সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
মহানগরী মুম্বই,
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন এসে
পৌঁছলাম দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেছে। এবার সোজা হোটেল। সাকিনাকা-তে আমাদের হোটেল,
বিমানবন্দর থেকে বেশি দূরে নয়। আমাদের ফেরার ফ্লাইট সকালে, তাই
এই জায়গাটা বেশ সুবিধার হলো আমাদের জন্যে। মুম্বই শহরে দীর্ঘদিন আমি কাটিয়েছি, কলেজের
পাঠ শেষ করে কর্মসূত্রে এ শহরে আমি এসেছিলাম। মেস, বন্ধু ছেড়ে যেদিন এই
শহরে পা রেখেছিলাম,
পরিচিত বৃত্তের বাইরে আমি হঠাৎই একা হয়ে পড়েছিলাম। এই শহর
আমাকে পরিণত হতে শিখিয়েছে, পেশাদারিত্বকে অনুভব করিয়েছে, বাস্তববোধকে দৃঢ় করেছে। তারপর অনেকটা দিন অতিবাহিত, এখন অন্য একটি শহরের
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াই। অনেক দিন পরে আবার একটা কাজের জন্যে আসতে হয়েছে মুম্বইতে
এবং সেই কাজের মধ্যে এক বা দুই দিন এই শহরটাকে (সপ্তাহান্তে স্বল্প দিনের বেড়ানোর মতন) আর একবার দেখে নেওয়া, স্মৃতিকে
একটু ঝালিয়ে নেওয়া। দ্বিপ্রাহরিক আহার সারতে একটু দেরিই হয়ে গেলো। তবে আজ কোনো ব্যস্ততা নেই, শুধুই
এদিক ওদিক ঘুরে,
খাওয়া দাওয়া করে দিন কেটে গেলো।
পরের দিনটা কাটলো ব্যস্ততার মধ্যে। দিনের অনেকটা সময় ব্যস্ত থাকতে হলো নানা কাজে, মাঝে
দ্বিপ্রাহরিক আহার সারলাম বান্দ্রায় এক পারসী মহিলার রেস্তোরাঁয়, তারপর
বিকেলের দিকে এসে এলাম মেরিন ড্রাইভে (Marine drive)। কত লোক, কত গল্প, আর
তারমধ্যেই মানুষ অবসর খুঁজে নেয় এখানে নিজের সাথে সময় কাটানোর। মুম্বইতে সন্ধ্যা নামে
একটু দেরিতে,
সন্ধ্যা নামার পর ফিরলাম হোটেলে। মেরিন ড্রাইভ থেকে বান্দ্রা-ওরলি সি লিংক (Bandra-Worli sea link) হয়ে সাকিনাকা আসার পথেই পড়বে হাজি আলি দরগা, নেহেরু
প্লানেটোরিয়াম,
নেহেরু সায়েন্স মিউজিয়াম। তবে এবার আর এসকল দর্শনীয় স্থানগুলি
দেখার মতন সময় হলো না। বান্দ্রা-ওরলি সি লিংক পার হয়ে তারপর মিঠি নদীকে কখনো
ডান দিক আবার কখনো বাঁ দিকে রেখে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।
পর দিন,
আজ কোনো কাজ নেই, ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে। সকালে প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম দ্য গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া-র উদ্দেশ্যে (The Gateway of India)।
তৎকালীন ব্রিটিশ সম্রাট জর্জ পঞ্চম এবং রানী ম্যারি-র ভারতবর্ষে আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে তাঁর অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয় এই প্রবেশদ্বার, তবে তা আজকের প্রস্তর ও কংক্রিট নির্মিত রূপে ছিল না। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হয়। ওই বৎসরই এটি সাধারণ জনগণের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ফ্রেব্রুয়ারি শেষ ব্রিটিশ সেনা দলটিও এই দ্বারের সামনে থেকে ভারতবর্ষ ছেড়ে ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এখান থেকে যাবো এলিফ্যান্টা কেভ (Elephanta Cave)। দ্য গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া-র সামনে যে জেটি বা ছোট বন্দরটি রয়েছে সেখান থেকে ফেরি ছাড়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এলিফ্যান্টা বা ঘাড়াপুড়ি দ্বীপের উদ্দেশ্যে, সময় নেয় প্রায় এক ঘন্টা। ব্যাসল্ট পাথর খোদিত গুহাগুলি এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলি এই দ্বীপের মূল আকর্ষণ। ফেরী থেকে নামার পর, কিছুটা পথ হেঁটে, ১২০ টি সিঁড়ি অতিক্রম করে পৌঁছতে হয় মূল গুহাটির সম্মুখে। একটি টয় ট্রেন রয়েছে ফেরী ঘাট থেকে সিঁড়িগুলির সামনে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। পথের দু'দিকে পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বসে রয়েছেন, রয়েছে অনেক রেস্তোরাঁ। পুরাতত্ব বিভাগের মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে দ্বীপটিতে প্রথম মানব বসতি গড়ে ওঠে, প্রথমে হীনযান বৌদ্ধ এবং তার পরে হিন্দুরা এস্থানে আসেন। চতুর্থ শতকের ক্ষাত্রপদের (শক) সময়ের কিছু মুদ্রা এখানে আবিষ্কৃত হয়, পরবর্তীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের দলিলে এস্থানের উল্লেখ থাকলেও বিশেষ কিছুই উল্লেখিত নেই। কিছু ঐতিহাসিকদের মতে এই গুহাগুলি সপ্তম শতাব্দীতে বা তারপর রাষ্ট্রকূটরা নির্মাণ করেছিলেন। তবে ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ এবং UNESCO অনুসারে গুহাগুলি পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হয়। কারোর মতে গুহাগুলি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সাময়িক আবার কারোর মতে এগুলি কালাচুরি বংশের দ্বারা নির্মিত। পূর্বেই বলেছি যে পাথর খোদাই করে গুহাগুলি নির্মিত হয়েছে, সমদর্শী স্তম্ভগুলির উপরে রয়েছে বিশালাকার পাহাড়।
গুহার অভ্যন্তরে রয়েছে মন্দিরের মূল মণ্ডপ আর তার চারপাশে পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে ভগবান শিবের নানান রূপ, সদাশিব-ত্রিমূর্তি, গঙ্গাধর, অর্ধনারীশ্বর, যোগীশ্বর, নটরাজ, কল্যাণসুন্দর, কৈলাশ পর্বত এবং রাবণ-অনুগ্রহের ভাস্কর্য। প্রণাম করলাম ভগবানকে, আর প্রণম্য তাঁর রূপ প্রণেতা। এরপরের দ্রষ্টব্য ক্যানন হিল। এগুলির নির্মাণকার্য অসম্পূর্ণ, আবার কিছুটা ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং পুনর্নির্মিত। এরপর রয়েছে স্তুপা হিল, যা থেকে এখানে বৌদ্ধদের আগমন ধারণা করা হয়।
এবার ফিরে চলা, তবে ফেরার পথে একটি রেস্তোরাঁয় দোসা সহযোগে আহার সারলাম। দ্য গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া তে ফিরে এসে চললাম মেরিন ড্রাইভের উদ্দেশ্যে। এখন থেকে প্রায়
সোয়া দুই কিলোমিটার পথ,
বিকেল বেলা,
কাজেই হেঁটেই চললাম,
তাজ হোটেল,
লিওপোল্ড কাফে,
নারিম্যান পয়েন্ট হয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেরিন ড্রাইভ, যার
পোশাকি নাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস রোড। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকা সাগরপাড়ে আর তারপর
আবার পথ চলা গিরগাঁও চৌপাটির উদ্দেশ্যে। পাও ভাজি, চা ইত্যাদির সাথে
সন্ধ্যেটা কাটিয়ে এবার ফেরা সাকিনাকা তে,
আমাদের হোটেলে।
পরের দিন, সকাল ১১ টার মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হলে আমরা গেলাম খারে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনে। মিশন ঘুরে, মহারাজের সাথে কথা বলে ওখানেই সারলাম আজকের আহার। আহারান্তে প্রণাম সেরে ফিরে এলাম হোটেলে। একটু বিশ্রাম নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে গেলাম জুহু বিচে। জুহু বিচ আমাদের হোটেল থেকে বেশি দূরে নয়, ৯-১০ কিলোমিটার হবে, যেতে বেশি সময় লাগে না। অনেক ছোট ছোট রেস্তোরাঁ রয়েছে বিচের ধারে। বেশ কাটলো আজকের দিন।
কাল ভোরে ফেরার ফ্লাইট।
জুন, ২০১৯







































