পৃষ্ঠাসমূহ

বালাঘাটের অদূরে ঐতিহাসিক স্থান লাঞ্জি (Lanji: A historical place near Balaghat)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের মৃত্তিকার প্রতিটি কণায় কান পাতলে শোনা যায় তার ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, আর দর্শন। এই বৈচিত্র্যময়তার সাথে একাত্মতা অনুভব করেই আমরা সেইস্থানের মাহাত্ম্য অনুধাবন করি।

অধ্যাপনার কাজে মধ্যপ্রদেশে কিছুকাল থাকার সুবাদে সেই স্থানের বেশ কয়েক জনজাতির মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। এদের মধ্যে ছিলেন বাইগা (Baiga), মাড়িয়া (Madia), করকু (Korku)গোন্ড (Gond) ইত্যাদি। বালাঘাট জেলার বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলি আমি ঘুরেছি, মানুষের সাথে মিশেছি, আমার আগ্রহ ছিল আদিবাসী মানুষদের খাদ্য, পুষ্টি, এবং এই সম্পর্কিত জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অবহিত হওয়া। যে কোনো জনজাতির দিকে লক্ষ্য করলে একটা সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থান পরিলক্ষিত হয় যা সাধারণভাবে কম-বেশি সেই জনজাতির সকল মানুষের জন্যে অনেকটা এক রকম। তবে গোন্ড জনজাতির মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু অন্য রকম। তাঁদের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বৈচিত্র্য (variation) দৃষ্টিগোচর হয়। অন্যান্য আদিবাসী মানুষের মতন একটা বড় অংশের গোন্ড মানুষ প্রকৃতির সাহচর্যে বাস করেন, জীবনধারণের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলি প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করেন, আবার আর একটি অংশের মানুষ চাষবাস এবং পশুপালন করেন, আবার কেউ ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি করে থাকেন। এই বৈচিত্র্যের কারণ অনুসন্ধানের জন্যে মধ্য ভারতের ইতিহাসের দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন, তবে সে ইতিহাসের বিস্তারিত উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। এই ব্লগে আমি একটি ছোট্ট শহর লাঞ্জি বেড়ানোর কথা বলবো, আর এখানেই বারবার ফিরে ফিরে আসবে গোন্ড রাজত্বের কথা। আজকের লাঞ্জি, অতীতে কালাচুরি বংশের রাজত্বকালে পরিচিত ছিল লাঞ্জিকা নামে। ইতিহাস তিনটি কালচুরি রাজবংশের উল্লেখ পাওয়া যায়, যথা (১) সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতকের ত্রিপুরীর কালাচুরি রাজবংশ যারা চেদি অঞ্চল তথা বর্তমানের বুন্দেলখন্ড থেকে দক্ষিণে যমুনা নদী আর কেন নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল শাসন করতেন, (২) একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের রত্নপুরার কালাচুরি রাজবংশ যারা রত্নপুরা (বর্তমানের বিলাসপুর) থেকে ছত্তিশগড় অঞ্চল শাসন করতেন আর (৩) দ্বাদশ শতকের কল্যাণীর কালাচুরি রাজবংশ যারা উত্তর কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্র অঞ্চল শাসন করতেন। লাঞ্জি ছিল এই রত্নপুরার কালাচুরি রাজবংশের অধীনস্থ। এর পর কালাচুরি রাজবংশকে পরাজিত করে রাজা যদুরাই প্রতিষ্ঠা করেন গোন্ড রাজবংশ। সম্রাট আকবরের সময়ের আইন-ই-আকবরীতেও লাঞ্জির উল্লেখ রয়েছে, তখন এটি ছিল একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র বা মহাল। 

দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে বালাঘাট থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ছোট্ট এই শহর লাঞ্জিতে প্রবেশ করে প্রথমেই দর্শন করলাম লাঞ্জকাই মাতার মন্দির এরপর এ স্থানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ লাঞ্জি দুর্গে যখন এসে পৌঁছলাম তখন বেলা দু'টো। আমার অনেক বিদেশী বন্ধুরা অনেক সময় আমায় জিজ্ঞেস করেছেন যে আমার দেশে নাকি রাস্তায় মানুষ আর গরু একত্রে যাতায়াত করে। বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁরা এরূপ চিত্র দেখেছেন। তাঁরা বেশ উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করেন এতে অসুবিধা হয় না ! আমি হাসি, কথা সত্য, গ্রাম ভারতে এ চিত্র কষ্টকল্পনা নয়। ভারতের মনন, এর দার্শনিক গভীরতা উপলব্ধির, তা যে সংক্ষেপে বর্ণনা করা যায় না। গরু বা মহিষের পালের সাথে সাথে পথ চলা, হর্ন দিয়ে তাদের সরিয়ে গাড়ির যাত্রাপথটুকু বের করে নেওয়া, কখনও গাড়ি থেকে নেমে 'হুস-হুস' করে রাস্তার উপরে বিশ্রামরত গরু বাছুর সরানো, দেরী হওয়ার কারণে বিরক্ত হওয়া আবার গরু বা মহিষের কান্ড দেখে হেসে ফেলা, এসবই আমাদের যাত্রাপথের উপাদান, এ অভিজ্ঞতা দৈনন্দিনের। এভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা। 

পৌঁছলাম প্রাচীন দুর্গে। 

কে এই দুর্গটি স্থাপন করেছিলেন এবং কোন সময়ে সেই সংক্রান্ত নির্ভর করার মতন কোনো ঐতিহাসিক তথ্য আমি খুঁজে পাইনি (যা পেয়েছি সেই সকল তথ্যের কোনো রেফারেন্স আমি পাইনি) কাজেই তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি। ভবিষ্যতে যদি কোনো ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারি তবে তা নিশ্চয়ই উল্লেখ করবো।

প্রবেশের মূল ফটকের মধ্যে দিয়ে প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়লো এক বিরাট গাছ আর তাতে প্রায় গোটা ত্রিশ মৌমাছির চাক। এগুলি Apis dorsata প্রজাতির মৌমাছির চাক। এ অঞ্চলে গাছে অনেক মৌচাক লক্ষ্য করা যায় রাস্তায় সদ্য চাক ভাঙা মধু বিক্রী হতে আমি অনেক বার দেখেছি।

প্রায় সাড়ে সাত একর জায়গার উপর গোন্ড রাজত্বের সময়কালের এই দুর্গ আজও তৎকালীন ইতিহাস, স্থাপত্য, এবং ভাস্কর্যের সাক্ষী বহন করে চলেছে। বর্তমানে দুর্গটির নানান অংশ ভগ্নপ্রাপ্ত এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এটিকে রক্ষণাবেক্ষন করছে। দুর্গের প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় 20 ফুট এবং চার কোণে ইট নির্মিত চারটি বুরুজ ছিল, যদিও বর্তমানে মাত্র দুটি দেখা যায়। 

দুর্গের প্রাচীর গাত্রে খোদিত ভাস্কর্য, মূর্তিগুলি সেই সময়ের উন্নত শিল্পকলার নিদর্শন। তবে এগুলির বিশেষ সংরক্ষণ প্রয়োজন।

দুর্গের চারপাশে একটি গভীর পরিখার অবশিষ্টাংশ এখনও দেখা যায়। দুর্গটিকে রক্ষা করার জন্যে পরিখায় কুমির রাখা হতো বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন। 

প্রাঙ্গনে রয়েছে বেলেপাথর নির্মিত পূর্বমুখী একটি  মন্দির। মন্দিরটিতে রয়েছে তিনটি প্রকোষ্ঠ। গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারটি অলংকৃত এবং সুন্দর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত। মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রস্তর নির্মিত মূর্তিগুলি উন্নত ভাস্কর্যের পরিচায়ক। আজ দীপাবলি, তাই মন্দির প্রাঙ্গনে এক মহিলা এবং একটি মেয়ে রঙ্গোলি বানাচ্ছেন।

আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য কোটেশ্বর মহাদেব ধাম। শ্রী দাদা কোটেশ্বর দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে এগিয়ে যেতে হবে কোটেশ্বর মহাদেব ধামের উদ্দেশ্যে। প্রতি বৎসর শ্রাবণ মাসে এখানে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। মন্দির চত্বরে, আশেপাশের গাছে রয়েছে অনেক মৌচাক। মন্দির ভবনে প্রবেশ করে সামনের দিকে একটু এগোলেই দেখে যাবে কুন্ড যেখানে শিবলিঙ্গ অবস্থান করছেন। এটি ভূমির থেকে কিছুটা নিচে অবস্থিত হাওয়ায় ভগবান দর্শন এবং পূজাপাঠের জন্য সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। মূল মন্দিরটি মূলত প্রস্তর নির্মিত, মন্দিরটি প্রদক্ষিণের সময় এটি স্পষ্ট হয়। মন্দিরগাত্রের উন্নত শিল্পকলার পরিচায়ক প্রস্তর ভাস্কর্যগুলি সহজেই আকর্ষণ করে। 

ফেরার পথে দেখে নিতে পারেন হাট্টা কি বাওলি। তবে আমাদের ফিরতে দেরি হওয়ার কারণে এটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এই বাওলিটিও স্থাপিত হয় সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়কালের মধ্যে। গোন্ড রাজা হাটটে সিং ভালকে বাওলিটি খনন করান। পানীয় জল, স্নান এবং ব্যবহারের জল, সৈন্যদের অবস্থান- এই সকল কাজের জন্যে দ্বিতলীয় প্রস্তর নির্মিত বাওলিটি এর স্থাপত্যের কারণে একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য। আশা করি সময় পেলে আমি পুনরায় সেই স্থানে বেড়াতে যাবো। জনশ্রুতি বাওলিটি থেকে লাঞ্জি দুর্গ পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গপথ রয়েছে। বর্তমানে এটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তত্ত্বাবধানে রয়েছে। 

এবার ঘরে ফেরা। দীপাবলির প্রদীপ জ্বালানো, রঙ্গোলি বানানো ইত্যাদি নানান কাজের মধ্যে দিয়ে বেশ কাটলো দিনটা।

পরিশেষে বলি, বালাঘাট এবং তৎসংলগ্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলি অন্য রাজ্যের পর্যটকদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। কাজেই এগুলি পরিদর্শন করা হয়ে ওঠে না। অনেকেই কান্হা ন্যাশনাল পার্কে (Kanha National Park) বেড়াতে যান। কলকাতা থেকে ট্রেনে কান্হা ন্যাশনাল পার্ক যাওয়ার অন্যতম সহজ উপায় গোন্ডিয়া জানক্শনে (Gondia Junction railway station) নেমে ৪৫ কিলোমিটার দূরে বালাঘাট (Balaghat) পৌঁছনো। বালাঘাট শহর থেকে কান্হা টাইগার রিসার্ভের দূরত্ব মাত্র ৮০-৮৫ কিলোমিটার, সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন ফরেস্টের প্রবেশদ্বারে। বালাঘাট শহরে রয়েছে একাধিক হোটেল, রেস্তোরাঁ। যাতায়াতের পথে এক বা দুই দিন এই শহরটিতে কাটিয়ে সহজেই দেখে নিতে পারেন কাছেপিঠের দর্শনীয়স্থানগুলি। 

নভেম্বর, ২০১৮

কাঁকড়া: একটি উপাদেয় খাদ্য (Crab: A delicacy)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

কাঁকড়া বাঙালির কাছে বরাবরই উপাদেয় খাদ্যবস্তু হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। সমকালীন সাহিত্যেও উঠে এসেছে কাঁকড়ার কথা। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অনতিকালের মধ্যে আসে ভয়াবহ বন্যা। বাংলার মানুষ, বিশেষত নিম্নবিত্ত মানুষ, আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পরে। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলশ্রুতিতে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, যা তেতাল্লিশের (১৯৪৩) বাংলার মন্বন্তর নামে পরিচিত। জগডুমুর সেদ্ধ, কচুর লতির ঝোলের মাধ্যমে ক্ষুধা নিবৃত্তি, বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটকের চরিত্র মাখন যখন এই সকল খাদ্যের বিরূদ্ধে তীব্র অনীহা প্রকাশ করে, বিনোদিনী ঝাঁজিয়ে উঠেন মাখনের উদ্দেশ্যে, বলেন সে ভালো মন্দ কিছু খুঁজে আনলেই পারে, ঠিক তখন প্রধান সমাদ্দার কিছু কাঁকড়া সংগ্রহ করে নিয়ে প্রবেশ করেন। কাঁকড়া বেশ ভালো অর্থাৎ উপাদেয় বলেই গণ্য হয়েছিল চরিত্রগুলির কাছে। তবে কোনো যাত্রার প্রাক্কালে কাঁকড়া দর্শন কিন্তু আবার অলুক্ষণে চিহ্ন বলে বিবেচনা করা হয়। সমরেশ বসুর উপন্যাস 'গঙ্গা'-তে দেখি নিবারণ আর পাঁচু মাছ ধরতে যাওয়ার পূর্বে কচ্ছপ দেখে বেশ সন্দিহান হয়ে পড়েছিল; কচ্ছপ, কাঁকড়া আর কলা, এই তিন বস্তু অলুক্ষণে চিহ্ন বলেই মনে করা হয়। কেন তা আমার অজানা।

কাঁকড়া (Crab) অনেকের পছন্দ হলেও ছাড়ানো বেশ কঠিন বলে খাওয়া হয়ে ওঠে না। বেশ কয়েক বৎসর পূর্বে তাজপুর সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে কাঁকড়া খেয়েছিলাম, তবে তা খুব সুস্বাদু ছিল এমনটা বলা যায়না। আবার ইয়ংদক ক্র্যাব ভিলেজের (Yeongdeok crab village) বাজারে অনেক প্রকার কাঁকড়া দেখে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করলেও রেস্তোরাঁতে এক একটি কাঁকড়ার দাম ছিল প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার, কাজেই তা দিয়ে রসনা তৃপ্ত করা আমার সাধ্যের অতীত ছিল। কাজেই বাজার থেকে কিনে বাড়িতে এনে রান্না করে কাঁকড়া খাওয়া, এটিই হলো সহজ পথ। আমাদের দেশে নানান প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২০টি প্রজাতির কাঁকড়া খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।এদের মধ্যে রয়েছে  Scylla serrata, S. tranquebarica (এদের মূলত ম্যানগ্রোভ, খাড়ি বা নোনাজলের ভেড়িতে পাওয়া যায় বা চাষ করা হয়), Protonus pelagicus, P. sanguinolentus, P. argentatus, P. latipesCharybdis feriata, C. helleri, C. affinis, C. lucifera, C. quadrimaculata, C. acutifrons (এদের সাধারণত কর্দমাক্ত অঞ্চলে কাদার নিচে পাওয়া যায়), Varuna litterata (মিঠা জলের পুকুর, নোনা জলাশয়, খাড়ি সকল স্থানেই এরা বাস করে), Episesarma mederi, Muradium tetragonum (কাদা অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়), Sartoriana spinigera, Spiralothelphusa hydroma (বিল, বাওর, মিঠা জলের পুকুর ইত্যাদিতে পাওয়া যায়), Diogenes milesMatuta planipes, M. lunaris (সমুদ্র উপকূলে বেলে অঞ্চলে পাওয়া যায়)। আবার বেশ কয়েক প্রজাতির কাঁকড়া, যেমন Charybdis rostrata, C. orientalis, C. helleri ইত্যাদি মাছের খাদ্য (Fishmeal) প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

প্রতিটি প্রজাতির কাঁকড়া দেখতে একটু আলাদা হলেও তাদের মূল গঠন একই রকমের। দক্ষিণ কোরিয়াতেও ভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের কাঁকড়ার মধ্যে কিং ক্র্যাব (King crab), স্নো ক্র্যাব (Snow crab), নীল কাঁকড়া (Blue crab), লাল কাঁকড়া (Red crab) উল্লেখযোগ্য। 

আমি বাজার থেকে নীল কাঁকড়া কিনে এনেছিলাম, এটি হিমায়িত (Frozen) অবস্থায় ছিল। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাজারে টাটকা কাঁকড়া পাওয়া যায়। সেটি কিনে এনে ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে (গায়ে শ্যাওলা থাকলে তা ঘষে তুলে দিতে হবে) নিতে হবে। এবার কাঁকড়াগুলিকে ঘন্টা খানেক রেফ্রিজারেটরের শূণ্য (০) ডিগ্রী তাপমাত্রায় রেখে দিলেই এরা নিস্তেজ হয়ে মরে যাবে, অন্যথায় গরমজলে একটু ফুটিয়ে নিলেও হবে। এবার কাটাকাটি করতে সুবিধা হবে। অন্যথায় জীবন্ত অবস্থায় কাটতে গেলে কাঁকড়াটিও যন্ত্রণাভোগ করবে আবার যিনি কাটবেন তিনিও আহত হতে পারেন। 

কাঁকড়া একটি খোলার (Exoskeleton) আবরণে থাকে, এই খোলাটি ছাড়িয়ে তবে তা রেঁধে খাওয়ার উপযোগী হয়। এই খোলাটি কাইটিনের (Chitin) সাথে বেশ কিছু খনিজ পদার্থ মিলিত (Mineralized) হয়ে সৃষ্টি হয়। তবে যতটা শক্ত বলে মনে হয় সেটা ততটা শক্ত নয়। জীবজগতে কাঁকড়ার স্থান লক্ষ্য করলে দেখা যায় এটি আর্থ্রোপোড (Arthropod/সন্ধিপদ) পর্বের ক্রাস্টেশিয়া (Crustacea) উপ-পর্বের (Subphylum) অন্তর্গত ম্যালাকোস্ট্রাকা (Class- Malacostraca) শ্রেণীভুক্ত প্রাণী। এই ম্যালাকোস্ট্রাকা শব্দটিকে একটি ভাঙলে দাঁড়ায় গ্রীক শব্দ 'ম্যালাকস' (Malakos) অর্থাৎ নরম (Soft) এবং 'অস্ট্রাকন' (Ostracon)-র অর্থ খোলা (Shell), কাজেই ম্যালাকোস্ট্রাকা-র মানে হলো নরম খোলা আবৃত প্রাণী। প্রন (Prawn), শ্রিম্প (Shrimp), লবস্টার (Lobster), কাঁকড়া (Crab) সকলেই এই শ্রেণীভুক্ত। কাঁকড়ার পৃষ্ঠীয় দেশের (Dorsal) খোলাটিকে ক্যারাপেস (Carapace) বলা হয়। পৃষ্ঠীয় (Dorsal) এবং অঙ্কীয় (Ventral) দেশের সন্ধিস্থলে ছুরি একটু ঢুকিয়ে উপরের দিকে চাপ দিতেই ক্যারাপেসটি উঠে আসবে। এই কাজটিকেই মনে হয় সবথেকে কঠিন, আসলে কিন্তু তা নয়।  এমনকি চাপ একটু বেশি লাগলে ক্যারাপেসটি ভেঙে যায়, তখন সহজেই বোঝা যায় এটি বাস্তবে খোলাটি অতটা শক্ত নয়। 

এই ম্যালাকোস্ট্রাকা শ্রেণীর মধ্যে আবার কাঁকড়া ডেকাপোডা অর্ডারের (Order- Decapoda) অন্তর্গত। শব্দটি থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, ডেকা (Deca) অর্থাৎ দশ আর পোডা (Poda) শব্দটির অর্থ পদ বা পা। মানে কাঁকড়ার পায়ের সংখ্যা পাঁচ জোড়া বা দশটি। সাধারণত বেশির ভাগ কাঁকড়ার ক্ষেত্রে, এই পাঁচ জোড়া পায়ের মধ্যে প্রথম জোড়া পা বেশ বড় আকারের এবং বাকি চার জোড়া পা তুলনামূলকভাবে ছোট হয়। প্রতিটি পা কাঁকড়ার দেহ থেকে আলাদা করা প্রয়োজন। পা গুলি যে স্থানে শরীরের সাথে সংযুক্ত সেই স্থানে একটু ঘোরাতেই এগুলি সহজেই আলাদা হয়ে যায়। বড় আকারের পা দুটি ছাড়া বাকিগুলি ফেলে দেওয়াই বাঞ্চনীয়, তবে ইচ্ছে হলে এগুলো ব্যবহারও করতে পারেন। বড় আকারের পা দুটির খোলা একটু ভেঙে নিতে হবে যাতে রান্নার সময় ভিতরের মাংস সহজে সিদ্ধ হতে পারে এবং রান্নার মশলার উপকরণগুলি পৌঁছতে পারে।

এইবার ক্যারাপেস উঠিয়ে নেওয়ার পর যা চোখে পড়বে তা হলো গিল (Gills), জলচর কাঁকড়ার দেহে গিলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ডান ও বাম গিলের সংযোগস্থলে রয়েছে হৃৎপিণ্ড (Heart)। গিলের নিচে থেকে অন্যান্য অন্তরযন্ত্ৰীয় অঙ্গগুলি, যেমন পাচক গ্রন্থিসমূহ (Digestive glands), ডিম্বাশয় (Ovary, স্ত্রী কাঁকড়ার ক্ষেত্রে), ম্যান্ডিবুলার পেশী (Mandibular muscle) ইত্যাদি থাকে। তবে এগুলি আলাদা করে চিহ্নিতকরণের প্রয়োজন নেই কারণ আমরা এখানে খাদ্য হিসেবে বর্ণনা করছি। এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য, সেটা হলো কিভাবে স্ত্রী এবং পুরুষ কাঁকড়া চিহ্নিত করা যায়। কাঁকড়ার অঙ্কীয়দেশের নিচের দিকে অ্যাবডোমেন (Abdomen) অংশটি (প্লেটটি এপ্রোন (Apron) বলেও পরিচিত) লক্ষ্য করতে হয়, যদি এটি ত্রিভুজের ন্যায় এবং আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট বা সরু হয় তবে কাঁকড়াটি পুরুষ কাঁকড়া, আর যদি এবডোমেনটি আকারে বৃহৎ হয় তবে সেটি স্ত্রী কাঁকড়া হয়ে থাকে। যাই হোক, এইবার কাঁকড়ার দেহের আকার অনুযায়ী একে দু'টি বা চারটি টুকরো করে নিতে হবে।  ব্যাস, কাঁকড়া কাটার কাজ শেষ।

এবার টুকরো গুলোকে ভোজ্য তেলে ভেজে নিয়ে রান্না করতে হবে। বিভিন্ন অঞ্চলে রান্নার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন ধরণের। কোনো অঞ্চলে আদা-পেঁয়াজ-রসুন-লঙ্কা বাটা দিয়ে, ধনে-জিরের গুঁড়ো সহযোগে কাঁকড়াকে কষিয়ে রান্না করা হয়। আবার কারোর কাছে নারিকেলের দুধ দিয়ে কাঁকড়া রান্না উপাদেয়। কেউ কাঁকড়ার পদে আলু ব্যবহার পছন্দ করেন আবার কেউ করেন না, কাজেই এটি ইচ্ছে অনুসারে।

এবার উপভোগ করুন সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাদ্যবস্তুটিকে।

পরিশেষে একটি কথা উল্লেখ্য। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব কিন্তু কাঁকড়ার উপর পড়ছে। বসবাসের উপযোগী পরিবেশ যেমন, জলের pH, লবণাক্ততা (Salinity), তাপমাত্রা ইত্যাদির পরিবর্তন কাঁকড়ার জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অণুজীবের (Microbes pathogens- Virus, Bacteria, Fungus) প্রভাব বাড়তে পারে, এর ফলে কাঁকড়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। আর পরিবেশগত দূষণ তো আছেই, যার মাধ্যমে বিষাক্ত যৌগ দূষণ বাড়াতে এবং কাঁকড়ার বাসস্থান ও শরীরকে দূষিত করতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে খাদ্যতালিকা থেকে শুধুমাত্র একটি পুষ্টিকর খাদ্য হারিয়ে যাবে তা নয়, যে সকল মানুষ কাঁকড়া ধরা এবং চাষের মাধ্যমে জীবনযাপন করেন তাঁদের জন্যেও প্রতিকূল অবস্থা তৈরী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই এই বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৫: ফার্মেন্টেড ফুড (Nutrition security and food - Part-5: Fermented foods)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

ইতিপূর্বে পুষ্টি সুরক্ষা ও খাদ্য সংস্থান সম্পর্কিত ৪ টি পর্ব লিখেছি, সেখানে মিলেট, শাক, ডাল ইত্যাদির বিষয়ে উল্লেখ করেছি। আজ এই পর্বে একটু অন্য প্রকারের খাদ্যের কথা উল্লেখ করবো, যা বহুলভাবে ব্যবহৃত হলেও অতটা পরিলক্ষিত হয় না। ফার্মেন্টেড ফুড (Fermented foods) বা সন্ধানীকৃত খাদ্য এবং পানীয়ের কথা বলছি। ফার্মেন্টেড খাদ্যের উদাহরণ কিন্তু অনেক আছে, তবে সবার আগে যা আমাদের মনে আসে তা হলো টক দই বা ইওগার্ট (Yogurt)ছোটবেলা থেকেই আমরা বাড়িতে টক দই পাততে দেখি, একটি দইয়ের সাজি নিয়ে তাতে ঈষদুষ্ণ দুধ দিয়ে উনুনের আঁচের পাশে রেখে দেওয়া হয়, পরদিন তা চাক বেঁধে দইতে রূপান্তরিত হয়। 

গরম কালে তো নিয়মিত আমাদের দেশের লোকেরা টক দই খেয়ে থাকেন, তবে বিভিন্ন প্রদেশে খাওয়ার ধরণ কিছুটা আলাদা। নান তৈরির সময়েও আটা বা ময়দাকে ইস্ট (Yeast) সহযোগে ফার্মেন্ট করা হয়ে থাকে। আবার কেউ যদি উত্তর পূর্ব ভারতে ভ্রমণ করেন এবং সেই স্থানের বিভিন্ন খাদ্যরীতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হয়ে থাকেন, তবে দেখবেন সেই স্থানের কয়েকটি জাতির মধ্যে সয়াবিন (Soybean), বাঁশের আগা (Bamboo shoot) ফার্মেন্ট করে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। যাঁরা ফার্মেন্টেড বাঁশের আগা সম্বন্ধে পরিচিত নন, তাঁদের কাছে প্রথম দিকে এর একটি গন্ধ অনুভূত হতে পারে। প্রথমে এই গন্ধটি উপভোগ্য না হলেও পরবর্তীতে এই গন্ধটি একটি আকর্ষণে পরিণত হয়। গরুর দুধ, বিশেষত চমরিগাইয়ের (Yalk) দুধ দিয়ে ফার্মেন্টেশন পদ্ধতিতে ছুরপি (Churpi) প্রস্তুত করা হয়ে থাকে, যা বেশ পুষ্টিকর এবং উপাদেয়। এবার আমি দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি ফার্মেন্টেড খাদ্যের কথা বলি। এদেশে সবার আগে যে ফার্মেন্টেড খাদ্যটির নাম মনে আসে সেটি হলো কিমচি (Kimchi) কিমচি ছাড়া এদেশের মানুষের কোনো আহারই সম্পূর্ণ হয় না। এই কিমচি কিন্তু ন্যাপা ক্যাবেজকে (Napa cabbage) ফার্মেন্ট করে তৈরী করা হয়। 

এছাড়াও রয়েছে সয়াবিন দিয়ে প্রস্তুত বিভিন্ন ফার্মেন্টেড খাদ্য যেমন ছোঙ্গকুকজাং (Chongkukjang: সিদ্ধ করা সয়াবিনকে অল্প সময়ের জন্যে Bacillus subtilis এবং খড় (Rice straw) ব্যবহার করে ফার্মেন্ট করে প্রস্তুত করা হয়), দোয়েনজাং (Doenjang: সয়াবিনকে প্রাকৃতিক ভাবে নানান ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ফার্মেন্ট করে প্রস্তুত করা হয়), গানজাং (Ganjang: সয়াবিন সস যা ফার্মেন্টেড সয়াবিন থেকে প্রস্তুত করা হয়) , ঘোচুজাং (Gochujang: লাল লঙ্কার পেস্ট কে ফার্মেন্ট করিয়ে প্রস্তুত করা হয়) (Patra et al., 2016)। শশা এবং মুলোকেও ফার্মেন্ট করা এখানে প্রচলিত।প্রতিদিনই এই খাদ্যগুলি আমার আহারে থাকে। অতএব বোঝা গেলো আমরা ফার্মেন্টেড খাদ্য সম্বন্ধে আমরা সকলেই কম বেশি অবহিত।

ফার্মেন্টেড সয়াবিনের পেস্ট দিয়ে প্রস্তুত স্টু (Fermented soybean stew with tofu and vegetables)

বর্তমানে খুব প্রোবায়োটিক-র (Probiotic) কথা শোনা যায়, প্রোবায়োটিক আসলে এমন কিছু অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক) যা আমাদের শরীরের মধ্যে থেকে নানান উপকার সাধন করে। ফার্মেন্টেড খাদ্যবস্তু যে বর্তমান সময়কালে প্রচলিত তা নয় বরং প্রাচীন সভ্যতাগুলির  দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যাবে ফার্মেন্টেশন পদ্ধতির আবিষ্কার এবং ব্যবহার সেই সময়েও উল্লেখযোগ্যভাবে ছিল (Prajapati and Nair, 2017, cited from RockEDU)। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। প্রায় ৭০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন চৈনিক সভ্যতায় কুই (Kui) প্রস্তুতের পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছিল। এই কুই হলো ভাত, মধু, আঙ্গুর, এবং হথর্ন (Hawthorn) নামক এক প্রকার হার্ব (Herb) থেকে ফার্মেন্ট পদ্ধতিতে প্রস্তুত পানীয়। একবার আমার ইথিওপিয়ার সহকর্মীরা মধুকে গেসো (Gesho, ইথিওপিয়ান স্থানীয় নাম, বিজ্ঞানসম্মত নাম Rhamnus prinoides) নামক এক প্রকার হার্বের সহযোগে ফার্মেন্ট করিয়ে তেজ (Tej) প্রস্তুত করেছিলেন। ইথিওপিয়ায় তেজ একটি জনপ্রিয় পানীয়। এটি বেশ সুস্বাদু, সাধারণ বিয়ারের ন্যায় তেতো নয়, বরং টক মিষ্টি একটা স্বাদ আছে। ৪৩০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় বিয়ার (Beer) প্রস্তুতের পদ্ধতির উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার মিশরীয় সভ্যতায় যে রুটি এবং বিয়ার প্রস্তুতের জন্যে যে ইস্ট ব্যবহৃত হতো তা সর্বজন বিদিত। সেই স্থান থেকেই ভারতবর্ষে ইস্টের আগমন বলে ধারণা করা হয় এবং আজ বিভিন্ন প্রকার নান রুটি তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে শশা (Cucumber) কে ফার্মেন্ট করিয়ে আঁচার তৈরির উল্লেখ পাওয়া যায় প্রায় ২০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ সময়কালে। বিভিন্ন ধরণের সব্জির ফার্মেন্টেশন প্রাচীন চৈনিক সভ্যতায় বেশ প্রচলিত ছিল। চায়ের (Tea) ফার্মেন্টেশন পদ্ধতি কিন্তু চীনেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। বর্তমানে জাপানে যে কম্বুচা-র (Kombucha) প্রচলন রয়েছে তা কিন্তু অনেক পরে আসে। আমাদের দেশেও চালের গুঁড়োকে ফার্মেন্ট করিয়ে ব্যাটার প্রস্তুত করা হয় যা দিয়ে দোসা ইত্যাদি খাবার বানানো হয়ে থাকে, এও প্রায় সহস্রাধিক বছর ধরেই প্রচলিত।   

সুপ্রাচীন কাল থেকে ফার্মেন্টেড খাদ্য ও পানীয়ের প্রচলন থাকলেও এর পশ্চাতের বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের ধারণা কিন্তু খুব পুরোনো নয়। এই বিষয়ের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয় ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের (Louis Pasteur) পর্যবেক্ষণ থেকে। এইবার এই ফার্মেন্টেশন পদ্ধতি সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিই। কোষীয় শ্বসনে গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis) একটি স্থায়ী প্রক্রিয়া। সকল জীবেই এই প্রক্রিয়াটি দেখা যায়। এই পাথওয়েটির (Biochemical Pathway) মাধ্যমে একটি গ্লুকোজ অণু (Glucose) দুইটি পাইরুভেট অণুতে (Pyruvate) পরিণত হয়। এইবার এই পাইরুভেট অণুগুলির কি হবে তা নির্ভর করে একটি বিষয়ের উপর। বিষয়টি হলো অক্সিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি। অক্সিজেন যখন ইলেক্ট্রন গ্রহণকারী (Electron accepter) হিসেবে উপস্থিত থাকে তখন পাইরুভেট এরোবিক শ্বসনে (Aerobic respiration) অর্থাৎ ক্রেবের সাইকেল (Kerb’s cycle) এবং ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেনে (Electron transport chain) অংশগ্রহণ করে এবং ATP উৎপাদন করে। অপরপক্ষে, যখন অক্সিজেন অনুপস্থিত থাকে তখন পাইরুভেট অণুগুলি সন্ধান প্রক্রিয়ায় (Fermentation) অংশগ্রহণ করে। এই সন্ধান প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া অংশগ্রহণ করে। কয়েক প্রকার ব্যাকটেরিয়া যারা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এবং অনুপস্থিতিতে, দুই ক্ষেত্রেই, সক্রিয় থাকতে পারে তাদের ফ্যাকালটেটিভ ব্যাক্টেরিয়া (Facultative bacteria) বলা হয়। আর যে সকল ব্যাক্টেরিয়া কেবলমাত্র অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে সক্রিয় থাকে এবং এনএরোবিক শ্বসনে (Anaerobic respiration) অংশ নেয় তাদের অব্লিগেটরি ব্যাকটেরিয়া (Obligatory anaerobes) বলা হয়। সন্ধান প্রক্রিয়ায় পাইরুভেট থেকে ল্যাকটিক অ্যাসিড (Lactic acid), এসিটিক অ্যাসিড (Acetic acid), প্রোপিওনিক অ্যাসিড (Propionic acid), ইথানল (Ethanol) তৈরী হয়ে থাকে। সন্ধান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যাক্টেরিয়াদের শরীরে বিভিন্ন রকমের উৎসেচক বা এনজাইম (Enzyme) থাকে (এটি তাদের বিশেষত্ব) যা পাইরুভেট থেকে এই যৌগগুলি উৎপন্ন করতে সাহায্য করে। যেমন দুধ থেকে দই প্রস্তুত করতে ল্যাক্টোব্যাসিলেলি (Lactobacillales) অর্ডারের ব্যাকটেরিয়া প্রয়োজন কারণ এদের দেহে ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজেনেজ (Lactate dehydrogenase) উৎসেচক থাকায় তা পাইরুভেট থেকে ল্যাকটেট প্রস্তুত করতে পারে  

ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় খাদ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সাধারণ দানা শস্য যেমন ভাত, গম, যব, ভুট্টা ইত্যাদিকে যখন ফার্মেন্ট করা হয় তখন এদের পুষ্টিমান বৃদ্ধি পায়। সাধরণত জলের মধ্যে রেখে ২৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এদের ফার্মেন্ট করা হয়। এর ফলে যে ব্যাকটেরিয়া এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে তাদের শরীরে থাকা উৎসেচকগুলি ব্যবহৃত হয় এবং অনেক যৌগ উৎপাদন করে যা মানুষের দেহে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। সাধারনত দানা শস্যগুলিতে লাইসিনের (Lysine) মাত্রা কম থাকলেও ফার্মেন্টেশনের ফলে এই অ্যামিনো অ্যাসিডটির (Amino acid) মাত্রা বৃদ্ধি পায় (Gilliland, 1990) ফার্মেন্টেড সয়াবিনের আটাতে (Soybean flour) প্রোটিনের (Protein) পরিমান বৃদ্ধি পায় (Li et al., 2020) প্রোটিন তৈরী হয় অ্যামিনো অ্যাসিড দ্বারা, কাজেই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। লাইসিনের পরিমান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এর সাথে অন্যান্য বেশ কয়েকটি অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড (Essential amino acid) যেমন লিউসিন (Leucine), হিস্টিডিন (Histidine), সালফার যুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিড (মিথিওনিন (Methionine), সিস্টিন (Cysteine)), থ্রিওনিন (Threonine), অ্যারোমাটিক অ্যামিনো অ্যাসিড (ফেনিলএলানিন (Phenylalanine) এনং টাইরোসিন (Tyrosine))-র মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আবার অ-অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড (Non-essential amino acid) যেমন গ্লুটামিক অ্যাসিড (Glutamic acid), এসপার্টিক অ্যাসিড (Aspartic acid), আরজিনিন (Arginine), এলানিন (Alanine), গ্লাইসিন (Glycine)-র মাত্রাও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় (Li et al., 2020) কুইনোয়া বীজের (Quinoa seed) ক্ষেত্রেও একই রূপ চিত্র দেখা যায়, এক্ষেত্রেও প্রোটিন মাত্রা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে (Li et al., 2018) প্রত্যেকটি অ্যামিনো অ্যাসিডের দিকে দেখলে দেখা যাবে ফার্মেন্টেড সয়াবিনের ন্যায় ফার্মেন্টেড কুইনোয়া বীজেতেও অ্যামিনো অ্যাসিডগুলির অনেকেরই মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র প্রোটিন বা অ্যামিনো অ্যাসিড নয়, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যৌগের পরিমান বাড়ে। উদাহরণ হিসেবে, ফার্মেন্টেড সয়াবিনে বিটা-ক্যারোটিনের (β-carotene) পরিমান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ফার্মেন্টেড কুইনোয়া বীজেতে ভিটামিন B, এবং B২ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় (Li et al., 2020) ফার্মেন্টেশনের সময়ের সাথে ফেনোলিক যৌগগুলির (Phenolic compounds) পরিমাণও কিন্তু বাড়তে দেখা যায় (Li et al., 2018; 2020) আবার অপরপক্ষে কিছু পদার্থের পরিমান হ্রাস পায়। যেমন ফাইবারের পরিমান হ্রাস পায় কারণ ব্যাক্টেরিয়াগুলিতে সেলুলোজ বা হেমি-সেলুলোজ ভঙ্গকারী উৎসেচকের উপস্থিতি (Li et al., 2018; 2020) সয়াবিন যে অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্ট (Anti-nutrient) ট্রিপসিন ইনহিবিটর (Trypsin inhibitor) ধারণ করে, ফার্মেন্টেশনের ফলে তা হ্রাস পেয়ে থাকে (Li et al., 2020)

খাদ্যবস্তুর ফার্মেন্টেশনের জন্যে প্রধানত স্যাকারোমাইসিস (Saccharomyces) গণের ছত্রাক (Leo et al., 2021), বিফিডোব্যাক্টেরিয়াম (Bifidobacterium) এবং ল্যাক্টোব্যাসিলাস (Lactobacillus) গণের ব্যাকটেরিয়া বহুল ব্যবহৃত, এদের একাধিক প্রজাতি রয়েছে (Gomes and Malcata, 1999) পূর্বেই উল্লেখ করেছি এই সকল ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীবের শরীরে উপস্থিত বিভিন্ন উৎসেচকের সাহায্যে। আমরা যদি অণুজীবের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে এই বিষয়ে বোঝা সম্ভব, আমরা দেখবো এমন অনেক জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া তাদের দেহে উপস্থিত  যা মানুষের দেহে অনুপিস্থিত। কাজেই তারা এমন অনেক যৌগ তৈরী করতে পারে যা মানুষের প্রয়োজনীয় হলেও মানুষ তা সংশ্লেষ করতে পারে না। একটি সহজ ধারণা দেওয়ার জন্যে আমি এটি উল্লেখ করলাম তবে বিশদে বলে ব্লগটিকে ভারাক্রান্ত করবো না। আশা করি ফার্মেন্টেড খাদ্য সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত সরল ধারণা দিতে পারলাম।

তথ্যসূত্র (References):

Gilliland, S.E. 1990. Health and nutritional benefits from lactic acid bacteria. FEMS Microbiology Reviews 87: 175-188.

Gomes, A.M.P.; Malcata, F.X. 1999. Bifidobacterium spp. and Lactobacillus acidophilus: biological, biochemical, technological and therapeutical properties relevant for use as probiotics. Trends in Food Science and Technology 10: 139-157.

Leo, V.V. et al., 2021. Saccharomyces and their potential applications in food and food processing industries. In: Abdel-Azeem, A.M.; Yadav, A.N.; Yadav, N.; Usmani, Z. (Eds.), Industrially Important Fungi for Sustainable Development. Fungal Biology. Springer, Cham. https://doi.org/10.1007/978-3-030-67561-5_12 

Li, S.; Chen, C.; Ji, Y.; Lin, J.; Chen, X.; Qi, B. 2018. Improvement of nutritional value, bioactivity and volatile constituents of quinoa seeds by fermentation with Lactobacillus casei. Journal of Cereal Science 84: 83-89. https://doi.org/10.1016/j.jcs.2018.10.008

Li, S.; Jin, Z.; Hu, D.; Yang, W.; Yan, Y.; Nie, X.; Lin, J.; Zhang, Q.; Gai, D.; Ki, X.; Chen, X. 2020. Effect of solid-state fermentation with Lactobacillus casei on the nutritional value, isoflavones, phenolic acids and antioxidant activity of whole soybean flour. LWT 125: 109264. https://doi.org/10.1016/j.lwt.2020.109264

Patra, J.K.; Das, G.; Paramithiotis, S.; Shin, H-S. 2016. Kimchi and other widely consumed traditional fermented foods of Korea: A review. Frontiers in Microbiology 7: 3389. https://doi.org/10.3389/fmicb.2016.01493

Prajapati, J.B.; Nair, B.M. 2017. The history of fermented foods. Handbook of Fermented Functional Foods, edited by Farnworth E.R. 2nd Edition, CRC Press, pp. 1-22.

RockEDU. History and Biochemistry of Fermented Foods. www.rockedu.rockfeller.edu/component/biochemistry-fermented-foods/ accessed 21st January 2023.


সোবেকসান ট্রেক (Sobaeksan trek)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

আমি যে খুব ট্রেকিং প্রিয় মানুষ তা নয়, তবে বিগত কয়েক বৎসর ধরে, মানে আমার দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাসের সময়কালের মধ্যে, বৎসরান্তে একবার গবেষণাগারের সকলের সাথে আমি কোনো না কোনো পর্বতে হাইকিং করতে যাই। করোনা মহামারীর পূর্বে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গিয়েছিলাম সোবেকসানে (সোবেক পর্বতে, কোরিয়ান 'সান' শব্দটির অর্থ পর্বত), আবার ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসেও আমরা গিয়েছিলাম ওই পর্বতে। তবে পার্থক্য ছিল সেবার যাওয়া-আসার পথটি এবার আসা-যাওয়ার পথ ছিল, অর্থাৎ সেবার যে পথে পর্বতের শিখরে পৌঁছেছিলাম এবার সে পথে শিখর থেকে নিচে নেমেছিলাম, আর যে পথে সেবার নেমেছিলাম এবার সে পথে উঠেছিলাম। এবার এই স্থান সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক। প্রায় ৩২২.৪ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে গড়ে ওঠা সোবেক পর্বত দক্ষিণ কোরিয়ার একটি জাতীয় উদ্যান। জিরিসান (Jirisan) এবং সিওরাকসানের (Seoraksan) পর এটি তৃতীয় পর্বতীয় জাতীয় উদ্যান (আমি পূর্বে একটি ব্লগে বিভিন্ন প্রকার জঙ্গল বা বনভূমি নিয়ে আলোচনা করেছি)। অন্যান্য পর্বতের ন্যায় এই পর্বতেরও একাধিক শিখর রয়েছে, যেমন বিরবং (Birobong-1,439.5 মিটার), গুঙ্গমংবং (Gungmangbong-1,420.8 মিটার), ইয়নহুয়াবং (Yeonhwabong-1,383 মিটার), দশলবং (Dosolbong-1,314.2 মিটার)। এই পর্বতীয় জাতীয় উদ্যানটি তিনটি প্রদেশের যথা গিয়ংসাংবুক (Yeongju/ ইয়ংজু শহর), চুংছেওংবুক (Danyang/ দানিয়াং শহর), এবং গ্যাংওয়ান (Yeongwol/ ইয়ংওল শহর) সীমানা স্পর্শ করে বিস্তৃত রয়েছে। ইয়ংজু শহরের সন্নিকটের উপত্যকাগুলির মধ্য দিয়ে নাকদংগাং (নাকদং নদী, কোরিয়ান শব্দ 'গাং' শব্দটির অর্থ নদী), এবং দানিয়াং শহরের সন্নিকটের উপত্যকাগুলির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে নামহাংগাং বা নামহাং নদী। এই জাতীয় উদ্যানটিতে রয়েছে প্রায় ১০৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ এনং ২৬৩৯ প্রজাতির প্রাণী। তবে অধিক ঠান্ডার কারণে আমি যাত্রাপথে কোনো প্রাণী দেখতে পাইনি। ২০০৭ সালে IUCN ইকোলজিকাল ভ্যালু (Ecological value) বা পরিবেশগত গুরুত্ব বিচার করে সোবেকসানকে IUCN ক্যাটেগোরি-II জাতীয় উদ্যান হিসেবে চিহ্নিত করে।

সোবেকসানের সর্বোচ্চ শিখর বিরবং, উচ্চতা ১৪৩৯ মিটার। যাঁরা আমাদের দেশে পর্বত ট্রেক বা হাইকিং করে থাকেন এ উচ্চতা তাঁদের নিকট নেহাৎই যৎসামান্য, তবে নাতিশীতোষ্ণ (Temperate) অঞ্চলে যে ভৌগোলিক অবস্থানে এই পর্বতটি অবস্থিত সে স্থানে ডিসেম্বর মাসে তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আসে পাশে থাকে, কাজেই বেশ ঠান্ডা। পূর্বের বৎসরটিতে (২০১৯ সালে) আমরা আগের দিন দুপুরে পর্বতের পাদদেশ থেকে রওনা হয়ে প্রায় ৩ ঘন্টা ট্রেক করে আশ্রয়স্থলে পৌঁছেছিলাম, প্রচন্ড তুষারপাত হওয়ার কারণে সেই রাত্রি আমরা আশ্রয় স্থানে অতিবাহিত করে পরদিন ভোর সাড়ে ৪ টে নাগাদ রওনা হয়ে সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বে পর্বত শিখরে পৌঁছই। 

যেহেতু আমি খুব একটা ট্রেক করিনা, কাজেই সকল ট্রেক কিট বিশেষ করে রান্নার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমার ছিল না। আমরা খাবার, জল ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই উঠেছিলাম, সকলে এই সকল দ্রব্যাদি ভাগ করে নিয়েছিলাম যেন কারও লাগেজ অধিক ভারী না হয়। আশ্রয়স্থলের একদিকে রান্না আর খাওয়ার জন্যে ঘর ছিল। সেখানে সকলে নিজের স্টোভ, পাত্র সব নিয়েই গিয়েছিলো, যে যার খাবার বানিয়ে নিচ্ছিলো। আমাকে স্বাভাবিক কারণেই অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল, যেটা খুব একটা উপভোগ্য ছিল না। বাইরের দেশে স্বনির্ভর হওয়াটাই কাম্য। এখানে একটা কথা উল্লেখ্য যে, পরদিন ভোরে আমরা যখন রওনা হয়েছিলাম সেই স্থান পরিষ্কার করে সকল আবর্জনা আমরা সাথে নিয়ে নিয়েছিলাম, সেই স্থানে কিছুই ফেলে আসিনি। 

সেই অসামান্য আর অনবদ্য সূর্যোদয়ের রূপ বর্ণনা করার শব্দ আমার কাছে নেই। এই প্রত্যুষ মনে এক নব আনন্দের দিগন্ত উন্মোচন করে, মেঘের মধ্যে দাঁড়িয়ে সূর্যের নরম সোনালী আভা যখন দিক থেকে দিকান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে সেই মনোমুগ্ধকর চিত্রকে অনুধাবন করে প্রকৃতি মাতাকে প্রণাম করি। 

এবার (২০২২ সালে) কিন্তু আমরা সূর্যোদয় দেখিনি, আমরা পর্বতের পাদদেশ থেকে আমরা রওনা হয়েছিলাম ভোর ৫ টেতে, কাজেই শীর্ষদেশে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে ৮ টা বেজে যায়।

আমরা পূর্বের দিনটি ইয়ংজু শহরে একটি পেনশন-এ অতিবাহিত করি। এই শহরের ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সেমিনার শেষ হতে দেরি হওয়ায় সেই দিন আমরা রওনা হতে পারিনি। কাজেই পরদিন ভোরবেলা প্রায় চারটের সময়ে প্রাতঃরাশ সেরে আমরা যখন পর্বতের পাদদেশে এসে পৌঁছয় তখন প্রায় ভোর পৌনে ৫ টা। ট্রেকিং উপযোগী পোশাক পরিহিত হয়ে যখন যাত্রা শুরু হলো তখন ৫ টা বাজে।

শুরুর রাস্তা বেশ খাড়াই, প্রথম ৪০ মিনিট বেশ ভালোই বেগ পেতে হয়। এ পথে এই সময়ে শুরু থেকেই আইস ক্লেট লাগিয়ে নেওয়া, পায়ে বটম গার্ড পরে নেওয়া উচিত, আমিও তাই করেছিলাম। তবে আমার সাথে কোনো ট্রেকিং পোল ছিল না, সেটা বেশ মুশকিলের। কিন্তু একটা শক্ত পোক্ত গাছের লম্বা ডাল পেয়ে গেলাম, হয়তো ফিরতি পথে কেউ ফেলে গিয়েছিলো। এই ঠান্ডায় আর্দ্রতার লেশ মাত্র নেই, কাজেই গাছের ডাল গুলি খুবই শুষ্ক ও ভঙ্গুর কিন্তু আমার লাঠিটি বেশ শক্তই ছিল এবং এতে আমার বেশ সুবিধা হয়েছিল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক রুট করা রয়েছে। হাঁফাতে হাঁফাতে চলেছি সেই পথে, চারিদিক খুব অন্ধকার। 

অত্যাধিক ঠান্ডায় একটা সুবিধা হলো কোনো প্রকার জীবজন্তু এই সময় খুব একটা এসে পরে না। আমার কাছে কোনো টর্চ ছিল না, তবে কয়েকজন সাথীর সাথে তা ছিল। বরফ প্রায় ফুট খানেক হবে এবং স্থানে স্থানে তা আরও বেশি। আমি প্রচন্ড ক্লান্ত পড়েছিলাম প্রথম ঘন্টায়, কাজেই পথের পাশে বসে পড়েছিলাম, কয়েক মিনিটের বিশ্রাম আবার পথ চলা। একটা ছোট মোনোপড আমি নিয়ে গিয়েছিলাম, তবে তা সেট করে ছবি তুলতে দস্তানার মধ্যে থেকে হাত বের করতেই ঠান্ডায় অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হচ্ছিলো (দস্তানার ভিতর থেকে আমার আঙ্গুল ফোনের ক্যামেরা সেট করতে ঠিক করে কাজ করছিলো না), কাজেই ফটো তোলা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছিলো অন্ধকারে, বরং আলো ফুটলে তা কিছুটা সহজ হলো। এই জঙ্গলে ডেসিডুয়াস উদ্ভিদের প্রাধান্য চোখে পড়ার মতন, শীতে তাদের সকল পাতা ঝরে গেছে, তারা পত্রশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে স্থানে স্থানে কনিফেরাস উদ্ভিদও রয়েছে, তাদের পত্রগুলি সূঁচের ন্যায় অভিযোজিত হওয়ায়, পরিধি কম হওয়ায় তা থেকে সমস্ত জল বেরিয়ে যায়নি ফলে সেগুলি শুষ্ক হয়ে যায়নি। এবার ধীরে ধীরে স্বর্ণাভ আভা ছড়িয়ে পড়ছে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করলাম। গাছের ডালের মধ্যে দিয়ে কমলা বর্ণের সূর্য। 

চলা, কখনও একটু বিশ্রাম, ছবি তোলা, আবার চলা। হঠাৎ চোখে পড়লো অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অব্জার্ভেটরি, নতুন উদ্যম এলো, এ পথ আমার জানা, এর পর আর সামান্য পথ অতিক্রম করলেই শিখরে পৌঁছবো আমরা। প্রায় চার ঘন্টা ট্রেক করে আমরা পৌঁছলাম শীর্ষে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য। তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের থেকেও কম। এবার কিছুটা জল খেয়ে বেশ ফিট লাগলো।


কিছুক্ষন কাটিয়ে ফেরার রাস্তা ধরা।  ফেরার পথ চওড়া, তবে প্রায় দেড় থেকে দুই ফুট বরফে ঢাকা। ফেরার পথ ঢালু তবে তা কিন্তু খুব সহজ নয়, ঢালু পথে চলতে বেশ চাপ পরে, আর খেয়াল রাখতে হয় পিছলে যেন না পড়ি, তাহলেই বড়ো মুশকিল। 



যখন প্রান্তদেশে এসে পৌঁছলাম তখন প্রায় বেল বারোটা বাজে। এবারের মতন বিদায় সোবেকসান।  সবাই খুব ক্লান্ত, এবার দ্বিপ্রাহরিক আহার সারতে হবে আর তারপর বাড়ি ফেরা। 


ডিসেম্বর ২০১৯, ডিসেম্বর ২০২২



রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...