পৃষ্ঠাসমূহ

পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৫: ফার্মেন্টেড ফুড (Nutrition security and food - Part-5: Fermented foods)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

ইতিপূর্বে পুষ্টি সুরক্ষা ও খাদ্য সংস্থান সম্পর্কিত ৪ টি পর্ব লিখেছি, সেখানে মিলেট, শাক, ডাল ইত্যাদির বিষয়ে উল্লেখ করেছি। আজ এই পর্বে একটু অন্য প্রকারের খাদ্যের কথা উল্লেখ করবো, যা বহুলভাবে ব্যবহৃত হলেও অতটা পরিলক্ষিত হয় না। ফার্মেন্টেড ফুড (Fermented foods) বা সন্ধানীকৃত খাদ্য এবং পানীয়ের কথা বলছি। ফার্মেন্টেড খাদ্যের উদাহরণ কিন্তু অনেক আছে, তবে সবার আগে যা আমাদের মনে আসে তা হলো টক দই বা ইওগার্ট (Yogurt)ছোটবেলা থেকেই আমরা বাড়িতে টক দই পাততে দেখি, একটি দইয়ের সাজি নিয়ে তাতে ঈষদুষ্ণ দুধ দিয়ে উনুনের আঁচের পাশে রেখে দেওয়া হয়, পরদিন তা চাক বেঁধে দইতে রূপান্তরিত হয়। 

গরম কালে তো নিয়মিত আমাদের দেশের লোকেরা টক দই খেয়ে থাকেন, তবে বিভিন্ন প্রদেশে খাওয়ার ধরণ কিছুটা আলাদা। নান তৈরির সময়েও আটা বা ময়দাকে ইস্ট (Yeast) সহযোগে ফার্মেন্ট করা হয়ে থাকে। আবার কেউ যদি উত্তর পূর্ব ভারতে ভ্রমণ করেন এবং সেই স্থানের বিভিন্ন খাদ্যরীতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হয়ে থাকেন, তবে দেখবেন সেই স্থানের কয়েকটি জাতির মধ্যে সয়াবিন (Soybean), বাঁশের আগা (Bamboo shoot) ফার্মেন্ট করে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। যাঁরা ফার্মেন্টেড বাঁশের আগা সম্বন্ধে পরিচিত নন, তাঁদের কাছে প্রথম দিকে এর একটি গন্ধ অনুভূত হতে পারে। প্রথমে এই গন্ধটি উপভোগ্য না হলেও পরবর্তীতে এই গন্ধটি একটি আকর্ষণে পরিণত হয়। গরুর দুধ, বিশেষত চমরিগাইয়ের (Yalk) দুধ দিয়ে ফার্মেন্টেশন পদ্ধতিতে ছুরপি (Churpi) প্রস্তুত করা হয়ে থাকে, যা বেশ পুষ্টিকর এবং উপাদেয়। এবার আমি দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি ফার্মেন্টেড খাদ্যের কথা বলি। এদেশে সবার আগে যে ফার্মেন্টেড খাদ্যটির নাম মনে আসে সেটি হলো কিমচি (Kimchi) কিমচি ছাড়া এদেশের মানুষের কোনো আহারই সম্পূর্ণ হয় না। এই কিমচি কিন্তু ন্যাপা ক্যাবেজকে (Napa cabbage) ফার্মেন্ট করে তৈরী করা হয়। 

এছাড়াও রয়েছে সয়াবিন দিয়ে প্রস্তুত বিভিন্ন ফার্মেন্টেড খাদ্য যেমন ছোঙ্গকুকজাং (Chongkukjang: সিদ্ধ করা সয়াবিনকে অল্প সময়ের জন্যে Bacillus subtilis এবং খড় (Rice straw) ব্যবহার করে ফার্মেন্ট করে প্রস্তুত করা হয়), দোয়েনজাং (Doenjang: সয়াবিনকে প্রাকৃতিক ভাবে নানান ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ফার্মেন্ট করে প্রস্তুত করা হয়), গানজাং (Ganjang: সয়াবিন সস যা ফার্মেন্টেড সয়াবিন থেকে প্রস্তুত করা হয়) , ঘোচুজাং (Gochujang: লাল লঙ্কার পেস্ট কে ফার্মেন্ট করিয়ে প্রস্তুত করা হয়) (Patra et al., 2016)। শশা এবং মুলোকেও ফার্মেন্ট করা এখানে প্রচলিত।প্রতিদিনই এই খাদ্যগুলি আমার আহারে থাকে। অতএব বোঝা গেলো আমরা ফার্মেন্টেড খাদ্য সম্বন্ধে আমরা সকলেই কম বেশি অবহিত।

ফার্মেন্টেড সয়াবিনের পেস্ট দিয়ে প্রস্তুত স্টু (Fermented soybean stew with tofu and vegetables)

বর্তমানে খুব প্রোবায়োটিক-র (Probiotic) কথা শোনা যায়, প্রোবায়োটিক আসলে এমন কিছু অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক) যা আমাদের শরীরের মধ্যে থেকে নানান উপকার সাধন করে। ফার্মেন্টেড খাদ্যবস্তু যে বর্তমান সময়কালে প্রচলিত তা নয় বরং প্রাচীন সভ্যতাগুলির  দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যাবে ফার্মেন্টেশন পদ্ধতির আবিষ্কার এবং ব্যবহার সেই সময়েও উল্লেখযোগ্যভাবে ছিল (Prajapati and Nair, 2017, cited from RockEDU)। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। প্রায় ৭০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন চৈনিক সভ্যতায় কুই (Kui) প্রস্তুতের পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছিল। এই কুই হলো ভাত, মধু, আঙ্গুর, এবং হথর্ন (Hawthorn) নামক এক প্রকার হার্ব (Herb) থেকে ফার্মেন্ট পদ্ধতিতে প্রস্তুত পানীয়। একবার আমার ইথিওপিয়ার সহকর্মীরা মধুকে গেসো (Gesho, ইথিওপিয়ান স্থানীয় নাম, বিজ্ঞানসম্মত নাম Rhamnus prinoides) নামক এক প্রকার হার্বের সহযোগে ফার্মেন্ট করিয়ে তেজ (Tej) প্রস্তুত করেছিলেন। ইথিওপিয়ায় তেজ একটি জনপ্রিয় পানীয়। এটি বেশ সুস্বাদু, সাধারণ বিয়ারের ন্যায় তেতো নয়, বরং টক মিষ্টি একটা স্বাদ আছে। ৪৩০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় বিয়ার (Beer) প্রস্তুতের পদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার মিশরীয় সভ্যতায় যে রুটি এবং বিয়ার প্রস্তুতের জন্যে যে ইস্ট ব্যবহৃত হতো তা সর্বজন বিদিত। সেই স্থান থেকেই ভারতবর্ষে ইস্টের আগমন বলে ধারণা করা হয় এবং আজ বিভিন্ন প্রকার নান রুটি তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে শশা (Cucumber) কে ফার্মেন্ট করিয়ে আঁচার তৈরির উল্লেখ পাওয়া যায় প্রায় ২০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ সময়কালে। বিভিন্ন ধরণের সব্জির ফার্মেন্টেশন প্রাচীন চৈনিক সভ্যতায় বেশ প্রচলিত ছিল। চায়ের (Tea) ফার্মেন্টেশন পদ্ধতি কিন্তু চীনেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। বর্তমানে জাপানে যে কম্বুচা-র (Kombucha) প্রচলন রয়েছে তা কিন্তু অনেক পরে আসে। আমাদের দেশেও চালের গুঁড়োকে ফার্মেন্ট করিয়ে ব্যাটার প্রস্তুত করা হয় যা দিয়ে দোসা ইত্যাদি খাবার বানানো হয়ে থাকে, এও প্রায় সহস্রাধিক বছর ধরেই প্রচলিত।   

সুপ্রাচীন কাল থেকে ফার্মেন্টেড খাদ্য ও পানীয়ের প্রচলন থাকলেও এর পশ্চাতের বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের ধারণা কিন্তু খুব পুরোনো নয়। এই বিষয়ের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয় ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের (Louis Pasteur) পর্যবেক্ষণ থেকে। এইবার এই ফার্মেন্টেশন পদ্ধতি সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিই। কোষীয় শ্বসনে গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis) একটি স্থায়ী প্রক্রিয়া। সকল জীবেই এই প্রক্রিয়াটি দেখা যায়। এই পাথওয়েটির (Biochemical Pathway) মাধ্যমে একটি গ্লুকোজ অণু (Glucose) দুইটি পাইরুভেট অণুতে (Pyruvate) পরিণত হয়। এইবার এই পাইরুভেট অণুগুলির কি হবে তা নির্ভর করে একটি বিষয়ের উপর। বিষয়টি হলো অক্সিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি। অক্সিজেন যখন ইলেক্ট্রন গ্রহণকারী (Electron accepter) হিসেবে উপস্থিত থাকে তখন পাইরুভেট এরোবিক শ্বসনে (Aerobic respiration) অর্থাৎ ক্রেবের সাইকেল (Kerb’s cycle) এবং ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেনে (Electron transport chain) অংশগ্রহণ করে এবং ATP উৎপাদন করে। অপরপক্ষে, যখন অক্সিজেন অনুপস্থিত থাকে তখন পাইরুভেট অণুগুলি সন্ধান প্রক্রিয়ায় (Fermentation) অংশগ্রহণ করে। এই সন্ধান প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া অংশগ্রহণ করে। কয়েক প্রকার ব্যাকটেরিয়া যারা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এবং অনুপস্থিতিতে, দুই ক্ষেত্রেই, সক্রিয় থাকতে পারে তাদের ফ্যাকালটেটিভ ব্যাক্টেরিয়া (Facultative bacteria) বলা হয়। আর যে সকল ব্যাক্টেরিয়া কেবলমাত্র অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে সক্রিয় থাকে এবং এনএরোবিক শ্বসনে (Anaerobic respiration) অংশ নেয় তাদের অব্লিগেটরি ব্যাকটেরিয়া (Obligatory anaerobes) বলা হয়। সন্ধান প্রক্রিয়ায় পাইরুভেট থেকে ল্যাকটিক অ্যাসিড (Lactic acid), এসিটিক অ্যাসিড (Acetic acid), প্রোপিওনিক অ্যাসিড (Propionic acid), ইথানল (Ethanol) তৈরী হয়ে থাকে। সন্ধান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যাক্টেরিয়াদের শরীরে বিভিন্ন রকমের উৎসেচক বা এনজাইম (Enzyme) থাকে (এটি তাদের বিশেষত্ব) যা পাইরুভেট থেকে এই যৌগগুলি উৎপন্ন করতে সাহায্য করে। যেমন দুধ থেকে দই প্রস্তুত করতে ল্যাক্টোব্যাসিলেলি (Lactobacillales) অর্ডারের ব্যাকটেরিয়া প্রয়োজন কারণ এদের দেহে ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজেনেজ (Lactate dehydrogenase) উৎসেচক থাকায় তা পাইরুভেট থেকে ল্যাকটেট প্রস্তুত করতে পারে  

ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় খাদ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সাধারণ দানা শস্য যেমন ভাত, গম, যব, ভুট্টা ইত্যাদিকে যখন ফার্মেন্ট করা হয় তখন এদের পুষ্টিমান বৃদ্ধি পায়। সাধরণত জলের মধ্যে রেখে ২৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এদের ফার্মেন্ট করা হয়। এর ফলে যে ব্যাকটেরিয়া এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে তাদের শরীরে থাকা উৎসেচকগুলি ব্যবহৃত হয় এবং অনেক যৌগ উৎপাদন করে যা মানুষের দেহে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। সাধারনত দানা শস্যগুলিতে লাইসিনের (Lysine) মাত্রা কম থাকলেও ফার্মেন্টেশনের ফলে এই অ্যামিনো অ্যাসিডটির (Amino acid) মাত্রা বৃদ্ধি পায় (Gilliland, 1990) ফার্মেন্টেড সয়াবিনের আটাতে (Soybean flour) প্রোটিনের (Protein) পরিমান বৃদ্ধি পায় (Li et al., 2020) প্রোটিন তৈরী হয় অ্যামিনো অ্যাসিড দ্বারা, কাজেই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। লাইসিনের পরিমান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এর সাথে অন্যান্য বেশ কয়েকটি অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড (Essential amino acid) যেমন লিউসিন (Leucine), হিস্টিডিন (Histidine), সালফার যুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিড (মিথিওনিন (Methionine), সিস্টিন (Cysteine)), থ্রিওনিন (Threonine), অ্যারোমাটিক অ্যামিনো অ্যাসিড (ফেনিলএলানিন (Phenylalanine) এনং টাইরোসিন (Tyrosine))-র মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আবার অ-অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড (Non-essential amino acid) যেমন গ্লুটামিক অ্যাসিড (Glutamic acid), এসপার্টিক অ্যাসিড (Aspartic acid), আরজিনিন (Arginine), এলানিন (Alanine), গ্লাইসিন (Glycine)-র মাত্রাও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় (Li et al., 2020) কুইনোয়া বীজের (Quinoa seed) ক্ষেত্রেও একই রূপ চিত্র দেখা যায়, এক্ষেত্রেও প্রোটিন মাত্রা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে (Li et al., 2018) প্রত্যেকটি অ্যামিনো অ্যাসিডের দিকে দেখলে দেখা যাবে ফার্মেন্টেড সয়াবিনের ন্যায় ফার্মেন্টেড কুইনোয়া বীজেতেও অ্যামিনো অ্যাসিডগুলির অনেকেরই মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র প্রোটিন বা অ্যামিনো অ্যাসিড নয়, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যৌগের পরিমান বাড়ে। উদাহরণ হিসেবে, ফার্মেন্টেড সয়াবিনে বিটা-ক্যারোটিনের (β-carotene) পরিমান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ফার্মেন্টেড কুইনোয়া বীজেতে ভিটামিন B, এবং B২ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় (Li et al., 2020) ফার্মেন্টেশনের সময়ের সাথে ফেনোলিক যৌগগুলির (Phenolic compounds) পরিমাণও কিন্তু বাড়তে দেখা যায় (Li et al., 2018; 2020) আবার অপরপক্ষে কিছু পদার্থের পরিমান হ্রাস পায়। যেমন ফাইবারের পরিমান হ্রাস পায় কারণ ব্যাক্টেরিয়াগুলিতে সেলুলোজ বা হেমি-সেলুলোজ ভঙ্গকারী উৎসেচকের উপস্থিতি (Li et al., 2018; 2020) সয়াবিন যে অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্ট (Anti-nutrient) ট্রিপসিন ইনহিবিটর (Trypsin inhibitor) ধারণ করে, ফার্মেন্টেশনের ফলে তা হ্রাস পেয়ে থাকে (Li et al., 2020)

খাদ্যবস্তুর ফার্মেন্টেশনের জন্যে প্রধানত স্যাকারোমাইসিস (Saccharomyces) গণের ছত্রাক (Leo et al., 2021), বিফিডোব্যাক্টেরিয়াম (Bifidobacterium) এবং ল্যাক্টোব্যাসিলাস (Lactobacillus) গণের ব্যাকটেরিয়া বহুল ব্যবহৃত, এদের একাধিক প্রজাতি রয়েছে (Gomes and Malcata, 1999) পূর্বেই উল্লেখ করেছি এই সকল ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীবের শরীরে উপস্থিত বিভিন্ন উৎসেচকের সাহায্যে। আমরা যদি অণুজীবের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে এই বিষয়ে বোঝা সম্ভব, আমরা দেখবো এমন অনেক জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া তাদের দেহে উপস্থিত  যা মানুষের দেহে অনুপিস্থিত। কাজেই তারা এমন অনেক যৌগ তৈরী করতে পারে যা মানুষের প্রয়োজনীয় হলেও মানুষ তা সংশ্লেষ করতে পারে না। একটি সহজ ধারণা দেওয়ার জন্যে আমি এটি উল্লেখ করলাম তবে বিশদে বলে ব্লগটিকে ভারাক্রান্ত করবো না। আশা করি ফার্মেন্টেড খাদ্য সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত সরল ধারণা দিতে পারলাম।

তথ্যসূত্র (References):

Gilliland, S.E. 1990. Health and nutritional benefits from lactic acid bacteria. FEMS Microbiology Reviews 87: 175-188.

Gomes, A.M.P.; Malcata, F.X. 1999. Bifidobacterium spp. and Lactobacillus acidophilus: biological, biochemical, technological and therapeutical properties relevant for use as probiotics. Trends in Food Science and Technology 10: 139-157.

Leo, V.V. et al., 2021. Saccharomyces and their potential applications in food and food processing industries. In: Abdel-Azeem, A.M.; Yadav, A.N.; Yadav, N.; Usmani, Z. (Eds.), Industrially Important Fungi for Sustainable Development. Fungal Biology. Springer, Cham. https://doi.org/10.1007/978-3-030-67561-5_12 

Li, S.; Chen, C.; Ji, Y.; Lin, J.; Chen, X.; Qi, B. 2018. Improvement of nutritional value, bioactivity and volatile constituents of quinoa seeds by fermentation with Lactobacillus casei. Journal of Cereal Science 84: 83-89. https://doi.org/10.1016/j.jcs.2018.10.008

Li, S.; Jin, Z.; Hu, D.; Yang, W.; Yan, Y.; Nie, X.; Lin, J.; Zhang, Q.; Gai, D.; Ki, X.; Chen, X. 2020. Effect of solid-state fermentation with Lactobacillus casei on the nutritional value, isoflavones, phenolic acids and antioxidant activity of whole soybean flour. LWT 125: 109264. https://doi.org/10.1016/j.lwt.2020.109264

Patra, J.K.; Das, G.; Paramithiotis, S.; Shin, H-S. 2016. Kimchi and other widely consumed traditional fermented foods of Korea: A review. Frontiers in Microbiology 7: 3389. https://doi.org/10.3389/fmicb.2016.01493

Prajapati, J.B.; Nair, B.M. 2017. The history of fermented foods. Handbook of Fermented Functional Foods, edited by Farnworth E.R. 2nd Edition, CRC Press, pp. 1-22.

RockEDU. History and Biochemistry of Fermented Foods. www.rockedu.rockfeller.edu/component/biochemistry-fermented-foods/ accessed 21st January 2023.


সোবেকসান ট্রেক (Sobaeksan trek)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আমি যে খুব ট্রেকিং প্রিয় মানুষ তা নয়, তবে বিগত কয়েক বৎসর ধরে, মানে আমার দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাসের সময়কালের মধ্যে, বৎসরান্তে একবার গবেষণাগারের সকলের সাথে আমি কোনো না কোনো পর্বতে হাইকিং করতে যাই। করোনা মহামারীর পূর্বে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গিয়েছিলাম সোবেকসানে (সোবেক পর্বতে, কোরিয়ান 'সান' শব্দটির অর্থ পর্বত), আবার ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসেও আমরা গিয়েছিলাম ওই পর্বতে। তবে পার্থক্য ছিল সেবার যাওয়া-আসার পথটি এবার আসা-যাওয়ার পথ ছিল, অর্থাৎ সেবার যে পথে পর্বতের শিখরে পৌঁছেছিলাম এবার সে পথে শিখর থেকে নিচে নেমেছিলাম, আর যে পথে সেবার নেমেছিলাম এবার সে পথে উঠেছিলাম। এবার এই স্থান সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক। প্রায় ৩২২.৪ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে গড়ে ওঠা সোবেক পর্বত দক্ষিণ কোরিয়ার একটি জাতীয় উদ্যান। জিরিসান (Jirisan) এবং সিওরাকসানের (Seoraksan) পর এটি তৃতীয় পর্বতীয় জাতীয় উদ্যান (আমি পূর্বে একটি ব্লগে বিভিন্ন প্রকার জঙ্গল বা বনভূমি নিয়ে আলোচনা করেছি)। অন্যান্য পর্বতের ন্যায় এই পর্বতেরও একাধিক শিখর রয়েছে, যেমন বিরবং (Birobong-1,439.5 মিটার), গুঙ্গমংবং (Gungmangbong-1,420.8 মিটার), ইয়নহুয়াবং (Yeonhwabong-1,383 মিটার), দশলবং (Dosolbong-1,314.2 মিটার)। এই পর্বতীয় জাতীয় উদ্যানটি তিনটি প্রদেশের যথা গিয়ংসাংবুক (Yeongju/ ইয়ংজু শহর), চুংছেওংবুক (Danyang/ দানিয়াং শহর), এবং গ্যাংওয়ান (Yeongwol/ ইয়ংওল শহর) সীমানা স্পর্শ করে বিস্তৃত রয়েছে। ইয়ংজু শহরের সন্নিকটের উপত্যকাগুলির মধ্য দিয়ে নাকদংগাং (নাকদং নদী, কোরিয়ান শব্দ 'গাং' শব্দটির অর্থ নদী), এবং দানিয়াং শহরের সন্নিকটের উপত্যকাগুলির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে নামহাংগাং বা নামহাং নদী। এই জাতীয় উদ্যানটিতে রয়েছে প্রায় ১০৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ এনং ২৬৩৯ প্রজাতির প্রাণী। তবে অধিক ঠান্ডার কারণে আমি যাত্রাপথে কোনো প্রাণী দেখতে পাইনি। ২০০৭ সালে IUCN ইকোলজিকাল ভ্যালু (Ecological value) বা পরিবেশগত গুরুত্ব বিচার করে সোবেকসানকে IUCN ক্যাটেগোরি-II জাতীয় উদ্যান হিসেবে চিহ্নিত করে।

সোবেকসানের সর্বোচ্চ শিখর বিরবং, উচ্চতা ১৪৩৯ মিটার। যাঁরা আমাদের দেশে পর্বত ট্রেক বা হাইকিং করে থাকেন এ উচ্চতা তাঁদের নিকট নেহাৎই যৎসামান্য, তবে নাতিশীতোষ্ণ (Temperate) অঞ্চলে যে ভৌগোলিক অবস্থানে এই পর্বতটি অবস্থিত সে স্থানে ডিসেম্বর মাসে তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আসে পাশে থাকে, কাজেই বেশ ঠান্ডা। পূর্বের বৎসরটিতে (২০১৯ সালে) আমরা আগের দিন দুপুরে পর্বতের পাদদেশ থেকে রওনা হয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা ট্রেক করে আশ্রয়স্থলে পৌঁছেছিলাম, প্রচন্ড তুষারপাত হওয়ার কারণে সেই রাত্রি আমরা আশ্রয় স্থানে অতিবাহিত করে পরদিন ভোর সাড়ে ৪ টে নাগাদ রওনা হয়ে সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বে পর্বত শিখরে পৌঁছই। 

যেহেতু আমি খুব একটা ট্রেক করিনা, কাজেই সকল ট্রেক কিট বিশেষ করে রান্নার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমার ছিল না। আমরা খাবার, জল ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই উঠেছিলাম, সকলে এই সকল দ্রব্যাদি ভাগ করে নিয়েছিলাম যেন কারও লাগেজ অধিক ভারী না হয়। আশ্রয়স্থলের একদিকে রান্না আর খাওয়ার জন্যে ঘর ছিল। সেখানে সকলে নিজের স্টোভ, পাত্র সব নিয়েই গিয়েছিলো, যে যার খাবার বানিয়ে নিচ্ছিলো। আমাকে স্বাভাবিক কারণেই অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল, যেটা খুব একটা উপভোগ্য ছিল না। বাইরের দেশে স্বনির্ভর হওয়াটাই কাম্য। এখানে একটা কথা উল্লেখ্য যে, পরদিন ভোরে আমরা যখন রওনা হয়েছিলাম সেই স্থান পরিষ্কার করে সকল আবর্জনা আমরা সাথে নিয়ে নিয়েছিলাম, সেই স্থানে কিছুই ফেলে আসিনি। 

সেই অসামান্য আর অনবদ্য সূর্যোদয়ের রূপ বর্ণনা করার শব্দ আমার কাছে নেই। এই প্রত্যুষ মনে এক নব আনন্দের দিগন্ত উন্মোচন করে, মেঘের মধ্যে দাঁড়িয়ে সূর্যের নরম সোনালী আভা যখন দিক থেকে দিকান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে সেই মনোমুগ্ধকর চিত্রকে অনুধাবন করে প্রকৃতি মাতাকে প্রণাম করি। 

এবার (২০২২ সালে) কিন্তু আমরা সূর্যোদয় দেখিনি, আমরা পর্বতের পাদদেশ থেকে আমরা রওনা হয়েছিলাম ভোর ৫ টেতে, কাজেই শীর্ষদেশে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে ৮ টা বেজে যায়।

আমরা পূর্বের দিনটি ইয়ংজু শহরে একটি পেনশন-এ অতিবাহিত করি। এই শহরের ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সেমিনার শেষ হতে দেরি হওয়ায় সেই দিন আমরা রওনা হতে পারিনি। কাজেই পরদিন ভোরবেলা প্রায় চারটের সময়ে প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যখন পর্বতের পাদদেশে এসে পৌঁছয় তখন প্রায় ভোর পৌনে ৫ টা। ট্রেকিং উপযোগী পোশাক পরিহিত হয়ে যখন যাত্রা শুরু হলো তখন ৫ টা বাজে।

শুরুর রাস্তা বেশ খাড়াই, প্রথম ৪০ মিনিট বেশ ভালোই বেগ পেতে হয়। এ পথে এই সময়ে শুরু থেকেই আইস ক্লেট লাগিয়ে নেওয়া, পায়ে বটম গার্ড পরে নেওয়া উচিত, আমিও তাই করেছিলাম। তবে আমার সাথে কোনো ট্রেকিং পোল ছিল না, সেটা বেশ মুশকিলের। কিন্তু একটা শক্ত পোক্ত গাছের লম্বা ডাল পেয়ে গেলাম, হয়তো ফিরতি পথে কেউ ফেলে গিয়েছিলো। এই ঠান্ডায় আর্দ্রতার লেশ মাত্র নেই, কাজেই গাছের ডাল গুলি খুবই শুষ্ক ও ভঙ্গুর কিন্তু আমার লাঠিটি বেশ শক্তই ছিল এবং এতে আমার বেশ সুবিধা হয়েছিল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক রুট করা রয়েছে। হাঁফাতে হাঁফাতে চলেছি সেই পথে, চারিদিক খুব অন্ধকার। 

অত্যাধিক ঠান্ডায় একটা সুবিধা হলো কোনো প্রকার জীবজন্তু এই সময় খুব একটা এসে পরে না। আমার কাছে কোনো টর্চ ছিল না, তবে কয়েকজন সাথীর সাথে তা ছিল। বরফ প্রায় ফুট খানেক হবে এবং স্থানে স্থানে তা আরও বেশি। আমি প্রচন্ড ক্লান্ত পড়েছিলাম প্রথম ঘন্টায়, কাজেই পথের পাশে বসে পড়েছিলাম, কয়েক মিনিটের বিশ্রাম আবার পথ চলা। একটা ছোট মোনোপড আমি নিয়ে গিয়েছিলাম, তবে তা সেট করে ছবি তুলতে দস্তানার মধ্যে থেকে হাত বের করতেই ঠান্ডায় অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হচ্ছিলো (দস্তানার ভিতর থেকে আমার আঙ্গুল ফোনের ক্যামেরা সেট করতে ঠিক করে কাজ করছিলো না), কাজেই ফটো তোলা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছিলো অন্ধকারে, বরং আলো ফুটলে তা কিছুটা সহজ হলো। এই জঙ্গলে ডেসিডুয়াস উদ্ভিদের প্রাধান্য চোখে পড়ার মতন, শীতে তাদের সকল পাতা ঝরে গেছে, তারা পত্রশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে স্থানে স্থানে কনিফেরাস উদ্ভিদও রয়েছে, তাদের পত্রগুলি সূঁচের ন্যায় অভিযোজিত হওয়ায়, পরিধি কম হওয়ায় তা থেকে সমস্ত জল বেরিয়ে যায়নি ফলে সেগুলি শুষ্ক হয়ে যায়নি। এবার ধীরে ধীরে স্বর্ণাভ আভা ছড়িয়ে পড়ছে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করলাম। গাছের ডালের মধ্যে দিয়ে কমলা বর্ণের সূর্য। 

চলা, কখনও একটু বিশ্রাম, ছবি তোলা, আবার চলা। হঠাৎ চোখে পড়লো অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অব্জার্ভেটরি, নতুন উদ্যম এলো, এ পথ আমার জানা, এর পর আর সামান্য পথ অতিক্রম করলেই শিখরে পৌঁছবো আমরা। প্রায় চার ঘন্টা ট্রেক করে আমরা পৌঁছলাম শীর্ষে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য। তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের থেকেও কম। এবার কিছুটা জল খেয়ে বেশ ফিট লাগলো।


কিছুক্ষন কাটিয়ে ফেরার রাস্তা ধরা।  ফেরার পথ চওড়া, তবে প্রায় দেড় থেকে দুই ফুট বরফে ঢাকা। ফেরার পথ ঢালু তবে তা কিন্তু খুব সহজ নয়, ঢালু পথে চলতে বেশ চাপ পরে, আর খেয়াল রাখতে হয় পিছলে যেন না পড়ি, তাহলেই বড়ো মুশকিল। 



যখন প্রান্তদেশে এসে পৌঁছলাম তখন প্রায় বেল বারোটা বাজে। এবারের মতন বিদায় সোবেকসান।  সবাই খুব ক্লান্ত, এবার দ্বিপ্রাহরিক আহার সারতে হবে আর তারপর বাড়ি ফেরা। 


ডিসেম্বর ২০১৯, ডিসেম্বর ২০২২



বন্য প্রাণীর গুরুত্ব (Importance of wildlife)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


পূর্বে একটি ব্লগে আমি বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের সংরক্ষিত স্থান, বিভিন্ন প্রকারের জঙ্গলের বিষয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আজ আলোচনা করবো এই জঙ্গলের বন্য প্রাণ নিয়ে। একসময় কত রাজা মহারাজার শিকারের গল্প পড়ে বা শুনে আমরা শিহরিত হয়েছি, কিন্তু এই শিকার আজ অতীত। পিছনের কয়েক দশকে মানুষ বন্য প্রাণীর গুরুত্বের কথা বুঝেছে তাই শিকার আজ বন্ধ হয়েছে। তবে মাঝে মাঝেই সংবাদ পত্রে বিভিন্ন চোরা শিকারের কথা কিংবা বন্য প্রাণী আটক হওয়ার কথা জানতে পারি, ভেবে দুঃখ পাই কিভাবে জীবগুলিকে অনৈতিক এবং অমানবিক ভাবে হত্যা করা হয়েছে বা হচ্ছে ! এই প্রকার বন্যপ্রাণী হত্যা আটকানোর জন্যে সরকার বাহাদুর নানান আইন প্রণয়ন করেছেন, বনবিভাগ সদা সর্বদা সজাগ রয়েছে এ ধরণের ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্যে। এর পাশাপাশি আরও নানান ভাবে কিন্তু বনের ক্ষতি হতে পারে বা হচ্ছে। যেমন, বনভূমি কেটে ফেলে, সেখানে মানুষের বসতি, কল কারখানা, ইত্যাদি গড়ে বা বনভূমিকে কৃষিভূমিতে পরিণত করলেও কিন্তু তা বনের ক্ষতিসাধন করে। আবার পরিবেশ বদলের প্রতিফলনও বনের উপর পড়ছে। আমরা জানি বন্য প্রাণী বা উদ্ভিদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বাস্তুতন্ত্রে তারা কত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এবং তারা বিলুপ্ত হয়ে গেলে মনুষ্য সমাজেও কিন্তু দুর্ভোগ নেমে আসবে, তা বলাই বাহুল্য। আজ আমাদের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় এটি, বন্য প্রাণীর গুরুত্ব।  

ইকোলজি (Ecology) বা বাস্তুশাস্ত্রের যে শাখা জীব বৈচিত্র নিয়ে অধ্যয়ন করে তা কমিউনিটি ইকোলজি (Community ecology) নামে পরিচিত। কোনো একটি ভৌগোলিক স্থান জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর (যেমন ট্রপিক্যাল চিরহরিৎ রেন ফরেস্ট) আবার কোনো স্থান জীব বৈচিত্র্যে তুলনামূলকভাবে দৈন (যেমন বোরিয়াল ফরেস্ট)। এর আবহাওয়া-জলবায়ু জনিত, বাস্তুতন্ত্র জনিত অনেক কারণ বর্তমান এবং তা সহজেই বোধ্য। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে মানুষ ধীরে ধীরে লক্ষ্য করলো যে বেশ কিছু প্রাণী অবলুপ্ত হয়ে গেছে বা যাচ্ছে এবং এ যদি অনবরত ঘটতে থাকে তবে তা মনুষ্য সমাজকে বিপর্যস্ত করবে। একটি বাস্তুতন্ত্রে অনেক জীব এবং উদ্ভিদ থাকে, তারা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল (সবাই তো খাদ্য শৃঙ্খল, খাদ্য জাল (Food chain, Food web), বাস্তুতন্ত্রের পিরামিড যেমন এনার্জি পিরামিড (Energy pyramid), বায়োমাস পিরামিড (Biomass pyramid) ইত্যাদি বিষয়ে জানে), একটির অবলুপ্তি অন্য একটির অবলুপ্তিকে ডেকে আনতে পারে, এইভাবে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রটির (এক্ষেত্রে যেমন জঙ্গল) বিপর্যয় ঘটতে পারে। এখন মানুষ সকল প্রাণীর থেকে সরাসরি উপকৃত হয় এমন নয়, তবে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের থেকে তো উপকৃত হয়। একটু সহজ করে বলি, একটি জঙ্গল অনেক প্রাণী যেমন পোকা-মাকড়, মোলাস্কা, সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী ইত্যাদির এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের বাসস্থান। মানুষ এদের প্রত্যেকের থেকে স্বতন্ত্রভাবে সরাসরি উপকৃত (মৌমাছি মধু প্রস্তুত করে, পরাগ বাহক পতঙ্গরা পরাগযোগে সাহায্য করে এবং তার ফলে ফুল-ফল-শস্য উৎপাদন হয়, ঔষধি গাছের রোগ নিরাময়ক ক্ষমতার জন্যে সংগৃহিত হয়, গাছের ফল-ফুল-পাতা, এগুলি সরাসরি উপকারের কয়েকটি উদাহরণ) নাও হতে পারে, তবে জঙ্গল সার্বিকভাবে কার্বন-ডাই -অক্সাইডকে শোষণ করে, মাটির উর্বরতাকে রক্ষা করে, জল ধরে রেখে, মাটির ক্ষয় প্রতিরোধ করে, বন্যা প্রতিরোধ করে, ইত্যাদিতে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করে, যেগুলি মানব সভ্যতাকে সাহায্য করে। কাজেই বোঝা গেলো বন্য জীবের অবলুপ্তিতে জঙ্গল বাস্তুতন্ত্রটির অবলুপ্তি আর তার ফলশ্রুতিতে মানব সভ্যতার উপর বিপর্যয় নেমে আসতে পারেকাজেই জঙ্গলকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। এর অর্থ বন্য প্রাণী এবং উদ্ভিদকে রক্ষা করতে হবে। আর রক্ষা করতে হলে এদের সম্বন্ধে আমাদের প্রথমে অবগত হতে হবে। এখন ছোট বড়ো আকারে এতো প্রাণী, এতো উদ্ভিদ, সকলের সম্বন্ধে জানব কিরূপে? একটি বাস্তুতন্ত্রে এতো জৈব উপাদান (প্রাণী, উদ্ভিদ, শৈবাল, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস), সকলের গুরুত্ব কি এক ! না কি কেউ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কেউ তুলনামূলকভাবে কম ! এ এক বিরাট প্রশ্ন আবির্ভূত হলো মানুষের সামনে।

প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হলো। প্রথম ধাপ হলো পর্যবেক্ষণ। বিংশ শতকের ষাটের দশকে চার্লস এলটন (Charles Elton) প্রস্তাব করলেন যে জীব বৈচিত্র্য (প্রজাতির সংখ্যা) আর স্থায়িত্ব (যা বৈচিত্র্য-স্থায়িত্ব প্রকল্প (Diversity-Stability hypothesis) নামে পরিচিত) একটি সরলরৈখিক (সমানুপাতিক) সম্পর্ক মেনে চলে। অর্থাৎ একটি কমিউনিটিতে যত বেশি প্রজাতি, তত বেশি স্থায়িত্ব। ব্যাপারটা বোঝা গেলো। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেলো ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রাণী অবলুপ্ত হয়েছে কিন্তু তাদের বাসস্থান যে বাস্তুতন্ত্রে সেগুলি কিন্তু টিঁকে আছে, অবলুপ্তি ঘটেনি। কাজেই তবে কি সকলে বাস্তুতন্ত্রে সকলে সমান ভূমিকা পালন করছে? এবার একটা নতুন তত্ত্ব এলো, নব্বইয়ের দশকের প্রথমভাগে পল (Paul) এবং অরলিখ (Anne Ehrlich) রিভেট প্রকল্পের (Rivet hypothesis) অবতারণা করলেন। রিভেট (Rivet) কথার অর্থ ছোট পিন যা দিয়ে ধাতুর প্লেট আটকানো থাকে। একটি বাস্তুতন্ত্র এরূপ অনেকগুলি ধাতুর প্লেট দিয়ে নির্মিত আর এই রিভেটগুলি দিয়ে একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের সাথে যুক্ত রাখে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী জীব বৈচিত্র্য অনেকটা রিভেটের মতন, প্রত্যেকেই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখন একটি রিভেট যদি নষ্ট হয়ে যায় বা তবে তার সাথে যুক্ত প্লেটগুলি কিন্তু নড়বড় হয়ে যায়, অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্রে একটু অসুবিধা হয়, কিন্তু বাস্তুতন্ত্রটি সেটা মানিয়ে নেয়, কয়েকটি রিভেটের ক্ষতি হলেও অনেকসময় বাস্তুতন্ত্রটি হয়তো মানিয়ে নিতে সমর্থ হয় তবে তার বেশি রিভেটের ক্ষতি হলে কিন্তু বাস্তুতন্ত্রটির পক্ষে সেটা মানিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হয়না। পরবর্তী দশকে ব্রায়ান ওয়াকার (Brian Walker)  রিডানডেন্সি প্রকল্পের (Redundancy hypothesis) অবতারণা করলেন। এটি বোঝা কিন্তু একটু সহজ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো একটি বাস্তুতন্ত্রে অনেক জীবের মধ্যে সকলের ভূমিকা এক নয়। যেমন ধরো জাহাজ বা উড়োজাহাজ একটি বাস্তুতন্ত্র, এখানে পাইলট বা নাবিকের ভূমিকা, জাহাজ এটেন্ডেন্টদের ভূমিকা, যাত্রীদের ভূমিকা আলাদা আলাদা। এবার বোঝা যাচ্ছে, যে এই বাস্তুতন্ত্রে, মানে জাহাজ চালানোতেনাবিকের ভূমিকা অনেক বেশি। এছাড়াও আর একটি প্রকল্প রয়েছে যা ইডিওসিনক্রেটিক প্রকল্প (Idiosyncratic hypothesis) নামে পরিচিত (তবে এ ব্যাপারে এখানে বলে ব্লগটিকে অধিক দীর্ঘ করবো না)

কাজেই বোঝা যাচ্ছে একটি বাস্তুতন্ত্রের সকল প্রজাতির ভূমিকা আলাদা। এবার গুরুত্বের বিচারে প্রজাতিগুলিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। প্রথমেই আসি এক ধরণের প্রজাতির দিকে যাদের কীস্টোন প্রজাতি (Keystone species) বলা হয়। আমরা যখন বিভিন্ন জঙ্গল বেড়াতে যাই তখন এরূপ কীস্টোন প্রজাতির দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করি। যেমন লঞ্চে করে সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া হয় তখন বাঘ দেখতে পেলে আনন্দের সীমা থাকে না, মনে হয় বেড়ানোটা সার্থক হলো। আবার গুজরাতের গির অরণ্যে গিয়ে সিংহ, আসামের কাজিরাঙা অভয়ারণ্যে গিয়ে গন্ডার, পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া বা গরুমারাতে হাতি বা গন্ডার দর্শন প্রধান লক্ষ্য বা আকর্ষণ হয়ে থাকে। কীস্টোন প্রজাতি একটি সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করে, এর অর্থ, বাস্তুতন্ত্রটি ওই প্রজাতির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং কীস্টোন প্রজাতি ব্যতীত বাস্তুতন্ত্রটি উল্লেখযোগ্য ভিন্ন হবে বা সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। এই সকল কীস্টোন প্রজাতির উপর বাস্তুতন্ত্রটি বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল। কীস্টোন প্রজাতি কিন্ত সাধারণভাবে তিন প্রকার হয়ে থাকে। যেমন শিকারী (Predator) প্রজাতি, মিউচুয়ালিস্ট বা পারস্পরিক উপকারপ্রাপ্ত প্রজাতি (Mutualist) প্রজাতি এবং ইকোলজিকাল ইঞ্জিনিয়ার (Ecological engineer) যেমন বাঘ একটি শীর্ষ শিকারী (Apex pyramid) প্রাণী, এনার্জি বা খাদ্য পিরামিডের উপরিভাগে অবস্থান করে, এর উপর নির্ভর করে ওই জঙ্গলের শিকারের (যেমন হরিণের) সংখ্যা, এবং সম্পর্কিত বাস্তুতন্ত্র। এনার্জি পিরামিডের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাস্তুতন্ত্রে যথাক্রমে প্রথমে ডিকম্পোজার (Decomposer, যারা পচনে সাহায্য করে), এর উপরে প্রোডিউসার বা অটোট্রফ (Producer-Autotroph, যারা সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য নিজেরা প্রস্তুত করতে পারে যেমন উদ্ভিদ), এর উপর প্রাইমারি কনসিউমার (Primary consumer, যারা প্রোডিউসারকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যেমন তৃণভোজী প্রাণী হরিণ ইত্যাদি), এর উপর সেকেন্ডারি কনসিউমার (Secondary consumer, যারা প্রাইমারি কনসিউমারকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে যেমন মাংসাশী প্রাণী), এর উপর টার্শিয়ারি কনসিউমার (Tertiary consumer, যারা অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে), এবং সবথেকে উপরে শীর্ষ শিকারী (Apex predator, যারা প্রাইমারি, সেকেন্ডারি বা টার্শিয়ারি কনসিউমারকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, যেমন বাঘ, সিংহ, ঈগল, হাঙ্গর) কাজেই বোঝা গেলো কোনো একটি বাস্তুতন্ত্র একেবারে শীর্ষ শিকারীর উপর নির্ভর করে। আবার গন্ডার বা হাতি ইকোলজিকাল ইঞ্জিনিয়ারের উদাহরণ, এরা নরম মাটিতে গর্ত করে, তাতে  জল জমে এবং সেগুলি অন্যান্য জীবের জন্যে পানীয় জলের উৎস হয়, হাতি গাছ বা গাছের ডাল ভেঙে বাস্তুতন্ত্রকে রূপ প্রদান করে, এইভাবে বাস্তুতন্ত্রটি এই প্রজাতির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। আবার মিউচুয়ালিস্ট-র প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মৌমাছিরা, এরা ফুল থেকে নেক্টর, পরাগ সংগ্রহ করে এবং উদ্ভিদের পরাগসংযোগে সাহায্য করে। যাইহোক, জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র বোঝাতে অনেকটা বিষয়ভিত্তিক (যদিও প্রাথমিক) আলোচনা করে ফেললাম। তবে আরও কয়েকটি প্রজাতির কথা না বললেই নয়। যেমন আমব্রেলা প্রজাতি (Umbrella species, এই প্রজাতিরা অনেকটা কীস্টোন প্রজাতির মতোই, তবেএরা একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত থাকে, যেমন সাইবেরিয়ান বাঘ), ফাউন্ডেশন প্রজাতি (Foundation species, এদের মধ্যেই রয়েছে ইকোলজিকাল ইঞ্জিনিয়াররা যার উল্লেখ আমি আগেই করেছি এই প্রজাতিরা বাসস্থান গড়ে তুলতে বা তাকে বজায় রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করে, যেমন কোরাল (Coral) যা আন্দামানের কোরাল রিফ (Coral reef) গঠন করেছে), ইনডিকেটর প্রজাতি (Indicator species, এই সকল প্রজাতির বৃদ্ধি বা হ্রাস বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশগত (দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি) পরিবর্তনের সূচনা দেয়, যেমন মেফ্লাই (Mayfly)-এর হ্রাস পাওয়া জলাশয়ের দূষণকে চিহ্নিত করে, মোনার্ক বাটারফ্লাই (Monarch butterfly)-এর হ্রাস পাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের, আবার লাইকেনের (Lichen) হ্রাস পাওয়া বাতাসের গুণমানের হ্রাস পাওয়াকে চিহ্নিত করে), ফ্ল্যাগশিপ প্রজাতি (Flagship species, এই প্রজাতিরা একটি অঞ্চলের সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে মাসকটের মতন রিপ্রেজেন্ট করে, অনেক সময় এরা পরিবেশ বা সংরক্ষণের বিভিন্ন ক্যাম্পেন বা আলোচনার প্রতীক হিবেসেও বিবেচিত হয়, যেমন জায়েন্ট পান্ডা)  

স্বাভাবিকভাবেই এই সকল প্রজাতির, যাদের উপর একটা বাস্তুতন্ত্র উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভরশীল, উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, এদের সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয় যাতে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রটিকে সংরক্ষণ করা যায়। সাস্টেনেবেল ট্যুরিজম কিন্ত ওয়াইল্ড লাইফ এবং জীব বৈচিত্র্যের উপকার করে থাকে। তবে সে বিষয়ে বিশদে অন্য কখনও আলোচনা করবো। আপাতত এই পর্যন্ত।

বিশদে জানার জন্যে References:

Stiling, P. 2002. Ecology Theories and Application. Fourth Edition, Prentice Hall, NJ, USA.

Higginbottom, K. (Ed.) 2004. Wildlife Tourism Impacts, Management and Planning. Common Ground, CRC for Sustainable Tourism, Australia.

Cottee-Jones, H.E.W.; Whittaker, R.J. 2012. The keystone species concept: a critical appraisal. Frontiers of Biogeography 4(3): 117- 127. https://doi.org/10.21425/F5FBG12533 

Hale, S.L.; Koprowski, J.L. 2018. Ecosystem-level effects of keystone species reintroduction: a literature review. Restoration Ecology. https://doi.org/10.1111/rec.12684 


রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...