সম্পত ঘোষ (Photographer: Sampat Ghosh)

সম্পত ঘোষ (Photographer: Sampat Ghosh)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
পূর্ববর্তী ব্লগটিতে (ভারতের স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ) আমি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় খাদ্য এবং রন্ধনপ্রণালীর উল্লেখ করেছি । অবশ্যই তা একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ, বলাই বাহুল্য যে তার বাইরে অনেক উপাদেয় পদ রয়েছে, কয়েকটি আইকনিক পদ ও প্রণালীকে তুলে ধরেছি মাত্র। আশা করি কর্মসূত্রে বা বেড়াতে গেলে পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয়ই ওই সকল স্থানীয় খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ করবেন। আজকের এই ব্লগটিতে আমি আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপজাতিদের বিভিন্ন খাদ্য পদ নিয়ে আলোচনা করব, অন্যথা আমাদের দেশের খাদ্য বৈচিত্র্য সম্বন্ধে যে আলোচনা আমি শুরু করেছি তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
ভারতবর্ষ অসংখ্য আদিবাসী বা উপজাতির আবাসস্থল। দেশের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই উপজাতিরা তাদের অনন্য রীতিনীতি, ভাষা এবং উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছেন বা করে চলেছেন। এই ব্লগে, আমরা ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য ভান্ডারের অন্বেষণ করব যা এই সম্প্রদায়গুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রেখেছে। আমার জীবনের দীর্ঘ সময়কাল ভারতেবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে, কাজেই কিছু ক্ষেত্রে এই লেখা আমার কাছে অনেকটা নস্টালজিয়ার মতন। বাংলা সাহিত্যেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের খাদ্যের বা খাদ্যরীতির কথা উঠে এসেছে। এই মুহুর্তে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পালামৌ' এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের 'আরণ্যক' উপন্যাসটির কথা মনে আসছে। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পালামৌ’ ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকেও উক্ত অঞ্চলের কোল জাতির মধ্যে খাদ্য হিসেবে মহুয়া ফুলের ব্যবহারের কথা জানা যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'আরণ্যক' উপন্যাসে লিখেছেন- 'আমাদের এ জঙ্গল-মহালের পূর্বে-দক্ষিণ সীমানা হইতে সাত-আট ক্রোশ দূরে অর্থাৎ সদর কাছারি হইতে প্রায় চৌদ্দ-পনের ক্রোশ দূরে ফাল্গুন মাসে এক প্রসিদ্ধ মেলা বসে। ....... মেলার এক অংশে তরিতরকারির বাজার বসিয়াছে, কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় শুঁটকি কুচো চিংড়ি ও লাল পিঁপড়ের ডিম বিক্রয় হইতেছে। লাল পিঁপড়ের ডিম এখানকার একটি সুখাদ্য। তাছাড়া আছে কাঁচা পেঁপে, শুকনো কুল, কেঁদ-ফুল, পেয়ারা ও বুনো শিম।'
সত্যজিত রায় মহাশয়ের পরিচালিত 'আগুন্তুক' ছায়াছবিটি আমার অন্যতম প্রিয় সিনেমা। ছায়াছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মনমোহন মিত্র আদিবাসীদের কৃষি, বুনন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ঔষধি, স্থাপত্য, শিল্পকলা ইত্যাদির কথা সাধারণ শহুরে মানুষদের প্রতিনিধি অনিলা দেবীর পরিবার এবং পারিবারিক বন্ধুর সামনে তুলে ধরেন, যদিও তাঁরা সেগুলির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না। এখানে একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কাটে, মনমোহন বলেন তিনি আদিবাসী নন বলেই তাঁর ফিল্ড নোট (Field notes) নেওয়ার প্রয়োজন হয়। সত্যি, আজ পৃথিবী যখন স্থায়িত্বের (Sustainability) জন্যে লড়ে যাচ্ছে, তখন আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমাজ থেকেই নেওয়া ফিল্ড নোটগুলি উল্টাতে হয় বইকি, তাতেই যে রয়েছে স্থায়িত্বের চাবিকাঠি ।
ভারতে উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালী ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত, জমি, ঋতু এবং আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ উপাদানগুলি ব্যবহার করেন। উত্তর-পূর্বের জঙ্গল থেকে শুরু করে রাজস্থানের শুষ্ক মরুভূমি পর্যন্ত, প্রতিটি অঞ্চল ভূগোল, জলবায়ু এবং সাংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত স্বতন্ত্র রন্ধনসম্পর্কীয় পরিচয় নিয়ে গর্ব করে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, আদিবাসী উপজাতিদের আবাসস্থল, খাদ্য শুধুমাত্র ভরণ-পোষণ নয় বরং জীবনের একটি উদযাপন। ভাত, মাছ, শুঁটকি মাছ এবং বাঁশের আগা (Bamboo shoot) এই অঞ্চলের অনেক উপজাতীয় খাদ্যের ভিত্তি। নাগাল্যান্ডের নাগা উপজাতিরা তাদের ঝাল ঝাল সুস্বাদু মাংসের খাবারের জন্য বিখ্যাত, প্রায়শই শক্তিশালী 'ভুত ঝোলোকিয়া' মরিচ দিয়ে রান্না করা হয়। মেঘালয়ের গারো এবং খাসি উপজাতিরা সুস্বাদু আচার এবং চাটনি তৈরি করতে বাঁশের আগা ফার্মেন্ট করেন, যা খুবই উপাদেয়। উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় বিভিন্ন কীট-পতঙ্গকে খাদ্য (Edible insects) হিসেবে ব্যবহার করেন। অরুণাচল প্রদেশে বিভিন্ন উৎসবে মিথুনের মাংস (Bos frontalis) মানুষের রসনা তৃপ্ত করে। এখানে মুরগি বা মাটনের থেকে শুয়োরের মাংসের আধিক্য দেখা যায়। পানীয়ের মধ্যে অরুণাচলের আপং (Apong-rice beer), নাগাল্যান্ডের জুথো (Zutho), সিকিমের ছাঙ (Chang) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আবার মিজোদের স্থানীয় ডেলিকেসি জাওলাইদি- আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত ওয়াইন (Zawlaidi- Grape wine) এক প্রেমের গল্প বলে। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পানীয় গ্রহণে কোনো বৈষম্য আমি দেখিনি, স্থানীয় মানুষকে মাতলামি করতেও আমার বিশেষ চোখে পড়েনি।
মধ্য ভারত বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল, প্রত্যেকের নিজস্ব রন্ধন ঐতিহ্য রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের গোন্ড এবং বাইগা উপজাতিরা মহুয়া ফুল, তেন্দু পাতা ইত্যাদি বনজ পণ্যের দক্ষতার সাথে ব্যবহারের জন্য পরিচিত। মহুয়া, বিশেষ করে, উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালীতে একটি বিশেষ স্থান রাখে, যা আলকোহলিক পানীয় (Alcoholic beverages) এবং মিষ্টি খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আদিবাসীদের বিভিন্ন মিলেটের, যেমন কোদো, কুটকি ইত্যাদির ব্যবহার (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট), বীজ সংরক্ষণ, কৃষি পদ্ধতি ইত্যাদি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়িত্ব এবং পুষ্টির নিশ্চয়তার দৃষ্টিকোণ খুবই প্রাসঙ্গিক। ছত্তিশগড়ের লাল পিঁপড়ের চাটনী, ঊড়িষ্যার G.I. ট্যাগ প্রাপ্ত 'কাই-চাটনী' (লাল পিঁপড়ের চাটনী- watery semi-solid paste of red weaver ant), মধ্য ভারতের স্থানীয় আদিবাসীদের খাদ্য হিসেবে শামুকের (Edible snails) ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
সবুজ পশ্চিম ঘাটের মাঝখানে অবস্থিত, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং কেরালার উপজাতি সম্প্রদায়গুলি রন্ধনসম্পর্কীয় আনন্দের একটি আকর্ষণীয় সম্ভার অফার করে। মহারাষ্ট্রের ওয়ারলি উপজাতি, তাদের শিল্পের জন্য পরিচিত, এছাড়াও রন্ধনশিল্পে পারদর্শী, পিঠলা-ভাকড়ি (Pithla-Bhakri- খামিরবিহীন রুটির সাথে বেসনের তরকারি) এর মতো হৃদয়গ্রাহী খাবার তৈরি করে। দক্ষিণ ভারতে কুরিচিয়া এবং কুরুম্বা মতো আদিবাসী উপজাতিরা বনের সবুজ শাক (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক), মিঠা পানির মাছ এবং বন্য মাংস দিয়ে রান্নার শিল্প আয়ত্ত করেছে, এমন খাবার তৈরি করেন যা যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর।
পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের কেন্দ্রস্থলে, রন্ধন প্রথাগুলি প্রকৃতি উপাসনা এবং পূর্বপুরুষদের আচারের সাথে গভীরভাবে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল উপজাতি ফসল কাটার মরসুম উদযাপন করে সোহরাই নামে পরিচিত একটি জমকালো ভোজের সাথে, যেখানে 'ধুসকা' (Dhuska- ডিপ-ফ্রাইড রাইস প্যানকেক) এবং পিঠা-র মতো খাবার রয়েছে। এদিকে, ওডিশার বোন্ডা উপজাতি বন্য মাশরুম, কন্দ এবং সবুজ শাক তাদের প্রতিদিনের খাবারে অন্তর্ভুক্ত করে।
আধুনিকীকরণ (?) এবং পরিবেশগত অবক্ষয় দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ভারতের সমৃদ্ধ উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য প্রচেষ্টা চলছে। ঐতিহ্যগত জ্ঞান (Traditional Knowledge) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রজম্নের পর প্রজন্ম মুখে মুখেই প্রচলিত, লিখিত ভাবে না থাকার জন্যে তা অবক্ষয়িত, এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তাই আমাদের সেই ফিল্ড নোটগুলিকেই ভরসা করতে হয়। 'আগুন্তুক' ছবিতে নিজের চিকিৎসার জন্যে মনমোহন মিত্র এমন এক ওঝাকে ডেকেছিলেন যাঁর নখদর্পনে ছিল ৫০০ ঔষধি গাছ-গাছড়ার গুণাবলীর তথ্য, এ কিন্তু নেহাত কল্পনা নয়, এরূপ উদাহরণ আমি দেখেছি। তবে স্থানান্তর (Migration), স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় (Ecosystem degradation), জীব বৈচিত্রের হ্রাস (Biodiversity loss) পাওয়া ইত্যাদির ফলে এই জ্ঞানভাণ্ডার আজ ক্ষয়িষ্ণু। এই মূল্যবান জ্ঞান ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা আবশ্যক। আদিবাসী সমাজের এই কম কার্বণ ফুটপ্রিন্ট (Low carbon footprint) বৈশিষ্টযুক্ত খাদ্য ব্যবস্থা পরিবেশের স্থায়িত্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে। সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে খাদ্য উৎসব, রন্ধনসম্পর্কীয় কর্মশালা এবং ডকুমেন্টেশন প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলি দেশীয় খাবার এবং ঐতিহ্যগত রান্নার পদ্ধতির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে। উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য উৎযাপন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে, আমরা শুধুমাত্র ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করি না বরং ভবিষ্যত প্রজন্মকে লালন করার জন্য আমাদের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকেও রক্ষা করি।
উপসংহারে, ভারতের উপজাতীয় খাবারগুলি প্রকৃতির সাথে গভীর সংযোগের প্রমাণ যা সারা দেশে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। উত্তর-পূর্বের কুয়াশা-ঢাকা পাহাড় থেকে মধ্য ভারতের রৌদ্রে ভেজা সমভূমি পর্যন্ত, এই সকল খাদ্যের প্রতিটি কামড় স্থিতিস্থাপকতা (Resilience), ঐতিহ্য (Tradition) এবং খাদ্য ও সংস্কৃতির (Food culture) মধ্যে স্থায়ী বন্ধনের গল্প বলে। পরিশেষে উল্লেখ করি, এছাড়াও অনেক পদ বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে, সমস্ত পদের বর্ণনা একটি সংক্ষিপ্ত ব্লগে সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি আইকনিক পদের বর্ণনা এই ব্লগটিতে করলাম।
সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
ভারতবর্ষের বাইরে কোনো স্থানে গেলে সেখানে যদি কোনো ভারতীয় রেস্তোরাঁ চোখে পরে তবে আনন্দের সীমা থাকে না। তবে সেখানে যে সকল প্রকার ভারতীয় খাবারের সম্ভার থাকে এমনটা কিন্তু নয়। কয়েকটি পদ-ই সেখানে প্রস্তুত করা হয় এবং ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এই বিষয়ে আমি পূর্বে একটি ব্লগে বিস্তারিত লিখেছি [অনুগ্রহ করে পড়ুন ভারতীয় রান্নার একটি গল্প ]। এই ব্লগে আমার উদ্দেশ্য এমন কিছু আইকনিক খাবারের পদ উল্লেখ করা যাতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্য বৈচিত্র্যের একটা ধারণা পাওয়া যায়।
ভারত বিভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং রন্ধনপ্রণালীর দেশ। এ দেশ দেশীয় খাদ্য ব্যবস্থার সমৃদ্ধ টেপেস্ট্রি নিয়ে গর্ব করে। ইতিহাস ও ভূগোলের গভীরে প্রোথিত এই রন্ধন প্রথা উপমহাদেশের অনন্য ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। হিমালয়ের তুষারময় শিখর থেকে ভারত মহাসাগরের গ্রীষ্মমন্ডলীয় উপকূল পর্যন্ত, প্রতিটি অঞ্চল ভারতীয় খাবারের প্রাণবন্ত উপাদান, স্বাদ এবং রান্নার কৌশলগুলির নিজস্ব অবদান রাখে। এই ব্লগে, আমরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ করার জন্য একটি যাত্রা শুরু করব, সারা দেশে বিভিন্ন রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যের ঐতিহ্যবাহী অভ্যাস, উপাদান এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের সন্ধান করব। এই অন্বেষণের মাধ্যমে, আমরা এই প্রাচীন খাদ্যপথের অন্তর্নিহিত স্থিতিস্থাপকতা (Resilience), বৈচিত্র্য (Diversity) এবং স্থায়িত্বের (Sustainability) দিকে লক্ষ্য রাখব।
উত্তর ভারত
প্রথমেই উত্তর ভারতের পাঞ্জাবের দিকে তাকানো যাক। পাঞ্জাবকে প্রায়শই "ভারতের রুটির ঝুড়ি" (Breadbasket of India) হিসাবে উল্লেখ করা হয়, পাঞ্জাব এমন একটি রন্ধনপ্রণালীর গর্ব করে যা হৃদয়গ্রাহী, সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যে ভরপুর। পাঞ্জাব সমভূমির উর্বর মাটি প্রচুর পরিমাণে শস্য, শাকসবজি এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপন্ন করে, যা পাঞ্জাবি খাবারের মূল ভিত্তি। পাঞ্জাবি খাবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তন্দুরি রান্নার (Tandoori cooking) উপর জোর দেওয়া। তন্দুর, একটি নলাকার (Cylindrical) মাটির চুলা, মাংস গ্রিল করতে, এবং রুটি বেক করতে ব্যবহৃত হয়, যা খাবারে একটি অনন্য ধোঁয়াটে স্বাদ (Smoky flavour) দেয়। তন্দুরি চিকেন (Tandoori chicken), তন্দুরে রান্না করার আগে দই এবং মশলার মিশ্রণে ম্যারিনেট (Marinate) করা হয়, পাঞ্জাবি রান্নার একটি ক্লাসিক কুইসিন। পাঞ্জাবের আরেকটি আইকনিক খাবার হল ‘সর্ষ দা সাগ’ (Sarson da saag) এবং ‘মাক্কি দি রোটি’ (Makkai di roti), সরিষার শাক এবং কর্নমিল ফ্ল্যাটব্রেডের (Cornmeal flatbread- ভুট্টার আটার রুটি) একটি উপাদেয় মিল। এই খাবারটি ঐতিহ্যগতভাবে শীতের মাসগুলিতে উপভোগ করা হয় যখন সরিষার শাক মরশুমি এবং প্রায়শই বাড়িতে তৈরি মাখন বা ঘি (Ghee) দিয়ে পরিবেশিত হয়ে থাকে। সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি, পাঞ্জাব তার মিষ্টি খাবারের জন্যও বিখ্যাত, যেমন 'পিন্নি' (Pinni), ময়দা, ঘি এবং গুড় দিয়ে তৈরি একটি ঘন এবং বাদামের মিষ্টি। এই মিষ্টিগুলি প্রায়শই উৎসব এবং বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়।
এবার আসি উত্তরপ্রদেশের কথায়। উত্তর প্রদেশ, ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য, মুঘলাই ঘরানা-র সুস্বাদু খাবার থেকে আওয়াধি ঘরানা পর্যন্ত রন্ধনসম্পর্কীয় সমৃদ্ধ টেপেস্ট্রির (Tapestry) আবাসস্থল। উত্তরপ্রদেশের রন্ধনপ্রণালী তার সমৃদ্ধ এবং সুগন্ধযুক্ত গ্রেভি (Aromatic gravies), ধীরে-ধীরে রান্না করা মাংস (Slow-cooked meat) এবং সূক্ষ্ম মশলার মিশ্রণ (Delicate spice blends) দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। উত্তর প্রদেশের সবচেয়ে আইকনিক খাবারগুলির মধ্যে একটি হল বিরিয়ানি (Biryani), একটি সুগন্ধি চাল, কোমল মাংস, সুগন্ধি মশলা এবং ক্যারামেলাইজড পেঁয়াজ দিয়ে প্রস্তুত এই ডিশ। লখনউই বিরিয়ানি (Lucknowi biryani), বিশেষ করে, জাফরান, কেশর এবং গোলাপ জল দিয়ে মিশ্রিত মাংসের সূক্ষ্ম স্বাদ এবং কোমল টুকরার জন্য বিখ্যাত। উত্তরপ্রদেশ কুইসিনের আর একটি রত্ন হল কাবাব, একটি রসালো মাংসের প্রস্তুতি যা আওধের রাজকীয় রান্নাঘরে উদ্ভূত হয়েছিল। আপনার মুখের গলে যাওয়া 'গালোটি কাবাব' হোক (Galouti kebab) বা রসালো 'শিক কাবাব' (Seekh kebab), উত্তরপ্রদেশ কাবাব উৎসাহীদের জন্য প্রচুর ধরণ সরবরাহ করে।নিরামিষ রন্ধনপ্রণালীতেও উত্তর প্রদেশে সমৃদ্ধ, নিরামিষ খাদ্যের মধ্যে 'পনির টিক্কা' (Paneer tikka), 'ডাল মাখানি' (Dal makhani) এবং 'ছোলে ভাটুরে'র (Chole bhature) মত খাবারগুলি উল্লেখযোগ্য। উত্তর ভারতীয় খাবারের প্রধান উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে গম, চাল, মসুর, শাকসবজি, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং সুগন্ধি মশলা যেমন জিরা, ধনে, হলুদ এবং গরম মসলা।
দক্ষিণ ভারত
এবার আসি দক্ষিণ ভারতে। কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং অন্ধ্র প্রদেশের প্রত্যেকেরই নিজস্ব অনন্য রন্ধন ঐতিহ্য রয়েছে, যা অঞ্চলের ভূগোল, ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক দ্বারা প্রভাবিত। "মশলার দেশ" (Land of Spices) হিসাবে পরিচিত কেরালা তার নারকেল-ভরা তরকারি, সামুদ্রিক খাবারের (Seafood) উপাদেয় এবং কলা পাতায় পরিবেশিত ঐতিহ্যবাহী 'সাধ্য মিল'-র (Sadhya meal) জন্য বিখ্যাত। কেরালার রন্ধনপ্রণালী নারকেল, মশলা এবং তাজা সামুদ্রিক খাবারের উদার ব্যবহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। 'মীন কারি' (Meen curry- মাছের কারি), 'অ্যাভিয়াল' (Avial- মিশ্র তরকারি), এবং 'আপাম' (Appam- গাঁজানো চালের প্যানকেক) এর মতো খাবারগুলি কেরালার সুস্বাদু খাবারের উদাহরণ দেয়।
তামিলনাড়ু একটি সমৃদ্ধ রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যের গর্ব করে, যেখানে চেটিনাড রন্ধনপ্রণালী (Chettinad cuisine) তার জ্বলন্ত স্বাদ এবং শক্তিশালী মশলার মিশ্রণের জন্য আলাদা। 'ইডলি' (Idli), 'দোসা' (Dosa) এবং 'সাম্বার' (Sambar) হল তামিল রন্ধনপ্রণালীর প্রধান পদ, যা সমগ্র অঞ্চল জুড়ে উপভোগ করা হয়। তামিলনাড়ুর চেটিনাড রন্ধনপ্রণালী তার জ্বলন্ত স্বাদ এবং দুর্দান্ত মশলার মিশ্রণের জন্য পরিচিত। সিগনেচার ডিশের মধ্যে রয়েছে 'চেটিনাদ চিকেন' (Chettinad chicken), প্রন মাসালা (Prawn masala), এবং 'কুঝি পানিয়ারম' (Kuzhi Paniyaram), প্রতিটি অঞ্চলের সাহসী এবং সুগন্ধি স্বাদকে তুলে ধরে।
কর্ণাটক ম্যাঙ্গালোরিয়ান রন্ধনপ্রণালী-র (Mangalorean cuisine) সুস্বাদু চালের ডাম্পলিং (Rice dumpling) থেকে শুরু করে মহীশূর অঞ্চলের সুগন্ধি 'বিসি বেলে বাথ' (Bisi Bele Bath) পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের খাবার প্রদান করে। রাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলগুলি তাদের সামুদ্রিক খাবারের প্রস্তুতির জন্য বিখ্যাত, যখন অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলি অনন্য নিরামিষ বিশেষত্ব প্রদর্শন করে। কর্ণাটকের রন্ধনপ্রণালী তার অঞ্চল জুড়ে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যাঙ্গালোরিয়ান ফিশ কারি-র মতো সামুদ্রিক খাবারের বিশেষত্ব রয়েছে, যখন অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে 'বিসি বেলে বাথ' এবং 'রাগি মুদ্দে' (Ragi Mudde-ফিঙ্গার মিলেটের বল) মতো নিরামিষ খাবারগুলি অফার করা হয়।
হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি (Hyderabadi biryani), 'গোঙ্গুরা পাচাদি' (Gongura pachadi) এবং 'পেসারাত্তু'-র (Pesarattu) মতো খাবারগুলি স্থানীয় এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করে অন্ধ্রপ্রদেশ তার মশলাদার এবং টক স্বাদের (ট্যাঙ্গি-Tangy) খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ। অন্ধ্রপ্রদেশের রন্ধনশৈলী তার সাহসী এবং মশলাদার স্বাদের জন্য বিখ্যাত, যার মধ্যে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, 'গোঙ্গুরা পাচাদি' (সারা পাতার চাটনি) এবং মিরচি ভাজি (মরিচের ভাজা) মতো খাবারগুলি এই অঞ্চলের রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে৷
পূর্ব ভারত
পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ
মাছ [অনুগ্রহ করে পড়ুন বাঙালী আহারে মাছ] এবং ভাতের প্রতি ভালোবাসার জন্য বিখ্যাত। মাছের ঝোল (মাছের তরকারি), চিংড়ি মালাই কারি (চিংড়ির তরকারি), সরিষা ইলিশ,
এবং ভাপা ইলিশ- এর মতো উপাদেয় পদ যেমন এখানে রয়েছে তেমনই
রাস্তার খাবারের সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত, যেখানে কাঠি রোল, ফুচকা ('পানি পুরি'), এবং ঝাল মুড়ি (মশলাদার পাফড
রাইস) এর মতো সুস্বাদু খাবারগুলি পাওয়া যায়। মিষ্টির মধ্যে এখানে উল্লেখযোগ্য রসগোল্লা,
সন্দেশ, মিষ্টি দই।
ওড়িশার
রন্ধনপ্রণালীতে পাঁচ ফোরোন (পাঁচ-মশলার মিশ্রণ), সরিষার তেল এবং বিভিন্ন
সবজি ব্যবহার করা হয়। 'ডালমা' (মসুর ডাল এবং সবজি দিয়ে প্রস্তুত পদ), 'ছেনা
পোড়া' (ক্যারামেলাইজড কটেজ পনির কেক), এবং 'রসবালি' (ঘন দুধে মিষ্টি
কটেজ পনির বল) এর মতো খাবারগুলি স্থানীয় এবং পর্যটকদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়। [অনুগ্রহ করে পড়ুন ঊড়িষ্যার কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদ: আমার অভিজ্ঞতা]
বিহারের
রন্ধনপ্রণালী তার সরলতা এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত উপাদান ব্যবহারের জন্য পরিচিত। 'লিট্টি
চোখা',
একটি সুস্বাদু গমের ডাম্পলিং যা ভাজা বেসন দিয়ে ভরা হয় এবং আলু এবং
বেগুনের ভর্তার সাথে পরিবেশন করা হয়, এটি এই অঞ্চলের একটি প্রিয়
খাবার। অন্যান্য বিশেষত্বের মধ্যে রয়েছে 'ছাতু পরাঠা', 'ঠেকুয়া' (মিষ্টি ভাজা কুকিজ), এবং 'পুয়া' (মিষ্টি প্যানকেক)।
আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম,
নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা এবং অরুণাচল প্রদেশ সহ ভারতের
উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলি উপজাতীয় সংস্কৃতি এবং বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত
একটি সমৃদ্ধ রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে। প্রতিটি রাজ্যে কচি বাঁশের আগা (Bamboo shoot),
ফার্মেন্টেড মাছ (Fermented fish) এবং স্থানীয় রান্নায় বিশিষ্টভাবে সুগন্ধযুক্ত ভেষজ
উপাদানের মতো উপাদান সহ খাবারের একটি অনন্য বিন্যাস রয়েছে।
আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি পূর্ব ভারতের রন্ধনপ্রণালীকে নানানভাবে প্রভাবিত করেছে। আদিবাসী উপাদান, রান্নার কৌশল এবং রন্ধন প্রথার অবদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যা প্রজন্মের মাধ্যমে চলে আসছে। উদাহরণ স্বরূপ, ওডিশায়, সাঁওতাল (Santal) এবং কোন্ধের (Kondh) মতো উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলি স্থানীয় রন্ধনপ্রণালীতে বাজরা, বুনো মাশরুম (Wild mushroom), কচি বাঁশের আগা (Bamboo shoot), ফার্মেন্টেড মাছ (Fermented fish), সুগন্ধি ভেষজ এবং বন্য সবুজ শাক-সবজির মতো উপাদানগুলি প্রবর্তন করেছে, এমন খাবার তৈরি করেছে যা পুষ্টিকর এবং স্বাদযুক্ত উভয়ই। একইভাবে, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, নাগা এবং খাসিদের মতো উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলি স্মোকিং (Smoking), শুকানো (Drying) এবং ফার্মেন্ট (Ferment) করার মতো প্রাচীন খাদ্য সংরক্ষণের কৌশলগুলি সংরক্ষণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গে, মাছকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করার জন্য প্রায়শই শুকানো হয়। শুঁটকি মাছ এক ধরণের ডেলিকেসি (Delicacy)।
একইভাবে, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, কচি বাঁশের আগা এবং ফার্মেন্টেড মাছের মতো উপাদানগুলি সাধারণত 'অ্যাক্সোন' (Axone- গাঁজানো সয়াবিন) এবং 'এরোম্বা' (Eromba- গাঁজানো মাছের তরকারি) এর মতো খাবারগুলিতে গভীরতা এবং উমামি স্বাদ যোগ করতে ব্যবহৃত হয়। এই সংরক্ষণ কৌশলগুলি শুধুমাত্র উপাদানগুলির শেলফ লাইফকে প্রসারিত করে না বরং পূর্ব ভারতীয় রন্ধনশৈলীর অনন্য স্বাদ প্রোফাইল এবং রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যগুলিতে অবদান রাখে, এটিকে গ্যাস্ট্রোনমিক (Gastronomic) আনন্দের ভান্ডারে পরিণত করে।
পশ্চিম ভারত
ভারতের ব্যস্ততম
আর্থিক রাজধানী মুম্বাইয়ের আবাসস্থল মহারাষ্ট্র, তার বৈচিত্র্যময়
এবং স্বাদযুক্ত খাবারের জন্য পরিচিত। মুম্বাইয়ের মশলাদার রাস্তার খাবার, যেমন 'বড়া পাও' (Vada Pav) এবং 'পাও ভাজি' (Pav Bhaji) থেকে শুরু করে মালভানি অঞ্চলের সমৃদ্ধ এবং সুগন্ধযুক্ত
কারি পর্যন্ত, মহারাষ্ট্রে সব রকম স্বাদের খাবারের সম্ভার রয়েছে।
গুজরাট, প্রায়শই "নিরামিষাশীদের দেশ" হিসাবে উল্লেখ করা হয়, এমন একটি রন্ধনপ্রণালী রয়েছে যা নিরামিষ-বান্ধব এবং স্বাদে সমৃদ্ধ। গুজরাটি
থালি, একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার যা স্টেইনলেস স্টিলের থালায় পরিবেশন
করা হয়, এতে ডাল, 'কাড়ি' (Kadhi), শাকসবজি, ভাত এবং রুটির মতো খাবারের ভাণ্ডার রয়েছে,
যা এই অঞ্চলের স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবারের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন
করে।
রাজস্থান, তার শুষ্ক ল্যান্ডস্কেপ এবং রাজকীয় দুর্গের জন্য পরিচিত, একটি রন্ধনপ্রণালী অফার করে যা তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মতোই সমৃদ্ধ এবং প্রাণবন্ত।
রাজস্থানী রন্ধনপ্রণালীর বৈশিষ্ট্য হল এর মশলা, শুকনো ফল এবং
দুগ্ধজাত দ্রব্যের ব্যবহার, যেখানে 'ডাল বাটি চুরমা' (Dal Baati Churma), 'গাত্তে কি সবজি' (Gatte ki Sabzi) এবং 'লাল মাস'-র (Laal Maas) মতো খাবারগুলি এই অঞ্চলের রন্ধনসম্পর্কীয় দক্ষতা
প্রদর্শন করে।
গোয়া, এর আদিম সমুদ্র সৈকত এবং শান্ত পরিবেশ সহ, সামুদ্রিক খাবারের সুস্বাদু এবং পর্তুগিজ-অনুপ্রাণিত খাবারের জন্য বিখ্যাত। গোয়ান রন্ধনপ্রণালীতে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক তরকারি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আইকনিক ফিশ কারি রাইস, পাশাপাশি 'গোয়ান সসেজ পোলাও' (Goan Sausage Pulao) এবং 'বেবিঙ্কা'-র (Bebinca) মতো ফিউশন খাবার, নারকেল দুধ এবং ডিম দিয়ে তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী গোয়ান ডেজার্ট। গোয়ান রন্ধনপ্রণালীতে, সামুদ্রিক খাবার একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, এই অঞ্চলের উপকূলীয় অবস্থান এবং প্রচুর সামুদ্রিক সম্পদের জন্য ধন্যবাদ। মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া এবং গলদা চিংড়ি সাধারণত গোয়ান খাবারে ব্যবহার করা হয়, যা তাদের সাহসী স্বাদ, ট্যাঙ্গি সস (Tangy sauce) এবং হলুদ, মরিচ এবং তেঁতুলের মতো মশলার উদার ব্যবহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, 'ফিশ কারি রাইস' (Fish Curry Rice): গোয়ান রন্ধনপ্রণালীর একটি প্রধান খাবার, এই থালাটিতে একটি ট্যাঙ্গি নারকেল তরকারিতে সিদ্ধ করা মাছ, ভাপানো ভাত এবং ভাজা মাছের সাথে পরিবেশন করা হয়; 'প্রন বালচাও' (Prawn Balchão): চিংড়িগুলি ভিনেগার, মরিচ এবং মশলা দিয়ে তৈরি একটি মশলাদার এবং ট্যাঞ্জি মসলায় মেরিনেট করা হয়, তারপরে সিদ্ধ করা হয়।
রাজস্থানে, যেখানে জলের ঘাটতি একটি চ্যালেঞ্জ, বাজরা দীর্ঘকাল ধরে
তাদের স্থিতিস্থাপকতা (Resilience) এবং পুষ্টির মূল্যের কারণে একটি প্রধান খাদ্য উৎস। বাজরা,
জোয়ার এবং রাগি দিয়ে প্রস্তুত রুটি বা চাপাটি (ফ্ল্যাটব্রেড), পোরিজ (Porridge) এবং
ডেজার্ট (Dessert) সহ বিভিন্ন ধরণের খাবার তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
আশা করি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানীয় খাদ্যসম্ভারের একটা চিত্র তুলে ধরতে পারলাম। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে, এছাড়াও অনেক পদ বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে, সমস্ত পদের বর্ণনা একটি সংক্ষিপ্ত ব্লগে সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি আইকনিক পদের বর্ণনা এই ব্লগটিতে করলাম।
সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
মালদা: পর্ব-২ -র পর [পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে অনুগ্রহ করে ক্লিক করুন মালদা: পর্ব-১, মালদা: পর্ব-২]
হাবশী বংশের পরে বাংলার শাসনভার ন্যস্ত হয় হুসেন শাহী বংশের (১৪৯৪ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ) উপর। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। বড়ো সোনা মসজিদ বা বারদুয়ারী মসজিদের নির্মাণ কার্য আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময়কালে আরম্ভ হলেও নির্মাণকার্যটি শেষ হয় নাসিরুদ্দিন নসরৎ শাহের আমলে।
সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
মালদা ভ্রমণের প্রথম পর্বটি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন মালদা: পর্ব-১
গতকাল রেডিওতে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে। হোটেলে প্রাতঃরাশ সকাল ৮ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত। আমরা পৌনে ন'টার মধ্যে প্রাতঃরাশ সেরে ন'টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। গতকালই আমি অটো-র জন্যে বলে রেখেছিলাম। সঠিক সময়ে আমাদের অটো চালক দাদা এসে গিয়েছিলেন। বর্তমানে মালদা শহরের দক্ষিণে গৌড় এবং উত্তরে রয়েছে পাণ্ডুয়া। আমরা সকালে প্রথমে গৌড় ঘুরে মধ্যাহ্নভোজন সেরে পাণ্ডুয়া ঘুরতে যাবো। ঐতিহাসিক স্থানের বর্ণনা দিতে গেলে একটা কালানুক্রম বজায় রাখা প্রয়োজন, তবেই পারম্পর্য বোঝা যায়, নচেৎ স্থানটিকে অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যায়, তবে ঘোরা তো আর সেইভাবে হয় না, যে স্পটটি আগে পরে সেটি আগে ঘুরে নিতে নয়। তাই আমি এখানে আমার বেড়ানো অনুযায়ী নয় বরং ইতিহাসের হাত ধরে পাঠক-পাঠিকাকে আমাদের বেড়ানোটির বর্ণনা করবো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক স্থাপত্যটির সম্বন্ধে যে বর্ণনা পুরাতত্ত্ব বিভাগের বোর্ডে লেখা রয়েছে তার চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করবো যাতে পাঠক পাঠিকা তথ্য সম্বন্ধে সেখান থেকেও অবগত হতে পারেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণকাহিনী (গবেষণাধর্মী বা গবেষণা নির্ভর ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়) যার অন্যতম উপাদান স্থানীয় গাইডদের প্রদত্ত তথ্য, সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান, প্রচলিত লোককথা, বিশ্বাস ইত্যাদি।
যে গৌড়ের প্রতি অসীম আগ্রহে আমরা এসে পৌঁছলাম, তখন সেখানে লক্ষণাবতী নামে এক নগর ছিল। কাশী জয় করে প্রবল পরাক্রমী লক্ষণ সেন নৌ-পথে এসে পৌঁছলেন মহানগরে। তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্যে পিতা বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ বল্লালবাটী তো বটেই সেজে উঠেছিল সমগ্র নগর। আজ আমরা যে ধ্বংসাবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, তাই অতীতের বল্লালবাটী, বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ। জানিনা আর কতদিন এই অবশেষটুকু টিঁকবে, বিশেষ কোনো সংরক্ষণ চোখে পড়েনি।
এই সেই সেন বংশ (১৭৭০-১২৩০ খ্রিস্টাব্দ) যার প্রবল পরাক্রমে পাল বংশের রাজা গোপালদেব ত্যাগ করলেন বঙ্গদেশ। পরাজিত হৃতসর্বস্ব রাজা গোপালদেব আশ্রয় গ্রহণ করলেন মগধে। পাল বংশের রাজত্ব অস্তমিত হলো, ধন-সম্পত্তি বিলুপ্ত হলো, কামরূপ থেকে প্রয়াগ পর্যন্ত একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো সেন বংশের, কিন্তু পাল বংশের উদারতা, শিক্ষা-দীক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা, উন্নত সমাজচেতনা- এসব কিন্তু আজও প্রশংসিত, সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারলো না পরবর্তী শাসক। এর একটি নিদর্শন রয়েছে মালদা জেলার হাবিবপুর ব্লকের জগজ্জীবনপুর আর্কিওলজিক্যাল সাইটটিতে। সময়ের অভাবে আমরা যেতে পারিনি তবে পর্যটকরা দেখে আসতে পারেন। সাইটটি মালদা শহরের কেন্দ্র ইংরেজ বাজার থেকে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই স্থান থেকে পাওয়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে পাল সম্রাট মহেন্দ্রপালদেবের একটি তাম্র-ফলক শিলালিপি এবং নবম শতাব্দীর একটি বৌদ্ধ বিহারের কাঠামোগত অবশেষ যা নন্দদীর্ঘিকা-উদ্রাঙ্গ মহাবিহার নামে পরিচিত।
এরপর অনেক দিন অতিবাহিত হয়েছে। কালের নিয়ম মেনেই একের পর এক শাসক এসেছেন, প্রবল পরাক্রমে নিজেকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠা করেছেন, আবার কালের নিয়মেই সে যুগের সমাপ্তি হয়েছে। বাংলায় সেন বংশের পরে বখতিয়ার খিলজির হাতে গড়ে উঠেছে খিলজি সাম্রাজ্য, তারপর দিল্লি সালতানাত মামলুক এবং তুঘলক সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলায় গভর্নর নিযুক্ত হন। তুঘলক সাম্রাজ্যের মাঝামাঝি সময় থেকে ইলিয়াস শাহী বংশের হাত ধরে বাংলার স্বাধীন সুলতানী যুগের আরম্ভ হয়।
বাংলায় তখন ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্ব (১৩৫২ থেকে ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ) চলছে। ইলিয়াস শাহী বংশের দ্বিতীয় সুলতান সিকান্দার শাহের (১৩৫৮ থেকে ১৩৯০ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকালে নির্মিত হয় এই আদিনা মসজিদ। দিল্লীর সুলতানী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দুই বার জয়লাভের (যথাক্রমে ১৩৫৩ এবং ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দ) এই মসজিদটি ছিল এই বংশের উচ্চাশার একপ্রকার প্রকাশ। মসজিদটির দেওয়ালের লিপিতে সুলতান সিকান্দার শাহকে একজন 'মহিমান্বিত সুলতান' বা 'বিশ্বস্থতার খলিফা' বলে বর্ণিত হয়েছে।
জানুয়ারী, ২০২৪
সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
সকাল ন'টায় কলকাতা স্টেশন থেকে রওনা হয়ে ১২৩৬৩ কলকাতা-হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট সঠিক সময় বিকাল ৩টে-তে মালদা টাউন পৌঁছলো। আর আমরা এসে পৌঁছলাম অতীতের মহানগর গৌড়ে। ১ নম্বর প্লাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে পাওয়া যায় টোটো, সেই বাহনই আমাদের পৌঁছে দিলো হোটেলে। রেলওয়ে স্টেশন থেকে যে রাস্তাটি রথবাড়ি মোড়ের দিকে চলে যাচ্ছে, সেই রাস্তার উপরেই হোটেল। রেলগাড়িতে ঝালমুড়ি, পেয়ারা মাখা (বেশ কয়েক বৎসর হলো বিভিন্ন ফল মেখে বিক্রয় করার প্রচলন হয়েছে। পূর্বে, আমার ছোটবেলায়, সাধারণত দোকানী পেয়ারা কেটে তাতে নুন, কখনও বিট নুন, দিয়ে ঠোঙায় করে দিতেন। এখন দেখি, পেয়ারা কেটে তাতে কাসুন্দি, নুন, বিট নুন, লঙ্কার গুঁড়ো ইত্যাদি দিয়ে মেখে কাগজের প্লেটে করে দেয়। খেতে ভালোই লাগে, তবে অন্যান্য উপকরণের প্রাধান্যে পেয়ারার স্বাদের গুরুত্ব কমে যায়।), চা, কেক ইত্যাদি টুকিটাকি খাওয়া চললেও দুপুরের খাওয়া হয়নি, কাজেই হোটেলে পৌঁছে প্রথম গন্তব্য হোটেলের রেস্তোরাঁ। খাওয়া-দাওয়া সারার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা শহরটা একটু ঘুরতে বেরোলাম। মালদা ভ্রমণ আমাদের এই প্রথম, এমনিতে কর্মব্যস্ততার কারণে খুব একটা ঘোরা হয়ে ওঠেনা আমার, যা ঘোরা সম্ভব হয় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্মসূত্রে। আমাদের হোটেলটির নিকটে রয়েছে একাধিক আধুনিক রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, হোটেল, ব্যাঙ্কের এটিএম, মন্দির, দোকান-বাজার; সব মিলিয়ে বেশ শহর, তবে কোলাহল কিছুটা কম। এদিকটা ঘুরে এবার চললাম রথবাড়ি মোড়ের উদ্দেশ্যে। এটি মালদা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, কলকাতা থেকে শিলিগুড়ির বাসগুলি এই মোড় হয়েই যায়। এখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার বাস বা গাড়ি ছাড়ে, এমনকি শহরটির দর্শনীয়স্থানগুলি ঘোরার জন্যে এখন থেকেই গাড়ি রিসার্ভ করা যায়। হাঁকডাক, কোলাহল, মানুষের ব্যস্ততা সব মিলিয়ে স্থানটি নিজের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে। বাঙালী জীবনে চা একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমরা সাধারণত দিনে অল্প অল্প পরিমানে অনেক বার চা খাই। বর্তমানে সেই চায়ের আবার বিভিন্ন রূপ, কেউ খান দুধ-চিনি সহযোগে, কেউ দুধ ছাড়া চিনি দিয়ে, কেউ দুধ দিয়ে চিনি ছাড়া, আবার কেউ দুধ এবং চিনি উভয় উপকরণই বর্জন করে শুধু চা। দোকানী কিন্তু বেশ মনে রেখে চা তৈরী করে পরিবেশন করে যান। কোলাহল প্রিয় আমাদের আনন্দটা আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিলো এক কাপ চা, ভালো লাগলে আরও এক কাপ।
জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহ, এখনও বেশ ঠান্ডা রয়েছে এখানে। এ বৎসর পশ্চিমবঙ্গে ঠান্ডাটা বেশ জমিয়ে পড়েছে, এটা উপভোগ্য। গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে শীত আমার কাছে অনেক প্রিয়। ছোটবেলায় কোনো এক ছোটদের পত্রিকায় কুয়াশার মধ্যে দিয়ে খেঁজুরের রসের বাঁক হাতে ক্ষেতের আল বেয়ে এক ব্যক্তি আসছেন আর এক দোকানী গ্রাম্য রাস্তার ধারে উনুন ধরিয়ে চা তৈরীর আয়োজন করছেন- এরূপ একটি চিত্র দেখেছিলাম। এই ছবিটি এখনও আমার মনে গেঁথে রয়েছে এবং আমার প্রিয় শীতকালের রূপ আজও ওই ছবিটির আধারেই আধারিত। আর শুধু কি তাই ! পৌষ পার্বনের পিঠে-পুলি, জয়নগরের মোয়া, পাটালি গুড়, পিকনিক, চিড়িয়াখানা ঘোরা, ভোরবেলা কাঁপতে কাঁপতে স্নান করে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি দেওয়া কি ছিল না ছোটবেলার শীতকালে। তবে ধূলোর প্রকোপ দেখলাম বেশ বেড়েছে, কুয়াশার সাথে মিশে স্মগ তৈরী করছে। দূষণের মাত্রা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের একটা ধারণা রয়েছে যে গ্রামে বোধহয় শহরের মতন দূষণের প্রকোপ নেই, কিন্তু বাস্তবে তা মনে হলো না, এই ভ্রমণের সময় সর্বত্রই, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে দূষণের চিত্রটা একই রকম দেখলাম। এটা নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত প্রয়োজনীয় বলেই মনে হয়, অন্যথায় মানুষের জীবনে এর নেতিবাচক পরিনাম পড়বে এবং তা নিয়ন্ত্রণ যে সহজ হবে না তা বলাই বাহুল্য।
রথবাড়ি থেকে হোটেলে ফিরে স্নান সেরে দেখি আমার বড়ো পিসির এক আত্মীয় আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন, আমার সাথে প্রথম পরিচয়, পূর্বে কখনও পরিচয় হয়েছে তা মনে পড়ে না। এঁরা মালদা-র বাসিন্দা, আমাদের জন্যে এখানকার আম-কাসুন্দির আচার নিয়ে এসেছিলেন। সেই আচারের বোতলটি আমরা ফেরার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছি। এখন যখন এই ভ্রমণ কাহিনীটি লিখছি, সেই আঁচারের স্বাদ আমি গ্রহণ করেছি, অপূর্ব স্বাদ। পরবর্তী ব্লগে মালদার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলির ভ্রমণের বর্ণনা করার চেষ্টা করবো।
সপ্তাহান্তে বা ছোট কোনো ছুটিতে ঐতিহাসিক স্থান মালদা ঘুরে আসা যেতে পারে।
জানুয়ারী, ২০২৪
সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
আমরা আমাদের খাদ্যের দিকে একটু তাকাই, দেখবো খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে, তা ব্যবহার হচ্ছে এবং অব্যবহৃত অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা সরলরেখার ন্যায় (Linear economy)। উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste)। কিন্তু এই যে অংশটি ব্যবহার হচ্ছে না, তা উৎপাদন করতেও তো পয়সা লেগেছে। শুধু যে পয়সা লেগেছে, এমনটা নয়, জমি লেগেছে, জল লেগেছে, সার লেগেছে, আবার সেই অতিরিক্ত সার পরিবেশের উপর ঋণাত্মক প্রভাবও ফেলেছে - এ সকলই তো বৃথা গেলো, কোনো উপকার তো হলোই না, বরং অপকার হলো। কাজেই, এই উৎপাদন-ব্যবহার-নষ্ট (Make-Take-Waste) মডেলটি কার্যকরী হচ্ছে না। তবে কি করতে হবে? এই সরলরৈখিক সম্পর্কটিকে বৃত্তাকার সম্পর্কে (Circular economy) পরিণত করতে হবে। অর্থাৎ কিছু নষ্ট করা চলবে না, পুনর্ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য দিতে হবে। এই বৃত্তের তিনটি অংশ, যথা- সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী উৎপাদন (Sustainable production), সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী ব্যবহার (Sustainable use), এবং পুনর্ব্যবহার (Recycle)।
সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী উৎপাদন হলো এমন এক উৎপাদন পদ্ধতি যাতে প্রকৃতির উপর অধিক চাপ পড়বে না, প্রাকৃতিক সম্পদের (ভূমি, জল ইত্যাদি) অতিরিক্ত শোষণ হবে না, আবার অতিরিক্ত মাত্রায় ইনপুট (রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হার্বিসাইড ইত্যাদি) প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করবে না। এর প্রধান উপাদান হলো সাস্টেনেবল কৃষি অনুশীলন, যেমন অর্গানিক ফার্মিং, অ্যাগ্রোফরেষ্ট্রী, ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (Integrated Pest Management), উপযোগী সেচ ব্যবস্থা, বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি, অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার না করা ইত্যাদির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা (অনুগ্রহ করে পড়ুন বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা)। একথা সঠিক যে, এর জন্যে গবেষণা এবং পরিকাঠামোর প্রয়োজন। পেস্ট কীটের জীবন চক্র পর্যালোচনা করে, যাকে ফেনোলজি বলা হয়, কোন সময়ে আধিক্য হবে তা সহজেই নিরূপণ করা যায় এবং রাসায়নিকের উপযুক্ত মাত্রা নির্ধারণ করাও কঠিন নয়, কাজেই এর মাধ্যমে অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সহজেই হ্রাস করা যায়, এবং প্রকৃতির উপর এর কুপ্রভাবগুলিকে এড়ানো সম্ভব। আজ অনেক অঞ্চলে অতিরিক্ত সারের ব্যবহারের ফলে মৃত্তিকার অবনমন ঘটেছে, এরূপ ঘটতে থাকলে ভবিষ্যতের খাদ্য উৎপাদন প্রশ্নের সামনে পড়বে। কৃষিক্ষেতে যেমন জলের প্রয়োজন, ঠিক তেমনই অতিরিক্ত জল অপ্রয়োজনীয়। তাই যতটুকু জল প্রয়োজন ঠিক ততটুকু জলই ব্যবহার করা উচিত, এই কারণে উন্নত সেচের ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন, এতে ফলনের কোনো ঘাটতি হবে না আবার জলের অপচয়ও বন্ধ হবে। এই সকল কার্যসাধনের জন্যে নীতি (Policy) নির্ধারণ প্রয়োজন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন কৃষি নীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় এই বিষয়ে আমাদের দেশ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নীতি প্রণয়ন করেছে যার মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চাই যোজনা, ক্ষুদ্র সেচ তহবিল গঠন ইত্যাদি।
আরবান কৃষি (Urban agriculture) একটি খুবই উপযোগী পদ্ধতি, এর মাধ্যমে খাদ্য তথা পুষ্টি নিশ্চয়তা যেমন একাধারে বৃদ্ধি পায় তেমনই পরিবেশের কার্বন সিকোয়েস্ট্রেট (Carbon sequestrate) করতেও গাছগুলি সাহায্য করে। সাস্টেনেবল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন। কৃষক কোঅপারেটিভ গড়ে তুলে কিংবা কমিউনিটি সমর্থিত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলে সাস্টেনেবল উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
এর পর আসি সাস্টেনেবল বা সুস্থায়ী ব্যবহারে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এক্ষেত্রে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে আর সব কিছুর সাথে সাথে খাদ্যেরও বিশ্বায়ন হয়েছে, যদিও আমাদের খাদ্য তালিকায় যেরূপ পিজ্জা বা বার্গার প্রবেশ করেছে সেরূপ বিদেশে কোনো স্থানে আমাদের খিচুড়ি, বা নলেন গুড় পরিবেশিত হতে আমি দেখিনি (অনুগ্রহ করে পড়ুন আমাদের খাদ্যের পশ্চিমায়ন)। যাইহোক, সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। এখন ক্রেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুষম আহার বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ অবহিত হয়েছেন বা ধীরে ধীরে অবহিত হচ্ছেন। যদিও এর গতি আরও একটু বৃদ্ধি পেলে ভালো হয়। খাদ্যে সকল প্রকার নিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতি নিয়ে মানুষ সচেতন হলে খাদ্যের বৈচিত্র্য বাড়বে, যা প্রকারান্তরে পুষ্টির নিশ্চয়তাকে বৃদ্ধি তো করবেই এবং জীব বৈচিত্র্যকেও সমর্থন করবে। আজ ক্রেতারা অনেক বেশি সচেতন সে কথা পূর্বেই বলেছি, এই সচেতনতা যে কেবল মাত্র খাদ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে তা নয়, খাদ্যটি কিরূপে উৎপন্ন হয়েছে সেটি নিয়েও সচেতনতা রয়েছে। আজকাল আমরা প্রায়ই বিভিন্ন প্রোডাক্টের লেবেলে 'অর্গানিক' কথাটি লিখে থাকতে দেখি, অনেকে একটু দাম বেশি হলেও সেটি ক্রয় করেন কারণ খাদ্যটির মধ্যে রাসায়নিক দূষণ যেমন তাঁরা পছন্দ করেন না তেমন পরিবেশের দূষণও সচেতন মানুষ পছন্দ করছেন না। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ক্রেতাদের সচেতনতার পাশাপাশি কিন্তু বিক্রেতাদেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমি যখন আমার দেশে বাজার করতে যাই প্রয়োজন মতন শাক-সব্জি কিনতে পারি, কোনোটা সাড়ে সাতশো গ্রাম, কোনটা দেড় কেজি, আবার কোনটা দেড়শো গ্রাম; অর্থাৎ যেটা যতটা লাগে। কিন্তু আমি যখন অন্য একটি উন্নত দেশে বিশাল এক শপিং মার্টে বাজার করার জন্যে উপস্থিত হই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিক্রেতার হিসেবে পূর্ব নির্ধারিত ওজনের দ্রব্যই কিন্তু আমাকে কিনতে হয়, নিজের প্রয়োজন মতন নয়। এতে কোনো দ্রব্য হয়তো ৫০০ গ্রাম প্রয়োজন কিন্তু আমি ১ কেজি নিয়েছি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ব্যবহার না হাওয়ায় সেটি পচে নষ্ট হয়েছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের মতন দেশগুলির খাদ্যদ্রব্য যেটুকু নষ্ট হয় তার অধিকাংশ হয় ফসল তোলার সময়ে। দেশের বাড়িতে বেগুনে পোকা পাওয়া যায় বৈকি, তবে সব্জি ঘরে থেকে পচে যায়না, কারণ বাজার প্রয়োজন অনুযায়ী করা হয়। কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে ফসল তোলার সময়ে নষ্ট হয় না, তা মূলত নষ্ট হয় এইভাবে।
কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যে একটি বৃত্তাকার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য হ্রাস পরিবেশের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে পুনর্ব্যবহার করার একটি উদাহরণ হল অন্যান্য প্রক্রিয়ার জন্য মূল্যবান ইনপুট তৈরি করতে কৃষি উপ-পণ্যের ব্যবহার। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, শস্য সংগ্রহ থেকে অবশিষ্ট উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ, যেমন ডালপালা এবং পাতা, কম্পোস্টিং এর মাধ্যমে জৈব সার তৈরি করার জন্য পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি শুধুমাত্র ল্যান্ডফিল থেকে এই উপাদানগুলিকে সরিয়ে দেয় না তবে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলিকে মাটিতে ফিরিয়ে দিয়ে পুষ্টির ঘাটতি বন্ধ করে দেয়। ফলস্বরূপ, এটি স্বাস্থ্যকর এবং আরও উর্বর কৃষি জমিকে উন্নীত করে, কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থায় সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্থায়ী এবং বৃত্তাকার পদ্ধতির সমর্থন করে। এই ধরনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য অনুশীলনগুলিকে বৃদ্ধি করে, শিল্প পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস, সম্পদ সংরক্ষণ এবং আরও স্থিতিস্থাপক এবং সুস্থায়ী খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরিতে অবদান রাখতে পারে।
সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)
বিশ্বায়নের প্রভাব আজকের জীবনে সর্বত্র। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক, পাঠক-পাঠিকা দেখুন তো বিষয়টি পরিচিত কিনা !
দৃশ্য ১- এই তো সেদিন দুর্গাপুজোর শিরনামা (বা ব্যানার) নিয়ে আলোচনার সময়ে জনৈক ব্যক্তি শিরনামাটি বাংলা ভাষায় তৈরী করতে বললেন, তবে মত ভারী হলো ইংরেজী ভাষায় ব্যানারটি লেখার পক্ষে।
দৃশ্য ২- জনৈক ব্যক্তি তাঁর নিকট এক আত্মীয়র বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন কিন্তু রাস্তায় গাড়ির ভিড় অত্যন্ত বেশি থাকায় দেরি হয়ে যাচ্ছে। বারবার মুঠোফোনটি বেজে উঠছে, সবাই যে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে, সে গেলে তবে কেক কাটা হবে।
দৃশ্য ৩- বাড়িতে আজ অনেক বন্ধু-বান্ধব এসেছে। অনেক দিন পরে দেখা-সাক্ষ্যাতের সুযোগ পেয়েছে সবাই। সবাই ঠিক করলো পিজ্জা আর কোক অর্ডার দেওয়া হবে।
এরূপ বিভিন্ন দৃশ্য আজ চতুর্দিকে দৃশ্যমান। তবে এর মধ্যে থেকে খাদ্যের বিষয়টিতে আলোকপাত করা আমার উদ্দেশ্য। আজকের নগরকেন্দ্রিক ভারতে পশ্চিমা খাদ্য সংস্কৃতি বেশ চোখে পরে। মানুষের মধ্যে অধিক প্রক্রিয়াজাত খাবার (Ultra-processed foods) এবং পানীয়ের পছন্দ উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ছে। বিশ্বায়নের ফলে দেশগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্য আর সব কিছুর সাথে রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যেরও ভাগাভাগি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, টেলিভিশন শো এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পশ্চিমা খাবারের এক্সপোজার (Exposure) ভারতীয় জনমানসে পশ্চিমা খাবারের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহে অবদান রেখেছে। নগরায়ন এবং যৌথ পরিবারের স্থানে ক্ষুদ্র পরিবারের (Nuclear family) উত্থান ঐতিহ্যগত খাদ্যাভ্যাস (Traditional food habit) পরিবর্তন করেছে। ব্যস্ত শহুরে জীবনধারা প্রায়শই দ্রুত এবং সুবিধাজনক খাবারের (Convenient food) জন্য অগ্রাধিকার দেয়, যার মধ্যে পশ্চিমা-স্টাইলের ফাস্ট ফুড এবং প্যাকেটজাত খাবার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। রেস্তোরাঁ এবং ফাস্ট-ফুড চেইন (Fast food chain) সহ আতিথেয়তা শিল্প (Hospitality industry) পশ্চিমা স্বাদগুলি প্রবর্তন এবং জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা বলাই বাহুল্য। ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি এবং পিৎজা হাট-এর মতো আন্তর্জাতিক ফাস্ট-ফুড চেইনগুলির ভারত জুড়ে শহুরে কেন্দ্রগুলিতে উপস্থিতি রয়েছে। এখানে দু'টি তথ্য উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ভারতে প্রথম ম্যাকডোনাল্ডস রেস্তোরাঁটি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে মুম্বইয়ের বান্দ্রাতে খুলেছিলো। বর্তমানে (২০২২ খ্রিস্টাব্দের কোম্পানিটির রিপোর্ট অনুযায়ী) ভারতে ৫১২ টি ম্যাকডোনাল্ডস রেস্তোরাঁ রয়েছে। অন্যদিকে ভারতবর্ষের ৩৭১ টি শহরে ডোমিনোসের ১৭০১ টি রেস্তোরাঁ রয়েছে (২০২২ খ্রিস্টাব্দ)। এতো শুধু এই কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফাস্ট-ফুড চেইনের পরিসংখ্যান। এর পাশাপাশি বিভিন্ন রাস্তার ধারের স্টলে (Street food stall) বা স্থানীয় রেস্তোরাঁতেও এই সকল খাদ্যগুলি সুলভ। এখানে উল্লেখ্য, ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁগুলিতেও (Fine dining restaurant) প্রায়শই ফিউশন উপাদানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য রন্ধনশৈলীকে মিশ্রিত করে বিভিন্ন স্বাদের জন্য। পাশ্চাত্য উপাদান (Western ingredients/Recipes) এবং রান্নার কৌশলগুলি (Culinary) ক্রমবর্ধমানভাবে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় রেসিপিগুলিতে একত্রিত হচ্ছে।
ফিউশন রন্ধনপ্রণালী (Fusion culinary), যা ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উভয় রান্নার উপাদানকে একত্রিত করে, জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আজকে "বাটার চিকেন পিজ্জা" বা "ভারতীয় মশলা সহ মশলাদার পাস্তা" এর মতো খাবারগুলিতে প্রায় প্রতিটা শহরেই সুলভ এবং তা আমাদের রসনা তৃপ্ত করে।
এখন প্রশ্ন হলো এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসলাম কেন ? বিশ্বায়ন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় তো ভালো, তবে সমস্যা কোথায় ? আসলে আমার মনে হয় বিশ্বায়নের মূল সূত্রটি গাঁথা 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে'- তে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে')। এখন যদি শুধু নেওয়ার দিক ভারী হয় তবে তা ভারসাম্য হারায়। আহারের বৈচিত্র সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এক প্রকারের আহার্যের ক্রমবর্ধমান চাপে যেন অন্য আহার্য বস্তুগুলি ক্রমে হারিয়ে না যায়, সেটা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। যে প্রকারে আমরা পশ্চিমের খাদ্যবস্তুগুলিকে আপন করে নিয়েছি, এমনকি বেশ কিছুক্ষেত্রে আমাদের স্বাদ অনুসারে মেটামর্ফোস (Metamorphose) করেছি সেই প্রকারে আজ পর্যন্ত কিন্তু আমাদের খাদ্যগুলিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। আমাদের খিচুড়ি, ইডলি, দোসা, নারকেলের তক্তি, চন্দ্রপুলি, পিঠা, আঁচার ইত্যাদি একান্ত আমাদের খাদ্যগুলি নিজেদের মধ্যেই যে শুধু সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে তা নয়, বরং অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন অধিক প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলির সাথে প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়েই পড়ছে। কাজেই এক্ষেত্রে বিশ্বায়নের থেকে পশ্চিমায়নের পাল্লাটি অধিক ভারী হয়ে পড়েছে। এটি সম্ভাব্যভাবে ঐতিহ্যগত রন্ধনপ্রণালীকে (Traditional culinary) ক্ষয় করা এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের সাথে যুক্ত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলিতে অবদান রাখার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। আমাদেরও আমাদের নিজস্ব খাদ্যগুলিকে বিশ্বের সামনে আরও অধিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।
সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh) রাজমহল: পর্ব-১ -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...