সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
রাজমহল: পর্ব-১ -র পর-
ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের জানলা বাষ্পে পূর্ণ, কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, অবশেষে জানলা খুলে কুচকাওয়াজ দেখছিলাম। তারপর প্রস্তুত হয়ে আমরা আমরা বেরোলাম স্থানীয় বিভিন্ন দ্রষ্টব্যস্থান গুলির উদ্দেশ্যে। গতকাল ছিল ঐতিহাসিক ভ্রমণ, আর আজ আমরা সাক্ষী থাকবো প্রাগৈতিহাসিক কালের কিছু নিদর্শনের।
আজকে আমাদের প্রধান দ্রষ্টব্য সাহিবগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৫৫-৬০ কিলোমিটার দূরত্বে মান্দ্রতে অবস্থিত জীবাশ্ম উদ্যান [বোলপুর শান্তিনিকেতন ভ্রমণের সময় আমরা আমখই গ্রামে অবস্থিত ওপর একটি জীবাশ্ম উদ্যান দেখেছিলাম।]। সকাল ৯ টা নাগাদ আমরা রওনা হলাম, পথেই প্রাতঃরাশ সারব। কিছুক্ষন গিয়ে শহরের কিছুটা বাইরে পথের ধারে একটি দোকানে দাঁড়ালাম। দোকানি চা, তেলেভাজা, মুড়ি, ছোলাভাজা, আরো হরেক ধরণের খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় করছেন। আমাদের ফরমায়েশ মতন কারও দুধ দেওয়া চিনি ছাড়া চা, কারও দুধ চিনি ছাড়া চা, আবার কারও দুধ চিনি দেওয়া চা বানিয়ে পরিবেশন করলেন। আজকাল শহুরে মানুষরা মধুমেহ (ডায়াবেটিস), হার্টের নানান সমস্যায় জর্জরিত। গ্রামের দোকানিও সম্ভবত তা জানেন, তিনি দেখলাম মনের আনন্দেই খাবার পরিবেশন করলেন, কারও শুধু মুড়ি, কারও মশলা-মুড়ি, কারও বা নানা স্বাদের বিস্কুট ইত্যাদি। চা যে কি সুস্বাদু, তা বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে কাপগুলি অত্যন্ত ছোট ছোট, কাজেই দুই-তিনবার করে সকলে চা নিলেন। আমি আমাদের দেশের মতন অন্য কোথাও এতো ছোট চায়ের কাপ বা খুড়ি দেখিনি (বড়ো পাওয়া যায়, তবে ছোটোগুলির চলই বেশি), কেন যে সেগুলি এতো ছোট হয় তা আমি জানিনা। যাইহোক, প্রাতঃরাশ সারা হলো। এই দোকানটির পাশেই একটা মিষ্টির দোকান ছিল, সেখান থেকে রসগোল্লা কিনে নেওয়া হলো, এবার আমরা আবার রওনা হলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
মান্দ্রো ফসিল মিউজিয়ামটি প্রাচীন উদ্ভিদ জীবনের উপর গবেষণা প্রচারের এবং জনসাধারণের সচেতনতাবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে পাওয়া জীবাশ্মগুলি প্রায় ৬৮ থেকে ১৪৫ মিলিয়ন বছর পুরানো জুরাসিক এবং ক্রিটেসিয়াস যুগের। অর্থাৎ যখন পৃথিবীতে ডাইনোসর ঘুরে বেড়াতো এই জীবাশ্মগুলি সেই সময়কার।
জাদুঘরটি শুধুমাত্র একটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেই কাজ করে না বরং ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভিদ জীবনের বিবর্তন অধ্যয়নরত জীবাশ্মবিদ এবং ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণা কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। প্রদর্শনীগুলি এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস এবং প্যালিওবোটানির বিশ্বব্যাপী জ্ঞানে অবদান রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা বলাই বাহুল্য।
যে সকল বিজ্ঞানী এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের পরিচয় রয়েছে।
মান্দ্রোর ফসিল মিউজিয়ামে বেশ কিছু প্রদর্শনী রয়েছে যা রাজমহল পাহাড়ের অনন্য প্যালিওবোটানিকাল ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। মূল প্রদর্শনীর অন্তর্ভুক্ত:
জীবাশ্মকৃত উদ্ভিদের নমুনা: যাদুঘরটি বিলুপ্ত ফার্ন, সাইক্যাড এবং কনিফারের জীবাশ্মাবশেষ সহ উদ্ভিদের জীবাশ্মের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহালয়। এই নমুনাগুলি লক্ষ লক্ষ বছর আগে বিদ্যমান উদ্ভিদের প্রকারের বিষয়ে ধারণা প্রদান করে।
পেট্রিফাইড কাঠ: যাদুঘরের প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে একটি হল এর পেট্রিফাইড কাঠের সংগ্রহ, যেখানে প্রাচীন গাছগুলি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে খনিজকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাথরে পরিণত হয়েছে। এই নমুনাগুলি গাছের গুঁড়ির বিশদ গঠন প্রদর্শন করে, যার মধ্যে বৃদ্ধির রিং এবং বাকলের ধরণ রয়েছে।
পাতার ছাপ এবং বীজের জীবাশ্ম: জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের পাতার ছাপ এবং বীজের জীবাশ্ম রয়েছে, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগের জলবায়ু পরিস্থিতি এবং উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের মূল সূচক। এই জীবাশ্মগুলি বিজ্ঞানীদের সময়ের সাথে উদ্ভিদ প্রজাতির বিবর্তন অধ্যয়ন করতে সহায়তা করে।
ভূতাত্ত্বিক এবং প্যালিওবোটানিকাল ডিসপ্লে: জাদুঘরে রাজমহল পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস, জীবাশ্মায়নের প্রক্রিয়া এবং এই অঞ্চলে পাওয়া জীবাশ্মের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বিস্তারিত প্রদর্শন রয়েছে। তথ্য প্যানেল এবং চার্ট দর্শকদের এই অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশের বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করে।
সমগ্র উদ্যানটির পরিধি বৃহৎ, আমি প্রথমে হেঁটে হেঁটে ঘুরবো ঠিক করলেও সকলের পরামর্শে আমরা ব্যাটারিচালিত গাড়ি রিসার্ভ করে ঘুরেছিলাম, এতে ঠিকভাবে সমগ্র উদ্যানটি ঘোরা যায়, অন্যথায় অনাবশ্যক অধিক সময় ব্যয় হতে পারে। উদ্যানটি ঘুরে আমাদের বেরোতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিলো। প্রায় ২ টো নাগাদ আমরা নিকটবর্তী একটি বাজারে এক ভাতের হোটেলে এসে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। সত্যি বলতে এই অঞ্চলের রান্নার স্বাদ আমাদের খুবই ভালো লেগেছিলো।
এবার আমাদের গন্তব্য শিবগাদি ধাম, যা প্রায় এখন থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে বোরহেট নামক স্থানে অবস্থিত।
এখানে রয়েছেন ভগবান শিব, শ্রাবণ মাসে এই ধামে খুব ভক্তসমাগম হয়ে থাকে। শিবগাদি ধাম দর্শন করে আমাদের বেরোতে বেরোতে বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা উপস্থিত হলো। আসলে শীতকালের বিকেল খুবই ক্ষণস্থায়ী। আমরা এবার যাবো বিন্দুবাসিনী মন্দির দর্শন করতে। সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে, আমি ভেবেছিলাম গতকাল আমরা মতি ঝর্ণা যখন পৌঁছেছিলাম তখন বেলা গড়িয়ে গিয়েছিলো, তাই আজকে আবার সেই স্থান দেখে আসবো। কিন্তু বিন্দুবাসিনী মন্দির দর্শন করে তা আর সম্ভব হলো না। সন্ধ্যা ৭ টার সময় আমরা যখন ফিরছিলাম তখন ঘড়ি না দেখলে অনায়াসে মধ্যরাত বলে মনে হতে পারে, রাস্তাঘাট এতোটাই শুনশান, আর অন্ধকার, গাড়ির হেড লাইটই একমাত্র ভরসা। এমন সময় গাড়ি একটি রেল গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো, সামনে মালট্রেন, কাজেই মালট্রেন না সরলে আমরা আর এগোতে পারবো না। আমি ড্রাইভার দাদা কে জিজ্ঞেস করলাম, অন্য পথ রয়েছে কিনা কারণ মালট্রেন যে কখন সরবে তা অজানা। উনি বললেন রাস্তা একখানা রয়েছে তবে তা অনেক কিলোমিটার ঘুরে, আমরা বিচলিত হলেও তিনি মোটেই চিন্তিত নন। ক্রমাগত হর্ন বাজাতে লাগলেন। আমরা তো অবাক, হর্ন বাজিয়ে রাস্তায় অন্য গাড়ীকে জায়গা দেওয়ার কথা বলা গেলেও এ যে মালট্রেন, সামান্য গাড়ীর হর্নে সে সরবে কেন ! আমাদের অবাক করে দিয়ে দেখলাম মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর মালট্রেনটি ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে চলতে শুরু করলো, কিছুটা সরে গিয়ে সে আমাদের যাওয়ার পথ করে দিলো। আমরা অবাক হয়ে গেলাম, ড্রাইভার দাদা বললেন, এ অঞ্চলে এটাই রীতি। এই অভিজ্ঞতা আমাদের প্রথম।
এবার হোটেলে ফিরে রাত্রিকালীন আহার সেরে আজকের মতন বিশ্রাম।
পরদিন,
সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো। স্নান সেরে এবার আমরা রওনা হবো মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। তবে বাকি থেকে গেলো অনেক স্থান, আবার আসবো কখনও। যথা সময়ে গাড়ি এসে পৌঁছলো। পথে প্রাতঃরাশ সারলাম, চা, বিস্কুট, মিষ্টি, মুড়ি-তেলেভাজা নানান কিছু সহযোগে। প্রজাতন্ত্র দিবসের এবং সপ্তাহান্তের ছুটির কারণে মুর্শিদাবাদে হোটেল রিসার্ভ করা বেশ মুশকিল হয়ে গিয়েছিলো, তবে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়েছিল। এবার মুর্শিদাবাদের কাহিনী (অনুগ্রহ করে পড়ুন মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ, মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের পরবর্তী পর্ব) [মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের এই কাহিনী কিন্তু এইবারের নয়, পূর্বের, তবে আশা করি পাঠক-পাঠিকার ভালো লাগবে। ]
জানুয়ারী, ২০২৪


















