক্ষিণবঙ্গের  সুন্দরবন বেড়ালেন, দু'টো তো আর এক হলো না, সেটাই বলছি। এই যে পার্থক্য সেটা নির্ভর করে ওই স্থানের জলবায়ুর উপর, অর্থাৎ ওই স্থানের তাপমাত্রা কত, বছরে বৃষ্টিপাত কেমন হয় ইত্যাদি, যা আবার স্থানটির ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে। এই বিভিন্ন আবহাওয়া, জলবায়ু, মৃত্তিকার প্রকৃতি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সেই স্থানের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ জন্ম নেয়, এই উদ্ভিদ কিন্তু জঙ্গল বাস্তুতন্ত্রের প্রধান উপাদান।   

জঙ্গল প্রধানত তিন প্রকার, যেমন বোরিয়াল ফরেস্ট (Boreal forest), টেম্পারেট ফরেস্ট (Temperate forest) এবং ট্রপিক্যাল ফরেস্ট (Tropical forest)। বোরিয়াল ফরেস্ট তাইগা (Taiga) নামেও পরিচিত, এই প্রকার ফরেস্ট সাবআর্কটিক অঞ্চলে দেখা যায়। সাবআর্কটিক অঞ্চলটি হলো উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত আর্কটিক সার্কেলের (Arctic circle) দক্ষিণ অংশ। উত্তরের তুন্দ্রা (Tundra) অঞ্চল থেকে দক্ষিণের টেম্পারেট অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানে এই প্রকার ফরেস্ট দেখা যায়। আলাস্কা, কানাডা, স্ক্যান্ডেনেভিয়া, সাইবেরিয়া স্থানগুলিতে এই প্রকার জঙ্গল দেখা যায়। রাশিয়াতে পৃথিবীর বৃহত্তম তাইগা রয়েছে। এই জঙ্গলের উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্প্রুস (Spruce), পাইন (Pine), ফার (Fir) ইত্যাদি কনিফেরাস (Coniferous) উদ্ভিদগুলি (যাদের পাতাগুলি সুচের মতন সরু, পাতানো বৃহৎ নয়)। প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন ধরণের রোডেন্ট (Rodents), বড়ো প্রজাতির হরিণ (Deer), মুস (Moose), ভাল্লুক (Bear), লিনক্স (Lynx), আর সাইবেরিয়ান বাঘের (Siberian tiger) কথা তো সকলেরই জানা, পাখিদের মধ্যে রয়েছে ঈগল (Eagle), পেঁচা (Owl) ইত্যাদি। এই তাইগা আবার দু'ধরণের হয়ে থাকে, সাধারণত উচ্চ অক্ষাংশে পাওয়া যায় ওপেন ক্যানোপি বোরিয়াল ফরেস্ট (Open canopy boreal forest; 'ক্যানোপি' কথাটির অর্থ ছাউনি) যা আবার লাইকেন জঙ্গল বলেও পরিচিত।  ঠান্ডা অধিক হওয়ার দরুন এখানে জীব বৈচিত্র কম হয়ে থাকে। নিম্ন অক্ষাংশে রয়েছে ক্লোস্ড ক্যানোপি বোরিয়াল ফরেস্ট (Closed canopy boreal forest), এখানে আবহাওয়া একটু কম রুক্ষ, কাজেই জীব বৈচিত্র তুলনামূলক ভাবে বেশি।

এর পর আসি টেম্পারেট ফরেস্টে। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই প্রকার ফরেস্ট টেম্পারেট অঞ্চলে পাওয়া যায়। সাধারণভাবে নিম্ন অক্ষাংশে (উত্তর গোলার্ধে ৬৬.৫ ডিগ্রী থেকে ২৩.৫ ডিগ্রী, আবার দক্ষিনে গোলার্ধেও তাই) অবস্থিত টেম্পারেট অঞ্চল, এখানে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়ে কাজেই তাপমাত্রা কমের দিকে থাকে এবং বছরে চারটি ঋতু যথাক্রমে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, এবং বসন্ত পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। টেম্পারেট ফরেস্টে আবার তিন প্রকার, পর্ণমোচী বা ডেসিডুয়াস ফরেস্ট (Deciduous forest), কনিফেরাস ফরেস্ট (Coniferous forest) এবং টেম্পারেট রেন ফরেস্ট (Temperate rain forest)। ডেসিডুয়াস ফরেস্টের উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদগুলি হলো ম্যাপেল (Maple), ওক (Oak), চেস্টনাট (Chestnut), গিংগো বাইলোবা (Ginkgo biloba) ইত্যাদি। ডেসিডুয়াস উদ্ভিদগুলি শীতকালে তাদের সমস্ত পাতা ঝরিয়ে দেয়। বাতাসে আর্দ্রতা এতটাই কম হয় যে পাতা গুলি শুকিয়ে ঝরে পরে যায়, আবার শীতকাল অতিক্রমিত হলে বসন্তের শুরুতে আবার নতুন পাতায় ভরে ওঠে, বড়ই দৃষ্টিনন্দন হয় সেই সময়। এই সময় পৃথিবীর অনেক শহরের মতন আমাদের (বর্তমান বসবাসের) শহর আনদং -এও চেরি ব্লসম (Cherry blossom) হয়ে থাকে, রাস্তার দু'পাশে গাছ গুলি ফুলে ভরে ওঠে। অসাধারণ সুন্দর লাগে এ দৃশ্য। 

অপরপক্ষে কনিফেরাস উদ্ভিদগুলির পাতা সূঁচের ন্যায় হয়ে থাকে, এই অভিযোজন নিজের প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং এদের বীজগুলি কাষ্ঠল কোণের (Cone) ভিতরে থাকে। আগেই উল্লেখ করেছি এই জাতীয় উদ্ভিদ হলো পাইন (Pine), ফার (Fir), সিডার (Cedar), হেমলক (Hemlock), জুনিপার (Juniper), স্প্রুস (Spruce), লার্চ (Larch) ইত্যাদি। এছাড়াও টেম্পারেট অঞ্চলের কিছু জায়গায় বছর বেশ বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে যে ফরেস্ট গড়ে ওঠে তা হলো টেম্পারেট রেন ফরেস্ট। এর উদাহরণ উত্তর আমেরিকার আপালাচিয়ান রেন ফরেস্ট (Appalachian temperate rain forest), দক্ষিণ আমেরিকার ভালদিভিয়ান (Valdivian temperate rain forest)  এবং ম্যাগেলানিক রেন ফরেস্ট (Magellanic temperate rain forest), ইউরোপের কোলচিয়ান রেন ফরেস্ট (Colchian temperate rain forest) ইত্যাদি। এবার আসি নিজেদের দেশে। আমাদের পূর্ব হিমালয়ান যে ব্রডলিফ ফরেস্ট (East Himalayan broadleaf forest) রয়েছে তাও কিন্তু এই রেন ফরেস্টের উদাহরণ। বিভিন্ন ধরণের ওক (Oak), রোডোডেনড্রন (Rhododendron), ম্যাগনোলিয়া (Magnolia), সিনামোন (Cinnamon), হিমালয়ান ম্যাপেল (Himalayan maple), হিমালয়ান বার্চ (Himalayan birch), বার্চ (Birch), পার্সিয়ান ওয়ালনাট (Persian walnut) ইত্যাদি উদ্ভিদ এই জঙ্গলে দেখা যায়। গোল্ডেন লাঙ্গুর (Gee's Golden langur), সাদা পেট বিশিষ্ট ইঁদুর (Brahma white-bellied rat), জায়ান্ট ফ্লাইং স্কুইরেল (Hodgson's giant flying squirrel, Namdapha flying squirrel), টাকিন (Takin), হিমালয়ান শিরো (Himalayan serow), ম্যাকাক বাঁদর (Macaque), লাল পান্ডা (Red panda), ক্লাউডেড লেপার্ড (Clouded leopard) ইত্যাদি এই জঙ্গলের প্রাণী। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরণের পাখি। কাজেই এদের দেখতে যেতে পারেন অরুণাচল প্রদেশের ঈগল নেস্ট ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Eagle nest Wildlife Sanctuary), মৌলিং ন্যাশনাল পার্ক (Mouling National Park)), কামলাং ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Kamlang Wildlife Sanctuary), নামদাফা ন্যাশনাল পার্ক (Namdapha National Park), পশ্চিমবঙ্গের নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক (Neora valley National Park) ইত্যাদি।

এই প্রসঙ্গে স্তন্যপায়ী এবং সরীসৃপ প্রাণীদের বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনার জন্যে ক্লিক করুন।

অবশেষে আসি ট্রপিক্যাল ফরেস্টে। আমাদের সকলেরই জানা আছে পৃথিবীর ট্রপিক্যাল অঞ্চলটি, ক্যান্সার (Cancer) এবং ক্যাপ্রিকর্ন (Capricorn) অক্ষাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চল হলো ট্রপিক্যাল অঞ্চল। আমাদের দেশ ভারতবর্ষের অধিকাংশই এর মধ্যে অবস্থান করে। সূর্যালোক অধিক পরিমানে প্রাপ্ত হওয়ায় এই অঞ্চল উষ্ণ হয় আর জীব বৈচিত্রে পূর্ণ। এই প্রকার জঙ্গলের সান্নিধ্যেই আমি জীবনের অনেকটা অতিবাহিত করেছি, কখনও উত্তর-পূর্বে, আবার কখনও মধ্য ভারতে। জঙ্গলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় মানুষের জীবন। সে জ্বালানির শুকনো কাঠ কুড়োয়, পাতা কুড়িয়ে আনে, গৃহপালিত পশু চড়ায়, ফল-মূল-মধু সংগ্রহ করে। সে ঔষধি গাছ গাছড়া চেনে, রোগের উপশমে প্রাকৃতিক উপাদানগুলিকে ব্যবহার করার বিপুল তথ্য রয়েছে তাঁর জ্ঞানভাণ্ডারে, বিভিন্ন ফসলের স্থানীয় ভ্যারাইটি (Variety) সংরক্ষণ করে, জিন পুল (Gene pool) কে ক্ষয় হতে দেয় না। জঙ্গলের সাহচর্যে বেড়ে ওঠা মানুষ অনুভব করতে পারেন জঙ্গলকে, বনভূমির সাথে তাঁর আত্মার যোগাযোগ, সে তাঁর জীবনযাত্রার মধ্যে দিয়েই পরিচর্যা করে প্রকৃতির। তাঁদের থেকে আমরা শিখি, শেখার চেষ্টা করি। বর্তমানে যে পরিবেশের ধারণক্ষমতার (Environmental Sustainability) উপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করি, তা কিন্তু এই সকল জনজাতি সহস্র বছর ধরে তাঁদের জীবনধারণের মধ্যে দিয়ে অনুশীলন করে আসছেন। এই বিপুল অমূল্য জ্ঞান ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। ট্রপিক্যাল ফরেস্টকে আমরা প্রধানত চারভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন চিরহরিৎ রেন ফরেস্ট (Evergreen rain forest), ট্রপিক্যাল আর্দ্র ফরেস্ট (Tropical moist forest), ট্রপিক্যাল শুষ্ক ফরেস্ট (Tropical dry forest), এবং পরিশেষে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (Mangrove forest)। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপে, উত্তর-পূর্বে, পশ্চিমঘাটে (যে স্থানগুলিতে বছরে ২৩০ সেন্টিমিটারের মতন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে) যে বনভূমি রয়েছে তা চিরহরিৎ ফরেস্ট। রাবার (Rubber), সিঙ্কোনা (Cinchona), রোজউড (Rosewood), মেহগনি (Mahogany), এবনি (Ebony), টিক (Teak), ইন্ডিয়ান লরেল (Indian Laurel) ইত্যাদি এই জঙ্গলে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে বছরে প্রায় ২০০ সেন্টিমিটারের বা বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। ট্রপিক্যাল আর্দ্র ফরেস্ট (বৃষ্টিপাতের পরিমান বছরে ১০০ থেকে ২০০ সেন্টিমিটার), এবং শুষ্ক ফরেস্ট (বৃষ্টিপাতের পরিমান বছরে ৭০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার) নির্ভর করে ওই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমানের উপর। চন্দন (Sandalwood), বাঁশ (Bamboo), শাল (Sal), কুসুম (Kusum), খয়ের (Khoir), মালবেরি (Mulberry), শিশু (Shishu), কেন (Cane), অর্জুন (Arjun) ইত্যাদি আর্দ্র বনভূমিতে পাওয়া যায়। পশ্চিমঘাটের পূর্ব ঢাল, ছোটনাগপুর মালভূমি, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং উত্তর পূর্বের কিছু অংশে এই প্রকার বনাঞ্চল দেখা যায়। অপরপক্ষে টিক (Teak), নিম (Neem), পিপল (Peepal), শাল (Sal), খয়ের (Khoir), বেল (Bel), পলাশ (Palash), লরেল (Laurel) ইত্যাদি শুষ্ক বনভূমিতে পাওয়া যায়। বিহার, উত্তর প্রদেশ, উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের কিছু অঞ্চলের বনভূমি এই প্রকার। উপকূল অঞ্চলে যে বনভূমি দেখা যায়, সেটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।  এখানকার উদ্ভিদগুলি লবনাক্ত মাটি এবং খাড়ির জলে বেঁচে থাকার জন্যে উপযোগী অভিযোজন করেছে, যেমন শ্বাসমূল। সুন্দরী (Sundari)গরান (Garan), গেঁওয়া (Genwa), গোলপাতা (Golpata), হেঁতাল (Hental), গর্জন (Garjan), ধুঁধুল (Dhundhul), পশুর (Pashur), হোয়া (Hoya), কেওড়া (Keora) ইত্যাদি এই বনভূমিতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন (Sundarbans), ওড়িশার ভিতরকণিকা (Bhitarkanika) ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের উদাহরণ।

আশা করি, জঙ্গল সম্বন্ধে আমি একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে পেরেছি। বেড়াতে যাওয়ার পূর্বে সহজেই বুঝে নিন সেই জঙ্গলের প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য, বেড়ানোর পরিকল্পনা করুন সেই মতন। 

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...