পৃষ্ঠাসমূহ

থাইল্যান্ড: পর্ব-৬ (Thailand: Part-6)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ থাইল্যান্ড: পর্ব-৪ থাইল্যান্ড: পর্ব-৫

আজ একটু বেলা করেই উঠলো সবাই। গত কয়েকদিন ধরে বেশ ভোর ভোরই উঠতে হচ্ছিলো সকলকে, আজ একটু বেশিক্ষন বিছানায় কাটানো যাচ্ছে, বেশ লাগছে। গতকাল একটি ফটো আমরা গাড়িতে ফেলে এসেছিলাম, তাই রুডিকে ফোন করে অনুরোধ করলাম সে যেন গতকালের গাড়িটিই আমাদের জন্যে আজকে পাঠায়, সেটিতেই আমরা যাবো পাটায়া। সকালে উঠে চা-বিস্কুট খেয়ে গল্পগুজব চলতে লাগলো। আজকের প্রাতঃরাশও ছিল নুডলস। সাড়ে দশটার মধ্যে আমরা তৈরী হয়ে গিয়েছিলাম, কথা-বার্তা চলছিল। হঠাৎ আমার ঘরের ফোন বেজে উঠলো, ফোনের ওপারে টনি, আমাদের গাড়ির চালক তথা আমাদের ব্যাঙ্কক ভ্রমণের গাইড। তিনি সময়ের পূর্বেই এসে হাজির হয়েছেন। আমরাও দেখলাম অযথা দেরি করে লাভ নেই, কাজেই আমরা লবিতে নেমে এলাম। প্রথমেই নমস্কার করে এক গাল হেসে আমাদের ফেলে আসা ছবিটি তিনি দিলেন। এদেশে আমাদের দেশের মতন দিনের প্রথম সাক্ষ্যাতে  হাত জোর করে প্রণাম করার সংস্কার রয়েছে। আমরা আগেই আজকের বেড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলাম, আমাদের আজকের প্রথম দ্রষ্টব্য স্যাংচুয়ারি অফ ট্রুথ। 

ব্যাঙ্কক ছেড়ে পাটায়ার দিকে চলতে চলতে সহজেই চোখে পড়বে রাস্তার পাশে ছবিগুলি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। গগনচুম্বী অট্টালিকা, বিরাট বিরাট মানব স্থাপত্য কখন অদৃশ্য হয়ে এখন শুধু প্রকৃতি। যখন স্যাংচুয়ারী অফ ট্রুথে পৌঁছলাম তখন প্রায় বেলা ১ টা। আমাদের সকলেই বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিলো। টনি গিয়ে টিকিট আর প্রত্যেকের জন্যে হাতে বাঁধার ব্যান্ড এনে দিলেন, এটি দেখালেই প্রবেশ করা যাবে অভ্যন্তরে।  ভিতরেই একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। আমরা গিয়ে সাগর দেখা যায় এমন একটি টেবিলে বসলাম। এবার খাবার অর্ডার দেওয়ার, সেখানে বিশেষ পরিবর্তন হলো না। তবে পানীয়ের ক্ষেত্রে যে যার পছন্দ মতন অর্ডার দিলো, আমি নিয়েছিলাম ডাব, ভিতরের শাঁসটাও বেশ ভালো ছিল।   

কাষ্ঠ নির্মিত এক বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদের অভ্যন্তরের প্রতিটি ভাস্কর্য কাঠ নির্মিত। প্রচুর পুরুষ-মহিলা একাগ্র চিত্তে হাতুড়ি আর ছেনির সাহায্যে ফুটিয়ে তুলছেন তাঁদের শিল্পকর্ম।  


এরপর আমরা গিয়েছিলাম আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে। এখানে বিশালাকায় একোয়ারিয়ামে রয়েছে বিভিন্ন জলচর প্রাণী। খুব ভালো লাগবে এটি দেখতে। 

এরপর আমরা গিয়েছিলাম পাটায়ার ভিউ পয়েন্টে, পাখির চোখে অপূর্ব পাটায়ার সৌন্দর্য ছিল মনোমুগ্ধকর। 


এর পরের পাহাড়টিতে এই শহরের বিগ বুদ্ধা স্থাপত্যটি রয়েছে তবে সেখানে আমরা এবার যেতে পারিনি, কাজেই এবার আমাদের গন্তব্য আজকের হোটেল, আমরা ছিলাম তেভান জমিতেনে। জমিতেন সমুদ্রসৈকত এখান থেকে হাঁটা পথে প্রায় ১৫-২০ মিনিট। একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। সকলের বেশ খিদে পেয়েছিলো, সৈকতের নিকটেই একটি রেস্তোরাঁ আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল, এর বিশেষত্ব ছিল এটি একটি মাল্টি-কুইসিন রেস্তোরাঁ, এখানে ভারতীয়, বাঙালি, থাই এবং ইউরোপিয়ান সকল ধরণের কুইসিন পাওয়া যায়। রেস্তোরাঁর এম্বিয়েন্সও আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল।  শেফের সাথে আমাদের পরিচয় হলো, উনি বাঙালী, ওঁনার স্ত্রী থাই, পুরো পরিবার একসাথে এই রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করেন। তন্দুরি রুটি, জিরা রাইস, মাছের কারী, চিকেন কারী, আমের লস্যি সব দিয়ে আমাদের ডিনারটা বেশ জমে উঠেছিল। অনেক গল্পও হলো, ওঁদের জীবন, থাইল্যান্ডের জীবন, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।  বারবার উঠে এসেছিলো করোনা-র সময়কালের কথা, সে সত্যই এক সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার কাহিনী।

আজকের মতন বিশ্রাম। আমরা ঠিক করেছিলাম ঘরে গিয়ে সবাই গল্প করবো, কিন্তু তা আর হল না। সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আবার আগামীকাল ভোর ভোর ওঠা ছিল, কারণ আগামীকাল আমাদের এই ভ্রমণের অন্তিম দিন। 

আজ আমরা সবাই সকাল সকাল উঠে পড়েছিলাম। এবার প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যাবো সমুদ্রে স্নান করতে। গত কাল রাত্রে ফেরার পথে সকলের জন্যে নিজ নিজ পছন্দ অনুসারে প্রাতঃরাশ কিনে আনা হয়েছিল। চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আগেই আমাদের আজকের দুপুরের খাবার আলু পরোটা অর্ডার দেওয়াই ছিল, সমুদ্রে স্নান করে ফেরার পথে সেটা নিয়ে আসার কথা। বেরোনোর আগে আমরা খেয়ে বেরোবো।  

এবার ফেরার পালা। সবথেকে বেশি আমরা প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞ। কয়েক মাস আগে যখন পরিকল্পনা করেছিলাম তখন আমাদের মনে বৃষ্টির একটা ভয় ছিল, জুলাই মাসে বৃষ্টি হওয়াটা একেবারেই আশ্চর্য নয়। এমনকি বেড়াতে আসার পূর্বের সপ্তাহটিতে আমাদের ওখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল, তবে প্রকৃতি আমাদের মনোস্কামনা শুনেছিলেন, খুব সুন্দর রৌদ্র ঝলমল আবহাওয়া আমাদের বেড়ানোটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল। বেলা ১২ টার সময়ে আমরা হোটেল ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, নিৰ্দিষ্ট সময়েই বির গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন হোটেলে। গাড়িতে মালপত্র সব তুলে দেওয়া হলো।  পাটায়াকে বিদায় জানিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য ব্যাঙ্ককে সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে অবস্থিত সিয়াম প্রিমিয়াম আউটলেট (Siam Premium Outlet), সবাই জিনিসপত্র দেখা কেনার জন্যে উৎসাহী, কাজেই আমরা এই স্থানে ঘন্টা তিনেক কাটালাম। দোকানগুলিতে ঘোরাঘুরির মাঝে বিভিন্ন ধরণের ফ্রাইড রাইস, আর থাই টি দিয়ে খাওয়াদাওয়া সারলাম। আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ হলে আমরা চললাম সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে, এখান থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ গাড়িতে। 

মা-বাবা দের যে বিমান সংস্থার টিকিট ছিল দেখলাম সেই সংস্থা তাদের বিমান বাতিল করেছে এবং কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থাও করেনি। এরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বড়ই আশ্চর্য করে আমাদের, তবে কি আর করা ! আমরা ওপর একটি বিমানের টিকিট কিনে নিলাম। ওঁদের বিমান ছিল রাত্রি ১১ টা বেজে ৩০ মিনিটে। আমাদের পরের দিনই ভোর ১ টা বেজে ৪৫ মিনিটে। বোর্ডিং, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি সবই ওঁদের আমাদের আগে হয়ে গিয়েছিলো। আমরা তখনও বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে আমাদের প্রক্রিয়া শুরু হলো, যখন ভিতরে গিয়ে মা-বাবা দের সাথে দেখা হলো ততক্ষনে ওঁদের বিমানের সময় প্রায় হয়ে গিয়েছিলো। ওঁরা এয়ারপোর্টে কোনো খাবার খেলো না, ফ্লাইটে ডিনার করবে বললো। একসাথে কিছুক্ষন কাটিয়ে ওঁদের বিমানে ওঠার পর আমরা আমাদের গেটের দিকে এগিয়ে চললাম, পথে একটি দোকানে ডিনার সেরে নিলাম। 

এবার ফিরে চলা, মাথায় ভিড় করে আসছে একের পর এক কাজ। গিয়েই সামনের সপ্তাহে আমাকে যেতে হবে একটি আন্তর্জাতিক ইকোলজি বিষয়ক সম্মেলনে, সেই সংক্রান্ত বেশ কিছু কাজ রয়েছে। বেশ ভালো বেড়ানো হলো। শেষ মুহূর্তে মা-বাবা দের জিজ্ঞেস করেছিলাম এর পর তাঁরা কোথায় যেতে পছন্দ করবে? উত্তর এখনো নিশ্চিত হয়নি, যদি কোথাও যাই নিশ্চয় তা ভবিষ্যতে আমার ব্লগে লেখার চেষ্টা করবো।  

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-৫ (Thailand: Part-5)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ থাইল্যান্ড: পর্ব-৪

আজ আমাদের ব্যাঙ্কক ঘোরার প্রথম দিন। প্রথমে আমরা যাবো ম্যাকলং রেলস্টেশনে (Maeklong Station)। রেললাইনের দু'পাশে পসরা সাজিয়ে বাজার বসেছে।  ট্রেনটি যখন আসে দোকানগুলির উপর থেকে চাঁদোয়াগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়, সংকীর্ণ লাইনটি বেয়ে রেলগাড়িটি স্টেশনে আসে। এই দৃশ্য দেখার জন্যে প্রত্যহ সকালে পর্যটকরা ভিড় করেন, যেমন আমরাও এসেছি আজ। কথা মতন নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ সকাল ৭টায় রুডি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর এক ভাইপোকেও পাঠিয়েছিলেন, আগে থেকে দর্শনীয় স্থানগুলির টিকিট কেটে আমাদের সাহায্য করার জন্য। স্থানীয় বাজারটি ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগে, বেশিরভাগ সব্জি পরিচিত হলেও বেশ কিছু সব্জি, ফল অচেনাও থাকতে পারে। ট্রেন আসার পূর্বেই আমরা যথাস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। স্টেশনের পাশেই রয়েছে সারি সারি রেস্তোরাঁ। চা-বিস্কুট আমরা খেয়েই বেরিয়েছিলাম। এখানে যে যার মতন পানীয় পছন্দ করে কিনলো, কেউ ডাব আবার কেউ ম্যাংগো স্মুদি। ডাব আমার বড়োই প্রিয়, জল তো বটেই, ভিতরের শাঁস টাও ততোধিক প্রিয়। তবে দক্ষিণ কোরিয়াতে ডাব খুব একটা পাওয়া যায় না, কখনও টিনে ডাবের জল পাওয়া যায় বটে কিন্তু তা আমার ভালো লাগে না, কাজেই এই পুরো ঘোরাতেই আমি মন ভরে ডাব খেয়েছিলাম। এবার ট্রেনটি ঢুকছে, লাইনের উপর পর্যটকদের ভিড়, নিজ নিজ দোকানের চাঁদোয়াগুলি দোকানিরা সরিয়ে নিচ্ছেন আর ট্রেনটি এগিয়ে আসছে। বেশ উপভোগ্য এ দৃশ্য। 

ক্রমাগত লাইন থেকে পর্যটকদের সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ বার্তা বাজতে লাগলো, ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করলো। এতক্ষণ ট্রেন আসার ছবি বা ভিডিও তুলতে ব্যস্ত পর্যটকরা এবার ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বলাই বাহুল্য, আমরাও এ আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করিনি। 

এখন থেকে আমরা যাবো দামনেন সাদুকে (Damnoen Saduak)। শহরের মধ্যে দিয়ে কয়েক কিলোমিটার ব্যাপী বয়ে চলেছে একটি খাল, তার দু'পাশে স্থানীয় মানুষের ঘর-বাড়ি, দোকান, আবার কোথাও নৌকা করে বাজারের পসরা সাজিয়ে চলেছে বেচা কেনা, অনেক ভেনিসের মতন। আমরা এখানে নৌকাবিহার করবো। তবে যাওয়ার পথে প্রথমে যাবো নারকেল থেকে গুড় প্রস্তুত করা দেখতে। আঁখি গুড়ের সাথে আমরা ভারতবাসীরা পরিচিত, শীতকালে খেঁজুরের রস থেকে যে গুড় বা পাটালি তৈরী হয় তা তো বাঙালির প্রেম, আবার তালের পাটালিও হয়ে থাকে, তবে নারকেল থেকে গুড় প্রস্তুত করা হয় তা আমি পূর্বে জানলেও  চেখে দেখার সুযোগ এই প্রথম বার, বেশ সুস্বাদু। 

এইবার চললাম দামনেন সাদুকের উদ্দেশ্যে। গাড়ি থেকে নেমে যে পথ দিয়ে নৌকার কাছে পৌঁছলাম তার দু'পাশে কাষ্ঠনির্মিত অনেক ভাস্কর্য রাখা রয়েছে, অধিকাংশই ভগবান বুদ্ধের এবং বৌদ্ধ ধর্মের নানান চরিত্রের। 

একটি নৌকায় ছয়জন, কাজেই আমাদের একটি নৌকা লেগেছিলো। নৌকার পশ্চাদভাগে ইঞ্জিন রয়েছে, নৌকার চালক সেখান থেকে নৌকাটিকে চালাচ্ছেন। সরু খাল বেয়ে অত্যন্ত দ্রুতবেগে চলে এই নৌকাগুলি আর পর্যটকরা তা উপভোগ করেন, নৌকায় যেতে যেতে দেখেন আশপাশের ঘর বাড়ি, বাগান ইত্যাদি, এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আবার প্রতিটি বাঁকের সময় নৌকার গতি ধীর হয়ে যায়, বাঁক ঘুরেই আবার সে গতি বৃদ্ধি করে। নৌকা যাত্রা সব মিলিয়ে প্রায় ২০ মিনিট মতন। 

নৌকা এসে যে স্থানে নামিয়ে দেয়, সেটা বাজার। নৌকা থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে আমরা যখন উঠে আসলাম, তখন দোকানিদের ডাকাডাকি, তাদের পসরা দেখানোর ধুম লেগে যায়। 

একটু এগিয়ে আসতেই দেখলাম, এক ব্যক্তি কয়েকটি বাঁধানো ছবি আমাদের সামনে এসে আমাদের বিক্রি করতে চাইছেন, ছবি দেখে তো আমরা আশ্চর্য। এতো আমাদেরই নৌকাবিহারের ছবি ! নৌকা ছাড়ার একটু পরেই এক ব্যক্তি পাড় থেকে আমাদের ছবি তুলেছিলেন, মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে তা প্রিন্ট করে বাঁধিয়ে বিক্রি করতে এসেছেন। ছবিগুলি আমরা কিনেছিলাম, এক একটা ১৫০ থাই বাত করে নিয়েছিলেন। কাপড়, বিভিন্ন দ্রব্যাদি ইত্যাদির পাশাপাশি এখানে একের পর এক রেস্তোরাঁ রয়েছে। নিজেদের পছন্দের মতন একটি দোকানে গিয়ে বসলাম। সি ফুড ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাইড রাইস, প্রন ফ্রাইড রাইস, স্যুপ ইত্যাদি ছাড়াও এখানে যে জিনিসটা আমাদের সর্বাধিক রসনাতৃপ্তকারক ছিল তা হলো ডাব আইসক্রিম। ডাবের নরম শাঁসের মধ্যে আইসক্রিম, তার উপর চীনাবাদাম, নীল রঙের অল্প ভাত আর একটি ফুল দিয়ে গার্নিশ করা।

এবার আমরা ফিরে চললাম। প্রথম গন্তব্য ব্যাঙ্ককের গ্র্যান্ড প্যালেস। এটি পর্যটকদের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য। মহান গ্র্যান্ড প্যালেস প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে অবস্থিত মহিমান্বিত ভবনগুলির স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ। রাজা প্রথম রামা দ্বারা রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ব্যাঙ্ককে প্রতিষ্ঠান করার সময় ১৭৮২ সালে এই প্যালেসটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ২১৮০০০ বর্গ মিটার ব্যাপৃত প্যালেস প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে রয়েছে রাজসিংহাসনের বাড়ি, প্রসিদ্ধ এমারাল্ড বুদ্ধ মন্দির (The Temple of the Emerald Buddha) সহ অনেকগুলি সরকারি দফতর। 

প্রথম পর্বে এই দেশটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনার সময় উল্লেখ করেছিলাম চাকরি রাজবংশের কথা, যা ইতিহাসে রাত্তানাকসিন রাজত্ব (Rattanakosin Kingdom) নাম পরিচিত। ব্যাঙ্ককের হৃদয়ে অবস্থিত এই মহান প্যালেসটি রাজা চাও ফ্রায়া (Phra Phutthayotfa Chulalok Maharaj) যিনি রাজা প্রথম রামা নাম পরিচিত, থেকে রাজা রামা পঞ্চম পর্যন্ত রাজাদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এই স্থানটি রাজপরিবারের অনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় এবং রাজার অতিথিদের, রাষ্ট্রের অতিথিদের এবং অন্যান্য বিদেশী বিশেষাধিকারীদের স্বাগতের জন্য ব্যবহৃত হয়। গ্র্যান্ড প্যালেসের প্রবেশ পথে অনেক গাইড রয়েছেন, তাঁরা নিজেরাই এগিয়ে আসবেন, তবে কথা বলে গাইডের পারিশ্রমিক ঠিক করে নেওয়া বাঞ্চনীয়। একা একাও এস্থান ঘুরে দেখা যায়, তবে সাথে গাইড থাকলে বুঝে নিতে সাহায্য হয়।   

 

প্রথম পর্বে আমি উল্লেখ করেছিলাম রামাকিয়েন-র কথা। এই কাহিনী রামায়ণের হলেও কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণের রাজা রাম রামাকিয়েনে ফ্রা রামা (Phra Rama), সীতা এখানে নাং সিদা (Nang Sida), দশরথ এখানে থোৎসারথ (Thotsaroth), রাবণ এখানে তৎসাকান (Totsakan) ইত্যাদি। রামাকিয়েনের কাহিনী অনুসারে মাতা সীতা রাবণের কন্যা, হনুমান বিবাহিত পুরুষ, হনুমান নিজেকে প্রসারিত করে সেতু নির্মাণ করেন ইত্যাদি বেশ কয়েকটি স্থানে বৈসাদৃশ্য লক্ষ্যিত হয়। এই কাহিনী প্রসঙ্গান্তরে সুযোগ পেলে কখনও বিস্তারিত আলোচনা করবো। এই কাহিনীগুলি শিল্পীর কল্পনায় প্যালেসের দেওয়ালে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

এরপর আমাদের দ্রষ্টব্য ওয়াট ফো, যার অফিসিয়াল নাম ওয়াট ফ্রা চেতুফন উইমন মংখলারাম রাজওয়ারমহাভিহান (Wat Phra Chetuphon Wimon Mangkhalaram Rajwaramahawihan)। রাজা রামা প্রথম পূর্ববর্তী মন্দিরটিকে পুনর্নির্মাণ করেন এবং পরবর্তীকালে রাজা রামা তৃতীয় মন্দিরটিকে সম্প্রসারণ এবং সংস্কার করেন। ব্যাঙ্কক শহরের প্রাচীনতম মন্দিরটির নাম ওয়াট ফো এসেছে ওয়াট ফোতারাম (Wat Photaram) বা ওয়াট ফোধারাম (Wat Phodharam) কথাটি থেকে, যা ভারতবর্ষের বোধ গয়ায় অবস্থিত বোধিবৃক্ষের মঠ কে নির্দেশ করে। থাইল্যান্ডের সাথে ভারতবর্ষের দর্শন একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, ভ্রমণের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের মাধ্যমে তা সহজেই অনুভব হয়। চোখে পড়বে চাও ফ্রায়া নদীর ওপর তীরে অবস্থিত অন্য একটি বৌদ্ধ মন্দির হলো ওয়াট অরুন। যখন আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য বার্মিজ আক্রমণে অস্তমিত তখন রাজা তাকসিন থোনবুরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং বৌদ্ধ মন্দির অরুনের পাশে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান। পরবর্তীকালে রাত্তানাকসিন রাজবংশের সূচনায় রাজা রামা প্রথম থোনবুরি থেকে ব্যাঙ্ককে রাজধানী স্থানান্তরিত করলে তিনি বৌদ্ধ মন্দির ফো-র পাশে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান।  

৮০ বর্গমিটার বিস্তৃত মন্দির প্রাঙ্গনটিতে রয়েছে ফ্রা উবসত (Phra Ubosot), ফ্রা রাবিয়াং (Phra Rabiang), ফ্রা মহা চেদি সি রাজকর্ণ (Phra Maha Chedi Si Rajakarn), এবং রিক্লাইনিং বুদ্ধ (Reclining Buddha) মূর্তি। ফ্রা উবসত (ফ্রা উপোসাথা) বা বট হল  হল, বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত প্রধান অর্ডিনেশন গৃহ এবং প্রাঙ্গণটির সর্বাধিক পবিত্র ভবন। এটি আয়ুথায়-শৈলীতে রাজা প্রথম রাম দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, এবং পরে রাম তৃতীয় দ্বারা রত্নকোসিন-শৈলীতে এটিকে প্রসারিত ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।  ফ্রা উবসত ফ্রা রাবিয়াং দ্বারা ঘেরা প্রাঙ্গনের মধ্যভাগে অবস্থিত।

এই ডাবল ক্লোস্টারে উত্তর থাইল্যান্ডের বুদ্ধের প্রায় ৪০০ টি মূর্তি রয়েছে যা মূলত রাজা রাম প্রথম দ্বারা আনা ১২০০ টির মধ্যে নির্বাচিত হয়েছে। এই বুদ্ধ মূর্তিগুলির মধ্যে ১৫০ টি ডাবল ক্লোস্টারের ভিতরের দিকে, অন্য ২৪৪ টি মূর্তি বাইরের দিকে রয়েছে। এই বুদ্ধের মূর্তিগুলো, কিছু দাঁড়িয়ে আছে এবং কিছু উপবিষ্ট, সমানভাবে সোনালি পাদদেশে মাউন্ট করা হয়েছে। এই মূর্তিগুলি সিয়ামের বিভিন্ন স্থান থেকে আনীত এবং ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালের, যেমন চিয়াংসেন (Chiang Saen), সুখোথাই (Sukhothai), ইউ-থং (U-Thong) এবং আয়ুত্থায়া (Ayutthaya) সময়কালের। মূর্তিগুলিকে রামা প্রথম সংস্কার করেছিলেন এবং এগুলিকে সোনার পাতা দিয়ে আবৃত করে দেওয়া হয়েছিল।      

রিক্লাইনিং বুদ্ধ (ফ্রা বুদ্ধসাইয়াস/ Phra Buddhasaiyas) ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামা তৃতীয় দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এই হেলান দেওয়া বুদ্ধমূর্তি ভগবান বুদ্ধের নির্বাণে প্রবেশ এবং সমস্ত পুনর্জন্মের সমাপ্তির প্রতিনিধিত্ব করে।



ভগবান বুদ্ধ কে নতজানু হয়ে প্রণাম করে এবার আমাদের আজকের মতন ফেরা। অনেক সকালে আমরা বেরিয়েছিলাম। ঘরে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সারাদিনের গল্প, দিনটিকে ফিরে দেখা, এইভাবেই কেটে গেলো সন্ধ্যেটা। ফেরার পথে একটু বৃষ্টি হয়েছিল তবে তা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি। আজ আমরা সন্ধ্যার জলখাবার, রাতের খাওয়া-দাওয়া ঘরেই সেরেছিলাম। চা-বিস্কুট, নুডলস, কেক, মিষ্টি ছিল খাদ্যের তালিকায়। কাল ব্যাঙ্কক থেকে আমরা যাবো পাটায়া। সেই গল্প আসবে আগামী পর্বে। 

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-৪ (Thailand: Part-4)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩

আজও ঘুম ভাঙলো ভোর ৫ টায়। আসলে থাইল্যান্ড সময় দক্ষিণ কোরিয়ার সময়ের থেকে ২ ঘন্টা পিছিয়ে, আমার বায়োলজিক্যাল ক্লক অনুসারে আমি বাড়িতে সকাল ৭ টায় উঠি, কাজেই এখানে তাড়াতাড়ি আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।  এতে বেশ ভালোই হয়, ভোর উপভোগও করতে পারি, নিজের কিছু কাজও সারা হয়ে যায়, আবার আগে থেকে বেড়ানোর সব কিছু ঠিকঠাক করে রাখতে পারি। মা বাবা'দের ক্ষেত্রে হচ্ছে এর ঠিক বিপরীত কারণ ভারতীয় সময় থাইল্যান্ডের সময় থেকে আবার দেড় ঘন্টা পিছিয়ে। যাই হোক আজ একটু তাড়াতড়ি সবাই উঠে পড়লো। চা বা কফি, যে যা খাবে তা তৈরী হলো, সাথে বিস্কুট, কেক, মিষ্টি এসব তো ছিলই। তৈরি হয়ে আমরা পৌনে ৮ টা নাগাদ বিচের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আগেই বলেছি পায়ে হেঁটে ৫-৭ মিনিট লাগে কারোণ বিচ, পথে অনেক রেস্তোরাঁর মধ্যে একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁও চোখে পড়লো। তবে সব দোকান, রেস্তোরাঁ এখন বন্ধ, একটু বেলা হলে খুলবে। বিচে পৌঁছে আমরা সোজা সমুদ্রে নেমে পড়লাম। মাঝে মাঝে পারে এসে ঘড়ি দেখে যাওয়া, আবার নেমে পড়া। প্রাণ মন ভরে আমরা দু'ঘন্টা সমুদ্রস্নান করেছিলাম।   

১০ টায় আমরা রিসর্টে পৌঁছলাম। এবার সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি করে ভাত বসানো হলো। তরকারী, ডিমের কষা- ফ্রিজে এসব তো ছিলই, শুধু গরম করে নেওয়া হলো। 

আমাদের গাড়ি এলো বেলা ১২ টায়। এবার আমরা যাব ফুকেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, সেখান থেকে ব্যাঙ্কক। ফুকেটকে বিদায় জানিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বিমান তার যাত্রা শুরু করলো, এবং সঠিক সময়েই ব্যাঙ্ককে অবতরণ করলো। 

যখন ব্যাঙ্কক নামলাম তখনও দিনের আলো ছিল। বাইরেই আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছিলো। আমি আগেই হোটেলে ফোন করে আমাদের চেক ইন সময়টি জানিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা চললাম আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমরা থাকবো ডেস রেস হোটেল এন্ড রেসিডেন্সে। এটি সমুৎপ্রাকার্নে অবস্থিত, ব্যাঙ্ককের এই স্থানটি রেসিডেনশিয়াল অঞ্চল। পর্যটকের জনপ্রিয় অঞ্চল খাওসান রোড বা চায়না টাউন থেকে একটু দূরে এই জায়গাটি। প্রায় সাড়ে ৭ টা নাগাদ আমরা হোটেল এসে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরোলাম রাত্রের আহারের জন্যে। এস্থানে রয়েছে একাধিক খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁ, অধিকাংশ থাই, একটি জাপানিজ রেস্তোরাঁও চোখে পড়লো। আমরা একটি থাই রেস্তোরাঁতে ঢুকলাম, যেহেতু আমরা থাই খাবারের নামগুলির সাথে পরিচিত নই, শেফ এসে আমাদের সাথে আলোচনা করে তারপর অর্ডার নিলেন। আমরা নিয়েছিলাম সি ফুড ফ্রাইড রাইস, প্রন-চিকেন ফ্রাইড রাইস ইত্যাদি।   

আজকের মতন বিশ্রাম। আগামীকাল আমাদের ব্যাঙ্কক বেড়ানো, আগামী পর্বে আসবে সেই কাহিনী। 

জুলাই, ২০২৩        

থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ (Thailand: Part-3)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্ব দু'টি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২

আজ খুব ভোরে, প্রায় ৫ টা নাগাদ, ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। বাইরে তখনও অন্ধকার, বারান্দায় এসে বসলাম, একটু পরে আলো ফুটবে। বেশ ভালো লাগে ভোর হওয়া দেখতে। ৬টা নাগাদ সবাইকে ডেকে দিলাম, প্রাত্যহিক কাজ সেরে ফ্রেশ হয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সাড়ে সাতটায় গাড়ি এলো আমাদের নিয়ে যেতে। আজ আমরা অনেকগুলি দ্বীপ ঘুরে দেখবো, সমুদ্র যাত্রা, সমুদ্রস্নান সবই হবে, কাজেই বাড়ি থেকে স্নান সেরে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।  

ভ্যান আমাদের নিয়ে আরও পর্যটক তুলতে তুলতে ফুকেট মেরিনা বে-তে (Phuket Marina Bay) উপস্থিত হলো। আমাদের নাম পূর্বেই অন্তর্ভুক্ত করা ছিল, গাইড তা পরীক্ষা করে নিয়ে আমাদের প্রাতঃরাশ সেরে নিতে বললেন। প্রাতঃরাশের জন্যে সেখানে নানান ধরণের কেক, বিস্কুট, চা, কফি, ক্যান্ডি ইত্যাদি ছিল। প্রায় আধ ঘন্টা পর আমাদের নির্দিষ্ট স্পিডবোটে ওঠানো হলো। গাইড ইংরাজিতে মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলেন। তিনি প্রথমেই যাত্রীদের স্বাগত করে আমাদের যাত্রার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন।

প্রথমেই আমরা এলাম খই দ্বীপপুপুঞ্জে বা 'কোহ খই'-তে (Koh Khai)। ফুকেটের পূর্বের উপকূল থেকে প্রায় ২৫ মিনিট দূরত্বে এই 'কোহ খই' (থাই ভাষায় 'কোহ' (Koh) কথাটির অর্থ দ্বীপ ) দ্বীপপুঞ্জটি তিনটি দ্বীপ, যথা কোহ খই নাই (Koh Khai Nai), কোহ খই নুই (Koh Khai Nui), এবং কোহ খই নোক (Koh Khai Nok) নিয়ে গড়ে উঠেছে। দ্বীপগুলি তাদের দুর্দান্ত শুভ্র বালুকাময় সৈকত এবং অবিশ্বাস্যভাবে স্বচ্ছ জলের জন্য জনপ্রিয়। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন এখানে রঙিন মাছের একটি ঝাঁক আপনার চারপাশে সাঁতার কাটতে এসেছে। প্রকৃতির এরূপ সাহচর্যে দিনের শুরুতেই মন ভরে উঠবে আনন্দে, গলা ছেড়ে গানও ধরতে পারেন।


ঘন্টা খানেক পর আমরা যাত্রা শুরু করলাম কোহ মাই ফাই-র (Koh Mai Phai) উদ্দেশ্যে, এটি ব্যাম্বু দ্বীপ (Bamboo island) নামে পরিচিত। পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্যগুলির একটি এই ব্যাম্বু দ্বীপ। দ্বীপটির জঙ্গলে ঝরা পাতার মধ্যে বাঁশ গাছ রয়েছে, যা থেকে এই দ্বীপের নামকরণ, তবে এখানে প্রচুর অন্যান্য গাছও রয়েছে। এটির চতুর্দিকে বেলাভূমি, সমুদ্রের স্বচ্ছ জলরাশি আপনাকে স্পর্শ করার জন্যে হাতছানি দেবে। আমরাও নেমে পড়লাম, কোহ খই তে সমুদ্রকে স্পর্শ করেছিলাম মাত্র, তবে এখানে সম্পূর্ণ সমুদ্রস্নান। এই জলে বালি নেই, এরূপ অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের জন্যে নতুন ছিল।  

এই দ্বীপের অন্যতম প্রধান কার্যকলাপ অবশ্যই স্নরকেলিং (Snorkeling)!  তবে সমগ্র ফি ফি দ্বীপ জুড়ে স্নরকেলিং উপভোগ্য। কাজেই সাথে স্নরকেলিং মাস্ক রাখা উপযোগী, লাইফ জ্যাকেট স্পীডবোট থেকে পাওয়া যায়। ফি ফি দ্বীপগুলির আরও কিছু হাইলাইট হল আশ্চর্যজনক পিলেহ লেগুন, মায়া উপসাগর এবং একে অপরের পাশে অবস্থিত ভাইকিং গুহা, দ্বীপ কোহ ফি ফি ডন এবং কোহ ফি ফি লেহ, মানকি বিচ এবং অবশ্যই, প্রধান আকর্ষণ হল সাদা বালি এবং স্বচ্ছ জল যা সুন্দর দ্বীপগুলোকে ঘিরে রেখেছে। 

ব্যাম্বু দ্বীপের পর আমাদের স্পিডবোটটি রওনা হলো ফি ফি ডন দ্বীপের (Koh Phi Phi Don) উদ্দেশ্যে, ফি ফি ডন ফি ফি দ্বীপপুঞ্জের (Phi Phi archipelago) মধ্যে সর্ববৃহৎ। এখানে আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজন।মধ্যাহ্ন ভোজনে ছিল বাফেটের আয়োজন, কত কি খাবার, সি-ফুড, পাস্তা, ভাত, ফ্রাইড রাইস, চিকেন, নুডলস, স্যুপ; ডেসার্টে ছিল বিভিন্ন ধরণের ফল, কেক, টার্ট; আর চা-কফি তো ছিলই।  

সারি সারি লং টেল (Long tail boat) বোট দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্রের কিনারে। লং টেল বোটেও ঘোরা যায় দ্বীপগুলি। অনেক পর্যটক ক্র্যাবি থেকে এই বোটগুলি নিয়ে বেড়াতে আসেন। একটু সময় হাতে থাকলে ক্র্যাবি ঘুরে যেতে পারেন।


মধ্যাহ্ন ভোজনের পর কোমর পর্যন্ত জল ভেঙ্গে আমরা স্পিডবোটে চড়লাম। ভাটার কারণে জল কমে যাওয়ায় স্পিডবোটটি একেবারে সমুদ্রের কিনারে আসতে পারেনি। আমাদের গন্তব্য মানকি বিচ (Monkey beach)। এখানে বোটটি সমুদ্রের মধ্যেই দাঁড়িয়েছিল, আর বোট থেকেই সবাই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে নামছিলো। এখনই চোখে পড়বে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন মাছ, স্বচ্ছ জলের মধ্যে ঝাঁক বেঁধে তাদের দ্রুত চলাফেরা লক্ষ্য করতে করতেই সময় কেটে যাবে। 


প্রায় ৪০ মিনিট মতন এই স্থানে থাকার পর স্পিডবোট রওনা হলো মায়া বে-র (Maya Bay) উদ্দেশ্যে। কার্স্ট ক্লিফ, সাদা বালু এবং পান্না সবুজ রঙের জলের মায়া বে বাস্তবিকই ট্রপিক্যাল স্বর্গ। উপসাগরটির সৌন্দর্যের জন্য এখানে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও অভিনীত হলিউড চলচ্চিত্র 'দ্য বিচ'-র (The Beach) শ্যুটিং হয়েছিল।



প্রায় প্রতিটি দ্বীপেই পর্যটকদের জন্য শৌচাগার রয়েছে ৷ সৈকতে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আপনাকে এটি পরিষ্কার রাখতে হবে। সৈকতের সাথে এমন আচরণ বাঞ্চনীয় যেমন আপনি আপনার নিজের বাড়ির সাথে করে থাকেন কারণ প্রকৃতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের, আর এটাই সাস্টেনেবল ট্যুরিজম (Sustainable tourism)।

প্রায় সাড়ে ৫ টা নাগাদ ফুকেট বে-তে আমরা ফিরলাম। ফেরার সময় বোটে সবাইকে আনারস আর তরমুজ খেতে দিয়েছিলো। বোটে সর্বক্ষণ ছিল প্রচুর কোল্ড ড্রিঙ্কস, ভিটামিন সি ওয়াটার, আর ঠান্ডা জল। পর্যটকরা যত ইচ্ছে ব্যবহার করতে পারেন। সকালে যে ভাবে গিয়েছিলাম সেই একই ভ্যানে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হলো আমাদের রিসর্টে। দুর্দান্ত কাটলো আজকের দিনটা। 

আজও আমরা রাতের খাবার তৈরী করবো, আর হাতের কাছেই রয়েছে সুপার মার্কেট, কাজেই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বেড়িয়ে ফিরে এসে আমরা প্রথমে গেলাম মার্কেটে। লাউ, চিংড়ি, কোয়েলের ডিম, বাসমতি চাল কেনা হলো, রুটি (বা টর্টিলা) তো ছিলই। আজকের খাবার সাদা ভাত (বা রুটি), লাউ-চিংড়ি, আর ডিমের কষা। গতকাল বাজার দেখে আমাদের তো মন ভরে গিয়েছিলো, এতো সব্জি যে কতকাল দেখিনি, ঢ্যাঁড়শ, লাউ, কাঁচা পেঁপে, উচ্ছে বিভিন্ন ধরণের শাক, কচু, কি নেই ! কতদিন যে এসকল সব্জি আমরা খাইনি, সবই কিনতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু একদিনে তো সব কিছু কিনে রান্না করা সম্ভব নয়। বাজার করে এসে গতকালের মতন সব কেটে পরিষ্কার করে, রান্নার জন্যে প্রস্তুত করে আমরা আজও সুইমিং পুলে ঘন্টা খানেক কাটালাম। তারপর বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে চা বানানো হলো, চা-বিস্কুট দিয়ে সন্ধ্যেটা পার হলো। বেশিরভাগ সময়টাই কাটলো সারাদিনের নানান ঘটনা স্মৃতিচারণ করে।ইতিমধ্যে রান্না চড়িয়ে দেওয়াও হয়েছে, ঢিমে আঁচে তা পাঁকছে। একটু বেশি করেই সবকিছু রান্না করা হয়েছিল, আগামীকাল আমরা ফুকেট থেকে ব্যাঙ্কক রওনা হবো, আমাদের বিমান বেলা ৪ টে বেজে ৩০ মিনিটে, কাজেই আমরা মধ্যাহ্নভোজন করেই রওনা হবো। 

আর কি ! এবার আজকের মতন বিশ্রাম। পরের পর্বে আসবে আগামীকালের গল্প।

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-২ (Thailand: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বটি পড়ার জন্য ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১

অন্তর্দেশীয় বহির্গমন বিমানবন্দরের তিনতলায় অবস্থিত। পূর্বেই বলেছি এবার আমাদের যাত্রা ফুকেটের উদ্দেশ্যে। বিমানবন্দরে নির্দিষ্ট বিমানের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে, নিরাপত্তা পরীক্ষার পর যখন নির্দিষ্ট দ্বারের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন হাতে বেশ কিছুটা সময় ছিল। মা বাবা'রা কলকাতা থেকে অনেক মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন, কয়েকটির সদ্গতি করে বিমানে চড়লাম। আমাদের সিটগুলি ছিল একেবারে পিছনে। এতে একটা সুবিধা হয়েছিল যে শৌচাগারটি ছিল কাছেই, যদিও তা আমাদের এবারের যাত্রায় বিশেষ প্রয়োজন হয়নি তবে সাথে বয়স্ক লোক থাকলে শৌচাগার হাতের কাছে থাকলে ভালো হয়। মাত্র দেড় ঘন্টার বিমান যাত্রা ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেট। বিমান কর্তৃপক্ষ সংক্ষিপ্ত প্রাতঃরাশ হিসেবে একটি মিষ্টি বান রুটি আর কফি (অথবা চা) দিয়েছিলেন। সাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বিমান প্রায় সমুদ্রকে স্পর্শ করে তার রানওয়েতে সঠিক সময়ে বেলা ৯ টা বেজে ৩৫ মিনিটে অবতরণ করলো।  

ফুকেট পর্বতময় রেনফরেস্টে ঘেরা থাইল্যান্ডের দক্ষিণভাগে আন্দামান সাগরে অবস্থিত দেশটির সর্ববৃহৎ দ্বীপ যা তার সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এই সমুদ্রসৈকত উপভোগ করতে এখানে আসেন। বিমানবন্দরের বাইরে এসে দেখা মিললো এক মহিলার সাথে, আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ১০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের ভ্যান এসে হাজির হলো এবং সাথে আমাদের গাইড বন্ধু পান্যা। মালপত্র যথাস্থানে উঠিয়ে আজ এই ফুকেট শহর ঘুরে দেখবো আমরা। আমাদের প্রথম গন্তব্য পুরাতন ফুকেট শহর। পূর্বের ব্লগে এই দেশটির ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছিলাম আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের সময়ে এদেশের সাথে বৈদেশিক বিশেষত পর্তুগিজদের ব্যবসায়িক  সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। পুরাতন নগরের স্থাপত্যে সেই পর্তুগিজ ঘরানা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। শুধু তাই নয়, এখানে পর্তুগিজ স্থাপত্যের পাশাপাশি চৈনিক স্থাপত্যরীতিও কিন্তু চোখে পড়ার মতন। অসংখ্য ক্যাফে, আর চাইনিজ রেস্তোরাঁ রয়েছে এই স্থানে। আমি যখন চীনে গিয়েছিলাম তখন ফলের দোকানে দুরিয়ান (Durian) দেখেছি, বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার যে শহরে আমি থাকি সেখানে একটি এশিয়ান মার্ট গড়ে ওঠায় সেখানেও এই ফলটি প্রায়ই পাওয়া যায় তবে কখনও তা খাইনি। পুরাতন ফুকেট নগরের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে প্রথবারের জন্যে এই ফলটির স্বাদগ্রহণ করলাম আমরা। এটি খেতে ভালো বা মন্দ কিরূপ, তা আমি এস্থানে উল্লেখ করবো না কারণ প্রতিটা ফল তার স্বাদে স্বতন্ত্র এবং স্থানীয় মানুষদের কাছে তা খুবই উপাদেয়। প্রায় ঘন্টা দেড়েক কোথা থেকে কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না। 


এবার আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে হবে। বেলা প্রায় ১ টা বাজে। আমাদের গাইডবন্ধুটি একটি রেস্তোরাঁয় আমাদের খাওয়ানোর জন্যে নিয়ে যাওয়ার স্থির করেছিলেন।  কিন্তু আমার মনে হলো গতরাতে সবাই জেগে বিমানযাত্রা করেছে, দুই জায়গায় প্রাতঃরাশ হয়েছে বটে কিন্তু ভারতীয় খাবার সবাই আজকে পছন্দ করবে, থাই খাবার পেট ভরে কতটা খেতে পারবে তা নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম না। তাই আমি তাঁকে ভালো একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলাম। একটু দুঃখ পেলেও উনি ব্যাপারটা বুঝলেন। আমরা একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে পৌঁছলাম। আমাদের খাবার ছিল খুবই সাধারণ, ভাত, ডাল, মাছের ঝোল (কারি), পেঁয়াজ-টোম্যাটো-ঢ্যাঁড়শ ভাজা, বাড়িতে পাতা দই- এই দিয়ে সবাই খাওয়া-দাওয়া সারলো। রেস্তোরাঁটি একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের। গল্প করছিলেন কোভিড প্যানডেমিকের (Covid pandemic) ফলে কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পর্যটন নির্ভর শিল্প। 

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'ওয়াট চালং' (Wat Chalong) বা চালং মন্দির (থাই ভাষায় 'ওয়াট' (Wat) শব্দটির অর্থ মন্দির)। এর প্রকৃত নাম 'ওয়াট চাইয়াথারারাম' (Wat Chaiyathararam)। ঊনবিংশ শতকে নির্মিত এই বুদ্ধ মন্দিরটি ফুকেটের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান। ভগবান বুদ্ধের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকরা লুয়াং ফো চাম (Luang Pho Cham) এবং লুয়াং ফো চুয়াং (Luang Pho Chuang) নামক দুইজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে মন্দিরটি দর্শন করতে আসেন। ঔষধি গাছ সম্পর্কিত এঁদের জ্ঞানভাণ্ডার ছিল অপরিসীম এবং এঁরা স্থানীয় মানুষকে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে চাইনিজ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন, তাই আজও এ দেশের  মানুষের কাছে পূজনীয়। সাম্প্রতিকতম মন্দিরটি ৬০ মিটার উঁচু এবং এই মন্দিরটিতে ভগবান বুদ্ধের দেহের একটি হাড় সংরক্ষিত রয়েছে। একেবারে উপরের তলায় পৌঁছলে ছাদ থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণটির একটি অপরূপ ছবি দেখা যায়। 


তিনতলা এই মন্দিরটিতে প্রবেশ করে সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে দেখা যায় দেওয়ালের গাত্রে একের পর এক চিত্র নির্মিত হয়েছে। ভগবান বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন কাহিনী শিল্পী তাঁর কল্পনায় তুলে ধরেছেন। একটি চিত্র আমার চোখকে আকৃষ্ট করেছিল, চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধের ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবৃত্তির জন্যে একটি বানর জঙ্গল থেকে মধুপূর্ণ মৌচাক আহরণ করে এনেছে আর একটি হাতি বাঁশের পাত্রে জল এনেছে (নিম্নের একেবারে ডানদিকের নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন)।

একেবারে উপরের তলায় পৌঁছলে ছাদ থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণটির একটি অপরূপ ছবি দেখা যায়। 

প্রাঙ্গণে একটি ইট নির্মিত চুল্লীর ন্যায় আবদ্ধ স্থান রয়েছে (নিম্নের একেবারে ডানদিকের নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন), ভগবানের উদ্দেশ্যে যে শব্দবাজি ফাটানো হয় তা এর মধ্যে ফাটাতে হয়, উন্মুক্ত পরিবেশে নয়। এর ফলে বাজির আগুন অন্যত্র ছড়িয়ে পরে দুর্ঘটনা ঘটে না, আবার পরিবেশের দূষণও কিয়দংশ কম হয়। 

এ স্থান থেকে চোখ পড়বে দূরে পাহাড়ের উপরে ধ্যানমগ্ন শাক্যমুনি যা 'বিগ বুদ্ধা' (Big Buddha) বলে পরিচিত, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।


চালং মন্দিরের ছাদ থেকে দূরে নাকার্ড (Nakkerd hill) বা নাগাকার্ড (Nagakerd hill) পাহাড়ের উপরে ভগবান বুদ্ধের যে মূর্তিটি দেখেছিলাম তার উচ্চতা ৪৫ মিটার এবং প্রস্থ ২৫.৪৫ মিটার। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে এই ধ্যানমগ্ন ভগবান বুদ্ধের মূর্তিটির নির্মাণ কার্য শুরু হয় এবং আজও এটি চলছে। শুনলাম এটি থাইল্যান্ডের তৃতীয় উচ্চতম বুদ্ধমূর্তি। 


প্রাঙ্গনে রয়েছে অনেক ভাস্কর্য। ভগবান বুদ্ধের শায়িত, দণ্ডায়মান এবং উপবেশন অবস্থানের ভাস্কর্য , এছাড়াও রয়েছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মূর্তি, ধরিত্রী মাতার মূর্তি ইত্যাদি। 


আর দেখলাম গরুড়ের মূর্তি, ভারতীয় মহাকাব্য এবং পুরাণাদিতে বিষ্ণুর বাহন গরুড়, থাই ভাষায় 'খ্র্রুট' (Khrut) নামে পরিচিত, 'খ্র্রুট' এদেশের জাতীয় প্রতীক। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন 'Visa on Arrival' ফর্মটির উপরে এই প্রতীকটি রয়েছে। 


এবার কারোণ (Karon beach) এবং কাটা (Kata beach) সমুদ্রসৈকতের ভিউ পয়েন্ট দেখে আজকের মতন আমরা রিসর্টে পৌঁছলাম। আমরা উঠেছিলাম কাটা ট্রানকুইল ভিলা-তে, রিসর্টটি থেকে কারোণ বিচের দূরত্ব ছিল পায়ে হেঁটে ৫-৭ মিনিট মতন।

আমরা ঠিক করলাম আজ আমরা নিজেরা রাত্রিকালীন আহারের বন্দোবস্ত করবো। আমাদের রিসোর্টটির সামনে ৪০০-৫০০ মিটারের মধ্যেই ছিল শপিং মার্ট 'ম্যাক্রো' (Makro), সবাই মিলে সেখানে গেলাম বাজার করতে। চিকেন, পেঁয়াজ, আদা, শশা, ধনে পাতা, জিরে-ধনের গুঁড়ো, চিকেন মশলা, তেল, নুন, কাঁচা লঙ্কা ইত্যাদি কিনে আনলাম। এবার আর কি? খুব পরিশ্রান্ত আমরা কেউই ছিলাম না, যেটুকু ছিলাম তাও কেটে গিয়েছিলো সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে।  রাতের খাদ্যতালিকায় ছিল রুটি (আমরা টর্টিলা নিয়ে গিয়েছিলাম), চিকেন, স্যালাড, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা আঁচার আর মিষ্টি । 

এবার বিশ্রাম, আগামীকাল আমাদের আন্দামান সাগরের বিভিন্ন দ্বীপ ঘোরার কথা।

জুলাই, ২০২৩ 

থাইল্যান্ড: পর্ব-১ (Thailand: Part-1)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

ইতিপূর্বে ভুটান (এ বিষয়ে আমি একটি ভ্রমণ কাহিনী 'দিন তিনেকের ভুটান' লিখেছিলাম যেটি 'আমাদের ছুটি' অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল) ছাড়া যে সকল দেশ আমি ভ্রমণ করেছি তা সর্বদা কর্মসূত্রে। প্রায় দীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর পর কয়েকদিনের ছুটিতে সপরিবারে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ড। আগামী কয়েকটি পর্বে আমি আমাদের এই ভ্রমণ কাহিনীটি বিস্তারিত লিখব। 

প্রথমে থাইল্যান্ড দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত প্রায় ৫১৩১২০ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্রফলের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র এই দেশটির জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭০ মিলিয়ন। দেশটির উত্তরে রয়েছে মায়ানমার এবং লাওস, পূর্বে লাওস এবং কম্বোডিয়া, পশ্চিমে মায়ানমার, দক্ষিণে দেশটির লম্বা একটি উপদ্বীপীয় (Peninsula) অঞ্চল রয়েছে আর তারপর রয়েছে মালেশিয়া। উপদ্বীপীয় অঞ্চলটির পশ্চিমে রয়েছে আন্দামান সাগর।   

আমরা, আমি আর আমার স্ত্রী, যাব দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Incheon International Airport) থেকে। ১ নম্বর টার্মিনাল থেকে রাত্রি ৮ টা বেজে ৪০ মিনিটে (কোরিয়া সময়) থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (Suvarnabhumi International Airport) উদ্দেশ্যে আমাদের বিমান যাত্রা শুরু করলো। প্রায় ৫ ঘন্টা ১০ মিনিটের বিমান যাত্রা, থাইল্যান্ড সময় পরদিন ভোর সাড়ে ১২ টায় আমাদের অবতরণ সঠিক সময়ানুসারেই হয়েছিল। এই বিমানবন্দর দিয়ে অগণিত বার আমি যাতায়াত করেছি বটে তবে এই দেশটা দেখার সুযোগ এইবার প্রথম।  


বিদেশে ভ্রমণের প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়টির অবতারণা হয় তা হলো ভিসা। এই ভিসা বা অনুমতি পেতে আবেদনকারীকে উপযুক্ত সময়ে সেই দেশের নিয়ম অনুযায়ী ভ্রমণের কারণ, যাতায়াত এবং থাকবার ব্যবস্থা, নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে প্রমাণ সহ বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হয়, এবং সকল বিষয় সেই দেশের নিয়মাবলীকে পরিতৃপ্ত করলে ভিসা পাওয়া যায়। কয়েকটি দেশ আবার ভারতবাসীকে পৌঁছনোর পর ভিসার জন্যে আবেদনের সুযোগ দিয়ে থাকে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড অন্যতম। দেশটি ভারতীয় নাগরিকদের পর্যটনের উদ্দেশ্যে ১৫ দিনের জন্যে 'Visa on Arrival' প্রদান করে থাকে। যদি কোনো ভারতীয় পর্যটক ১৫ দিনের অধিক থাইল্যান্ডে থাকতে চান তবে তাকে পূর্বেই ভিসার জন্যে আবেদন করতে হবে। থাইল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর 'Visa on Arrival' ফর্মটি পূরণ করতে হয়। এই জন্যে কয়েকটি ডকুমেন্টের প্রয়োজন হয়, তা এখানে উল্লেখ করলাম।

(১) থাইল্যান্ডের থেকে ফেরার বিমানের টিকিট, 

(২) থাকবার স্থানের (পর্যটকদের ক্ষেত্রে হোটেলের) সংরক্ষনের প্রমান, 

(৩) জনপ্রতি ১০,০০০ থাই বাত (Thai Baht) (পরিবার প্রতি ২০,০০০ থাই বাত), 

(৪) নিজের একটি ফোটোগ্রাফ (৬ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪ সেন্টিমিটার প্রস্থ) প্রয়োজন। 

বিমানবন্দরে অবতরণের পর চলার পথে লক্ষ্য করলেই দিক নির্দেশ চোখে পড়বে, দিক নির্দেশ অনুসরণ করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় "Visa on Arrival' স্থানটিতে। অতএব বিমান থেকে অবতরণের পর প্রথম কর্তব্য 'Visa on Arrival' ফর্মটি সঠিকভাবে পূরণ করে কাউন্টারে সেটি জমা করা, অফিসার ফর্মটি পরীক্ষা করে ভিসা আবেদনের মূল্য (আমাদের জন প্রতি ২২০০ থাই বাত লেগেছিলো) জমা করতে বলবেন। তারপর ঐদেশের ইমিগ্রেশন নিয়মানুসারে আঙুলের ছাপ এবং চোখের স্ক্যান করে পাসপোর্টে ভিসা স্ট্যাম্প এবং অনুমতি সাপেক্ষে দিনসংখ্যা উল্লেখ করে স্ট্যাম্প করে দিলেই আপনি দেশটিতে প্রবেশ করতে পারবেন। 

ভিসা পাওয়ার পর আমরা মোবাইল ফোনের সিম নেওয়ার জন্যে আবেদন করেছিলাম, পদ্ধতিটি খুবই সহজ, একাধিক কাউন্টার রয়েছে সিম নেওয়ার, যে কোনো একটিতে গিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী (৮ দিনের জন্যে ১৫ GB ২০০ থাই বাত, আর আনলিমিটেড ইন্টারনেটের জন্যে ৪৯৯ থাই বাত) সিম নেওয়া যায়, পাসপোর্টের ফটোকপি এবং আবেদনকারীর চিত্র দুই-ই দোকানের কর্মী তুলে নেবেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা এই কাজ দু'টি সপন্ন করে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করার স্থানে পৌঁছলাম। আমার এবং আমার স্ত্রীর মা-বাবা আসবেন কলকাতা থেকে, তাঁদের বিমান পৌঁছনোর সময় ভোর ৪ টে বেজে ১০ মিনিটে। এবার অপেক্ষা, বিমানবন্দরে অপেক্ষা করার স্থানটিতে পৌঁছে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্যে।  

তবে এই অবসরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নিই।

'সুবর্ণভূমি' নামের অর্থ স্বর্ণের ভূমি বা সোনার দেশ। শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ থেকে। শুধু এই শব্দটি নয়, এখানে প্রচলিত অনেক শব্দ কিন্তু ভারতীয় ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়, কখনও উচ্চারণ রীতিটি একটু আলাদা। যেমন মনুষ্য (Manushyo) এখানে মানুথ (Manuth), গজ (Gaja) এখানে খজ (Khaja), দেবী (Devi) এখানে তেয়ি (The yi), চাঁদ (Chand) এখানে চান (Chan), তারা (Tara) হলো দারা (Dara), রাজা (Raja) হয়েছে রাচা (Ra chaa), ভাষা (Bhasha) হয়েছে পাষা (Pa sha) ইত্যাদি। থাই মানুষের অভিবাদন 'স্বাদিকাম' আর ভারতীয়দের 'স্বাগতম'-র  ভাষাগত নৈকট্য কিন্তু লক্ষ্যণীয়। কোথাও বেশ ভালো লাগছে না ! বেশ নিজ নিজ অনুভূতি, আর হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় আছে কাজেই এই দেশের ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যেতেই পারে। কোনো স্থান সম্বন্ধে জানতে হলে তার ইতিহাস, সংস্কৃতি জানা অপরিহার্য বলেই আমার মনে হয়। এখানে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক যা আমাদের এই ভ্রমণের সাথে বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। 

বর্তমান থাইল্যান্ডের পূর্বের নাম ছিল শ্যামদেশ। এই 'শ্যাম' নামটির উৎপত্তি খুঁজতে গেলে দেখা যায় শব্দটি সংস্কৃত বা পালি ভাষা থেকে এসেছে বলে বোধ হয়। দেশটির ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ইত্যাদির উপর ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে নান চাওয়ের 'তাই' (Tai) জনজাতির মানুষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূখণ্ডে আসেন এবং খমের সাম্রাজ্যের (Khmer Empire) অধীনে তাঁদের বসতি স্থাপন করেন। ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রী ইন্দ্রাদিত্য খমের সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে সুখোথাই (Sukhothai Kingdom) রাজত্ব গঠন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটিই প্রথম থাই রাজত্ব বলে বিবেচিত হয়। 'থাই' কথাটির অর্থ এখানে 'মুক্ত' (Free), আবার 'তাই' জনগোষ্ঠীর নামানুসারেও 'থাই' নামটি আসে। এর পরবর্তী কালে সুখতাই রাজত্বের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তা ছড়িয়ে পরে লাওস, বার্মা এবং মালাক্কা উপদ্বীপে, মূলত সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি হয়েছিল ভ্যাসাল স্টেট (Vassal state: একটি ভাসাল রাষ্ট্র এমন যে কোনো রাষ্ট্র যার একটি উচ্চতর রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের প্রতি পারস্পরিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে) গঠনের মাধ্যমে। সুখোথাই রাজত্বের রাজারা বিদেশী শক্তির (যেমন চীনের ইউয়ান রাজবংশের সাথে) সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এরপর সুখোথাই রাজত্বের ভ্যাসাল স্টেটগুলি যখন বিদ্রোহ শুরু করে তা আর পুনর্গঠন করা এই রাজত্বের পক্ষে সম্ভব হয়নি, বরং আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে বিরোধী শক্তির কাছে। এর মধ্যে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য (Ayutthaya Empire) গড়ে ওঠে। ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমগ্র সুখোতাই রাজত্বের অবসান ঘটে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য ওই অঞ্চলের বৃহৎ শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সুখোথাই যেমন ভ্যাসাল স্টেট গঠনের মাধ্যমে নিজের পরিধি এবং শক্তি বৃদ্ধি করেছিল, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য কিন্তু তা করেনি, বরং এই সাম্রাজ্য ছিল সামগ্রিকভাবে রাজতন্ত্র নির্ভর। এই 'আয়ুত্থায়া' নামটির সাথে ভারতবর্ষের 'অযোধ্যা' নামটির সাদৃশ্য রয়েছে। শুধু অযোধ্যা নামের সাদৃশ্য নয়, ভারতবর্ষের মহাকাব্য রামায়ণ এখানে 'রামাকিয়েন', থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ। আমাদের 'রাজা রাম' এখানে 'ফ্রা রামা'। 'রামাকিয়েন' শব্দটির অর্থ 'রামের গৌরব' (Glory of Rama)। এই সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পর্তুগালের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। পর্তুগিজদের উচ্চারণে 'শ্যাম' পরিণত হলো 'সিয়াম' (Siam) এ। তখন পর্তুগাল মালাক্কা উপদ্বীপ দখল করেছে এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের স্থানীয় থাই রাজত্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। থাই রাজত্বও এর ফলে উপকৃত হতো, কাজেই ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। এর ফলে একাধিক ট্রিটি (Treaty) স্থাপন হয়েছিল, যেমন ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং পর্তুগালের মধ্যে, আবার বেশ কয়েক দশক পরে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জাপানের সাথেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, মিশনারীদের আগমনে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব লক্ষ্যিত হলে পরবর্তী প্রায় দেড় শতাব্দী ইচ্ছানুসারে থাই সাম্রাজ্য বিদেশী সম্পর্ক থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখেন। 

১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলো বার্মিজ-সিয়ামিজ যুদ্ধ, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয় এই যুদ্ধে, রাজধানী আয়ুত্থায়া ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বার্মিজদের হাতে। আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের কমান্ডার ফ্রায়া তাকসিন (Phraya Taksin) বার্মিজদের অবরোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করেন এবং নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। থনবুরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং চীনের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। তবে তাকসিন যে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া রাজত্বের অন্যতম কমান্ডার জেনারেল চাও ফ্রায়া চাকরি (Chao Phraya Chakri) রাজসিংহাসন থেকে রাজা তাকসিনকে অপসারণ করে চাকরি রাজবংশের (Chakri Kingdom) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় তাঁরা রাজধানী ব্যাঙ্ককে স্থানান্তরিত করেন। আজও থাইল্যান্ডে চাকরি বংশ রাজত্ব করছেন এবং রাজধানী ব্যাঙ্কক। পরবর্তীতে অনেক কাল অতিবাহিত হয়েছে, ঘটনার পরম্পরা এই দেশকে আজ উন্নত দেশে পরিণত করেছে, তবে সে ইতিহাস সবিস্তারে এই ভ্রমণ কাহিনীতে বিশেষ প্রাসঙ্গিক নয়।

আমাদের সারা রাত বিমানবন্দরের অপেক্ষার স্থানে পার হলো, দেখলাম মা-বাবা'দের বিমান সঠিক সময়ে অবতরণ করেছে। এবার ওঁরা বিমানবন্দরের সব কাজ শেষ করে বাইরে আসবে। এখানে একটু কিছু প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যাবো অন্তর্দেশীয় বহির্গমনের উদ্দেশ্যে। আমাদের বিমান সকাল ৮ টা ৫ মিনিটে, ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেট।

জুলাই, ২০২৩

কিচেন গার্ডেন (Kitchen Garden)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


ছোটবেলায় দিদাকে দেখছি কাঁচা রান্নাঘর সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত আর্দ্র অঞ্চল থেকে থানকুনি পাতা তুলে আনতে। পেটের রোগে ভুগলে থানকুনি পাতা পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো, হয়তো এখনও হয়। পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হলেও থানকুনি পাতা বাটা খুবই সুস্বাদু একটি খাদ্য। আবার গ্রামাঞ্চলে মানুষ ক্ষেত, খামার, পুকুর ঘাট, খালবিলের আশপাশ থেকে শাকপাতা তুলে আনতো, আমিও এক আধবার মামাবাড়িতে গেলে দিদির সাথে কালীপুজোর  আগের দিন চোদ্দ শাক তুলতে গিয়েছি। 'কিচেন গার্ডেন' কথাটির বিশেষ ব্যবহার তখন হতো না। আসলে কোনো কিছুর অনুপস্থিতি তার গুরুত্ব বোঝায়। তখনও নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা আজকের অবস্থায় পৌঁছয়নি। সকলেরই বাড়িতে একটু আধটু জায়গা, উঠোন ছিল, মানুষ তাতে বিভিন্ন ধরণের সব্জি লাগাতেন, বেশিরভাগ সময়ে তা এমনিই ফেলে দেওয়া সব্জি বা ফলের বীজ থেকে জন্মাতো, পরিচর্যা বিশেষ লাগতও না। ঘরের চালে কুমড়ো, চালকুমড়ো, লাউ, কিংবা উঠোনে লঙ্কা, লেবু, এমনকি বাড়ির পিছনে কচু, বিভিন্ন ফলের গাছ যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল, বেল, নারিকেল ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যেত। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতেও নানান ফলের গাছ ছিল। যেহেতু, এই সকল সুবিধে সহজেই প্রাপ্ত হতো, এর গুরুত্ব তখন অতটা উপলদ্ধি হয়নি। এখন শহরাঞ্চলে এক চিলতে মাটি সহজে পাওয়া যায় না, শহর কেন্দ্রিক সভ্যতায় আজ বড়ো বড়ো গগনচুম্বি অট্টালিকাগুলি আজ মুখ্য ভূমিকায়, মাটি কংক্রিটাবৃত। বাড়ির উঠোন, বাগান আজ অমিল আর তাই 'কিচেন গার্ডেন'-র গুরুত্ব এখন উপলব্ধি হচ্ছে। বাড়ির সংলগ্ন এই বাগানগুলি হারিয়ে যাওয়ার রেশ কিন্তু মানুষের পুষ্টির উপর এসে পড়ছে। যেমন বাড়ির চালে হয়ে থাকা কুমড়ো ভিটামিন A প্রদান করে, বেড়ার গায়ে যে লাউটা হয়ে থাকে তাতে প্রচুর পরিমানে ফোলেট বা ফলিক অ্যাসিড (Folate/ ভিটামিন B9) থাকে, আবার ওল বা কচুতে রয়েছে অনেক ক্যালসিয়াম (Calcium), এগুলো কিন্তু এমনিতেই পাওয়া যেত। পুকুর ধারে হয়ে থাকা নানান শাকগুলোতে মিনারেল আর ভিটামিনের প্রাচুর্য্য উল্লেখযোগ্য (অনুগ্রহ করে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক পড়ুন)।

চাল, গম, মূলত শর্করা জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে; ডাল, মাছ, মাংস প্রোটিন সরবারহ করে; তৈলবীজগুলি তেল বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে। এই হলো তিন প্রকার বৃহৎ জাতীয় পুষ্টি উপাদান যা ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Macro-nutrient) নামে পরিচিত। অপরপক্ষে, শাক-সব্জি, ফল হলো মিনারেল এবং ভিটামিনের অন্যতম প্রধান উৎস, এরা মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Micro-nutrient) নামে পরিচিত। এই সকল অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলি পুষ্টি নিশ্চয়তার জন্যে একান্ত প্রয়োজন, যা অনেক সহজেই গৃহ সংলগ্ন বাগান থেকে পাওয়া যেত এবং এগুলি বাজার থেকে ব্যয় করে ক্রয় করার প্রয়োজন হতো না। কাজেই ব্যবহারিক জীবনে বিনামূল্যে পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ খাবার পাতে এসে পৌঁছতো।    

সাধারণভাবে, সভ্যতায় নগরকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পেলে অধিক মানুষ গ্রাম থেকে নগরে বসবাস শুরু করে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ চিত্র বর্তমান। কৃষক, পশুপালক, কামার, কুমোর, ছুঁতোর সকলে যারা গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদন্ড ছিল, তারা ক্রমে 'ভালোভাবে' বাঁচার আশায় কর্মসংস্থানের সন্ধানে শহরে আসতে শুরু করেন, গ্রামের অপেক্ষাকৃত খোলামেলা বাগান, উঠোন সহ ঘরের পরিবর্তে শহরের ছোট ছোট গায়ে গায়ে লাগানো ঘর। সকল কিছুই সেখানে বাজার থেকে পয়সা খরচ করে আহরণ করতে হয়। এদিকে শহরও আয়তনে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তার আশেপাশের ভূমির তথা বাস্তুতন্ত্রের চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বনাঞ্চল পরিষ্কার করে নগর আয়তনে বৃদ্ধি পায়। বনের শুকনো কাঠ জ্বালানির জন্যে, বনের ঘাস পশুখাদ্যের জন্যে, পাতা সারের জন্যে, বাঁশ, গোলপাতা ঘর বানানোর জন্যে, বনের ফল-মূল-মধু খাওয়ার জন্যে - এসকলের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করে একটা পরিবর্ত পরিস্থিতিতে উপনীত হয়, অনিবার্যভাবে এঁদেরও আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে নগর। এতদিন যখন সকলেই কিছুটা কিছুটা খাদ্য নিজ নিজ পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করতো আজ সকলেই সম্পূর্ণটার জন্য বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে। অনিবার্যভাবেই পূর্বের সাধারণ চাষী বর্তমানে পরিণত হয়েছেন বাজার-চালিত কৃষকে, সেই সকল উৎপাদনে মানব সভ্যতা মনোনিবেশ করেছে যা অধিক মুনাফা দেয়, মাত্র কয়েকটি খাদ্যের উপর আজ জোর দেওয়া হচ্ছে, ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে খাদ্য বৈচিত্র।     

আজকে যখন আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে খাদ্যের বৈচিত্র পুষ্টি নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে অপরিহার্য, ততদিনে অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। একসময় যা সহজলভ্য ছিল, উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে যা হেলায় হারিয়েছি তা আজ প্রকৃতই দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এই বিষয়ে বর্তমানে অনেকগুলি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্কুল কিচেন গার্ডেন। প্রধানত এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য স্কুল কিচেন গার্ডেন স্থাপন করার মাধ্যমে, ছাত্র-ছাত্রীদের এর ফলে উৎপন্ন সব্জি ফল ইত্যাদি খাওয়ার ফলে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাব পূরণ হবে, তাঁদের শাক-সব্জি ফলানোর অভিজ্ঞতা লাভ হবে, এবং শাক-সব্জি ইত্যাদির পুষ্টি বিষয়ে তাঁরা জ্ঞানলাভ করবেন এবং জাঙ্ক-ফুডের (Junk food)  ক্ষতিকারক দিকগুলি সম্বন্ধে সচেতন হবেন। কিচেন গার্ডেনের প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজ্য ভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।বাড়িতে কিচেন গার্ডেন করলে তা যেমন খাদ্যের বৈচিত্র বাড়াবে, পুষ্টির অনিশ্চয়তা দূর করার হাতিয়ার হবে, তেমনি এটা অতিরিক্ত আয়ের একটা পথও হয়ে উঠতে পারে।

শঙ্করপুর (Shankarpur)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে গিয়েছিলাম তাজপুর-শঙ্করপুর-দীঘা বেড়াতে। তাজপুর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একটি ব্লগ আমি পূর্বে লিখেছি। আজকের ব্লগে আমি শঙ্করপুর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা লিখবো। 

ভ্রমণপিপাসু বাঙালীর কাছে কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থিত দীঘার সমুদ্র সৈকত একটি নস্টালজিয়া।সপ্তাহান্তে চলে আসাই যায়। অনেকে এখন একটু অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে পছন্দ করেন, আমার কিন্তু আজও দীঘা অত্যন্ত প্রিয়। 

ছোটবেলার দীঘার স্মৃতি আজও উজ্জ্বল, তখনও বঙ্গোপসাগরের সৈকতে আজকের মতন মেরিন ড্রাইভ গড়ে ওঠেনি, ঝাউবন হারিয়ে যায়নি, ট্রেন লাইন পাতা হয়নি, নতুন দীঘা গড়ে ওঠেনি, আসে পাশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলিও আজকের মতন বিকশিত হয়নি। তখন হাওড়া বা ধর্মতলা থেকে বাসে করে দীঘা পৌঁছতে হতো, যা এখন পুরোনো দীঘা বলে পরিচিত। মোবাইল এবং ইন্টারনেট নির্ভর জীবনযাত্রা তখনও গড়ে ওঠেনি, কাজেই বাস স্ট্যান্ডে নেমে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন হোটেল দেখেশুনে ঘর নেওয়াই ছিল প্রচলিত প্রথা, সৈকতের উপরে হলে তো কথাই ছিল না। তবে অনেকে আগে থাকতেই ঘর রিসার্ভ করেও আসতেন। তারপরেই সমুদ্রে ছোটা, সমুদ্রস্নান সেরে, রেস্তোরাঁগুলিতে খাওয়া বা কখনও মনের মতন মাছ রাঁধিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারা, একটু দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রাম, আবার সমুদ্রপাড়ে বসে উপভোগ করা, রাত্রে ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে যে সরুপথ চলে গেছে তা ধরে হোটেল থেকে সমুদ্রপাড়ের রেস্তোরাঁতে খেতে আসা, এইভাবে দিন দু'য়েক কাটিয়ে আবার ফিরে আসা দৈনন্দিন ব্যস্তময় জীবনে। তারপর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, দীঘার পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছে, সৈকত কেন্দ্রিক এই পর্যটন বর্তনীটি (দীঘা-শঙ্করপুর-তাজপুর-জুনপুট-মন্দারমনি) আজ খুবই জনপ্রিয়। এখন দীঘা গেলে বেশিরভাগ মানুষ শংকরপুর, মন্দারমণি, তালসারি, তাজপুর, উদয়পুর সৈকত ইত্যাদি স্থানগুলো ঘুরে আসেন। 

আমরাও তাজপুর থেকে গিয়েছিলাম শঙ্করপুরে। তাজপুর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শংকরপুর সমুদ্র সৈকতে পৌঁছতে সময় লাগে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। আর সেখান থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দীঘা। শঙ্করপুর পশ্চিমবঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য মৎস বন্দর কেন্দ্র। শঙ্করপুর সৈকত তুলনামূলকভাবে এখনও কম জনবহুল।
 

সমুদ্র সৈকতে রয়েছে কয়েকটি দোকান, দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসেছেন, ঝিনুক দিয়ে বানানো বিভিন্ন দ্রব্য, চাবির রিং, শঙ্খ, কাঠের গাড়ি, পুতুল ইত্যাদি আরও হরেক জিনিস। পায়ে পায়ে মৎস বন্দরের দিকে এগিয়ে এলাম, অনেক ট্রলার দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি, এগুলি মাছ ধরার ট্রলার। ট্রলার থেকে পাটাতন নামিয়ে রাখা হয়েছে তীরে, সেই পাটাতন বেয়ে বিরাট বিরাট বরফের চাই মাথায় নিয়ে কর্মীরা উঠে যাচ্ছেন ট্রলারে। অত্যন্ত ব্যস্ত দিন, কয়েক হাজার মানুষ এই মাছ ধরার কাজে যুক্ত, এতেই তাঁদের জীবনধারণ হয়। বছরে প্রায় ১০ মাস চলে মাছ ধরার কাজ, দুই মাস এপ্রিল মাসের মধ্যবর্তী সময় থেকে জুন মাসের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ওই সময় মাছের সংখ্যা যেন বৃদ্ধি পেতে পারে সেইজন্যে মাছ ধরা বন্ধ থাকে। 


এবার এই মৎস বন্দরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাছের প্রজাতির উল্লেখ করি (আমি পূর্বের একটি ব্লগ 'বাঙালির আহারে মাছ'-এর উপরে লিখছি)। এখানে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই বলি কন্ড্রিকথিস (Condrichthyes: যে সকল মাছের দেহে অস্থি অনুপস্থিত, এদের দেহে তরুনাস্থি (Cartilage) বর্তমান) শ্রেণীর কথা। এই শ্রেণীর অন্তর্গত উপশ্রেণী হলো এলাসমব্র্যাংকি (Elasmobranchii)। এদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এদের পাঁচ থেকে সাত জোড়া গিল বর্তমান যা বাইরের দিকে উন্মুক্ত, পৃষ্ঠদেশের পাখনা দৃঢ় হয়ে থাকে, এবং দেহে ছোট ছোট প্ল্যাকোয়েড আঁশ উপস্থিত। এই উপশ্রেণীর অন্তর্গত মাছের দেহে সুইম ব্লাডার থাকে না। এদের মুখের অভ্যন্তরে দাঁতের একাধিক সিরিজ রয়েছে। হাঙ্গর, রে ইত্যাদি এই উপশ্রেণীর অন্তর্গত প্রজাতি। ব্ল্যাকটিপ হাঙ্গর (Carcharhinus limbatus), স্পেডনোজ হাঙ্গর (Scoliodon laticaudus), দুধ হাঙ্গর (Rhizoprionodon acutus), ধূসর স্টিং রে (Dasyatis zugei), হানিকোম্ব স্টিং রে (Himantura uarnak) ইত্যাদি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।হাঙ্গর বা রে বাঙালির পাতে খুব উপাদেয় বলে গণ্য না হলেও বাইরে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। হাঙ্গরের লিভার থেকে প্রাপ্ত তৈলের ঔষধিগুণ রয়েছে, যা ফার্মাসিউটিকাল শিল্পে ব্যবহৃত হয়। কয়েক প্রকার হাঙ্গর এবং রে মাছের লিভার থেকে প্রাপ্ত তৈলের ব্যবহার চর্মশিল্পেও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও মাছের খাদ্য বা ফিশমিল (Fishmeal) এবং সার (Manure) প্রস্তুতিকরণে এই মাছগুলি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এরপর আসি অস্থিযুক্ত মাছের কথায়, যা অস্থিকথিস (Osteichthyes) শ্রেণীর অন্তর্গত। এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত একটি উপশ্রেণী হলো একটিনটেরিজি (Actinopterygii), যাদের রে-ফিন্ড ফিশ (Ray-finned fish) বলা হয়। ইল (Eel) হলো এই প্রকার মাছ, যা এই বন্দরের একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক মাছ। ইলের জীবনচক্র খুব কৌতূহলোদ্দীপক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের জীবনচক্রে ক্যাটাড্রোমাস (Catadromous) প্রকার লক্ষিত হয়, অর্থাৎ মিঠা জল (Fresh water) থেকে স্পনিং (Spawn) এবং ডিম পাড়ার জন্যে এরা সমুদ্রের নোনা জলে স্থানান্তরিত হয়। ডিম ফুটে যে চ্যাপ্টা এবং স্বচ্ছ লার্ভা বের হয় তার মাধ্যমে ইলের জীবন শুরু হয়, এদের লেপ্টোসেফালি (Leptocephali) বলা হয়। এরা সাধারণত সমুদ্রের পৃষ্ঠতলের ভাসমান জৈব পদার্থের কণা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।  এর পর এরা গ্লাস ইলে (Glass eel) রূপান্তরিত হয়, এই পর্যায়ে তারা মিঠা জলের দিকে ধাবিত হয়। এরপর যথাক্রমে এলভার (Elver), হলুদ ইল (Yellow Eel) হয়ে তারা পরিণত সিলভার ইলে (Silver Eel) রূপান্তরিত হয়। পরিণত সিলভার ইল স্পনিং এবং ডিম পাড়ার জন্যে আবার সমুদ্রের নোনা জলে ফিরে যায়। একটিনটেরিজি (Actinopterygii)-র অন্তর্ভুক্ত ওপর একটি ফ্যামিলি ক্লুপেডি (Clupeidae)। বাঙালির রসনা তৃপ্ত করে যে ইলিশ তা এর অন্তর্গত। বিভিন্ন প্রজাতির ইলিশ (Hilsa ilisha, H. toli, Ilisha kampeni, I. megaloptera ইত্যাদি) এই বন্দরের উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক মাছ। এদের জীবন চক্রে কিন্তু ইলের বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এরা এনাড্রোমাস (Anadromous) প্রকৃতির, অর্থাৎ স্পনিং-র জন্যে এরা সমুদ্রের নোনা জল থেকে মিঠা জলে স্থানান্তরিত হয়। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমানে এনকোভি (Anchovy; Family- Engraulidae), সামুদ্রিক ক্যাট ফিশ (Sea Catfish), উল্ফ হেরিং (Wolf Herring; Family- Chirocentridae) ইত্যাদি। এখানে উল্লেখযোগ্য লোটে বা লোইট্যা (Harpadon nehereus), বাঙালির আর এক রসনা তৃপ্তকারক এই মাছ। এর প্রচলিত নাম বোম্বে ডাক (Bombay Duck/Bombay Daak)। এই নামকরণের পিছনের কাহিনীটি বেশ মজার। তখন বোম্বের (বর্তমানের মুম্বাই) মৎসবন্দরগুলোতে বিপুল পরিমানে এই লোটে উঠতো। লোটে বাঙালির খুবই উপাদেয়।  রেলগাড়ি চালু হওয়ার পর মেল ট্রেনের (Mail train) মাধ্যমে তা সুদূর বোম্বে থেকে কলকাতায় এসে হাজির হতো। বাংলায় 'মেল/Mail' শব্দটির অর্থ ডাক, অতএব এর নাম হয়ে গেলো বোম্বে ডাক। এখানে অপর দু'টো উপাদেয় মাছ ব্ল্যাক পমফ্রেট (Black pomfret, Parastromateus niger; Family- Carangidae) এবং সিলভার পমফ্রেটও (Silver pomfrets, Pampus argenteus, P. chinensis) উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায়।

বেশ কিছুক্ষন শঙ্করপুরে কাটিয়ে আমরা রওনা হয়েছিলাম দীঘার উদ্দেশ্যে। 

অক্টোবর, ২০১৭

পুষ্টি সুরক্ষা ও আমাদের সমাজের কিছু চিত্র (Nutrition Security and Society)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আমি পূর্বে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-১: সূচনা ব্লগটিতে বর্তমান ভারতবর্ষে পুষ্টি বিষয়ক চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমান ব্লগে ব্যবহারিক জীবনে খাদ্য বা পুষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা অংশ তুলে ধরার একটা প্রয়াস করবো। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন চিত্র। তা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাহিনী নয়। চরিত্র নামকরণ অপ্রয়োজনীয় কারণ এটি কোনো গল্প বা উপন্যাস নয়, বাস্তবের উপর ভিত্তি করে কিছু কাল্পনিক কাহিনী/ ভাবনা/ সংলাপ, যা থেকে সহজে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য এবং পুষ্টির স্থান অনুমান করা যাবে। আসলে খাদ্য এবং পুষ্টির সুরক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির পাশাপাশি আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কিছু সচেতনতা ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পুষ্টির সুরক্ষাকে দ্রুততর করে।  সেই রকম কয়েকটি দিক তুলে ধরতেই আমি এই কাল্পনিক সমাজচিত্রটির অবতারণা করলাম এই ব্লগে।

-------------------------------------------------------

'আগে বললেই পারতে, কিছুটা তুলে রাখতে বলতাম, অতটা খাবার নষ্ট হতো না'

অশীতিপর বৃদ্ধ বক্তার উদ্দেশ্যে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকায় বছর ত্রিশের অতিথি যুবক। গৃহের অন্য সদস্যরা হা হা করে ওঠেন, 'আরে না না, কি হয়েছে! আগে থেকে কি ঠিক বোঝা যায়, তুমি কিছু মনে করো না বাবা, ওনার তো বয়স হয়েছেইত্যাদি।

যুবক মনে মনে ভাবলেন, বৃদ্ধ বড়ই খিট্খিটে, কারোর বাড়িতে এলে এরকম কথা কেউ অতিথির উদ্দেশ্যে বলে নাকি! যাইহোক, আমতা আমতা করে প্লেটটি সরিয়ে রাখলেন। আবার গল্প গুজব চলতে থাকে। নানান কথা, ছুঁয়ে যায় একটার পর একটা বিষয়, চলচ্চিত্র-রাজনীতি-খেলা-সমাজ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি কি নেই সেখানে। একের মুখ থেকে কেড়ে আরেক মুখ কথা বলে ওঠে, সেখানে তথ্য-তত্ত্ব কিছুমাত্রায় ঠাঁই পায় বটে, তবে কল্পনা, ধারণা, নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার এক রমরমা আজকাল বড়ই চলছে। অতিথি নির্দিষ্ট সময় পার করে চলে যান, সবাই খুব ব্যস্ত আজকাল, তারমধ্যে সময় বের করে সকলের খোঁজ নিতে এসেছে সে, সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় অতিথির। এর মধ্যে কেউ একজন অর্ধেক খাবার পূর্ণ প্লেটটি টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।  রান্না ঘরের পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় গোটা দুয়েক তরকারি লেগে যাওয়া লুচিঅবশিষ্ট তরকারি আর দেড়খানা রসগোল্লা। বৃদ্ধ তাঁকিয়ে দেখেন। এমন ভাববেন না বৃদ্ধ গরীব, সে আর তাঁর পরিবার উচ্চ মধ্যবিত্ত। একটু বাদে আহ্নিক সেরে বৃদ্ধ তাঁর ঘরের ইজি চেয়ারটায় এসে বসবেন, চিনি ছাড়া চা আর দু'টো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট আসবে তাঁর জন্যে। দিনে দু'বার চা খান বৃদ্ধ, সকালে গ্রিন টি আর সন্ধ্যায় এমনি প্রচলিত চা, যাকে ব্ল্যাক টি বলে। তবে এই যে স্বাচ্ছন্দ্য, বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যায়ে পৌঁছনো সেই দীর্ঘ পথ কিন্তু মসৃন নয়, সেখানে অগণিত না খাওয়া রাত রয়েছে, আক্ষরিক অর্থে দু'মুঠো ভাত খেয়ে দিনাতিপাত রয়েছে, মুখ ফুটে খাবার চেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে বসে থাকার মুহূর্তগুলো রয়েছে, খাবারের আশায় ক্রোশের পর ক্রোশ পথ চলা আছে, আবার এর মাঝে কখনও জুটে যাওয়া কিছু ভালো খাবার আর তা নিয়ে উল্লাস রয়েছে। বৃদ্ধ ভাবেন, সেই সময়কার কথা, তাঁদের জীবনধারণের কথা, সে অনেকটা সংগ্রামের মতন শোনায়, বৃদ্ধ অনেক গল্প বলেন তাঁর নাতি নাতিনীদের, সবই আবর্তিত হয় নিজের জীবনের  কথা, তাঁর শৈশব, বড়ো হওয়া, কর্ম জীবন, ইত্যাদি। সবাই যে বোঝে তা নয় আবার বোঝে যে না তাও নয়। তবে কারা ভালো বোঝে, সে বোঝা দায় ! 

এই যে মেয়েটি প্রত্যেকদিন ঘরের কাজ করতে আসেন ওঁর মেয়েকে স্কুলে দিয়েছে, দাদার সাথে সেও যায়, রোজ স্কুলে খেতে দেয়, ও বলছিলো একবেলার জন্যে ও নিশ্চিন্ত। আবার পুজোর ফুল বাজারে যার কাছ থেকে নেওয়া হয়, ও বলছিলো ছেলেটাকে স্কুল পাঠিয়ে পড়াশুনা আর দুপুরের খাওয়াটা দু'টি বিষয়েই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। এঁরা হয়তো বোঝেন।

এই চিত্র আবার বৃদ্ধের প্রতিবেশী বাড়িটির ক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা। ওঁদের থেকে বৃদ্ধ কথায় কথায় শুনেছে ওঁদের বাড়ির ছেলেটা রোজ স্কুলের মিড ডে মিলের খাবারটা খায়না, মাঝে মাঝে খায়, ডিম দিলে সেটা নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। ওঁরা কেক, চিপস এসব দিয়ে দেন টিফিনে।

বাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার করতে এসেছে একটা লোক, দুপুরে বৃদ্ধের বাড়িতে খেতে দেওয়া হয়েছিল, সাধারণত এসকল লোককে নিরামিষই দেওয়া হয় কিন্তু সেদিন বাড়িতে মুরগির মাংস একটু বেশি পরিমানেই রান্না হয়েছিল, দু'টুকরো লোকটাকে দেওয়ায় তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, তা বৃদ্ধ লক্ষ্য করেছিলেনখাবারের অভাব এও হয়তো বোঝে।

'তোমার ঘরে কে কে আছে?'

'বৌ, এক ছেলে আর এক মেয়ে বাবু'

'ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়াশুনো করাচ্ছ তো?'

'আজ্ঞে!' একটু আমতা আমতা করে বলে 'আসলে গত দু'বছরে তেমন কিছু রোজগারপাতি ছেলো না, তাই মেয়েটা মায়ের সাথে কাজের বাড়ি যায়।

বৃদ্ধ বলে ওঠেন, 'বলো কি ! স্কুল ছাড়িয়ে দিলে?'

'না বাবু, আবার যাবেখন, মানে স্কুল ও তো বন্ধ ছেলো, তাই ......, তা যাবেখন আবার, গেলি তো খাওন টাও পায়।'

বৃদ্ধ বোঝে, কিন্তু কি বলতে হবে সেটা বোঝেন না !    

বাড়িতে হৈ হৈ পরে যায়। বৃদ্ধের বড়ো নাতি এসেছে, কর্মসূত্রে সে প্রবাসীকাজেই সকলে ঠিক করলো বাইরে খাবে। তবে এখন বাইরে বেড়ানোটা বেশ অসুবিধাজনক, প্যানডেমিকের কারণে একটা উদ্বেগ থেকেই যায়। অবশেষে ঠিক হলো খাবার আনিয়ে নেওয়া হবে যার যা ভালো লাগে, সবাই নিজের নিজের মতন অর্ডার দিলো, বিরাট আয়োজন। কেউ ফ্রাইড রাইস, কেউ বাসন্তী পোলাও, কেউ সাদা ভাত, আবার কেউ বিরিয়ানি। কেউ মাটন কষা, কেউ রেজালা, কেউ চিকেন বাটার মশালা, আবার কেউ পনির মশালা। আরও কত কি! কেউ কিন্তু নিজের সমস্ত খাবার এবেলায় শেষ করতে পারলো না। বৃদ্ধকে সকলে কথা দিলো, রাতে অবশিষ্টাংশ খেয়ে নেবে তবে তা আর হয়নি, অবেলায় এতো কিছু খেয়ে রাতে কেউ খাবার মুখেই তুলতে পারলো না। আগেরবার, মানে দু'বছর আগে কিন্তু এমনটা হয়নি, সেবার সবাই মিলেমিশে অর্ডার দিয়েছিলো, মানে এক প্লেট পোলাও দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, আবার এক প্লেট মাটন দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, এতে পুরোটাই খেতে পেরেছিলো, নষ্ট হয়নি         

বৃদ্ধ কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন। সেখানে একাধিকবার সে বিভিন্ন পার্টিতে যোগ দিয়েছে, ওখানে অনেকটা খাবারের এমন রীতি, অনেক খাবারের আয়োজন হয়। রেঁস্তোরা থেকে যখন বেরোয় কত খাবার পাতেই পড়ে থাকে।  বৃদ্ধের, তখন সে যুবক, মুখ থেকে কতবার আক্ষেপ সূচক বাক্য নিঃসৃত হয়েছেএকবার সাহেব বন্ধু বলেছিলেন, 'আরে এই খাবার বাঁচলে কি পৃথিবীর খাদ্য সংকট মিটে যাবে নাকি?' যুবক কিছু বলেননি, শুধু তাঁকিয়ে থেকেছেন আর ভেবেছেন কয়েক বৎসর পূর্বের তাঁর জীবনের কথা। এখানে এতো খাবার নষ্ট হয় আর এমন মানুষও আমাদের সমাজে ছিলেন যারা ফসল তোলার পর মিনতি করতে আসতেন, বাবু যদি তাঁদের আজ্ঞা দেন তবে তাঁরা মাঠে পরে থাকা শস্য সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে পারেন। প্রবাস জীবনে বাজার করতে গিয়েও তিনি অভিজ্ঞতা করেছেন সেদেশে সকল বস্তুই নির্দিষ্ট ওজন করা প্যাকেটে বন্দী, ঠিক যতটা লাগবে ততটা কেউ ওজন করে নিতে পারবেন না (আমাদের দেশের বাজারের মতন), কাজেই অধিকাংশ সময়ে অতিরিক্ত পরিমান বস্তু বাজার থেকে নিয়ে আসতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে তা পচে নষ্ট হয়।  

কি রে ওটা কি রাখলি? এক খানা ডিম নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’ কাজের মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন গৃহকত্রী।

‘আর বোলো না গো মা, ছেলেটা মোটে নিরিমিষ মুখে তুলতে চায় না, তাই আর কি করি, এই এক খান ডিম নিয়ে যাচ্ছি, ভেজে দেবোখন, ভাত দু'টি খাবে।’ উত্তর দেয় মেয়েটি।

তা এক খানা নিলি যে বড় ! বোনটার জন্যে নিলি না ?’

না গো, ও বড় লক্ষ্মী, ও খেয়ে নেয় যা জোটে।’ 

আচ্ছা, বুঝেছি, বলে এক খানা ডিম ফ্রিজ থেকে এনে দেন মেয়েটির হাতে, বলেন দুই ভাইবোনকেই ভেজে দিস।

বৃদ্ধ দেখছিলেন। ভাবছিলেন কয়েক দশক আগের কথা, যখন রাত্রের আহারে তিনি একা মাছের টুকরো খেতেন, বিধবা মা আর স্ত্রী খেতেন ভাত-ডাল আর যেদিন যা তরকারী থাকতো তাই। বাইরে কাজের জন্যে কোন সকালে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন রাত্রে, তাই টানাটানির সংসারে দু'বেলা যা কিছু উত্তম জুটতো তা তাঁর পাতেই জায়গা পেতো। এই নিয়ে অবশ্য মা বা স্ত্রীর কোনো আফসোস ছিল না। তাঁরা তো বাড়িতেই থাকতেন, সমস্ত ঘর পরিষ্কার, রান্না করা, কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া, ইত্যাদি কত শত কাজ, তবে সবটাই বাড়িতে, কাজেই তাঁরা 'অধিক' পরিশ্রম করে যিনি সংসার টানছেন বলে মনে করতেন তাঁকেই ভালোটা পরিবেশনের জন্যে সচেষ্ট থাকতেন।  

তবে প্রথমবার যখন তাঁর স্ত্রী মা হয়েছিলেন, তখন মা এবং সন্তান বেশ ভুগেছিলেন। মেয়ে সন্তানের ওজন হয়েছিল অনেক কম, জ্বর, ডায়রিয়া ইত্যাদির সাথে লড়তে লড়তে বাচ্চাটা প্রায় বিছানায় মিশেই গিয়েছিলো। ডাক্তার অনেক বাকাবকি করেছিলেন। এই সকল ভোগান্তি অপুষ্টিজনিত বলেছিলেন, বৃদ্ধ (তখন যুবক) বুঝেছিলেন কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস ততদিনে পদোন্নতি হয়েছিল তাইতো অনেক ডাক্তার হসপিটাল করে কোনো মতে মা মেয়েকে সুস্থ্য করে ঘরে এনেছিলেন। সে প্রায় বছর পঞ্চাশের আগের কথা, এখন তো খুকীর ছেলেই কত বড় হয়ে গেছে ! তারপর তো মা চলে গেলেন। অফিস থেকে তাঁকে পশ্চিমে পাঠালো। জীবনে এক ধাক্কায় অনেকটা পরিবর্তন এলো। খুকী খুবই ঘ্যান ঘ্যান করতো ছোটবেলায়, সে ওই দেশে কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া শুরু করলো, দিদিমণিদের পরামর্শে খুকীকে কাউন্সেলিং করানো হলো, ধীরে ধীরে বেশ চনমনে হয়ে উঠলো  সে। তারপর তাঁদের একটি ছেলে হলো, ডাক্তার স্ত্রীর মেডিকেল হিস্ট্রিতে সিজার দেখে একটু চিন্তিত হলেন।  যাইহোক এবার পূর্বের ন্যায় পরিস্থিতি হলো না, তবে সেবারও স্ত্রী সিজারের মাধ্যমেই পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।

এসকল ভাবছিলেন বৃদ্ধ, তখন নাতি ঘরে প্রবেশ করলেন। বৃদ্ধ তাকালেন, দৃষ্টিটা একটু পরিষ্কার হলে প্রশ্ন করলেন, 'হ্যাঁ রে তুই যে দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছিস' ! নাতি হেসে উত্তর দিলো 'সেডেন্টারি লাইফ গো দাদু, সারাদিন বসে বসে কাজ, জগৎ সংসার এগিয়ে চলছে আর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে উৎপন্ন করছে এই অপুষ্টিগত পরিনাম' বলে থামে সে।

তা কতদিন ছুটি পেলি?

আর ছুটি..’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে পেয়েছি দু'দিনের, তার সাথে রবিবার 

বাব্বা, কাজের তো বড্ড চাপ ! তা খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকে করিস তো?

হ্যাঁ সেটা করি, বেশিরভাগ দিন দুপুরে অফিসেই বিরিয়ানি না হয় সিজওয়ান ফ্রাইড রাইসের একটা প্লেট আনিয়ে নিই, বাড়িতে রাতে হালকা কিছু ধরো রুটি আর মাংস বা পনিরের কিছু একটা আর টক দই। খাওয়া নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা নেই

নাতি আরো বলে ও যেখানে বাসা ভাড়া নিয়েছে, তার সামনে বেশ কতগুলো দোকান রয়েছে, পিজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, মোমো, পাস্তা সব কিছুই সেখানে সহজলভ্য। নাতির মধ্যে কি যেন খোঁজে বৃদ্ধ, হয়তো নিজের তরুণ অবস্থাকে, নাতিকে দেখতে পুরো তাঁরই মতন। এই বয়সে তাঁর নিজের কি অবস্থা ছিল, কিভাবে যে বেঁচেছিল অসহায় মাকে নিয়ে সেটাই সে বুঝতে পারে না। দিনের পর দিন ভাত, এখান-ওখান তুলে আনা কলমি শাক ভাজা খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া, এই ছিল তাঁদের দিনাতিপাত। ডাল-ভাত-তরকারি-মাছ সহযোগে পরিপূর্ণ আহার তাঁদের কাছে তখন ছিল চাঁদ হাতে পাওয়ার মতন, তা সম্ভব হতো যদি কেউ নিমন্ত্রণ করতেন তবে মা'র মুখে কোনোদিন তেমন সুখাদ্য তুলে দিতে পারেননি বৃদ্ধ। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে নাতির ডাকে, দাঁড়াও আমি আসছি বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক বাদে, হাতে তখন আলুর চিপস আর এক গ্লাস কোল্ড ড্রিঙ্কস। নাতিকে খেতে বারণ করে বৃদ্ধ, পরক্ষণে কি মনে হয় আবার বলে আসলে একটু এসব কম খাস মনে মনে হিসেব করে, পয়সা যখন ছিল না আর যখন হলো আসলে ঠিক কতটা পার্থক্য হলো ?  

কাজের মেয়েটি আবার আসে পড়ন্ত বিকেল বেলায়। ও রেশন নিয়ে কার্ড ফেরত দিতে এসেছে। গৃহকত্রী রান্না ঘর থেকে বলেন দাদুর কাছে রেখে যেতে। বৃদ্ধ হাসিমুখে কার্ডগুলো রেখে দেয়। 'দাদু কি হয়েছে? হাসছ যে'! 'না রে, আসলে ভাবছি কত মানুষের মুখে অন্ন উঠছে, একি আর মুখের কথা রে দিদিভাই' 

দাদু ওঁকে বলেন নাতিকে ডেকে দিতে। মেয়েটি নাতিকে ডেকে দিয়ে চলে যায়। দাদু বলে তোর ল্যাপটপ টা আন তো, দু'জনে মিলে একটা সিনেমা দেখি, আজ দেখবো মৃনাল সেন পরিচালিত 'আকালের সন্ধানে' আর কাল দেখবো সত্যজিৎ রায় পরিচালিতগুপী গাইন বাঘা বাইন'

এই দু'টো বাছলে কেন?

আচ্ছা.....তবে তুই বল। না থাক, আছে তো আরও তবে আগে এই দুটোই দেখি

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...