পৃষ্ঠাসমূহ

তাজপুরের জীবনধারা আর উন্নয়ন: একটি ভ্রমণ কাহিনী (Livelihood and Development of Tajpur: A travelogue)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)


পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বঙ্গোপসাগর উপকূলে অবস্থিত তাজপুর পশ্চিমবঙ্গের সৈকত পর্যটনের তুলনামূলক নতুন সংযোজন। দ্বাদশ পরিকল্পনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত যে চারটি পর্যটন বর্তনী (Circuit) শনাক্তকরণ  করা হয়েছিল তার মধ্যে প্রথমটি সৈকত কেন্দ্রিক (দীঘা -শঙ্করপুর - তাজপুর  - জুনপুট - মন্দারমনি) আর আমাদের গন্তব্য তাজপুর, জেলে বসতির উপর আধারিত এই পর্যটন কেন্দ্র। বারাসাত থেকে সকাল ৮ টায় রওনা হয়ে জাতীয় সড়ক ১৬ আর ১৬ধরে কোলাঘাট-নন্দকুমার-কণ্টাই-চালখোলা-বালিসাই হয়ে প্রায় ১৮৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যখন তাজপুর পৌঁছলাম তখন বেলা ১ টা।

মাছের ভেরী, শালুকের জলা পার হয়ে সোজা পৌঁছলাম  সমুদ্রের পাড়ে। অচেনা অতিথিদের উপস্থিতি লক্ষাধিক লাল কাঁকড়া পরিবারকে একটু বিচলিত করলো, লক্ষ্য করলাম আমাদের পায়ের শব্দে একটু বিরাম পড়েছিল তাদের ব্যস্তময় দৈনন্দিন কাজে। দিনের অনেকটা সময় তারা তাদের বাসস্থান বালির গর্তগুলো পরিষ্কার রাখতে বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যয় করে।  গর্তের মুখ থেকে প্রায় ১ ফুট দূর পর্যন্ত বালি বয়ে এনে ফেলে যায়। দীঘা উপকূল বরাবর ৩০ টির ও অধিক প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। বর্ণময়তা আর সংখ্যাধিক্যের কারণে লালকাঁকড়া পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র। আমরা এগিয়ে গেলাম সমুদ্রের আরও কাছে, বিশালতার এই অপরূপ হাতছানিকে উপেক্ষা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব  ছিল না  ভাঁটা চলছে, তাই অনেকটা দূর যেতে হলো সমুদ্র স্পর্শ করতে এবার একটু যেতে হবে পাড়ের দিকে, থাকার সংস্থান আর দ্বিপ্রাহরিক আহার, আর তারপরেই আবার ফিরবো।

আগেই বলেছি তাজপুর পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে নতুন সংযোজন। সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে, তার নমুনা সর্বত্র বিদ্যমান, কোথাও ক্রেন দাঁড়িয়ে, কোথাও বা খানিকটা সিঁড়ি তৈরি হয়েছে, আবার কোথাও রিসোর্ট তৈরির কাজ চলছে আজ যেখানে জেলে ডিঙিগুলি নোঙ্গর করা রয়েছে , অদূর ভবিষ্যতে সেখানেই গড়ে উঠবে বন্দর। 

দীঘার পরিচিত হোটেল সংস্কৃতি থেকে একটু আলাদা তাজপুর। এখানে অধিকাংশই কুটীর (Cottage) জাতীয় আবাসন। বিশালাকায় উন্নত অট্টালিকার পরিবর্তে বেশ সুন্দর বাগান, ছোট্ট পার্ক নিয়ে গড়ে ওঠা কুটীরগুলি একদণ্ড শান্তির জন্যে আদর্শ। পাড়ের কাছে রয়েছে গোটা চব্বিশেক দোকান, বাঁশের কাঠামো, টিন আর পাতার ছাউনি। পছন্দ মতন রান্না করিয়ে খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে সেগুলিতে। পমফ্রেট, ভেটকি, ভোলা, পার্শে, কাঁকড়া, দেশী  মুরগি সবই  মিলবে বাঙালির রসনা তৃপ্ত করতে। সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যেতে যেতে কিছুটা দূর গিয়ে আবারও দেখা মেলে এইরকম আরও কয়েকটি দোকানের। প্রধানত স্থানীয় লোকেরা এই দোকানগুলি চালান। স্থানীয় জনজাতির জীবিকা মূলত মাছধরা বা মৎস পালন। তবে বর্তমানে অনেকেই পর্যটন শিল্পের সাথে যুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পেশাকে বেঁছে নিয়েছেন পর্যটন বাড়ার সাথে সাথে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নতির একটা ইতিবাচক সম্পর্ক চোখে পড়লো, বেশ ভালো লাগলো।



একটু দূরেই রয়েছে মৎসকোঠি। প্রায় ৩০০ পরিবার এখানে মাছ শুকানোর (যা 'শুটকি মাছ' বলেই আমাদের কাছে পরিচিত) কাজে যুক্ত আছেন। বেশ অনেকগুলি পরিবারের সাথে কথা হলো।  জানলাম তাঁদের জীবনধারণের কথা। আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত তাঁরা শুটকি মাছের কাজে নিযুক্ত থাকেন আর অন্য সময়ে আলাদা কাজ বা ছোটোখাটো ব্যবসা করেন।  বুমলা, রুপা পাইত্যা, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি প্রধানত শুকানো হচ্ছে শুনলাম, কয়েকদিন আগের (১৬ থেকে ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৭) বঙ্গোপসাগরের উপরের ঘূর্ণাবর্তের ফলে যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল তাতে শুটকি মাছের এবং স্বভাবতই তাদের জীবিকার খুব ক্ষতি হয়েছে

উন্নয়ন সর্বদা কাম্য। তবে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ জরুরি, প্রাকৃতিক উপাদানের বিনাশ বাঞ্ছনীয় নয়। লাল কাঁকড়ারা অবলুপ্ত হবে না, কচ্ছপের ডিম খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য হবে না, ঝাউ আর কেয়ার জঙ্গল অদৃশ্য হয়ে যাবে না, ঐতিহ্যের সাথে বর্তমানের একীকরণ (Integration) হবে -- এগুলিই হোক উন্নয়নের পরিমাপ, সেটাই আদর্শ সাস্টেনেবল উন্নয়ন (Sustainable development) এবার ফিরতে হবে, তবে আবার আসবো। জানতে আসবো লালকাঁকড়ারা কেমন আছে, শুটকির উপর আঁশখোসি পোকার উপদ্রব কমলো কিনা, আর নাম না জানা ছেলেটার সাথে কচ্ছপের ডিম খুঁজতে যাবো তখন।

অক্টোবর, ২০১৭

দক্ষিণ কোরিয়ার একটি মৎস বন্দর ইয়ংদক ক্র্যাব ভিলেজ-র ভ্রমণ পড়ার জন্য ক্লিক করুন

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের পরবর্তী পর্ব (The next part of the trip to Murshidabad)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের প্রথম পর্বটি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ

সিরাজের মৃত্যুতে অবসান হল আফসার বংশের, ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে নেমে এলো সূর্যাস্ত। শুরু হল মীর জাফর বংশ, ইতিহাসে যা নাজাফী বংশ বলে পরিচিত। ২৪ শে জুন ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে যখন পলাশির যুদ্ধ শেষ হয় আর ২৯শে জুন মীর জাফর মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেন, রবার্ট ক্লাইভ যথার্থই বলেছিলেন এই জয় তাঁর নয় বরং এই জয় মীর জাফরেরসত্যিই সেদিন ইংরেজদের জয় সম্ভব হত না যদি মীর জাফর, ইয়ার লতিফ খাঁ, রায়দুর্লভরা দেশরক্ষার দায়ভার গ্রহণ করে অস্ত্র তুলে নিতেন, বিফল হত জগৎ শেঠদের ষড়যন্ত্র এবং সর্বোপরি  বিস্বাসঘাতকতা যদি না করতেন মীর জাফর। ভাগীরথীর পূর্বপাড়ে রাস্তার বাঁ পাশে অবস্থিত জাফরগঞ্জ প্রাসাদের প্রবেশ দ্বার বর্তমানে জীর্ণদশায় উপনীত। বোন শাহখানামের জন্যে এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন নবাব আলীবর্দি খাঁ। মীর জাফর ছিলেন শাহখানামের স্বামী অর্থাৎ নবাব আলীবর্দি খাঁ-র ভগিনীপতি। প্রবেশ দ্বারে পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি নেই, এই বিজ্ঞপ্তি টাঙানো রয়েছে। মীর জাফরের জীবনের পরিণতি ছিল করুণ, কুষ্ঠ রোগগ্রস্থ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। বাঁচার অন্তিম ইচ্ছে নিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন কিরীটীশ্বরী মন্দিরের দেবীর চরণামৃত! এমনই প্রচলিত লোককথা, এর ঐতিহাসিক প্রমাণ অজানা। সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম এই পীঠ। বিশ্বাস এখানে দেবীর কিরীট (‘কিরীট’ কথাটি ‘করোটি’ থেকে এসেছে) পতিত হয়েছিল নবগ্রামের কিরীটকোনা গ্রামে অবস্থিত সতীপীঠ কিরীটীশ্বরী মন্দির, আমাদের গন্তব্য। দেবী এখানে বিমলা নামে  পূজিত হন।  বর্তমানে নবনির্মিত মন্দিরটির পাশেই পুরোনো ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি অবস্থিত। 


এবার দর্শনীয় হলো হাজারদুয়ারি প্রাসাদ। মুর্শিদাবাদ বলতেই যে হাজারদুয়ারির চিত্র মানসপটে উদ্ভাসিত হয় তা ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব নাজিম হুমায়ুন জা নির্মাণ করেছিলেন। শুনলাম এর নির্মাণ কার্য ১৮২৪ থেকে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল।  প্রাসাদটি পরিকল্পনা করেছিলেন ডানকান ম্যাক লিওড সাহেব। বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ এটি সংরক্ষণ করে। প্রাসাদটির স্থাপত্যশৈলী সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বর্তমানে এর অভ্যন্তরে রয়েছে একটি সংগ্রহালয় যেখানে নবাব আমলে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী যথা আসবাব, চিত্র, বাসন পত্র, অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রবেশমূল্য দিয়ে হাজারদুয়ারি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। পর্যটকরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গাইডদের থেকে জেনে নিতে পারেন হাজারদুয়ারি এবং এর প্রাঙ্গণে উপস্থিত বাচ্চাওয়ালী তোপ, নিজামত ইমামবাড়া, মদিনা মসজিদ ইত্যাদি সম্পর্কিত নানান তথ্য। ইতিহাস, জনশ্রুতি, লোককথা মিশিয়ে গাইডদের পরিবেশন পর্যটকের বেশ আকর্ষণ করে। 


এই মদিনা মসজিদটি নবাব সিরাজ উদ দৌল্লা নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং এটি নির্মিত হয় মক্কা মদিনা থেকে আনা মাটি স্থানীয় মাটির সাথে মিশিয়ে।
 

হাজারদুয়ারীর ঠিক উল্টো দিকে বর্তমানে যে নিজামত ইমামবাড়াটি দেখা যায় সেটি ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব নাজিম মনসুর আলী খান কর্তৃক তৎকালীন সময়ে প্রায় ছয় লক্ষ টাকায় নির্মিত হয়। তবে পূর্বে যে নিজামত ইমামবাড়াটি ছিল সেটি নবাব সিরাজ উদ দৌল্লা নির্মাণ করেছিলেন। জনশ্রুতি, ইমামবাড়াটির ভিত্তিপ্রস্তর নবাব নিজহস্তে স্থাপন করেছিলেন। সেই ইমামবাড়াটি ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে আগুনে আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়, তার পর এই নতুন ইমামবাড়াটি তৈরী করা হয়। হাজারদুয়ারি এবং নিজামত ইমামবাড়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে  সুদৃশ্য বাগান রয়েছে, সেখানে রয়েছে ঘড়ি ঘর বা ক্লক-টাওয়ার।

এবার দ্রষ্টব্য জাফরগঞ্জ কবরস্থান। এখানে রয়েছে মীর জাফর, তাঁর বংশের সদস্যদের এবং উত্তরসূরিদের, নবাব নাজিম হুমায়ুন জা পর্যন্ত সকলের কবর। এখানে কিছু বই বিক্রি হচ্ছে দেখলাম, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস সম্পর্কিত ইতিহাস নির্ভর বইগুলি।


মুর্শিদাবাদের উল্লেখযোগ্য একটি দর্শনীয় স্থান জগৎ শেঠের বাড়ি। এই 'জগৎ শেঠ' কিন্তু কেবল একজন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে না, বরং এর অর্থ জগতের শেঠ (ব্যাংকার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড), বংশানুক্রমিক এঁদের সদস্যদের মধ্যে  হিরানন্দ শা, মানিক চাঁদ, ফতে চাঁদ, মেহতাব চাঁদ, স্বরূপ চাঁদ প্রমুখ। ধন সম্পদের প্রাচুর্য্যের জন্যে জগৎ শেঠ দের নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।  শোনা যায়, অর্থসাহায্য করার জন্যে মানিক চাঁদ কে এই উপাধি প্রদান করেন মোঘল সম্রাট ফারুখশিয়ার। নশিপুরে অবস্থিত বর্তমানে জগৎ শেঠদের বাড়িটি সংগ্রহালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে দর্শনীয় তৎকালীন সময়ের মুদ্রা, স্বর্ণ-রৌপের কারুকার্য সম্বলিত তাঁদের ব্যবহৃত বস্ত্র, বাসন ইত্যাদি। গুপ্ত সুড়ঙ্গটি পর্যটকদের দেখার জন্যে উন্মুক্ত।

এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল নশিপুর রাজবাড়ী। হাজারদুয়ারি প্রাসাদ থেকে এর দূরত্ব প্রায় আড়াই-তিন কিলোমিটার। রাজা বলে পরিচিত হলেও এঁরা ছিলেন জমিদার, ব্রিটিশ প্রশাসকের হয়ে ট্যাক্স কালেক্টর। বিরাট ছিল সেই জমিদারিরই সীমানা, বীরভূম, মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত রাজশাহী, পাবনা এবং বগুড়ার কিছু অংশ। সম্ভবত এই বিশাল জমিদারির জন্যেই এঁরা রাজা বলে পরিচিত ছিলেন। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা দেবী সিংহ রাজবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন তবে বর্তমানে যে নশিপুর রাজবাড়িটি দ্রষ্টব্য সেটি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা কীর্তি চন্দ্র সিংহ কর্তৃক হাজারদুয়ারীর আদলে নির্মিত। ব্যবসার সূত্র ধরে পানিপথ থেকে দেবী সিংহ এখানে আসেন এবং ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এই বিপুল জমিদারি গড়ে তোলেন । খাজনা দিতে অপারগ দরিদ্র প্রজাগণের প্রতি রাজার ব্যবহারের নানান গল্প আজও মানুষের মুখ মুখে ঘোরে।


এই নশিপুর রাজবাড়ীর সন্নিকটেই রয়েছে নশিপুর আখড়া। এখানে পর্যটকদের দর্শনের উদ্দেশ্যে পুরোনো গাড়ি, বাসনপত্র, রথ ইত্যাদি প্রদর্শিত রয়েছে।  শুনলাম, ঝুলনযাত্রা এবং সেই উপলক্ষ্যে এখানে বড়ো মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

মুর্শিদাবাদের অন্যতম আর একটি দর্শনীয় স্থান হলো কাঠগোলা বাগানবাড়ি।  শুনলাম, ধনপত সিং দুগার এবং লক্ষ্মীপত সিং দুগার নির্মাণ করেন।  বাগান বাড়িটির প্রাঙ্গনে রয়েছে আদিনাথ মন্দির।  এই স্থানের বাড়িটির বিভিন্ন স্থাপত্য, প্রদর্শনশালা, বাউলি, প্রাঙ্গনের মূর্তি-ভাস্কর্য, অলংকৃত দেওয়াল পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এবার ফিরে চলা। এই মাটির প্রতিটি কণা ইতিহাসের কথা বলে, সেই ইতিহাসকে ঘিরে গড়ে ওঠে নানান কাহিনী। সময় সংক্ষিপ্ত তাই বিদায় নিতে হয়, ইতিহাসের জ্ঞান কে সম্বল করে ফিরতে হয় বাস্তবতায়।  তবে আসতে আবার হবে, বাকি রয়ে গেছে অনেক কিছু দেখার, শোনার আর বোঝার।

মার্চ, ২০১৮

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ (Murshidabad)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পড়ন্ত বেলাতেই এসে উপস্থিত হলাম অতীতের মহানগরীমুক্সুবাদ’- নগরীর বাঁ দিক দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী নদী, এই নগরের উত্থান তাকে ঘিরেই নদীপথে ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা হেতুই মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব নিযুক্ত তৎকালীন বাঙলা, বিহার আর উড়িষ্যার সুবেদার (পরবর্তীকালে ‘নবাব নাজিম’) মুর্শিদকুলী খাঁ ঢাকা থেকে ভাগীরথীর উপকণ্ঠে মুক্সুবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, তাঁর নামানুসারে নগরের নাম পরিবর্তিত হয়ে হল মুর্শিদাবাদ, সূচনা হল ভারতবর্ষের এক নতুন ইতিহাসের ইতিহাসের সেই চরিত্ররা আজ আর নেই, রয়ে গিয়েছে তাঁদের স্থাপত্য, লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে তাঁদের উদার কর্মযজ্ঞ, বন্দিত হয়েছেন তাঁরা আবার কখনও বা নিন্দিত হয়েছেন ঘৃণ্য অপরাধের জন্যে, লোভ লালসার উন্মত্ততা নিজের অজান্তেই রাজাকে পর্যবসিত করেছে দাসে ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গেছে লোককথা, বিশ্বাস; ইতিহাস কখনও হয়েছে অতিরঞ্জিত আবার কখনও বা বিকৃত।  

এই ভ্রমণ কাহিনী ইতিহাসকেন্দ্রিক আর তাই ইতিহাসের পথ অনুসরণ করাটাই শ্রেয় মনে হয় অতএব এ রচনা অতীতের ঘটনাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ; ঘোরার সুবিধের জন্যে উল্লেখিত দ্রষ্টব্য স্থানগুলির পর্যায়ক্রম পরিবর্তন করা যেতেই পারে। এখানে উল্লেখ্য, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণকাহিনী (গবেষণাধর্মী বা গবেষণা নির্ভর ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়) যার অন্যতম উপাদান স্থানীয় গাইডদের প্রদত্ত তথ্য, প্রচলিত লোককথা, বিশ্বাস ইত্যাদি। 

জন্মসূত্রে (১৬৬০) দাক্ষিণাত্যের এক ব্রাহ্মণ সন্তান দশ বছর বয়সে হাজি শাফি নামে একজন পার্সি (ইরানী)-র নিকট বিক্রিত হয়। হাজি সাহেব তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং তাঁর নামকরণ করেন মহম্মদ হাদি। ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে হাজি শাফি মহম্মদ হাদিকে নিয়ে মোঘল রাজদরবারের কাজ পরিত্যাগপূর্বক পারস্যদেশে (বর্তমানে ইরান) চলে যানপরবর্তীকালে হাজি-র মৃত্যুর পর পুনরায় হাদি ভারতবর্ষে ফিরে আসেন এবং মোঘল সাম্রাজ্যের অধীন বিদর্ভ নগরের দেওয়ান আবদুল্লা খুরাসানির অধীনে কাজ শুরু করেন। তাঁর কর্মনিষ্ঠায় প্রসন্ন হয়ে ঔরঙ্গজেব তাঁকে বাঙলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। ঔরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ সময়ে মারাঠারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাঁদের আক্রমণ মোঘল সম্রাটের আর্থিক স্থিতি দুর্বল করে দিয়েছিল এমতাবস্থায় নবনিযুক্ত দেওয়ান মহম্মদ হাদি রাজস্বস্বরূপ অনেক টাকা দিল্লির সম্রাটকে পাঠিয়েছিলেন এবং মুর্শিদকুলী খাঁ উপাধি লাভ করেন, এর কিছুকালের মধ্যে ‘নাজিম’ উপাধিও লাভ করেন ১৭০১ থেকে ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দ অবধি রাজত্ব করেন মুর্শিদকুলী খাঁ মৃত্যুর পর তাঁরই ইচ্ছানুসারে কাটরা মসজিদে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে জীবৎকালে বিভিন্ন কৃতকর্মের জন্য বৃদ্ধ মুর্শিদকুলী খাঁ অনুতপ্ত হন, সেইজন্যে সকল মানুষের পদধূলি তাঁর পাপস্খলন ঘটাবে এই উদ্দেশ্যে নিজেকে সোপানের নীচে সমাধিস্থ করার আদেশ প্রদান করেন। মুর্শিদাবাদের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত এই কাটরা মসজিদ আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য। মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশনের অনতিদূরেই রেল লাইন পার করে দেখা যায় কাটরা মসজিদ। মসজিদের দুই প্রান্তে ৭০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দুইটি গম্বুজ রয়েছে।মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে অনেকগুলি ছোট আয়তনের প্রকোষ্ঠ আর অতি বৃহদাকার চত্বর যেখানে প্রায় সহস্রাধিক মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারেন। বর্তমানে মসজিদটি ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ (Archeological Survey of India) দ্বারা সংরক্ষিত। প্রকোষ্ঠ গুলিতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। পাথরের যোগান পর্যাপ্ত না থাকা আর ভাগীরথীর তীরে এঁটেল মাটি অপরিযাপ্ত, সম্ভবত এই দুইকারণেই এখানকার স্থাপত্য পোড়া ইটের, ইটগুলি আকারে বর্তমানের থেকে অনেকটাই ছোট বলে মনে হয়। কাটরা মসজিদের স্থাপত্যে কোন করি-বরগার ব্যবহার দেখা যায়না। 




প্রায় তিনশ বছরের পুরাতন এই স্থাপত্য শুধুমাত্র স্থাপত্যশৈলীর জন্যে নয় বরং তাঁর উন্নত দার্শনিকতার জন্যে আজও প্রাসঙ্গিক।

মুর্শিদকুলী খাঁ-র একপুত্র আর দুই কন্যা। এক কন্যার নাম আজিমুন্নেশা আজিমুন্নেশা-র বিবাহ সম্পন্ন হয় সুজা খাঁ-র (সুজাউদ্দিন মহম্মদ খাঁ) সহিত। সুজা খাঁ-ই হলেন মুর্শিদকুলী পরবর্তী বাঙলার নবাব (১৭২৭-১৭৩৯) উদার চিত্ত আর ন্যায় পরায়নতা জন্মসূত্রে তুর্কী মুসলিম সুজাউদ্দিন-কে একজন আদর্শ শাসক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলহাজি আহমেদ (আলীবর্দি খাঁ-র বড়ভাই যার আসল নাম মির্জা আহমেদ), আলমচাঁদ প্রমুখ তাঁর শাসনকালে রাজ্যের প্রধান পদে আসীন হন এবং বেগম আজিমুন্নেশার ইচ্ছানুসারে আলীবর্দি খাঁ-কে পাটনার নায়েব নিযুক্ত করা হয়১৭৩৯ সালে মৃত্যুর পর সুজাউদ্দিন-কে ভাগীরথীর পশ্চিমপারে রোশনিবাগে সমাধিস্থ করা হয়। রোশনিবাগ (‘বাগ’ কথাটির অর্থ বাগিচাবা ‘বাগান’) সুজা খাঁ-ই নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন যেন মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় রোশনিবাগেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়আজ রোশনিবাগে যে পথটি দিয়ে পর্যটকরা প্রবেশ করেন সেটি আসলে বাগের পশ্চাৎভাগ, অতীতের প্রধান সম্মুখ ফটকটি এর ঠিক সোজা মধ্যের বিশ্রামাগার (যা পরবর্তীকালের সুজা খাঁ-র সমাধি)-র আগে একই সরলরেখায় অবস্থিত। মূল ফটকটি দিয়ে প্রবেশ করলে ডান দিকে রয়েছে নবাব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, সম্মুখে ফোয়ারা আর তারপর বিশ্রামাগার। সমগ্র অঞ্চলটি ছিল ফুলের বাগান। রোশনিবাগের অনতিদূরেই সুজা খাঁ প্রতিষ্ঠা করেন অপর একটি মনরম বাগানবাড়ি যা ‘ফারহাবাগ’ বা সুখকানন নামে পরিচিত ছিল, যদিও বর্তমানে একটি জলাশয় ছাড়া এর বিশেষ কোন অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়না। 


রোশনিবাগেই রয়েছে সুজা খাঁ-র অপর স্ত্রী জিন্নাতুন্নেশা-র সমাধি। বর্তমানে রোশনিবাগ ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ (Archeological Survey of India) রক্ষণাবেক্ষণ করে। রোশনিবাগের পরিধির লাগোয়া গড়ে উঠেছে একটি মাজারআলাপ হল এক বৃদ্ধের সাথে, পরনে লুঙ্গি আর ফতুয়া। তিনি এই মাজারটি পরিস্কার পরিছন্ন রাখার কাজ করেন আর জীবনযাপনের জন্যে এখানে আগত পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করে কিছু উপার্জন করেন। প্রতি চৈত্র মাসে ৩ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত এখানে মেলা বসে, শুনলাম অনেক বাজি পোড়ে মেলা উপলক্ষে। সুজা খাঁ-র অপর উল্লেখযোগ্য কীর্তি ত্রিপলিয়া দরওয়াজা, ডাহাপাড়া মসজিদ নির্মাণ।



আজিমুন্নেশা সম্পর্কিত নানান লোককথা আজও প্রচলিত যেমন তাঁর পুরুষ আসক্তি, শারীরিক অসুস্থতা, আরোগ্যলাভ হেতু মনুষ্য আন্তরযন্ত্রীয় অঙ্গ সেবন এবং সেইহেতু পিতার (মতান্তরে স্বামীর) আদেশে তাঁর জীবন্ত সমাধি ইত্যাদি। যদিও এসবের ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুপস্থিত বরং ঐতিহাসিকগণের ধারণা আজিমুন্নেশার মৃত্যু তাঁর পিতার এবং পতির মৃত্যুর পরবর্তীতেই হয়। তাঁর সমাধি রয়েছে ভাগীরথীর পূর্বপারে, এটিও বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্বিক বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত। পিতার মৃত্যুর পর সুজা খাঁ আর আজিমুন্নেশার সন্তান সরফরাজ খাঁ সিংহাসন আরোহণ করেন (১৭৩৯-১৭৪০)। অধিক নারী সংসর্গ, আলস্য, ভোগ বিলাসিতা এবং মন্ত্রীবর্গের উপর অধিক নির্ভরতা রাজ্য পরিচালনায় বাঁধা হয়ে উঠল। অচিরেই মন্ত্রীবর্গের আর নবাবের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় আর তারই পরিণতিতে ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে গিরিয়ার যুদ্ধে আলীবর্দি খাঁ-র কাছে পরাজিত হয়েছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করেন। অবসান হয় এক বংশের। এ ইতিহাস বিষাদের, কখনও বিশ্বাসঘাতকতার। ফৌতি মসজিদের স্থাপনা তাঁর আমলেই শুরু হয় কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুর পর এটির স্থাপনা শেষ হয়নিএই ফৌতি মসজিদ-ই বর্তমানে ফুটি মসজিদ নামে পরিচিত। 

সেই সময়ে অনবরত মারাঠাদের (যারা বর্গী নামে তৎকালীন বাঙলাতে পরিচিত ছিল) আক্রমণে বাঙলা, বিহার আর উড়িষ্যা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বর্গী আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত। রোশনিবাগের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভাস্কর পণ্ডিত ভগবান শিবের মন্দির স্থাপন করেন। এরূপ অবস্থায় কিছুটা বাধ্য হয়েই ভাস্কর পণ্ডিতকে মানকরা নামক জায়গায় নিজের শিবিরে আমন্ত্রণ করে নবাব আলীবর্দি খাঁ তাঁদের হত্যা করেন এ ইতিহাস এক বিশ্বাসঘাতকের কালিমালিপ্ত ইতিহাস হয়েই থেকে যেত যদিনা আলীবর্দি নিজেকে একজন দক্ষ আর প্রজাদরদী নবাব হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হতেন আলীবর্দি-র ধারণা ছিল হয়ত এরপর বর্গী আক্রমণের হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষা করা যাবে কিন্তু তা হয়নি। কিছুকাল বর্গী আক্রমণ বন্ধ ছিল, আর তারপরেই তাঁরা আবার এসেছিল আরও বিক্রমে।

নবাব আলীবর্দি খাঁ-র অধিক স্নেহপরায়ণতাই যে কনিষ্ঠা কন্যা আমিনার পুত্র মির্জা মহম্মদ (যিনি ইতিহাসে সিরাজদউল্লা নামে পরিচিত)-র সিংহাসন আরোহণের অন্যতম প্রধান কারণ সে নিয়ে বিশেষ দ্বিমত নেই। নবাব আলীবর্দি-র মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজ নবাব পদে অভিষিক্ত হন। বড়ই কণ্টকাকীর্ণ ছিল সিংহাসন আরোহণের সেই পথ। তার উপর কখনও সিরাজের দূরদৃষ্টিহীনতা আর ভুল সিদ্ধান্তগ্রহণ পরিস্থিতিকে অনেকটাই প্রতিকূল তৈরি করে দেয়। এইসকলের সন্মিলিত ফলশ্রুতি বাঙলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের করুন পরিণতি আর বাঙলা তথা ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে সূর্যাস্ত। শেষ হল পলাশির যুদ্ধ, রাজমহলের নিকট ধরা পরলেন সিরাজ। বন্দী সিরাজকে কয়েদ করে রাখা হল মন্সুরগঞ্জের প্রাসাদে। মীর জাফর পুত্র মীরণ মহম্মদি বেগকে নির্দেশ দিলেন সিরাজকে হত্যা করার, বারংবার ছুরিকাঘাতে লুটিয়ে পড়লেন সিরাজ। মৃত্যুর পর সিরাজের দেহ নিয়ে আসা হয় খোসবাগে। লোকবিশ্বাস সিরাজের দেহ  খোসবাগে আনা মাত্র নবাব আলীবর্দির সমাধি দু’ভাগ হয়ে যায়, শুরু হয় রক্তপ্রবাহ। এ শুধুই কল্পিত কাহিনী যার ভিত্তি দাদামশাই আর পৌত্রের  বাস্তব অপত্য স্নেহ আর প্রেম। অবশ্যই সিরাজের ব্যক্তিগত জীবন সমালোচনার উর্দ্ধে নয় কিন্তু তাঁর শৌর্য, বীরত্ব, রাজ্যের স্বায়ত্তের দায়বদ্ধতা, অগ্রজের উপদেশ গ্রহণ এবং স্বয়ং সংশোধন কোন প্রকারেই ক্ষুদ্র নয়। মাতামহ আলীবর্দি খাঁ-র সমাধির পাশেই সমাধিস্থ হন সিরাজ। 






কিন্তু হত্যালীলা স্তব্ধ হয়না। লোভ লালসা অর্থমোহ অত্যাচারী শাসককে হত্যার যন্ত্রে পরিণত করে। খোসবাগে রাখা আছে সেই সকল সমাধি। খোসবাগকথাটিখুশবাগ’-র (আনন্দ উদ্যান) অপভ্রংশমাত্রনবাব আলীবর্দি এই খুশবাগ তৈরি করান, শতাধিক গোলাপ ফুলের গাছ রোপণ করেছিলেন এবং তার সৌন্দর্য্য ও সুবাসের জন্যেই বাগ বা বাগিচার নামকরণ করেন খুশবাগ বা আনন্দ উদ্যান বর্তমানে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধীনে সংরক্ষিত খোসবাগের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর সর্বপ্রথম যে সমাধিটি দেখা যায় সেটি নাফিসা খানম বেগমের, নবাব আলীবর্দি খাঁ-র পত্নী বিচক্ষণা বেগমের পরামর্শ বৃদ্ধ নবাবের কাছে অপরিহার্য ছিলবেগমের সমাধির অনতিদূরেই রয়েছে তাঁর দুই কন্যার সমাধি যথাক্রমে সিরাজের বড় মাসি ঘসেটি বেগম আর মা আমিনা বেগমের, নবাব আলীবর্দির মধ্যম কন্যার সমাধি রয়েছে বিহারে

এখানে রয়েছে একটি মসজিদ, আজ আর নামাজ পড়া হয়না সেখানে, আজান দেওয়া হয়না কখনই, মসজিদের সম্মুখের জলাশয়টি আজ শুষ্ক। মৃত্যুর এই মহামিছিলের কাহিনী শুনতে শুনতে চোখের জলও এই জলাশয়ের মতন শুকিয়ে যায়। এক অদ্ভুত শান্তি রয়েছে এই খোসবাগে। যেন আজও লুৎফুন্নেশা অপেক্ষা করে আছেন সিরাজের, হয়ত তিনি প্রত্যক্ষ করছেন তাঁর প্রিয় সিরাজকে, স্বহস্তে সিরাজের প্রিয় ফুলের গাছ রোপণ করছেন, জল দিচ্ছেন।   



মার্চ, ২০১৮ 

পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৪: ডালের সূচনা (Nutrition security and food - Part-4: Introduction of Pulses)

 সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্বের পর্বগুলি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩


ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙালীর ইতিহাস' গ্রন্থে প্রাচীন বাংলায় বাঙালির খাদ্যতালিকায় ডালের অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। নদী মাতৃক জল-বহুল বাংলায় মাছের আধিক্যের কারণে মানুষের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদা মাছের মাধ্যমে মিটে যাওয়ায় ডালের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়নি। আবার বাংলায় ডাল খাওয়ার ভিন্ন রীতি দেখা যায় যেমন ফরিদপুর এবং বরিশালের (অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত) মানুষ ভাত, তরকারী, এমনকি আমিষ পদ গ্রহণের পর ডাল গ্রহণ করতেন। আবার কিছু মানুষের, যাঁদের পূর্বপুরুষের আদি বাসস্থান কুমিল্লা জিলায় (অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত), কাছ থেকে জানতে পেরেছি তাঁরাও ডাল সব পদ খাওয়ার পরেই খেয়ে থাকেন। সময় বদলেছে, বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডাল খাদ্যতালিকায় একটি প্রধান পদ বলেই বিবেচিত হচ্ছে।

তবে সমগ্র ভারতবর্ষের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে ডাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য, তা সে ভাত-ডাল- তরকারী হোক বা ডাল-রোটি ডাল পুষ্টি উপাদান বিশেষত প্রোটিনের উৎস। তথ্য পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ভারতবর্ষের প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষ নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন (Maurya et al., 2022) কাজেই ডালের গুরুত্ব সেক্ষেত্রে (নিরামিষ আহারের ক্ষেত্রে) আরো বৃদ্ধি পায় কারণ নিরামিষ আহারের তালিকায় এটি একটি প্রধান প্রোটিনের উৎস। এবার আমাদের দেশে প্রচলিত কয়েকটি প্রধান ডালের তালিকা দেখে নিই। যদিও এর মধ্যে সয়াবিনের ব্যবহার ডাল হিসেবে ভারতবর্ষে খুব একটা বেশি হয় না। প্রধানত খাদ্যোপযোগী তেল উৎপাদনের জন্যে এর ব্যবহার অধিক হয়ে থাকে। তবে সোয়া চাঙ্ক বা সোয়া বড়ির চল বেশ আছে।

Table 1: ভারতবর্ষে প্রচলিত কয়েকটি ডাল

বাংলা/স্থানীয় নাম

ইংলিশ নাম

বিজ্ঞানসম্মত নাম

অড়হর/তুর

Pigeon pea

Cajanus cajan

কুলথি

Horse gram

Dolichos uniflorus

Macrotyloma uniflorum

খেসারি

Grass pea

Lathyrus sativus

ছোলা/চানা

Chick pea

Cicer arietinum

মটর/কড়াইশুঁটি

Pea

Pisum sativum

মথ/মাটকি

Moth bean

Vigna aconitifolia

মসুর/মুসুরি

Lentil

Lens culinaris

মাসকলাই/উর্দ

Black gram

Vigna  mungo

মুগ

Green gram/Mung

Vigna radiata

রাজমা

Kidney bean

Phaseolus vulgaris

লোবিয়া/চৌলি

Cow pea

Vigna unguiculata

বাকলা

Faba bean

Vicia faba

সয়াবিন

Soybean

Glycine max

সেম/ভাল

Lablab bean

Lablab purpureus

ডালের ব্যবহার যে প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে চলে আসছে তা ঋগবেদ বা পরবর্তী বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে ডালের উল্লেখ থেকে বোঝা যায়। যেমন ঋগবেদে এবং পরবর্তী কালে যজুর্বেদে 'খালওয়া' ('Khalva'কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে 'কালায়া' ('Kalaya'এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রে 'চানাকা' ('Chanaka'বলে যা উল্লেখিত হয়েছে তা চানা ডাল।  আবার  তুর বা অড়হর ডালকে চরক এবং সুশ্রুত 'আধাকি' ('Adhaki'বলে উল্লেখ করেছেন, বৌদ্ধসাহিত্যেও এর উল্লেখ রয়েছে। কৌটিল্য 'অর্থশাস্ত্রে' একে উদারা ('Udaara') বলে উল্লেখ করেছেন (Nene, 2006)। মুগ ডালের সংস্কৃত নাম 'মুদগা' ('Mudga') আর গাছের নাম 'মুদগাপর্ণী' ('Mudgaparni')। যজুর্বেদেও মুগ ডালকে 'মুদগা' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার আমরা যাকে মাস-কলাইয়ের ডাল বলে থাকি তা ব্রাহারন্যকে, মহাভারতে এবং কৃষি-পরাশর গ্রন্থে মাশা ('Masha') নামে উল্লেখিত হয়েছে।  মসুর ডালের সংস্কৃত নাম 'মঙ্গল্যা' ('Mangalya') বা 'মাসুরা' ('Masura') পাওয়া যায়।  আবার কুলথি যজুর্বেদে, এবং বৌদ্ধ এবং জৈন গ্রন্থে 'কুলত্থ্যা' ('Kulottha') নামে উল্লেখিত (Nene, 2006)

ডালের ব্যবহার এদেশে অত্যন্ত প্রাচীন হলেও সকল প্রকার ডালের উৎপত্তি ভারত বা ভারতীয় উপমহাদেশে নয়। যেমন চানা বা ছোলার ডালের উৎপত্তিস্থল তুর্কি-সিরিয়া অঞ্চল, মসুর বা মুসুরির ডালের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, মটর এবং খেসারির ডালের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ ইউরোপ। বাকলা পশ্চিম এশিয়া, আবার লোবিয়া বা চৌলি পশ্চিম আফ্রিকাতে উৎপন্ন হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে। অন্যদিকে অড়হর, কুলথি, মথ বা মাটকি, মুগ ইত্যাদি ডালের উৎপত্তিস্থল ভারতীয় উপমহাদেশ (Nene, 2006; Fuller and Harvey, 2006)। Fuller and Harvey (2006) বৈজ্ঞানিক আর্টিকেলটিতে বিভিন্ন সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকার ডালের নিদর্শনের তালিকা উপস্থাপিত হয়েছে। 

এই পর্যন্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেলো যে ডাল খাওয়ার প্রবণতা প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে রয়েছে। এবার বর্তমান সময়কালের প্রতি দৃকপাত করা যাক। 

যদি বর্তমানে ভারতবর্ষের ডালের উৎপাদনের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তবে দেখা যায়, গত দুই দশক ধরে বিভিন্ন ডাল উৎপাদনের কৃষিজমি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও মুসুরির ডালের ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয় (Figure 1)। 


Figure 1: ২০০০ টি ২০২০ পর্যন্ত ফসল (Pulses ) অনুসারে কৃষিজমি আয়তনের হিসাব (Food and Agriculture Organisation হইতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে Source: FAOSTAT)

অন্যদিকে, চানা, মটর, অড়হর ডালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও মুসুরির ডালের উৎপাদন খুব একটা বৃদ্ধি পায়নি (Figure 2)। সয়াবিনের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা বিভিন্ন সময় উপর-নিচ হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ডালের (যা উল্লেখিত হয়নি আলাদাভাবে) সমগ্রভাবে  উৎপাদন খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। 


Figure 2: ২০০০ টি ২০২০ পর্যন্ত ফসল (Pulses ) অনুসারে উৎপাদনের হিসাব (Food and Agriculture Organisation হইতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে Source: FAOSTAT)

ডাল উৎপাদনে ভারতবর্ষ অগ্রগণ্য, এমনকি সর্বাধিক উৎপাদনশীল হলেও, উৎপাদন থেকে চাহিদা অধিক হাওয়ায় আমদানি করতে হচ্ছে (John et al., 2021; Mishra et al., 2021)। যদি উৎপাদন বৃদ্ধি না পায় তবে উত্তরোত্তর চাহিদা আর উৎপাদনের এই ফাঁক বৃদ্ধি পেতে পারে তা বলাই বাহুল্য। পরবর্তী অধ্যায়ে ডালের পুষ্টি গুণ সম্বন্ধে আলোচনা করবো।

তথ্য সহায়তা (References)

Fuller, D.Q.; Harvey, E.L. 2006. The archaeobotany of Indian pulses: identification, processing and evidence for cultivation. Environmental Archaeology 11: 219-246. https://doi.org/10.1179/17963106x123232

John, A.T.; Makkar, S.; Swaminathan, S.; Minocha, S.; Webb, P.; Kurpad, A.V.; Thomas, T. 2021. Factors influencing household pulse consumption in India: A multilevel model analysis. Global Food Security 29: 100534. https://doi.org/10.1016/j.gfs.2021.100534

Maurya, S.; Tripathy, A.K.; Verma, S.P.; Ali, W.; Shukla, S. 2022. Assessment of baseline nutritional status, vitamin B12, and folate levels in patients with acute leukemia and their effect on initial treatment outcome: A prospective observational study. Indian Journal of Medical and Paediatric Oncology 43(2): 171-176. https://doi.org/10.1055/s-0042-1742665

Mishra, P.; Yonar, A.; Yonar, H.; Kumari, B.; Abotaleb, M.; Das, S.S.; Patil, S.G. 2021. State of the art in total pulse production in major states of India using ARIMA techniques. Current Research in Food Science 4: 800-806. https://doi.org/10.1016/j.crfs.2021.10.009

Nene, Y.L. 2006. Indian pulses through millennia. Asian Agri-History 10(3): 179-202.

নীহাররঞ্জন রায় (বাংলা ১৩৫৬)। বাঙ্গালীর ইতিহাস। দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা।

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...