পৃষ্ঠাসমূহ

থাইল্যান্ড: পর্ব-১ (Thailand: Part-1)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

ইতিপূর্বে ভুটান (এ বিষয়ে আমি একটি ভ্রমণ কাহিনী 'দিন তিনেকের ভুটান' লিখেছিলাম যেটি 'আমাদের ছুটি' অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল) ছাড়া যে সকল দেশ আমি ভ্রমণ করেছি তা সর্বদা কর্মসূত্রে। প্রায় দীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর পর কয়েকদিনের ছুটিতে সপরিবারে গিয়েছিলাম থাইল্যান্ড। আগামী কয়েকটি পর্বে আমি আমাদের এই ভ্রমণ কাহিনীটি বিস্তারিত লিখব। 

প্রথমে থাইল্যান্ড দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত প্রায় ৫১৩১২০ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্রফলের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র এই দেশটির জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৭০ মিলিয়ন। দেশটির উত্তরে রয়েছে মায়ানমার এবং লাওস, পূর্বে লাওস এবং কম্বোডিয়া, পশ্চিমে মায়ানমার, দক্ষিণে দেশটির লম্বা একটি উপদ্বীপীয় (Peninsula) অঞ্চল রয়েছে আর তারপর রয়েছে মালেশিয়া। উপদ্বীপীয় অঞ্চলটির পশ্চিমে রয়েছে আন্দামান সাগর।   

আমরা, আমি আর আমার স্ত্রী, যাব দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Incheon International Airport) থেকে। ১ নম্বর টার্মিনাল থেকে রাত্রি ৮ টা বেজে ৪০ মিনিটে (কোরিয়া সময়) থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (Suvarnabhumi International Airport) উদ্দেশ্যে আমাদের বিমান যাত্রা শুরু করলো। প্রায় ৫ ঘন্টা ১০ মিনিটের বিমান যাত্রা, থাইল্যান্ড সময় পরদিন ভোর সাড়ে ১২ টায় আমাদের অবতরণ সঠিক সময়ানুসারেই হয়েছিল। এই বিমানবন্দর দিয়ে অগণিত বার আমি যাতায়াত করেছি বটে তবে এই দেশটা দেখার সুযোগ এইবার প্রথম।  


বিদেশে ভ্রমণের প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়টির অবতারণা হয় তা হলো ভিসা। এই ভিসা বা অনুমতি পেতে আবেদনকারীকে উপযুক্ত সময়ে সেই দেশের নিয়ম অনুযায়ী ভ্রমণের কারণ, যাতায়াত এবং থাকবার ব্যবস্থা, নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে প্রমাণ সহ বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হয়, এবং সকল বিষয় সেই দেশের নিয়মাবলীকে পরিতৃপ্ত করলে ভিসা পাওয়া যায়। কয়েকটি দেশ আবার ভারতবাসীকে পৌঁছনোর পর ভিসার জন্যে আবেদনের সুযোগ দিয়ে থাকে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড অন্যতম। দেশটি ভারতীয় নাগরিকদের পর্যটনের উদ্দেশ্যে ১৫ দিনের জন্যে 'Visa on Arrival' প্রদান করে থাকে। যদি কোনো ভারতীয় পর্যটক ১৫ দিনের অধিক থাইল্যান্ডে থাকতে চান তবে তাকে পূর্বেই ভিসার জন্যে আবেদন করতে হবে। থাইল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর 'Visa on Arrival' ফর্মটি পূরণ করতে হয়। এই জন্যে কয়েকটি ডকুমেন্টের প্রয়োজন হয়, তা এখানে উল্লেখ করলাম।

(১) থাইল্যান্ডের থেকে ফেরার বিমানের টিকিট, 

(২) থাকবার স্থানের (পর্যটকদের ক্ষেত্রে হোটেলের) সংরক্ষনের প্রমান, 

(৩) জনপ্রতি ১০,০০০ থাই বাত (Thai Baht) (পরিবার প্রতি ২০,০০০ থাই বাত), 

(৪) নিজের একটি ফোটোগ্রাফ (৬ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪ সেন্টিমিটার প্রস্থ) প্রয়োজন। 

বিমানবন্দরে অবতরণের পর চলার পথে লক্ষ্য করলেই দিক নির্দেশ চোখে পড়বে, দিক নির্দেশ অনুসরণ করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় "Visa on Arrival' স্থানটিতে। অতএব বিমান থেকে অবতরণের পর প্রথম কর্তব্য 'Visa on Arrival' ফর্মটি সঠিকভাবে পূরণ করে কাউন্টারে সেটি জমা করা, অফিসার ফর্মটি পরীক্ষা করে ভিসা আবেদনের মূল্য (আমাদের জন প্রতি ২২০০ থাই বাত লেগেছিলো) জমা করতে বলবেন। তারপর ঐদেশের ইমিগ্রেশন নিয়মানুসারে আঙুলের ছাপ এবং চোখের স্ক্যান করে পাসপোর্টে ভিসা স্ট্যাম্প এবং অনুমতি সাপেক্ষে দিনসংখ্যা উল্লেখ করে স্ট্যাম্প করে দিলেই আপনি দেশটিতে প্রবেশ করতে পারবেন। 

ভিসা পাওয়ার পর আমরা মোবাইল ফোনের সিম নেওয়ার জন্যে আবেদন করেছিলাম, পদ্ধতিটি খুবই সহজ, একাধিক কাউন্টার রয়েছে সিম নেওয়ার, যে কোনো একটিতে গিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী (৮ দিনের জন্যে ১৫ GB ২০০ থাই বাত, আর আনলিমিটেড ইন্টারনেটের জন্যে ৪৯৯ থাই বাত) সিম নেওয়া যায়, পাসপোর্টের ফটোকপি এবং আবেদনকারীর চিত্র দুই-ই দোকানের কর্মী তুলে নেবেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা এই কাজ দু'টি সপন্ন করে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করার স্থানে পৌঁছলাম। আমার এবং আমার স্ত্রীর মা-বাবা আসবেন কলকাতা থেকে, তাঁদের বিমান পৌঁছনোর সময় ভোর ৪ টে বেজে ১০ মিনিটে। এবার অপেক্ষা, বিমানবন্দরে অপেক্ষা করার স্থানটিতে পৌঁছে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্যে।  

তবে এই অবসরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নিই।

'সুবর্ণভূমি' নামের অর্থ স্বর্ণের ভূমি বা সোনার দেশ। শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ থেকে। শুধু এই শব্দটি নয়, এখানে প্রচলিত অনেক শব্দ কিন্তু ভারতীয় ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়, কখনও উচ্চারণ রীতিটি একটু আলাদা। যেমন মনুষ্য (Manushyo) এখানে মানুথ (Manuth), গজ (Gaja) এখানে খজ (Khaja), দেবী (Devi) এখানে তেয়ি (The yi), চাঁদ (Chand) এখানে চান (Chan), তারা (Tara) হলো দারা (Dara), রাজা (Raja) হয়েছে রাচা (Ra chaa), ভাষা (Bhasha) হয়েছে পাষা (Pa sha) ইত্যাদি। থাই মানুষের অভিবাদন 'স্বাদিকাম' আর ভারতীয়দের 'স্বাগতম'-র  ভাষাগত নৈকট্য কিন্তু লক্ষ্যণীয়। কোথাও বেশ ভালো লাগছে না ! বেশ নিজ নিজ অনুভূতি, আর হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় আছে কাজেই এই দেশের ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যেতেই পারে। কোনো স্থান সম্বন্ধে জানতে হলে তার ইতিহাস, সংস্কৃতি জানা অপরিহার্য বলেই আমার মনে হয়। এখানে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক যা আমাদের এই ভ্রমণের সাথে বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। 

বর্তমান থাইল্যান্ডের পূর্বের নাম ছিল শ্যামদেশ। এই 'শ্যাম' নামটির উৎপত্তি খুঁজতে গেলে দেখা যায় শব্দটি সংস্কৃত বা পালি ভাষা থেকে এসেছে বলে বোধ হয়। দেশটির ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ইত্যাদির উপর ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে নান চাওয়ের 'তাই' (Tai) জনজাতির মানুষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূখণ্ডে আসেন এবং খমের সাম্রাজ্যের (Khmer Empire) অধীনে তাঁদের বসতি স্থাপন করেন। ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রী ইন্দ্রাদিত্য খমের সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে সুখোথাই (Sukhothai Kingdom) রাজত্ব গঠন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটিই প্রথম থাই রাজত্ব বলে বিবেচিত হয়। 'থাই' কথাটির অর্থ এখানে 'মুক্ত' (Free), আবার 'তাই' জনগোষ্ঠীর নামানুসারেও 'থাই' নামটি আসে। এর পরবর্তী কালে সুখতাই রাজত্বের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তা ছড়িয়ে পরে লাওস, বার্মা এবং মালাক্কা উপদ্বীপে, মূলত সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি হয়েছিল ভ্যাসাল স্টেট (Vassal state: একটি ভাসাল রাষ্ট্র এমন যে কোনো রাষ্ট্র যার একটি উচ্চতর রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের প্রতি পারস্পরিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে) গঠনের মাধ্যমে। সুখোথাই রাজত্বের রাজারা বিদেশী শক্তির (যেমন চীনের ইউয়ান রাজবংশের সাথে) সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এরপর সুখোথাই রাজত্বের ভ্যাসাল স্টেটগুলি যখন বিদ্রোহ শুরু করে তা আর পুনর্গঠন করা এই রাজত্বের পক্ষে সম্ভব হয়নি, বরং আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে বিরোধী শক্তির কাছে। এর মধ্যে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য (Ayutthaya Empire) গড়ে ওঠে। ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমগ্র সুখোতাই রাজত্বের অবসান ঘটে আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য ওই অঞ্চলের বৃহৎ শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সুখোথাই যেমন ভ্যাসাল স্টেট গঠনের মাধ্যমে নিজের পরিধি এবং শক্তি বৃদ্ধি করেছিল, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য কিন্তু তা করেনি, বরং এই সাম্রাজ্য ছিল সামগ্রিকভাবে রাজতন্ত্র নির্ভর। এই 'আয়ুত্থায়া' নামটির সাথে ভারতবর্ষের 'অযোধ্যা' নামটির সাদৃশ্য রয়েছে। শুধু অযোধ্যা নামের সাদৃশ্য নয়, ভারতবর্ষের মহাকাব্য রামায়ণ এখানে 'রামাকিয়েন', থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ। আমাদের 'রাজা রাম' এখানে 'ফ্রা রামা'। 'রামাকিয়েন' শব্দটির অর্থ 'রামের গৌরব' (Glory of Rama)। এই সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পর্তুগালের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। পর্তুগিজদের উচ্চারণে 'শ্যাম' পরিণত হলো 'সিয়াম' (Siam) এ। তখন পর্তুগাল মালাক্কা উপদ্বীপ দখল করেছে এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের স্থানীয় থাই রাজত্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। থাই রাজত্বও এর ফলে উপকৃত হতো, কাজেই ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। এর ফলে একাধিক ট্রিটি (Treaty) স্থাপন হয়েছিল, যেমন ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং পর্তুগালের মধ্যে, আবার বেশ কয়েক দশক পরে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যে। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জাপানের সাথেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, মিশনারীদের আগমনে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব লক্ষ্যিত হলে পরবর্তী প্রায় দেড় শতাব্দী ইচ্ছানুসারে থাই সাম্রাজ্য বিদেশী সম্পর্ক থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখেন। 

১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলো বার্মিজ-সিয়ামিজ যুদ্ধ, আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্য সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয় এই যুদ্ধে, রাজধানী আয়ুত্থায়া ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বার্মিজদের হাতে। আয়ুত্থায়া সাম্রাজ্যের কমান্ডার ফ্রায়া তাকসিন (Phraya Taksin) বার্মিজদের অবরোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করেন এবং নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। থনবুরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং চীনের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। তবে তাকসিন যে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে আয়ুত্থায়া রাজত্বের অন্যতম কমান্ডার জেনারেল চাও ফ্রায়া চাকরি (Chao Phraya Chakri) রাজসিংহাসন থেকে রাজা তাকসিনকে অপসারণ করে চাকরি রাজবংশের (Chakri Kingdom) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় তাঁরা রাজধানী ব্যাঙ্ককে স্থানান্তরিত করেন। আজও থাইল্যান্ডে চাকরি বংশ রাজত্ব করছেন এবং রাজধানী ব্যাঙ্কক। পরবর্তীতে অনেক কাল অতিবাহিত হয়েছে, ঘটনার পরম্পরা এই দেশকে আজ উন্নত দেশে পরিণত করেছে, তবে সে ইতিহাস সবিস্তারে এই ভ্রমণ কাহিনীতে বিশেষ প্রাসঙ্গিক নয়।

আমাদের সারা রাত বিমানবন্দরের অপেক্ষার স্থানে পার হলো, দেখলাম মা-বাবা'দের বিমান সঠিক সময়ে অবতরণ করেছে। এবার ওঁরা বিমানবন্দরের সব কাজ শেষ করে বাইরে আসবে। এখানে একটু কিছু প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যাবো অন্তর্দেশীয় বহির্গমনের উদ্দেশ্যে। আমাদের বিমান সকাল ৮ টা ৫ মিনিটে, ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেট।

জুলাই, ২০২৩

কিচেন গার্ডেন (Kitchen Garden)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


ছোটবেলায় দিদাকে দেখছি কাঁচা রান্নাঘর সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত আর্দ্র অঞ্চল থেকে থানকুনি পাতা তুলে আনতে। পেটের রোগে ভুগলে থানকুনি পাতা পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো, হয়তো এখনও হয়। পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হলেও থানকুনি পাতা বাটা খুবই সুস্বাদু একটি খাদ্য। আবার গ্রামাঞ্চলে মানুষ ক্ষেত, খামার, পুকুর ঘাট, খালবিলের আশপাশ থেকে শাকপাতা তুলে আনতো, আমিও এক আধবার মামাবাড়িতে গেলে দিদির সাথে কালীপুজোর  আগের দিন চোদ্দ শাক তুলতে গিয়েছি। 'কিচেন গার্ডেন' কথাটির বিশেষ ব্যবহার তখন হতো না। আসলে কোনো কিছুর অনুপস্থিতি তার গুরুত্ব বোঝায়। তখনও নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা আজকের অবস্থায় পৌঁছয়নি। সকলেরই বাড়িতে একটু আধটু জায়গা, উঠোন ছিল, মানুষ তাতে বিভিন্ন ধরণের সব্জি লাগাতেন, বেশিরভাগ সময়ে তা এমনিই ফেলে দেওয়া সব্জি বা ফলের বীজ থেকে জন্মাতো, পরিচর্যা বিশেষ লাগতও না। ঘরের চালে কুমড়ো, চালকুমড়ো, লাউ, কিংবা উঠোনে লঙ্কা, লেবু, এমনকি বাড়ির পিছনে কচু, বিভিন্ন ফলের গাছ যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল, বেল, নারিকেল ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যেত। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতেও নানান ফলের গাছ ছিল। যেহেতু, এই সকল সুবিধে সহজেই প্রাপ্ত হতো, এর গুরুত্ব তখন অতটা উপলদ্ধি হয়নি। এখন শহরাঞ্চলে এক চিলতে মাটি সহজে পাওয়া যায় না, শহর কেন্দ্রিক সভ্যতায় আজ বড়ো বড়ো গগনচুম্বি অট্টালিকাগুলি আজ মুখ্য ভূমিকায়, মাটি কংক্রিটাবৃত। বাড়ির উঠোন, বাগান আজ অমিল আর তাই 'কিচেন গার্ডেন'-র গুরুত্ব এখন উপলব্ধি হচ্ছে। বাড়ির সংলগ্ন এই বাগানগুলি হারিয়ে যাওয়ার রেশ কিন্তু মানুষের পুষ্টির উপর এসে পড়ছে। যেমন বাড়ির চালে হয়ে থাকা কুমড়ো ভিটামিন A প্রদান করে, বেড়ার গায়ে যে লাউটা হয়ে থাকে তাতে প্রচুর পরিমানে ফোলেট বা ফলিক অ্যাসিড (Folate/ ভিটামিন B9) থাকে, আবার ওল বা কচুতে রয়েছে অনেক ক্যালসিয়াম (Calcium), এগুলো কিন্তু এমনিতেই পাওয়া যেত। পুকুর ধারে হয়ে থাকা নানান শাকগুলোতে মিনারেল আর ভিটামিনের প্রাচুর্য্য উল্লেখযোগ্য (অনুগ্রহ করে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক পড়ুন)।

চাল, গম, মূলত শর্করা জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে; ডাল, মাছ, মাংস প্রোটিন সরবারহ করে; তৈলবীজগুলি তেল বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে। এই হলো তিন প্রকার বৃহৎ জাতীয় পুষ্টি উপাদান যা ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Macro-nutrient) নামে পরিচিত। অপরপক্ষে, শাক-সব্জি, ফল হলো মিনারেল এবং ভিটামিনের অন্যতম প্রধান উৎস, এরা মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Micro-nutrient) নামে পরিচিত। এই সকল অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলি পুষ্টি নিশ্চয়তার জন্যে একান্ত প্রয়োজন, যা অনেক সহজেই গৃহ সংলগ্ন বাগান থেকে পাওয়া যেত এবং এগুলি বাজার থেকে ব্যয় করে ক্রয় করার প্রয়োজন হতো না। কাজেই ব্যবহারিক জীবনে বিনামূল্যে পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ খাবার পাতে এসে পৌঁছতো।    

সাধারণভাবে, সভ্যতায় নগরকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পেলে অধিক মানুষ গ্রাম থেকে নগরে বসবাস শুরু করে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ চিত্র বর্তমান। কৃষক, পশুপালক, কামার, কুমোর, ছুঁতোর সকলে যারা গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদন্ড ছিল, তারা ক্রমে 'ভালোভাবে' বাঁচার আশায় কর্মসংস্থানের সন্ধানে শহরে আসতে শুরু করেন, গ্রামের অপেক্ষাকৃত খোলামেলা বাগান, উঠোন সহ ঘরের পরিবর্তে শহরের ছোট ছোট গায়ে গায়ে লাগানো ঘর। সকল কিছুই সেখানে বাজার থেকে পয়সা খরচ করে আহরণ করতে হয়। এদিকে শহরও আয়তনে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তার আশেপাশের ভূমির তথা বাস্তুতন্ত্রের চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বনাঞ্চল পরিষ্কার করে নগর আয়তনে বৃদ্ধি পায়। বনের শুকনো কাঠ জ্বালানির জন্যে, বনের ঘাস পশুখাদ্যের জন্যে, পাতা সারের জন্যে, বাঁশ, গোলপাতা ঘর বানানোর জন্যে, বনের ফল-মূল-মধু খাওয়ার জন্যে - এসকলের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করে একটা পরিবর্ত পরিস্থিতিতে উপনীত হয়, অনিবার্যভাবে এঁদেরও আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে নগর। এতদিন যখন সকলেই কিছুটা কিছুটা খাদ্য নিজ নিজ পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করতো আজ সকলেই সম্পূর্ণটার জন্য বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে। অনিবার্যভাবেই পূর্বের সাধারণ চাষী বর্তমানে পরিণত হয়েছেন বাজার-চালিত কৃষকে, সেই সকল উৎপাদনে মানব সভ্যতা মনোনিবেশ করেছে যা অধিক মুনাফা দেয়, মাত্র কয়েকটি খাদ্যের উপর আজ জোর দেওয়া হচ্ছে, ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে খাদ্য বৈচিত্র।     

আজকে যখন আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে খাদ্যের বৈচিত্র পুষ্টি নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে অপরিহার্য, ততদিনে অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। একসময় যা সহজলভ্য ছিল, উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে যা হেলায় হারিয়েছি তা আজ প্রকৃতই দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এই বিষয়ে বর্তমানে অনেকগুলি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্কুল কিচেন গার্ডেন। প্রধানত এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য স্কুল কিচেন গার্ডেন স্থাপন করার মাধ্যমে, ছাত্র-ছাত্রীদের এর ফলে উৎপন্ন সব্জি ফল ইত্যাদি খাওয়ার ফলে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাব পূরণ হবে, তাঁদের শাক-সব্জি ফলানোর অভিজ্ঞতা লাভ হবে, এবং শাক-সব্জি ইত্যাদির পুষ্টি বিষয়ে তাঁরা জ্ঞানলাভ করবেন এবং জাঙ্ক-ফুডের (Junk food)  ক্ষতিকারক দিকগুলি সম্বন্ধে সচেতন হবেন। কিচেন গার্ডেনের প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজ্য ভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।বাড়িতে কিচেন গার্ডেন করলে তা যেমন খাদ্যের বৈচিত্র বাড়াবে, পুষ্টির অনিশ্চয়তা দূর করার হাতিয়ার হবে, তেমনি এটা অতিরিক্ত আয়ের একটা পথও হয়ে উঠতে পারে।

শঙ্করপুর (Shankarpur)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে গিয়েছিলাম তাজপুর-শঙ্করপুর-দীঘা বেড়াতে। তাজপুর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একটি ব্লগ আমি পূর্বে লিখেছি। আজকের ব্লগে আমি শঙ্করপুর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা লিখবো। 

ভ্রমণপিপাসু বাঙালীর কাছে কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থিত দীঘার সমুদ্র সৈকত একটি নস্টালজিয়া।সপ্তাহান্তে চলে আসাই যায়। অনেকে এখন একটু অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে পছন্দ করেন, আমার কিন্তু আজও দীঘা অত্যন্ত প্রিয়। 

ছোটবেলার দীঘার স্মৃতি আজও উজ্জ্বল, তখনও বঙ্গোপসাগরের সৈকতে আজকের মতন মেরিন ড্রাইভ গড়ে ওঠেনি, ঝাউবন হারিয়ে যায়নি, ট্রেন লাইন পাতা হয়নি, নতুন দীঘা গড়ে ওঠেনি, আসে পাশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলিও আজকের মতন বিকশিত হয়নি। তখন হাওড়া বা ধর্মতলা থেকে বাসে করে দীঘা পৌঁছতে হতো, যা এখন পুরোনো দীঘা বলে পরিচিত। মোবাইল এবং ইন্টারনেট নির্ভর জীবনযাত্রা তখনও গড়ে ওঠেনি, কাজেই বাস স্ট্যান্ডে নেমে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন হোটেল দেখেশুনে ঘর নেওয়াই ছিল প্রচলিত প্রথা, সৈকতের উপরে হলে তো কথাই ছিল না। তবে অনেকে আগে থাকতেই ঘর রিসার্ভ করেও আসতেন। তারপরেই সমুদ্রে ছোটা, সমুদ্রস্নান সেরে, রেস্তোরাঁগুলিতে খাওয়া বা কখনও মনের মতন মাছ রাঁধিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারা, একটু দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রাম, আবার সমুদ্রপাড়ে বসে উপভোগ করা, রাত্রে ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে যে সরুপথ চলে গেছে তা ধরে হোটেল থেকে সমুদ্রপাড়ের রেস্তোরাঁতে খেতে আসা, এইভাবে দিন দু'য়েক কাটিয়ে আবার ফিরে আসা দৈনন্দিন ব্যস্তময় জীবনে। তারপর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, দীঘার পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছে, সৈকত কেন্দ্রিক এই পর্যটন বর্তনীটি (দীঘা-শঙ্করপুর-তাজপুর-জুনপুট-মন্দারমনি) আজ খুবই জনপ্রিয়। এখন দীঘা গেলে বেশিরভাগ মানুষ শংকরপুর, মন্দারমণি, তালসারি, তাজপুর, উদয়পুর সৈকত ইত্যাদি স্থানগুলো ঘুরে আসেন। 

আমরাও তাজপুর থেকে গিয়েছিলাম শঙ্করপুরে। তাজপুর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শংকরপুর সমুদ্র সৈকতে পৌঁছতে সময় লাগে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। আর সেখান থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দীঘা। শঙ্করপুর পশ্চিমবঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য মৎস বন্দর কেন্দ্র। শঙ্করপুর সৈকত তুলনামূলকভাবে এখনও কম জনবহুল।
 

সমুদ্র সৈকতে রয়েছে কয়েকটি দোকান, দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসেছেন, ঝিনুক দিয়ে বানানো বিভিন্ন দ্রব্য, চাবির রিং, শঙ্খ, কাঠের গাড়ি, পুতুল ইত্যাদি আরও হরেক জিনিস। পায়ে পায়ে মৎস বন্দরের দিকে এগিয়ে এলাম, অনেক ট্রলার দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি, এগুলি মাছ ধরার ট্রলার। ট্রলার থেকে পাটাতন নামিয়ে রাখা হয়েছে তীরে, সেই পাটাতন বেয়ে বিরাট বিরাট বরফের চাই মাথায় নিয়ে কর্মীরা উঠে যাচ্ছেন ট্রলারে। অত্যন্ত ব্যস্ত দিন, কয়েক হাজার মানুষ এই মাছ ধরার কাজে যুক্ত, এতেই তাঁদের জীবনধারণ হয়। বছরে প্রায় ১০ মাস চলে মাছ ধরার কাজ, দুই মাস এপ্রিল মাসের মধ্যবর্তী সময় থেকে জুন মাসের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ওই সময় মাছের সংখ্যা যেন বৃদ্ধি পেতে পারে সেইজন্যে মাছ ধরা বন্ধ থাকে। 


এবার এই মৎস বন্দরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাছের প্রজাতির উল্লেখ করি (আমি পূর্বের একটি ব্লগ 'বাঙালির আহারে মাছ'-এর উপরে লিখছি)। এখানে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই বলি কন্ড্রিকথিস (Condrichthyes: যে সকল মাছের দেহে অস্থি অনুপস্থিত, এদের দেহে তরুনাস্থি (Cartilage) বর্তমান) শ্রেণীর কথা। এই শ্রেণীর অন্তর্গত উপশ্রেণী হলো এলাসমব্র্যাংকি (Elasmobranchii)। এদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এদের পাঁচ থেকে সাত জোড়া গিল বর্তমান যা বাইরের দিকে উন্মুক্ত, পৃষ্ঠদেশের পাখনা দৃঢ় হয়ে থাকে, এবং দেহে ছোট ছোট প্ল্যাকোয়েড আঁশ উপস্থিত। এই উপশ্রেণীর অন্তর্গত মাছের দেহে সুইম ব্লাডার থাকে না। এদের মুখের অভ্যন্তরে দাঁতের একাধিক সিরিজ রয়েছে। হাঙ্গর, রে ইত্যাদি এই উপশ্রেণীর অন্তর্গত প্রজাতি। ব্ল্যাকটিপ হাঙ্গর (Carcharhinus limbatus), স্পেডনোজ হাঙ্গর (Scoliodon laticaudus), দুধ হাঙ্গর (Rhizoprionodon acutus), ধূসর স্টিং রে (Dasyatis zugei), হানিকোম্ব স্টিং রে (Himantura uarnak) ইত্যাদি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।হাঙ্গর বা রে বাঙালির পাতে খুব উপাদেয় বলে গণ্য না হলেও বাইরে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। হাঙ্গরের লিভার থেকে প্রাপ্ত তৈলের ঔষধিগুণ রয়েছে, যা ফার্মাসিউটিকাল শিল্পে ব্যবহৃত হয়। কয়েক প্রকার হাঙ্গর এবং রে মাছের লিভার থেকে প্রাপ্ত তৈলের ব্যবহার চর্মশিল্পেও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও মাছের খাদ্য বা ফিশমিল (Fishmeal) এবং সার (Manure) প্রস্তুতিকরণে এই মাছগুলি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এরপর আসি অস্থিযুক্ত মাছের কথায়, যা অস্থিকথিস (Osteichthyes) শ্রেণীর অন্তর্গত। এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত একটি উপশ্রেণী হলো একটিনটেরিজি (Actinopterygii), যাদের রে-ফিন্ড ফিশ (Ray-finned fish) বলা হয়। ইল (Eel) হলো এই প্রকার মাছ, যা এই বন্দরের একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক মাছ। ইলের জীবনচক্র খুব কৌতূহলোদ্দীপক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের জীবনচক্রে ক্যাটাড্রোমাস (Catadromous) প্রকার লক্ষিত হয়, অর্থাৎ মিঠা জল (Fresh water) থেকে স্পনিং (Spawn) এবং ডিম পাড়ার জন্যে এরা সমুদ্রের নোনা জলে স্থানান্তরিত হয়। ডিম ফুটে যে চ্যাপ্টা এবং স্বচ্ছ লার্ভা বের হয় তার মাধ্যমে ইলের জীবন শুরু হয়, এদের লেপ্টোসেফালি (Leptocephali) বলা হয়। এরা সাধারণত সমুদ্রের পৃষ্ঠতলের ভাসমান জৈব পদার্থের কণা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।  এর পর এরা গ্লাস ইলে (Glass eel) রূপান্তরিত হয়, এই পর্যায়ে তারা মিঠা জলের দিকে ধাবিত হয়। এরপর যথাক্রমে এলভার (Elver), হলুদ ইল (Yellow Eel) হয়ে তারা পরিণত সিলভার ইলে (Silver Eel) রূপান্তরিত হয়। পরিণত সিলভার ইল স্পনিং এবং ডিম পাড়ার জন্যে আবার সমুদ্রের নোনা জলে ফিরে যায়। একটিনটেরিজি (Actinopterygii)-র অন্তর্ভুক্ত ওপর একটি ফ্যামিলি ক্লুপেডি (Clupeidae)। বাঙালির রসনা তৃপ্ত করে যে ইলিশ তা এর অন্তর্গত। বিভিন্ন প্রজাতির ইলিশ (Hilsa ilisha, H. toli, Ilisha kampeni, I. megaloptera ইত্যাদি) এই বন্দরের উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক মাছ। এদের জীবন চক্রে কিন্তু ইলের বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এরা এনাড্রোমাস (Anadromous) প্রকৃতির, অর্থাৎ স্পনিং-র জন্যে এরা সমুদ্রের নোনা জল থেকে মিঠা জলে স্থানান্তরিত হয়। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমানে এনকোভি (Anchovy; Family- Engraulidae), সামুদ্রিক ক্যাট ফিশ (Sea Catfish), উল্ফ হেরিং (Wolf Herring; Family- Chirocentridae) ইত্যাদি। এখানে উল্লেখযোগ্য লোটে বা লোইট্যা (Harpadon nehereus), বাঙালির আর এক রসনা তৃপ্তকারক এই মাছ। এর প্রচলিত নাম বোম্বে ডাক (Bombay Duck/Bombay Daak)। এই নামকরণের পিছনের কাহিনীটি বেশ মজার। তখন বোম্বের (বর্তমানের মুম্বাই) মৎসবন্দরগুলোতে বিপুল পরিমানে এই লোটে উঠতো। লোটে বাঙালির খুবই উপাদেয়।  রেলগাড়ি চালু হওয়ার পর মেল ট্রেনের (Mail train) মাধ্যমে তা সুদূর বোম্বে থেকে কলকাতায় এসে হাজির হতো। বাংলায় 'মেল/Mail' শব্দটির অর্থ ডাক, অতএব এর নাম হয়ে গেলো বোম্বে ডাক। এখানে অপর দু'টো উপাদেয় মাছ ব্ল্যাক পমফ্রেট (Black pomfret, Parastromateus niger; Family- Carangidae) এবং সিলভার পমফ্রেটও (Silver pomfrets, Pampus argenteus, P. chinensis) উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায়।

বেশ কিছুক্ষন শঙ্করপুরে কাটিয়ে আমরা রওনা হয়েছিলাম দীঘার উদ্দেশ্যে। 

অক্টোবর, ২০১৭

পুষ্টি সুরক্ষা ও আমাদের সমাজের কিছু চিত্র (Nutrition Security and Society)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আমি পূর্বে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-১: সূচনা ব্লগটিতে বর্তমান ভারতবর্ষে পুষ্টি বিষয়ক চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমান ব্লগে ব্যবহারিক জীবনে খাদ্য বা পুষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা অংশ তুলে ধরার একটা প্রয়াস করবো। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন চিত্র। তা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাহিনী নয়। চরিত্র নামকরণ অপ্রয়োজনীয় কারণ এটি কোনো গল্প বা উপন্যাস নয়, বাস্তবের উপর ভিত্তি করে কিছু কাল্পনিক কাহিনী/ ভাবনা/ সংলাপ, যা থেকে সহজে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য এবং পুষ্টির স্থান অনুমান করা যাবে। আসলে খাদ্য এবং পুষ্টির সুরক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির পাশাপাশি আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কিছু সচেতনতা ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পুষ্টির সুরক্ষাকে দ্রুততর করে।  সেই রকম কয়েকটি দিক তুলে ধরতেই আমি এই কাল্পনিক সমাজচিত্রটির অবতারণা করলাম এই ব্লগে।

-------------------------------------------------------

'আগে বললেই পারতে, কিছুটা তুলে রাখতে বলতাম, অতটা খাবার নষ্ট হতো না'

অশীতিপর বৃদ্ধ বক্তার উদ্দেশ্যে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকায় বছর ত্রিশের অতিথি যুবক। গৃহের অন্য সদস্যরা হা হা করে ওঠেন, 'আরে না না, কি হয়েছে! আগে থেকে কি ঠিক বোঝা যায়, তুমি কিছু মনে করো না বাবা, ওনার তো বয়স হয়েছেইত্যাদি।

যুবক মনে মনে ভাবলেন, বৃদ্ধ বড়ই খিট্খিটে, কারোর বাড়িতে এলে এরকম কথা কেউ অতিথির উদ্দেশ্যে বলে নাকি! যাইহোক, আমতা আমতা করে প্লেটটি সরিয়ে রাখলেন। আবার গল্প গুজব চলতে থাকে। নানান কথা, ছুঁয়ে যায় একটার পর একটা বিষয়, চলচ্চিত্র-রাজনীতি-খেলা-সমাজ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি কি নেই সেখানে। একের মুখ থেকে কেড়ে আরেক মুখ কথা বলে ওঠে, সেখানে তথ্য-তত্ত্ব কিছুমাত্রায় ঠাঁই পায় বটে, তবে কল্পনা, ধারণা, নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার এক রমরমা আজকাল বড়ই চলছে। অতিথি নির্দিষ্ট সময় পার করে চলে যান, সবাই খুব ব্যস্ত আজকাল, তারমধ্যে সময় বের করে সকলের খোঁজ নিতে এসেছে সে, সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় অতিথির। এর মধ্যে কেউ একজন অর্ধেক খাবার পূর্ণ প্লেটটি টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।  রান্না ঘরের পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় গোটা দুয়েক তরকারি লেগে যাওয়া লুচিঅবশিষ্ট তরকারি আর দেড়খানা রসগোল্লা। বৃদ্ধ তাঁকিয়ে দেখেন। এমন ভাববেন না বৃদ্ধ গরীব, সে আর তাঁর পরিবার উচ্চ মধ্যবিত্ত। একটু বাদে আহ্নিক সেরে বৃদ্ধ তাঁর ঘরের ইজি চেয়ারটায় এসে বসবেন, চিনি ছাড়া চা আর দু'টো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট আসবে তাঁর জন্যে। দিনে দু'বার চা খান বৃদ্ধ, সকালে গ্রিন টি আর সন্ধ্যায় এমনি প্রচলিত চা, যাকে ব্ল্যাক টি বলে। তবে এই যে স্বাচ্ছন্দ্য, বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যায়ে পৌঁছনো সেই দীর্ঘ পথ কিন্তু মসৃন নয়, সেখানে অগণিত না খাওয়া রাত রয়েছে, আক্ষরিক অর্থে দু'মুঠো ভাত খেয়ে দিনাতিপাত রয়েছে, মুখ ফুটে খাবার চেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে বসে থাকার মুহূর্তগুলো রয়েছে, খাবারের আশায় ক্রোশের পর ক্রোশ পথ চলা আছে, আবার এর মাঝে কখনও জুটে যাওয়া কিছু ভালো খাবার আর তা নিয়ে উল্লাস রয়েছে। বৃদ্ধ ভাবেন, সেই সময়কার কথা, তাঁদের জীবনধারণের কথা, সে অনেকটা সংগ্রামের মতন শোনায়, বৃদ্ধ অনেক গল্প বলেন তাঁর নাতি নাতিনীদের, সবই আবর্তিত হয় নিজের জীবনের  কথা, তাঁর শৈশব, বড়ো হওয়া, কর্ম জীবন, ইত্যাদি। সবাই যে বোঝে তা নয় আবার বোঝে যে না তাও নয়। তবে কারা ভালো বোঝে, সে বোঝা দায় ! 

এই যে মেয়েটি প্রত্যেকদিন ঘরের কাজ করতে আসেন ওঁর মেয়েকে স্কুলে দিয়েছে, দাদার সাথে সেও যায়, রোজ স্কুলে খেতে দেয়, ও বলছিলো একবেলার জন্যে ও নিশ্চিন্ত। আবার পুজোর ফুল বাজারে যার কাছ থেকে নেওয়া হয়, ও বলছিলো ছেলেটাকে স্কুল পাঠিয়ে পড়াশুনা আর দুপুরের খাওয়াটা দু'টি বিষয়েই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। এঁরা হয়তো বোঝেন।

এই চিত্র আবার বৃদ্ধের প্রতিবেশী বাড়িটির ক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা। ওঁদের থেকে বৃদ্ধ কথায় কথায় শুনেছে ওঁদের বাড়ির ছেলেটা রোজ স্কুলের মিড ডে মিলের খাবারটা খায়না, মাঝে মাঝে খায়, ডিম দিলে সেটা নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। ওঁরা কেক, চিপস এসব দিয়ে দেন টিফিনে।

বাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার করতে এসেছে একটা লোক, দুপুরে বৃদ্ধের বাড়িতে খেতে দেওয়া হয়েছিল, সাধারণত এসকল লোককে নিরামিষই দেওয়া হয় কিন্তু সেদিন বাড়িতে মুরগির মাংস একটু বেশি পরিমানেই রান্না হয়েছিল, দু'টুকরো লোকটাকে দেওয়ায় তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, তা বৃদ্ধ লক্ষ্য করেছিলেনখাবারের অভাব এও হয়তো বোঝে।

'তোমার ঘরে কে কে আছে?'

'বৌ, এক ছেলে আর এক মেয়ে বাবু'

'ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়াশুনো করাচ্ছ তো?'

'আজ্ঞে!' একটু আমতা আমতা করে বলে 'আসলে গত দু'বছরে তেমন কিছু রোজগারপাতি ছেলো না, তাই মেয়েটা মায়ের সাথে কাজের বাড়ি যায়।

বৃদ্ধ বলে ওঠেন, 'বলো কি ! স্কুল ছাড়িয়ে দিলে?'

'না বাবু, আবার যাবেখন, মানে স্কুল ও তো বন্ধ ছেলো, তাই ......, তা যাবেখন আবার, গেলি তো খাওন টাও পায়।'

বৃদ্ধ বোঝে, কিন্তু কি বলতে হবে সেটা বোঝেন না !    

বাড়িতে হৈ হৈ পরে যায়। বৃদ্ধের বড়ো নাতি এসেছে, কর্মসূত্রে সে প্রবাসীকাজেই সকলে ঠিক করলো বাইরে খাবে। তবে এখন বাইরে বেড়ানোটা বেশ অসুবিধাজনক, প্যানডেমিকের কারণে একটা উদ্বেগ থেকেই যায়। অবশেষে ঠিক হলো খাবার আনিয়ে নেওয়া হবে যার যা ভালো লাগে, সবাই নিজের নিজের মতন অর্ডার দিলো, বিরাট আয়োজন। কেউ ফ্রাইড রাইস, কেউ বাসন্তী পোলাও, কেউ সাদা ভাত, আবার কেউ বিরিয়ানি। কেউ মাটন কষা, কেউ রেজালা, কেউ চিকেন বাটার মশালা, আবার কেউ পনির মশালা। আরও কত কি! কেউ কিন্তু নিজের সমস্ত খাবার এবেলায় শেষ করতে পারলো না। বৃদ্ধকে সকলে কথা দিলো, রাতে অবশিষ্টাংশ খেয়ে নেবে তবে তা আর হয়নি, অবেলায় এতো কিছু খেয়ে রাতে কেউ খাবার মুখেই তুলতে পারলো না। আগেরবার, মানে দু'বছর আগে কিন্তু এমনটা হয়নি, সেবার সবাই মিলেমিশে অর্ডার দিয়েছিলো, মানে এক প্লেট পোলাও দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, আবার এক প্লেট মাটন দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, এতে পুরোটাই খেতে পেরেছিলো, নষ্ট হয়নি         

বৃদ্ধ কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন। সেখানে একাধিকবার সে বিভিন্ন পার্টিতে যোগ দিয়েছে, ওখানে অনেকটা খাবারের এমন রীতি, অনেক খাবারের আয়োজন হয়। রেঁস্তোরা থেকে যখন বেরোয় কত খাবার পাতেই পড়ে থাকে।  বৃদ্ধের, তখন সে যুবক, মুখ থেকে কতবার আক্ষেপ সূচক বাক্য নিঃসৃত হয়েছেএকবার সাহেব বন্ধু বলেছিলেন, 'আরে এই খাবার বাঁচলে কি পৃথিবীর খাদ্য সংকট মিটে যাবে নাকি?' যুবক কিছু বলেননি, শুধু তাঁকিয়ে থেকেছেন আর ভেবেছেন কয়েক বৎসর পূর্বের তাঁর জীবনের কথা। এখানে এতো খাবার নষ্ট হয় আর এমন মানুষও আমাদের সমাজে ছিলেন যারা ফসল তোলার পর মিনতি করতে আসতেন, বাবু যদি তাঁদের আজ্ঞা দেন তবে তাঁরা মাঠে পরে থাকা শস্য সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে পারেন। প্রবাস জীবনে বাজার করতে গিয়েও তিনি অভিজ্ঞতা করেছেন সেদেশে সকল বস্তুই নির্দিষ্ট ওজন করা প্যাকেটে বন্দী, ঠিক যতটা লাগবে ততটা কেউ ওজন করে নিতে পারবেন না (আমাদের দেশের বাজারের মতন), কাজেই অধিকাংশ সময়ে অতিরিক্ত পরিমান বস্তু বাজার থেকে নিয়ে আসতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে তা পচে নষ্ট হয়।  

কি রে ওটা কি রাখলি? এক খানা ডিম নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’ কাজের মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন গৃহকত্রী।

‘আর বোলো না গো মা, ছেলেটা মোটে নিরিমিষ মুখে তুলতে চায় না, তাই আর কি করি, এই এক খান ডিম নিয়ে যাচ্ছি, ভেজে দেবোখন, ভাত দু'টি খাবে।’ উত্তর দেয় মেয়েটি।

তা এক খানা নিলি যে বড় ! বোনটার জন্যে নিলি না ?’

না গো, ও বড় লক্ষ্মী, ও খেয়ে নেয় যা জোটে।’ 

আচ্ছা, বুঝেছি, বলে এক খানা ডিম ফ্রিজ থেকে এনে দেন মেয়েটির হাতে, বলেন দুই ভাইবোনকেই ভেজে দিস।

বৃদ্ধ দেখছিলেন। ভাবছিলেন কয়েক দশক আগের কথা, যখন রাত্রের আহারে তিনি একা মাছের টুকরো খেতেন, বিধবা মা আর স্ত্রী খেতেন ভাত-ডাল আর যেদিন যা তরকারী থাকতো তাই। বাইরে কাজের জন্যে কোন সকালে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন রাত্রে, তাই টানাটানির সংসারে দু'বেলা যা কিছু উত্তম জুটতো তা তাঁর পাতেই জায়গা পেতো। এই নিয়ে অবশ্য মা বা স্ত্রীর কোনো আফসোস ছিল না। তাঁরা তো বাড়িতেই থাকতেন, সমস্ত ঘর পরিষ্কার, রান্না করা, কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া, ইত্যাদি কত শত কাজ, তবে সবটাই বাড়িতে, কাজেই তাঁরা 'অধিক' পরিশ্রম করে যিনি সংসার টানছেন বলে মনে করতেন তাঁকেই ভালোটা পরিবেশনের জন্যে সচেষ্ট থাকতেন।  

তবে প্রথমবার যখন তাঁর স্ত্রী মা হয়েছিলেন, তখন মা এবং সন্তান বেশ ভুগেছিলেন। মেয়ে সন্তানের ওজন হয়েছিল অনেক কম, জ্বর, ডায়রিয়া ইত্যাদির সাথে লড়তে লড়তে বাচ্চাটা প্রায় বিছানায় মিশেই গিয়েছিলো। ডাক্তার অনেক বাকাবকি করেছিলেন। এই সকল ভোগান্তি অপুষ্টিজনিত বলেছিলেন, বৃদ্ধ (তখন যুবক) বুঝেছিলেন কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস ততদিনে পদোন্নতি হয়েছিল তাইতো অনেক ডাক্তার হসপিটাল করে কোনো মতে মা মেয়েকে সুস্থ্য করে ঘরে এনেছিলেন। সে প্রায় বছর পঞ্চাশের আগের কথা, এখন তো খুকীর ছেলেই কত বড় হয়ে গেছে ! তারপর তো মা চলে গেলেন। অফিস থেকে তাঁকে পশ্চিমে পাঠালো। জীবনে এক ধাক্কায় অনেকটা পরিবর্তন এলো। খুকী খুবই ঘ্যান ঘ্যান করতো ছোটবেলায়, সে ওই দেশে কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া শুরু করলো, দিদিমণিদের পরামর্শে খুকীকে কাউন্সেলিং করানো হলো, ধীরে ধীরে বেশ চনমনে হয়ে উঠলো  সে। তারপর তাঁদের একটি ছেলে হলো, ডাক্তার স্ত্রীর মেডিকেল হিস্ট্রিতে সিজার দেখে একটু চিন্তিত হলেন।  যাইহোক এবার পূর্বের ন্যায় পরিস্থিতি হলো না, তবে সেবারও স্ত্রী সিজারের মাধ্যমেই পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।

এসকল ভাবছিলেন বৃদ্ধ, তখন নাতি ঘরে প্রবেশ করলেন। বৃদ্ধ তাকালেন, দৃষ্টিটা একটু পরিষ্কার হলে প্রশ্ন করলেন, 'হ্যাঁ রে তুই যে দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছিস' ! নাতি হেসে উত্তর দিলো 'সেডেন্টারি লাইফ গো দাদু, সারাদিন বসে বসে কাজ, জগৎ সংসার এগিয়ে চলছে আর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে উৎপন্ন করছে এই অপুষ্টিগত পরিনাম' বলে থামে সে।

তা কতদিন ছুটি পেলি?

আর ছুটি..’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে পেয়েছি দু'দিনের, তার সাথে রবিবার 

বাব্বা, কাজের তো বড্ড চাপ ! তা খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকে করিস তো?

হ্যাঁ সেটা করি, বেশিরভাগ দিন দুপুরে অফিসেই বিরিয়ানি না হয় সিজওয়ান ফ্রাইড রাইসের একটা প্লেট আনিয়ে নিই, বাড়িতে রাতে হালকা কিছু ধরো রুটি আর মাংস বা পনিরের কিছু একটা আর টক দই। খাওয়া নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা নেই

নাতি আরো বলে ও যেখানে বাসা ভাড়া নিয়েছে, তার সামনে বেশ কতগুলো দোকান রয়েছে, পিজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, মোমো, পাস্তা সব কিছুই সেখানে সহজলভ্য। নাতির মধ্যে কি যেন খোঁজে বৃদ্ধ, হয়তো নিজের তরুণ অবস্থাকে, নাতিকে দেখতে পুরো তাঁরই মতন। এই বয়সে তাঁর নিজের কি অবস্থা ছিল, কিভাবে যে বেঁচেছিল অসহায় মাকে নিয়ে সেটাই সে বুঝতে পারে না। দিনের পর দিন ভাত, এখান-ওখান তুলে আনা কলমি শাক ভাজা খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া, এই ছিল তাঁদের দিনাতিপাত। ডাল-ভাত-তরকারি-মাছ সহযোগে পরিপূর্ণ আহার তাঁদের কাছে তখন ছিল চাঁদ হাতে পাওয়ার মতন, তা সম্ভব হতো যদি কেউ নিমন্ত্রণ করতেন তবে মা'র মুখে কোনোদিন তেমন সুখাদ্য তুলে দিতে পারেননি বৃদ্ধ। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে নাতির ডাকে, দাঁড়াও আমি আসছি বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক বাদে, হাতে তখন আলুর চিপস আর এক গ্লাস কোল্ড ড্রিঙ্কস। নাতিকে খেতে বারণ করে বৃদ্ধ, পরক্ষণে কি মনে হয় আবার বলে আসলে একটু এসব কম খাস মনে মনে হিসেব করে, পয়সা যখন ছিল না আর যখন হলো আসলে ঠিক কতটা পার্থক্য হলো ?  

কাজের মেয়েটি আবার আসে পড়ন্ত বিকেল বেলায়। ও রেশন নিয়ে কার্ড ফেরত দিতে এসেছে। গৃহকত্রী রান্না ঘর থেকে বলেন দাদুর কাছে রেখে যেতে। বৃদ্ধ হাসিমুখে কার্ডগুলো রেখে দেয়। 'দাদু কি হয়েছে? হাসছ যে'! 'না রে, আসলে ভাবছি কত মানুষের মুখে অন্ন উঠছে, একি আর মুখের কথা রে দিদিভাই' 

দাদু ওঁকে বলেন নাতিকে ডেকে দিতে। মেয়েটি নাতিকে ডেকে দিয়ে চলে যায়। দাদু বলে তোর ল্যাপটপ টা আন তো, দু'জনে মিলে একটা সিনেমা দেখি, আজ দেখবো মৃনাল সেন পরিচালিত 'আকালের সন্ধানে' আর কাল দেখবো সত্যজিৎ রায় পরিচালিতগুপী গাইন বাঘা বাইন'

এই দু'টো বাছলে কেন?

আচ্ছা.....তবে তুই বল। না থাক, আছে তো আরও তবে আগে এই দুটোই দেখি

বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য (Ecosystem services and Foods)

সম্পত ঘোষ  (Sampat Ghosh)

'আঃ বড্ড দাম নিচ্ছ, তরকারীতে তো হাত দেওয়ার উপায় নেই গো'খদ্দেরের অভিযোগ শুনে বিক্রেতা একগাল হেসে, 'আমরাও তো দাম দিয়ে কিনে আনি বাবু, কতটুকু আর লাভ থাকে! তবে মাল আমার এখানে এক্কেবারে টাটকা' এই বলে প্রয়োজনীয় সব্জিগুলি খদ্দেরকে গুছিয়ে দিয়ে দেয়। খদ্দেরবাবু মনে মনে একটু খুশি হয়, অতিরিক্ত দামের জন্যে মনের মধ্যে যে ক্ষতটা সৃষ্টি হচ্ছিলো, টাটকা সব্জি কিনতে পেরে সেই ক্ষতে মলম পড়ে।

এই যে খাবারগুলি প্রত্যহ আমরা খাই, তা উৎপাদন করতে আমাদের একটা খরচ হয়, যেমন ধরা যাক চারা বা বীজ কিনে আনা, রোপন করা, উপযুক্ত পরিমানে জল (সেচের মাধ্যমে বা ভূগর্ভস্থ জল তুলে), সার (পরিপূরক হিসেবে), কীটনাশক (প্রয়োজন অনুযায়ী) সরবারহ করা, ফসল তোলা, এবং বাজারজাত করা; প্রত্যেকটি ধাপে কিন্তু খরচ হয় আর এই সমগ্র খরচের উপর বিক্রয়মূল্য নির্ভর করে। মনে রাখা প্রয়োজন, এখানে কিন্তু প্রকৃতি আমাদের থেকে কোনো দাম নেয় না। একটু সহজ ভাষায় বলি, এই যে কৃষি বাস্তুতন্ত্রটি (Agro-ecosystem) প্রকৃতি প্রদান করছে, যেমন ভূগর্ভস্থ বা পৃষ্ঠদেশের জলভাণ্ডার, মাটি যেখানে পুষ্টি উপাদানগুলি রয়েছে যা উদ্ভিদকে জীবনধারণে সাহায্য করে, পরাগবহনকারী প্রাণী (Pollinators) বিশেষত পতঙ্গ (Insects) যা পরাগ সংযোগের জন্যে অপরিহার্য, সেই সকল প্রাণী (যারা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল (Biological control) বলে পরিচিত) যারা শস্যের জন্যে ক্ষতিকারক পতঙ্গগুলিকে ধ্বংস করে; এই তাবৎ সেবা কিন্তু বিনামূল্যেই (বাজার অর্থনীতির বাইরে) প্রাপ্ত হচ্ছে। যদি প্রকৃতি এর জন্যে বাজারমূল্য ধার্য করতো তবে কি হতো একবার ভেবে দেখো !  

এই প্রকার বিভিন্ন সেবা আমরা প্রকৃতি থেকে পেয়ে থাকি। হয়তো বিনামূল্যে পাই বলেই গুরুত্ব আরোপে বিলম্ব হয়। পঁচিশ বৎসর পূর্বে রবার্ট কনস্টানজা (Robert Constanza) তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন যে বাস্তুতন্ত্র যে সকল সুবিধা মানুষকে প্রদান করে তার বাজারমূল্য বার্ষিক প্রায় ৩৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য (Constanza et al. 1997)এর মধ্যে খাদ্য উৎপাদনের জন্যে ক্রপল্যান্ড (Cropland) বাস্তুতন্ত্রটি যে সেবা প্রদান করে তার মূল্য পৃথিবীব্যাপী বার্ষিক ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য (Constanza et al. 1997)কাজেই সহজেই বোধগম্য হয় যে এই মূল্য যদি মানুষকে বাজারমূল্যের ন্যায় চোকাতে হতো তবে খাদ্যের দাম কিরূপ হতো !  

[পরবর্তী কোনো ব্লগে আমি বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করবো।]

অতএব প্রকৃতির কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। মনে রাখা দরকার এই সকল সেবা ব্যতীত শস্য উৎপাদন কিন্তু অসম্ভব আর প্রকৃতি এইসকল সুবিধা প্রদান করবে যতদিন মানুষ প্রকৃতিকে তার ধারণক্ষমতার (Sustainability) মধ্যে থাকতে দেবে। এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কিরূপে সম্ভব? আমাদের প্রকৃতির ধারণক্ষমতাকে বুঝতে হবে, সেই ধারণক্ষমতা বিঘ্নিত হয় এহেন কার্যের থেকে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন। 

প্রথমেই আমাদের মৃত্তিকার কথা মনে আসে কারন মাটিতেই আমাদের খাদ্যের সিংহ ভাগ উৎপন্ন হয়ে থাকে। মাটিতে যে জীব বৈচিত্র থাকে, ব্যাকটেরিয়া থেকে কেঁচো, এরা মাটিকে সতেজ এবং উর্বর রাখে। মৃত্তিকার প্রধান কয়েকটি উল্লেখ্য সেবা হলো, মাটি বিভিন্ন পুষ্টিউপাদান বিশেষত খনিজ ধারণ করে যা উদ্ভিদকে জীবনধারণ করতে সাহায্য করে, মাটি  জল পরিশ্রুত করে, বন্যা এবং খরা প্রতিরোধ করে, এমনকি কার্বণকে সঞ্চিত রেখে জলবায়ু পরিবর্তনকে রোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। মাটিতে উপস্থিত অণুজীব (Microbes) পচন (Decompose) তথা রিসাইকেল (Recycle) প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, এরা গুরুত্বপূর্ণ এন্টিবায়োটিকের উৎসও বটে।। দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বব্যাপী মাটির বা ভূমির অধঃপতিত (Degrade) হওয়ার হিসাব প্রায় ১ থেকে ৬ বিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে (Gibbs and Salmon, 2015; Global Land Outlook by United Nations 2017), বিভিন্ন কারণ যথা নগরায়ন, খনি, শক্তি উৎপাদন ইত্যাদির সাথে মূলত বর্তমান নিবিড় চাষ (Intensive agriculture) পদ্ধতি ভূমির অধঃপতনের জন্যে অনেকাংশে দায়ী। 

জলের সংকট বর্তমান সময়ের একটি চ্যালেঞ্জ। যত জল আমরা তুলে থাকি তার প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে। ফসলের মধ্যে ডাল জাতীয় শস্যের জন্য জল তুলনামূলক কম পরিমানে লাগে, তাও ১ কিলোগ্রাম মশুর ডাল উৎপাদনের জন্যে প্রায় ১২৫০ লিটার জল ব্যবহৃত হয়, আর ১ কিলোগ্রাম বিফের জন্যে লাগে প্রায় ১৩০০০ লিটার জল (FAO)। কাজেই ভেবে দেখা যায় কি পরিমান জল খাদ্য উৎপাদনের জন্যে লাগে ! আবার চাষের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিকের দ্বারা অনেক সময়েই এই জল দূষিত হয় এবং সম্পর্কিত অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রগুলিকেও প্রভাবিত করে থাকে। মনে রাখা দরকার বর্তমানে বিপুল জনসংখ্যা, প্রায় ২.২. বিলিয়ন মানুষ পরিশুদ্ধ পানীয় জলে থেকে বঞ্চিত।তাহলে বোঝা গেলো, এই জলের ব্যবহার এবং সংরক্ষণের বিষয়েও যত্নবান হতে হবে।

আবার বিভিন্ন গবেষণায় পরাগবহনকারী পতঙ্গদের, বিশেষত মৌমাছিদের, স্বাস্থ্য, সংখ্যা এবং বিস্তারের যে চিত্র উঠে আসছে তাও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রায় এক তৃতীয়াংশ খাদ্য উৎপাদন (প্রায় ৭০ টি ফসল/ শস্য) পরাগবহনকারী পতঙ্গদের উপর নির্ভরশীল, যদি এই উপকারী বন্ধু পতঙ্গগুলির সংখ্যা হ্রাস পায় তবে নিঃসন্দেহে তা ফলনের উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে এবং খাদ্য তথা পুষ্টি নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে (Eilers et al., 2011; Smith et al., 2015; Ghosh and Jung, 2018) এই হ্রাস পাওয়ার পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান, যথা, পরাগবাহক পতঙ্গদের বাসস্থান ধ্বংস, ল্যান্ডস্ক্যাপের (Landscape) পরিবর্তন, নিবিড় চাষের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি মনোক্রপিং (Mono-cropping), অতিরিক্ত পরিমান কীটনাশকের (Insecticides) ব্যবহার, উপযুক্ত পুষ্টির অভাব, বিভিন্ন পেস্ট (Pest) এবং প্যাথোজেনের (Pathogen) বৃদ্ধি, এবং অবশ্যই জলবায়ুর পরিবর্তন (Climate change) ইত্যাদি। ঠিক কতটা ক্ষতি হতে পারে তা নিরুপন করা সম্ভব, বিশ্বব্যাপী চিত্রের পাশাপাশি রাষ্ট্র বা অঞ্চল ভিত্তিক চিত্রও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ 

অতএব এই সকল অধঃপতন বা অবনমন (Degradation) প্রতিরোধ করা একান্ত প্রয়োজন, অন্যথা মানবসভ্যতা বিপর্যয়ের সামনে এসে পড়তে পারে। মানুষ বিষয়গুলি অনুধাবন করেছে এবং প্রতিটি বিষয়েই যত্নবান হয়েছে, তবে আরও অনেকটা এগোনো প্রয়োজন। 

তথ্যসূত্র (Reference):

Costanza, R.; d'Arge, R.; de Groot, R.; Farber, S.; Grasso, M.; Hannon, B.; Limburg, K.; Naeem, S.; O'Neill, R.V.; Paruelo, J.; Raskin, R.G.; Sutton, P.; van den Belt, M. 1997. The value of the world's ecosystem services and natural capital. Nature 387, 253–260. https://doi.org/10.1038/387253a0

FAO (Food and Agriculture Organization of the United Nations), Water scarcity- One of the greatest challenges of our time.  https://www.fao.org/fao-stories/article/en/c/1185405/ (accessed on 23rd March 2023)

Ghosh, S.; Jung, C. 2018. Contribution of insect pollination to nutritional security of minerals and vitamins in Korea. Journal of Asia-Pacific Entomology 21, 598-602. https://doi.org/10.1016/j.aspen.2018.03.014 

Eilers, E.J.; Kremen, C.; Smith Greenleaf, S.; Garber, A.K., Klein, A-M. 2011. Contribution of Pollinator-Mediated Crops to Nutrients in the Human Food Supply. PLoS ONE 6, e21363. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0021363

Gibbs, H.K.; Salmon, J.M. 2015. Mapping the world's degraded lands. Applied Geography 57, 12-21. https://doi.org/10.1016/j.apgeog.2014.11.024 

Global Land Outlook, First Edition, United Nations Convention to Combat Desertification, 2017. Bonn, Germany.

Smith, M.R.; Singh, G.M.; Mozaffarian, D.; Myers, S. 2015. Effects of decreases of animal pollinators on human nutrition and global health: a modeling analysis. Lancet 386: 1964-1972. https://dx.doi.org/10.1016/S0140-6736(15)61085-6 

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...