পৃষ্ঠাসমূহ

কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় বৃত্তাকার অর্থনীতি (Circular Economy in Agro-food System)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আমরা আমাদের খাদ্যের দিকে একটু তাকাই, দেখবো খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে, তা ব্যবহার হচ্ছে এবং অব্যবহৃত অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা সরলরেখার ন্যায় (Linear economy)। উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste)। কিন্তু এই যে অংশটি ব্যবহার হচ্ছে না, তা উৎপাদন করতেও তো পয়সা লেগেছে। শুধু যে পয়সা লেগেছে, এমনটা নয়, জমি লেগেছে, জল লেগেছে, সার লেগেছে, আবার সেই অতিরিক্ত সার পরিবেশের উপর ঋণাত্মক প্রভাবও ফেলেছে - এ সকলই তো বৃথা গেলো, কোনো উপকার তো হলোই না, বরং অপকার হলো। কাজেই, এই উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste) মডেলটি কার্যকরী হচ্ছে না। তবে কি করতে হবে? এই সরলরৈখিক সম্পর্কটিকে বৃত্তাকার সম্পর্কে (Circular economy) পরিণত করতে হবে। অর্থাৎ কিছু নষ্ট করা চলবে না, পুনর্ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য দিতে হবে। এই বৃত্তের তিনটি অংশ, যথা- সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী উৎপাদন (Sustainable production), সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী ব্যবহার (Sustainable use), এবং পুনর্ব্যবহার (Recycle)।  

সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী উৎপাদন হলো এমন এক উৎপাদন পদ্ধতি যাতে প্রকৃতির উপর অধিক চাপ পড়বে না, প্রাকৃতিক সম্পদের (ভূমি, জল ইত্যাদি) অতিরিক্ত শোষণ হবে না, আবার অতিরিক্ত মাত্রায় ইনপুট (রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হার্বিসাইড ইত্যাদি) প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করবে না। এর প্রধান উপাদান হলো সাস্টেনেবল কৃষি অনুশীলন, যেমন অর্গানিক ফার্মিং, অ্যাগ্রোফরেষ্ট্রী, ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (Integrated Pest Management), উপযোগী সেচ ব্যবস্থা, বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি, অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার না করা ইত্যাদির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা (অনুগ্রহ করে পড়ুন বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা)। একথা সঠিক যে, এর জন্যে গবেষণা এবং পরিকাঠামোর প্রয়োজন। পেস্ট কীটের জীবন চক্র পর্যালোচনা করে, যাকে ফেনোলজি বলা হয়, কোন সময়ে আধিক্য হবে তা সহজেই নিরূপণ করা যায় এবং রাসায়নিকের উপযুক্ত মাত্রা নির্ধারণ করাও কঠিন নয়, কাজেই এর মাধ্যমে অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সহজেই হ্রাস করা যায়, এবং প্রকৃতির উপর এর কুপ্রভাবগুলিকে এড়ানো সম্ভব। আজ অনেক অঞ্চলে অতিরিক্ত সারের ব্যবহারের ফলে মৃত্তিকার অবনমন ঘটেছে, এরূপ ঘটতে থাকলে ভবিষ্যতের খাদ্য উৎপাদন প্রশ্নের সামনে পড়বে। কৃষিক্ষেতে যেমন জলের প্রয়োজন, ঠিক তেমনই অতিরিক্ত জল অপ্রয়োজনীয়। তাই যতটুকু জল প্রয়োজন ঠিক ততটুকু জলই ব্যবহার করা উচিত, এই কারণে উন্নত সেচের ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন, এতে ফলনের কোনো ঘাটতি হবে না আবার জলের অপচয়ও বন্ধ হবে। এই সকল কার্যসাধনের জন্যে নীতি (Policy) নির্ধারণ প্রয়োজন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন কৃষি নীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় এই বিষয়ে আমাদের দেশ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীতি প্রণয়ন করেছে যার মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চাই যোজনা, ক্ষুদ্র সেচ তহবিল গঠন ইত্যাদি।

আরবান কৃষি (Urban agriculture) একটি খুবই উপযোগী পদ্ধতি, এর মাধ্যমে খাদ্য তথা পুষ্টি নিশ্চয়তা যেমন একাধারে বৃদ্ধি পায় তেমনই পরিবেশের কার্বন সিকোয়েস্ট্রেট (Carbon sequestrate) করতেও গাছগুলি সাহায্য করে। সাস্টেনেবল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন। কৃষক কোঅপারেটিভ গড়ে তুলে কিংবা কমিউনিটি সমর্থিত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলে সাস্টেনেবল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। 

এর পর আসি সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী ব্যবহারে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এক্ষেত্রে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে আর সব কিছুর সাথে সাথে খাদ্যেরও বিশ্বায়ন হয়েছে, যদিও আমাদের খাদ্য তালিকায় যেরূপ পিজ্জা বা বার্গার প্রবেশ করেছে সেরূপ বিদেশে কোনো স্থানে আমাদের খিচুড়ি, বা নলেন গুড় পরিবেশিত হতে আমি দেখিনি (অনুগ্রহ করে পড়ুন আমাদের খাদ্যের পশ্চিমায়ন)। যাইহোক, সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। এখন ক্রেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুষম আহার বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ অবহিত হয়েছেন বা ধীরে ধীরে অবহিত হচ্ছেন। যদিও এর গতি আরও একটু বৃদ্ধি পেলে ভালো হয়। খাদ্যে সকল প্রকার নিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতি নিয়ে মানুষ সচেতন হলে খাদ্যের বৈচিত্র্য বাড়বে, যা প্রকারান্তরে পুষ্টির নিশ্চয়তাকে বৃদ্ধি তো করবেই এবং জীব বৈচিত্র্যকেও সমর্থন করবে। আজ ক্রেতারা অনেক বেশি সচেতন সে কথা পূর্বেই বলেছি, এই সচেতনতা যে কেবল মাত্র খাদ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে তা নয়, খাদ্যটি কিরূপে উৎপন্ন হয়েছে সেটি নিয়েও সচেতনতা রয়েছে।  আজকাল আমরা প্রায়ই বিভিন্ন প্রোডাক্টের লেবেলে 'অর্গানিক' কথাটি লিখে থাকতে দেখি, অনেকে একটু দাম বেশি হলেও সেটি ক্রয় করেন কারণ খাদ্যটির মধ্যে রাসায়নিক দূষণ যেমন তাঁরা পছন্দ করেন না তেমন পরিবেশের দূষণও সচেতন মানুষ পছন্দ করছেন না। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ক্রেতাদের সচেতনতার পাশাপাশি কিন্তু বিক্রেতাদেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমি যখন আমার দেশে বাজার করতে যাই প্রয়োজন মতন শাক-সব্জি কিনতে পারি, কোনোটা সাড়ে সাতশো গ্রাম, কোনটা দেড় কেজি, আবার কোনটা দেড়শো গ্রাম; অর্থাৎ যেটা যতটা লাগে। কিন্তু আমি যখন অন্য একটি উন্নত দেশে বিশাল এক শপিং মার্টে বাজার করার জন্যে উপস্থিত হই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিক্রেতার হিসেবে পূর্ব নির্ধারিত ওজনের দ্রব্যই কিন্তু আমাকে কিনতে হয়, নিজের প্রয়োজন মতন নয়। এতে কোনো দ্রব্য হয়তো ৫০০ গ্রাম প্রয়োজন কিন্তু আমি ১ কেজি নিয়েছি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ব্যবহার না হাওয়ায় সেটি পচে নষ্ট হয়েছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের মতন দেশগুলির খাদ্যদ্রব্য যেটুকু নষ্ট হয় তার অধিকাংশ হয় ফসল তোলার সময়ে। দেশের বাড়িতে বেগুনে পোকা পাওয়া যায় বৈকি, তবে সব্জি ঘরে থেকে পচে যায়না, কারণ বাজার প্রয়োজন অনুযায়ী করা হয়। কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে ফসল তোলার সময়ে নষ্ট হয় না, তা মূলত নষ্ট হয় এইভাবে। 

কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যে একটি বৃত্তাকার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য হ্রাস পরিবেশের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে পুনর্ব্যবহার করার একটি উদাহরণ হল অন্যান্য প্রক্রিয়ার জন্য মূল্যবান ইনপুট তৈরি করতে কৃষি উপ-পণ্যের ব্যবহার। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, শস্য সংগ্রহ থেকে অবশিষ্ট উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ, যেমন ডালপালা এবং পাতা, কম্পোস্টিং এর মাধ্যমে জৈব সার তৈরি করার জন্য পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি শুধুমাত্র ল্যান্ডফিল থেকে এই উপাদানগুলিকে সরিয়ে দেয় না তবে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলিকে মাটিতে ফিরিয়ে দিয়ে পুষ্টির ঘাটতি বন্ধ করে দেয়। ফলস্বরূপ, এটি স্বাস্থ্যকর এবং আরও উর্বর কৃষি জমিকে উন্নীত করে, কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্থায়ী এবং বৃত্তাকার পদ্ধতির সমর্থন করে। এই ধরনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য অনুশীলনগুলিকে বৃদ্ধি করে, শিল্প পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস, সম্পদ সংরক্ষণ এবং আরও স্থিতিস্থাপক এবং সুস্থায়ী খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরিতে অবদান রাখতে পারে।       

আমাদের খাদ্যের পশ্চিমায়ন (Westernization of the Our Diet)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


ইতিপূর্বে খাদ্যের রূপান্তরের সম্বন্ধে একটি ব্লগে আমি সবিস্তারে আলোচনা করেছি। বর্তমানেও এর ধারা অব্যাহত। এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যেমন অর্থনৈতিক উন্নতি বা আয় বৃদ্ধি, নগরায়ন, এবং অবশ্যই বিশ্বায়ন। বর্তমান আলোচনাটি আমি সীমাবদ্ধ রাখবো খাদ্য ব্যবস্থার উপরে বিশ্বায়নের প্রভাবের বিষয়ে।  

বিশ্বায়নের প্রভাব আজকের জীবনে সর্বত্র। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক, পাঠক-পাঠিকা দেখুন তো বিষয়টি পরিচিত কিনা !

দৃশ্য ১- এই তো সেদিন দুর্গাপুজোর শিরনামা (বা ব্যানার) নিয়ে আলোচনার সময়ে জনৈক ব্যক্তি শিরনামাটি বাংলা ভাষায় তৈরী করতে বললেন, তবে মত ভারী হলো ইংরেজী ভাষায় ব্যানারটি লেখার পক্ষে। 

দৃশ্য ২- জনৈক ব্যক্তি তাঁর নিকট এক আত্মীয়র বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন কিন্তু রাস্তায় গাড়ির ভিড় অত্যন্ত বেশি থাকায় দেরি হয়ে যাচ্ছে।  বারবার মুঠোফোনটি বেজে উঠছে, সবাই যে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে, সে গেলে তবে কেক কাটা হবে। 

দৃশ্য ৩- বাড়িতে আজ অনেক বন্ধু-বান্ধব এসেছে। অনেক দিন পরে দেখা-সাক্ষ্যাতের  সুযোগ পেয়েছে সবাই। সবাই ঠিক করলো পিজ্জা আর কোক অর্ডার দেওয়া হবে। 

এরূপ বিভিন্ন দৃশ্য আজ চতুর্দিকে দৃশ্যমান। তবে এর মধ্যে থেকে খাদ্যের বিষয়টিতে আলোকপাত করা আমার উদ্দেশ্য। আজকের নগরকেন্দ্রিক ভারতে পশ্চিমা খাদ্য সংস্কৃতি বেশ চোখে পরে। মানুষের মধ্যে অধিক প্রক্রিয়াজাত খাবার (Ultra-processed foods) এবং পানীয়ের পছন্দ উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ছে। বিশ্বায়নের ফলে দেশগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্য আর সব কিছুর সাথে রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যেরও ভাগাভাগি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, টেলিভিশন শো এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পশ্চিমা খাবারের এক্সপোজার (Exposure) ভারতীয় জনমানসে পশ্চিমা খাবারের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহে অবদান রেখেছে। নগরায়ন এবং যৌথ পরিবারের স্থানে ক্ষুদ্র পরিবারের (Nuclear family) উত্থান ঐতিহ্যগত খাদ্যাভ্যাস (Traditional food habit) পরিবর্তন করেছে। ব্যস্ত শহুরে জীবনধারা প্রায়শই দ্রুত এবং সুবিধাজনক খাবারের (Convenient food) জন্য অগ্রাধিকার দেয়, যার মধ্যে পশ্চিমা-স্টাইলের ফাস্ট ফুড এবং প্যাকেটজাত খাবার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। রেস্তোরাঁ এবং ফাস্ট-ফুড চেইন (Fast food chain) সহ আতিথেয়তা শিল্প (Hospitality industry) পশ্চিমা স্বাদগুলি প্রবর্তন এবং জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা বলাই বাহুল্য। ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি এবং পিৎজা হাট-এর মতো আন্তর্জাতিক ফাস্ট-ফুড চেইনগুলির ভারত জুড়ে শহুরে কেন্দ্রগুলিতে উপস্থিতি রয়েছে। এখানে দু'টি তথ্য উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ভারতে প্রথম ম্যাকডোনাল্ডস রেস্তোরাঁটি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে মুম্বইয়ের বান্দ্রাতে খুলেছিলো। বর্তমানে (২০২২ খ্রিস্টাব্দের কোম্পানিটির রিপোর্ট অনুযায়ী) ভারতে ৫১২ টি ম্যাকডোনাল্ডস রেস্তোরাঁ রয়েছে। অন্যদিকে ভারতবর্ষের ৩৭১ টি শহরে ডোমিনোসের ১৭০১ টি রেস্তোরাঁ রয়েছে (২০২২ খ্রিস্টাব্দ)। এতো শুধু এই কয়েকটি  আন্তর্জাতিক ফাস্ট-ফুড চেইনের পরিসংখ্যান। এর পাশাপাশি বিভিন্ন রাস্তার ধারের স্টলে (Street food stall) বা স্থানীয় রেস্তোরাঁতেও এই সকল খাদ্যগুলি সুলভ। এখানে উল্লেখ্য, ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁগুলিতেও (Fine dining restaurant) প্রায়শই ফিউশন উপাদানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য রন্ধনশৈলীকে মিশ্রিত করে বিভিন্ন স্বাদের জন্য। পাশ্চাত্য উপাদান (Western ingredients/Recipes) এবং রান্নার কৌশলগুলি (Culinary) ক্রমবর্ধমানভাবে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় রেসিপিগুলিতে একত্রিত হচ্ছে। 

ফিউশন রন্ধনপ্রণালী (Fusion culinary), যা ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উভয় রান্নার উপাদানকে একত্রিত করে, জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আজকে "বাটার চিকেন পিজ্জা" বা "ভারতীয় মশলা সহ মশলাদার পাস্তা" এর মতো খাবারগুলিতে প্রায় প্রতিটা শহরেই সুলভ এবং তা আমাদের রসনা তৃপ্ত করে।

এখন প্রশ্ন হলো এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসলাম কেন ? বিশ্বায়ন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় তো ভালো, তবে সমস্যা কোথায় ? আসলে আমার মনে হয় বিশ্বায়নের মূল সূত্রটি গাঁথা 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে'- তে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে')। এখন যদি শুধু নেওয়ার দিক ভারী হয় তবে তা ভারসাম্য হারায়। আহারের বৈচিত্র সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এক প্রকারের আহার্যের ক্রমবর্ধমান চাপে যেন অন্য আহার্য বস্তুগুলি ক্রমে হারিয়ে না যায়, সেটা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। যে প্রকারে আমরা পশ্চিমের খাদ্যবস্তুগুলিকে আপন করে নিয়েছি, এমনকি বেশ কিছুক্ষেত্রে আমাদের স্বাদ অনুসারে মেটামর্ফোস (Metamorphose) করেছি সেই প্রকারে আজ পর্যন্ত কিন্তু আমাদের খাদ্যগুলিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। আমাদের খিচুড়ি, ইডলি, দোসা, নারকেলের তক্তি, চন্দ্রপুলি, পিঠা, আঁচার ইত্যাদি একান্ত আমাদের খাদ্যগুলি নিজেদের মধ্যেই যে শুধু সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে তা নয়, বরং অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন অধিক প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলির সাথে প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়েই পড়ছে। কাজেই এক্ষেত্রে বিশ্বায়নের থেকে পশ্চিমায়নের পাল্লাটি অধিক ভারী হয়ে পড়েছে। এটি সম্ভাব্যভাবে ঐতিহ্যগত রন্ধনপ্রণালীকে (Traditional culinary) ক্ষয় করা এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের সাথে যুক্ত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলিতে অবদান রাখার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। আমাদেরও আমাদের নিজস্ব খাদ্যগুলিকে বিশ্বের সামনে আরও অধিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।

বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা (Ecosystem-based-Adaptation and Food Security)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্বের একটি ব্লগে আমি (বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য) বাস্তুতন্ত্র কিরূপে আমাদের খাদ্য সংস্থান বিষয়ে পরিষেবা প্রদান করে সেই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। এই ব্লগটিতে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে খাদ্য সংকট উৎপন্ন হচ্ছে তার মোকাবিলা বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভর করে কিরূপে করা সম্ভব তার উপর আলোচনা করবো। 

বর্তমান পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তারফলে উত্থিত সমস্যাগুলিকে মোকাবিলা করা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যাগুলির অন্যতম সমস্যা হলো খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া। এখন প্রথম প্রশ্ন জলবায়ু পরিবর্তন কেন হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনভূমি হ্রাসপ্রাপ্ত হওয়া, জলাশয়গুলি বুজিয়ে ফেলা, প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত শোষণ (Overexploitation), স্ট্রিপ মাইনিং, ফ্র্যাকিং ইত্যাদি। এই সকল কারণের ফলে আজ আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। পরবর্তী প্রশ্ন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কি হচ্ছে ? এর ফলে (১) তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে (Increasing temperature), (২) বৃষ্টিপাতের ধরণে পরিবর্তন আসছে (Changing precipitation pattern), (৩) চরম আবহাওয়া জনিত ঘটনাগুলির তীব্রতা এবং সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে (Increasing intensity and frequency of extreme weather events), (৪) জলবায়ুর পরিবর্তনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত (Increasing unanticipated climate variability)। এই যে পরিবর্তন এর প্রভাব কিন্তু আমাদের জীবনের সর্বত্র পড়ছে। আজ এই ব্লগটিতে আমরা আলোচনা করবো খাদ্য নিরাপত্তার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি এবং কিরূপে তার মোকাবিলা করা যায়।  

প্রথমেই উল্লেখ করেছি তাপমাত্রা বৃদ্ধির কথা। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাব্য ফলগুলি হলো ফসলের ফলন কমে যাওয়া, গবাদিপশুর মধ্যে হিট স্ট্রেস, পরাগসংযোগকারী কীট পতঙ্গের ব্যাঘাত ঘটা, ক্ষতিকারক পেস্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, ফসল ও গবাদি পশুর রোগ বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে কিন্তু আবার জলস্তরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কাজেই পৃথিবীর অনেক অঞ্চল আজ জলের তলায় নিমজ্জিত হচ্ছে বা অদূরেই হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। এবার বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তনের ফলে কি কি হচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে অতিবৃষ্টির কথা শুনছি, কখনো অতিবৃষ্টি আর তার ফলে বন্যা তো আবার কখনো অনাবৃষ্টি তথা খরা সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানের কৃষিব্যবস্থা কিন্তু বৃষ্টিনির্ভর (Rainfed agriculture), এখন এই বৃষ্টিপাত যদি সঠিক সময়ে এবং সঠিক পরিমানে না হয় তবে তা যে কৃষিকাজ এবং অবশ্যই ফলনে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে তা বলাই বাহুল্য। পূর্বের তুলনায় চরম আবহাওয়া জনিত ঘটনাগুলির তীব্রতা এবং সংখ্যা বৃদ্ধি প্রতি বছরই চোখে পড়ছে। আর এর ফলে মানুষ ঘরবাড়ি, চাষজমি, গবাদিপশু সবই হারাচ্ছে।  এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। এই যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপদ (Natural hazard) সেগুলি যে বর্তমানে প্রায়ই বিপর্যয়ে (Disaster) পরিণত হচ্ছে তার পিছনেও কিন্তু আমাদের অপরিকল্পিত এবংঅনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাগুলিই দায়ী, যেগুলির উল্লেখ আমি জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছি। এই পরিবর্তনগুলির ধরণ এতটাই অপ্রত্যাশিত হয়ে পড়ছে যে তা আগে থেকে অনুধাবন করা বা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। আশা করি বোঝা গেলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের খাদ্যে তা কি মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে বা ভবিষ্যতে আরও বেশি করতে চলেছে। কাজেই সচেতনতার প্রয়োজনই যে শুধু রয়েছে তাই নয়, উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় এসে গেছে। 

এই ব্যবস্থাগুলি কিরূপ বা প্রশ্ন করা ভালো, এই ব্যবস্থাগুলির ভিত্তি কি? এর ভিত্তি হলো প্রকৃতির ধারণক্ষমতার (Sustainability) উপর সর্বাগ্রে গুরুত্ব আরোপ করা। অর্থাৎ এমন ব্যবস্থা প্রয়োজন যা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করার পাশাপাশি প্রকৃতির ধারণক্ষমতাকেও বিপর্যস্ত করবে না। যেমন ধরো, বনভূমি ধ্বংস করে কৃষিজমি প্রস্তুত হবে না, এমন কৃষিব্যবস্থা যাকে আমরা নিবিড় কৃষি (Intensive agriculture) বলে অভিহিত করে থাকি যা ফলন বা ফসলের উৎপাদনশীলতাকে (Yield) সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় এরূপ ব্যবস্থার থেকে সাস্টেনেবল কৃষিব্যবস্থার (Sustainable agriculture) উপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে, ফসলের স্থানীয় ভ্যারাইটিগুলিকে (Local variety) সংরক্ষণ করা ইত্যাদি। এই প্রকার ব্যবস্থাগুলিকে কিরূপে প্রয়োগ করা যেতে পারে, সেই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় বাস্তুতন্ত্র ভিত্তিক অভিযোজন (Ecosystem-based-adaptation/EbA) খুবই উপযোগী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষকে সাহায্য করার জন্য একটি সামগ্রিক অভিযোজন কৌশলের অংশ হিসাবে জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্র পরিষেবার (পড়ুন বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য) ব্যবহার হলো EbA-র মূল ভিত্তি।


এস্থানে EbA-র কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।       

উদাহরণ ১

যেমন ধরো, কোনো অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই হ্রাস পেয়েছে এর ফলে ওই অঞ্চলের যদি বা জলাশয়গুলিতে জলের পরিমাণ বৎসরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হচ্ছে, এবং এই পরিমাণের পার্থক্য খুবই বেশি হচ্ছে। আগে যেখানে সারা বৎসর মোটামুটি জল থাকতো এবং এর উপর ভিত্তি করে মানুষের জীবন-জীবিকা গড়ে উঠেছিল এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে আবার ওই অঞ্চলের জমি ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পাহাড়ের ঢালগুলি ধীরে ধীরে ভ্রান্ত জমি ব্যবহারের (Inappropriate land management practice) ফলে ধীরে ধীরে অবনমিত (Degradation) হয়ে গেছে, প্রচুর পরিমানে বনাঞ্চল ধ্বংস এবং তার ফলে ভূমিক্ষয় (Soil erosion) এর পিছনে দায়ী। এর মধ্যে আবার ওই অঞ্চলের জমি ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পাহাড়ের ঢালগুলি ধীরে ধীরে ভ্রান্ত জমি ব্যবহারের (Inappropriate land management practice) ফলে ধীরে ধীরে অবনমিত (Degradation) হয়ে গেছে, প্রচুর পরিমানে বনাঞ্চল ধ্বংস এবং তার ফলে ভূমিক্ষয় (Soil erosion) এর পিছনে দায়ী। আবার জনসংখ্যাও দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে, তার একটা চাপ প্রকৃতির উপরে পড়েছে। অপরিকল্পিত ভাবে বসতি অঞ্চল গড়ে উঠায় প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে, যথেচ্ছ জলের ব্যবহার হচ্ছে, বন কেটে বসতি জমি গড়ে উঠছে ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই ওই অঞ্চল বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠছে। বর্ষাকালের সময় অতিবৃষ্টির কারণে প্রায়ই বন্যা হয়, আশপাশের সব ঘর বাড়ি, গবাদি পশু, চাষজমি সব ভাসিয়ে দেয়, তারপর কিছুদিন পর থেকে বৎসরের বাকি সময়ে আর বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না, ধীরে ধীরে জলাশয়গুলো শুকোতে থাকে। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জল পাওয়া যায় না, পাম্প লাগিয়ে ভূগর্ভস্থ জল তুলে তা ব্যবহার করতে হয়, আগে ১০ মিনিট পাম্প চালিয়ে যতটা জল তোলা যেত এখন সেই পরিমান জল তুলতে প্রায় আধ ঘন্টা লাগে। আগে মাছ ধরে যে সকল মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করতো তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাজেই জীবিকাতে একটা পরিবর্তন হয়েছে, কৃষিকাজ ছেড়ে অনেকেই বড়ো শহরে চলে যাচ্ছেন অন্য কর্মসন্ধানে। পূর্বে যারা মৎস্যজীবি ছিলেন তাঁরাও এখন এই পথই অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।  স্বাভাবিকভাবেই ওই অঞ্চল বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠছে। এবার উপায় ? 

উপায় একটা হলো, ওই অঞ্চলের যে সকল কৃষক ছিলেন, তাঁরা এগিয়ে এলেন। প্রথমেই পাহাড়ের ঢালগুলিতে বৃক্ষ রোপণ করা হলো। গাছগুলির মধ্যে স্থানীয় গাছের প্রজাতিগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া হলো। ধীরে ধীরে এগ্রোফরেস্ট্রি সিস্টেম (Agroforestry system) গড়ে তুললেন, ফসলের সাথে সাথে বৃক্ষ রোপণের অনুশীলনের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেলো, জল ধারণ ক্ষমতা বাড়লো,এর প্রভাব ফলনের উপর পড়লো, ফলন বৃদ্ধি পেলো। আর ওই যে পাহাড়ের ঢাল গুলিতে পুনর্বনায়নের (Reforestation) মাধ্যমে ভূমিক্ষয় তো রোধ হয়েই ছিল, এখন অতিবৃষ্টিতে সহজেই ধ্বস নেমে প্রাকৃতিক বিপদ বিপর্যয়ে পরিণত হয় না। তারপর তাঁরা বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করলেন, ফলে ভূগর্ভস্থ জলের প্রয়োজনীয়তা কমল। এই যে স্থানীয় মানুষ নিজেদের সহায়তায় বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবা কে ব্যবহার করে আনসাস্টেনেবল অবস্থা থেকে একটা সাস্টেনেবল অবস্থায় ফিরিয়ে আনলেন, এবং ক্ষয়প্রাপ্ত একটি অঞ্চলকে পুনর্জীবন প্রদান করলেন, এই ব্যবস্থাটাই হলো বাস্তুতন্ত্র ভিত্তিক অভিযোজন।     

উদাহরণ ২

আবার ধরো, একটি ম্যানগ্রোভ অঞ্চল। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যথেচ্ছ বন কেটে ফেলে বাসভূমি গড়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি বেশ কয়েক বৎসরে ধরে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে, পূর্বে পাঁচ দশ বৎসরে একটা প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা হতো, আজকাল প্রতি বৎসরই কোনো না কোনো ঝঞ্ঝা হয়, স্থানীয় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, সব ঠিকঠাক হওয়ার আগেই আবার একটি ঝড় এসে উপস্থিত হয়। এ অঞ্চলে মানুষের জীবিকা বলতে প্রধানত কৃষিকাজ, মাছ ধরা এবং গৃহপালিত পশুপালন ছিল। কৃষিকাজ  ছিল মূলত বৃষ্টি নির্ভর।  জ্বালানির কাঠ-কুটো, ঘর ছাওয়ার পাতা, গাছের খুঁটি ইত্যাদি জঙ্গল থেকেই আসত, গবাদি পশুরাও চড়তো  মাঠে ঘাটে। মৎস্যজীবিরাও স্থানীয় প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখন খুব বৃষ্টি হওয়ার দরুন প্রচুর জমি জলের তলায় চলে গেছে, পশু চারণের স্থান প্রায় নেই বললেও হয়।  তাদের রোগের প্রাদুর্ভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় মানুষ এখন আর পশুপালন করতে পারছেন না, আগে গৃহপালিত গরু, বা ছাগল থেকে দুধ পাওয়া যেত সহজেই, এখন তা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অধিক বৃষ্টিপাত  এবং ঝড় ঝঞ্ঝায় চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, বন্যা হয়ে মাটির চরিত্রে পরিবর্তন ঘটেছে, লবনাক্ত হয়ে পড়েছে, কৃষিকাজও খুব ভালো হচ্ছে না, ফলন কমেছে। এর প্রভাব জন জীবনে পড়েছে, বিশেষ করে তাঁদের খাদ্য ব্যবস্থায়। এখন কি উপায় ? 

একটি সংস্থা এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় একসাথে ৬০ জন স্থানীয় নারী পুরুষকে ম্যানগ্রোভ বনের উপযোগিতা সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ প্রদান করলো। তাঁরা ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গুরুত্ব পরিষেবা সম্পর্কে বিশদে অবহিত হলেন, এর পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বৃক্ষ প্রজাতিগুলির চারা গাছ তৈরী করলেন। সেই চারা গাছ রোপণ করা হলো, ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধার সম্ভব হলো। উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার (Mangrove restoration) ও সংরক্ষণ ঝড়ের জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করলো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলির বিরুদ্ধে একটি বাফার প্রদান করলো, যেমন বন্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করলো, এখন আর এগুলির ফলে কৃষিজমি জলে নিমজ্জিত হয় না, ফসল নষ্ট হয়না ইত্যাদি। এটি মৎস্য চাষকেও সমর্থন করে। বাস্তুতন্ত্র নির্ভর মৎস চাষ এবং কাঁকড়া চাষ সম্পর্কে প্রচার এবং প্রশিক্ষণের ফলে সেগুলি প্রোটিনের উৎস হলো এবং এই চাষগুলি স্থানীয় মানুষদের জীবিকার সাথে যুক্ত হয়ে তাঁদের অর্থ উপার্জনের অন্যতম একটি পথ হয়ে উঠলো। 

উদাহরণ ৩

একটি জলাভূমি অধ্যুষিত অঞ্চল। কিন্তু সম্প্রতি কিছু  বৎসর যাবৎ বৃষ্টিপাতের ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে, বৃষ্টিপাত এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে খরা সৃষ্টি হচ্ছে, জলাশয়গুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আবার প্রায় শুকিয়ে যাওয়া জলাগুলি বুজিয়ে বাসজমি তৈরী হচ্ছে। এইবার জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে এখন বৃষ্টিপাত হলেই বন্যা হয়ে যায় কিন্তু সেই জল ধরে রাখা যায় না। কয়েক বৎসর পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলের মানুষ কৃষিকাজ ও পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন আর সেই ফলন নেই, কৃষিজমিতে প্রয়োজনও পরিমানে জলের জোগান নেই। আবার তাপপ্রবাহের ফলে ফসল নষ্ট হচ্ছে। পশুচারণের মাঠগুলিরও অবস্থা খারাপ, পশুখাদ্যের প্রয়োজনীয় ঘাস তেমন একটা উৎপন্ন হয়না। হিট স্ট্রেসের কারণে গবাদি পশুও মারা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় মানুষের খাদ্য সংস্থানের উপর প্রশ্নচিহ্ন দেখা যাচ্ছে।  এরূপ চলতে থাকলে অচিরেই যে পুষ্টির নিরাপত্তা ব্যাহত হবে তা বলাই বাহুল্য। তবে এখন কি উপায়?

উপায় হলো জলাভূমি পুনরুদ্ধার (Wetland restoration) করা। জলাভূমি পুনর্বাসন জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে, জলের গুণমান উন্নত করতে এবং জলজ প্রজাতির জন্য বাসস্থান সরবরাহ করতে সহায়তা করতে পারে। জলাভূমি বন্যার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক বাফার হিসেবেও কাজ করে এবং কৃষি ও মৎস্য চাষে সহায়তা করতে পারে। জলাশয়গুলো পুনর্নির্মাণের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন অবশ্যই তবে তা ধরে রাখতে কি করা যায়। স্থানীয় মানুষজন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের বিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা করে  ঠিক করলেন এই অঞ্চলে স্থানীয় গাছ লাগাতে হবে, এই গাছগুলিই একদিকে যেমন কার্বন সিকোয়েস্ট্রেট (Carbon sequestrate) করে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকে ব্যালান্স করবে, আবার মাটিতে জল ধরে রাখার কাজও করবে। এর ফলে জলাভূমিগুলি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে, জীব বৈচিত্র আবার ফিরে আসবে আশা করা যায়। খাদ্য সংস্থান সম্ভব হবে।

আশা করি বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন কিরূপে জলবায়ু পরিবর্তনকে সামলে খাদ্য সংস্থান কে নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে তা কিছুটা বোঝা গেলো।

থাইল্যান্ড: পর্ব-৬ (Thailand: Part-6)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ থাইল্যান্ড: পর্ব-৪ থাইল্যান্ড: পর্ব-৫

আজ একটু বেলা করেই উঠলো সবাই। গত কয়েকদিন ধরে বেশ ভোর ভোরই উঠতে হচ্ছিলো সকলকে, আজ একটু বেশিক্ষন বিছানায় কাটানো যাচ্ছে, বেশ লাগছে। গতকাল একটি ফটো আমরা গাড়িতে ফেলে এসেছিলাম, তাই রুডিকে ফোন করে অনুরোধ করলাম সে যেন গতকালের গাড়িটিই আমাদের জন্যে আজকে পাঠায়, সেটিতেই আমরা যাবো পাটায়া। সকালে উঠে চা-বিস্কুট খেয়ে গল্পগুজব চলতে লাগলো। আজকের প্রাতঃরাশও ছিল নুডলস। সাড়ে দশটার মধ্যে আমরা তৈরী হয়ে গিয়েছিলাম, কথা-বার্তা চলছিল। হঠাৎ আমার ঘরের ফোন বেজে উঠলো, ফোনের ওপারে টনি, আমাদের গাড়ির চালক তথা আমাদের ব্যাঙ্কক ভ্রমণের গাইড। তিনি সময়ের পূর্বেই এসে হাজির হয়েছেন। আমরাও দেখলাম অযথা দেরি করে লাভ নেই, কাজেই আমরা লবিতে নেমে এলাম। প্রথমেই নমস্কার করে এক গাল হেসে আমাদের ফেলে আসা ছবিটি তিনি দিলেন। এদেশে আমাদের দেশের মতন দিনের প্রথম সাক্ষ্যাতে  হাত জোর করে প্রণাম করার সংস্কার রয়েছে। আমরা আগেই আজকের বেড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলাম, আমাদের আজকের প্রথম দ্রষ্টব্য স্যাংচুয়ারি অফ ট্রুথ। 

ব্যাঙ্কক ছেড়ে পাটায়ার দিকে চলতে চলতে সহজেই চোখে পড়বে রাস্তার পাশে ছবিগুলি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। গগনচুম্বী অট্টালিকা, বিরাট বিরাট মানব স্থাপত্য কখন অদৃশ্য হয়ে এখন শুধু প্রকৃতি। যখন স্যাংচুয়ারী অফ ট্রুথে পৌঁছলাম তখন প্রায় বেলা ১ টা। আমাদের সকলেই বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিলো। টনি গিয়ে টিকিট আর প্রত্যেকের জন্যে হাতে বাঁধার ব্যান্ড এনে দিলেন, এটি দেখালেই প্রবেশ করা যাবে অভ্যন্তরে।  ভিতরেই একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। আমরা গিয়ে সাগর দেখা যায় এমন একটি টেবিলে বসলাম। এবার খাবার অর্ডার দেওয়ার, সেখানে বিশেষ পরিবর্তন হলো না। তবে পানীয়ের ক্ষেত্রে যে যার পছন্দ মতন অর্ডার দিলো, আমি নিয়েছিলাম ডাব, ভিতরের শাঁসটাও বেশ ভালো ছিল।   

কাষ্ঠ নির্মিত এক বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদের অভ্যন্তরের প্রতিটি ভাস্কর্য কাঠ নির্মিত। প্রচুর পুরুষ-মহিলা একাগ্র চিত্তে হাতুড়ি আর ছেনির সাহায্যে ফুটিয়ে তুলছেন তাঁদের শিল্পকর্ম।  


এরপর আমরা গিয়েছিলাম আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে। এখানে বিশালাকায় একোয়ারিয়ামে রয়েছে বিভিন্ন জলচর প্রাণী। খুব ভালো লাগবে এটি দেখতে। 

এরপর আমরা গিয়েছিলাম পাটায়ার ভিউ পয়েন্টে, পাখির চোখে অপূর্ব পাটায়ার সৌন্দর্য ছিল মনোমুগ্ধকর। 


এর পরের পাহাড়টিতে এই শহরের বিগ বুদ্ধা স্থাপত্যটি রয়েছে তবে সেখানে আমরা এবার যেতে পারিনি, কাজেই এবার আমাদের গন্তব্য আজকের হোটেল, আমরা ছিলাম তেভান জমিতেনে। জমিতেন সমুদ্রসৈকত এখান থেকে হাঁটা পথে প্রায় ১৫-২০ মিনিট। একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। সকলের বেশ খিদে পেয়েছিলো, সৈকতের নিকটেই একটি রেস্তোরাঁ আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল, এর বিশেষত্ব ছিল এটি একটি মাল্টি-কুইসিন রেস্তোরাঁ, এখানে ভারতীয়, বাঙালি, থাই এবং ইউরোপিয়ান সকল ধরণের কুইসিন পাওয়া যায়। রেস্তোরাঁর এম্বিয়েন্সও আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল।  শেফের সাথে আমাদের পরিচয় হলো, উনি বাঙালী, ওঁনার স্ত্রী থাই, পুরো পরিবার একসাথে এই রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করেন। তন্দুরি রুটি, জিরা রাইস, মাছের কারী, চিকেন কারী, আমের লস্যি সব দিয়ে আমাদের ডিনারটা বেশ জমে উঠেছিল। অনেক গল্পও হলো, ওঁদের জীবন, থাইল্যান্ডের জীবন, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।  বারবার উঠে এসেছিলো করোনা-র সময়কালের কথা, সে সত্যই এক সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার কাহিনী।

আজকের মতন বিশ্রাম। আমরা ঠিক করেছিলাম ঘরে গিয়ে সবাই গল্প করবো, কিন্তু তা আর হল না। সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আবার আগামীকাল ভোর ভোর ওঠা ছিল, কারণ আগামীকাল আমাদের এই ভ্রমণের অন্তিম দিন। 

আজ আমরা সবাই সকাল সকাল উঠে পড়েছিলাম। এবার প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যাবো সমুদ্রে স্নান করতে। গত কাল রাত্রে ফেরার পথে সকলের জন্যে নিজ নিজ পছন্দ অনুসারে প্রাতঃরাশ কিনে আনা হয়েছিল। চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আগেই আমাদের আজকের দুপুরের খাবার আলু পরোটা অর্ডার দেওয়াই ছিল, সমুদ্রে স্নান করে ফেরার পথে সেটা নিয়ে আসার কথা। বেরোনোর আগে আমরা খেয়ে বেরোবো।  

এবার ফেরার পালা। সবথেকে বেশি আমরা প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞ। কয়েক মাস আগে যখন পরিকল্পনা করেছিলাম তখন আমাদের মনে বৃষ্টির একটা ভয় ছিল, জুলাই মাসে বৃষ্টি হওয়াটা একেবারেই আশ্চর্য নয়। এমনকি বেড়াতে আসার পূর্বের সপ্তাহটিতে আমাদের ওখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল, তবে প্রকৃতি আমাদের মনোস্কামনা শুনেছিলেন, খুব সুন্দর রৌদ্র ঝলমল আবহাওয়া আমাদের বেড়ানোটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল। বেলা ১২ টার সময়ে আমরা হোটেল ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, নিৰ্দিষ্ট সময়েই বির গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন হোটেলে। গাড়িতে মালপত্র সব তুলে দেওয়া হলো।  পাটায়াকে বিদায় জানিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য ব্যাঙ্ককে সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে অবস্থিত সিয়াম প্রিমিয়াম আউটলেট (Siam Premium Outlet), সবাই জিনিসপত্র দেখা কেনার জন্যে উৎসাহী, কাজেই আমরা এই স্থানে ঘন্টা তিনেক কাটালাম। দোকানগুলিতে ঘোরাঘুরির মাঝে বিভিন্ন ধরণের ফ্রাইড রাইস, আর থাই টি দিয়ে খাওয়াদাওয়া সারলাম। আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ হলে আমরা চললাম সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে, এখান থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ গাড়িতে। 

মা-বাবা দের যে বিমান সংস্থার টিকিট ছিল দেখলাম সেই সংস্থা তাদের বিমান বাতিল করেছে এবং কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থাও করেনি। এরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বড়ই আশ্চর্য করে আমাদের, তবে কি আর করা ! আমরা ওপর একটি বিমানের টিকিট কিনে নিলাম। ওঁদের বিমান ছিল রাত্রি ১১ টা বেজে ৩০ মিনিটে। আমাদের পরের দিনই ভোর ১ টা বেজে ৪৫ মিনিটে। বোর্ডিং, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি সবই ওঁদের আমাদের আগে হয়ে গিয়েছিলো। আমরা তখনও বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে আমাদের প্রক্রিয়া শুরু হলো, যখন ভিতরে গিয়ে মা-বাবা দের সাথে দেখা হলো ততক্ষনে ওঁদের বিমানের সময় প্রায় হয়ে গিয়েছিলো। ওঁরা এয়ারপোর্টে কোনো খাবার খেলো না, ফ্লাইটে ডিনার করবে বললো। একসাথে কিছুক্ষন কাটিয়ে ওঁদের বিমানে ওঠার পর আমরা আমাদের গেটের দিকে এগিয়ে চললাম, পথে একটি দোকানে ডিনার সেরে নিলাম। 

এবার ফিরে চলা, মাথায় ভিড় করে আসছে একের পর এক কাজ। গিয়েই সামনের সপ্তাহে আমাকে যেতে হবে একটি আন্তর্জাতিক ইকোলজি বিষয়ক সম্মেলনে, সেই সংক্রান্ত বেশ কিছু কাজ রয়েছে। বেশ ভালো বেড়ানো হলো। শেষ মুহূর্তে মা-বাবা দের জিজ্ঞেস করেছিলাম এর পর তাঁরা কোথায় যেতে পছন্দ করবে? উত্তর এখনো নিশ্চিত হয়নি, যদি কোথাও যাই নিশ্চয় তা ভবিষ্যতে আমার ব্লগে লেখার চেষ্টা করবো।  

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-৫ (Thailand: Part-5)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ থাইল্যান্ড: পর্ব-৪

আজ আমাদের ব্যাঙ্কক ঘোরার প্রথম দিন। প্রথমে আমরা যাবো ম্যাকলং রেলস্টেশনে (Maeklong Station)। রেললাইনের দু'পাশে পসরা সাজিয়ে বাজার বসেছে।  ট্রেনটি যখন আসে দোকানগুলির উপর থেকে চাঁদোয়াগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়, সংকীর্ণ লাইনটি বেয়ে রেলগাড়িটি স্টেশনে আসে। এই দৃশ্য দেখার জন্যে প্রত্যহ সকালে পর্যটকরা ভিড় করেন, যেমন আমরাও এসেছি আজ। কথা মতন নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ সকাল ৭টায় রুডি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর এক ভাইপোকেও পাঠিয়েছিলেন, আগে থেকে দর্শনীয় স্থানগুলির টিকিট কেটে আমাদের সাহায্য করার জন্য। স্থানীয় বাজারটি ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগে, বেশিরভাগ সব্জি পরিচিত হলেও বেশ কিছু সব্জি, ফল অচেনাও থাকতে পারে। ট্রেন আসার পূর্বেই আমরা যথাস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। স্টেশনের পাশেই রয়েছে সারি সারি রেস্তোরাঁ। চা-বিস্কুট আমরা খেয়েই বেরিয়েছিলাম। এখানে যে যার মতন পানীয় পছন্দ করে কিনলো, কেউ ডাব আবার কেউ ম্যাংগো স্মুদি। ডাব আমার বড়োই প্রিয়, জল তো বটেই, ভিতরের শাঁস টাও ততোধিক প্রিয়। তবে দক্ষিণ কোরিয়াতে ডাব খুব একটা পাওয়া যায় না, কখনও টিনে ডাবের জল পাওয়া যায় বটে কিন্তু তা আমার ভালো লাগে না, কাজেই এই পুরো ঘোরাতেই আমি মন ভরে ডাব খেয়েছিলাম। এবার ট্রেনটি ঢুকছে, লাইনের উপর পর্যটকদের ভিড়, নিজ নিজ দোকানের চাঁদোয়াগুলি দোকানিরা সরিয়ে নিচ্ছেন আর ট্রেনটি এগিয়ে আসছে। বেশ উপভোগ্য এ দৃশ্য। 

ক্রমাগত লাইন থেকে পর্যটকদের সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ বার্তা বাজতে লাগলো, ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করলো। এতক্ষণ ট্রেন আসার ছবি বা ভিডিও তুলতে ব্যস্ত পর্যটকরা এবার ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বলাই বাহুল্য, আমরাও এ আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করিনি। 

এখন থেকে আমরা যাবো দামনেন সাদুকে (Damnoen Saduak)। শহরের মধ্যে দিয়ে কয়েক কিলোমিটার ব্যাপী বয়ে চলেছে একটি খাল, তার দু'পাশে স্থানীয় মানুষের ঘর-বাড়ি, দোকান, আবার কোথাও নৌকা করে বাজারের পসরা সাজিয়ে চলেছে বেচা কেনা, অনেক ভেনিসের মতন। আমরা এখানে নৌকাবিহার করবো। তবে যাওয়ার পথে প্রথমে যাবো নারকেল থেকে গুড় প্রস্তুত করা দেখতে। আঁখি গুড়ের সাথে আমরা ভারতবাসীরা পরিচিত, শীতকালে খেঁজুরের রস থেকে যে গুড় বা পাটালি তৈরী হয় তা তো বাঙালির প্রেম, আবার তালের পাটালিও হয়ে থাকে, তবে নারকেল থেকে গুড় প্রস্তুত করা হয় তা আমি পূর্বে জানলেও  চেখে দেখার সুযোগ এই প্রথম বার, বেশ সুস্বাদু। 

এইবার চললাম দামনেন সাদুকের উদ্দেশ্যে। গাড়ি থেকে নেমে যে পথ দিয়ে নৌকার কাছে পৌঁছলাম তার দু'পাশে কাষ্ঠনির্মিত অনেক ভাস্কর্য রাখা রয়েছে, অধিকাংশই ভগবান বুদ্ধের এবং বৌদ্ধ ধর্মের নানান চরিত্রের। 

একটি নৌকায় ছয়জন, কাজেই আমাদের একটি নৌকা লেগেছিলো। নৌকার পশ্চাদভাগে ইঞ্জিন রয়েছে, নৌকার চালক সেখান থেকে নৌকাটিকে চালাচ্ছেন। সরু খাল বেয়ে অত্যন্ত দ্রুতবেগে চলে এই নৌকাগুলি আর পর্যটকরা তা উপভোগ করেন, নৌকায় যেতে যেতে দেখেন আশপাশের ঘর বাড়ি, বাগান ইত্যাদি, এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আবার প্রতিটি বাঁকের সময় নৌকার গতি ধীর হয়ে যায়, বাঁক ঘুরেই আবার সে গতি বৃদ্ধি করে। নৌকা যাত্রা সব মিলিয়ে প্রায় ২০ মিনিট মতন। 

নৌকা এসে যে স্থানে নামিয়ে দেয়, সেটা বাজার। নৌকা থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে আমরা যখন উঠে আসলাম, তখন দোকানিদের ডাকাডাকি, তাদের পসরা দেখানোর ধুম লেগে যায়। 

একটু এগিয়ে আসতেই দেখলাম, এক ব্যক্তি কয়েকটি বাঁধানো ছবি আমাদের সামনে এসে আমাদের বিক্রি করতে চাইছেন, ছবি দেখে তো আমরা আশ্চর্য। এতো আমাদেরই নৌকাবিহারের ছবি ! নৌকা ছাড়ার একটু পরেই এক ব্যক্তি পাড় থেকে আমাদের ছবি তুলেছিলেন, মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে তা প্রিন্ট করে বাঁধিয়ে বিক্রি করতে এসেছেন। ছবিগুলি আমরা কিনেছিলাম, এক একটা ১৫০ থাই বাত করে নিয়েছিলেন। কাপড়, বিভিন্ন দ্রব্যাদি ইত্যাদির পাশাপাশি এখানে একের পর এক রেস্তোরাঁ রয়েছে। নিজেদের পছন্দের মতন একটি দোকানে গিয়ে বসলাম। সি ফুড ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাইড রাইস, প্রন ফ্রাইড রাইস, স্যুপ ইত্যাদি ছাড়াও এখানে যে জিনিসটা আমাদের সর্বাধিক রসনাতৃপ্তকারক ছিল তা হলো ডাব আইসক্রিম। ডাবের নরম শাঁসের মধ্যে আইসক্রিম, তার উপর চীনাবাদাম, নীল রঙের অল্প ভাত আর একটি ফুল দিয়ে গার্নিশ করা।

এবার আমরা ফিরে চললাম। প্রথম গন্তব্য ব্যাঙ্ককের গ্র্যান্ড প্যালেস। এটি পর্যটকদের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য। মহান গ্র্যান্ড প্যালেস প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে অবস্থিত মহিমান্বিত ভবনগুলির স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ। রাজা প্রথম রামা দ্বারা রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ব্যাঙ্ককে প্রতিষ্ঠান করার সময় ১৭৮২ সালে এই প্যালেসটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ২১৮০০০ বর্গ মিটার ব্যাপৃত প্যালেস প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে রয়েছে রাজসিংহাসনের বাড়ি, প্রসিদ্ধ এমারাল্ড বুদ্ধ মন্দির (The Temple of the Emerald Buddha) সহ অনেকগুলি সরকারি দফতর। 

প্রথম পর্বে এই দেশটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনার সময় উল্লেখ করেছিলাম চাকরি রাজবংশের কথা, যা ইতিহাসে রাত্তানাকসিন রাজত্ব (Rattanakosin Kingdom) নাম পরিচিত। ব্যাঙ্ককের হৃদয়ে অবস্থিত এই মহান প্যালেসটি রাজা চাও ফ্রায়া (Phra Phutthayotfa Chulalok Maharaj) যিনি রাজা প্রথম রামা নাম পরিচিত, থেকে রাজা রামা পঞ্চম পর্যন্ত রাজাদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এই স্থানটি রাজপরিবারের অনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় এবং রাজার অতিথিদের, রাষ্ট্রের অতিথিদের এবং অন্যান্য বিদেশী বিশেষাধিকারীদের স্বাগতের জন্য ব্যবহৃত হয়। গ্র্যান্ড প্যালেসের প্রবেশ পথে অনেক গাইড রয়েছেন, তাঁরা নিজেরাই এগিয়ে আসবেন, তবে কথা বলে গাইডের পারিশ্রমিক ঠিক করে নেওয়া বাঞ্চনীয়। একা একাও এস্থান ঘুরে দেখা যায়, তবে সাথে গাইড থাকলে বুঝে নিতে সাহায্য হয়।   

 

প্রথম পর্বে আমি উল্লেখ করেছিলাম রামাকিয়েন-র কথা। এই কাহিনী রামায়ণের হলেও কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে। ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণের রাজা রাম রামাকিয়েনে ফ্রা রামা (Phra Rama), সীতা এখানে নাং সিদা (Nang Sida), দশরথ এখানে থোৎসারথ (Thotsaroth), রাবণ এখানে তৎসাকান (Totsakan) ইত্যাদি। রামাকিয়েনের কাহিনী অনুসারে মাতা সীতা রাবণের কন্যা, হনুমান বিবাহিত পুরুষ, হনুমান নিজেকে প্রসারিত করে সেতু নির্মাণ করেন ইত্যাদি বেশ কয়েকটি স্থানে বৈসাদৃশ্য লক্ষ্যিত হয়। এই কাহিনী প্রসঙ্গান্তরে সুযোগ পেলে কখনও বিস্তারিত আলোচনা করবো। এই কাহিনীগুলি শিল্পীর কল্পনায় প্যালেসের দেওয়ালে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

এরপর আমাদের দ্রষ্টব্য ওয়াট ফো, যার অফিসিয়াল নাম ওয়াট ফ্রা চেতুফন উইমন মংখলারাম রাজওয়ারমহাভিহান (Wat Phra Chetuphon Wimon Mangkhalaram Rajwaramahawihan)। রাজা রামা প্রথম পূর্ববর্তী মন্দিরটিকে পুনর্নির্মাণ করেন এবং পরবর্তীকালে রাজা রামা তৃতীয় মন্দিরটিকে সম্প্রসারণ এবং সংস্কার করেন। ব্যাঙ্কক শহরের প্রাচীনতম মন্দিরটির নাম ওয়াট ফো এসেছে ওয়াট ফোতারাম (Wat Photaram) বা ওয়াট ফোধারাম (Wat Phodharam) কথাটি থেকে, যা ভারতবর্ষের বোধ গয়ায় অবস্থিত বোধিবৃক্ষের মঠ কে নির্দেশ করে। থাইল্যান্ডের সাথে ভারতবর্ষের দর্শন একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, ভ্রমণের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের মাধ্যমে তা সহজেই অনুভব হয়। চোখে পড়বে চাও ফ্রায়া নদীর ওপর তীরে অবস্থিত অন্য একটি বৌদ্ধ মন্দির হলো ওয়াট অরুন। যখন আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য বার্মিজ আক্রমণে অস্তমিত তখন রাজা তাকসিন থোনবুরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং বৌদ্ধ মন্দির অরুনের পাশে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান। পরবর্তীকালে রাত্তানাকসিন রাজবংশের সূচনায় রাজা রামা প্রথম থোনবুরি থেকে ব্যাঙ্ককে রাজধানী স্থানান্তরিত করলে তিনি বৌদ্ধ মন্দির ফো-র পাশে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করান।  

৮০ বর্গমিটার বিস্তৃত মন্দির প্রাঙ্গনটিতে রয়েছে ফ্রা উবসত (Phra Ubosot), ফ্রা রাবিয়াং (Phra Rabiang), ফ্রা মহা চেদি সি রাজকর্ণ (Phra Maha Chedi Si Rajakarn), এবং রিক্লাইনিং বুদ্ধ (Reclining Buddha) মূর্তি। ফ্রা উবসত (ফ্রা উপোসাথা) বা বট হল  হল, বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত প্রধান অর্ডিনেশন গৃহ এবং প্রাঙ্গণটির সর্বাধিক পবিত্র ভবন। এটি আয়ুথায়-শৈলীতে রাজা প্রথম রাম দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, এবং পরে রাম তৃতীয় দ্বারা রত্নকোসিন-শৈলীতে এটিকে প্রসারিত ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।  ফ্রা উবসত ফ্রা রাবিয়াং দ্বারা ঘেরা প্রাঙ্গনের মধ্যভাগে অবস্থিত।

এই ডাবল ক্লোস্টারে উত্তর থাইল্যান্ডের বুদ্ধের প্রায় ৪০০ টি মূর্তি রয়েছে যা মূলত রাজা রাম প্রথম দ্বারা আনা ১২০০ টির মধ্যে নির্বাচিত হয়েছে। এই বুদ্ধ মূর্তিগুলির মধ্যে ১৫০ টি ডাবল ক্লোস্টারের ভিতরের দিকে, অন্য ২৪৪ টি মূর্তি বাইরের দিকে রয়েছে। এই বুদ্ধের মূর্তিগুলো, কিছু দাঁড়িয়ে আছে এবং কিছু উপবিষ্ট, সমানভাবে সোনালি পাদদেশে মাউন্ট করা হয়েছে। এই মূর্তিগুলি সিয়ামের বিভিন্ন স্থান থেকে আনীত এবং ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালের, যেমন চিয়াংসেন (Chiang Saen), সুখোথাই (Sukhothai), ইউ-থং (U-Thong) এবং আয়ুত্থায়া (Ayutthaya) সময়কালের। মূর্তিগুলিকে রামা প্রথম সংস্কার করেছিলেন এবং এগুলিকে সোনার পাতা দিয়ে আবৃত করে দেওয়া হয়েছিল।      

রিক্লাইনিং বুদ্ধ (ফ্রা বুদ্ধসাইয়াস/ Phra Buddhasaiyas) ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামা তৃতীয় দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এই হেলান দেওয়া বুদ্ধমূর্তি ভগবান বুদ্ধের নির্বাণে প্রবেশ এবং সমস্ত পুনর্জন্মের সমাপ্তির প্রতিনিধিত্ব করে।



ভগবান বুদ্ধ কে নতজানু হয়ে প্রণাম করে এবার আমাদের আজকের মতন ফেরা। অনেক সকালে আমরা বেরিয়েছিলাম। ঘরে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সারাদিনের গল্প, দিনটিকে ফিরে দেখা, এইভাবেই কেটে গেলো সন্ধ্যেটা। ফেরার পথে একটু বৃষ্টি হয়েছিল তবে তা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি। আজ আমরা সন্ধ্যার জলখাবার, রাতের খাওয়া-দাওয়া ঘরেই সেরেছিলাম। চা-বিস্কুট, নুডলস, কেক, মিষ্টি ছিল খাদ্যের তালিকায়। কাল ব্যাঙ্কক থেকে আমরা যাবো পাটায়া। সেই গল্প আসবে আগামী পর্বে। 

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-৪ (Thailand: Part-4)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২ থাইল্যান্ড: পর্ব-৩

আজও ঘুম ভাঙলো ভোর ৫ টায়। আসলে থাইল্যান্ড সময় দক্ষিণ কোরিয়ার সময়ের থেকে ২ ঘন্টা পিছিয়ে, আমার বায়োলজিক্যাল ক্লক অনুসারে আমি বাড়িতে সকাল ৭ টায় উঠি, কাজেই এখানে তাড়াতাড়ি আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।  এতে বেশ ভালোই হয়, ভোর উপভোগও করতে পারি, নিজের কিছু কাজও সারা হয়ে যায়, আবার আগে থেকে বেড়ানোর সব কিছু ঠিকঠাক করে রাখতে পারি। মা বাবা'দের ক্ষেত্রে হচ্ছে এর ঠিক বিপরীত কারণ ভারতীয় সময় থাইল্যান্ডের সময় থেকে আবার দেড় ঘন্টা পিছিয়ে। যাই হোক আজ একটু তাড়াতড়ি সবাই উঠে পড়লো। চা বা কফি, যে যা খাবে তা তৈরী হলো, সাথে বিস্কুট, কেক, মিষ্টি এসব তো ছিলই। তৈরি হয়ে আমরা পৌনে ৮ টা নাগাদ বিচের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আগেই বলেছি পায়ে হেঁটে ৫-৭ মিনিট লাগে কারোণ বিচ, পথে অনেক রেস্তোরাঁর মধ্যে একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁও চোখে পড়লো। তবে সব দোকান, রেস্তোরাঁ এখন বন্ধ, একটু বেলা হলে খুলবে। বিচে পৌঁছে আমরা সোজা সমুদ্রে নেমে পড়লাম। মাঝে মাঝে পারে এসে ঘড়ি দেখে যাওয়া, আবার নেমে পড়া। প্রাণ মন ভরে আমরা দু'ঘন্টা সমুদ্রস্নান করেছিলাম।   

১০ টায় আমরা রিসর্টে পৌঁছলাম। এবার সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি করে ভাত বসানো হলো। তরকারী, ডিমের কষা- ফ্রিজে এসব তো ছিলই, শুধু গরম করে নেওয়া হলো। 

আমাদের গাড়ি এলো বেলা ১২ টায়। এবার আমরা যাব ফুকেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, সেখান থেকে ব্যাঙ্কক। ফুকেটকে বিদায় জানিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বিমান তার যাত্রা শুরু করলো, এবং সঠিক সময়েই ব্যাঙ্ককে অবতরণ করলো। 

যখন ব্যাঙ্কক নামলাম তখনও দিনের আলো ছিল। বাইরেই আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছিলো। আমি আগেই হোটেলে ফোন করে আমাদের চেক ইন সময়টি জানিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা চললাম আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমরা থাকবো ডেস রেস হোটেল এন্ড রেসিডেন্সে। এটি সমুৎপ্রাকার্নে অবস্থিত, ব্যাঙ্ককের এই স্থানটি রেসিডেনশিয়াল অঞ্চল। পর্যটকের জনপ্রিয় অঞ্চল খাওসান রোড বা চায়না টাউন থেকে একটু দূরে এই জায়গাটি। প্রায় সাড়ে ৭ টা নাগাদ আমরা হোটেল এসে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরোলাম রাত্রের আহারের জন্যে। এস্থানে রয়েছে একাধিক খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁ, অধিকাংশ থাই, একটি জাপানিজ রেস্তোরাঁও চোখে পড়লো। আমরা একটি থাই রেস্তোরাঁতে ঢুকলাম, যেহেতু আমরা থাই খাবারের নামগুলির সাথে পরিচিত নই, শেফ এসে আমাদের সাথে আলোচনা করে তারপর অর্ডার নিলেন। আমরা নিয়েছিলাম সি ফুড ফ্রাইড রাইস, প্রন-চিকেন ফ্রাইড রাইস ইত্যাদি।   

আজকের মতন বিশ্রাম। আগামীকাল আমাদের ব্যাঙ্কক বেড়ানো, আগামী পর্বে আসবে সেই কাহিনী। 

জুলাই, ২০২৩        

থাইল্যান্ড: পর্ব-৩ (Thailand: Part-3)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্ব দু'টি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১ থাইল্যান্ড: পর্ব-২

আজ খুব ভোরে, প্রায় ৫ টা নাগাদ, ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। বাইরে তখনও অন্ধকার, বারান্দায় এসে বসলাম, একটু পরে আলো ফুটবে। বেশ ভালো লাগে ভোর হওয়া দেখতে। ৬টা নাগাদ সবাইকে ডেকে দিলাম, প্রাত্যহিক কাজ সেরে ফ্রেশ হয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সাড়ে সাতটায় গাড়ি এলো আমাদের নিয়ে যেতে। আজ আমরা অনেকগুলি দ্বীপ ঘুরে দেখবো, সমুদ্র যাত্রা, সমুদ্রস্নান সবই হবে, কাজেই বাড়ি থেকে স্নান সেরে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।  

ভ্যান আমাদের নিয়ে আরও পর্যটক তুলতে তুলতে ফুকেট মেরিনা বে-তে (Phuket Marina Bay) উপস্থিত হলো। আমাদের নাম পূর্বেই অন্তর্ভুক্ত করা ছিল, গাইড তা পরীক্ষা করে নিয়ে আমাদের প্রাতঃরাশ সেরে নিতে বললেন। প্রাতঃরাশের জন্যে সেখানে নানান ধরণের কেক, বিস্কুট, চা, কফি, ক্যান্ডি ইত্যাদি ছিল। প্রায় আধ ঘন্টা পর আমাদের নির্দিষ্ট স্পিডবোটে ওঠানো হলো। গাইড ইংরাজিতে মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলেন। তিনি প্রথমেই যাত্রীদের স্বাগত করে আমাদের যাত্রার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন।

প্রথমেই আমরা এলাম খই দ্বীপপুপুঞ্জে বা 'কোহ খই'-তে (Koh Khai)। ফুকেটের পূর্বের উপকূল থেকে প্রায় ২৫ মিনিট দূরত্বে এই 'কোহ খই' (থাই ভাষায় 'কোহ' (Koh) কথাটির অর্থ দ্বীপ ) দ্বীপপুঞ্জটি তিনটি দ্বীপ, যথা কোহ খই নাই (Koh Khai Nai), কোহ খই নুই (Koh Khai Nui), এবং কোহ খই নোক (Koh Khai Nok) নিয়ে গড়ে উঠেছে। দ্বীপগুলি তাদের দুর্দান্ত শুভ্র বালুকাময় সৈকত এবং অবিশ্বাস্যভাবে স্বচ্ছ জলের জন্য জনপ্রিয়। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন এখানে রঙিন মাছের একটি ঝাঁক আপনার চারপাশে সাঁতার কাটতে এসেছে। প্রকৃতির এরূপ সাহচর্যে দিনের শুরুতেই মন ভরে উঠবে আনন্দে, গলা ছেড়ে গানও ধরতে পারেন।


ঘন্টা খানেক পর আমরা যাত্রা শুরু করলাম কোহ মাই ফাই-র (Koh Mai Phai) উদ্দেশ্যে, এটি ব্যাম্বু দ্বীপ (Bamboo island) নামে পরিচিত। পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্যগুলির একটি এই ব্যাম্বু দ্বীপ। দ্বীপটির জঙ্গলে ঝরা পাতার মধ্যে বাঁশ গাছ রয়েছে, যা থেকে এই দ্বীপের নামকরণ, তবে এখানে প্রচুর অন্যান্য গাছও রয়েছে। এটির চতুর্দিকে বেলাভূমি, সমুদ্রের স্বচ্ছ জলরাশি আপনাকে স্পর্শ করার জন্যে হাতছানি দেবে। আমরাও নেমে পড়লাম, কোহ খই তে সমুদ্রকে স্পর্শ করেছিলাম মাত্র, তবে এখানে সম্পূর্ণ সমুদ্রস্নান। এই জলে বালি নেই, এরূপ অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের জন্যে নতুন ছিল।  

এই দ্বীপের অন্যতম প্রধান কার্যকলাপ অবশ্যই স্নরকেলিং (Snorkeling)!  তবে সমগ্র ফি ফি দ্বীপ জুড়ে স্নরকেলিং উপভোগ্য। কাজেই সাথে স্নরকেলিং মাস্ক রাখা উপযোগী, লাইফ জ্যাকেট স্পীডবোট থেকে পাওয়া যায়। ফি ফি দ্বীপগুলির আরও কিছু হাইলাইট হল আশ্চর্যজনক পিলেহ লেগুন, মায়া উপসাগর এবং একে অপরের পাশে অবস্থিত ভাইকিং গুহা, দ্বীপ কোহ ফি ফি ডন এবং কোহ ফি ফি লেহ, মানকি বিচ এবং অবশ্যই, প্রধান আকর্ষণ হল সাদা বালি এবং স্বচ্ছ জল যা সুন্দর দ্বীপগুলোকে ঘিরে রেখেছে। 

ব্যাম্বু দ্বীপের পর আমাদের স্পিডবোটটি রওনা হলো ফি ফি ডন দ্বীপের (Koh Phi Phi Don) উদ্দেশ্যে, ফি ফি ডন ফি ফি দ্বীপপুঞ্জের (Phi Phi archipelago) মধ্যে সর্ববৃহৎ। এখানে আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজন।মধ্যাহ্ন ভোজনে ছিল বাফেটের আয়োজন, কত কি খাবার, সি-ফুড, পাস্তা, ভাত, ফ্রাইড রাইস, চিকেন, নুডলস, স্যুপ; ডেসার্টে ছিল বিভিন্ন ধরণের ফল, কেক, টার্ট; আর চা-কফি তো ছিলই।  

সারি সারি লং টেল (Long tail boat) বোট দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্রের কিনারে। লং টেল বোটেও ঘোরা যায় দ্বীপগুলি। অনেক পর্যটক ক্র্যাবি থেকে এই বোটগুলি নিয়ে বেড়াতে আসেন। একটু সময় হাতে থাকলে ক্র্যাবি ঘুরে যেতে পারেন।


মধ্যাহ্ন ভোজনের পর কোমর পর্যন্ত জল ভেঙ্গে আমরা স্পিডবোটে চড়লাম। ভাটার কারণে জল কমে যাওয়ায় স্পিডবোটটি একেবারে সমুদ্রের কিনারে আসতে পারেনি। আমাদের গন্তব্য মানকি বিচ (Monkey beach)। এখানে বোটটি সমুদ্রের মধ্যেই দাঁড়িয়েছিল, আর বোট থেকেই সবাই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে নামছিলো। এখনই চোখে পড়বে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন মাছ, স্বচ্ছ জলের মধ্যে ঝাঁক বেঁধে তাদের দ্রুত চলাফেরা লক্ষ্য করতে করতেই সময় কেটে যাবে। 


প্রায় ৪০ মিনিট মতন এই স্থানে থাকার পর স্পিডবোট রওনা হলো মায়া বে-র (Maya Bay) উদ্দেশ্যে। কার্স্ট ক্লিফ, সাদা বালু এবং পান্না সবুজ রঙের জলের মায়া বে বাস্তবিকই ট্রপিক্যাল স্বর্গ। উপসাগরটির সৌন্দর্যের জন্য এখানে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও অভিনীত হলিউড চলচ্চিত্র 'দ্য বিচ'-র (The Beach) শ্যুটিং হয়েছিল।



প্রায় প্রতিটি দ্বীপেই পর্যটকদের জন্য শৌচাগার রয়েছে ৷ সৈকতে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আপনাকে এটি পরিষ্কার রাখতে হবে। সৈকতের সাথে এমন আচরণ বাঞ্চনীয় যেমন আপনি আপনার নিজের বাড়ির সাথে করে থাকেন কারণ প্রকৃতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের, আর এটাই সাস্টেনেবল ট্যুরিজম (Sustainable tourism)।

প্রায় সাড়ে ৫ টা নাগাদ ফুকেট বে-তে আমরা ফিরলাম। ফেরার সময় বোটে সবাইকে আনারস আর তরমুজ খেতে দিয়েছিলো। বোটে সর্বক্ষণ ছিল প্রচুর কোল্ড ড্রিঙ্কস, ভিটামিন সি ওয়াটার, আর ঠান্ডা জল। পর্যটকরা যত ইচ্ছে ব্যবহার করতে পারেন। সকালে যে ভাবে গিয়েছিলাম সেই একই ভ্যানে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হলো আমাদের রিসর্টে। দুর্দান্ত কাটলো আজকের দিনটা। 

আজও আমরা রাতের খাবার তৈরী করবো, আর হাতের কাছেই রয়েছে সুপার মার্কেট, কাজেই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বেড়িয়ে ফিরে এসে আমরা প্রথমে গেলাম মার্কেটে। লাউ, চিংড়ি, কোয়েলের ডিম, বাসমতি চাল কেনা হলো, রুটি (বা টর্টিলা) তো ছিলই। আজকের খাবার সাদা ভাত (বা রুটি), লাউ-চিংড়ি, আর ডিমের কষা। গতকাল বাজার দেখে আমাদের তো মন ভরে গিয়েছিলো, এতো সব্জি যে কতকাল দেখিনি, ঢ্যাঁড়শ, লাউ, কাঁচা পেঁপে, উচ্ছে বিভিন্ন ধরণের শাক, কচু, কি নেই ! কতদিন যে এসকল সব্জি আমরা খাইনি, সবই কিনতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু একদিনে তো সব কিছু কিনে রান্না করা সম্ভব নয়। বাজার করে এসে গতকালের মতন সব কেটে পরিষ্কার করে, রান্নার জন্যে প্রস্তুত করে আমরা আজও সুইমিং পুলে ঘন্টা খানেক কাটালাম। তারপর বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে চা বানানো হলো, চা-বিস্কুট দিয়ে সন্ধ্যেটা পার হলো। বেশিরভাগ সময়টাই কাটলো সারাদিনের নানান ঘটনা স্মৃতিচারণ করে।ইতিমধ্যে রান্না চড়িয়ে দেওয়াও হয়েছে, ঢিমে আঁচে তা পাঁকছে। একটু বেশি করেই সবকিছু রান্না করা হয়েছিল, আগামীকাল আমরা ফুকেট থেকে ব্যাঙ্কক রওনা হবো, আমাদের বিমান বেলা ৪ টে বেজে ৩০ মিনিটে, কাজেই আমরা মধ্যাহ্নভোজন করেই রওনা হবো। 

আর কি ! এবার আজকের মতন বিশ্রাম। পরের পর্বে আসবে আগামীকালের গল্প।

জুলাই, ২০২৩

থাইল্যান্ড: পর্ব-২ (Thailand: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী পর্বটি পড়ার জন্য ক্লিক করুন থাইল্যান্ড: পর্ব-১

অন্তর্দেশীয় বহির্গমন বিমানবন্দরের তিনতলায় অবস্থিত। পূর্বেই বলেছি এবার আমাদের যাত্রা ফুকেটের উদ্দেশ্যে। বিমানবন্দরে নির্দিষ্ট বিমানের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করে, নিরাপত্তা পরীক্ষার পর যখন নির্দিষ্ট দ্বারের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন হাতে বেশ কিছুটা সময় ছিল। মা বাবা'রা কলকাতা থেকে অনেক মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন, কয়েকটির সদ্গতি করে বিমানে চড়লাম। আমাদের সিটগুলি ছিল একেবারে পিছনে। এতে একটা সুবিধা হয়েছিল যে শৌচাগারটি ছিল কাছেই, যদিও তা আমাদের এবারের যাত্রায় বিশেষ প্রয়োজন হয়নি তবে সাথে বয়স্ক লোক থাকলে শৌচাগার হাতের কাছে থাকলে ভালো হয়। মাত্র দেড় ঘন্টার বিমান যাত্রা ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেট। বিমান কর্তৃপক্ষ সংক্ষিপ্ত প্রাতঃরাশ হিসেবে একটি মিষ্টি বান রুটি আর কফি (অথবা চা) দিয়েছিলেন। সাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বিমান প্রায় সমুদ্রকে স্পর্শ করে তার রানওয়েতে সঠিক সময়ে বেলা ৯ টা বেজে ৩৫ মিনিটে অবতরণ করলো।  

ফুকেট পর্বতময় রেনফরেস্টে ঘেরা থাইল্যান্ডের দক্ষিণভাগে আন্দামান সাগরে অবস্থিত দেশটির সর্ববৃহৎ দ্বীপ যা তার সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এই সমুদ্রসৈকত উপভোগ করতে এখানে আসেন। বিমানবন্দরের বাইরে এসে দেখা মিললো এক মহিলার সাথে, আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ১০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের ভ্যান এসে হাজির হলো এবং সাথে আমাদের গাইড বন্ধু পান্যা। মালপত্র যথাস্থানে উঠিয়ে আজ এই ফুকেট শহর ঘুরে দেখবো আমরা। আমাদের প্রথম গন্তব্য পুরাতন ফুকেট শহর। পূর্বের ব্লগে এই দেশটির ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছিলাম আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের সময়ে এদেশের সাথে বৈদেশিক বিশেষত পর্তুগিজদের ব্যবসায়িক  সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। পুরাতন নগরের স্থাপত্যে সেই পর্তুগিজ ঘরানা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। শুধু তাই নয়, এখানে পর্তুগিজ স্থাপত্যের পাশাপাশি চৈনিক স্থাপত্যরীতিও কিন্তু চোখে পড়ার মতন। অসংখ্য ক্যাফে, আর চাইনিজ রেস্তোরাঁ রয়েছে এই স্থানে। আমি যখন চীনে গিয়েছিলাম তখন ফলের দোকানে দুরিয়ান (Durian) দেখেছি, বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার যে শহরে আমি থাকি সেখানে একটি এশিয়ান মার্ট গড়ে ওঠায় সেখানেও এই ফলটি প্রায়ই পাওয়া যায় তবে কখনও তা খাইনি। পুরাতন ফুকেট নগরের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে প্রথবারের জন্যে এই ফলটির স্বাদগ্রহণ করলাম আমরা। এটি খেতে ভালো বা মন্দ কিরূপ, তা আমি এস্থানে উল্লেখ করবো না কারণ প্রতিটা ফল তার স্বাদে স্বতন্ত্র এবং স্থানীয় মানুষদের কাছে তা খুবই উপাদেয়। প্রায় ঘন্টা দেড়েক কোথা থেকে কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না। 


এবার আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে হবে। বেলা প্রায় ১ টা বাজে। আমাদের গাইডবন্ধুটি একটি রেস্তোরাঁয় আমাদের খাওয়ানোর জন্যে নিয়ে যাওয়ার স্থির করেছিলেন।  কিন্তু আমার মনে হলো গতরাতে সবাই জেগে বিমানযাত্রা করেছে, দুই জায়গায় প্রাতঃরাশ হয়েছে বটে কিন্তু ভারতীয় খাবার সবাই আজকে পছন্দ করবে, থাই খাবার পেট ভরে কতটা খেতে পারবে তা নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম না। তাই আমি তাঁকে ভালো একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলাম। একটু দুঃখ পেলেও উনি ব্যাপারটা বুঝলেন। আমরা একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁতে পৌঁছলাম। আমাদের খাবার ছিল খুবই সাধারণ, ভাত, ডাল, মাছের ঝোল (কারি), পেঁয়াজ-টোম্যাটো-ঢ্যাঁড়শ ভাজা, বাড়িতে পাতা দই- এই দিয়ে সবাই খাওয়া-দাওয়া সারলো। রেস্তোরাঁটি একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের। গল্প করছিলেন কোভিড প্যানডেমিকের (Covid pandemic) ফলে কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পর্যটন নির্ভর শিল্প। 

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'ওয়াট চালং' (Wat Chalong) বা চালং মন্দির (থাই ভাষায় 'ওয়াট' (Wat) শব্দটির অর্থ মন্দির)। এর প্রকৃত নাম 'ওয়াট চাইয়াথারারাম' (Wat Chaiyathararam)। ঊনবিংশ শতকে নির্মিত এই বুদ্ধ মন্দিরটি ফুকেটের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান। ভগবান বুদ্ধের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকরা লুয়াং ফো চাম (Luang Pho Cham) এবং লুয়াং ফো চুয়াং (Luang Pho Chuang) নামক দুইজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে মন্দিরটি দর্শন করতে আসেন। ঔষধি গাছ সম্পর্কিত এঁদের জ্ঞানভাণ্ডার ছিল অপরিসীম এবং এঁরা স্থানীয় মানুষকে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে চাইনিজ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন, তাই আজও এ দেশের  মানুষের কাছে পূজনীয়। সাম্প্রতিকতম মন্দিরটি ৬০ মিটার উঁচু এবং এই মন্দিরটিতে ভগবান বুদ্ধের দেহের একটি হাড় সংরক্ষিত রয়েছে। একেবারে উপরের তলায় পৌঁছলে ছাদ থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণটির একটি অপরূপ ছবি দেখা যায়। 


তিনতলা এই মন্দিরটিতে প্রবেশ করে সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে দেখা যায় দেওয়ালের গাত্রে একের পর এক চিত্র নির্মিত হয়েছে। ভগবান বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন কাহিনী শিল্পী তাঁর কল্পনায় তুলে ধরেছেন। একটি চিত্র আমার চোখকে আকৃষ্ট করেছিল, চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধের ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবৃত্তির জন্যে একটি বানর জঙ্গল থেকে মধুপূর্ণ মৌচাক আহরণ করে এনেছে আর একটি হাতি বাঁশের পাত্রে জল এনেছে (নিম্নের একেবারে ডানদিকের নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন)।

একেবারে উপরের তলায় পৌঁছলে ছাদ থেকে সমগ্র প্রাঙ্গণটির একটি অপরূপ ছবি দেখা যায়। 

প্রাঙ্গণে একটি ইট নির্মিত চুল্লীর ন্যায় আবদ্ধ স্থান রয়েছে (নিম্নের একেবারে ডানদিকের নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন), ভগবানের উদ্দেশ্যে যে শব্দবাজি ফাটানো হয় তা এর মধ্যে ফাটাতে হয়, উন্মুক্ত পরিবেশে নয়। এর ফলে বাজির আগুন অন্যত্র ছড়িয়ে পরে দুর্ঘটনা ঘটে না, আবার পরিবেশের দূষণও কিয়দংশ কম হয়। 

এ স্থান থেকে চোখ পড়বে দূরে পাহাড়ের উপরে ধ্যানমগ্ন শাক্যমুনি যা 'বিগ বুদ্ধা' (Big Buddha) বলে পরিচিত, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।


চালং মন্দিরের ছাদ থেকে দূরে নাকার্ড (Nakkerd hill) বা নাগাকার্ড (Nagakerd hill) পাহাড়ের উপরে ভগবান বুদ্ধের যে মূর্তিটি দেখেছিলাম তার উচ্চতা ৪৫ মিটার এবং প্রস্থ ২৫.৪৫ মিটার। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে এই ধ্যানমগ্ন ভগবান বুদ্ধের মূর্তিটির নির্মাণ কার্য শুরু হয় এবং আজও এটি চলছে। শুনলাম এটি থাইল্যান্ডের তৃতীয় উচ্চতম বুদ্ধমূর্তি। 


প্রাঙ্গনে রয়েছে অনেক ভাস্কর্য। ভগবান বুদ্ধের শায়িত, দণ্ডায়মান এবং উপবেশন অবস্থানের ভাস্কর্য , এছাড়াও রয়েছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মূর্তি, ধরিত্রী মাতার মূর্তি ইত্যাদি। 


আর দেখলাম গরুড়ের মূর্তি, ভারতীয় মহাকাব্য এবং পুরাণাদিতে বিষ্ণুর বাহন গরুড়, থাই ভাষায় 'খ্র্রুট' (Khrut) নামে পরিচিত, 'খ্র্রুট' এদেশের জাতীয় প্রতীক। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন 'Visa on Arrival' ফর্মটির উপরে এই প্রতীকটি রয়েছে। 


এবার কারোণ (Karon beach) এবং কাটা (Kata beach) সমুদ্রসৈকতের ভিউ পয়েন্ট দেখে আজকের মতন আমরা রিসর্টে পৌঁছলাম। আমরা উঠেছিলাম কাটা ট্রানকুইল ভিলা-তে, রিসর্টটি থেকে কারোণ বিচের দূরত্ব ছিল পায়ে হেঁটে ৫-৭ মিনিট মতন।

আমরা ঠিক করলাম আজ আমরা নিজেরা রাত্রিকালীন আহারের বন্দোবস্ত করবো। আমাদের রিসোর্টটির সামনে ৪০০-৫০০ মিটারের মধ্যেই ছিল শপিং মার্ট 'ম্যাক্রো' (Makro), সবাই মিলে সেখানে গেলাম বাজার করতে। চিকেন, পেঁয়াজ, আদা, শশা, ধনে পাতা, জিরে-ধনের গুঁড়ো, চিকেন মশলা, তেল, নুন, কাঁচা লঙ্কা ইত্যাদি কিনে আনলাম। এবার আর কি? খুব পরিশ্রান্ত আমরা কেউই ছিলাম না, যেটুকু ছিলাম তাও কেটে গিয়েছিলো সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে।  রাতের খাদ্যতালিকায় ছিল রুটি (আমরা টর্টিলা নিয়ে গিয়েছিলাম), চিকেন, স্যালাড, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা আঁচার আর মিষ্টি । 

এবার বিশ্রাম, আগামীকাল আমাদের আন্দামান সাগরের বিভিন্ন দ্বীপ ঘোরার কথা।

জুলাই, ২০২৩ 

থাইল্যান্ড: পর্ব-১ (Thailand: Part-1)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

ইতিপূর্বে ভুটান (এ বিষয়ে আমি একটি ভ্রমণ কাহিনী 'দিন তিনেকের ভুটান' লিখেছিলাম যেটি 'আমাদের ছুটি' অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল) ছাড়া যে সকল দেশ আমি ভ্রমণ করেছি তা সর্বদা কর্মসূত্রে। প্রায় দীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর পর কয়েকদিনের ছুটিতে সপরিবারে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ড। আগামী কয়েকটি পর্বে আমি আমাদের এই ভ্রমণ কাহিনীটি বিস্তারিত লিখব। 

প্রথমে থাইল্যান্ড দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত প্রায় ৫১৩১২০ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্রফলের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র এই দেশটির জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭০ মিলিয়ন। দেশটির উত্তরে রয়েছে মায়ানমার এবং লাওস, পূর্বে লাওস এবং কম্বোডিয়া, পশ্চিমে মায়ানমার, দক্ষিণে দেশটির লম্বা একটি উপদ্বীপীয় (Peninsula) অঞ্চল রয়েছে আর তারপর রয়েছে মালেশিয়া। উপদ্বীপীয় অঞ্চলটির পশ্চিমে রয়েছে আন্দামান সাগর।   

আমরা, আমি আর আমার স্ত্রী, যাব দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Incheon International Airport) থেকে। ১ নম্বর টার্মিনাল থেকে রাত্রি ৮ টা বেজে ৪০ মিনিটে (কোরিয়া সময়) থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (Suvarnabhumi International Airport) উদ্দেশ্যে আমাদের বিমান যাত্রা শুরু করলো। প্রায় ৫ ঘন্টা ১০ মিনিটের বিমান যাত্রা, থাইল্যান্ড সময় পরদিন ভোর সাড়ে ১২ টায় আমাদের অবতরণ সঠিক সময়ানুসারেই হয়েছিল। এই বিমানবন্দর দিয়ে অগণিত বার আমি যাতায়াত করেছি বটে তবে এই দেশটা দেখার সুযোগ এইবার প্রথম।  


বিদেশে ভ্রমণের প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়টির অবতারণা হয় তা হলো ভিসা। এই ভিসা বা অনুমতি পেতে আবেদনকারীকে উপযুক্ত সময়ে সেই দেশের নিয়ম অনুযায়ী ভ্রমণের কারণ, যাতায়াত এবং থাকবার ব্যবস্থা, নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে প্রমাণ সহ বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হয়, এবং সকল বিষয় সেই দেশের নিয়মাবলীকে পরিতৃপ্ত করলে ভিসা পাওয়া যায়। কয়েকটি দেশ আবার ভারতবাসীকে পৌঁছনোর পর ভিসার জন্যে আবেদনের সুযোগ দিয়ে থাকে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড অন্যতম। দেশটি ভারতীয় নাগরিকদের পর্যটনের উদ্দেশ্যে ১৫ দিনের জন্যে 'Visa on Arrival' প্রদান করে থাকে। যদি কোনো ভারতীয় পর্যটক ১৫ দিনের অধিক থাইল্যান্ডে থাকতে চান তবে তাকে পূর্বেই ভিসার জন্যে আবেদন করতে হবে। থাইল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর 'Visa on Arrival' ফর্মটি পূরণ করতে হয়। এই জন্যে কয়েকটি ডকুমেন্টের প্রয়োজন হয়, তা এখানে উল্লেখ করলাম।

(১) থাইল্যান্ডের থেকে ফেরার বিমানের টিকিট, 

(২) থাকবার স্থানের (পর্যটকদের ক্ষেত্রে হোটেলের) সংরক্ষনের প্রমান, 

(৩) জনপ্রতি ১০,০০০ থাই বাত (Thai Baht) (পরিবার প্রতি ২০,০০০ থাই বাত), 

(৪) নিজের একটি ফোটোগ্রাফ (৬ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪ সেন্টিমিটার প্রস্থ) প্রয়োজন। 

বিমানবন্দরে অবতরণের পর চলার পথে লক্ষ্য করলেই দিক নির্দেশ চোখে পড়বে, দিক নির্দেশ অনুসরণ করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় "Visa on Arrival' স্থানটিতে। অতএব বিমান থেকে অবতরণের পর প্রথম কর্তব্য 'Visa on Arrival' ফর্মটি সঠিকভাবে পূরণ করে কাউন্টারে সেটি জমা করা, অফিসার ফর্মটি পরীক্ষা করে ভিসা আবেদনের মূল্য (আমাদের জন প্রতি ২২০০ থাই বাত লেগেছিলো) জমা করতে বলবেন। তারপর ঐদেশের ইমিগ্রেশন নিয়মানুসারে আঙুলের ছাপ এবং চোখের স্ক্যান করে পাসপোর্টে ভিসা স্ট্যাম্প এবং অনুমতি সাপেক্ষে দিনসংখ্যা উল্লেখ করে স্ট্যাম্প করে দিলেই আপনি দেশটিতে প্রবেশ করতে পারবেন। 

ভিসা পাওয়ার পর আমরা মোবাইল ফোনের সিম নেওয়ার জন্যে আবেদন করেছিলাম, পদ্ধতিটি খুবই সহজ, একাধিক কাউন্টার রয়েছে সিম নেওয়ার, যে কোনো একটিতে গিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী (৮ দিনের জন্যে ১৫ GB ২০০ থাই বাত, আর আনলিমিটেড ইন্টারনেটের জন্যে ৪৯৯ থাই বাত) সিম নেওয়া যায়, পাসপোর্টের ফটোকপি এবং আবেদনকারীর চিত্র দুই-ই দোকানের কর্মী তুলে নেবেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা এই কাজ দু'টি সপন্ন করে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করার স্থানে পৌঁছলাম। আমার এবং আমার স্ত্রীর মা-বাবা আসবেন কলকাতা থেকে, তাঁদের বিমান পৌঁছনোর সময় ভোর ৪ টে বেজে ১০ মিনিটে। এবার অপেক্ষা, বিমানবন্দরে অপেক্ষা করার স্থানটিতে পৌঁছে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্যে।  

তবে এই অবসরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নিই।

'সুবর্ণভূমি' নামের অর্থ স্বর্ণের ভূমি বা সোনার দেশ। শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ থেকে। শুধু এই শব্দটি নয়, এখানে প্রচলিত অনেক শব্দ কিন্তু ভারতীয় ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়, কখনও উচ্চারণ রীতিটি একটু আলাদা। যেমন মনুষ্য (Manushyo) এখানে মানুথ (Manuth), গজ (Gaja) এখানে খজ (Khaja), দেবী (Devi) এখানে তেয়ি (The yi), চাঁদ (Chand) এখানে চান (Chan), তারা (Tara) হলো দারা (Dara), রাজা (Raja) হয়েছে রাচা (Ra chaa), ভাষা (Bhasha) হয়েছে পাষা (Pa sha) ইত্যাদি। থাই মানুষের অভিবাদন 'স্বাদিকাম' আর ভারতীয়দের 'স্বাগতম'-র  ভাষাগত নৈকট্য কিন্তু লক্ষ্যণীয়। কোথাও বেশ ভালো লাগছে না ! বেশ নিজ নিজ অনুভূতি, আর হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় আছে কাজেই এই দেশের ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যেতেই পারে। কোনো স্থান সম্বন্ধে জানতে হলে তার ইতিহাস, সংস্কৃতি জানা অপরিহার্য বলেই আমার মনে হয়। এখানে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক যা আমাদের এই ভ্রমণের সাথে বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। 

বর্তমান থাইল্যান্ডের পূর্বের নাম ছিল শ্যামদেশ। এই 'শ্যাম' নামটির উৎপত্তি খুঁজতে গেলে দেখা যায় শব্দটি সংস্কৃত বা পালি ভাষা থেকে এসেছে বলে বোধ হয়। দেশটির ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ইত্যাদির উপর ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে নান চাওয়ের 'তাই' (Tai) জনজাতির মানুষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূখণ্ডে আসেন এবং খমের সাম্রাজ্যের (Khmer Empire) অধীনে তাঁদের বসতি স্থাপন করেন। ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রী ইন্দ্রাদিত্য খমের সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে সুখোথাই (Sukhothai Kingdom) রাজত্ব গঠন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটিই প্রথম থাই রাজত্ব বলে বিবেচিত হয়। 'থাই' কথাটির অর্থ এখানে 'মুক্ত' (Free), আবার 'তাই' জনগোষ্ঠীর নামানুসারেও 'থাই' নামটি আসে। এর পরবর্তী কালে সুখতাই রাজত্বের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তা ছড়িয়ে পরে লাওস, বার্মা এবং মালাক্কা উপদ্বীপে, মূলত সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি হয়েছিল ভ্যাসাল স্টেট (Vassal state: একটি ভাসাল রাষ্ট্র এমন যে কোনো রাষ্ট্র যার একটি উচ্চতর রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের প্রতি পারস্পরিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে) গঠনের মাধ্যমে। সুখোথাই রাজত্বের রাজারা বিদেশী শক্তির (যেমন চীনের ইউয়ান রাজবংশের সাথে) সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এরপর সুখোথাই রাজত্বের ভ্যাসাল স্টেটগুলি যখন বিদ্রোহ শুরু করে তা আর পুনর্গঠন করা এই রাজত্বের পক্ষে সম্ভব হয়নি, বরং আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে বিরোধী শক্তির কাছে। এর মধ্যে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য (Ayutthaya Empire) গড়ে ওঠে। ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমগ্র সুখোতাই রাজত্বের অবসান ঘটে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য ওই অঞ্চলের বৃহৎ শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সুখোথাই যেমন ভ্যাসাল স্টেট গঠনের মাধ্যমে নিজের পরিধি এবং শক্তি বৃদ্ধি করেছিল, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য কিন্তু তা করেনি, বরং এই সাম্রাজ্য ছিল সামগ্রিকভাবে রাজতন্ত্র নির্ভর। এই 'আয়ুত্থায়া' নামটির সাথে ভারতবর্ষের 'অযোধ্যা' নামটির সাদৃশ্য রয়েছে। শুধু অযোধ্যা নামের সাদৃশ্য নয়, ভারতবর্ষের মহাকাব্য রামায়ণ এখানে 'রামাকিয়েন', থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ। আমাদের 'রাজা রাম' এখানে 'ফ্রা রামা'। 'রামাকিয়েন' শব্দটির অর্থ 'রামের গৌরব' (Glory of Rama)। এই সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পর্তুগালের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। পর্তুগিজদের উচ্চারণে 'শ্যাম' পরিণত হলো 'সিয়াম' (Siam) এ। তখন পর্তুগাল মালাক্কা উপদ্বীপ দখল করেছে এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের স্থানীয় থাই রাজত্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। থাই রাজত্বও এর ফলে উপকৃত হতো, কাজেই ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। এর ফলে একাধিক ট্রিটি (Treaty) স্থাপন হয়েছিল, যেমন ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং পর্তুগালের মধ্যে, আবার বেশ কয়েক দশক পরে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জাপানের সাথেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, মিশনারীদের আগমনে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব লক্ষ্যিত হলে পরবর্তী প্রায় দেড় শতাব্দী ইচ্ছানুসারে থাই সাম্রাজ্য বিদেশী সম্পর্ক থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখেন। 

১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলো বার্মিজ-সিয়ামিজ যুদ্ধ, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয় এই যুদ্ধে, রাজধানী আয়ুত্থায়া ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বার্মিজদের হাতে। আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের কমান্ডার ফ্রায়া তাকসিন (Phraya Taksin) বার্মিজদের অবরোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করেন এবং নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। থনবুরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং চীনের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। তবে তাকসিন যে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া রাজত্বের অন্যতম কমান্ডার জেনারেল চাও ফ্রায়া চাকরি (Chao Phraya Chakri) রাজসিংহাসন থেকে রাজা তাকসিনকে অপসারণ করে চাকরি রাজবংশের (Chakri Kingdom) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় তাঁরা রাজধানী ব্যাঙ্ককে স্থানান্তরিত করেন। আজও থাইল্যান্ডে চাকরি বংশ রাজত্ব করছেন এবং রাজধানী ব্যাঙ্কক। পরবর্তীতে অনেক কাল অতিবাহিত হয়েছে, ঘটনার পরম্পরা এই দেশকে আজ উন্নত দেশে পরিণত করেছে, তবে সে ইতিহাস সবিস্তারে এই ভ্রমণ কাহিনীতে বিশেষ প্রাসঙ্গিক নয়।

আমাদের সারা রাত বিমানবন্দরের অপেক্ষার স্থানে পার হলো, দেখলাম মা-বাবা'দের বিমান সঠিক সময়ে অবতরণ করেছে। এবার ওঁরা বিমানবন্দরের সব কাজ শেষ করে বাইরে আসবে। এখানে একটু কিছু প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যাবো অন্তর্দেশীয় বহির্গমনের উদ্দেশ্যে। আমাদের বিমান সকাল ৮ টা ৫ মিনিটে, ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেট।

জুলাই, ২০২৩

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...