পৃষ্ঠাসমূহ

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh) 

রাজমহল: পর্ব-১ -র পর-

ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের জানলা বাষ্পে পূর্ণ, কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, অবশেষে জানলা খুলে কুচকাওয়াজ দেখছিলাম। তারপর প্রস্তুত হয়ে আমরা আমরা বেরোলাম স্থানীয় বিভিন্ন দ্রষ্টব্যস্থান গুলির উদ্দেশ্যে। গতকাল ছিল ঐতিহাসিক ভ্রমণ, আর আজ আমরা সাক্ষী থাকবো প্রাগৈতিহাসিক কালের কিছু নিদর্শনের। 

আজকে আমাদের প্রধান দ্রষ্টব্য সাহিবগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৫৫-৬০ কিলোমিটার দূরত্বে মান্দ্রতে অবস্থিত জীবাশ্ম উদ্যান [বোলপুর শান্তিনিকেতন ভ্রমণের সময় আমরা আমখই গ্রামে অবস্থিত ওপর একটি জীবাশ্ম উদ্যান দেখেছিলাম।]। সকাল ৯ টা নাগাদ আমরা রওনা হলাম, পথেই প্রাতঃরাশ সারব। কিছুক্ষন গিয়ে শহরের কিছুটা বাইরে পথের ধারে একটি দোকানে দাঁড়ালাম। দোকানি চা, তেলেভাজা, মুড়ি, ছোলাভাজা, আরো হরেক ধরণের খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় করছেন। আমাদের ফরমায়েশ মতন কারও দুধ দেওয়া চিনি ছাড়া চা, কারও দুধ চিনি ছাড়া চা, আবার কারও দুধ চিনি দেওয়া চা বানিয়ে পরিবেশন করলেন। আজকাল শহুরে মানুষরা মধুমেহ (ডায়াবেটিস), হার্টের নানান সমস্যায় জর্জরিত। গ্রামের দোকানিও সম্ভবত তা জানেন, তিনি দেখলাম মনের আনন্দেই খাবার পরিবেশন করলেন, কারও শুধু মুড়ি, কারও মশলা-মুড়ি, কারও বা নানা স্বাদের বিস্কুট ইত্যাদি। চা যে কি সুস্বাদু, তা বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে কাপগুলি অত্যন্ত ছোট ছোট, কাজেই দুই-তিনবার করে সকলে চা নিলেন। আমি আমাদের দেশের মতন অন্য কোথাও এতো ছোট চায়ের কাপ বা খুড়ি দেখিনি (বড়ো পাওয়া যায়, তবে ছোটোগুলির চলই বেশি), কেন যে সেগুলি এতো ছোট হয় তা আমি জানিনা। যাইহোক, প্রাতঃরাশ সারা হলো। এই দোকানটির পাশেই একটা মিষ্টির দোকান ছিল, সেখান থেকে রসগোল্লা কিনে নেওয়া হলো, এবার আমরা আবার রওনা হলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। 

মান্দ্রো ফসিল মিউজিয়ামটি প্রাচীন উদ্ভিদ জীবনের উপর গবেষণা প্রচারের এবং জনসাধারণের সচেতনতাবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে পাওয়া জীবাশ্মগুলি প্রায় ৬৮ থেকে ১৪৫ মিলিয়ন বছর পুরানো জুরাসিক এবং ক্রিটেসিয়াস যুগের। অর্থাৎ যখন পৃথিবীতে ডাইনোসর ঘুরে বেড়াতো এই জীবাশ্মগুলি সেই সময়কার। 

জাদুঘরটি শুধুমাত্র একটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেই কাজ করে না বরং ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভিদ জীবনের বিবর্তন অধ্যয়নরত জীবাশ্মবিদ এবং ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণা কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। প্রদর্শনীগুলি এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস এবং প্যালিওবোটানির বিশ্বব্যাপী জ্ঞানে অবদান রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা বলাই বাহুল্য।

যে সকল বিজ্ঞানী এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের পরিচয় রয়েছে।

মান্দ্রোর ফসিল মিউজিয়ামে বেশ কিছু প্রদর্শনী রয়েছে যা রাজমহল পাহাড়ের অনন্য প্যালিওবোটানিকাল ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। মূল প্রদর্শনীর অন্তর্ভুক্ত:

জীবাশ্মকৃত উদ্ভিদের নমুনা: যাদুঘরটি বিলুপ্ত ফার্ন, সাইক্যাড এবং কনিফারের জীবাশ্মাবশেষ সহ উদ্ভিদের জীবাশ্মের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহালয়।   এই নমুনাগুলি লক্ষ লক্ষ বছর আগে বিদ্যমান উদ্ভিদের প্রকারের বিষয়ে ধারণা প্রদান করে।

পেট্রিফাইড কাঠ: যাদুঘরের প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে একটি হল এর পেট্রিফাইড কাঠের সংগ্রহ, যেখানে প্রাচীন গাছগুলি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে খনিজকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাথরে পরিণত হয়েছে। এই নমুনাগুলি গাছের গুঁড়ির বিশদ গঠন প্রদর্শন করে, যার মধ্যে বৃদ্ধির রিং এবং বাকলের ধরণ রয়েছে।

পাতার ছাপ এবং বীজের জীবাশ্ম: জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের পাতার ছাপ এবং বীজের জীবাশ্ম রয়েছে, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগের জলবায়ু পরিস্থিতি এবং উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের মূল সূচক। এই জীবাশ্মগুলি বিজ্ঞানীদের সময়ের সাথে উদ্ভিদ প্রজাতির বিবর্তন অধ্যয়ন করতে সহায়তা করে।

ভূতাত্ত্বিক এবং প্যালিওবোটানিকাল ডিসপ্লে: জাদুঘরে রাজমহল পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস, জীবাশ্মায়নের প্রক্রিয়া এবং এই অঞ্চলে পাওয়া জীবাশ্মের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বিস্তারিত প্রদর্শন রয়েছে। তথ্য প্যানেল এবং চার্ট দর্শকদের এই অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশের বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করে।  

সমগ্র উদ্যানটির পরিধি বৃহৎ, আমি প্রথমে হেঁটে হেঁটে ঘুরবো ঠিক করলেও সকলের পরামর্শে আমরা ব্যাটারিচালিত গাড়ি রিসার্ভ করে ঘুরেছিলাম, এতে ঠিকভাবে সমগ্র উদ্যানটি ঘোরা যায়, অন্যথায় অনাবশ্যক অধিক সময় ব্যয় হতে পারে। উদ্যানটি ঘুরে আমাদের বেরোতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিলো। প্রায় ২ টো নাগাদ আমরা নিকটবর্তী একটি বাজারে এক ভাতের হোটেলে এসে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। সত্যি বলতে এই অঞ্চলের রান্নার স্বাদ আমাদের খুবই ভালো লেগেছিলো। 

এবার আমাদের গন্তব্য শিবগাদি ধাম, যা প্রায় এখন থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে বোরহেট নামক স্থানে অবস্থিত। 

এখানে রয়েছেন ভগবান শিব, শ্রাবণ মাসে এই ধামে খুব ভক্তসমাগম হয়ে থাকে। শিবগাদি ধাম দর্শন করে আমাদের বেরোতে বেরোতে বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা উপস্থিত হলো।  আসলে শীতকালের বিকেল খুবই ক্ষণস্থায়ী। আমরা এবার যাবো বিন্দুবাসিনী মন্দির দর্শন করতে। সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে, আমি ভেবেছিলাম গতকাল আমরা মতি ঝর্ণা যখন পৌঁছেছিলাম তখন বেলা গড়িয়ে গিয়েছিলো, তাই আজকে আবার সেই স্থান দেখে আসবো।  কিন্তু বিন্দুবাসিনী মন্দির দর্শন করে তা আর সম্ভব হলো না। সন্ধ্যা ৭ টার সময় আমরা যখন ফিরছিলাম তখন ঘড়ি না দেখলে অনায়াসে মধ্যরাত বলে মনে হতে পারে, রাস্তাঘাট এতোটাই শুনশান, আর অন্ধকার, গাড়ির হেড লাইটই একমাত্র ভরসা। এমন সময় গাড়ি একটি রেল গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো, সামনে মালট্রেন, কাজেই মালট্রেন না সরলে আমরা আর এগোতে পারবো না। আমি ড্রাইভার দাদা কে জিজ্ঞেস করলাম, অন্য পথ রয়েছে কিনা কারণ মালট্রেন যে কখন সরবে তা অজানা। উনি বললেন রাস্তা একখানা রয়েছে তবে তা অনেক কিলোমিটার ঘুরে, আমরা বিচলিত হলেও তিনি মোটেই চিন্তিত নন। ক্রমাগত হর্ন বাজাতে লাগলেন। আমরা তো অবাক, হর্ন বাজিয়ে রাস্তায় অন্য গাড়ীকে জায়গা দেওয়ার কথা বলা গেলেও এ যে মালট্রেন, সামান্য গাড়ীর হর্নে সে সরবে কেন ! আমাদের অবাক করে দিয়ে দেখলাম মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর মালট্রেনটি ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে চলতে শুরু করলো, কিছুটা সরে গিয়ে সে আমাদের যাওয়ার পথ করে দিলো। আমরা অবাক হয়ে গেলাম, ড্রাইভার দাদা বললেন, এ অঞ্চলে এটাই রীতি। এই অভিজ্ঞতা আমাদের প্রথম।  

এবার হোটেলে ফিরে রাত্রিকালীন আহার সেরে আজকের মতন বিশ্রাম। 

পরদিন, 

সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো। স্নান সেরে এবার আমরা রওনা হবো মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। তবে বাকি থেকে গেলো অনেক স্থান, আবার আসবো কখনও। যথা সময়ে গাড়ি এসে পৌঁছলো। পথে প্রাতঃরাশ সারলাম, চা, বিস্কুট, মিষ্টি, মুড়ি-তেলেভাজা নানান কিছু সহযোগে। প্রজাতন্ত্র দিবসের এবং সপ্তাহান্তের ছুটির কারণে মুর্শিদাবাদে হোটেল রিসার্ভ করা বেশ মুশকিল হয়ে গিয়েছিলো, তবে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়েছিল। এবার মুর্শিদাবাদের কাহিনী (অনুগ্রহ করে পড়ুন মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ, মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের পরবর্তী পর্ব) [মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের এই কাহিনী কিন্তু এইবারের নয়, পূর্বের, তবে আশা করি পাঠক-পাঠিকার ভালো লাগবে। ] 

জানুয়ারী, ২০২৪

রাজমহল: পর্ব-১ (Rajmahal: Part-1)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh) 



মালদার নিকট মানিকচক ঘাট থেকে ভেসেলে গঙ্গা পার হয়ে আমরা পৌঁছলাম রাজমহল ঘাটে, তখন প্রায় ১'টা বাজে। মালদা ভ্রমণের পর এবার আমরা রাজমহল ঘুরব। ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাহিবগঞ্জ জেলায় রাজমহল অবস্থিত, যা একদা মাল-পাহাড়িয়া উপজাতির গোষ্ঠী মাল রাজা শাসন করতেন। সকালে হোটেল থেকে প্রাতঃরাশ সেরেই বেরিয়েছিলাম আমরা। ঘাটের কাছেই একটি হোটেলে গরম গরম ভাত, ধোঁয়া ওঠা ডাল, ভাজা, সব্জি সহযোগে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। এবার রাজমহল ঘুরে দেখা। এখান থেকেই সম্রাট আকবরের বাংলা দখল, কালাপাহাড়ের প্রবল পরাক্রম সত্ত্বেও বিফল হওয়া, আবার এই রাজমহলের পাহাড়েই পাহাড়িয়া, মাঝ-পাহাড়িয়াদের বাস, প্রণম্য তিলক মাঝির জন্ম, তাঁর দূরদৃষ্টি - কত ইতিহাস এই স্থানকে ঘিরে। দুপুরের খাওয়া সারতে সারতে একবার অতীতের নগরী রাজমহলের ইতিহাস সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক, তাহলে ঘুরতে সুবিধা হবে। 

[এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণকাহিনী (গবেষণাধর্মী বা গবেষণা নির্ভর ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়) যার অন্যতম উপাদান স্থানীয় গাইডদের  বা মানুষের প্রদত্ত তথ্য, সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান, প্রচলিত লোককথা, বিশ্বাস ইত্যাদি। তবে আমি স্থানগুলিতে যে ফলকগুলি রয়েছে তার চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছি, সেগুলি থেকে পাঠক-পাঠিকা তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন।]

হুসেন শাহী বংশের শেষ সুলতান ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ [অনুগ্রহ করে পড়ুন মালদা: পর্ব-২ এবং মালদা: পর্ব-১]। মোঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বাদশাহ হুমায়ুন গৌড় দখল করেছিলেন কিন্তু তা অতি স্বল্প সময়ের জন্যে।  হুমায়ুন চৌসার যুদ্ধে শের শাহ সুরি-র নিকট পরাজিত হলে দিল্লী তথা বাংলা শের শাহ সুরি-র অধীনে আসে। এরপর সুরি বংশের অবসান হলে বাংলায় মহম্মদ শাহ বংশ (১৫৫৪-১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং এর অবসানে কারনানি বংশের (১৫৬৪ -১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ) সূচনা হয়। এই কারনানি বংশের শেষ সুলতান ছিলেন দাউদ খান কারনানি। এই সময় বাংলা জয়ের জন্যে সম্রাট আকবর সেনাপতি মুনিম খানকে প্রেরণ করেন, টুকরোই-এর যুদ্ধে তিনি দাউদ খান-কে পরাজিত করেন এবং তাঁর কাছ থেকে বাংলা, আর বিহার অধিকার করেন। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কারণ বাংলার বারো ভূইঁয়াদের অন্যতম ঈশা খান মোঘলদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। এদিকে, আকবরের সেনাপতি মুনিম খানের মৃত্যুর পর দাউদ খান পুনরায় বাংলা দখল করতে সচেষ্টা হন।  

অবশেষে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি, রাজা মান সিং, ওড়িশা জয়ের পর প্রথম রাজমহলে আসেন এবং ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে সুবে বাংলার রাজধানী হিসাবে রাজমহল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার রাজধানী মালদা থেকে রাজমহলে স্থানান্তরিত হলো, এই স্থানান্তর ছিল অনেকটা কৌশলগত, কারণ এটি গঙ্গার তীরে এবং এখান থেকে  বিহার ও বাংলা উভয় স্থানেই সহজ পৌঁছনো যায় কারণ এই নগর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। মান সিংয়ের আমলে, রাজমহল একটি সমৃদ্ধ প্রশাসনিক ও সামরিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অতীতের আগমহল, মুঘল সাম্রাজ্যের 'দামান-ই-কোহ' পরিচিত হলো নতুন নামে আকবরনগর। এখানে নির্মিত হয় প্রাসাদ, প্রশাসনিক ভবন, এবং দূর্গ। পরবর্তী মুঘল গভর্নরদের অধীনেও মসজিদ, বাগান এবং দূর্গ নির্মাণের মাধ্যমে শহরের গুরুত্ব অব্যাহত ছিল যা এখনও তার অতীত গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে। বাংলার রাজধানী হিসেবে রাজমহলের প্রাধান্য সুবাহদার ইসলাম খান দ্বারা তাঁর শাসনকালের মধ্যে (১৬০৮ থেকে ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ) রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত করা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। যদিও তখন রাজমহল একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ফাঁড়ি এবং বাণিজ্য শহর হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজমহল তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করে যখন সুবে বাংলার গভর্নর এবং সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজা কর্তৃক  রাজমহলে বাংলার রাজধানী পুনর্স্থাপিত হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীতে, রাজমহল স্থানীয় ক্ষমতার উত্থান, মারাঠা অনুপ্রবেশ এবং মুঘল সাম্রাজ্য এবং নতুন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে দ্বন্দ্বের সাথে অশান্তি এবং আনুগত্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, মুর্শিদাবাদ ক্ষমতার কেন্দ্র রূপে গিরে ওঠে, যা মুর্শিদকুলী খানের অধীনে বাংলার নতুন রাজধানী হয়ে ওঠে। ওই শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা পর্বে রাজমহলের তাৎপর্য  আরও হ্রাস পায়। বাংলা ও বিহারের অন্যান্য অংশে ব্রিটিশ প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপনের ফলে শহরটিকে একটি ছোট প্রশাসনিক ইউনিটে পরিণত করা হয়। যাইহোক, এটি একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যের স্থান হিসাবে অব্যাহত ছিল এবং এর সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্য ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

মধ্যাহ্নভোজন সারতেই আমাদের গাড়ী এসে উপস্থিত হলো। এবার আমরা এই নগরের ইতিহাসকে প্রতক্ষ্য করবো। প্রথম গন্তব্য সাঙ্গি দালান। 

সাঙ্গি দালান বা মার্বেল প্যাভিলিয়ন ঝাড়খণ্ডের রাজমহলের ঐতিহাসিক শহরের মধ্যে অবস্থিত একটি মার্জিত মুঘল যুগের কাঠামো। এই সুন্দর মণ্ডপটি মান সিং কর্তৃক বা মতান্তরে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার, যিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সময়ে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সাঙ্গি দালান নির্মাণে প্রতিসাম্য নকশার ব্যবহার করা হয়েছে - মুঘল স্থাপত্যের একটি বৈশিষ্ট্য। মণ্ডপটিতে খিলানযুক্ত একটি বড় কেন্দ্রীয় হল রয়েছে, যাতে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করতে পারে এবং বায়ুচলাচল করে। এখান থেকে গঙ্গা নদী এবং মনোরম রাজমহল পাহাড়ের একটি অপরূপ দৃশ্য উপভোগ্য। আগে এখান থেকে দাঁড়িয়ে গঙ্গায় শুশুক দেখা যেত বলে শুনেছি, জানি না এখন তাদের দেখা যায় কিনা। কাঠামোটি মুঘল আভিজাতদের জন্য একটি আনন্দ মণ্ডপ বা অভ্যর্থনা হল হিসাবে ব্যবহার করা হতো বলে মনে করা হয়। আবার, সমাবেশ, আলোচনা এবং মনোরম পরিবেশ উপভোগ করার জন্যও ব্যবহৃত হতো বলে মনে করা হয়। মার্জিত নকশা এবং কৌশলগত অবস্থান থেকে বোঝা যায় যে এটি নান্দনিক এবং কার্যকরী উভয় উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল।

এই প্রাঙ্গনেই রয়েছে অপূর্ব ভাস্কর্যের কয়েকটি নিদর্শন, একটা ছোট উদ্যান। মণ্ডপের মধ্যে দেখলাম ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল শতরঞ্চি বিছিয়ে আঁকছে। অনেক মানুষ উদ্যানটিতে বেড়াতে এসেছেন। 'ঝাড়ো কে দেশ' ('ঝাড়' শব্দটির অর্থ জঙ্গল, অর্থাৎ জঙ্গলের দেশ) এই ঝাড়খন্ড। অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় যথা সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, সাওরিয়া পাহাড়িয়া, বিরহর, করওয়া, মাহলি, কারমালি ইত্যাদি। জীবনধারণের উদ্দেশ্যে কোনো সম্প্রদায় চাষাবাদ করেন, আবার কোনো সম্প্রদায় কারিগরী শিল্পে নিপুণ। চাষাবাদ আবার প্রধানত দুই ধরণের, যেমন সেটলড কৃষিকাজ আবার কোথাও কোথাও ঝুমচাষ হয়ে থাকে।  

ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে মুঘল আমলে রাজা মান সিং কর্তৃক নির্মিত আকবরী দূর্গটি রাজমহলের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নিদর্শন,আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য। রাজমহল যখন সুবে (সুবাহ) বাংলার রাজধানী ছিল সেই সময়ে এই দূর্গটি নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে দূর্গের অধিকাংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এটি আজও অতীত নগরের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এবং এই অঞ্চলের স্থাপত্যের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। আকবরী দূর্গের নিকটেই অবস্থিত জামি মসজিদটি রাজমহলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপত্য। রাজা মান সিংয়ের শাসনামলে নির্মিত, মসজিদটি তার গঠন, গম্বুজ এবং মিনারগুলির সাথে চমৎকার মুঘল স্থাপত্যশৈলীকে প্রতিফলিত করে। এটি একটি উপাসনার স্থান এবং একটি মুঘল প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে শহরের প্রাক্তন তাৎপর্যের  একটি প্রমাণ হিসাবে রয়ে গেছে।




জামি মসজিদ এবং আকবরী দূর্গ দেখে এবার আমরা চললাম বারাদারি-র উদ্দেশ্যে। রাজমহলের বারাদারি-র অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক আকর্ষণ এবং স্থাপত্যটির উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক মূল্য রয়েছে। "বারাদারি" শব্দটির অর্থ "বারো দরজা" (ফার্সী শব্দ বারাহ থেকে যার অর্থ বারোটি এবং দার মানে দরজা) এবং এটি সাধারণত একটি মণ্ডপ বা ভবনকে বোঝায় যা বারোটি দরজা দিয়ে চারদিকে খোলা থাকে। রাজমহলের বারাদারি মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল, সম্ভবত সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার শাসনকালে।


শাহ সুজা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং রাজমহলকে তার বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করেন। কাঠামোটি রাজপরিবারের জন্য একটি আনন্দের মণ্ডপ হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল এবং এটি অবসর, সমাবেশ এবং সভাকার্যের জন্য একটি স্থান ছিল। এখান থেকে কিছুক্ষনের জন্যে হলেও আশেপাশের এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং গঙ্গা নদীর দৃশ্য উপভোগ করা যেতে পারে।




বারাদারি মুঘল স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন যার প্রতিসাম্য নকশা এবং মার্জিত খিলান রয়েছে। যদিও কাঠামোটি সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষিত নয়, তবে এর অবশিষ্ট উপাদানগুলি সেই সময়ের চমৎকার কারুকার্য প্রদর্শন করে। বারাদারি-র মূল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে: উন্মুক্ত কাঠামো: বারোটি খিলান বা দরজা দিয়ে বারোটি খিলান সহ বারাদারিটি খোলা নকশা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে যা চারপাশের একটি অবাধ দৃশ্য প্রদান করে। কেন্দ্রীয় হল: প্যাভিলিয়নের কেন্দ্রীয় হল সম্ভবত সামাজিক জমায়েত বা অফিসিয়াল মিটিং-এর জন্য ব্যবহার করা হত। আলংকারিক উপাদান: এমনকি বর্তমান জীর্ণ অবস্থায়ও, খিলান ও স্তম্ভগুলি মুঘল স্থাপত্যের শৈল্পিক সূক্ষ্মতাকে প্রতিফলিত করে।

এরপর কানহাইয়াস্থান মন্দির দর্শন করে আমরা গিয়েছিলাম মতি ঝর্ণা দেখতে। 


তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। দেখলাম সেই স্থানে কয়েকটি দোকান রয়েছে, সেখান থেকে বিকেলের চা, কেক ইত্যাদি খেয়ে আমরা ফিরলাম সাহিবগঞ্জে হোটেলে। একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরোলাম রাতের খাওদাওয়ার উদ্দেশ্যে। এখানে লোডশেডিংয়ের কারণে রাস্তাঘাট বেশ অন্ধকার। যাইহোক, অনতিদূরে একটি রেস্তোরাঁতে আমরা রাতের আহার সারলাম। খাওয়াদাওয়া সেরে হোটেলে ফিরে আজকের মতন বিশ্রাম।

জানুয়ারী, ২০২৪

জলবায়ু সংকট থেকে পুষ্টির স্থিতিশীলতা: সুস্থায়ী পদক্ষেপের আহ্বান (From Climate Crisis to Nutritional Stability: A Call for Sustainable Action)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

রেমাল (Remal cyclone) কি তাণ্ডব করে তা নিয়ে এক গভীর উৎকণ্ঠায় কয়েক মাস আগে টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের উপর অনবরত দৃষ্টি রেখে চলেছিলাম। সাইক্লোন (Cyclone) বা  ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ফল। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ নিয়ে জনসাধারণের খুব একটা আলোচনা শোনা যায় না। জলবায়ু পরিবর্তন আর দূরবর্তী কোনো বিষয় নয়, এটি ইতিমধ্যে আমাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কাজেই এর হাত থেকে রক্ষা পেতে এই বিষয় সম্বন্ধে অবহিত হতে হবে এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমেই বলি, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনে কতটা বিপর্যয় বা বিপদ নিয়ে আসতে পারে তা কিন্তু আমাদের উপরেই নির্ভর করে। এই প্রবন্ধে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরব, বিশেষত কৃষিতে এর প্রভাবের দিকে নজর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মতো অঞ্চলে, যা এই পরিবর্তনের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।

উচ্চ তাপমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান পরিণতি এবং এটি সরাসরি ফসলের উৎপাদনের উপর নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে গমের উৎপাদন ৪-৬% এবং ধানের উৎপাদন ৩-১০% কমে যেতে পারে (Welch et al., 2010; Liu et al., 2016; Zhao et al., 2017)। পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি রাজ্যের জন্য, যেখানে ধান একটি অন্যতম প্রধান ফসল, এটি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ফসলের উৎপাদন হ্রাস খাদ্য নিরাপত্তা এবং লক্ষ লক্ষ কৃষকের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলতে পারে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হল বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন। চরম বৃষ্টিপাতের ঘটনা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃদ্ধি পেয়েছে (Saha and Sateesh 2022; Chaubey et al. 2022)। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত খরা এবং বন্যা উভয়ের কারণ হতে পারে, যা কৃষি কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। বন্যা ফসল ও অবকাঠামো ধ্বংস করতে পারে, খরা জলের অভাব ঘটাতে পারে, যা সেচ ব্যবস্থা এবং উৎপাদন হ্রাসে প্রভাব ফেলে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি উদ্বেগজনক পরিণতি হল ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা বৃদ্ধি। বঙ্গোপসাগরের উষ্ণতর সমুদ্র তাপমাত্রা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম দেয়। ২০২০ সালের মে মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এর ফলে প্রায় ১৭ লাখ হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে (Sarkar and Chakravorty 2021; Bonyopadhyay and Jana 2024; Islam et al. 2024)। ঘূর্ণিঝড় শুধু ফসল ধ্বংস করে না, এটি উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা বাড়িয়ে তোলে, যার ফলে কৃষি উৎপাদনশীলতা কমে যায়।

[এখানে উল্লেখ্য যে, আমি প্রধান সাইক্লোনগুলিকে গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করেছি মাত্র, এটা একটা সংক্ষিপ্ত চিত্রকে প্রকাশ করে। তবে এই সংখ্যার বিভিন্ন উৎস এবং মানদণ্ড অনুসারে কিছু ভিন্নতা থাকতে পারে।]

জলবায়ু পরিবর্তন জলপ্রাপ্যতা এবং মাটির স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে, যা সুস্থায়ী কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বাষ্পীভবনের হার বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তনের ফলে জলাভাব দেখা দিতে পারে (Pathak et al. 2014)। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নদী অববাহিকার সেচের জন্য জলপ্রাপ্যতা কমে যেতে পারে, যা কৃষিকার্যে ঋণাত্মক প্রভাব বৃদ্ধি করতে পারে। উচ্চতর সমুদ্রের স্তর (Rising sea level) এবং ঘন ঘন ঝড়ের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়, যা মাটির উর্বরতাকে হ্রাস করে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের মতো উপকূলীয় জেলাগুলিতে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা ধান, শাক-সবজি এবং অন্যান্য ফসলের চাষকে প্রভাবিত করে (Sarkar et al., 2021; Das et al. 2024)। এছাড়াও, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে মাটির ক্ষয় হয়, যা মাটির স্বাস্থ্যকে আরও খারাপ করে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা কমায়।

কাজেই সহজেই বোধগম্য যে জলবায়ু পরিবর্তনের ঋণাত্মক প্রভাব কৃষিকার্যে পড়ছে, এরফলে খাদ্য উৎপাদন যে ব্যাহত হচ্ছে বা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। আবহাওয়া এবং মৃত্তিকা জনিত কারণে ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেলে বাজারে তার মূল্যবৃদ্ধি হবে, অধিক মূল্যের কারণে তা অনেক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করবে - তা সহজেই বোধ্য। এরূপ অবস্থায় হয়তো প্রথম দিকে পুষ্টির চিত্রটির করুন অবস্থাটি ধরা না পড়লেও, বারংবার যদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করতে আমরা ব্যর্থ হই, তবে তা আমাদের খাদ্য এবং পুষ্টি অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি করবে। 

পদক্ষেপের প্রয়োজন:

কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর প্রভাবের কারণে, সুস্থায়ী এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় নিম্নলিখিত কৌশলগুলি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে:

১. কৃষি পদ্ধতির উন্নতি: জলবায়ু সহনশীল ফসল গ্রহণ করা, সেচের দক্ষতা বাড়ানো এবং টেকসই চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করতে পারে।

[অনুগ্রহ করে পড়ুন বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা ]

২. অবকাঠামোর উন্নতি: ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী কাঠামো এবং দক্ষ জলব্যবস্থাপনা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: জলবায়ু পরিবর্তন জনসাধারণের আলোচনার একটি প্রধান বিষয় হওয়া উচিত, যার মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক এবং নির্বাচনী প্রচারণা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধি সম্মিলিত পদক্ষেপ এবং নীতিগত পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

৪. গবেষণা এবং উন্নয়নে বিনিয়োগ: জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর কৃষির ওপর প্রভাব নিয়ে চলমান গবেষণা নতুন প্রযুক্তি এবং পদ্ধতির উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে, যা সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার জন্য একটি বড় হুমকি (Threat) হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মাটির স্বাস্থ্যের অবনতি - এই সকল সমস্যার জরুরি সমাধান প্রয়োজন। যদি আমরা পদক্ষেপ নিতে দেরী করি, এর পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। নীতিনির্ধারক, বিজ্ঞানী, কৃষক এবং জনসাধারণের একসাথে এসে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই বা সুস্থায়ী উন্নয়ন (Sustainable Development) নিশ্চিত করতে পারি। 

তথ্যসূত্র (References) [বিশদে জানার জন্যে করে গবেষণাপত্রগুলি পড়তে পারেন ]

Bondyopadhyay, S.; Jana, M.S. 2024. Precursors of hazard due to super cyclone AMPHAN for Kolkata, India from surface observation. Mausam 75(2): 373-380. https://doi.org/10.54302/mausam.v75i2.6259

Chaubey, P.K.; Mall, R.K.; Jaiswal, R.; Payra, S. 2022. Spatio-temporal changes in extreme rainfall events over different Indian river basins. Earth and Space Science 9(3): e2021EA001930. https://doi.org/10.1029/2021EA001930

Das, S.; Bandyopadhyay, J.; Acharyya, N.; Jana, M.; Maity, S. 2024. Chapter 7- Impact of soil salinity on the increasing trends of aqua farming in the coastal blocks of Purba Medinipur districts: a geospatial approach. Developments in Environmental Science 16: 153-181. https://doi.org/10.1016/B978-0-443-23665-5.00007-7 

Islam, A.; Chakraborty, D.; Rahaman, A.; Pal, S.C.; Islam, A.R.M.T.; Ghosh, S.; Chowdhuri, I. 2024. Spatial heterogeneity of cyclone induced social psychology in the Indian Sundarbans using empirical data and geospatial techniques. International Journal of Disaster Risk Reduction 111: 104665. https://doi.org/10.1016.j.iidrr.2024.104665

Liu, B.; Asseng, S.; Müller, C.; Ewert, F.; Elliot, J.; et al. 2016. Similar estimates of temperature impacts on global wheat yield by three independent methods. Nature Climate Change 6: 1130-1136. https://doi.org/10.1038/nclimate3115

Pathak, H.; Pramanik, P.; Khanna, M.; Kumar, A. 2014. Climate change and water availability in Indian agriculture: Impacts and adaptation. Indian Journal of Agricultural Sciences 84(6): 671-679. https://doi.org/10.56093/ijas.v84i6.41421 

Saha, U.; Sateesh, M. 2022. Rainfall extremes on the rise: Observations during 1951-2020 and bias-corrected CMIP6 projections for near- and late 21st Century over Indian landmass. Journal of Hydrology 608: 127682. https://doi.org/10.1016/j.hydrol.2022.127682 

Sarkar, B.; Islam, A.; Majumder, A. 2021. Seawater intrusion into groundwater and its impact on irrigation and agriculture: Evidence from the coastal region of West Bengal, India. Regional Studies in Marine Science 44: 101751. https://doi.org/10.1016/j.rsma.2021.101751 

Sarkar, C.S.; Chakraborty, A. 2021. Historical trend of cyclone over the Bay of Bengal and people's perception about coping with cyclone in Kakdwip block of South 24 Pargonas, West Bengal, India. Turkish Online Journal of Qualitative Inquiry 12(7): 2904-2924.

Welch, J.R.; Vincent, J.R.; Auffhammer, M.; Moya, P.F.; Dobermann, A.; Dawe, D. 2010. Rice yields in tropical/subtropical Asia exhibit large but opposing sensitivities to minimum and maximum temperatures. The Proceedings of the National Academy of Sciences 107 (33): 14562-14567. https://doi.org/10.1073/pnas.1001222107

Zhao, C.; Liu, B.; Wang, X.; Lobell, D.B. Huang, Y. et al. 2017. Temperature increase reduces global yields of major crops in four independent estimates. The Proceedings of the National Academy of Sciences 114 (35): 9326-9331. https://doi.org/10.1073/pnas.1701762114 

অ-পতঙ্গ পরাগায়নকারী (Non-insect pollinators)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী ব্লগে পরাগসংযোগকারী কীট-পতঙ্গ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলাম (অনুগ্রহ করে পড়ুন খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তায় পরাগ-সংযোগকারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা)। বর্তমান ব্লগটিতে কীট-পতঙ্গ ছাড়া অন্য কয়েকটি প্রাণী নিয়ে আলোচনা করবো যারাও পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অ-পতঙ্গ পরাগায়নকারীদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পাখি (Birds), স্তন্যপায়ী প্রাণী (Mammals) এবং সরীসৃপ (Reptiles) । এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে:

পাখি

হামিংবার্ড (Hummingbird): আমেরিকাতে, হামিংবার্ডগুলি নলাকার ফুলের (Tubular flowers) উল্লেখযোগ্য পরাগায়নকারী, যেমন ট্রাম্পেট ভাইন (Trumpet vine), ফুসিয়া (Fuchsia) এবং অনেক অর্কিড। তারা ফুলের উপর ঘোরাফেরা করে এবং তাদের লম্বা চঞ্চু এবং জিহ্বা ব্যবহার করে নেক্টর (Nectar) আহরণ করে এবং  ফুল থেকে ফুলে পরাগ বহন করে।

সানবার্ড (Sunbirds) এবং হানিইটার (Honeyeaters): আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায়, সানবার্ড এবং হানিইটাররা হামিংবার্ডের মতো একই ভূমিকা পালন করে। তারা নলাকার আকার এবং উজ্জ্বল রঙের ফুলের পরাগায়ন করে, যেমন প্রোটিয়া (Protea) এবং গ্রেভিলিয়া (Grevillea)।

হানিক্রিপার (Honeycreepers) এবং লরিকিটস (Lorikeets): এই পাখিগুলি, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয়, গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফুলের পরাগায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

স্তন্যপায়ী প্রাণী 

বাদুড় (Bats): বাদুড়, বিশেষ করে ফল-খাওয়া বাদুড় এবং নেক্টর-খাওয়া বাদুড়, গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং মরুভূমি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ পরাগায়নকারী। তারা গাছের পরাগায়ন করে যেমন অ্যাগাভ (Agave) (টাকিলার (Tequila) জন্য ব্যবহৃত হয়), সাগুয়ারো ক্যাকটাস (Saguaro cactus), দুরিয়ান (Durian) এবং অনেক গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল। বাদুড় ফ্যাকাশে রঙের, তীব্র গন্ধযুক্ত ফুলের প্রতি আকৃষ্ট হয় যা রাতে ফোটে।

প্রাইমেট (Primates): কিছু প্রাইমেট, যেমন মাদাগাস্কারের কালো-সাদা রাফড লেমুর (Black-and-white ruffed lemur), তারা নেক্টর পান করার সময় তাদের মুখে লেগে থাকা পরাগ স্থানান্তর করে বড় ফুলের, যেমন ট্রাভেলার'স পাম (Traveler’s palm),  পরাগায়নকারী হিসাবে কাজ করে।

রোডেন্ট (Rodents): কিছু রোডেন্ট, যেমন ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালি, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রোটিয়া-র মতো  ফুলের পরাগায়ন করতে সাহায্য করে কারণ তারা ফুলের নেক্টর বা পরাগরেণু খায়।

মারসুপিয়ালস (Marsupials): অস্ট্রেলিয়ায়, হানি পোসাম (Honey possum) এবং সুগার গ্লাইডারের (Sugar glider) মতো কিছু মার্সুপিয়াল নেক্টর খায় এবং ইউক্যালিপটাস (Eucalyptus) এবং ব্যাঙ্কসিয়াসের (Banksias) মতো ফুলের পরাগায়ন করে ।

সরীসৃপ

লিজার্ড এবং গেকোস (Lizards and Geckos): কিছু দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রে, লিজার্ড এবং গেকো গুরুত্বপূর্ণ পরাগায়নকারী। তারা নেক্টর খাওয়ার জন্য ফুল পরিদর্শন করে এবং পরাগ স্থানান্তর করে। উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে স্কিনক (Skinks) এবং গেকো (Gecko) যা নিউজিল্যান্ড, হাওয়াই এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদের ফুলের পরাগায়ন করে।

এই অ-পতঙ্গ পরাগায়নকারীরা প্রায়শই নির্দিষ্ট উদ্ভিদের সাথে অভিযোজিত হয় যেগুলি তাদের আকর্ষণ করার জন্য অনন্য ফুলের আকার, রঙ এবং প্রস্ফুটিত সময় বিকশিত হয়েছে। এই অভিযোজনগুলি ইকোসিস্টেমের সফল পরাগায়ন নিশ্চিত করে যেখানে পরাগসংযোগকারী কীট-পতঙ্গ কম বা অনুপস্থিত। 

[স্তন্যপায়ী এবং সরীসৃপ প্রাণীদের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনার জন্যে অনুগ্রহ করে যথাক্রমে পড়ুন আনদং-র জু-টোপিয়াম: পর্ব-১: স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একটি সংক্ষিপ্ত সরল বর্ণনা, আনদং-র জু-টোপিয়াম: পর্ব-২: সরীসৃপ প্রাণীদের একটি সংক্ষিপ্ত সরল বর্ণনা]

খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তায় পরাগ-সংযোগকারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা (The Crucial Role of Pollinators in Food and Nutrition Security)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্বের একটি ব্লগে (Photographs of some insects) আমি কয়েকটি কীট-পতঙ্গের ছবি দিয়েছি। ছবি তুলতে আমি ভালোবাসি, তবে ব্লগে এই ছবিগুলি প্রকাশ করার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র কয়েকটি ছবির প্রদর্শন করা নয়, আশা করি এই ছবিগুলি (বাস্তবে খালি চোখে দেখলে আরও ভালো লাগে) এই কীট-পতঙ্গগুলি সম্বন্ধে পাঠক-পাঠিকাদের মনে কৌতূহল উদ্রেক করবে। আসলে অনেক সময় আমরা বিস্মৃত হই আমাদের বাস্তুতন্ত্রটি কি প্রকারে আমাদের সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলি আমাদের প্রদান করে চলেছে, সেই বিষয়ে (অনুগ্রহ করে পড়ুন বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য)। 

কীট-পতঙ্গ, বিশেষত পরাগ বহনকারী বা পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গ (Pollinator), আমাদের খাদ্য উৎপাদনের জন্যে অপরিহার্য। যে সকল খাদ্যশস্য আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি তার প্রায় ৭৫% পরাগ-সংযোগকারী প্রাণীদের উপর নির্ভর করে, এই সকল পরাগ-সংযোগকারী প্রাণীদের মধ্যে কীট-পতঙ্গ উল্লেখযোগ্য (About 75% of global food crop types depend on pollinators)। যদি কোনো কারণে এরা প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয় বা এদের বৈচিত্র্য বা সংখ্যা কমে যায়, তবে তার ফলে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পাবে, যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান ফসলগুলি থেকে আসত, ফলন হ্রাস পাওয়ায় পুষ্টি উপাদানগুলির সরবারহ স্বাভাবিক কারণেই সংকুচিত হয়ে পড়বে। এর ফলে আমাদের খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরা যে কেবলমাত্র উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে তা নয়, ফসলের গুণমানও বৃদ্ধি পায়। 

একদিকে পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গদের সংখ্যা হ্রাস পেলে ফসল উৎপাদন হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং এরফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর পাশাপাশি এরফলে পুষ্টি উপাদানগুলির পরিমাণও কিন্তু হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং তা মানব স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বলি, ধরা যাক, কোনো এক স্থানে কুমড়ো চাষ করা হয়। এই ফসলটি উৎপাদনের জন্যে পরাগ-সংযোগকারী কীট-পতঙ্গদের প্রয়োজন হয়। এখন যদি এই পরাগবাহকদের বৈচিত্র বা সংখ্যা যে কোনো কারণেই কমে যায় তবে তার ফলে কুমড়ো গাছের পরাগ সংযোগ ব্যাহত হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন কম হবে। কম উৎপাদন হলে কৃষকের আয় কমে যাবে তা বলাই বাহুল্য। ১০০ গ্রাম কুমড়ো একটি নির্দিষ্ট পরিমান ভিটামিন এ (Vitamin A) ধারণ করে, সেই হিসেবে থেকে যত উৎপাদনের পরিমাণ ততই পুষ্টি উপাদানগুলির (যেমন, ভিটামিন এ) পরিমাণও হ্রাস পাবে। 

এ স্থানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরাগসংযোগকারী কীট-পতঙ্গের কথা উল্লেখ করি, তবে বিষয়টি একটু সহজ হবে।  

প্রথমেই মনে আসে মৌমাছি (Honey bee- Apis spp.) - আমাদের দেশে কিন্তু বেশ কয়েক প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায় যেমন Apis mellifera, Apis cerana, Apis dorsata, Apis laboriosa ইত্যাদি। ফসলের মধ্যে এরা প্রধানত আপেল, আমন্ড (Almond), ব্লুবেরী (Blueberries), অ্যাভোকাডো (Avocado), শশা, কুমড়ো, মেলন (Melon), সর্ষে, তিল, লিচু, ক্রেনবেরি (Craneberry), ধোনে ইত্যাদির পরাগ সংযোগে সাহায্য করে। মৌমাছিরা সাধারণ পরাগায়নকারী (Generalist), মোটামুটি সকল প্রকার ফল, বাদাম এবং সবজি ফসলের পরাগসংযোগে অংশগ্রহণ করে , ফসলের ফলন এবং গুণমানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। 

এরপর আসি বাম্বেল বি-র (Bumble bee- Bombus spp.) কথায়, যাকে আমরা ভ্রমর বলে চিনি। প্রধানত টম্যাটো, লঙ্কা, স্ট্রবেরী (Strawberries), ব্লুবেরী (Blueberries), লবঙ্গ (Clove) ইত্যাদি ফসলের পরাগসংযোগে ভ্রমর খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বাম্বেল বি (Bumble bee) বিশেষভাবে "বাজ পরাগায়ন" (Buzz pollination) এ কার্যকরী, এরা যখন উড়ে বেড়ায়, কান পাতলে একটা বুউজজ জজজ  বুউজজ জজজ শব্দ শোনা যায়, এর ফলে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তারফলে গাছের যেমন টম্যাটো এবং লঙ্কার পরাগ নির্গত হয়। তাদের দৃঢ় দেহ (Robust body) এবং দীর্ঘ জিহ্বা (Proboscis) তাদের গভীর ফুলে প্রবেশ করতে দেয়। 

ম্যাসন বি (Mason bee- Osmia spp.) ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ পরাগ সংযোগকারী, এরা আপেল, নাসপাতি, চেরি (Cherries), আমন্ড, পিচ ইত্যাদি ফলের পরাগসংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ম্যাসন বি-রা প্রারম্ভিক ঋতুর পরাগায়নকারী এবং উচ্চ পরাগায়ন দক্ষতার কারণে ফল বাগানের পরাগায়নের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। 

কার্পেন্টার বি (Carpenter bee- Xylocopa spp.) মূলত প্যাশনফ্রুট (Passionfruit), বেগুন এবং লেগুম জাতীয় ফসলের পরাগ সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কার্পেন্টার বি আকারে বড়, সলিটারি অর্থাৎ মৌমাছির মতন এরা সমাজবদ্ধ নয়, এরা বিশেষত বড় পাপড়ি (Large petals) এবং নলাকার আকৃতির (Tubular shape) বিভিন্ন ধরনের ফুলের পরাগায়ন করে।

প্রজাপতি (Butterfly) তো আমরা সকলেই দেখেছি, ফুলের উপর এরা যখন উড়ে বেড়ায় তখন তা বড়ই ভালো লাগে। এরাও কিন্তু পরাগায়নে সাহায্য করে, মূলত গাজর, পেঁয়াজ, বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ (Herb), এবং বন্য ফুল এদের দ্বারা উপকৃত হয়। প্রজাপতি হল গৌণ পরাগায়নকারী কিন্তু ভেষজ এবং ফুলের উদ্ভিদের পরাগায়নে অবদান রাখে, বিশেষ করে যাদের সমতল (Flat) বা গুচ্ছ ফুল (Clustered) রয়েছে। অপরপক্ষে বিভিন্ন মথ (Moth, Sphingidae পরিবারভুক্ত) তামাক, ইভিনিং প্রাইমরোজ (Evening primrose), ইয়ুক্কা (Yucca) এবং নানান ধরণের ফলের পরাগায়নে অংশগ্রহণ করে। মথ সাধারণত রাতে সক্রিয় থাকে এবং যে ফুলগুলি সন্ধ্যায় বা রাতে ফোটে তাদের পরাগায়ন করে। এগুলি নির্দিষ্ট রাত্রে প্রস্ফুটিত উদ্ভিদের পরাগায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

আমি নিশ্চিত যে আমাদের মধ্যে অনেকেই হোভারফ্লাই (Hoverfly, Family: Syrphidae) চেনেন। এরা গাজর, ধোনে, সেলেরি (Celery), মৌরি ইত্যাদির পরাগায়নে সাহায্য করে।  হোভারফ্লাই ছোট ফুল এবং ছাতার আকৃতির ফুলের গুচ্ছ (Umbel-shaped flower clusters) বিশিষ্ট উদ্ভিদের পরাগায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারা এফিডের (Aphid) প্রাকৃতিক শিকারী (Natural predators)।  

লিফকাটার বি (Leafcutter bee- Megachile spp.) বা মেগাচিলিড বি (Megachilid bee) আলফালফা (Alfalfa), বিন (Beans), মেলন (Melon), বেরী (Berries) ইত্যাদির পরাগায়নে সাহায্য করে। বিটলদের মধ্যে, বিশেষত Nitidulidae পরিবারভুক্ত স্যাপ বিটল (Sap beetle), ম্যাগনোলিয়া (Magnolia), ওয়াটার লিলি (Water lilies), পপ (Pawpaw), কোকো (Cocoa) ইত্যাদির পরাগায়ন করে। 

এছাড়াও আরও অনেক প্রজাতির কীট-পতঙ্গ (যেমন পিঁপড়ে, Halictidae পরিবারভুক্ত সোয়েট বি (Sweat bee) ইত্যাদি) রয়েছে, আর শুধু কীট -পতঙ্গ-ই নয়, অন্যান্য প্রাণী যেমন পাখি, বাদুড়, কয়েক প্রজাতির রোডেন্ট, ইত্যাদিরাও কিন্তু বিভিন্ন উদ্ভিদের পরাগায়নে সাহায্য করে। সেই বিষয়ে পরে কখনও বিশদে উল্লেখ করবো। 

বর্তমানে নানান কারণে, যেমন অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এই সকল পতঙ্গদের বাসস্থানের অবক্ষয় (Habitat degradation), নিবিড় কৃষিকাজ (ফসলের বৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত পরিমানে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার ইত্যাদি) (Intensive agriculture), প্যাথোজেন এবং পরজীবীদের আক্রমণ (Pathogen and parasite burden), এবং জলবায়ুর পরিবর্তন (Climate change) ইত্যাদি, এই সকল উপকারী অপরিহার্য কীট-পতঙ্গরা অনেক স্থানে কমে যাচ্ছে। এদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া একান্তভাবে অপরিহার্য, অন্যথায় আমাদের খাদ্য এবং পুষ্টির সংকট দেখা দেবে। কাজেই এদের সংরক্ষণ বাঞ্চনীয়। 

স্থানীয় পরাগ সংযোগকারী কীট-পতঙ্গগুলিকে চিহ্নিতকরণ, তাদের পর্যবেক্ষণ করা এবং প্ল্যান্ট-পলিনেটর নেটওয়ার্ক গঠনের (Plant-Pollinator network) মাধ্যমে তাদের গুরুত্ব অধ্যয়ন, সমস্যা চিহ্নিত করা এবং সেই বিষয়গুলির সমাধানের জন্যে গবেষণা করা একান্ত প্রয়োজনীয়। এর পাশাপাশি এই সকল উপকারী পতঙ্গগুলির বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষত স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম এবং নাগরিক বিজ্ঞান প্রকল্পগুলির মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করে, এমনকি তাঁদের পর্যবেক্ষণকে ডেটাবেসে অন্তর্ভুক্ত করে এদের সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় মানুষের  অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।     

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...