পৃষ্ঠাসমূহ

কিচেন গার্ডেন (Kitchen Garden)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


ছোটবেলায় দিদাকে দেখছি কাঁচা রান্নাঘর সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত আর্দ্র অঞ্চল থেকে থানকুনি পাতা তুলে আনতে। পেটের রোগে ভুগলে থানকুনি পাতা পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো, হয়তো এখনও হয়। পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হলেও থানকুনি পাতা বাটা খুবই সুস্বাদু একটি খাদ্য। আবার গ্রামাঞ্চলে মানুষ ক্ষেত, খামার, পুকুর ঘাট, খালবিলের আশপাশ থেকে শাকপাতা তুলে আনতো, আমিও এক আধবার মামাবাড়িতে গেলে দিদির সাথে কালীপুজোর  আগের দিন চোদ্দ শাক তুলতে গিয়েছি। 'কিচেন গার্ডেন' কথাটির বিশেষ ব্যবহার তখন হতো না। আসলে কোনো কিছুর অনুপস্থিতি তার গুরুত্ব বোঝায়। তখনও নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা আজকের অবস্থায় পৌঁছয়নি। সকলেরই বাড়িতে একটু আধটু জায়গা, উঠোন ছিল, মানুষ তাতে বিভিন্ন ধরণের সব্জি লাগাতেন, বেশিরভাগ সময়ে তা এমনিই ফেলে দেওয়া সব্জি বা ফলের বীজ থেকে জন্মাতো, পরিচর্যা বিশেষ লাগতও না। ঘরের চালে কুমড়ো, চালকুমড়ো, লাউ, কিংবা উঠোনে লঙ্কা, লেবু, এমনকি বাড়ির পিছনে কচু, বিভিন্ন ফলের গাছ যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল, বেল, নারিকেল ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যেত। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতেও নানান ফলের গাছ ছিল। যেহেতু, এই সকল সুবিধে সহজেই প্রাপ্ত হতো, এর গুরুত্ব তখন অতটা উপলদ্ধি হয়নি। এখন শহরাঞ্চলে এক চিলতে মাটি সহজে পাওয়া যায় না, শহর কেন্দ্রিক সভ্যতায় আজ বড়ো বড়ো গগনচুম্বি অট্টালিকাগুলি আজ মুখ্য ভূমিকায়, মাটি কংক্রিটাবৃত। বাড়ির উঠোন, বাগান আজ অমিল আর তাই 'কিচেন গার্ডেন'-র গুরুত্ব এখন উপলব্ধি হচ্ছে। বাড়ির সংলগ্ন এই বাগানগুলি হারিয়ে যাওয়ার রেশ কিন্তু মানুষের পুষ্টির উপর এসে পড়ছে। যেমন বাড়ির চালে হয়ে থাকা কুমড়ো ভিটামিন A প্রদান করে, বেড়ার গায়ে যে লাউটা হয়ে থাকে তাতে প্রচুর পরিমানে ফোলেট বা ফলিক অ্যাসিড (Folate/ ভিটামিন B9) থাকে, আবার ওল বা কচুতে রয়েছে অনেক ক্যালসিয়াম (Calcium), এগুলো কিন্তু এমনিতেই পাওয়া যেত। পুকুর ধারে হয়ে থাকা নানান শাকগুলোতে মিনারেল আর ভিটামিনের প্রাচুর্য্য উল্লেখযোগ্য (অনুগ্রহ করে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক পড়ুন)।

চাল, গম, মূলত শর্করা জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে; ডাল, মাছ, মাংস প্রোটিন সরবারহ করে; তৈলবীজগুলি তেল বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ সরবারহ করে। এই হলো তিন প্রকার বৃহৎ জাতীয় পুষ্টি উপাদান যা ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Macro-nutrient) নামে পরিচিত। অপরপক্ষে, শাক-সব্জি, ফল হলো মিনারেল এবং ভিটামিনের অন্যতম প্রধান উৎস, এরা মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট (Micro-nutrient) নামে পরিচিত। এই সকল অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলি পুষ্টি নিশ্চয়তার জন্যে একান্ত প্রয়োজন, যা অনেক সহজেই গৃহ সংলগ্ন বাগান থেকে পাওয়া যেত এবং এগুলি বাজার থেকে ব্যয় করে ক্রয় করার প্রয়োজন হতো না। কাজেই ব্যবহারিক জীবনে বিনামূল্যে পুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ খাবার পাতে এসে পৌঁছতো।    

সাধারণভাবে, সভ্যতায় নগরকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পেলে অধিক মানুষ গ্রাম থেকে নগরে বসবাস শুরু করে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ চিত্র বর্তমান। কৃষক, পশুপালক, কামার, কুমোর, ছুঁতোর সকলে যারা গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদন্ড ছিল, তারা ক্রমে 'ভালোভাবে' বাঁচার আশায় কর্মসংস্থানের সন্ধানে শহরে আসতে শুরু করেন, গ্রামের অপেক্ষাকৃত খোলামেলা বাগান, উঠোন সহ ঘরের পরিবর্তে শহরের ছোট ছোট গায়ে গায়ে লাগানো ঘর। সকল কিছুই সেখানে বাজার থেকে পয়সা খরচ করে আহরণ করতে হয়। এদিকে শহরও আয়তনে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তার আশেপাশের ভূমির তথা বাস্তুতন্ত্রের চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বনাঞ্চল পরিষ্কার করে নগর আয়তনে বৃদ্ধি পায়। বনের শুকনো কাঠ জ্বালানির জন্যে, বনের ঘাস পশুখাদ্যের জন্যে, পাতা সারের জন্যে, বাঁশ, গোলপাতা ঘর বানানোর জন্যে, বনের ফল-মূল-মধু খাওয়ার জন্যে - এসকলের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করে একটা পরিবর্ত পরিস্থিতিতে উপনীত হয়, অনিবার্যভাবে এঁদেরও আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে নগর। এতদিন যখন সকলেই কিছুটা কিছুটা খাদ্য নিজ নিজ পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করতো আজ সকলেই সম্পূর্ণটার জন্য বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে। অনিবার্যভাবেই পূর্বের সাধারণ চাষী বর্তমানে পরিণত হয়েছেন বাজার-চালিত কৃষকে, সেই সকল উৎপাদনে মানব সভ্যতা মনোনিবেশ করেছে যা অধিক মুনাফা দেয়, মাত্র কয়েকটি খাদ্যের উপর আজ জোর দেওয়া হচ্ছে, ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে খাদ্য বৈচিত্র।     

আজকে যখন আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে খাদ্যের বৈচিত্র পুষ্টি নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে অপরিহার্য, ততদিনে অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। একসময় যা সহজলভ্য ছিল, উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে যা হেলায় হারিয়েছি তা আজ প্রকৃতই দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এই বিষয়ে বর্তমানে অনেকগুলি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্কুল কিচেন গার্ডেন। প্রধানত এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য স্কুল কিচেন গার্ডেন স্থাপন করার মাধ্যমে, ছাত্র-ছাত্রীদের এর ফলে উৎপন্ন সব্জি ফল ইত্যাদি খাওয়ার ফলে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাব পূরণ হবে, তাঁদের শাক-সব্জি ফলানোর অভিজ্ঞতা লাভ হবে, এবং শাক-সব্জি ইত্যাদির পুষ্টি বিষয়ে তাঁরা জ্ঞানলাভ করবেন এবং জাঙ্ক-ফুডের (Junk food)  ক্ষতিকারক দিকগুলি সম্বন্ধে সচেতন হবেন। কিচেন গার্ডেনের প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজ্য ভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।বাড়িতে কিচেন গার্ডেন করলে তা যেমন খাদ্যের বৈচিত্র বাড়াবে, পুষ্টির অনিশ্চয়তা দূর করার হাতিয়ার হবে, তেমনি এটা অতিরিক্ত আয়ের একটা পথও হয়ে উঠতে পারে।

শঙ্করপুর (Shankarpur)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে গিয়েছিলাম তাজপুর-শঙ্করপুর-দীঘা বেড়াতে। তাজপুর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একটি ব্লগ আমি পূর্বে লিখেছি। আজকের ব্লগে আমি শঙ্করপুর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা লিখবো। 

ভ্রমণপিপাসু বাঙালীর কাছে কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থিত দীঘার সমুদ্র সৈকত একটি নস্টালজিয়া।সপ্তাহান্তে চলে আসাই যায়। অনেকে এখন একটু অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে পছন্দ করেন, আমার কিন্তু আজও দীঘা অত্যন্ত প্রিয়। 

ছোটবেলার দীঘার স্মৃতি আজও উজ্জ্বল, তখনও বঙ্গোপসাগরের সৈকতে আজকের মতন মেরিন ড্রাইভ গড়ে ওঠেনি, ঝাউবন হারিয়ে যায়নি, ট্রেন লাইন পাতা হয়নি, নতুন দীঘা গড়ে ওঠেনি, আসে পাশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলিও আজকের মতন বিকশিত হয়নি। তখন হাওড়া বা ধর্মতলা থেকে বাসে করে দীঘা পৌঁছতে হতো, যা এখন পুরোনো দীঘা বলে পরিচিত। মোবাইল এবং ইন্টারনেট নির্ভর জীবনযাত্রা তখনও গড়ে ওঠেনি, কাজেই বাস স্ট্যান্ডে নেমে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন হোটেল দেখেশুনে ঘর নেওয়াই ছিল প্রচলিত প্রথা, সৈকতের উপরে হলে তো কথাই ছিল না। তবে অনেকে আগে থাকতেই ঘর রিসার্ভ করেও আসতেন। তারপরেই সমুদ্রে ছোটা, সমুদ্রস্নান সেরে, রেস্তোরাঁগুলিতে খাওয়া বা কখনও মনের মতন মাছ রাঁধিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারা, একটু দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রাম, আবার সমুদ্রপাড়ে বসে উপভোগ করা, রাত্রে ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে যে সরুপথ চলে গেছে তা ধরে হোটেল থেকে সমুদ্রপাড়ের রেস্তোরাঁতে খেতে আসা, এইভাবে দিন দু'য়েক কাটিয়ে আবার ফিরে আসা দৈনন্দিন ব্যস্তময় জীবনে। তারপর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, দীঘার পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রগুলি গড়ে উঠেছে, সৈকত কেন্দ্রিক এই পর্যটন বর্তনীটি (দীঘা-শঙ্করপুর-তাজপুর-জুনপুট-মন্দারমনি) আজ খুবই জনপ্রিয়। এখন দীঘা গেলে বেশিরভাগ মানুষ শংকরপুর, মন্দারমণি, তালসারি, তাজপুর, উদয়পুর সৈকত ইত্যাদি স্থানগুলো ঘুরে আসেন। 

আমরাও তাজপুর থেকে গিয়েছিলাম শঙ্করপুরে। তাজপুর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শংকরপুর সমুদ্র সৈকতে পৌঁছতে সময় লাগে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। আর সেখান থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দীঘা। শঙ্করপুর পশ্চিমবঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য মৎস বন্দর কেন্দ্র। শঙ্করপুর সৈকত তুলনামূলকভাবে এখনও কম জনবহুল।
 

সমুদ্র সৈকতে রয়েছে কয়েকটি দোকান, দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসেছেন, ঝিনুক দিয়ে বানানো বিভিন্ন দ্রব্য, চাবির রিং, শঙ্খ, কাঠের গাড়ি, পুতুল ইত্যাদি আরও হরেক জিনিস। পায়ে পায়ে মৎস বন্দরের দিকে এগিয়ে এলাম, অনেক ট্রলার দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি, এগুলি মাছ ধরার ট্রলার। ট্রলার থেকে পাটাতন নামিয়ে রাখা হয়েছে তীরে, সেই পাটাতন বেয়ে বিরাট বিরাট বরফের চাই মাথায় নিয়ে কর্মীরা উঠে যাচ্ছেন ট্রলারে। অত্যন্ত ব্যস্ত দিন, কয়েক হাজার মানুষ এই মাছ ধরার কাজে যুক্ত, এতেই তাঁদের জীবনধারণ হয়। বছরে প্রায় ১০ মাস চলে মাছ ধরার কাজ, দুই মাস এপ্রিল মাসের মধ্যবর্তী সময় থেকে জুন মাসের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ওই সময় মাছের সংখ্যা যেন বৃদ্ধি পেতে পারে সেইজন্যে মাছ ধরা বন্ধ থাকে। 


এবার এই মৎস বন্দরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাছের প্রজাতির উল্লেখ করি (আমি পূর্বের একটি ব্লগ 'বাঙালির আহারে মাছ'-এর উপরে লিখছি)। এখানে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই বলি কন্ড্রিকথিস (Condrichthyes: যে সকল মাছের দেহে অস্থি অনুপস্থিত, এদের দেহে তরুনাস্থি (Cartilage) বর্তমান) শ্রেণীর কথা। এই শ্রেণীর অন্তর্গত উপশ্রেণী হলো এলাসমব্র্যাংকি (Elasmobranchii)। এদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এদের পাঁচ থেকে সাত জোড়া গিল বর্তমান যা বাইরের দিকে উন্মুক্ত, পৃষ্ঠদেশের পাখনা দৃঢ় হয়ে থাকে, এবং দেহে ছোট ছোট প্ল্যাকোয়েড আঁশ উপস্থিত। এই উপশ্রেণীর অন্তর্গত মাছের দেহে সুইম ব্লাডার থাকে না। এদের মুখের অভ্যন্তরে দাঁতের একাধিক সিরিজ রয়েছে। হাঙ্গর, রে ইত্যাদি এই উপশ্রেণীর অন্তর্গত প্রজাতি। ব্ল্যাকটিপ হাঙ্গর (Carcharhinus limbatus), স্পেডনোজ হাঙ্গর (Scoliodon laticaudus), দুধ হাঙ্গর (Rhizoprionodon acutus), ধূসর স্টিং রে (Dasyatis zugei), হানিকোম্ব স্টিং রে (Himantura uarnak) ইত্যাদি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।হাঙ্গর বা রে বাঙালির পাতে খুব উপাদেয় বলে গণ্য না হলেও বাইরে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। হাঙ্গরের লিভার থেকে প্রাপ্ত তৈলের ঔষধিগুণ রয়েছে, যা ফার্মাসিউটিকাল শিল্পে ব্যবহৃত হয়। কয়েক প্রকার হাঙ্গর এবং রে মাছের লিভার থেকে প্রাপ্ত তৈলের ব্যবহার চর্মশিল্পেও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও মাছের খাদ্য বা ফিশমিল (Fishmeal) এবং সার (Manure) প্রস্তুতিকরণে এই মাছগুলি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এরপর আসি অস্থিযুক্ত মাছের কথায়, যা অস্থিকথিস (Osteichthyes) শ্রেণীর অন্তর্গত। এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত একটি উপশ্রেণী হলো একটিনটেরিজি (Actinopterygii), যাদের রে-ফিন্ড ফিশ (Ray-finned fish) বলা হয়। ইল (Eel) হলো এই প্রকার মাছ, যা এই বন্দরের একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক মাছ। ইলের জীবনচক্র খুব কৌতূহলোদ্দীপক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের জীবনচক্রে ক্যাটাড্রোমাস (Catadromous) প্রকার লক্ষিত হয়, অর্থাৎ মিঠা জল (Fresh water) থেকে স্পনিং (Spawn) এবং ডিম পাড়ার জন্যে এরা সমুদ্রের নোনা জলে স্থানান্তরিত হয়। ডিম ফুটে যে চ্যাপ্টা এবং স্বচ্ছ লার্ভা বের হয় তার মাধ্যমে ইলের জীবন শুরু হয়, এদের লেপ্টোসেফালি (Leptocephali) বলা হয়। এরা সাধারণত সমুদ্রের পৃষ্ঠতলের ভাসমান জৈব পদার্থের কণা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।  এর পর এরা গ্লাস ইলে (Glass eel) রূপান্তরিত হয়, এই পর্যায়ে তারা মিঠা জলের দিকে ধাবিত হয়। এরপর যথাক্রমে এলভার (Elver), হলুদ ইল (Yellow Eel) হয়ে তারা পরিণত সিলভার ইলে (Silver Eel) রূপান্তরিত হয়। পরিণত সিলভার ইল স্পনিং এবং ডিম পাড়ার জন্যে আবার সমুদ্রের নোনা জলে ফিরে যায়। একটিনটেরিজি (Actinopterygii)-র অন্তর্ভুক্ত ওপর একটি ফ্যামিলি ক্লুপেডি (Clupeidae)। বাঙালির রসনা তৃপ্ত করে যে ইলিশ তা এর অন্তর্গত। বিভিন্ন প্রজাতির ইলিশ (Hilsa ilisha, H. toli, Ilisha kampeni, I. megaloptera ইত্যাদি) এই বন্দরের উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক মাছ। এদের জীবন চক্রে কিন্তু ইলের বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এরা এনাড্রোমাস (Anadromous) প্রকৃতির, অর্থাৎ স্পনিং-র জন্যে এরা সমুদ্রের নোনা জল থেকে মিঠা জলে স্থানান্তরিত হয়। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমানে এনকোভি (Anchovy; Family- Engraulidae), সামুদ্রিক ক্যাট ফিশ (Sea Catfish), উল্ফ হেরিং (Wolf Herring; Family- Chirocentridae) ইত্যাদি। এখানে উল্লেখযোগ্য লোটে বা লোইট্যা (Harpadon nehereus), বাঙালির আর এক রসনা তৃপ্তকারক এই মাছ। এর প্রচলিত নাম বোম্বে ডাক (Bombay Duck/Bombay Daak)। এই নামকরণের পিছনের কাহিনীটি বেশ মজার। তখন বোম্বের (বর্তমানের মুম্বাই) মৎসবন্দরগুলোতে বিপুল পরিমানে এই লোটে উঠতো। লোটে বাঙালির খুবই উপাদেয়।  রেলগাড়ি চালু হওয়ার পর মেল ট্রেনের (Mail train) মাধ্যমে তা সুদূর বোম্বে থেকে কলকাতায় এসে হাজির হতো। বাংলায় 'মেল/Mail' শব্দটির অর্থ ডাক, অতএব এর নাম হয়ে গেলো বোম্বে ডাক। এখানে অপর দু'টো উপাদেয় মাছ ব্ল্যাক পমফ্রেট (Black pomfret, Parastromateus niger; Family- Carangidae) এবং সিলভার পমফ্রেটও (Silver pomfrets, Pampus argenteus, P. chinensis) উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায়।

বেশ কিছুক্ষন শঙ্করপুরে কাটিয়ে আমরা রওনা হয়েছিলাম দীঘার উদ্দেশ্যে। 

অক্টোবর, ২০১৭

পুষ্টি সুরক্ষা ও আমাদের সমাজের কিছু চিত্র (Nutrition Security and Society)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আমি পূর্বে পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-১: সূচনা ব্লগটিতে বর্তমান ভারতবর্ষে পুষ্টি বিষয়ক চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমান ব্লগে ব্যবহারিক জীবনে খাদ্য বা পুষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা অংশ তুলে ধরার একটা প্রয়াস করবো। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন চিত্র। তা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাহিনী নয়। চরিত্র নামকরণ অপ্রয়োজনীয় কারণ এটি কোনো গল্প বা উপন্যাস নয়, বাস্তবের উপর ভিত্তি করে কিছু কাল্পনিক কাহিনী/ ভাবনা/ সংলাপ, যা থেকে সহজে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য এবং পুষ্টির স্থান অনুমান করা যাবে। আসলে খাদ্য এবং পুষ্টির সুরক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির পাশাপাশি আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কিছু সচেতনতা ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পুষ্টির সুরক্ষাকে দ্রুততর করে।  সেই রকম কয়েকটি দিক তুলে ধরতেই আমি এই কাল্পনিক সমাজচিত্রটির অবতারণা করলাম এই ব্লগে।

-------------------------------------------------------

'আগে বললেই পারতে, কিছুটা তুলে রাখতে বলতাম, অতটা খাবার নষ্ট হতো না'

অশীতিপর বৃদ্ধ বক্তার উদ্দেশ্যে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকায় বছর ত্রিশের অতিথি যুবক। গৃহের অন্য সদস্যরা হা হা করে ওঠেন, 'আরে না না, কি হয়েছে! আগে থেকে কি ঠিক বোঝা যায়, তুমি কিছু মনে করো না বাবা, ওনার তো বয়স হয়েছেইত্যাদি।

যুবক মনে মনে ভাবলেন, বৃদ্ধ বড়ই খিট্খিটে, কারোর বাড়িতে এলে এরকম কথা কেউ অতিথির উদ্দেশ্যে বলে নাকি! যাইহোক, আমতা আমতা করে প্লেটটি সরিয়ে রাখলেন। আবার গল্প গুজব চলতে থাকে। নানান কথা, ছুঁয়ে যায় একটার পর একটা বিষয়, চলচ্চিত্র-রাজনীতি-খেলা-সমাজ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি কি নেই সেখানে। একের মুখ থেকে কেড়ে আরেক মুখ কথা বলে ওঠে, সেখানে তথ্য-তত্ত্ব কিছুমাত্রায় ঠাঁই পায় বটে, তবে কল্পনা, ধারণা, নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার এক রমরমা আজকাল বড়ই চলছে। অতিথি নির্দিষ্ট সময় পার করে চলে যান, সবাই খুব ব্যস্ত আজকাল, তারমধ্যে সময় বের করে সকলের খোঁজ নিতে এসেছে সে, সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় অতিথির। এর মধ্যে কেউ একজন অর্ধেক খাবার পূর্ণ প্লেটটি টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।  রান্না ঘরের পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় গোটা দুয়েক তরকারি লেগে যাওয়া লুচিঅবশিষ্ট তরকারি আর দেড়খানা রসগোল্লা। বৃদ্ধ তাঁকিয়ে দেখেন। এমন ভাববেন না বৃদ্ধ গরীব, সে আর তাঁর পরিবার উচ্চ মধ্যবিত্ত। একটু বাদে আহ্নিক সেরে বৃদ্ধ তাঁর ঘরের ইজি চেয়ারটায় এসে বসবেন, চিনি ছাড়া চা আর দু'টো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট আসবে তাঁর জন্যে। দিনে দু'বার চা খান বৃদ্ধ, সকালে গ্রিন টি আর সন্ধ্যায় এমনি প্রচলিত চা, যাকে ব্ল্যাক টি বলে। তবে এই যে স্বাচ্ছন্দ্য, বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যায়ে পৌঁছনো সেই দীর্ঘ পথ কিন্তু মসৃন নয়, সেখানে অগণিত না খাওয়া রাত রয়েছে, আক্ষরিক অর্থে দু'মুঠো ভাত খেয়ে দিনাতিপাত রয়েছে, মুখ ফুটে খাবার চেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে বসে থাকার মুহূর্তগুলো রয়েছে, খাবারের আশায় ক্রোশের পর ক্রোশ পথ চলা আছে, আবার এর মাঝে কখনও জুটে যাওয়া কিছু ভালো খাবার আর তা নিয়ে উল্লাস রয়েছে। বৃদ্ধ ভাবেন, সেই সময়কার কথা, তাঁদের জীবনধারণের কথা, সে অনেকটা সংগ্রামের মতন শোনায়, বৃদ্ধ অনেক গল্প বলেন তাঁর নাতি নাতিনীদের, সবই আবর্তিত হয় নিজের জীবনের  কথা, তাঁর শৈশব, বড়ো হওয়া, কর্ম জীবন, ইত্যাদি। সবাই যে বোঝে তা নয় আবার বোঝে যে না তাও নয়। তবে কারা ভালো বোঝে, সে বোঝা দায় ! 

এই যে মেয়েটি প্রত্যেকদিন ঘরের কাজ করতে আসেন ওঁর মেয়েকে স্কুলে দিয়েছে, দাদার সাথে সেও যায়, রোজ স্কুলে খেতে দেয়, ও বলছিলো একবেলার জন্যে ও নিশ্চিন্ত। আবার পুজোর ফুল বাজারে যার কাছ থেকে নেওয়া হয়, ও বলছিলো ছেলেটাকে স্কুল পাঠিয়ে পড়াশুনা আর দুপুরের খাওয়াটা দু'টি বিষয়েই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। এঁরা হয়তো বোঝেন।

এই চিত্র আবার বৃদ্ধের প্রতিবেশী বাড়িটির ক্ষেত্রে কিছুটা আলাদা। ওঁদের থেকে বৃদ্ধ কথায় কথায় শুনেছে ওঁদের বাড়ির ছেলেটা রোজ স্কুলের মিড ডে মিলের খাবারটা খায়না, মাঝে মাঝে খায়, ডিম দিলে সেটা নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। ওঁরা কেক, চিপস এসব দিয়ে দেন টিফিনে।

বাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার করতে এসেছে একটা লোক, দুপুরে বৃদ্ধের বাড়িতে খেতে দেওয়া হয়েছিল, সাধারণত এসকল লোককে নিরামিষই দেওয়া হয় কিন্তু সেদিন বাড়িতে মুরগির মাংস একটু বেশি পরিমানেই রান্না হয়েছিল, দু'টুকরো লোকটাকে দেওয়ায় তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, তা বৃদ্ধ লক্ষ্য করেছিলেনখাবারের অভাব এও হয়তো বোঝে।

'তোমার ঘরে কে কে আছে?'

'বৌ, এক ছেলে আর এক মেয়ে বাবু'

'ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়াশুনো করাচ্ছ তো?'

'আজ্ঞে!' একটু আমতা আমতা করে বলে 'আসলে গত দু'বছরে তেমন কিছু রোজগারপাতি ছেলো না, তাই মেয়েটা মায়ের সাথে কাজের বাড়ি যায়।

বৃদ্ধ বলে ওঠেন, 'বলো কি ! স্কুল ছাড়িয়ে দিলে?'

'না বাবু, আবার যাবেখন, মানে স্কুল ও তো বন্ধ ছেলো, তাই ......, তা যাবেখন আবার, গেলি তো খাওন টাও পায়।'

বৃদ্ধ বোঝে, কিন্তু কি বলতে হবে সেটা বোঝেন না !    

বাড়িতে হৈ হৈ পরে যায়। বৃদ্ধের বড়ো নাতি এসেছে, কর্মসূত্রে সে প্রবাসীকাজেই সকলে ঠিক করলো বাইরে খাবে। তবে এখন বাইরে বেড়ানোটা বেশ অসুবিধাজনক, প্যানডেমিকের কারণে একটা উদ্বেগ থেকেই যায়। অবশেষে ঠিক হলো খাবার আনিয়ে নেওয়া হবে যার যা ভালো লাগে, সবাই নিজের নিজের মতন অর্ডার দিলো, বিরাট আয়োজন। কেউ ফ্রাইড রাইস, কেউ বাসন্তী পোলাও, কেউ সাদা ভাত, আবার কেউ বিরিয়ানি। কেউ মাটন কষা, কেউ রেজালা, কেউ চিকেন বাটার মশালা, আবার কেউ পনির মশালা। আরও কত কি! কেউ কিন্তু নিজের সমস্ত খাবার এবেলায় শেষ করতে পারলো না। বৃদ্ধকে সকলে কথা দিলো, রাতে অবশিষ্টাংশ খেয়ে নেবে তবে তা আর হয়নি, অবেলায় এতো কিছু খেয়ে রাতে কেউ খাবার মুখেই তুলতে পারলো না। আগেরবার, মানে দু'বছর আগে কিন্তু এমনটা হয়নি, সেবার সবাই মিলেমিশে অর্ডার দিয়েছিলো, মানে এক প্লেট পোলাও দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, আবার এক প্লেট মাটন দু'জনে ভাগ করে নিয়েছিল, এতে পুরোটাই খেতে পেরেছিলো, নষ্ট হয়নি         

বৃদ্ধ কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন। সেখানে একাধিকবার সে বিভিন্ন পার্টিতে যোগ দিয়েছে, ওখানে অনেকটা খাবারের এমন রীতি, অনেক খাবারের আয়োজন হয়। রেঁস্তোরা থেকে যখন বেরোয় কত খাবার পাতেই পড়ে থাকে।  বৃদ্ধের, তখন সে যুবক, মুখ থেকে কতবার আক্ষেপ সূচক বাক্য নিঃসৃত হয়েছেএকবার সাহেব বন্ধু বলেছিলেন, 'আরে এই খাবার বাঁচলে কি পৃথিবীর খাদ্য সংকট মিটে যাবে নাকি?' যুবক কিছু বলেননি, শুধু তাঁকিয়ে থেকেছেন আর ভেবেছেন কয়েক বৎসর পূর্বের তাঁর জীবনের কথা। এখানে এতো খাবার নষ্ট হয় আর এমন মানুষও আমাদের সমাজে ছিলেন যারা ফসল তোলার পর মিনতি করতে আসতেন, বাবু যদি তাঁদের আজ্ঞা দেন তবে তাঁরা মাঠে পরে থাকা শস্য সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে পারেন। প্রবাস জীবনে বাজার করতে গিয়েও তিনি অভিজ্ঞতা করেছেন সেদেশে সকল বস্তুই নির্দিষ্ট ওজন করা প্যাকেটে বন্দী, ঠিক যতটা লাগবে ততটা কেউ ওজন করে নিতে পারবেন না (আমাদের দেশের বাজারের মতন), কাজেই অধিকাংশ সময়ে অতিরিক্ত পরিমান বস্তু বাজার থেকে নিয়ে আসতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে তা পচে নষ্ট হয়।  

কি রে ওটা কি রাখলি? এক খানা ডিম নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’ কাজের মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন গৃহকত্রী।

‘আর বোলো না গো মা, ছেলেটা মোটে নিরিমিষ মুখে তুলতে চায় না, তাই আর কি করি, এই এক খান ডিম নিয়ে যাচ্ছি, ভেজে দেবোখন, ভাত দু'টি খাবে।’ উত্তর দেয় মেয়েটি।

তা এক খানা নিলি যে বড় ! বোনটার জন্যে নিলি না ?’

না গো, ও বড় লক্ষ্মী, ও খেয়ে নেয় যা জোটে।’ 

আচ্ছা, বুঝেছি, বলে এক খানা ডিম ফ্রিজ থেকে এনে দেন মেয়েটির হাতে, বলেন দুই ভাইবোনকেই ভেজে দিস।

বৃদ্ধ দেখছিলেন। ভাবছিলেন কয়েক দশক আগের কথা, যখন রাত্রের আহারে তিনি একা মাছের টুকরো খেতেন, বিধবা মা আর স্ত্রী খেতেন ভাত-ডাল আর যেদিন যা তরকারী থাকতো তাই। বাইরে কাজের জন্যে কোন সকালে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন রাত্রে, তাই টানাটানির সংসারে দু'বেলা যা কিছু উত্তম জুটতো তা তাঁর পাতেই জায়গা পেতো। এই নিয়ে অবশ্য মা বা স্ত্রীর কোনো আফসোস ছিল না। তাঁরা তো বাড়িতেই থাকতেন, সমস্ত ঘর পরিষ্কার, রান্না করা, কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া, ইত্যাদি কত শত কাজ, তবে সবটাই বাড়িতে, কাজেই তাঁরা 'অধিক' পরিশ্রম করে যিনি সংসার টানছেন বলে মনে করতেন তাঁকেই ভালোটা পরিবেশনের জন্যে সচেষ্ট থাকতেন।  

তবে প্রথমবার যখন তাঁর স্ত্রী মা হয়েছিলেন, তখন মা এবং সন্তান বেশ ভুগেছিলেন। মেয়ে সন্তানের ওজন হয়েছিল অনেক কম, জ্বর, ডায়রিয়া ইত্যাদির সাথে লড়তে লড়তে বাচ্চাটা প্রায় বিছানায় মিশেই গিয়েছিলো। ডাক্তার অনেক বাকাবকি করেছিলেন। এই সকল ভোগান্তি অপুষ্টিজনিত বলেছিলেন, বৃদ্ধ (তখন যুবক) বুঝেছিলেন কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস ততদিনে পদোন্নতি হয়েছিল তাইতো অনেক ডাক্তার হসপিটাল করে কোনো মতে মা মেয়েকে সুস্থ্য করে ঘরে এনেছিলেন। সে প্রায় বছর পঞ্চাশের আগের কথা, এখন তো খুকীর ছেলেই কত বড় হয়ে গেছে ! তারপর তো মা চলে গেলেন। অফিস থেকে তাঁকে পশ্চিমে পাঠালো। জীবনে এক ধাক্কায় অনেকটা পরিবর্তন এলো। খুকী খুবই ঘ্যান ঘ্যান করতো ছোটবেলায়, সে ওই দেশে কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া শুরু করলো, দিদিমণিদের পরামর্শে খুকীকে কাউন্সেলিং করানো হলো, ধীরে ধীরে বেশ চনমনে হয়ে উঠলো  সে। তারপর তাঁদের একটি ছেলে হলো, ডাক্তার স্ত্রীর মেডিকেল হিস্ট্রিতে সিজার দেখে একটু চিন্তিত হলেন।  যাইহোক এবার পূর্বের ন্যায় পরিস্থিতি হলো না, তবে সেবারও স্ত্রী সিজারের মাধ্যমেই পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।

এসকল ভাবছিলেন বৃদ্ধ, তখন নাতি ঘরে প্রবেশ করলেন। বৃদ্ধ তাকালেন, দৃষ্টিটা একটু পরিষ্কার হলে প্রশ্ন করলেন, 'হ্যাঁ রে তুই যে দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছিস' ! নাতি হেসে উত্তর দিলো 'সেডেন্টারি লাইফ গো দাদু, সারাদিন বসে বসে কাজ, জগৎ সংসার এগিয়ে চলছে আর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে উৎপন্ন করছে এই অপুষ্টিগত পরিনাম' বলে থামে সে।

তা কতদিন ছুটি পেলি?

আর ছুটি..’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে পেয়েছি দু'দিনের, তার সাথে রবিবার 

বাব্বা, কাজের তো বড্ড চাপ ! তা খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকে করিস তো?

হ্যাঁ সেটা করি, বেশিরভাগ দিন দুপুরে অফিসেই বিরিয়ানি না হয় সিজওয়ান ফ্রাইড রাইসের একটা প্লেট আনিয়ে নিই, বাড়িতে রাতে হালকা কিছু ধরো রুটি আর মাংস বা পনিরের কিছু একটা আর টক দই। খাওয়া নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা নেই

নাতি আরো বলে ও যেখানে বাসা ভাড়া নিয়েছে, তার সামনে বেশ কতগুলো দোকান রয়েছে, পিজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, মোমো, পাস্তা সব কিছুই সেখানে সহজলভ্য। নাতির মধ্যে কি যেন খোঁজে বৃদ্ধ, হয়তো নিজের তরুণ অবস্থাকে, নাতিকে দেখতে পুরো তাঁরই মতন। এই বয়সে তাঁর নিজের কি অবস্থা ছিল, কিভাবে যে বেঁচেছিল অসহায় মাকে নিয়ে সেটাই সে বুঝতে পারে না। দিনের পর দিন ভাত, এখান-ওখান তুলে আনা কলমি শাক ভাজা খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া, এই ছিল তাঁদের দিনাতিপাত। ডাল-ভাত-তরকারি-মাছ সহযোগে পরিপূর্ণ আহার তাঁদের কাছে তখন ছিল চাঁদ হাতে পাওয়ার মতন, তা সম্ভব হতো যদি কেউ নিমন্ত্রণ করতেন তবে মা'র মুখে কোনোদিন তেমন সুখাদ্য তুলে দিতে পারেননি বৃদ্ধ। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে নাতির ডাকে, দাঁড়াও আমি আসছি বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক বাদে, হাতে তখন আলুর চিপস আর এক গ্লাস কোল্ড ড্রিঙ্কস। নাতিকে খেতে বারণ করে বৃদ্ধ, পরক্ষণে কি মনে হয় আবার বলে আসলে একটু এসব কম খাস মনে মনে হিসেব করে, পয়সা যখন ছিল না আর যখন হলো আসলে ঠিক কতটা পার্থক্য হলো ?  

কাজের মেয়েটি আবার আসে পড়ন্ত বিকেল বেলায়। ও রেশন নিয়ে কার্ড ফেরত দিতে এসেছে। গৃহকত্রী রান্না ঘর থেকে বলেন দাদুর কাছে রেখে যেতে। বৃদ্ধ হাসিমুখে কার্ডগুলো রেখে দেয়। 'দাদু কি হয়েছে? হাসছ যে'! 'না রে, আসলে ভাবছি কত মানুষের মুখে অন্ন উঠছে, একি আর মুখের কথা রে দিদিভাই' 

দাদু ওঁকে বলেন নাতিকে ডেকে দিতে। মেয়েটি নাতিকে ডেকে দিয়ে চলে যায়। দাদু বলে তোর ল্যাপটপ টা আন তো, দু'জনে মিলে একটা সিনেমা দেখি, আজ দেখবো মৃনাল সেন পরিচালিত 'আকালের সন্ধানে' আর কাল দেখবো সত্যজিৎ রায় পরিচালিতগুপী গাইন বাঘা বাইন'

এই দু'টো বাছলে কেন?

আচ্ছা.....তবে তুই বল। না থাক, আছে তো আরও তবে আগে এই দুটোই দেখি

বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য (Ecosystem services and Foods)

সম্পত ঘোষ  (Sampat Ghosh)

'আঃ বড্ড দাম নিচ্ছ, তরকারীতে তো হাত দেওয়ার উপায় নেই গো'খদ্দেরের অভিযোগ শুনে বিক্রেতা একগাল হেসে, 'আমরাও তো দাম দিয়ে কিনে আনি বাবু, কতটুকু আর লাভ থাকে! তবে মাল আমার এখানে এক্কেবারে টাটকা' এই বলে প্রয়োজনীয় সব্জিগুলি খদ্দেরকে গুছিয়ে দিয়ে দেয়। খদ্দেরবাবু মনে মনে একটু খুশি হয়, অতিরিক্ত দামের জন্যে মনের মধ্যে যে ক্ষতটা সৃষ্টি হচ্ছিলো, টাটকা সব্জি কিনতে পেরে সেই ক্ষতে মলম পড়ে।

এই যে খাবারগুলি প্রত্যহ আমরা খাই, তা উৎপাদন করতে আমাদের একটা খরচ হয়, যেমন ধরা যাক চারা বা বীজ কিনে আনা, রোপন করা, উপযুক্ত পরিমানে জল (সেচের মাধ্যমে বা ভূগর্ভস্থ জল তুলে), সার (পরিপূরক হিসেবে), কীটনাশক (প্রয়োজন অনুযায়ী) সরবারহ করা, ফসল তোলা, এবং বাজারজাত করা; প্রত্যেকটি ধাপে কিন্তু খরচ হয় আর এই সমগ্র খরচের উপর বিক্রয়মূল্য নির্ভর করে। মনে রাখা প্রয়োজন, এখানে কিন্তু প্রকৃতি আমাদের থেকে কোনো দাম নেয় না। একটু সহজ ভাষায় বলি, এই যে কৃষি বাস্তুতন্ত্রটি (Agro-ecosystem) প্রকৃতি প্রদান করছে, যেমন ভূগর্ভস্থ বা পৃষ্ঠদেশের জলভাণ্ডার, মাটি যেখানে পুষ্টি উপাদানগুলি রয়েছে যা উদ্ভিদকে জীবনধারণে সাহায্য করে, পরাগবহনকারী প্রাণী (Pollinators) বিশেষত পতঙ্গ (Insects) যা পরাগ সংযোগের জন্যে অপরিহার্য, সেই সকল প্রাণী (যারা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল (Biological control) বলে পরিচিত) যারা শস্যের জন্যে ক্ষতিকারক পতঙ্গগুলিকে ধ্বংস করে; এই তাবৎ সেবা কিন্তু বিনামূল্যেই (বাজার অর্থনীতির বাইরে) প্রাপ্ত হচ্ছে। যদি প্রকৃতি এর জন্যে বাজারমূল্য ধার্য করতো তবে কি হতো একবার ভেবে দেখো !  

এই প্রকার বিভিন্ন সেবা আমরা প্রকৃতি থেকে পেয়ে থাকি। হয়তো বিনামূল্যে পাই বলেই গুরুত্ব আরোপে বিলম্ব হয়। পঁচিশ বৎসর পূর্বে রবার্ট কনস্টানজা (Robert Constanza) তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন যে বাস্তুতন্ত্র যে সকল সুবিধা মানুষকে প্রদান করে তার বাজারমূল্য বার্ষিক প্রায় ৩৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য (Constanza et al. 1997)এর মধ্যে খাদ্য উৎপাদনের জন্যে ক্রপল্যান্ড (Cropland) বাস্তুতন্ত্রটি যে সেবা প্রদান করে তার মূল্য পৃথিবীব্যাপী বার্ষিক ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য (Constanza et al. 1997)কাজেই সহজেই বোধগম্য হয় যে এই মূল্য যদি মানুষকে বাজারমূল্যের ন্যায় চোকাতে হতো তবে খাদ্যের দাম কিরূপ হতো !  

[পরবর্তী কোনো ব্লগে আমি বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করবো।]

অতএব প্রকৃতির কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। মনে রাখা দরকার এই সকল সেবা ব্যতীত শস্য উৎপাদন কিন্তু অসম্ভব আর প্রকৃতি এইসকল সুবিধা প্রদান করবে যতদিন মানুষ প্রকৃতিকে তার ধারণক্ষমতার (Sustainability) মধ্যে থাকতে দেবে। এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কিরূপে সম্ভব? আমাদের প্রকৃতির ধারণক্ষমতাকে বুঝতে হবে, সেই ধারণক্ষমতা বিঘ্নিত হয় এহেন কার্যের থেকে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন। 

প্রথমেই আমাদের মৃত্তিকার কথা মনে আসে কারন মাটিতেই আমাদের খাদ্যের সিংহ ভাগ উৎপন্ন হয়ে থাকে। মাটিতে যে জীব বৈচিত্র থাকে, ব্যাকটেরিয়া থেকে কেঁচো, এরা মাটিকে সতেজ এবং উর্বর রাখে। মৃত্তিকার প্রধান কয়েকটি উল্লেখ্য সেবা হলো, মাটি বিভিন্ন পুষ্টিউপাদান বিশেষত খনিজ ধারণ করে যা উদ্ভিদকে জীবনধারণ করতে সাহায্য করে, মাটি  জল পরিশ্রুত করে, বন্যা এবং খরা প্রতিরোধ করে, এমনকি কার্বণকে সঞ্চিত রেখে জলবায়ু পরিবর্তনকে রোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। মাটিতে উপস্থিত অণুজীব (Microbes) পচন (Decompose) তথা রিসাইকেল (Recycle) প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, এরা গুরুত্বপূর্ণ এন্টিবায়োটিকের উৎসও বটে।। দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বব্যাপী মাটির বা ভূমির অধঃপতিত (Degrade) হওয়ার হিসাব প্রায় ১ থেকে ৬ বিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে (Gibbs and Salmon, 2015; Global Land Outlook by United Nations 2017), বিভিন্ন কারণ যথা নগরায়ন, খনি, শক্তি উৎপাদন ইত্যাদির সাথে মূলত বর্তমান নিবিড় চাষ (Intensive agriculture) পদ্ধতি ভূমির অধঃপতনের জন্যে অনেকাংশে দায়ী। 

জলের সংকট বর্তমান সময়ের একটি চ্যালেঞ্জ। যত জল আমরা তুলে থাকি তার প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে। ফসলের মধ্যে ডাল জাতীয় শস্যের জন্য জল তুলনামূলক কম পরিমানে লাগে, তাও ১ কিলোগ্রাম মশুর ডাল উৎপাদনের জন্যে প্রায় ১২৫০ লিটার জল ব্যবহৃত হয়, আর ১ কিলোগ্রাম বিফের জন্যে লাগে প্রায় ১৩০০০ লিটার জল (FAO)। কাজেই ভেবে দেখা যায় কি পরিমান জল খাদ্য উৎপাদনের জন্যে লাগে ! আবার চাষের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিকের দ্বারা অনেক সময়েই এই জল দূষিত হয় এবং সম্পর্কিত অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রগুলিকেও প্রভাবিত করে থাকে। মনে রাখা দরকার বর্তমানে বিপুল জনসংখ্যা, প্রায় ২.২. বিলিয়ন মানুষ পরিশুদ্ধ পানীয় জলে থেকে বঞ্চিত।তাহলে বোঝা গেলো, এই জলের ব্যবহার এবং সংরক্ষণের বিষয়েও যত্নবান হতে হবে।

আবার বিভিন্ন গবেষণায় পরাগবহনকারী পতঙ্গদের, বিশেষত মৌমাছিদের, স্বাস্থ্য, সংখ্যা এবং বিস্তারের যে চিত্র উঠে আসছে তাও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রায় এক তৃতীয়াংশ খাদ্য উৎপাদন (প্রায় ৭০ টি ফসল/ শস্য) পরাগবহনকারী পতঙ্গদের উপর নির্ভরশীল, যদি এই উপকারী বন্ধু পতঙ্গগুলির সংখ্যা হ্রাস পায় তবে নিঃসন্দেহে তা ফলনের উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে এবং খাদ্য তথা পুষ্টি নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে (Eilers et al., 2011; Smith et al., 2015; Ghosh and Jung, 2018) এই হ্রাস পাওয়ার পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান, যথা, পরাগবাহক পতঙ্গদের বাসস্থান ধ্বংস, ল্যান্ডস্ক্যাপের (Landscape) পরিবর্তন, নিবিড় চাষের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি মনোক্রপিং (Mono-cropping), অতিরিক্ত পরিমান কীটনাশকের (Insecticides) ব্যবহার, উপযুক্ত পুষ্টির অভাব, বিভিন্ন পেস্ট (Pest) এবং প্যাথোজেনের (Pathogen) বৃদ্ধি, এবং অবশ্যই জলবায়ুর পরিবর্তন (Climate change) ইত্যাদি। ঠিক কতটা ক্ষতি হতে পারে তা নিরুপন করা সম্ভব, বিশ্বব্যাপী চিত্রের পাশাপাশি রাষ্ট্র বা অঞ্চল ভিত্তিক চিত্রও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ 

অতএব এই সকল অধঃপতন বা অবনমন (Degradation) প্রতিরোধ করা একান্ত প্রয়োজন, অন্যথা মানবসভ্যতা বিপর্যয়ের সামনে এসে পড়তে পারে। মানুষ বিষয়গুলি অনুধাবন করেছে এবং প্রতিটি বিষয়েই যত্নবান হয়েছে, তবে আরও অনেকটা এগোনো প্রয়োজন। 

তথ্যসূত্র (Reference):

Costanza, R.; d'Arge, R.; de Groot, R.; Farber, S.; Grasso, M.; Hannon, B.; Limburg, K.; Naeem, S.; O'Neill, R.V.; Paruelo, J.; Raskin, R.G.; Sutton, P.; van den Belt, M. 1997. The value of the world's ecosystem services and natural capital. Nature 387, 253–260. https://doi.org/10.1038/387253a0

FAO (Food and Agriculture Organization of the United Nations), Water scarcity- One of the greatest challenges of our time.  https://www.fao.org/fao-stories/article/en/c/1185405/ (accessed on 23rd March 2023)

Ghosh, S.; Jung, C. 2018. Contribution of insect pollination to nutritional security of minerals and vitamins in Korea. Journal of Asia-Pacific Entomology 21, 598-602. https://doi.org/10.1016/j.aspen.2018.03.014 

Eilers, E.J.; Kremen, C.; Smith Greenleaf, S.; Garber, A.K., Klein, A-M. 2011. Contribution of Pollinator-Mediated Crops to Nutrients in the Human Food Supply. PLoS ONE 6, e21363. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0021363

Gibbs, H.K.; Salmon, J.M. 2015. Mapping the world's degraded lands. Applied Geography 57, 12-21. https://doi.org/10.1016/j.apgeog.2014.11.024 

Global Land Outlook, First Edition, United Nations Convention to Combat Desertification, 2017. Bonn, Germany.

Smith, M.R.; Singh, G.M.; Mozaffarian, D.; Myers, S. 2015. Effects of decreases of animal pollinators on human nutrition and global health: a modeling analysis. Lancet 386: 1964-1972. https://dx.doi.org/10.1016/S0140-6736(15)61085-6 

ঊড়িষ্যার কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদ: আমার অভিজ্ঞতা (Some special food items in Orissa: My experience)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পড়াশুনা বা কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে থাকার সুযোগ আমার হয়েছে, সেই সুবাদে বিভিন্ন স্থানের খাদ্যবস্তুগুলির স্বাদ গ্রহণ আমি করেছি। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এমনকি কখনও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন রকমের খাদ্য গ্রহণের প্রচলন রয়েছে। এই ব্লগটিতে আমি আমার অভিজ্ঞতার ঊড়িষ্যার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থানীয় খাদ্যের কথা বলবো।

জীবনের কয়েক বৎসর আমি ঊড়িষ্যা রাজ্যে কাটিয়েছি, সে প্রায় বছর পনেরো-কুড়ি আগের কথা। অনেক মানুষ জগন্নাথদেব দর্শনের উদ্দেশ্যে পুরী বেড়াতে যান, তাঁরা নিশ্চয়ই ভগবানের মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেছেন। পুরী শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁতে উড়িষ্যার খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করেছেন। কলকাতা শহরে অনেক পাইস হোটেল রয়েছে যেখানে ওড়িয়া ঠাকুর রান্না করেন। রান্নার কাজে ওড়িয়া ঠাকুর বেশ দক্ষ, ক্যাটারিঙে বা হোটেলে রান্নার জন্যে তাঁদের চাহিদা বেশ। বাংলা সাহিত্যেও এর অনেক উল্লেখ রয়েছে। যাইহোক, আমি থাকতাম গঞ্জাম (Ganjam) জেলার ব্রহ্মপুর বা বেরহামপুর (Berhampur) শহরে, দক্ষিণ ঊড়িষ্যার একটি শহর। বিভিন্ন ধরণের আচার আর পাঁপড়ের জন্যে এ শহর প্রসিদ্ধ। তবে যতদিন সেই শহরে আমি থেকেছি, কোনোদিনই আমি তা কিনিনি। পরে যখন সেই শহরে কোনো কাজে গিয়েছি তখন তা কিনেছি, এবং সেগুলির স্বাদ গ্রহণ করে পরিচিত মহলে যথেষ্ট প্রসংশা করেছি। বেরহামপুর বসবাসের সময় অধিকাংশ দিনই প্রাতঃরাশ করা হতো না, ছুটির দিনে যেদিন তা সম্ভব হতো তা ছিল পাড়ার দোকানের শালপাতার ঠোঙ্গায় তিনটি ছোট আকারের আটার পুরি, আলুর তরকারী, আর এক হাতা উপ্মা। এর দাম ছিল পাঁচ টাকা। যদি কেউ উপ্মা না নিতেন তবে দোকানি তাঁকে পাঁচটি পুরি দিতেন। কখনও দোকানে বসে খেয়ে আসতাম আবার কখনও যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেখানে জেঠিমা যদি তাঁদের বাড়ির জন্যে আনতে দিতেন তবে আমিও আমার খাবার নিয়ে বাড়িতেই আসতাম। তবে দোকানে দাঁড়িয়ে খাওয়ার একটা সুবিধা ছিল, ক্রেতা চাইলে দোকানি আরও একবার তরকারী দিতেন। প্রাতঃরাশের অন্যান্য পদও ছিল যেমন ইডলি, বড়া ইত্যাদি। তবে স্থানীয় মানুষ অধিকাংশ সময়ে 'পাখালা' দিয়ে প্রাতঃরাশ সারেন। ঊড়িষ্যার প্রচন্ড গরমে এই 'পাখালা' খুবই কার্যকারী। পাখালা ছাড়া ওড়িশার খাবার অসম্পূর্ণ। আমাদের যেমন পান্তাভাত ঠিক তেমনই ওড়িশার মানুষের 'পাখালা ভাত'। যদিও আমি এই পদটি ওড়িশাতে কখনও খাইনি তবে আমার বন্ধুদের মুখে শুনেছি, আমাদের ভাড়া বাড়ির জেঠিমাদেরও খেতে দেখছি। পাখালা প্রধানত দুই রকমের হয়, ১. ভাতে জল এবং টক দই দিয়ে  সারারাত ধরে রাখা হয়, এতে খাবারটি ফার্মেন্ট (Ferment) হয়, একে বাসি পাখালা বা কখনও দই পাখালা বলা হয়; ২. অপরটি হলো সাজা পাখালা, এ ক্ষেত্রে ফার্মেন্ট করা হয় না, ভাতে টকদই আর জল যোগ করে পেঁয়াজ, লঙ্কা  এবং বড়ি সহযোগে খাওয়া হয়।

চা আমি সেই সময় বিশেষ খেতাম না, তবে বিকেলে একটি পাড়ার চায়ের দোকানে নিয়মিত বন্ধুদের সাথে যেতাম, অধিকাংশ দিনই আমি কিছু স্থানীয় বেকারির বিস্কুট কিনে খেতাম। সান্ধ্যকালীন খাবারের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল ব্রেড চপ, বাঁধাকপির কাটলেট, সিঙ্গাড়া ইত্যাদি। এখানে প্রতিটি পদের সাথে তরকারি পরিবেশন করা হয়। চপগুলি ভেঙে তরকারী দিয়ে মেখে খাওয়াটাই এখানে রীতি।

দুপুরে বেশিরভাগ দিন কলেজে থাকার কারণে দুপুরের খাবার প্রায় হতোই না বলা চলে, তবে বিকেলের দিকে বেশ খিদে পেতো, তখন বেশ ভারি কিছু খাবার খেতাম। পাড়ার মোড়ের কাছে একটি রেস্তোরাঁ ছিল, সেখানে সাত টাকায় একটি মশলা দোসা পাওয়া যেত সেই সময়ে, এটা বেশ উপাদেয় ছিল আমার কাছে। সেই দোকানটির সামনে দিয়ে বড়ো রাস্তাটি গিয়েছে, রাস্তার অপর পাড়ে একটি মিষ্টির দোকান ছিল সেখানে দশ টাকায় একটি বড়ো গ্লাস লস্যি পাওয়া যেত, দোকানি লস্যির উপরে নারিকেল কুড়োনো, কাজু-কিশমিশ-আলমন্ডের টুকরো ইত্যাদি দিতেন, এটা সুস্বাদু তো ছিলই এবং উদরপূর্তিও করতো। এখানে একটা কথা বলি, দোকানি লস্যির গ্লাসে শুকনো ফলের টুকরোর সাথে লাল রঙের চেরীও দিতেন, তখন যেটি চেরী বলে জানতাম তা বোধ করি করমচা-কে চিনির রস আর লাল রং সহযোগে প্রস্তুত করা এক ধরণের বস্তু। আমি প্রকৃত চেরী নামক ফল কখনও আমার দেশে দেখিনি (পাওয়া যায় নিশ্চয় তবে আমার চোখে তা পড়েনি), তা দেখছি বাইরের দেশে। চেরী ফল আর যা আমাদের দেশে চেরী বলে কেক, সন্দেশ বা লস্যিতে দেওয়া হয় তাদের মধ্যে কোনোরূপ সাদৃশ্য নেই, তা বলাই বাহুল্য। পানীয়র কথা যখন উঠলোই, একখানি ঘটনা উল্লেখ করি। 

একবার রেলগাড়িতে চলেছি বেরহামপুরে, রেলস্টেশনের নাম ব্রহ্মপুর। সকাল ৭ টা ২০ তে হাওড়া ছেড়ে সন্ধ্যে সাড়ে ৫ টা নাগাদ নামিয়ে দেবে গন্তব্যে। গরমকাল, তাপমাত্রা প্রায় ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আশেপাশে। রেলের কামড়া-র পাখাগুলো চললেও তা যে খুব যুৎসই হচ্ছে তা না, তারপরে এটি অনারক্ষিত কামড়া, কাজেই বেশ ভিড়। চিল্কা হ্রদটি ছাড়িয়ে একটু পরে ট্রেনটি পড়ল দাঁড়িয়ে, এ ঘটনা ভারতীয় রেলের জন্যে বিছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা যাত্রীরাও এটি অভ্যেস করে নিয়েছি। এমনকি  নিত্য যাত্রীরা তো জানেন ঠিক কোনখানে ট্রেনটি দাঁড়াবে বা ধীরে চলবে, সেই মতন তাঁরা নামার পরিকল্পনাও করে রাখেন।  যাইহোক, এই ঘটনাটি সেই বর্ণনা নয়। ট্রেন তো দাঁড়িয়ে পড়লো, ভুবনেশ্বরের পর ভিড়টা একটু পাতলা হয়েছে। একজন আদিবাসী বৃদ্ধা উঠে এলেন কামড়ায়, ঘোল বেচতে এসেছেন। গলা শুকিয়ে গেছিলো, এক গ্লাস ঘোল ৫ টাকায় বিক্রি করছিলেন। মাটির পাত্র করে এনেছেন, আর স্টিলের গ্লাসে দিচ্ছেন, খেয়ে সেটা ফেরত দিয়ে দিতে হবে। আমিও কিনলাম এক গ্লাস, গলায় ঢেলে প্রাণ ঠান্ডা হলো কিছুটা, আমি পয়সা দিয়ে দিলাম। বৃদ্ধা সেটি নিয়ে রেখে দিলেন, আবার আমার গ্লাসটায় ঘোল ঢেলে দিলেন কিন্তু আর পয়সা নিলেন না। আমার বুদ্ধি পরিণত হতে সময় লেগেছে, এটা আমি জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোকে দেখে বুঝতে পারি। আমি জোর করেও পয়সাটা দিতে পারতাম হয়তো, কিন্তু দু'বার বলার পরে সে যখন নিল না আমি রেখে দিলাম। এটাই ভারতবর্ষের আসল রূপ। এই রূপ আমি দেখেছি প্রতিনিয়ত, আজ অনেকটা দিন পেরিয়ে এসে পৃথিবীর অতি আধুনিক শহরের জীবনের মাঝেও তাই প্রায়ই মন চলে যায় দেশে, ফিরে পেতে চায় সেই মানুষগুলোকে, যাঁদের মানবিকতাই এই সভ্যতার ভিত্তি।

আবার অনেক দিন বিকেলে আমরা বন্ধুরা বেড়াতে বেরোতাম, কখনো পুরোনো আবার কখনো নতুন বাস স্ট্যান্ডে। সেই স্থান গুলিতে অনেক রেস্তোরাঁ ছিল, বেরহামপুর খুব যে খরচ বহুল স্থান ছিল তা একেবারেই নয়, তবে সেইটুকুও সর্বদা আমাদের সাধ্যের মধ্যে ছিল না। কাজেই রেস্তোরাঁতে প্রবেশের পূর্বেই আমরা খাবারের দাম জেনে নিতাম। পনেরো-কুড়ি টাকা প্রাতঃরাশ বা বিকেলের খাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বেশি বলেই আমরা সাধারণত গণ্য করতাম। ছুটির দিনে দুপুরে বা প্রত্যহ রাত্রির আহারের ক্ষেত্রে বারো থেকে পনেরো টাকা যথেষ্ট বলে আমরা হিসাব করতাম। প্রত্যহ রাত্রে আমরা বড়ো রাস্তার উপর একটি নির্দিষ্ট হোটেলে খেতে যেতাম, এটি 'ভাইনা'র দোকান বলেই আমাদের কাছে পরিচিত ছিল। ওড়িয়া ভাষায় বড়োভাই কে ভাইনা বলে হয়, দোকানি আমাদের বাবার বয়সী হলেও আমরা তাকে ভাইনা বলেই সম্বোধন করতাম। বারো টাকায় স্টিলের থালার উপর শালপাতায় পেট ভোরে ভাত, ডাল, কিছু একটা ভাজা (প্রধানত আলু), আর মাছের ঝোল পাওয়া যেত। ওখানে মাছের টুকরোকে ব্যাসনের প্রলেপ লাগিয়ে ভাজে যাতে মাছ ভেঙে না যায়। প্রায়ই ভাইনা ফ্রি তে মাংসের ঝোল, কখনও এক টুকরো মাংস দিয়ে যেতেন আমার বন্ধুদের, সেই সময় আমি কোনোপ্রকার মাংস খেতাম না।পনেরো টাকায় দুটি ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত পাওয়া যেত, কখনও কখনও আমি সেটি খেতাম। কুড়ি টাকায় পাওয়া যেত মাংস ভাত। তবে সকল দিন যে আমিষ পাওয়া যেত তা নয়, সপ্তাহের তিন চারদিন আমিষ পাওয়া গেলেও বাকিদিনগুলিতে নিরামিষ আহার পাওয়া যেত, দাম ছিল দশ টাকা। মাঝে মধ্যে আমি আর আমার এক বন্ধু তন্দুর রুটি, ডিমের ওমলেট আর পাহালের রসগোলা কিনে আনতাম রাত্রের খাওয়ার জন্যে। কয়েক বৎসর পূর্বে ঊড়িষ্যা আর বাংলার মধ্যে রসগোল্লার মধ্যে G.I. tag (Geographical Indications tag) নিয়ে একটি লড়াই চলেছিল। বাংলা বলল, ছানা, সুজি, আর চিনির রস উপকরণগুলির সাহায্যে ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে নবীন চন্দ্র দাস রসগোল্লা প্রথম প্রস্তুত করেন। অপরপক্ষে, ঊড়িষ্যা রসগোলার উৎপত্তি বলতে এগারোশো শতাব্দীর কথা উল্লেখ করল, পঞ্চদশ শতকের কবি বলরাম দাসের লেখায় রসগোলা-র উল্লেখ রয়েছে বলে জানালো। কথিত রয়েছে মন্দিরের পুরোহিত পাহাল গ্রামবাসীকে দুধ থেকে ছানা এবং তা দিয়ে রসগোলা সহ ভিন্নভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রস্তুত করা শেখান। আমি এই দুটি মিষ্টিই অনেকবার খেয়েছি, দুইটিই সুস্বাদু, স্বাদ স্বতন্ত্র এবং নামে একরকমের হলেও এদের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বিদ্যমান। দু'টি রাজ্যই সঠিকভাবে তাদের দু'টি মিষ্টির জন্যে G.I. tag পেয়েছে। বাংলার রসগোল্লা যেমন সাদা বর্ণের হয়, ঊড়িষ্যার রসগোলা হয় হালকা বাদামি বর্ণের। বাংলার রসগোল্লা স্পঞ্জি হয়, ঊড়িষ্যার রসগোলা হয় নরম, ভাঙলে আপনি নরম অংশটি দেখতে পারবেন এবং অনুভব করতে পারবেন, রসগোলাটি স্পঞ্জি নয়। স্বাদের দিক থেকেও পার্থক্য স্পষ্ট বোঝা যায়, বাংলার রসগোল্লা ঊড়িষ্যার রসগোলার থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক মিষ্টি হয়। যাঁরা ঊড়িষ্যায় বেড়াতে যাবেন তাঁরা পাহালের রসগোলা খেয়ে দেখলে সঠিকভাবে বুঝতে সমর্থ হবেন। তবে বাংলায় যেমন রসগোল্লা বাংলার খাদ্যের একটি অন্যতম প্রতীক বলে বিবেচিত হয়, ঊড়িষ্যায় কিন্তু রসগোলা সেরূপ নয় বরং ছানা পোড়া বা 'ছেনা পুড়ো' তুলনামূলক একটি অনেক প্রসিদ্ধ মিষ্টি। এর ইতিহাস কিন্তু অধিক প্রাচীন নয়, বিংশ শতাব্দীতে এটি আবিষ্কৃত হয়। ছানাকে, চিনি, দারুচিনি গুঁড়ো, সুজি সহযোগে শাল বা কলাপাতায় বেঁধে কয়লার উনুনে ৩ থেকে ৪ ঘন্টায় ছানা পোড়া প্রস্তুত হয়। আমি একাধিকবার পুরীতে বেড়াতে গিয়ে এর স্বাদ গ্রহণ করেছি তবে বেরহামপুরে তা কখনও খেয়েছি বলে মনে পরে না।     

বেরহামপুরের মানুষের মাতৃভাষা ওড়িয়া, তবে সেখানে অনেক তেলুগুভাষী মানুষও বাস করেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন সম্প্রদায়, ভাষার মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহজেই একে ওপরের বন্ধু পরিজন হয়ে ওঠেন আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সহপাঠীদের বাড়ির অনুষ্ঠানে, পাড়ার কোনো বাড়ির অনুষ্ঠানে তাঁরা আমাদের নিমন্ত্রণ করতেন। একাধিক অনুষ্ঠান বাড়িতে আমি গিয়েছি, বেশিরভাগই বিয়ে বাড়ি। এখানে বিয়ে বাঙালিদের মতন রাত্রে হয়না, দিনের বেলায় হয়, অনেকক্ষেত্রে আবার মন্দিরে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, বিয়েতে নিরামিষ আহার-ই হয়ে থাকে। আমি স্থানীয় বন্ধুদের থেকে শুনেছি বামুন ঠাকুর রাঁধেন অনুষ্ঠান বাড়িতে। এখানে দু'টি পদের কথা উল্লেখ করি, একটি হলো নবরত্ন কোর্মা, অপরটি 'দই- বাইগনা' (দই-বেগুন), এই দু'টি পদ-ই প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানের আহারে থাকে। নবরত্ন কোর্মা অত্যন্ত সুস্বাদু একটি পদ, আমি অনেক রেস্তোরাঁতে এই পদটি দেখেছি। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য পদের মধ্যে রয়েছে দই-ভেন্ডি (দই-ঢ্যাঁড়শ), 'খাজুরি-খাট্টা' (খেজুর, টম্যাটো দিয়ে একটি টক মিষ্টি পদ), 'আম্ব খাট্টা' (আমের টক) ইত্যাদি। এর পর আসি ওপর একটি পদের বিবরণে, এর নাম 'ডালমা'। ডাল, প্রধানত অড়হর বা তুরের ডালে বিভিন্ন প্রকার সব্জি যেমন কুমড়ো, কাঁচকলা, বেগুন, লাউ, পেঁপে ইত্যাদি ছোটছোট করে কেটে দিয়ে একসাথে রান্না করা হয়। এটি ডালমা নাম পরিচিত। এতে পাঁচ ফোড়ন ব্যবহার করা হয়। সরিষার ব্যবহার ঊড়িষ্যা রাজ্যে খুবই ব্যবহার হয়, এখানে আমি শুকনো সরিষা গুঁড়ো করে ব্যবহার করতে দেখেছি। আমি জীবনে প্রথমবার মাশরুম খেয়েছি বেরহামপুর শহরে। প্রথমদিকে আমি যে মেসটিতে থাকতাম, তার অদূরে একটি হোটেলে প্রথবার আমি এটি খেয়েছিলাম। ঊড়িষ্যায় মাশরুমকে ছাতু বলি, আমরা বাঙালিরা বলি ছাতা বা ব্যাঙের ছাতা। সরিষা দিয়ে রান্না করা মাশরুমের পদটির নাম 'ছাতু রাই'। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন শাক যেমন পালং, পুঁই, লাল, কলমি, সজনে, সরিষা, মেথি, মটর ইত্যাদি।

এবার আসি জগন্নাথ দেবের মহাপ্রসাদের বিষয়ে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে ভগবান বিষ্ণু রামেশ্বরমে স্নান সেরে, বদ্রীনাথে ধ্যান করে, দ্বারকায় বিশ্রাম নিয়ে পুরীতে আসেন আহার করতে। প্রত্যহ জগন্নাথদেবকে ৫৬ পদ দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন করতে দেওয়া হয়। আবার মকর সংক্রান্তিতে পিঠে পুলি সহযোগে এই ৫৬ পদ বেড়ে ৮৪টি পদ হয়। এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলি, ভারতবর্ষে চাষবাসের জন্যে বৃষ্টির উপর নির্ভরতা ছিল ভীষণ মাত্রায়, তখন সেচ ব্যবস্থার প্রচলন খুব বেশি ছিল না বা  এতো উন্নত হয়নি। মানুষ ইন্দ্রদেবকে বজ্রপাত, বৃষ্টি ইত্যাদির দেবতা মান্য করতেন। কোনো বৎসর যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হলে কৃষিকাজ ভালো হতো আবার বৃষ্টিপাত না হলে বা আশানুরূপ না হলে কৃষির ক্ষতি হতো এমনকি খরা পর্যন্ত হতো। সঠিক বৃষ্টিপাতের জন্যে যেমন মানুষ ইন্দ্রদেবকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে পূজা করতেন তেমনই আবার বৃষ্টিপাত না হলে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে দেবতার উদ্দেশ্যে আরাধনা করা হতো। তা এমনই এক বৎসর বৃন্দাবনে খুব ভালো বৃষ্টিপাত হলো, কৃষিকাজ বেশ হলো, ঘরে ঘরে ফসল উঠলো, সকল ব্রজবাসীর মুখে হাসি ফুটলো। সকলে ঠিক করলেন যে ইন্দ্রদেবকে ধন্যবাদ দেবেন, তাঁকে পুজো করবেন, শুরু হলো ঘরবাড়ি পরিস্কার, গ্রাম সাজানো, সুস্বাদু সব খাবার প্রস্তুত ইত্যাদি। গ্রামের ছোট বালক কৃষ্ণ এসকল প্রতক্ষ্য করে বললো, 'এ বৃষ্টির জন্যে তোমার কেন ইন্দ্র দেবতাকে পুজো করছ? আকাশের মেঘ তো গোবর্ধন পর্বতের ঢালে প্রতিহত হয়ে এই স্থানে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে। কাজেই গোবর্ধন পর্বতের পুজো করা উচিত'। সকলে কৃষ্ণের বিদগ্ধতা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, তবু যেন একটু ভীত হলেন, কিন্তু অবশেষে মেনে নিলেন। গোবর্ধন পর্বতের পুজো শুরু হলো। এদিকে এসকল দেখে ইন্দ্রদেব তো খুব ক্রুদ্ধ হলেন, বৃন্দাবনে ভয়ানক বৃষ্টিপাত শুরু হলো, ঘরবাড়ি ডুবে গেলো, চাষের জমি ডুবে গেলো। ভীত সন্ত্রস্ত ব্রজবাসী এবার কি করেন, তাঁরা কৃষ্ণের সমীপে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ বললো তাঁরা যখন গোবর্ধন পর্বতের পুজো করার কথা ভেবেছেন তিনিই তাঁদের রক্ষা করবেন। বালক কৃষ্ণ সকল ব্রজবাসীকে নিয়ে গোবর্ধন পর্বতের সামনে উপস্থিত হলো, পর্বতকে উঠিয়ে একটি মাত্র আঙুলের সাহায্যে  ধরে রাখলো, সকল ব্রজবাসী পর্বতের তলায় আশ্রয় নিলেন। কৃষ্ণ এক নাগাড়ে পর্বতকে তুলে রেখেছেন দেখে ব্রজবাসী তাঁকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করলেন, ভাবলেন কৃষ্ণের বিশ্রামের সময় নিজেরা সেই পর্বতকে অনেকগুলি লাঠির সাহায্যে তুলে রাখবেন। কৃষ্ণ তাঁর আঙ্গুল একটু সরাতেই সব লাঠি ভেঙে গেল, পর্বত ভূমিতে আবার বসে যেতে লাগলো। কৃষ্ণ স্বয়ং পুনরায় পর্বতকে ধারণ করলেন। এদিকে কিন্তু ইন্দ্রদেবের ক্রোধ কিছুতেই কমে না, ক্রোধ সর্বদা চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দেয়, এক্ষেত্রেও তাই হলো, তিনি বজ্রপাত করলেন, বৃষ্টির ধারা আরও বৃদ্ধি করলেন, সাতদিন নাগাড়ে চললো এই অবস্থা কিন্তু বুঝতে পারলেন না কোনো সাধারণ বালকের পক্ষে বিশালাকায় এই পর্বতের ভার বহন শুধুমাত্র অসম্ভব নয়, এ কার্য কল্পনারও অতীত। শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করে গেলেন সমগ্র ব্রজবাসীকে। পরিশেষে হার মানলেন ইন্দ্রদেব, বুঝতে পারলেন এই বালক এই বিশাল পর্বত একটি হাতে তুলে রেখেছেন, তিনি স্বয়ং বিষ্ণু, ভুল বুঝতে পেরে নিজের অন্যায় স্বীকার করলেন। এই সাতদিন স্বয়ং ভগবান কোনো খাদ্যগ্রহণ করেননি।  তাই প্রতিদিন তিন ঘন্টা অন্তর আটবার (৩ ঘন্টা  x ৮ বার (বা প্রহর) = ২৪ ঘন্টায় এক দিন), এবং সাতদিন প্রতিদিন আটবার করে মোট ৫৬ বার ভগবান বিষ্ণু যে খাদ্যগ্রহণ করেননি, সেই কারণে এই ৫৬ রকমের ভোগ প্রস্তুত করার প্রচলন হয়। 

ঊড়িষ্যা রাজ্যে অনেক মন্দির রয়েছে যেখানে ভগবানের উদ্দেশ্যে যে ভোগ অর্পণ করা হয় মানুষ তাকে মহাপ্রসাদ বলে গ্রহণ করেন। এই ভোগের অপূর্ব স্বাদ বর্ণনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু যে এই স্থানের তা নয়, যে কোনো স্থানের ভগবানের উদ্দেশ্যে অর্পিত ভোগের খিচুড়ির স্বাদ আমার কাছে বাড়িতে বা দোকানে প্রস্তুত খিচুড়ির থেকে অধিক সুস্বাদু লাগে, তবে এর বৈজ্ঞানিক কারণ নিরূপণে বা বিশ্লেষণে আমি কখনও উৎসাহিত হইনি। ঊড়িষ্যা রাজ্যের বেশ কয়েকটি মন্দিরে ভোগের ক্ষেত্রে দেখেছি সেখানে পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা, ইত্যাদি যে সকল সব্জি বিদেশ থেকে আগত সেগুলির ব্যবহার হয় না। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অনেক হিন্দু সনাতন ধর্মের মানুষ পেঁয়াজ, রসুন খান না। আসলে টম্যাটো, আলু, লঙ্কা সহ বর্তমানে যে সকল সব্জি আমরা ব্যবহার করি তার মধ্যে অনেকগুলিই কিন্তু পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে পশ্চিমী বিদেশী বণিকদের মাধ্যমে আমাদের দেশে পৌঁছয়। মন্দিরগুলিতে ভোগ নিবেদনের রীতি এই সকল শাকসব্জির ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব থেকেই প্রচলিত। ভারতীয় রান্নাতে তাদের ব্যবহার প্রায় অপিহার্য হয়ে উঠলেও অনেক মন্দিরে এ সকল উপকরণ আজও অব্যবহৃত (অনুগ্রহ করে পড়ুন ভারতীয় রান্নার একটি গল্প)। এই মন্দিরগুলির ভোগে ব্যবহৃত শাকসব্জি থেকে আমরা সহজেই আমাদের খাদ্যরীতির একটি ধারণা করতে পারি। 

একটি কথা পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এখানে আমি ঊড়িষ্যা রাজ্যের আমার পরিচিত কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদের কথা বিবরণ করেছি। এছাড়াও অনেক পদ সেখানে অবশ্যই রয়েছে, অন্যান্য ভারতীয় পদগুলির পাশাপাশি মোগলাই, চাইনিজ, পশ্চিমী (পিজা-বার্গার ইত্যাদি) সকলই সহজেই পাওয়া যায়। তবে যতদূর মনে পরে, সেই সময়ে আমার কোনো পিজা বা বার্গারের দোকান স্মৃতিতে আসছে না।। যেহেতু সেই সময়ে আমি মাংস খেতাম না তাই সেই ধরণের কোনো খাবারের স্বাদ আমি পাইনি, তাই তার জন্যে উল্লেখ করিনি। বেরহামপুর তথা ঊড়িষ্যায় অনেক আদিবাসী মানুষ বসবাস করেন, দৈনিক বাজারে, রাস্তায় আমি তাঁদের দেখেছি, কথা বলেছি, একসাথে বাসে চড়ে যাতায়াত করেছি। তবে তাঁদের খাদ্যরীতির বিষয়ে আমার কোনো গবেষণার বা পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়নি, কোনো সুযোগ পেলে অবশ্যই আমি তা জানার চেষ্টা করবো। আশা করি, যাঁরা ওই রাজ্যে কর্মসূত্রে বা পর্যটনের উদ্দেশ্যে যাবেন তাঁরা নিশ্চয় ওই স্থানের খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ করবেন। 

প্রদত্ত চিত্রখানি আমাদের বাড়ির পান্তা ভাত, তবে আমরা খাওয়ার পূর্বে পান্তার সাথে ডাল মেখেছিলাম আর টক দই ব্যবহার করিনি। পাখালা ভাতের সাথে এর সাদৃশ্য থাকলেও এটি প্রকৃত পাখালা নয়। 

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...