সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের মৃত্তিকার প্রতিটি কণায় কান পাতলে শোনা যায় তার ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, আর দর্শন। এই বৈচিত্র্যময়তার সাথে একাত্মতা অনুভব করেই আমরা সেইস্থানের মাহাত্ম্য অনুধাবন করি।
অধ্যাপনার কাজে মধ্যপ্রদেশে কিছুকাল থাকার সুবাদে সেই স্থানের বেশ কয়েক জনজাতির মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। এদের মধ্যে ছিলেন বাইগা (Baiga), মাড়িয়া (Madia), করকু (Korku), গোন্ড (Gond) ইত্যাদি। বালাঘাট জেলার বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলি আমি ঘুরেছি, মানুষের সাথে মিশেছি, আমার আগ্রহ ছিল আদিবাসী মানুষদের খাদ্য, পুষ্টি, এবং এই সম্পর্কিত জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অবহিত হওয়া। যে কোনো জনজাতির দিকে লক্ষ্য করলে একটা সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থান পরিলক্ষিত হয় যা সাধারণভাবে কম-বেশি সেই জনজাতির সকল মানুষের জন্যে অনেকটা এক রকম। তবে গোন্ড জনজাতির মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু অন্য রকম। তাঁদের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বৈচিত্র্য (variation) দৃষ্টিগোচর হয়। অন্যান্য আদিবাসী মানুষের মতন একটা বড় অংশের গোন্ড মানুষ প্রকৃতির সাহচর্যে বাস করেন, জীবনধারণের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলি প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করেন, আবার আর একটি অংশের মানুষ চাষবাস এবং পশুপালন করেন, আবার কেউ ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি করে থাকেন। এই বৈচিত্র্যের কারণ অনুসন্ধানের জন্যে মধ্য ভারতের ইতিহাসের দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন, তবে সে ইতিহাসের বিস্তারিত উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। এই ব্লগে আমি একটি ছোট্ট শহর লাঞ্জি বেড়ানোর কথা বলবো, আর এখানেই বারবার ফিরে ফিরে আসবে গোন্ড রাজত্বের কথা। আজকের লাঞ্জি, অতীতে কালাচুরি বংশের রাজত্বকালে পরিচিত ছিল লাঞ্জিকা নামে। ইতিহাস তিনটি কালচুরি রাজবংশের উল্লেখ পাওয়া যায়, যথা (১) সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতকের ত্রিপুরীর কালাচুরি রাজবংশ যারা চেদি অঞ্চল তথা বর্তমানের বুন্দেলখন্ড থেকে দক্ষিণে যমুনা নদী আর কেন নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল শাসন করতেন, (২) একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের রত্নপুরার কালাচুরি রাজবংশ যারা রত্নপুরা (বর্তমানের বিলাসপুর) থেকে ছত্তিশগড় অঞ্চল শাসন করতেন আর (৩) দ্বাদশ শতকের কল্যাণীর কালাচুরি রাজবংশ যারা উত্তর কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্র অঞ্চল শাসন করতেন। লাঞ্জি ছিল এই রত্নপুরার কালাচুরি রাজবংশের অধীনস্থ। এর পর কালাচুরি রাজবংশকে পরাজিত করে রাজা যদুরাই প্রতিষ্ঠা করেন গোন্ড রাজবংশ। সম্রাট আকবরের সময়ের আইন-ই-আকবরীতেও লাঞ্জির উল্লেখ রয়েছে, তখন এটি ছিল একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র বা মহাল।
দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে বালাঘাট থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ছোট্ট এই শহর লাঞ্জিতে প্রবেশ করে প্রথমেই দর্শন করলাম লাঞ্জকাই মাতার মন্দির। এরপর এ স্থানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ লাঞ্জি দুর্গে যখন এসে পৌঁছলাম তখন বেলা দু'টো। আমার অনেক বিদেশী বন্ধুরা অনেক সময় আমায় জিজ্ঞেস করেছেন যে আমার দেশে নাকি রাস্তায় মানুষ আর গরু একত্রে যাতায়াত করে। বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁরা এরূপ চিত্র দেখেছেন। তাঁরা বেশ উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করেন এতে অসুবিধা হয় না ! আমি হাসি, কথা সত্য, গ্রাম ভারতে এ চিত্র কষ্টকল্পনা নয়। ভারতের মনন, এর দার্শনিক গভীরতা উপলব্ধির, তা যে সংক্ষেপে বর্ণনা করা যায় না। গরু বা মহিষের পালের সাথে সাথে পথ চলা, হর্ন দিয়ে তাদের সরিয়ে গাড়ির যাত্রাপথটুকু বের করে নেওয়া, কখনও গাড়ি থেকে নেমে 'হুস-হুস' করে রাস্তার উপরে বিশ্রামরত গরু বাছুর সরানো, দেরী হওয়ার কারণে বিরক্ত হওয়া আবার গরু বা মহিষের কান্ড দেখে হেসে ফেলা, এসবই আমাদের যাত্রাপথের উপাদান, এ অভিজ্ঞতা দৈনন্দিনের। এভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা।
পৌঁছলাম প্রাচীন দুর্গে।
কে এই দুর্গটি স্থাপন করেছিলেন এবং কোন সময়ে সেই সংক্রান্ত নির্ভর করার মতন কোনো ঐতিহাসিক তথ্য আমি খুঁজে পাইনি (যা পেয়েছি সেই সকল তথ্যের কোনো রেফারেন্স আমি পাইনি) কাজেই তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি। ভবিষ্যতে যদি কোনো ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারি তবে তা নিশ্চয়ই উল্লেখ করবো।
প্রবেশের মূল ফটকের মধ্যে দিয়ে প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়লো এক বিরাট গাছ আর তাতে প্রায় গোটা ত্রিশ মৌমাছির চাক। এগুলি Apis dorsata প্রজাতির মৌমাছির চাক। এ অঞ্চলে গাছে অনেক মৌচাক লক্ষ্য করা যায়। রাস্তায় সদ্য চাক ভাঙা মধু বিক্রী হতে আমি অনেক বার দেখেছি।
প্রায় সাড়ে সাত একর জায়গার উপর গোন্ড রাজত্বের সময়কালের এই দুর্গ আজও তৎকালীন ইতিহাস, স্থাপত্য, এবং ভাস্কর্যের সাক্ষী বহন করে চলেছে। বর্তমানে দুর্গটির নানান অংশ ভগ্নপ্রাপ্ত এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এটিকে রক্ষণাবেক্ষন করছে। দুর্গের প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় 20 ফুট এবং চার কোণে ইট নির্মিত চারটি বুরুজ ছিল, যদিও বর্তমানে মাত্র দুটি দেখা যায়।
দুর্গের প্রাচীর গাত্রে খোদিত ভাস্কর্য, মূর্তিগুলি সেই সময়ের উন্নত শিল্পকলার নিদর্শন। তবে এগুলির বিশেষ সংরক্ষণ প্রয়োজন।
দুর্গের চারপাশে একটি গভীর পরিখার অবশিষ্টাংশ এখনও দেখা যায়। দুর্গটিকে রক্ষা করার জন্যে পরিখায় কুমির রাখা হতো বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন।
প্রাঙ্গনে রয়েছে বেলেপাথর নির্মিত পূর্বমুখী একটি মন্দির। মন্দিরটিতে রয়েছে তিনটি প্রকোষ্ঠ। গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারটি অলংকৃত এবং সুন্দর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত। মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রস্তর নির্মিত মূর্তিগুলি উন্নত ভাস্কর্যের পরিচায়ক। আজ দীপাবলি, তাই মন্দির প্রাঙ্গনে এক মহিলা এবং একটি মেয়ে রঙ্গোলি বানাচ্ছেন।
আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য কোটেশ্বর মহাদেব ধাম। শ্রী দাদা কোটেশ্বর দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে এগিয়ে যেতে হবে কোটেশ্বর মহাদেব ধামের উদ্দেশ্যে। প্রতি বৎসর শ্রাবণ মাসে এখানে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। মন্দির চত্বরে, আশেপাশের গাছে রয়েছে অনেক মৌচাক। মন্দির ভবনে প্রবেশ করে সামনের দিকে একটু এগোলেই দেখে যাবে কুন্ড যেখানে শিবলিঙ্গ অবস্থান করছেন। এটি ভূমির থেকে কিছুটা নিচে অবস্থিত হাওয়ায় ভগবান দর্শন এবং পূজাপাঠের জন্য সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। মূল মন্দিরটি মূলত প্রস্তর নির্মিত, মন্দিরটি প্রদক্ষিণের সময় এটি স্পষ্ট হয়। মন্দিরগাত্রের উন্নত শিল্পকলার পরিচায়ক প্রস্তর ভাস্কর্যগুলি সহজেই আকর্ষণ করে।
ফেরার পথে দেখে নিতে পারেন হাট্টা কি বাওলি। তবে আমাদের ফিরতে দেরি হওয়ার কারণে এটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এই বাওলিটিও স্থাপিত হয় সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়কালের মধ্যে। গোন্ড রাজা হাটটে সিং ভালকে বাওলিটি খনন করান। পানীয় জল, স্নান এবং ব্যবহারের জল, সৈন্যদের অবস্থান- এই সকল কাজের জন্যে দ্বিতলীয় প্রস্তর নির্মিত বাওলিটি এর স্থাপত্যের কারণে একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য। আশা করি সময় পেলে আমি পুনরায় সেই স্থানে বেড়াতে যাবো। জনশ্রুতি বাওলিটি থেকে লাঞ্জি দুর্গ পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গপথ রয়েছে। বর্তমানে এটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
এবার ঘরে ফেরা। দীপাবলির প্রদীপ জ্বালানো, রঙ্গোলি বানানো ইত্যাদি নানান কাজের মধ্যে দিয়ে বেশ কাটলো দিনটা।
পরিশেষে বলি, বালাঘাট এবং তৎসংলগ্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলি অন্য রাজ্যের পর্যটকদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। কাজেই এগুলি পরিদর্শন করা হয়ে ওঠে না। অনেকেই কান্হা ন্যাশনাল পার্কে (Kanha National Park) বেড়াতে যান। কলকাতা থেকে ট্রেনে কান্হা ন্যাশনাল পার্ক যাওয়ার অন্যতম সহজ উপায় গোন্ডিয়া জানক্শনে (Gondia Junction railway station) নেমে ৪৫ কিলোমিটার দূরে বালাঘাট (Balaghat) পৌঁছনো। বালাঘাট শহর থেকে কান্হা টাইগার রিসার্ভের দূরত্ব মাত্র ৮০-৮৫ কিলোমিটার, সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন ফরেস্টের প্রবেশদ্বারে। বালাঘাট শহরে রয়েছে একাধিক হোটেল, রেস্তোরাঁ। যাতায়াতের পথে এক বা দুই দিন এই শহরটিতে কাটিয়ে সহজেই দেখে নিতে পারেন কাছেপিঠের দর্শনীয়স্থানগুলি।
নভেম্বর, ২০১৮


























