সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
আমি পূর্বে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-১: সূচনা ব্লগটিতে বর্তমান
ভারতবর্ষে পুষ্টি বিষয়ক চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমান ব্লগে ব্যবহারিক জীবনে খাদ্য বা পুষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা অংশ তুলে ধরার একটা প্রয়াস করবো। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি আমাদের
ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন চিত্র। তা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাহিনী নয়।
চরিত্র নামকরণ অপ্রয়োজনীয় কারণ এটি কোনো গল্প বা উপন্যাস নয়, বাস্তবের
উপর ভিত্তি করে কিছু কাল্পনিক কাহিনী/ ভাবনা/ সংলাপ, যা
থেকে সহজে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য এবং পুষ্টির স্থান অনুমান করা যাবে। আসলে খাদ্য
এবং পুষ্টির সুরক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির পাশাপাশি আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কিছু সচেতনতা ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পুষ্টির সুরক্ষাকে দ্রুততর করে। সেই রকম কয়েকটি দিক তুলে ধরতেই আমি এই কাল্পনিক
সমাজচিত্রটির অবতারণা করলাম এই ব্লগে।
-------------------------------------------------------
'আগে বললেই পারতে, কিছুটা তুলে রাখতে বলতাম, অতটা খাবার নষ্ট হতো না'।
অশীতিপর বৃদ্ধ বক্তার উদ্দেশ্যে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকায় বছর ত্রিশের অতিথি যুবক।
গৃহের অন্য সদস্যরা হা হা করে ওঠেন,
'আরে না না,
কি হয়েছে! আগে থেকে কি ঠিক বোঝা যায়, তুমি
কিছু মনে করো না বাবা,
ওনার তো বয়স হয়েছে' ইত্যাদি।
যুবক মনে মনে ভাবলেন, বৃদ্ধ বড়ই খিট্খিটে, কারোর বাড়িতে এলে এরকম কথা কেউ অতিথির উদ্দেশ্যে বলে নাকি! যাইহোক, আমতা আমতা করে প্লেটটি সরিয়ে রাখলেন। আবার গল্প গুজব চলতে থাকে। নানান কথা, ছুঁয়ে যায় একটার পর একটা বিষয়, চলচ্চিত্র-রাজনীতি-খেলা-সমাজ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি কি নেই সেখানে। একের মুখ থেকে কেড়ে আরেক মুখ কথা বলে ওঠে, সেখানে তথ্য-তত্ত্ব কিছুমাত্রায় ঠাঁই পায় বটে, তবে কল্পনা, ধারণা, নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার এক রমরমা আজকাল বড়ই চলছে। অতিথি নির্দিষ্ট সময় পার করে চলে যান, সবাই খুব ব্যস্ত আজকাল, তারমধ্যে সময় বের করে সকলের খোঁজ নিতে এসেছে সে, সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় অতিথির। এর মধ্যে কেউ একজন অর্ধেক খাবার পূর্ণ প্লেটটি টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। রান্না ঘরের পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় গোটা দুয়েক তরকারি লেগে যাওয়া লুচি, অবশিষ্ট তরকারি আর দেড়খানা রসগোল্লা। বৃদ্ধ তাঁকিয়ে দেখেন। এমন ভাববেন না বৃদ্ধ গরীব, সে আর তাঁর পরিবার উচ্চ মধ্যবিত্ত। একটু বাদে আহ্নিক সেরে বৃদ্ধ তাঁর ঘরের ইজি চেয়ারটায় এসে বসবেন, চিনি ছাড়া চা আর দু'টো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট আসবে তাঁর জন্যে। দিনে দু'বার চা খান বৃদ্ধ, সকালে গ্রিন টি আর সন্ধ্যায় এমনি প্রচলিত চা, যাকে ব্ল্যাক টি বলে। তবে এই যে স্বাচ্ছন্দ্য, বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যায়ে পৌঁছনো সেই দীর্ঘ পথ কিন্তু মসৃন নয়, সেখানে অগণিত না খাওয়া রাত রয়েছে, আক্ষরিক অর্থে দু'মুঠো ভাত খেয়ে দিনাতিপাত রয়েছে, মুখ ফুটে খাবার চেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে বসে থাকার মুহূর্তগুলো রয়েছে, খাবারের আশায় ক্রোশের পর ক্রোশ পথ চলা আছে, আবার এর মাঝে কখনও জুটে যাওয়া কিছু ভালো খাবার আর তা নিয়ে উল্লাস রয়েছে। বৃদ্ধ ভাবেন, সেই সময়কার কথা, তাঁদের জীবনধারণের কথা, সে অনেকটা সংগ্রামের মতন শোনায়, বৃদ্ধ অনেক গল্প বলেন তাঁর নাতি নাতিনীদের, সবই আবর্তিত হয় নিজের জীবনের কথা, তাঁর শৈশব, বড়ো হওয়া, কর্ম জীবন, ইত্যাদি। সবাই যে বোঝে তা নয় আবার বোঝে যে না তাও নয়। তবে কারা ভালো বোঝে, সে বোঝা দায় !
এই যে মেয়েটি প্রত্যেকদিন ঘরের কাজ করতে আসেন ওঁর মেয়েকে স্কুলে দিয়েছে, দাদার সাথে সেও যায়, রোজ স্কুলে খেতে দেয়, ও বলছিলো একবেলার জন্যে ও নিশ্চিন্ত। আবার পুজোর ফুল বাজারে যার কাছ থেকে নেওয়া হয়, ও বলছিলো ছেলেটাকে স্কুল পাঠিয়ে পড়াশুনা আর দুপুরের খাওয়াটা দু'টি বিষয়েই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। এঁরা হয়তো বোঝেন।
এই চিত্র আবার বৃদ্ধের প্রতিবেশী বাড়িটির ক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা। ওঁদের থেকে বৃদ্ধ
কথায় কথায় শুনেছে ওঁদের বাড়ির ছেলেটা রোজ স্কুলের মিড ডে মিলের খাবারটা খায়না, মাঝে
মাঝে খায়, ডিম দিলে সেটা নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। ওঁরা কেক, চিপস এসব দিয়ে দেন টিফিনে।
বাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার করতে এসেছে একটা লোক, দুপুরে বৃদ্ধের বাড়িতে
খেতে দেওয়া হয়েছিল,
সাধারণত এসকল লোককে নিরামিষই দেওয়া হয় কিন্তু সেদিন বাড়িতে
মুরগির মাংস একটু বেশি পরিমানেই রান্না হয়েছিল, দু'টুকরো
লোকটাকে দেওয়ায় তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল,
তা বৃদ্ধ লক্ষ্য করেছিলেন। খাবারের অভাব এও হয়তো বোঝে।
'তোমার ঘরে কে কে আছে?'
'বৌ, এক ছেলে আর এক মেয়ে বাবু'।
'ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়াশুনো করাচ্ছ তো?'
'আজ্ঞে!' একটু আমতা আমতা করে বলে 'আসলে গত দু'বছরে তেমন কিছু রোজগারপাতি ছেলো না,
তাই মেয়েটা মায়ের সাথে কাজের বাড়ি যায়।
বৃদ্ধ বলে ওঠেন, 'বলো কি ! স্কুল ছাড়িয়ে দিলে?'
'না বাবু, আবার যাবেখন, মানে স্কুল
ও তো বন্ধ ছেলো, তাই ......, তা যাবেখন
আবার, গেলি তো খাওন টাও পায়।'
বৃদ্ধ বোঝেন, কিন্তু কি বলতে হবে সেটা বোঝেন না !
বাড়িতে হৈ হৈ পরে যায়। বৃদ্ধের বড়ো নাতি এসেছে, কর্মসূত্রে সে প্রবাসী। কাজেই সকলে ঠিক করলো বাইরে খাবে। তবে এখন বাইরে বেড়ানোটা
বেশ অসুবিধাজনক,
প্যানডেমিকের কারণে একটা উদ্বেগ থেকেই যায়। অবশেষে ঠিক হলো
খাবার আনিয়ে নেওয়া হবে যার যা ভালো লাগে,
সবাই নিজের নিজের মতন অর্ডার দিলো, বিরাট আয়োজন। কেউ ফ্রাইড রাইস, কেউ বাসন্তী পোলাও, কেউ
সাদা ভাত, আবার কেউ বিরিয়ানি। কেউ মাটন কষা,
কেউ রেজালা,
কেউ চিকেন বাটার মশালা,
আবার কেউ পনির মশালা। আরও কত কি! কেউ কিন্তু নিজের সমস্ত
খাবার এবেলায় শেষ করতে পারলো না। বৃদ্ধকে সকলে কথা দিলো, রাতে
অবশিষ্টাংশ খেয়ে নেবে তবে তা আর হয়নি,
অবেলায় এতো কিছু খেয়ে রাতে কেউ খাবার মুখেই তুলতে পারলো না।
আগেরবার, মানে দু'বছর আগে কিন্তু এমনটা হয়নি,
সেবার সবাই মিলেমিশে অর্ডার দিয়েছিলো, মানে
এক প্লেট পোলাও দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল,
আবার এক প্লেট মাটন দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, এতে
পুরোটাই খেতে পেরেছিলো, নষ্ট হয়নি।
বৃদ্ধ কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন। সেখানে একাধিকবার সে বিভিন্ন পার্টিতে
যোগ দিয়েছে,
ওখানে অনেকটা খাবারের এমন রীতি, অনেক খাবারের আয়োজন হয়। রেঁস্তোরা থেকে যখন বেরোয় কত খাবার
পাতেই পড়ে থাকে। বৃদ্ধের, তখন
সে যুবক, মুখ থেকে কতবার আক্ষেপ সূচক বাক্য নিঃসৃত হয়েছে। একবার সাহেব বন্ধু বলেছিলেন, 'আরে এই খাবার বাঁচলে কি পৃথিবীর খাদ্য সংকট মিটে যাবে নাকি?' যুবক
কিছু বলেননি,
শুধু তাঁকিয়ে থেকেছেন আর ভেবেছেন কয়েক বৎসর পূর্বের তাঁর
জীবনের কথা। এখানে এতো খাবার নষ্ট হয় আর এমন মানুষও আমাদের সমাজে ছিলেন যারা ফসল
তোলার পর মিনতি করতে আসতেন, বাবু যদি তাঁদের আজ্ঞা দেন তবে তাঁরা মাঠে
পরে থাকা শস্য সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে পারেন। প্রবাস জীবনে বাজার করতে গিয়েও তিনি অভিজ্ঞতা করেছেন সেদেশে সকল বস্তুই
নির্দিষ্ট ওজন করা প্যাকেটে বন্দী,
ঠিক যতটা লাগবে ততটা কেউ ওজন করে নিতে পারবেন না (আমাদের
দেশের বাজারের মতন),
কাজেই অধিকাংশ সময়ে অতিরিক্ত পরিমান বস্তু বাজার থেকে নিয়ে
আসতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে তা পচে নষ্ট হয়।
‘কি রে ওটা কি রাখলি?
এক খানা ডিম নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’ কাজের মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন গৃহকত্রী।
‘আর বোলো না গো মা,
ছেলেটা মোটে নিরিমিষ মুখে তুলতে চায় না, তাই
আর কি করি,
এই এক খান ডিম নিয়ে যাচ্ছি, ভেজে দেবোখন, ভাত
দু'টি খাবে।’ উত্তর দেয় মেয়েটি।
‘তা এক খানা নিলি যে বড় ! বোনটার জন্যে নিলি না ?’
‘না গো,
ও বড় লক্ষ্মী,
ও খেয়ে নেয় যা জোটে।’
আচ্ছা,
বুঝেছি,
বলে এক খানা ডিম ফ্রিজ থেকে এনে দেন মেয়েটির হাতে, বলেন
দুই ভাইবোনকেই ভেজে দিস।
বৃদ্ধ দেখছিলেন। ভাবছিলেন কয়েক দশক আগের কথা, যখন রাত্রের আহারে তিনি একা মাছের টুকরো খেতেন, বিধবা মা আর স্ত্রী খেতেন ভাত-ডাল আর যেদিন যা তরকারী থাকতো তাই। বাইরে কাজের জন্যে কোন সকালে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন রাত্রে, তাই টানাটানির সংসারে দু'বেলা যা কিছু উত্তম জুটতো তা তাঁর পাতেই জায়গা পেতো। এই নিয়ে অবশ্য মা বা স্ত্রীর কোনো আফসোস ছিল না। তাঁরা তো বাড়িতেই থাকতেন, সমস্ত ঘর পরিষ্কার, রান্না করা, কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া, ইত্যাদি কত শত কাজ, তবে সবটাই বাড়িতে, কাজেই তাঁরা 'অধিক' পরিশ্রম করে যিনি সংসার টানছেন বলে মনে করতেন তাঁকেই ভালোটা পরিবেশনের জন্যে সচেষ্ট থাকতেন।
তবে প্রথমবার যখন তাঁর স্ত্রী মা হয়েছিলেন, তখন মা এবং সন্তান বেশ
ভুগেছিলেন। মেয়ে সন্তানের ওজন হয়েছিল অনেক কম, জ্বর, ডায়রিয়া
ইত্যাদির সাথে লড়তে লড়তে বাচ্চাটা প্রায় বিছানায় মিশেই গিয়েছিলো। ডাক্তার অনেক বাকাবকি
করেছিলেন। এই সকল ভোগান্তি অপুষ্টিজনিত বলেছিলেন, বৃদ্ধ (তখন যুবক) বুঝেছিলেন কিন্তু
দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস ততদিনে পদোন্নতি হয়েছিল তাইতো অনেক ডাক্তার হসপিটাল করে
কোনো মতে মা মেয়েকে সুস্থ্য করে ঘরে এনেছিলেন। সে প্রায় বছর পঞ্চাশের আগের কথা, এখন
তো খুকীর ছেলেই কত বড় হয়ে গেছে ! তারপর তো মা চলে গেলেন। অফিস থেকে তাঁকে পশ্চিমে পাঠালো।
জীবনে এক ধাক্কায় অনেকটা পরিবর্তন এলো। খুকী খুবই ঘ্যান ঘ্যান করতো ছোটবেলায়, সে
ওই দেশে কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া শুরু করলো,
দিদিমণিদের পরামর্শে খুকীকে কাউন্সেলিং করানো হলো, ধীরে ধীরে বেশ
চনমনে হয়ে উঠলো সে। তারপর তাঁদের একটি ছেলে
হলো, ডাক্তার স্ত্রীর মেডিকেল হিস্ট্রিতে সিজার দেখে একটু চিন্তিত হলেন। যাইহোক এবার পূর্বের ন্যায় পরিস্থিতি হলো না, তবে
সেবারও স্ত্রী সিজারের মাধ্যমেই পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।
এসকল ভাবছিলেন বৃদ্ধ,
তখন নাতি ঘরে প্রবেশ করলেন। বৃদ্ধ তাকালেন, দৃষ্টিটা
একটু পরিষ্কার হলে প্রশ্ন করলেন,
'হ্যাঁ রে তুই যে দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছিস' ! নাতি হেসে উত্তর দিলো 'সেডেন্টারি লাইফ গো দাদু,
সারাদিন বসে বসে কাজ,
জগৎ সংসার এগিয়ে চলছে আর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে উৎপন্ন করছে এই
অপুষ্টিগত পরিনাম'। বলে থামে সে।
‘তা কতদিন ছুটি পেলি’?
‘আর
ছুটি..’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে ‘পেয়েছি দু'দিনের,
তার সাথে রবিবার’।
‘বাব্বা, কাজের তো বড্ড চাপ ! তা খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকে
করিস তো’?
‘হ্যাঁ
সেটা করি, বেশিরভাগ দিন দুপুরে অফিসেই বিরিয়ানি না হয় সিজওয়ান ফ্রাইড রাইসের একটা প্লেট আনিয়ে
নিই, বাড়িতে রাতে হালকা কিছু ধরো রুটি আর মাংস বা পনিরের কিছু একটা আর টক দই। খাওয়া
নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা নেই।
নাতি আরো বলে ও যেখানে বাসা ভাড়া নিয়েছে,
তার সামনে বেশ কতগুলো দোকান রয়েছে, পিজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, মোমো, পাস্তা
সব কিছুই সেখানে সহজলভ্য। নাতির মধ্যে কি যেন খোঁজে বৃদ্ধ, হয়তো
নিজের তরুণ অবস্থাকে,
নাতিকে দেখতে পুরো তাঁরই মতন। এই বয়সে তাঁর নিজের কি অবস্থা
ছিল, কিভাবে যে বেঁচেছিল অসহায় মাকে নিয়ে সেটাই সে বুঝতে পারে না। দিনের পর দিন ভাত, এখান-ওখান
তুলে আনা কলমি শাক ভাজা খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া,
এই ছিল তাঁদের দিনাতিপাত। ডাল-ভাত-তরকারি-মাছ সহযোগে পরিপূর্ণ
আহার তাঁদের কাছে তখন ছিল চাঁদ হাতে পাওয়ার মতন, তা সম্ভব হতো যদি কেউ নিমন্ত্রণ করতেন তবে। মা'র মুখে কোনোদিন তেমন সুখাদ্য তুলে দিতে পারেননি বৃদ্ধ। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে নাতির
ডাকে, দাঁড়াও আমি আসছি বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক
বাদে, হাতে তখন আলুর চিপস আর এক গ্লাস কোল্ড ড্রিঙ্কস। নাতিকে খেতে বারণ করে বৃদ্ধ, পরক্ষণে
কি মনে হয় আবার বলে ‘আসলে একটু এসব কম খাস’। মনে মনে হিসেব করে,
পয়সা যখন ছিল না আর যখন হলো আসলে ঠিক কতটা পার্থক্য হলো ?
কাজের মেয়েটি আবার আসে পড়ন্ত বিকেল বেলায়। ও রেশন নিয়ে কার্ড ফেরত দিতে এসেছে।
গৃহকত্রী রান্না ঘর থেকে বলেন দাদুর কাছে রেখে যেতে। বৃদ্ধ হাসিমুখে কার্ডগুলো রেখে
দেয়। 'দাদু কি হয়েছে?
হাসছ যে'!
'না রে,
আসলে ভাবছি কত মানুষের মুখে অন্ন উঠছে, একি
আর মুখের কথা রে দিদিভাই'।
দাদু ওঁকে বলেন নাতিকে ডেকে দিতে। মেয়েটি নাতিকে ডেকে দিয়ে চলে যায়। দাদু বলে তোর
ল্যাপটপ টা আন তো,
দু'জনে মিলে একটা সিনেমা দেখি,
আজ দেখবো মৃনাল সেন পরিচালিত 'আকালের
সন্ধানে' আর কাল দেখবো সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন'।
‘এই দু'টো বাছলে কেন’?
‘আচ্ছা.....তবে
তুই বল। না থাক,
আছে তো আরও তবে আগে এই দুটোই দেখি’।




