সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
কাঁকড়া বাঙালির কাছে বরাবরই উপাদেয় খাদ্যবস্তু হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। সমকালীন সাহিত্যেও উঠে এসেছে কাঁকড়ার কথা। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অনতিকালের মধ্যে আসে ভয়াবহ বন্যা। বাংলার মানুষ, বিশেষত নিম্নবিত্ত মানুষ, আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পরে। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলশ্রুতিতে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, যা তেতাল্লিশের (১৯৪৩) বাংলার মন্বন্তর নামে পরিচিত। জগডুমুর সেদ্ধ, কচুর লতির ঝোলের মাধ্যমে ক্ষুধা নিবৃত্তি, বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটকের চরিত্র মাখন যখন এই সকল খাদ্যের বিরূদ্ধে তীব্র অনীহা প্রকাশ করে, বিনোদিনী ঝাঁজিয়ে উঠেন মাখনের উদ্দেশ্যে, বলেন সে ভালো মন্দ কিছু খুঁজে আনলেই পারে, ঠিক তখন প্রধান সমাদ্দার কিছু কাঁকড়া সংগ্রহ করে নিয়ে প্রবেশ করেন। কাঁকড়া বেশ ভালো অর্থাৎ উপাদেয় বলেই গণ্য হয়েছিল চরিত্রগুলির কাছে। তবে কোনো যাত্রার প্রাক্কালে কাঁকড়া দর্শন কিন্তু আবার অলুক্ষণে চিহ্ন বলে বিবেচনা করা হয়। সমরেশ বসুর উপন্যাস 'গঙ্গা'-তে দেখি নিবারণ আর পাঁচু মাছ ধরতে যাওয়ার পূর্বে কচ্ছপ দেখে বেশ সন্দিহান হয়ে পড়েছিল; কচ্ছপ, কাঁকড়া আর কলা, এই তিন বস্তু অলুক্ষণে চিহ্ন বলেই মনে করা হয়। কেন তা আমার অজানা।
কাঁকড়া (Crab) অনেকের পছন্দ হলেও ছাড়ানো বেশ কঠিন বলে খাওয়া হয়ে ওঠে না। বেশ কয়েক বৎসর পূর্বে তাজপুর সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে কাঁকড়া খেয়েছিলাম, তবে তা খুব সুস্বাদু ছিল এমনটা বলা যায়না। আবার ইয়ংদক ক্র্যাব ভিলেজের (Yeongdeok crab village) বাজারে অনেক প্রকার কাঁকড়া দেখে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করলেও রেস্তোরাঁতে এক একটি কাঁকড়ার দাম ছিল প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার, কাজেই তা দিয়ে রসনা তৃপ্ত করা আমার সাধ্যের অতীত ছিল। কাজেই বাজার থেকে কিনে বাড়িতে এনে রান্না করে কাঁকড়া খাওয়া, এটিই হলো সহজ পথ। আমাদের দেশে নানান প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২০টি প্রজাতির কাঁকড়া খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।এদের মধ্যে রয়েছে Scylla serrata, S. tranquebarica (এদের মূলত ম্যানগ্রোভ, খাড়ি বা নোনাজলের ভেড়িতে পাওয়া যায় বা চাষ করা হয়), Protonus pelagicus, P. sanguinolentus, P. argentatus, P. latipes, Charybdis feriata, C. helleri, C. affinis, C. lucifera, C. quadrimaculata, C. acutifrons (এদের সাধারণত কর্দমাক্ত অঞ্চলে কাদার নিচে পাওয়া যায়), Varuna litterata (মিঠা জলের পুকুর, নোনা জলাশয়, খাড়ি সকল স্থানেই এরা বাস করে), Episesarma mederi, Muradium tetragonum (কাদা অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়), Sartoriana spinigera, Spiralothelphusa hydroma (বিল, বাওর, মিঠা জলের পুকুর ইত্যাদিতে পাওয়া যায়), Diogenes miles, Matuta planipes, M. lunaris (সমুদ্র উপকূলে বেলে অঞ্চলে পাওয়া যায়)। আবার বেশ কয়েক প্রজাতির কাঁকড়া, যেমন Charybdis rostrata, C. orientalis, C. helleri ইত্যাদি মাছের খাদ্য (Fishmeal) প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
প্রতিটি প্রজাতির কাঁকড়া দেখতে একটু আলাদা হলেও তাদের মূল গঠন একই রকমের। দক্ষিণ কোরিয়াতেও ভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের কাঁকড়ার মধ্যে কিং ক্র্যাব (King crab), স্নো ক্র্যাব (Snow crab), নীল কাঁকড়া (Blue crab), লাল কাঁকড়া (Red crab) উল্লেখযোগ্য।
আমি বাজার থেকে নীল কাঁকড়া কিনে এনেছিলাম, এটি হিমায়িত (Frozen) অবস্থায় ছিল। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাজারে টাটকা কাঁকড়া পাওয়া যায়। সেটি কিনে এনে ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে (গায়ে শ্যাওলা থাকলে তা ঘষে তুলে দিতে হবে) নিতে হবে। এবার কাঁকড়াগুলিকে ঘন্টা খানেক রেফ্রিজারেটরের শূণ্য (০) ডিগ্রী তাপমাত্রায় রেখে দিলেই এরা নিস্তেজ হয়ে মরে যাবে, অন্যথায় গরমজলে একটু ফুটিয়ে নিলেও হবে। এবার কাটাকাটি করতে সুবিধা হবে। অন্যথায় জীবন্ত অবস্থায় কাটতে গেলে কাঁকড়াটিও যন্ত্রণাভোগ করবে আবার যিনি কাটবেন তিনিও আহত হতে পারেন।
কাঁকড়া একটি খোলার (Exoskeleton) আবরণে থাকে, এই খোলাটি ছাড়িয়ে তবে তা রেঁধে খাওয়ার উপযোগী হয়। এই খোলাটি কাইটিনের (Chitin) সাথে বেশ কিছু খনিজ পদার্থ মিলিত (Mineralized) হয়ে সৃষ্টি হয়। তবে যতটা শক্ত বলে মনে হয় সেটা ততটা শক্ত নয়। জীবজগতে কাঁকড়ার স্থান লক্ষ্য করলে দেখা যায় এটি আর্থ্রোপোড (Arthropod/সন্ধিপদ) পর্বের ক্রাস্টেশিয়া (Crustacea) উপ-পর্বের (Subphylum) অন্তর্গত ম্যালাকোস্ট্রাকা (Class- Malacostraca) শ্রেণীভুক্ত প্রাণী। এই ম্যালাকোস্ট্রাকা শব্দটিকে একটি ভাঙলে দাঁড়ায় গ্রীক শব্দ 'ম্যালাকস' (Malakos) অর্থাৎ নরম (Soft) এবং 'অস্ট্রাকন' (Ostracon)-র অর্থ খোলা (Shell), কাজেই ম্যালাকোস্ট্রাকা-র মানে হলো নরম খোলা আবৃত প্রাণী। প্রন (Prawn), শ্রিম্প (Shrimp), লবস্টার (Lobster), কাঁকড়া (Crab) সকলেই এই শ্রেণীভুক্ত। কাঁকড়ার পৃষ্ঠীয় দেশের (Dorsal) খোলাটিকে ক্যারাপেস (Carapace) বলা হয়। পৃষ্ঠীয় (Dorsal) এবং অঙ্কীয় (Ventral) দেশের সন্ধিস্থলে ছুরি একটু ঢুকিয়ে উপরের দিকে চাপ দিতেই ক্যারাপেসটি উঠে আসবে। এই কাজটিকেই মনে হয় সবথেকে কঠিন, আসলে কিন্তু তা নয়। এমনকি চাপ একটু বেশি লাগলে ক্যারাপেসটি ভেঙে যায়, তখন সহজেই বোঝা যায় এটি বাস্তবে খোলাটি অতটা শক্ত নয়।
এই ম্যালাকোস্ট্রাকা শ্রেণীর মধ্যে আবার কাঁকড়া ডেকাপোডা অর্ডারের
(Order- Decapoda) অন্তর্গত। শব্দটি থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, ডেকা
(Deca) অর্থাৎ দশ আর পোডা (Poda) শব্দটির অর্থ
পদ বা পা। মানে কাঁকড়ার পায়ের সংখ্যা পাঁচ জোড়া বা দশটি। সাধারণত বেশির ভাগ কাঁকড়ার ক্ষেত্রে, এই পাঁচ জোড়া পায়ের মধ্যে
প্রথম জোড়া পা বেশ বড় আকারের এবং বাকি চার জোড়া পা তুলনামূলকভাবে ছোট হয়। প্রতিটি পা কাঁকড়ার দেহ থেকে আলাদা করা প্রয়োজন।
পা গুলি যে স্থানে শরীরের সাথে সংযুক্ত সেই স্থানে একটু ঘোরাতেই এগুলি সহজেই আলাদা
হয়ে যায়। বড় আকারের পা দুটি ছাড়া বাকিগুলি ফেলে দেওয়াই বাঞ্চনীয়, তবে ইচ্ছে হলে এগুলো ব্যবহারও করতে পারেন। বড় আকারের পা
দুটির খোলা একটু ভেঙে নিতে হবে যাতে রান্নার সময় ভিতরের মাংস সহজে সিদ্ধ হতে পারে
এবং রান্নার মশলার উপকরণগুলি পৌঁছতে পারে।
এইবার ক্যারাপেস উঠিয়ে নেওয়ার পর যা চোখে পড়বে তা হলো গিল
(Gills), জলচর কাঁকড়ার দেহে গিলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ডান ও বাম গিলের সংযোগস্থলে
রয়েছে হৃৎপিণ্ড (Heart)। গিলের নিচে থেকে অন্যান্য
অন্তরযন্ত্ৰীয় অঙ্গগুলি,
যেমন পাচক গ্রন্থিসমূহ (Digestive glands), ডিম্বাশয়
(Ovary, স্ত্রী কাঁকড়ার ক্ষেত্রে), ম্যান্ডিবুলার
পেশী (Mandibular muscle) ইত্যাদি থাকে। তবে
এগুলি আলাদা করে চিহ্নিতকরণের প্রয়োজন নেই কারণ আমরা এখানে খাদ্য হিসেবে বর্ণনা
করছি। এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য,
সেটা হলো কিভাবে স্ত্রী এবং পুরুষ কাঁকড়া চিহ্নিত করা যায়।
কাঁকড়ার অঙ্কীয়দেশের নিচের দিকে অ্যাবডোমেন (Abdomen) অংশটি (প্লেটটি এপ্রোন
(Apron) বলেও পরিচিত) লক্ষ্য করতে হয়, যদি
এটি ত্রিভুজের ন্যায় এবং আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট বা সরু হয় তবে কাঁকড়াটি পুরুষ
কাঁকড়া, আর যদি এবডোমেনটি আকারে বৃহৎ হয় তবে সেটি স্ত্রী কাঁকড়া হয়ে থাকে। যাই হোক, এইবার
কাঁকড়ার দেহের আকার অনুযায়ী একে দু'টি বা চারটি টুকরো করে নিতে হবে।
ব্যাস,
কাঁকড়া কাটার কাজ শেষ।
এবার টুকরো গুলোকে ভোজ্য তেলে ভেজে নিয়ে রান্না করতে হবে। বিভিন্ন অঞ্চলে
রান্নার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন ধরণের। কোনো অঞ্চলে আদা-পেঁয়াজ-রসুন-লঙ্কা বাটা দিয়ে, ধনে-জিরের
গুঁড়ো সহযোগে কাঁকড়াকে কষিয়ে রান্না করা হয়। আবার কারোর কাছে নারিকেলের দুধ দিয়ে
কাঁকড়া রান্না উপাদেয়। কেউ কাঁকড়ার পদে আলু ব্যবহার পছন্দ করেন আবার কেউ করেন না, কাজেই
এটি ইচ্ছে অনুসারে।
এবার উপভোগ করুন সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাদ্যবস্তুটিকে।
পরিশেষে একটি কথা উল্লেখ্য। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব কিন্তু কাঁকড়ার উপর পড়ছে। বসবাসের উপযোগী পরিবেশ যেমন, জলের pH, লবণাক্ততা (Salinity), তাপমাত্রা ইত্যাদির পরিবর্তন কাঁকড়ার জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অণুজীবের (Microbes pathogens- Virus, Bacteria, Fungus) প্রভাব বাড়তে পারে, এর ফলে কাঁকড়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। আর পরিবেশগত দূষণ তো আছেই, যার মাধ্যমে বিষাক্ত যৌগ দূষণ বাড়াতে এবং কাঁকড়ার বাসস্থান ও শরীরকে দূষিত করতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে খাদ্যতালিকা থেকে শুধুমাত্র একটি পুষ্টিকর খাদ্য হারিয়ে যাবে তা নয়, যে সকল মানুষ কাঁকড়া ধরা এবং চাষের মাধ্যমে জীবনযাপন করেন তাঁদের জন্যেও প্রতিকূল অবস্থা তৈরী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই এই বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন