পৃষ্ঠাসমূহ

একটা ছোট্ট ট্রিপ মুম্বইতে (A short trip to Mumbai)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


মহানগরী মুম্বই, ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন এসে পৌঁছলাম দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেছে। এবার সোজা হোটেল সাকিনাকা-তে আমাদের হোটেল, বিমানবন্দর থেকে বেশি দূরে নয়। আমাদের ফেরার ফ্লাইট সকালে, তাই এই জায়গাটা বেশ সুবিধার হলো আমাদের জন্যে। মুম্বই শহরে দীর্ঘদিন আমি কাটিয়েছি, কলেজের পাঠ শেষ করে কর্মসূত্রে এ শহরে আমি এসেছিলাম। মেস, বন্ধু ছেড়ে যেদিন এই শহরে পা রেখেছিলাম, পরিচিত বৃত্তের বাইরে আমি হঠাৎই একা হয়ে পড়েছিলাম। এই শহর আমাকে পরিণত হতে শিখিয়েছেপেশাদারিত্বকে অনুভব করিয়েছে, বাস্তববোধকে দৃঢ় করেছেতারপর অনেকটা দিন অতিবাহিত, এখন অন্য একটি শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াই। অনেক দিন পরে আবার একটা কাজের জন্যে আসতে হয়েছে মুম্বইতে এবং সেই কাজের মধ্যে এক বা দুই দিন এই শহরটাকে (সপ্তাহান্তে স্বল্প দিনের বেড়ানোর মতন) আর একবার দেখে নেওয়া, স্মৃতিকে একটু ঝালিয়ে নেওয়া। দ্বিপ্রাহরিক আহার সারতে একটু দেরিই হয়ে গেলো। তবে আজ কোনো ব্যস্ততা নেই, শুধুই এদিক ওদিক ঘুরে, খাওয়া দাওয়া করে দিন কেটে গেলো।

পরের দিনটা কাটলো ব্যস্ততার মধ্যে। দিনের অনেকটা সময় ব্যস্ত থাকতে হলো নানা কাজে, মাঝে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারলাম বান্দ্রায় এক পারসী মহিলার রেস্তোরাঁয়, তারপর বিকেলের দিকে এসে এলাম মেরিন ড্রাইভে (Marine drive)। কত লোক, কত গল্প, আর তারমধ্যেই মানুষ অবসর খুঁজে নেয় এখানে নিজের সাথে সময় কাটানোর। মুম্বইতে সন্ধ্যা নামে একটু দেরিতে, সন্ধ্যা নামার পর ফিরলাম হোটেলে। মেরিন ড্রাইভ থেকে বান্দ্রা-ওরলি সি লিংক (Bandra-Worli sea link) হয়ে সাকিনাকা আসার পথেই পড়বে হাজি আলি দরগা, নেহেরু প্লানেটোরিয়াম, নেহেরু সায়েন্স মিউজিয়াম। তবে এবার আর এসকল দর্শনীয় স্থানগুলি দেখার মতন সময় হলো না। বান্দ্রা-ওরলি সি লিংক পার হয়ে তারপর মিঠি নদীকে কখনো ডান দিক আবার কখনো বাঁ দিকে রেখে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

পর দিন,

আজ কোনো কাজ নেই, ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে। সকালে প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম দ্য গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া-র উদ্দেশ্যে (The Gateway of India)। 

তৎকালীন ব্রিটিশ সম্রাট জর্জ পঞ্চম এবং রানী ম্যারি-র ভারতবর্ষে আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে তাঁর অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয় এই প্রবেশদ্বার, তবে তা আজকের প্রস্তর ও কংক্রিট নির্মিত রূপে ছিল না। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হয়। ওই বৎসরই এটি সাধারণ জনগণের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে  ফ্রেব্রুয়ারি শেষ ব্রিটিশ সেনা দলটিও এই দ্বারের সামনে থেকে ভারতবর্ষ ছেড়ে ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এখান থেকে যাবো এলিফ্যান্টা কেভ (Elephanta Cave)। দ্য গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া-র সামনে যে জেটি বা ছোট বন্দরটি রয়েছে সেখান থেকে ফেরি ছাড়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এলিফ্যান্টা বা ঘাড়াপুড়ি দ্বীপের উদ্দেশ্যে, সময় নেয় প্রায় এক ঘন্টা। ব্যাসল্ট পাথর খোদিত গুহাগুলি এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলি এই দ্বীপের মূল আকর্ষণ। ফেরী থেকে নামার পর, কিছুটা পথ  হেঁটে, ১২০ টি সিঁড়ি অতিক্রম করে পৌঁছতে হয় মূল গুহাটির সম্মুখে। একটি টয় ট্রেন রয়েছে ফেরী ঘাট থেকে সিঁড়িগুলির সামনে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। পথের দু'দিকে পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বসে রয়েছেন, রয়েছে অনেক রেস্তোরাঁ। পুরাতত্ব বিভাগের মতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে দ্বীপটিতে প্রথম মানব বসতি গড়ে ওঠে, প্রথমে হীনযান বৌদ্ধ এবং তার পরে হিন্দুরা এস্থানে আসেন।  চতুর্থ শতকের ক্ষাত্রপদের (শক) সময়ের কিছু মুদ্রা এখানে আবিষ্কৃত হয়, পরবর্তীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের দলিলে এস্থানের উল্লেখ থাকলেও বিশেষ কিছুই উল্লেখিত নেই। কিছু ঐতিহাসিকদের মতে এই গুহাগুলি সপ্তম শতাব্দীতে বা তারপর রাষ্ট্রকূটরা নির্মাণ করেছিলেন। তবে ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ এবং UNESCO অনুসারে গুহাগুলি পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হয়। কারোর মতে গুহাগুলি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সাময়িক আবার কারোর মতে এগুলি কালাচুরি বংশের দ্বারা নির্মিত। পূর্বেই বলেছি যে পাথর খোদাই করে গুহাগুলি নির্মিত হয়েছে, সমদর্শী স্তম্ভগুলির উপরে রয়েছে বিশালাকার পাহাড়। 

গুহার অভ্যন্তরে রয়েছে মন্দিরের মূল মণ্ডপ আর তার চারপাশে পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে ভগবান শিবের নানান রূপ, সদাশিব-ত্রিমূর্তি, গঙ্গাধর, অর্ধনারীশ্বর, যোগীশ্বর, নটরাজ, কল্যাণসুন্দর, কৈলাশ পর্বত এবং রাবণ-অনুগ্রহের ভাস্কর্য। প্রণাম করলাম ভগবানকে, আর প্রণম্য তাঁর রূপ প্রণেতা। এরপরের দ্রষ্টব্য ক্যানন হিল। এগুলির নির্মাণকার্য অসম্পূর্ণ, আবার কিছুটা ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং পুনর্নির্মিত। এরপর রয়েছে  স্তুপা হিল, যা থেকে এখানে বৌদ্ধদের আগমন ধারণা করা হয়।



এবার ফিরে চলাতবে ফেরার পথে একটি রেস্তোরাঁয় দোসা সহযোগে আহার সারলাম। দ্য গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া তে ফিরে এসে চললাম মেরিন ড্রাইভের উদ্দেশ্যে। এখন থেকে প্রায় সোয়া দুই কিলোমিটার পথ, বিকেল বেলা, কাজেই হেঁটেই চললাম, তাজ হোটেল, লিওপোল্ড কাফে, নারিম্যান পয়েন্ট হয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেরিন ড্রাইভ, যার পোশাকি নাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস রোড। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকা সাগরপাড়ে আর তারপর আবার পথ চলা গিরগাঁও চৌপাটির উদ্দেশ্যে। পাও ভাজি, চা ইত্যাদির সাথে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে এবার ফেরা সাকিনাকা তে, আমাদের হোটেলে।


পরের দিন, সকাল ১১ টার মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হলে আমরা গেলাম খারে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনে। মিশন ঘুরে, মহারাজের সাথে কথা বলে ওখানেই সারলাম আজকের আহার। আহারান্তে প্রণাম সেরে ফিরে এলাম হোটেলে। একটু বিশ্রাম নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে গেলাম জুহু বিচে। জুহু বিচ আমাদের হোটেল থেকে বেশি দূরে নয়, ৯-১০ কিলোমিটার হবে, যেতে বেশি সময় লাগে না। অনেক ছোট ছোট রেস্তোরাঁ রয়েছে বিচের ধারে। বেশ কাটলো আজকের দিন।

কাল ভোরে ফেরার ফ্লাইট।

জুন, ২০১৯

সপ্তাহান্তে বেড়ানো: কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা (Weekend Travel: A few important tips)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


বর্তমানে সর্বাধিক মূল্যবান যদি কিছু থাকে তবে তা হলো সময়। তাই দৈনন্দিন ব্যস্ততার থেকে কয়েকটি দিন ছুটি নিয়ে কিংবা সপ্তাহান্তের দুইদিন বা কখনও তারসাথে সম্ভব হলে শুক্রবারের আধা বেলাটা যোগ করে নিয়ে কোথাও বেরিয়ে পড়া যেতেই পারে। এবার প্রশ্ন কোথায় যাব, কেমন করে যাব, কোথায় থাকব, কত খরচ হবে ইত্যাদি। আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো এই ব্লগটিতে।  

প্রথমেই স্থির করুন আপনার পছন্দ, অর্থাৎ আপনি কি প্রকৃতির সাহচর্য চান, ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যেতে চান, অথবা শহুরে ভাইব্স আপনাকে সতেজ করে, ইত্যাদি। এর উত্তর আপনাকে আপনার পছন্দের জায়গা নির্বাচনে সাহায্য করবে। প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে এবার অগ্রসর হন আর একটু ভিতরে। যেমন ধরুন, যদি আপনার প্রাকৃতিক সাহচর্য পছন্দ হয় তবে সেটা কি সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল, গ্রাম, কোনটি? উত্তরের সাথে সাথে আপনার কাছে কয়েকটি বিকল্প উঠে আসবে, এর মধ্যে একটি নির্বাচন করতে হবে। এখানে আমি পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি পর্যটন স্থানের উল্লেখ করলাম।

সমুদ্র 

দিঘা-শংকরপুর-তালসারি, মন্দারমণি, তাজপুর, বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ

পাহাড় 

দার্জিলিং, কালিম্পঙ-কার্শিয়াং, লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ, মিরিক, সান্দাকফু, পুরুলিয়া-অযোধ্যা 

অরণ্য/ জঙ্গল 

ডুয়ার্স, গরুমারা-জলদাপাড়া-চাপড়ামাড়ি, রাজাভাতখাওয়া, সুন্দরবন, পারমাদান, বেথুয়াডহরী

ঐতিহাসিক স্থান/ ঐতিহ্য/ সাংস্কৃতিক পীঠভূমি

মুর্শিদাবাদ-১, মালদা, বিষ্ণুপুর, বোলপুর শান্তিনিকেতন, কোচবিহার, নবদ্বীপ

 

এছাড়াও আরো একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। 

এবারের প্রশ্ন, কি উপায়ে যাবেন? ভ্রমণের খরচের একটা বড়ো অংশ যাতায়াতে, তারপর আর একটা বড়ো অংশ থাকবার জন্যে ব্যয় হয়। এবার এই যাতায়াত খরচ নির্ভর করে অনেক গুলি বিষয়ের উপর। সাধারণত গণ পরিবহন, যেমন বাস, ট্রেন ইত্যাদি, ব্যবহার করলে খরচ অনেক কমে যায়, এবং অপরপক্ষে ব্যক্তিগত পরিবহন ব্যবহার করলে যেমন ধরুন গাড়ি বুক করে ঘুরতে গেলে অনেক বেশি খরচ হবে তা বলাই বাহুল্য। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু কিছু সুবিধা এবং কিছু অসুবিধা আছে। যেমন গণ পরিবহন ব্যবহার করলে খরচ কম হবে ঠিকই তবে তার স্বাচ্ছন্দ্য ব্যক্তিগত পরিবহন থেকে অনেকটাই কম। আবার ব্যক্তিগত পরিবহনের খরচ বেশ বেশি হয়ে যায়। এমত অবস্থায় আপনি স্থানীয় ট্যুর অপারেটরের সাহায্য নিতে পারেন। যেহেতু তাঁরা প্যাকেজেড ট্যুরে (Packaged tour) অনেক মানুষ একত্রিত করে নিয়ে যান, এটা একটা মধ্যবর্তী ব্যবস্থা হতে পারে। যেমন খরচটা নাগালের মধ্যে থাকলো আবার গণ পরিবহনের ভিড়ও এড়ানো গেলো।

এর পরের বিষয় থাকার জায়গা নির্বাচন দেখুন, খুবই সাধারণ কারণে দর্শনীয় স্থানের কেন্দ্রস্থলে সর্বদাই হোটেলের দাম অধিক হয়ে থাকে, তাই পকেট বাঁচাতে তুলনামূলক ভাবে একটু দূরে ঘরের ভাড়া কম হয়। যেমন, উদাহরণস্বরূপ দেখুন, দিঘায় সমুদ্রমূখী হোটেলের ঘরের দাম অধিক, আবার বাজারের কাছে ঘরের দাম কিন্তু অনেকটা কম, তবে সেখান থেকে সমুদ্র দেখতে আপনাকে মিনিট কয়েক হেঁটে আসতে হবে, ঘরে বসে দেখতে পাবেন না। তাইবলে আবার এতটা দূরে ঘর ভাড়া নেওয়াটা আবার ঠিক নয় যেখান থেকে প্রতিমুহূর্তে সমুদ্রের বীচে আসতে আপনাকে অটো বা টোটো গাড়ি ভাড়া করতে হয়। এখন বেড়ানোর স্থানগুলিতে থাকবার জন্যে বিভিন্ন আয়োজন রয়েছে। হোটেল বা হলিডে হোমের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে হোম-স্টে। প্রত্যেকটির স্বাচ্ছন্দ্য এবং উদ্দেশ্য কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। হোটেলের পেশাদারিত্ব আর স্বাচ্ছন্দ্য আলাদা, উন্নত পরিষেবাযুক্ত হোটেলগুলি আপনাকে অনেক হালকা হয়ে ঘুরতে সাহায্য করবে। যেমন, স্নানের জন্যে সাবান, শ্যাম্পু, লোশন, গা মোছার তোয়ালে, দাঁত মাজার ব্রাশ-পেস্ট, ব্লাঙ্কেট, প্রয়োজনে ঘরে চা বা কফির ব্যবস্থা ইত্যাদি নানান উপকরণ আপনি এই হোটেলগুলি থেকে পেতে পারেন, কাজেই এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি বহন করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার ব্যাগ হালকা হয়ে গেলো। যদি আপনি বাজেটেড হোটেলে থাকেন তবে হয়তো এই জিনিসগুলি নাও পেতে পারেন, সেক্ষেত্রে আপনি তোয়ালের পরিবর্তে গামছা, শ্যাম্পু বা লোশনের বোতলের পরিবর্তে ইউস এন্ড থ্রো স্যাশে, ইত্যাদি নিতে পারেন, এতে  ব্যাগ অনেকটা হালকা হয়ে যাবে। হালকা ব্যাগ ভ্রমণের সময় আপনাকে সাহায্য করবে। হলিডে হোমে আপনি আপনার মতন নিজেরা নিজেদের রান্না-বান্না করে খেতে পারেন, অনেকে মিলে বেড়াতে গেলে বা গেট টুগেদারের ক্ষেত্রে এটি বেশ উপযোগী। আবার হোম-স্টে তে আপনি স্থানীয় মানুষের সাহচর্য, তাদের সংস্কৃতি, খাদ্য ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হতে পারেন। আজকের দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেটের গুরুত্ব অপরিহার্য, কাজেই যদি আপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হয় তবে Wi-Fi-র সংযোগ হোটেল বা হোম-স্টেতে রয়েছে কিনা তার খোঁজ নিয়ে রিসার্ভ করুন।

এবার আসি বেড়ানোর কথায়। প্রাণ আর মন ভরে বেড়ান। সমুদ্র, নদী ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন, যেকোন বীচে নেমে পড়বেন না, দেখুন সেটি ঘোষিত বীচ কিনা, জোয়ার-ভাঁটার সময় সম্বন্ধে অবহিত থাকুন, বাচ্চাদের বিষয়ে সতর্ক থাকুন, অযথা ঝুঁকি নেবেন না। পাহাড়ে গেলে ট্রেকিং পথ সম্বন্ধে ভালোভাবে অবহিত হন, প্রয়োজনে স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিন। ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণের সময় দ্রষ্টব্য বিষয়ে জানার জন্যে স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিতে পারেন, তবে মনে রাখবেন তথ্যগুলি সবসময় যে সম্পূর্ণভাবে ইতিহাস নির্ভর তা নাও হতে পারে, বিভিন্ন লোককথা, বিশ্বাস এগুলি সব মিশে থাকতে পারে বর্ণনায়। কাজেই উৎসাহ থাকলে ইতিহাস বই বা জার্নালের সাহায্য নিতে পারেন তথ্যগুলি দেখে নেওয়ার জন্য। বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলিতে তার বর্ণনা লেখা থাকে বোর্ডে, সেগুলিও ভালোভাবে পড়ে নিতে পারেন। ছবি তুলুন মন ভরে, তবে দেখে নিন কিছুক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য স্থানে ছবি তোলা নিষেধ থাকতে পারে, সেই নির্দেশ মান্য করুন। স্থানীয় মানুষদের সাথে মেলামেশা করুন, তাঁদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানুন, সংস্কৃতির আদান-প্রদান করুন। 

এবার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা যাক যা যেকোনো ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য,

প্রথমত, কোনোভাবেই স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির সাথে আপোস করবেন না। অপরিচ্ছন্ন কোনো স্থানে থাকবেন না, এবং সেই স্থানে খাওয়া দাওয়া করবেন না। স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। স্যানিটাইজার আর মাস্ক হাতের কাছেই রাখুন, প্রয়োজনে তা অবশ্যই ব্যবহার করুন। স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সকল নিয়ম পালন করুন।

দ্বিতীয়ত, পানীয় জলের বিষয়ে সচেতন থাকবেন। যে কোনো জায়গার জল পান করবেন না, আগে নিশ্চিন্ত হবেন সেখানকার জল পানযোগ্য কিনা। বেশিরভাগ স্থানে আপনি পানীয় জলের সুবিধা পাবেন, একান্ত যদি না পান তবে পানীয় জল কিনে খাওয়ার চেষ্টা করবেন।

তৃতীয়ত, রাস্তার খোলা খাবার লোভনীয় হলেও সংযমী হতে হবে, বেড়াতে গিয়ে অধিকাংশ সময়ে পেট খারাপ হয়ে থাকে উপযুক্ত গুণমানের খাবারের অভাবে আর অনুপযুক্ত খাবারের প্রাচুর্যে শুকনো খাবার (শুকনো ফল, বিস্কুট, কেক ইত্যাদি), ফল (পরিষ্কার করে ধোয়া) ইত্যাদি সুযোগ করে কিনে নিন আর খান।

চতুর্থত এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ, মনে রাখবেন যে স্থানে আপনি বেড়াতে গিয়েছেন সেটির রক্ষণাবেক্ষণের কিছুটা দায়িত্ব কিন্তু আপনারও প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি যেখানে সেখানে ফেলবেন না; আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলবেন, ডাস্টবিন না পেলে তা ব্যাগে করে হোটেলে নিয়ে আসুন, সেখানে ডাস্টবিন পাবেন, তাতে ফেলুন; গাছের ডাল ভাঙবেন না, ফলমূল, ফুল তুলবেন না; জলাশয়ে কিছু ফেলে অপরিষ্কার করবেন না; অকারণে শব্দ দূষণ করবেন না; খেয়াল রাখবেন আপনার আনন্দ যেন কোনো অবস্থাতেই অপরের (মানুষ বা কোনো প্রাণীর)দুঃখের কারণ না হয়ে ওঠে। এই জায়গাটিতে আবার যদি কখনো আসেন, যেন সেটি এরূপ সুন্দর অবস্থাতেই ফিরে পান, সেটির খেয়াল রাখবেন।

আর দেরি কেন ! এবার ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়ুন।

তাজপুরের জীবনধারা আর উন্নয়ন: একটি ভ্রমণ কাহিনী (Livelihood and Development of Tajpur: A travelogue)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বঙ্গোপসাগর উপকূলে অবস্থিত তাজপুর পশ্চিমবঙ্গের সৈকত পর্যটনের তুলনামূলক নতুন সংযোজন। দ্বাদশ পরিকল্পনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত যে চারটি পর্যটন বর্তনী (Circuit) শনাক্তকরণ  করা হয়েছিল তার মধ্যে প্রথমটি সৈকত কেন্দ্রিক (দীঘা -শঙ্করপুর - তাজপুর  - জুনপুট - মন্দারমনি) আর আমাদের গন্তব্য তাজপুর, জেলে বসতির উপর আধারিত এই পর্যটন কেন্দ্র। বারাসাত থেকে সকাল ৮ টায় রওনা হয়ে জাতীয় সড়ক ১৬ আর ১৬ধরে কোলাঘাট-নন্দকুমার-কণ্টাই-চালখোলা-বালিসাই হয়ে প্রায় ১৮৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যখন তাজপুর পৌঁছলাম তখন বেলা ১ টা।

মাছের ভেরী, শালুকের জলা পার হয়ে সোজা পৌঁছলাম  সমুদ্রের পাড়ে। অচেনা অতিথিদের উপস্থিতি লক্ষাধিক লাল কাঁকড়া পরিবারকে একটু বিচলিত করলো, লক্ষ্য করলাম আমাদের পায়ের শব্দে একটু বিরাম পড়েছিল তাদের ব্যস্তময় দৈনন্দিন কাজে। দিনের অনেকটা সময় তারা তাদের বাসস্থান বালির গর্তগুলো পরিষ্কার রাখতে বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যয় করে।  গর্তের মুখ থেকে প্রায় ১ ফুট দূর পর্যন্ত বালি বয়ে এনে ফেলে যায়। দীঘা উপকূল বরাবর ৩০ টির ও অধিক প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। বর্ণময়তা আর সংখ্যাধিক্যের কারণে লালকাঁকড়া পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র। আমরা এগিয়ে গেলাম সমুদ্রের আরও কাছে, বিশালতার এই অপরূপ হাতছানিকে উপেক্ষা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব  ছিল না  ভাঁটা চলছে, তাই অনেকটা দূর যেতে হলো সমুদ্র স্পর্শ করতে এবার একটু যেতে হবে পাড়ের দিকে, থাকার সংস্থান আর দ্বিপ্রাহরিক আহার, আর তারপরেই আবার ফিরবো।

আগেই বলেছি তাজপুর পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে নতুন সংযোজন। সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে, তার নমুনা সর্বত্র বিদ্যমান, কোথাও ক্রেন দাঁড়িয়ে, কোথাও বা খানিকটা সিঁড়ি তৈরি হয়েছে, আবার কোথাও রিসোর্ট তৈরির কাজ চলছে আজ যেখানে জেলে ডিঙিগুলি নোঙ্গর করা রয়েছে , অদূর ভবিষ্যতে সেখানেই গড়ে উঠবে বন্দর। 

দীঘার পরিচিত হোটেল সংস্কৃতি থেকে একটু আলাদা তাজপুর। এখানে অধিকাংশই কুটীর (Cottage) জাতীয় আবাসন। বিশালাকায় উন্নত অট্টালিকার পরিবর্তে বেশ সুন্দর বাগান, ছোট্ট পার্ক নিয়ে গড়ে ওঠা কুটীরগুলি একদণ্ড শান্তির জন্যে আদর্শ। পাড়ের কাছে রয়েছে গোটা চব্বিশেক দোকান, বাঁশের কাঠামো, টিন আর পাতার ছাউনি। পছন্দ মতন রান্না করিয়ে খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে সেগুলিতে। পমফ্রেট, ভেটকি, ভোলা, পার্শে, কাঁকড়া, দেশী  মুরগি সবই  মিলবে বাঙালির রসনা তৃপ্ত করতে। সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যেতে যেতে কিছুটা দূর গিয়ে আবারও দেখা মেলে এইরকম আরও কয়েকটি দোকানের। প্রধানত স্থানীয় লোকেরা এই দোকানগুলি চালান। স্থানীয় জনজাতির জীবিকা মূলত মাছধরা বা মৎস পালন। তবে বর্তমানে অনেকেই পর্যটন শিল্পের সাথে যুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পেশাকে বেঁছে নিয়েছেন পর্যটন বাড়ার সাথে সাথে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নতির একটা ইতিবাচক সম্পর্ক চোখে পড়লো, বেশ ভালো লাগলো।



একটু দূরেই রয়েছে মৎসকোঠি। প্রায় ৩০০ পরিবার এখানে মাছ শুকানোর (যা 'শুটকি মাছ' বলেই আমাদের কাছে পরিচিত) কাজে যুক্ত আছেন। বেশ অনেকগুলি পরিবারের সাথে কথা হলো।  জানলাম তাঁদের জীবনধারণের কথা। আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত তাঁরা শুটকি মাছের কাজে নিযুক্ত থাকেন আর অন্য সময়ে আলাদা কাজ বা ছোটোখাটো ব্যবসা করেন।  বুমলা, রুপা পাইত্যা, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি প্রধানত শুকানো হচ্ছে শুনলাম, কয়েকদিন আগের (১৬ থেকে ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৭) বঙ্গোপসাগরের উপরের ঘূর্ণাবর্তের ফলে যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল তাতে শুটকি মাছের এবং স্বভাবতই তাদের জীবিকার খুব ক্ষতি হয়েছে

উন্নয়ন সর্বদা কাম্য। তবে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ জরুরি, প্রাকৃতিক উপাদানের বিনাশ বাঞ্ছনীয় নয়। লাল কাঁকড়ারা অবলুপ্ত হবে না, কচ্ছপের ডিম খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য হবে না, ঝাউ আর কেয়ার জঙ্গল অদৃশ্য হয়ে যাবে না, ঐতিহ্যের সাথে বর্তমানের একীকরণ (Integration) হবে -- এগুলিই হোক উন্নয়নের পরিমাপ, সেটাই আদর্শ সাস্টেনেবল উন্নয়ন (Sustainable development) এবার ফিরতে হবে, তবে আবার আসবো। জানতে আসবো লালকাঁকড়ারা কেমন আছে, শুটকির উপর আঁশখোসি পোকার উপদ্রব কমলো কিনা, আর নাম না জানা ছেলেটার সাথে কচ্ছপের ডিম খুঁজতে যাবো তখন।

অক্টোবর, ২০১৭

দক্ষিণ কোরিয়ার একটি মৎস বন্দর ইয়ংদক ক্র্যাব ভিলেজ-র ভ্রমণ পড়ার জন্য ক্লিক করুন

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের পরবর্তী পর্ব (The next part of the trip to Murshidabad)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের প্রথম পর্বটি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ

সিরাজের মৃত্যুতে অবসান হল আফসার বংশের, ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে নেমে এলো সূর্যাস্ত। শুরু হল মীর জাফর বংশ, ইতিহাসে যা নাজাফী বংশ বলে পরিচিত। ২৪ শে জুন ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে যখন পলাশির যুদ্ধ শেষ হয় আর ২৯শে জুন মীর জাফর মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেন, রবার্ট ক্লাইভ যথার্থই বলেছিলেন এই জয় তাঁর নয় বরং এই জয় মীর জাফরেরসত্যিই সেদিন ইংরেজদের জয় সম্ভব হত না যদি মীর জাফর, ইয়ার লতিফ খাঁ, রায়দুর্লভরা দেশরক্ষার দায়ভার গ্রহণ করে অস্ত্র তুলে নিতেন, বিফল হত জগৎ শেঠদের ষড়যন্ত্র এবং সর্বোপরি  বিস্বাসঘাতকতা যদি না করতেন মীর জাফর। ভাগীরথীর পূর্বপাড়ে রাস্তার বাঁ পাশে অবস্থিত জাফরগঞ্জ প্রাসাদের প্রবেশ দ্বার বর্তমানে জীর্ণদশায় উপনীত। বোন শাহখানামের জন্যে এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন নবাব আলীবর্দি খাঁ। মীর জাফর ছিলেন শাহখানামের স্বামী অর্থাৎ নবাব আলীবর্দি খাঁ-র ভগিনীপতি। প্রবেশ দ্বারে পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি নেই, এই বিজ্ঞপ্তি টাঙানো রয়েছে। মীর জাফরের জীবনের পরিণতি ছিল করুণ, কুষ্ঠ রোগগ্রস্থ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। বাঁচার অন্তিম ইচ্ছে নিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন কিরীটীশ্বরী মন্দিরের দেবীর চরণামৃত! এমনই প্রচলিত লোককথা, এর ঐতিহাসিক প্রমাণ অজানা। সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম এই পীঠ। বিশ্বাস এখানে দেবীর কিরীট (‘কিরীট’ কথাটি ‘করোটি’ থেকে এসেছে) পতিত হয়েছিল নবগ্রামের কিরীটকোনা গ্রামে অবস্থিত সতীপীঠ কিরীটীশ্বরী মন্দির, আমাদের গন্তব্য। দেবী এখানে বিমলা নামে  পূজিত হন।  বর্তমানে নবনির্মিত মন্দিরটির পাশেই পুরোনো ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি অবস্থিত। 


এবার দর্শনীয় হলো হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। মুর্শিদাবাদ বলতেই যে হাজারদুয়ারির চিত্র মানসপটে উদ্ভাসিত হয় তা ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব নাজিম হুমায়ুন জা নির্মাণ করেছিলেন। শুনলাম এর নির্মাণ কার্য ১৮২৪ থেকে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল।  প্রাসাদটি পরিকল্পনা করেছিলেন ডানকান ম্যাক লিওড সাহেব। বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ এটি সংরক্ষণ করে। প্রাসাদটির স্থাপত্যশৈলী সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বর্তমানে এর অভ্যন্তরে রয়েছে একটি সংগ্রহালয় যেখানে নবাব আমলে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী যথা আসবাব, চিত্র, বাসন পত্র, অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রবেশমূল্য দিয়ে হাজারদুয়ারি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। পর্যটকরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গাইডদের থেকে জেনে নিতে পারেন হাজারদুয়ারি এবং এর প্রাঙ্গণে উপস্থিত বাচ্চাওয়ালী তোপ, নিজামত ইমামবাড়া, মদিনা মসজিদ ইত্যাদি সম্পর্কিত নানান তথ্য। ইতিহাস, জনশ্রুতি, লোককথা মিশিয়ে গাইডদের পরিবেশন পর্যটকের বেশ আকর্ষণ করে। 


এই মদিনা মসজিদটি নবাব সিরাজ উদ দৌল্লা নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং এটি নির্মিত হয় মক্কা মদিনা থেকে আনা মাটি স্থানীয় মাটির সাথে মিশিয়ে।
 

হাজারদুয়ারীর ঠিক উল্টো দিকে বর্তমানে যে নিজামত ইমামবাড়াটি দেখা যায় সেটি ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব নাজিম মনসুর আলী খান কর্তৃক তৎকালীন সময়ে প্রায় ছয় লক্ষ টাকায় নির্মিত হয়। তবে পূর্বে যে নিজামত ইমামবাড়াটি ছিল সেটি নবাব সিরাজ উদ দৌল্লা নির্মাণ করেছিলেন। জনশ্রুতি, ইমামবাড়াটির ভিত্তিপ্রস্তর নবাব নিজহস্তে স্থাপন করেছিলেন। সেই ইমামবাড়াটি ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে আগুনে আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়, তার পর এই নতুন ইমামবাড়াটি তৈরী করা হয়। হাজারদুয়ারি এবং নিজামত ইমামবাড়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে  সুদৃশ্য বাগান রয়েছে, সেখানে রয়েছে ঘড়ি ঘর বা ক্লক-টাওয়ার।

এবার দ্রষ্টব্য জাফরগঞ্জ কবরস্থান। এখানে রয়েছে মীর জাফর, তাঁর বংশের সদস্যদের এবং উত্তরসূরিদের, নবাব নাজিম হুমায়ুন জা পর্যন্ত সকলের কবর। এখানে কিছু বই বিক্রি হচ্ছে দেখলাম, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস সম্পর্কিত ইতিহাস নির্ভর বইগুলি।


মুর্শিদাবাদের উল্লেখযোগ্য একটি দর্শনীয় স্থান জগৎ শেঠের বাড়ি। এই 'জগৎ শেঠ' কিন্তু কেবল একজন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে না, বরং এর অর্থ জগতের শেঠ (ব্যাংকার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড), বংশানুক্রমিক এঁদের সদস্যদের মধ্যে  হিরানন্দ শা, মানিক চাঁদ, ফতে চাঁদ, মেহতাব চাঁদ, স্বরূপ চাঁদ প্রমুখ। ধন সম্পদের প্রাচুর্য্যের জন্যে জগৎ শেঠ দের নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।  শোনা যায়, অর্থসাহায্য করার জন্যে মানিক চাঁদ কে এই উপাধি প্রদান করেন মোঘল সম্রাট ফারুখশিয়ার। নশিপুরে অবস্থিত বর্তমানে জগৎ শেঠদের বাড়িটি সংগ্রহালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে দর্শনীয় তৎকালীন সময়ের মুদ্রা, স্বর্ণ-রৌপের কারুকার্য সম্বলিত তাঁদের ব্যবহৃত বস্ত্র, বাসন ইত্যাদি। গুপ্ত সুড়ঙ্গটি পর্যটকদের দেখার জন্যে উন্মুক্ত।

এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল নশিপুর রাজবাড়ী। হাজারদুয়ারি প্রাসাদ থেকে এর দূরত্ব প্রায় আড়াই-তিন কিলোমিটার। রাজা বলে পরিচিত হলেও এঁরা ছিলেন জমিদার, ব্রিটিশ প্রশাসকের হয়ে ট্যাক্স কালেক্টর। বিরাট ছিল সেই জমিদারিরই সীমানা, বীরভূম, মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত রাজশাহী, পাবনা এবং বগুড়ার কিছু অংশ। সম্ভবত এই বিশাল জমিদারির জন্যেই এঁরা রাজা বলে পরিচিত ছিলেন। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা দেবী সিংহ রাজবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন তবে বর্তমানে যে নশিপুর রাজবাড়িটি দ্রষ্টব্য সেটি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা কীর্তি চন্দ্র সিংহ কর্তৃক হাজারদুয়ারীর আদলে নির্মিত। ব্যবসার সূত্র ধরে পানিপথ থেকে দেবী সিংহ এখানে আসেন এবং ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এই বিপুল জমিদারি গড়ে তোলেন । খাজনা দিতে অপারগ দরিদ্র প্রজাগণের প্রতি রাজার ব্যবহারের নানান গল্প আজও মানুষের মুখ মুখে ঘোরে।


এই নশিপুর রাজবাড়ীর সন্নিকটেই রয়েছে নশিপুর আখড়া। এখানে পর্যটকদের দর্শনের উদ্দেশ্যে পুরোনো গাড়ি, বাসনপত্র, রথ ইত্যাদি প্রদর্শিত রয়েছে।  শুনলাম, ঝুলনযাত্রা এবং সেই উপলক্ষ্যে এখানে বড়ো মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

মুর্শিদাবাদের অন্যতম আর একটি দর্শনীয় স্থান হলো কাঠগোলা বাগানবাড়ি।  শুনলাম, ধনপত সিং দুগার এবং লক্ষ্মীপত সিং দুগার নির্মাণ করেন।  বাগান বাড়িটির প্রাঙ্গনে রয়েছে আদিনাথ মন্দির।  এই স্থানের বাড়িটির বিভিন্ন স্থাপত্য, প্রদর্শনশালা, বাউলি, প্রাঙ্গনের মূর্তি-ভাস্কর্য, অলংকৃত দেওয়াল পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এবার ফিরে চলা। এই মাটির প্রতিটি কণা ইতিহাসের কথা বলে, সেই ইতিহাসকে ঘিরে গড়ে ওঠে নানান কাহিনী। সময় সংক্ষিপ্ত তাই বিদায় নিতে হয়, ইতিহাসের জ্ঞান কে সম্বল করে ফিরতে হয় বাস্তবতায়।  তবে আসতে আবার হবে, বাকি রয়ে গেছে অনেক কিছু দেখার, শোনার আর বোঝার।

মার্চ, ২০১৮

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ (Murshidabad)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পড়ন্ত বেলাতেই এসে উপস্থিত হলাম অতীতের মহানগরীমুক্সুবাদ’- নগরীর বাঁ দিক দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী নদী, এই নগরের উত্থান তাকে ঘিরেই নদীপথে ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা হেতুই মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব নিযুক্ত তৎকালীন বাঙলা, বিহার আর উড়িষ্যার সুবেদার (পরবর্তীকালে ‘নবাব নাজিম’) মুর্শিদকুলী খাঁ ঢাকা থেকে ভাগীরথীর উপকণ্ঠে মুক্সুবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, তাঁর নামানুসারে নগরের নাম পরিবর্তিত হয়ে হল মুর্শিদাবাদ, সূচনা হল ভারতবর্ষের এক নতুন ইতিহাসের ইতিহাসের সেই চরিত্ররা আজ আর নেই, রয়ে গিয়েছে তাঁদের স্থাপত্য, লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে তাঁদের উদার কর্মযজ্ঞ, বন্দিত হয়েছেন তাঁরা আবার কখনও বা নিন্দিত হয়েছেন ঘৃণ্য অপরাধের জন্যে, লোভ লালসার উন্মত্ততা নিজের অজান্তেই রাজাকে পর্যবসিত করেছে দাসে ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গেছে লোককথা, বিশ্বাস; ইতিহাস কখনও হয়েছে অতিরঞ্জিত আবার কখনও বা বিকৃত।  

এই ভ্রমণ কাহিনী ইতিহাসকেন্দ্রিক আর তাই ইতিহাসের পথ অনুসরণ করাটাই শ্রেয় মনে হয় অতএব এ রচনা অতীতের ঘটনাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ; ঘোরার সুবিধের জন্যে উল্লেখিত দ্রষ্টব্য স্থানগুলির পর্যায়ক্রম পরিবর্তন করা যেতেই পারে। এখানে উল্লেখ্য, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণকাহিনী (গবেষণাধর্মী বা গবেষণা নির্ভর ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়) যার অন্যতম উপাদান স্থানীয় গাইডদের প্রদত্ত তথ্য, প্রচলিত লোককথা, বিশ্বাস ইত্যাদি। 

জন্মসূত্রে (১৬৬০) দাক্ষিণাত্যের এক ব্রাহ্মণ সন্তান দশ বছর বয়সে হাজি শাফি নামে একজন পার্সি (ইরানী)-র নিকট বিক্রিত হয়। হাজি সাহেব তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং তাঁর নামকরণ করেন মহম্মদ হাদি। ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে হাজি শাফি মহম্মদ হাদিকে নিয়ে মোঘল রাজদরবারের কাজ পরিত্যাগপূর্বক পারস্যদেশে (বর্তমানে ইরান) চলে যানপরবর্তীকালে হাজি-র মৃত্যুর পর পুনরায় হাদি ভারতবর্ষে ফিরে আসেন এবং মোঘল সাম্রাজ্যের অধীন বিদর্ভ নগরের দেওয়ান আবদুল্লা খুরাসানির অধীনে কাজ শুরু করেন। তাঁর কর্মনিষ্ঠায় প্রসন্ন হয়ে ঔরঙ্গজেব তাঁকে বাঙলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। ঔরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ সময়ে মারাঠারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাঁদের আক্রমণ মোঘল সম্রাটের আর্থিক স্থিতি দুর্বল করে দিয়েছিল এমতাবস্থায় নবনিযুক্ত দেওয়ান মহম্মদ হাদি রাজস্বস্বরূপ অনেক টাকা দিল্লির সম্রাটকে পাঠিয়েছিলেন এবং মুর্শিদকুলী খাঁ উপাধি লাভ করেন, এর কিছুকালের মধ্যে ‘নাজিম’ উপাধিও লাভ করেন ১৭০১ থেকে ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দ অবধি রাজত্ব করেন মুর্শিদকুলী খাঁ মৃত্যুর পর তাঁরই ইচ্ছানুসারে কাটরা মসজিদে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে জীবৎকালে বিভিন্ন কৃতকর্মের জন্য বৃদ্ধ মুর্শিদকুলী খাঁ অনুতপ্ত হন, সেইজন্যে সকল মানুষের পদধূলি তাঁর পাপস্খলন ঘটাবে এই উদ্দেশ্যে নিজেকে সোপানের নীচে সমাধিস্থ করার আদেশ প্রদান করেন। মুর্শিদাবাদের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত এই কাটরা মসজিদ আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য। মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশনের অনতিদূরেই রেল লাইন পার করে দেখা যায় কাটরা মসজিদ। মসজিদের দুই প্রান্তে ৭০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দুইটি গম্বুজ রয়েছে।মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে অনেকগুলি ছোট আয়তনের প্রকোষ্ঠ আর অতি বৃহদাকার চত্বর যেখানে প্রায় সহস্রাধিক মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারেন। বর্তমানে মসজিদটি ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ (Archeological Survey of India) দ্বারা সংরক্ষিত। প্রকোষ্ঠ গুলিতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। পাথরের যোগান পর্যাপ্ত না থাকা আর ভাগীরথীর তীরে এঁটেল মাটি অপরিযাপ্ত, সম্ভবত এই দুইকারণেই এখানকার স্থাপত্য পোড়া ইটের, ইটগুলি আকারে বর্তমানের থেকে অনেকটাই ছোট বলে মনে হয়। কাটরা মসজিদের স্থাপত্যে কোন করি-বরগার ব্যবহার দেখা যায়না। 




প্রায় তিনশ বছরের পুরাতন এই স্থাপত্য শুধুমাত্র স্থাপত্যশৈলীর জন্যে নয় বরং তাঁর উন্নত দার্শনিকতার জন্যে আজও প্রাসঙ্গিক।

মুর্শিদকুলী খাঁ-র একপুত্র আর দুই কন্যা। এক কন্যার নাম আজিমুন্নেশা আজিমুন্নেশা-র বিবাহ সম্পন্ন হয় সুজা খাঁ-র (সুজাউদ্দিন মহম্মদ খাঁ) সহিত। সুজা খাঁ-ই হলেন মুর্শিদকুলী পরবর্তী বাঙলার নবাব (১৭২৭-১৭৩৯) উদার চিত্ত আর ন্যায় পরায়নতা জন্মসূত্রে তুর্কী মুসলিম সুজাউদ্দিন-কে একজন আদর্শ শাসক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলহাজি আহমেদ (আলীবর্দি খাঁ-র বড়ভাই যার আসল নাম মির্জা আহমেদ), আলমচাঁদ প্রমুখ তাঁর শাসনকালে রাজ্যের প্রধান পদে আসীন হন এবং বেগম আজিমুন্নেশার ইচ্ছানুসারে আলীবর্দি খাঁ-কে পাটনার নায়েব নিযুক্ত করা হয়১৭৩৯ সালে মৃত্যুর পর সুজাউদ্দিন-কে ভাগীরথীর পশ্চিমপারে রোশনিবাগে সমাধিস্থ করা হয়। রোশনিবাগ (‘বাগ’ কথাটির অর্থ বাগিচাবা ‘বাগান’) সুজা খাঁ-ই নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন যেন মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় রোশনিবাগেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়আজ রোশনিবাগে যে পথটি দিয়ে পর্যটকরা প্রবেশ করেন সেটি আসলে বাগের পশ্চাৎভাগ, অতীতের প্রধান সম্মুখ ফটকটি এর ঠিক সোজা মধ্যের বিশ্রামাগার (যা পরবর্তীকালের সুজা খাঁ-র সমাধি)-র আগে একই সরলরেখায় অবস্থিত। মূল ফটকটি দিয়ে প্রবেশ করলে ডান দিকে রয়েছে নবাব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, সম্মুখে ফোয়ারা আর তারপর বিশ্রামাগার। সমগ্র অঞ্চলটি ছিল ফুলের বাগান। রোশনিবাগের অনতিদূরেই সুজা খাঁ প্রতিষ্ঠা করেন অপর একটি মনরম বাগানবাড়ি যা ‘ফারহাবাগ’ বা সুখকানন নামে পরিচিত ছিল, যদিও বর্তমানে একটি জলাশয় ছাড়া এর বিশেষ কোন অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়না। 


রোশনিবাগেই রয়েছে সুজা খাঁ-র অপর স্ত্রী জিন্নাতুন্নেশা-র সমাধি। বর্তমানে রোশনিবাগ ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ (Archeological Survey of India) রক্ষণাবেক্ষণ করে। রোশনিবাগের পরিধির লাগোয়া গড়ে উঠেছে একটি মাজারআলাপ হল এক বৃদ্ধের সাথে, পরনে লুঙ্গি আর ফতুয়া। তিনি এই মাজারটি পরিস্কার পরিছন্ন রাখার কাজ করেন আর জীবনযাপনের জন্যে এখানে আগত পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করে কিছু উপার্জন করেন। প্রতি চৈত্র মাসে ৩ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত এখানে মেলা বসে, শুনলাম অনেক বাজি পোড়ে মেলা উপলক্ষে। সুজা খাঁ-র অপর উল্লেখযোগ্য কীর্তি ত্রিপলিয়া দরওয়াজা, ডাহাপাড়া মসজিদ নির্মাণ।



আজিমুন্নেশা সম্পর্কিত নানান লোককথা আজও প্রচলিত যেমন তাঁর পুরুষ আসক্তি, শারীরিক অসুস্থতা, আরোগ্যলাভ হেতু মনুষ্য আন্তরযন্ত্রীয় অঙ্গ সেবন এবং সেইহেতু পিতার (মতান্তরে স্বামীর) আদেশে তাঁর জীবন্ত সমাধি ইত্যাদি। যদিও এসবের ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুপস্থিত বরং ঐতিহাসিকগণের ধারণা আজিমুন্নেশার মৃত্যু তাঁর পিতার এবং পতির মৃত্যুর পরবর্তীতেই হয়। তাঁর সমাধি রয়েছে ভাগীরথীর পূর্বপারে, এটিও বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত। পিতার মৃত্যুর পর সুজা খাঁ আর আজিমুন্নেশার সন্তান সরফরাজ খাঁ সিংহাসন আরোহণ করেন (১৭৩৯-১৭৪০)। অধিক নারী সংসর্গ, আলস্য, ভোগ বিলাসিতা এবং মন্ত্রীবর্গের উপর অধিক নির্ভরতা রাজ্য পরিচালনায় বাঁধা হয়ে উঠল। অচিরেই মন্ত্রীবর্গের আর নবাবের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় আর তারই পরিণতিতে ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে গিরিয়ার যুদ্ধে আলীবর্দি খাঁ-র কাছে পরাজিত হয়েছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করেন। অবসান হয় এক বংশের। এ ইতিহাস বিষাদের, কখনও বিশ্বাসঘাতকতার। ফৌতি মসজিদের স্থাপনা তাঁর আমলেই শুরু হয় কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুর পর এটির স্থাপনা শেষ হয়নিএই ফৌতি মসজিদ-ই বর্তমানে ফুটি মসজিদ নামে পরিচিত। 

সেই সময়ে অনবরত মারাঠাদের (যারা বর্গী নামে তৎকালীন বাঙলাতে পরিচিত ছিল) আক্রমণে বাঙলা, বিহার আর উড়িষ্যা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বর্গী আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত। রোশনিবাগের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভাস্কর পণ্ডিত ভগবান শিবের মন্দির স্থাপন করেন। এরূপ অবস্থায় কিছুটা বাধ্য হয়েই ভাস্কর পণ্ডিতকে মানকরা নামক জায়গায় নিজের শিবিরে আমন্ত্রণ করে নবাব আলীবর্দি খাঁ তাঁদের হত্যা করেন এ ইতিহাস এক বিশ্বাসঘাতকের কালিমালিপ্ত ইতিহাস হয়েই থেকে যেত যদিনা আলীবর্দি নিজেকে একজন দক্ষ আর প্রজাদরদী নবাব হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হতেন আলীবর্দি-র ধারণা ছিল হয়ত এরপর বর্গী আক্রমণের হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষা করা যাবে কিন্তু তা হয়নি। কিছুকাল বর্গী আক্রমণ বন্ধ ছিল, আর তারপরেই তাঁরা আবার এসেছিল আরও বিক্রমে।

নবাব আলীবর্দি খাঁ-র অধিক স্নেহপরায়ণতাই যে কনিষ্ঠা কন্যা আমিনার পুত্র মির্জা মহম্মদ (যিনি ইতিহাসে সিরাজদউল্লা নামে পরিচিত)-র সিংহাসন আরোহণের অন্যতম প্রধান কারণ সে নিয়ে বিশেষ দ্বিমত নেই। নবাব আলীবর্দি-র মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজ নবাব পদে অভিষিক্ত হন। বড়ই কণ্টকাকীর্ণ ছিল সিংহাসন আরোহণের সেই পথ। তার উপর কখনও সিরাজের দূরদৃষ্টিহীনতা আর ভুল সিদ্ধান্তগ্রহণ পরিস্থিতিকে অনেকটাই প্রতিকূল তৈরি করে দেয়। এইসকলের সন্মিলিত ফলশ্রুতি বাঙলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের করুন পরিণতি আর বাঙলা তথা ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে সূর্যাস্ত। শেষ হল পলাশির যুদ্ধ, রাজমহলের নিকট ধরা পরলেন সিরাজ। বন্দী সিরাজকে কয়েদ করে রাখা হল মন্সুরগঞ্জের প্রাসাদে। মীর জাফর পুত্র মীরণ মহম্মদি বেগকে নির্দেশ দিলেন সিরাজকে হত্যা করার, বারংবার ছুরিকাঘাতে লুটিয়ে পড়লেন সিরাজ। মৃত্যুর পর সিরাজের দেহ নিয়ে আসা হয় খোসবাগে। লোকবিশ্বাস সিরাজের দেহ  খোসবাগে আনা মাত্র নবাব আলীবর্দির সমাধি দু’ভাগ হয়ে যায়, শুরু হয় রক্তপ্রবাহ। এ শুধুই কল্পিত কাহিনী যার ভিত্তি দাদামশাই আর পৌত্রের  বাস্তব অপত্য স্নেহ আর প্রেম। অবশ্যই সিরাজের ব্যক্তিগত জীবন সমালোচনার উর্দ্ধে নয় কিন্তু তাঁর শৌর্য, বীরত্ব, রাজ্যের স্বায়ত্তের দায়বদ্ধতা, অগ্রজের উপদেশ গ্রহণ এবং স্বয়ং সংশোধন কোন প্রকারেই ক্ষুদ্র নয়। মাতামহ আলীবর্দি খাঁ-র সমাধির পাশেই সমাধিস্থ হন সিরাজ। 






কিন্তু হত্যালীলা স্তব্ধ হয়না। লোভ লালসা অর্থমোহ অত্যাচারী শাসককে হত্যার যন্ত্রে পরিণত করে। খোসবাগে রাখা আছে সেই সকল সমাধি। খোসবাগকথাটিখুশবাগ’-র (আনন্দ উদ্যান) অপভ্রংশমাত্রনবাব আলীবর্দি এই খুশবাগ তৈরি করান, শতাধিক গোলাপ ফুলের গাছ রোপণ করেছিলেন এবং তার সৌন্দর্য্য ও সুবাসের জন্যেই বাগ বা বাগিচার নামকরণ করেন খুশবাগ বা আনন্দ উদ্যান বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধীনে সংরক্ষিত খোসবাগের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর সর্বপ্রথম যে সমাধিটি দেখা যায় সেটি নাফিসা খানম বেগমের, নবাব আলীবর্দি খাঁ-র পত্নী বিচক্ষণা বেগমের পরামর্শ বৃদ্ধ নবাবের কাছে অপরিহার্য ছিলবেগমের সমাধির অনতিদূরেই রয়েছে তাঁর দুই কন্যার সমাধি যথাক্রমে সিরাজের বড় মাসি ঘসেটি বেগম আর মা আমিনা বেগমের, নবাব আলীবর্দির মধ্যম কন্যার সমাধি রয়েছে বিহারে

এখানে রয়েছে একটি মসজিদ, আজ আর নামাজ পড়া হয়না সেখানে, আজান দেওয়া হয়না কখনই, মসজিদের সম্মুখের জলাশয়টি আজ শুষ্ক। মৃত্যুর এই মহামিছিলের কাহিনী শুনতে শুনতে চোখের জলও এই জলাশয়ের মতন শুকিয়ে যায়। এক অদ্ভুত শান্তি রয়েছে এই খোসবাগে। যেন আজও লুৎফুন্নেশা অপেক্ষা করে আছেন সিরাজের, হয়ত তিনি প্রত্যক্ষ করছেন তাঁর প্রিয় সিরাজকে, স্বহস্তে সিরাজের প্রিয় ফুলের গাছ রোপণ করছেন, জল দিচ্ছেন।   



মার্চ, ২০১৮ 

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...