পৃষ্ঠাসমূহ

বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য (Ecosystem services and Foods)

সম্পত ঘোষ  (Sampat Ghosh)

'আঃ বড্ড দাম নিচ্ছ, তরকারীতে তো হাত দেওয়ার উপায় নেই গো'খদ্দেরের অভিযোগ শুনে বিক্রেতা একগাল হেসে, 'আমরাও তো দাম দিয়ে কিনে আনি বাবু, কতটুকু আর লাভ থাকে! তবে মাল আমার এখানে এক্কেবারে টাটকা' এই বলে প্রয়োজনীয় সব্জিগুলি খদ্দেরকে গুছিয়ে দিয়ে দেয়। খদ্দেরবাবু মনে মনে একটু খুশি হয়, অতিরিক্ত দামের জন্যে মনের মধ্যে যে ক্ষতটা সৃষ্টি হচ্ছিলো, টাটকা সব্জি কিনতে পেরে সেই ক্ষতে মলম পড়ে।

এই যে খাবারগুলি প্রত্যহ আমরা খাই, তা উৎপাদন করতে আমাদের একটা খরচ হয়, যেমন ধরা যাক চারা বা বীজ কিনে আনা, রোপন করা, উপযুক্ত পরিমানে জল (সেচের মাধ্যমে বা ভূগর্ভস্থ জল তুলে), সার (পরিপূরক হিসেবে), কীটনাশক (প্রয়োজন অনুযায়ী) সরবারহ করা, ফসল তোলা, এবং বাজারজাত করা; প্রত্যেকটি ধাপে কিন্তু খরচ হয় আর এই সমগ্র খরচের উপর বিক্রয়মূল্য নির্ভর করে। মনে রাখা প্রয়োজন, এখানে কিন্তু প্রকৃতি আমাদের থেকে কোনো দাম নেয় না। একটু সহজ ভাষায় বলি, এই যে কৃষি বাস্তুতন্ত্রটি (Agro-ecosystem) প্রকৃতি প্রদান করছে, যেমন ভূগর্ভস্থ বা পৃষ্ঠদেশের জলভাণ্ডার, মাটি যেখানে পুষ্টি উপাদানগুলি রয়েছে যা উদ্ভিদকে জীবনধারণে সাহায্য করে, পরাগবহনকারী প্রাণী (Pollinators) বিশেষত পতঙ্গ (Insects) যা পরাগ সংযোগের জন্যে অপরিহার্য, সেই সকল প্রাণী (যারা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল (Biological control) বলে পরিচিত) যারা শস্যের জন্যে ক্ষতিকারক পতঙ্গগুলিকে ধ্বংস করে; এই তাবৎ সেবা কিন্তু বিনামূল্যেই (বাজার অর্থনীতির বাইরে) প্রাপ্ত হচ্ছে। যদি প্রকৃতি এর জন্যে বাজারমূল্য ধার্য করতো তবে কি হতো একবার ভেবে দেখো !  

এই প্রকার বিভিন্ন সেবা আমরা প্রকৃতি থেকে পেয়ে থাকি। হয়তো বিনামূল্যে পাই বলেই গুরুত্ব আরোপে বিলম্ব হয়। পঁচিশ বৎসর পূর্বে রবার্ট কনস্টানজা (Robert Constanza) তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন যে বাস্তুতন্ত্র যে সকল সুবিধা মানুষকে প্রদান করে তার বাজারমূল্য বার্ষিক প্রায় ৩৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য (Constanza et al. 1997)এর মধ্যে খাদ্য উৎপাদনের জন্যে ক্রপল্যান্ড (Cropland) বাস্তুতন্ত্রটি যে সেবা প্রদান করে তার মূল্য পৃথিবীব্যাপী বার্ষিক ১২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য (Constanza et al. 1997)কাজেই সহজেই বোধগম্য হয় যে এই মূল্য যদি মানুষকে বাজারমূল্যের ন্যায় চোকাতে হতো তবে খাদ্যের দাম কিরূপ হতো !  

[পরবর্তী কোনো ব্লগে আমি বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করবো।]

অতএব প্রকৃতির কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। মনে রাখা দরকার এই সকল সেবা ব্যতীত শস্য উৎপাদন কিন্তু অসম্ভব আর প্রকৃতি এইসকল সুবিধা প্রদান করবে যতদিন মানুষ প্রকৃতিকে তার ধারণক্ষমতার (Sustainability) মধ্যে থাকতে দেবে। এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কিরূপে সম্ভব? আমাদের প্রকৃতির ধারণক্ষমতাকে বুঝতে হবে, সেই ধারণক্ষমতা বিঘ্নিত হয় এহেন কার্যের থেকে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন। 

প্রথমেই আমাদের মৃত্তিকার কথা মনে আসে কারন মাটিতেই আমাদের খাদ্যের সিংহ ভাগ উৎপন্ন হয়ে থাকে। মাটিতে যে জীব বৈচিত্র থাকে, ব্যাকটেরিয়া থেকে কেঁচো, এরা মাটিকে সতেজ এবং উর্বর রাখে। মৃত্তিকার প্রধান কয়েকটি উল্লেখ্য সেবা হলো, মাটি বিভিন্ন পুষ্টিউপাদান বিশেষত খনিজ ধারণ করে যা উদ্ভিদকে জীবনধারণ করতে সাহায্য করে, মাটি  জল পরিশ্রুত করে, বন্যা এবং খরা প্রতিরোধ করে, এমনকি কার্বণকে সঞ্চিত রেখে জলবায়ু পরিবর্তনকে রোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। মাটিতে উপস্থিত অণুজীব (Microbes) পচন (Decompose) তথা রিসাইকেল (Recycle) প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, এরা গুরুত্বপূর্ণ এন্টিবায়োটিকের উৎসও বটে।। দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বব্যাপী মাটির বা ভূমির অধঃপতিত (Degrade) হওয়ার হিসাব প্রায় ১ থেকে ৬ বিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে (Gibbs and Salmon, 2015; Global Land Outlook by United Nations 2017), বিভিন্ন কারণ যথা নগরায়ন, খনি, শক্তি উৎপাদন ইত্যাদির সাথে মূলত বর্তমান নিবিড় চাষ (Intensive agriculture) পদ্ধতি ভূমির অধঃপতনের জন্যে অনেকাংশে দায়ী। 

জলের সংকট বর্তমান সময়ের একটি চ্যালেঞ্জ। যত জল আমরা তুলে থাকি তার প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে। ফসলের মধ্যে ডাল জাতীয় শস্যের জন্য জল তুলনামূলক কম পরিমানে লাগে, তাও ১ কিলোগ্রাম মশুর ডাল উৎপাদনের জন্যে প্রায় ১২৫০ লিটার জল ব্যবহৃত হয়, আর ১ কিলোগ্রাম বিফের জন্যে লাগে প্রায় ১৩০০০ লিটার জল (FAO)। কাজেই ভেবে দেখা যায় কি পরিমান জল খাদ্য উৎপাদনের জন্যে লাগে ! আবার চাষের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিকের দ্বারা অনেক সময়েই এই জল দূষিত হয় এবং সম্পর্কিত অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রগুলিকেও প্রভাবিত করে থাকে। মনে রাখা দরকার বর্তমানে বিপুল জনসংখ্যা, প্রায় ২.২. বিলিয়ন মানুষ পরিশুদ্ধ পানীয় জলে থেকে বঞ্চিত।তাহলে বোঝা গেলো, এই জলের ব্যবহার এবং সংরক্ষণের বিষয়েও যত্নবান হতে হবে।

আবার বিভিন্ন গবেষণায় পরাগবহনকারী পতঙ্গদের, বিশেষত মৌমাছিদের, স্বাস্থ্য, সংখ্যা এবং বিস্তারের যে চিত্র উঠে আসছে তাও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রায় এক তৃতীয়াংশ খাদ্য উৎপাদন (প্রায় ৭০ টি ফসল/ শস্য) পরাগবহনকারী পতঙ্গদের উপর নির্ভরশীল, যদি এই উপকারী বন্ধু পতঙ্গগুলির সংখ্যা হ্রাস পায় তবে নিঃসন্দেহে তা ফলনের উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে এবং খাদ্য তথা পুষ্টি নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে (Eilers et al., 2011; Smith et al., 2015; Ghosh and Jung, 2018) এই হ্রাস পাওয়ার পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান, যথা, পরাগবাহক পতঙ্গদের বাসস্থান ধ্বংস, ল্যান্ডস্ক্যাপের (Landscape) পরিবর্তন, নিবিড় চাষের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি মনোক্রপিং (Mono-cropping), অতিরিক্ত পরিমান কীটনাশকের (Insecticides) ব্যবহার, উপযুক্ত পুষ্টির অভাব, বিভিন্ন পেস্ট (Pest) এবং প্যাথোজেনের (Pathogen) বৃদ্ধি, এবং অবশ্যই জলবায়ুর পরিবর্তন (Climate change) ইত্যাদি। ঠিক কতটা ক্ষতি হতে পারে তা নিরুপন করা সম্ভব, বিশ্বব্যাপী চিত্রের পাশাপাশি রাষ্ট্র বা অঞ্চল ভিত্তিক চিত্রও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ 

অতএব এই সকল অধঃপতন বা অবনমন (Degradation) প্রতিরোধ করা একান্ত প্রয়োজন, অন্যথা মানবসভ্যতা বিপর্যয়ের সামনে এসে পড়তে পারে। মানুষ বিষয়গুলি অনুধাবন করেছে এবং প্রতিটি বিষয়েই যত্নবান হয়েছে, তবে আরও অনেকটা এগোনো প্রয়োজন। 

তথ্যসূত্র (Reference):

Costanza, R.; d'Arge, R.; de Groot, R.; Farber, S.; Grasso, M.; Hannon, B.; Limburg, K.; Naeem, S.; O'Neill, R.V.; Paruelo, J.; Raskin, R.G.; Sutton, P.; van den Belt, M. 1997. The value of the world's ecosystem services and natural capital. Nature 387, 253–260. https://doi.org/10.1038/387253a0

FAO (Food and Agriculture Organization of the United Nations), Water scarcity- One of the greatest challenges of our time.  https://www.fao.org/fao-stories/article/en/c/1185405/ (accessed on 23rd March 2023)

Ghosh, S.; Jung, C. 2018. Contribution of insect pollination to nutritional security of minerals and vitamins in Korea. Journal of Asia-Pacific Entomology 21, 598-602. https://doi.org/10.1016/j.aspen.2018.03.014 

Eilers, E.J.; Kremen, C.; Smith Greenleaf, S.; Garber, A.K., Klein, A-M. 2011. Contribution of Pollinator-Mediated Crops to Nutrients in the Human Food Supply. PLoS ONE 6, e21363. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0021363

Gibbs, H.K.; Salmon, J.M. 2015. Mapping the world's degraded lands. Applied Geography 57, 12-21. https://doi.org/10.1016/j.apgeog.2014.11.024 

Global Land Outlook, First Edition, United Nations Convention to Combat Desertification, 2017. Bonn, Germany.

Smith, M.R.; Singh, G.M.; Mozaffarian, D.; Myers, S. 2015. Effects of decreases of animal pollinators on human nutrition and global health: a modeling analysis. Lancet 386: 1964-1972. https://dx.doi.org/10.1016/S0140-6736(15)61085-6 

ঊড়িষ্যার কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদ: আমার অভিজ্ঞতা (Some special food items in Orissa: My experience)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পড়াশুনা বা কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে থাকার সুযোগ আমার হয়েছে, সেই সুবাদে বিভিন্ন স্থানের খাদ্যবস্তুগুলির স্বাদ গ্রহণ আমি করেছি। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এমনকি কখনও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন রকমের খাদ্য গ্রহণের প্রচলন রয়েছে। এই ব্লগটিতে আমি আমার অভিজ্ঞতার ঊড়িষ্যার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থানীয় খাদ্যের কথা বলবো।

জীবনের কয়েক বৎসর আমি ঊড়িষ্যা রাজ্যে কাটিয়েছি, সে প্রায় বছর পনেরো-কুড়ি আগের কথা। অনেক মানুষ জগন্নাথদেব দর্শনের উদ্দেশ্যে পুরী বেড়াতে যান, তাঁরা নিশ্চয়ই ভগবানের মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেছেন। পুরী শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁতে উড়িষ্যার খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করেছেন। কলকাতা শহরে অনেক পাইস হোটেল রয়েছে যেখানে ওড়িয়া ঠাকুর রান্না করেন। রান্নার কাজে ওড়িয়া ঠাকুর বেশ দক্ষ, ক্যাটারিঙে বা হোটেলে রান্নার জন্যে তাঁদের চাহিদা বেশ। বাংলা সাহিত্যেও এর অনেক উল্লেখ রয়েছে। যাইহোক, আমি থাকতাম গঞ্জাম (Ganjam) জেলার ব্রহ্মপুর বা বেরহামপুর (Berhampur) শহরে, দক্ষিণ ঊড়িষ্যার একটি শহর। বিভিন্ন ধরণের আচার আর পাঁপড়ের জন্যে এ শহর প্রসিদ্ধ। তবে যতদিন সেই শহরে আমি থেকেছি, কোনোদিনই আমি তা কিনিনি। পরে যখন সেই শহরে কোনো কাজে গিয়েছি তখন তা কিনেছি, এবং সেগুলির স্বাদ গ্রহণ করে পরিচিত মহলে যথেষ্ট প্রসংশা করেছি। বেরহামপুর বসবাসের সময় অধিকাংশ দিনই প্রাতঃরাশ করা হতো না, ছুটির দিনে যেদিন তা সম্ভব হতো তা ছিল পাড়ার দোকানের শালপাতার ঠোঙ্গায় তিনটি ছোট আকারের আটার পুরি, আলুর তরকারী, আর এক হাতা উপ্মা। এর দাম ছিল পাঁচ টাকা। যদি কেউ উপ্মা না নিতেন তবে দোকানি তাঁকে পাঁচটি পুরি দিতেন। কখনও দোকানে বসে খেয়ে আসতাম আবার কখনও যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেখানে জেঠিমা যদি তাঁদের বাড়ির জন্যে আনতে দিতেন তবে আমিও আমার খাবার নিয়ে বাড়িতেই আসতাম। তবে দোকানে দাঁড়িয়ে খাওয়ার একটা সুবিধা ছিল, ক্রেতা চাইলে দোকানি আরও একবার তরকারী দিতেন। প্রাতঃরাশের অন্যান্য পদও ছিল যেমন ইডলি, বড়া ইত্যাদি। তবে স্থানীয় মানুষ অধিকাংশ সময়ে 'পাখালা' দিয়ে প্রাতঃরাশ সারেন। ঊড়িষ্যার প্রচন্ড গরমে এই 'পাখালা' খুবই কার্যকারী। পাখালা ছাড়া ওড়িশার খাবার অসম্পূর্ণ। আমাদের যেমন পান্তাভাত ঠিক তেমনই ওড়িশার মানুষের 'পাখালা ভাত'। যদিও আমি এই পদটি ওড়িশাতে কখনও খাইনি তবে আমার বন্ধুদের মুখে শুনেছি, আমাদের ভাড়া বাড়ির জেঠিমাদেরও খেতে দেখছি। পাখালা প্রধানত দুই রকমের হয়, ১. ভাতে জল এবং টক দই দিয়ে  সারারাত ধরে রাখা হয়, এতে খাবারটি ফার্মেন্ট (Ferment) হয়, একে বাসি পাখালা বা কখনও দই পাখালা বলা হয়; ২. অপরটি হলো সাজা পাখালা, এ ক্ষেত্রে ফার্মেন্ট করা হয় না, ভাতে টকদই আর জল যোগ করে পেঁয়াজ, লঙ্কা  এবং বড়ি সহযোগে খাওয়া হয়।

চা আমি সেই সময় বিশেষ খেতাম না, তবে বিকেলে একটি পাড়ার চায়ের দোকানে নিয়মিত বন্ধুদের সাথে যেতাম, অধিকাংশ দিনই আমি কিছু স্থানীয় বেকারির বিস্কুট কিনে খেতাম। সান্ধ্যকালীন খাবারের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল ব্রেড চপ, বাঁধাকপির কাটলেট, সিঙ্গাড়া ইত্যাদি। এখানে প্রতিটি পদের সাথে তরকারি পরিবেশন করা হয়। চপগুলি ভেঙে তরকারী দিয়ে মেখে খাওয়াটাই এখানে রীতি।

দুপুরে বেশিরভাগ দিন কলেজে থাকার কারণে দুপুরের খাবার প্রায় হতোই না বলা চলে, তবে বিকেলের দিকে বেশ খিদে পেতো, তখন বেশ ভারি কিছু খাবার খেতাম। পাড়ার মোড়ের কাছে একটি রেস্তোরাঁ ছিল, সেখানে সাত টাকায় একটি মশলা দোসা পাওয়া যেত সেই সময়ে, এটা বেশ উপাদেয় ছিল আমার কাছে। সেই দোকানটির সামনে দিয়ে বড়ো রাস্তাটি গিয়েছে, রাস্তার অপর পাড়ে একটি মিষ্টির দোকান ছিল সেখানে দশ টাকায় একটি বড়ো গ্লাস লস্যি পাওয়া যেত, দোকানি লস্যির উপরে নারিকেল কুড়োনো, কাজু-কিশমিশ-আলমন্ডের টুকরো ইত্যাদি দিতেন, এটা সুস্বাদু তো ছিলই এবং উদরপূর্তিও করতো। এখানে একটা কথা বলি, দোকানি লস্যির গ্লাসে শুকনো ফলের টুকরোর সাথে লাল রঙের চেরীও দিতেন, তখন যেটি চেরী বলে জানতাম তা বোধ করি করমচা-কে চিনির রস আর লাল রং সহযোগে প্রস্তুত করা এক ধরণের বস্তু। আমি প্রকৃত চেরী নামক ফল কখনও আমার দেশে দেখিনি (পাওয়া যায় নিশ্চয় তবে আমার চোখে তা পড়েনি), তা দেখছি বাইরের দেশে। চেরী ফল আর যা আমাদের দেশে চেরী বলে কেক, সন্দেশ বা লস্যিতে দেওয়া হয় তাদের মধ্যে কোনোরূপ সাদৃশ্য নেই, তা বলাই বাহুল্য। পানীয়র কথা যখন উঠলোই, একখানি ঘটনা উল্লেখ করি। 

একবার রেলগাড়িতে চলেছি বেরহামপুরে, রেলস্টেশনের নাম ব্রহ্মপুর। সকাল ৭ টা ২০ তে হাওড়া ছেড়ে সন্ধ্যে সাড়ে ৫ টা নাগাদ নামিয়ে দেবে গন্তব্যে। গরমকাল, তাপমাত্রা প্রায় ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আশেপাশে। রেলের কামড়া-র পাখাগুলো চললেও তা যে খুব যুৎসই হচ্ছে তা না, তারপরে এটি অনারক্ষিত কামড়া, কাজেই বেশ ভিড়। চিল্কা হ্রদটি ছাড়িয়ে একটু পরে ট্রেনটি পড়ল দাঁড়িয়ে, এ ঘটনা ভারতীয় রেলের জন্যে বিছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা যাত্রীরাও এটি অভ্যেস করে নিয়েছি। এমনকি  নিত্য যাত্রীরা তো জানেন ঠিক কোনখানে ট্রেনটি দাঁড়াবে বা ধীরে চলবে, সেই মতন তাঁরা নামার পরিকল্পনাও করে রাখেন।  যাইহোক, এই ঘটনাটি সেই বর্ণনা নয়। ট্রেন তো দাঁড়িয়ে পড়লো, ভুবনেশ্বরের পর ভিড়টা একটু পাতলা হয়েছে। একজন আদিবাসী বৃদ্ধা উঠে এলেন কামড়ায়, ঘোল বেচতে এসেছেন। গলা শুকিয়ে গেছিলো, এক গ্লাস ঘোল ৫ টাকায় বিক্রি করছিলেন। মাটির পাত্র করে এনেছেন, আর স্টিলের গ্লাসে দিচ্ছেন, খেয়ে সেটা ফেরত দিয়ে দিতে হবে। আমিও কিনলাম এক গ্লাস, গলায় ঢেলে প্রাণ ঠান্ডা হলো কিছুটা, আমি পয়সা দিয়ে দিলাম। বৃদ্ধা সেটি নিয়ে রেখে দিলেন, আবার আমার গ্লাসটায় ঘোল ঢেলে দিলেন কিন্তু আর পয়সা নিলেন না। আমার বুদ্ধি পরিণত হতে সময় লেগেছে, এটা আমি জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোকে দেখে বুঝতে পারি। আমি জোর করেও পয়সাটা দিতে পারতাম হয়তো, কিন্তু দু'বার বলার পরে সে যখন নিল না আমি রেখে দিলাম। এটাই ভারতবর্ষের আসল রূপ। এই রূপ আমি দেখেছি প্রতিনিয়ত, আজ অনেকটা দিন পেরিয়ে এসে পৃথিবীর অতি আধুনিক শহরের জীবনের মাঝেও তাই প্রায়ই মন চলে যায় দেশে, ফিরে পেতে চায় সেই মানুষগুলোকে, যাঁদের মানবিকতাই এই সভ্যতার ভিত্তি।

আবার অনেক দিন বিকেলে আমরা বন্ধুরা বেড়াতে বেরোতাম, কখনো পুরোনো আবার কখনো নতুন বাস স্ট্যান্ডে। সেই স্থান গুলিতে অনেক রেস্তোরাঁ ছিল, বেরহামপুর খুব যে খরচ বহুল স্থান ছিল তা একেবারেই নয়, তবে সেইটুকুও সর্বদা আমাদের সাধ্যের মধ্যে ছিল না। কাজেই রেস্তোরাঁতে প্রবেশের পূর্বেই আমরা খাবারের দাম জেনে নিতাম। পনেরো-কুড়ি টাকা প্রাতঃরাশ বা বিকেলের খাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বেশি বলেই আমরা সাধারণত গণ্য করতাম। ছুটির দিনে দুপুরে বা প্রত্যহ রাত্রির আহারের ক্ষেত্রে বারো থেকে পনেরো টাকা যথেষ্ট বলে আমরা হিসাব করতাম। প্রত্যহ রাত্রে আমরা বড়ো রাস্তার উপর একটি নির্দিষ্ট হোটেলে খেতে যেতাম, এটি 'ভাইনা'র দোকান বলেই আমাদের কাছে পরিচিত ছিল। ওড়িয়া ভাষায় বড়োভাই কে ভাইনা বলে হয়, দোকানি আমাদের বাবার বয়সী হলেও আমরা তাকে ভাইনা বলেই সম্বোধন করতাম। বারো টাকায় স্টিলের থালার উপর শালপাতায় পেট ভোরে ভাত, ডাল, কিছু একটা ভাজা (প্রধানত আলু), আর মাছের ঝোল পাওয়া যেত। ওখানে মাছের টুকরোকে ব্যাসনের প্রলেপ লাগিয়ে ভাজে যাতে মাছ ভেঙে না যায়। প্রায়ই ভাইনা ফ্রি তে মাংসের ঝোল, কখনও এক টুকরো মাংস দিয়ে যেতেন আমার বন্ধুদের, সেই সময় আমি কোনোপ্রকার মাংস খেতাম না।পনেরো টাকায় দুটি ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত পাওয়া যেত, কখনও কখনও আমি সেটি খেতাম। কুড়ি টাকায় পাওয়া যেত মাংস ভাত। তবে সকল দিন যে আমিষ পাওয়া যেত তা নয়, সপ্তাহের তিন চারদিন আমিষ পাওয়া গেলেও বাকিদিনগুলিতে নিরামিষ আহার পাওয়া যেত, দাম ছিল দশ টাকা। মাঝে মধ্যে আমি আর আমার এক বন্ধু তন্দুর রুটি, ডিমের ওমলেট আর পাহালের রসগোলা কিনে আনতাম রাত্রের খাওয়ার জন্যে। কয়েক বৎসর পূর্বে ঊড়িষ্যা আর বাংলার মধ্যে রসগোল্লার মধ্যে G.I. tag (Geographical Indications tag) নিয়ে একটি লড়াই চলেছিল। বাংলা বলল, ছানা, সুজি, আর চিনির রস উপকরণগুলির সাহায্যে ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে নবীন চন্দ্র দাস রসগোল্লা প্রথম প্রস্তুত করেন। অপরপক্ষে, ঊড়িষ্যা রসগোলার উৎপত্তি বলতে এগারোশো শতাব্দীর কথা উল্লেখ করল, পঞ্চদশ শতকের কবি বলরাম দাসের লেখায় রসগোলা-র উল্লেখ রয়েছে বলে জানালো। কথিত রয়েছে মন্দিরের পুরোহিত পাহাল গ্রামবাসীকে দুধ থেকে ছানা এবং তা দিয়ে রসগোলা সহ ভিন্নভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রস্তুত করা শেখান। আমি এই দুটি মিষ্টিই অনেকবার খেয়েছি, দুইটিই সুস্বাদু, স্বাদ স্বতন্ত্র এবং নামে একরকমের হলেও এদের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বিদ্যমান। দু'টি রাজ্যই সঠিকভাবে তাদের দু'টি মিষ্টির জন্যে G.I. tag পেয়েছে। বাংলার রসগোল্লা যেমন সাদা বর্ণের হয়, ঊড়িষ্যার রসগোলা হয় হালকা বাদামি বর্ণের। বাংলার রসগোল্লা স্পঞ্জি হয়, ঊড়িষ্যার রসগোলা হয় নরম, ভাঙলে আপনি নরম অংশটি দেখতে পারবেন এবং অনুভব করতে পারবেন, রসগোলাটি স্পঞ্জি নয়। স্বাদের দিক থেকেও পার্থক্য স্পষ্ট বোঝা যায়, বাংলার রসগোল্লা ঊড়িষ্যার রসগোলার থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক মিষ্টি হয়। যাঁরা ঊড়িষ্যায় বেড়াতে যাবেন তাঁরা পাহালের রসগোলা খেয়ে দেখলে সঠিকভাবে বুঝতে সমর্থ হবেন। তবে বাংলায় যেমন রসগোল্লা বাংলার খাদ্যের একটি অন্যতম প্রতীক বলে বিবেচিত হয়, ঊড়িষ্যায় কিন্তু রসগোলা সেরূপ নয় বরং ছানা পোড়া বা 'ছেনা পুড়ো' তুলনামূলক একটি অনেক প্রসিদ্ধ মিষ্টি। এর ইতিহাস কিন্তু অধিক প্রাচীন নয়, বিংশ শতাব্দীতে এটি আবিষ্কৃত হয়। ছানাকে, চিনি, দারুচিনি গুঁড়ো, সুজি সহযোগে শাল বা কলাপাতায় বেঁধে কয়লার উনুনে ৩ থেকে ৪ ঘন্টায় ছানা পোড়া প্রস্তুত হয়। আমি একাধিকবার পুরীতে বেড়াতে গিয়ে এর স্বাদ গ্রহণ করেছি তবে বেরহামপুরে তা কখনও খেয়েছি বলে মনে পরে না।     

বেরহামপুরের মানুষের মাতৃভাষা ওড়িয়া, তবে সেখানে অনেক তেলুগুভাষী মানুষও বাস করেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন সম্প্রদায়, ভাষার মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহজেই একে ওপরের বন্ধু পরিজন হয়ে ওঠেন আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সহপাঠীদের বাড়ির অনুষ্ঠানে, পাড়ার কোনো বাড়ির অনুষ্ঠানে তাঁরা আমাদের নিমন্ত্রণ করতেন। একাধিক অনুষ্ঠান বাড়িতে আমি গিয়েছি, বেশিরভাগই বিয়ে বাড়ি। এখানে বিয়ে বাঙালিদের মতন রাত্রে হয়না, দিনের বেলায় হয়, অনেকক্ষেত্রে আবার মন্দিরে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, বিয়েতে নিরামিষ আহার-ই হয়ে থাকে। আমি স্থানীয় বন্ধুদের থেকে শুনেছি বামুন ঠাকুর রাঁধেন অনুষ্ঠান বাড়িতে। এখানে দু'টি পদের কথা উল্লেখ করি, একটি হলো নবরত্ন কোর্মা, অপরটি 'দই- বাইগনা' (দই-বেগুন), এই দু'টি পদ-ই প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানের আহারে থাকে। নবরত্ন কোর্মা অত্যন্ত সুস্বাদু একটি পদ, আমি অনেক রেস্তোরাঁতে এই পদটি দেখেছি। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য পদের মধ্যে রয়েছে দই-ভেন্ডি (দই-ঢ্যাঁড়শ), 'খাজুরি-খাট্টা' (খেজুর, টম্যাটো দিয়ে একটি টক মিষ্টি পদ), 'আম্ব খাট্টা' (আমের টক) ইত্যাদি। এর পর আসি ওপর একটি পদের বিবরণে, এর নাম 'ডালমা'। ডাল, প্রধানত অড়হর বা তুরের ডালে বিভিন্ন প্রকার সব্জি যেমন কুমড়ো, কাঁচকলা, বেগুন, লাউ, পেঁপে ইত্যাদি ছোটছোট করে কেটে দিয়ে একসাথে রান্না করা হয়। এটি ডালমা নাম পরিচিত। এতে পাঁচ ফোড়ন ব্যবহার করা হয়। সরিষার ব্যবহার ঊড়িষ্যা রাজ্যে খুবই ব্যবহার হয়, এখানে আমি শুকনো সরিষা গুঁড়ো করে ব্যবহার করতে দেখেছি। আমি জীবনে প্রথমবার মাশরুম খেয়েছি বেরহামপুর শহরে। প্রথমদিকে আমি যে মেসটিতে থাকতাম, তার অদূরে একটি হোটেলে প্রথবার আমি এটি খেয়েছিলাম। ঊড়িষ্যায় মাশরুমকে ছাতু বলি, আমরা বাঙালিরা বলি ছাতা বা ব্যাঙের ছাতা। সরিষা দিয়ে রান্না করা মাশরুমের পদটির নাম 'ছাতু রাই'। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন শাক যেমন পালং, পুঁই, লাল, কলমি, সজনে, সরিষা, মেথি, মটর ইত্যাদি।

এবার আসি জগন্নাথ দেবের মহাপ্রসাদের বিষয়ে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে ভগবান বিষ্ণু রামেশ্বরমে স্নান সেরে, বদ্রীনাথে ধ্যান করে, দ্বারকায় বিশ্রাম নিয়ে পুরীতে আসেন আহার করতে। প্রত্যহ জগন্নাথদেবকে ৫৬ পদ দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন করতে দেওয়া হয়। আবার মকর সংক্রান্তিতে পিঠে পুলি সহযোগে এই ৫৬ পদ বেড়ে ৮৪টি পদ হয়। এই প্রসঙ্গে একটি গল্প বলি, ভারতবর্ষে চাষবাসের জন্যে বৃষ্টির উপর নির্ভরতা ছিল ভীষণ মাত্রায়, তখন সেচ ব্যবস্থার প্রচলন খুব বেশি ছিল না বা  এতো উন্নত হয়নি। মানুষ ইন্দ্রদেবকে বজ্রপাত, বৃষ্টি ইত্যাদির দেবতা মান্য করতেন। কোনো বৎসর যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হলে কৃষিকাজ ভালো হতো আবার বৃষ্টিপাত না হলে বা আশানুরূপ না হলে কৃষির ক্ষতি হতো এমনকি খরা পর্যন্ত হতো। সঠিক বৃষ্টিপাতের জন্যে যেমন মানুষ ইন্দ্রদেবকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে পূজা করতেন তেমনই আবার বৃষ্টিপাত না হলে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে দেবতার উদ্দেশ্যে আরাধনা করা হতো। তা এমনই এক বৎসর বৃন্দাবনে খুব ভালো বৃষ্টিপাত হলো, কৃষিকাজ বেশ হলো, ঘরে ঘরে ফসল উঠলো, সকল ব্রজবাসীর মুখে হাসি ফুটলো। সকলে ঠিক করলেন যে ইন্দ্রদেবকে ধন্যবাদ দেবেন, তাঁকে পুজো করবেন, শুরু হলো ঘরবাড়ি পরিস্কার, গ্রাম সাজানো, সুস্বাদু সব খাবার প্রস্তুত ইত্যাদি। গ্রামের ছোট বালক কৃষ্ণ এসকল প্রতক্ষ্য করে বললো, 'এ বৃষ্টির জন্যে তোমার কেন ইন্দ্র দেবতাকে পুজো করছ? আকাশের মেঘ তো গোবর্ধন পর্বতের ঢালে প্রতিহত হয়ে এই স্থানে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে। কাজেই গোবর্ধন পর্বতের পুজো করা উচিত'। সকলে কৃষ্ণের বিদগ্ধতা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, তবু যেন একটু ভীত হলেন, কিন্তু অবশেষে মেনে নিলেন। গোবর্ধন পর্বতের পুজো শুরু হলো। এদিকে এসকল দেখে ইন্দ্রদেব তো খুব ক্রুদ্ধ হলেন, বৃন্দাবনে ভয়ানক বৃষ্টিপাত শুরু হলো, ঘরবাড়ি ডুবে গেলো, চাষের জমি ডুবে গেলো। ভীত সন্ত্রস্ত ব্রজবাসী এবার কি করেন, তাঁরা কৃষ্ণের সমীপে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ বললো তাঁরা যখন গোবর্ধন পর্বতের পুজো করার কথা ভেবেছেন তিনিই তাঁদের রক্ষা করবেন। বালক কৃষ্ণ সকল ব্রজবাসীকে নিয়ে গোবর্ধন পর্বতের সামনে উপস্থিত হলো, পর্বতকে উঠিয়ে একটি মাত্র আঙুলের সাহায্যে  ধরে রাখলো, সকল ব্রজবাসী পর্বতের তলায় আশ্রয় নিলেন। কৃষ্ণ এক নাগাড়ে পর্বতকে তুলে রেখেছেন দেখে ব্রজবাসী তাঁকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করলেন, ভাবলেন কৃষ্ণের বিশ্রামের সময় নিজেরা সেই পর্বতকে অনেকগুলি লাঠির সাহায্যে তুলে রাখবেন। কৃষ্ণ তাঁর আঙ্গুল একটু সরাতেই সব লাঠি ভেঙে গেল, পর্বত ভূমিতে আবার বসে যেতে লাগলো। কৃষ্ণ স্বয়ং পুনরায় পর্বতকে ধারণ করলেন। এদিকে কিন্তু ইন্দ্রদেবের ক্রোধ কিছুতেই কমে না, ক্রোধ সর্বদা চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দেয়, এক্ষেত্রেও তাই হলো, তিনি বজ্রপাত করলেন, বৃষ্টির ধারা আরও বৃদ্ধি করলেন, সাতদিন নাগাড়ে চললো এই অবস্থা কিন্তু বুঝতে পারলেন না কোনো সাধারণ বালকের পক্ষে বিশালাকায় এই পর্বতের ভার বহন শুধুমাত্র অসম্ভব নয়, এ কার্য কল্পনারও অতীত। শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করে গেলেন সমগ্র ব্রজবাসীকে। পরিশেষে হার মানলেন ইন্দ্রদেব, বুঝতে পারলেন এই বালক এই বিশাল পর্বত একটি হাতে তুলে রেখেছেন, তিনি স্বয়ং বিষ্ণু, ভুল বুঝতে পেরে নিজের অন্যায় স্বীকার করলেন। এই সাতদিন স্বয়ং ভগবান কোনো খাদ্যগ্রহণ করেননি।  তাই প্রতিদিন তিন ঘন্টা অন্তর আটবার (৩ ঘন্টা  x ৮ বার (বা প্রহর) = ২৪ ঘন্টায় এক দিন), এবং সাতদিন প্রতিদিন আটবার করে মোট ৫৬ বার ভগবান বিষ্ণু যে খাদ্যগ্রহণ করেননি, সেই কারণে এই ৫৬ রকমের ভোগ প্রস্তুত করার প্রচলন হয়। 

ঊড়িষ্যা রাজ্যে অনেক মন্দির রয়েছে যেখানে ভগবানের উদ্দেশ্যে যে ভোগ অর্পণ করা হয় মানুষ তাকে মহাপ্রসাদ বলে গ্রহণ করেন। এই ভোগের অপূর্ব স্বাদ বর্ণনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু যে এই স্থানের তা নয়, যে কোনো স্থানের ভগবানের উদ্দেশ্যে অর্পিত ভোগের খিচুড়ির স্বাদ আমার কাছে বাড়িতে বা দোকানে প্রস্তুত খিচুড়ির থেকে অধিক সুস্বাদু লাগে, তবে এর বৈজ্ঞানিক কারণ নিরূপণে বা বিশ্লেষণে আমি কখনও উৎসাহিত হইনি। ঊড়িষ্যা রাজ্যের বেশ কয়েকটি মন্দিরে ভোগের ক্ষেত্রে দেখেছি সেখানে পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা, ইত্যাদি যে সকল সব্জি বিদেশ থেকে আগত সেগুলির ব্যবহার হয় না। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অনেক হিন্দু সনাতন ধর্মের মানুষ পেঁয়াজ, রসুন খান না। আসলে টম্যাটো, আলু, লঙ্কা সহ বর্তমানে যে সকল সব্জি আমরা ব্যবহার করি তার মধ্যে অনেকগুলিই কিন্তু পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে পশ্চিমী বিদেশী বণিকদের মাধ্যমে আমাদের দেশে পৌঁছয়। মন্দিরগুলিতে ভোগ নিবেদনের রীতি এই সকল শাকসব্জির ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব থেকেই প্রচলিত। ভারতীয় রান্নাতে তাদের ব্যবহার প্রায় অপিহার্য হয়ে উঠলেও অনেক মন্দিরে এ সকল উপকরণ আজও অব্যবহৃত (অনুগ্রহ করে পড়ুন ভারতীয় রান্নার একটি গল্প)। এই মন্দিরগুলির ভোগে ব্যবহৃত শাকসব্জি থেকে আমরা সহজেই আমাদের খাদ্যরীতির একটি ধারণা করতে পারি। 

একটি কথা পরিশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এখানে আমি ঊড়িষ্যা রাজ্যের আমার পরিচিত কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদের কথা বিবরণ করেছি। এছাড়াও অনেক পদ সেখানে অবশ্যই রয়েছে, অন্যান্য ভারতীয় পদগুলির পাশাপাশি মোগলাই, চাইনিজ, পশ্চিমী (পিজা-বার্গার ইত্যাদি) সকলই সহজেই পাওয়া যায়। তবে যতদূর মনে পরে, সেই সময়ে আমার কোনো পিজা বা বার্গারের দোকান স্মৃতিতে আসছে না।। যেহেতু সেই সময়ে আমি মাংস খেতাম না তাই সেই ধরণের কোনো খাবারের স্বাদ আমি পাইনি, তাই তার জন্যে উল্লেখ করিনি। বেরহামপুর তথা ঊড়িষ্যায় অনেক আদিবাসী মানুষ বসবাস করেন, দৈনিক বাজারে, রাস্তায় আমি তাঁদের দেখেছি, কথা বলেছি, একসাথে বাসে চড়ে যাতায়াত করেছি। তবে তাঁদের খাদ্যরীতির বিষয়ে আমার কোনো গবেষণার বা পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়নি, কোনো সুযোগ পেলে অবশ্যই আমি তা জানার চেষ্টা করবো। আশা করি, যাঁরা ওই রাজ্যে কর্মসূত্রে বা পর্যটনের উদ্দেশ্যে যাবেন তাঁরা নিশ্চয় ওই স্থানের খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ করবেন। 

প্রদত্ত চিত্রখানি আমাদের বাড়ির পান্তা ভাত, তবে আমরা খাওয়ার পূর্বে পান্তার সাথে ডাল মেখেছিলাম আর টক দই ব্যবহার করিনি। পাখালা ভাতের সাথে এর সাদৃশ্য থাকলেও এটি প্রকৃত পাখালা নয়। 

বালাঘাটের অদূরে ঐতিহাসিক স্থান লাঞ্জি (Lanji: A historical place near Balaghat)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের মৃত্তিকার প্রতিটি কণায় কান পাতলে শোনা যায় তার ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, আর দর্শন। এই বৈচিত্র্যময়তার সাথে একাত্মতা অনুভব করেই আমরা সেইস্থানের মাহাত্ম্য অনুধাবন করি।

অধ্যাপনার কাজে মধ্যপ্রদেশে কিছুকাল থাকার সুবাদে সেই স্থানের বেশ কয়েক জনজাতির মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। এদের মধ্যে ছিলেন বাইগা (Baiga), মাড়িয়া (Madia), করকু (Korku)গোন্ড (Gond) ইত্যাদি। বালাঘাট জেলার বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলি আমি ঘুরেছি, মানুষের সাথে মিশেছি, আমার আগ্রহ ছিল আদিবাসী মানুষদের খাদ্য, পুষ্টি, এবং এই সম্পর্কিত জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অবহিত হওয়া। যে কোনো জনজাতির দিকে লক্ষ্য করলে একটা সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থান পরিলক্ষিত হয় যা সাধারণভাবে কম-বেশি সেই জনজাতির সকল মানুষের জন্যে অনেকটা এক রকম। তবে গোন্ড জনজাতির মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু অন্য রকম। তাঁদের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বৈচিত্র্য (variation) দৃষ্টিগোচর হয়। অন্যান্য আদিবাসী মানুষের মতন একটা বড় অংশের গোন্ড মানুষ প্রকৃতির সাহচর্যে বাস করেন, জীবনধারণের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলি প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করেন, আবার আর একটি অংশের মানুষ চাষবাস এবং পশুপালন করেন, আবার কেউ ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি করে থাকেন। এই বৈচিত্র্যের কারণ অনুসন্ধানের জন্যে মধ্য ভারতের ইতিহাসের দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন, তবে সে ইতিহাসের বিস্তারিত উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। এই ব্লগে আমি একটি ছোট্ট শহর লাঞ্জি বেড়ানোর কথা বলবো, আর এখানেই বারবার ফিরে ফিরে আসবে গোন্ড রাজত্বের কথা। আজকের লাঞ্জি, অতীতে কালাচুরি বংশের রাজত্বকালে পরিচিত ছিল লাঞ্জিকা নামে। ইতিহাস তিনটি কালচুরি রাজবংশের উল্লেখ পাওয়া যায়, যথা (১) সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতকের ত্রিপুরীর কালাচুরি রাজবংশ যারা চেদি অঞ্চল তথা বর্তমানের বুন্দেলখন্ড থেকে দক্ষিণে যমুনা নদী আর কেন নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল শাসন করতেন, (২) একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের রত্নপুরার কালাচুরি রাজবংশ যারা রত্নপুরা (বর্তমানের বিলাসপুর) থেকে ছত্তিশগড় অঞ্চল শাসন করতেন আর (৩) দ্বাদশ শতকের কল্যাণীর কালাচুরি রাজবংশ যারা উত্তর কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্র অঞ্চল শাসন করতেন। লাঞ্জি ছিল এই রত্নপুরার কালাচুরি রাজবংশের অধীনস্থ। এর পর কালাচুরি রাজবংশকে পরাজিত করে রাজা যদুরাই প্রতিষ্ঠা করেন গোন্ড রাজবংশ। সম্রাট আকবরের সময়ের আইন-ই-আকবরীতেও লাঞ্জির উল্লেখ রয়েছে, তখন এটি ছিল একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র বা মহাল। 

দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে বালাঘাট থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ছোট্ট এই শহর লাঞ্জিতে প্রবেশ করে প্রথমেই দর্শন করলাম লাঞ্জকাই মাতার মন্দির এরপর এ স্থানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ লাঞ্জি দুর্গে যখন এসে পৌঁছলাম তখন বেলা দু'টো। আমার অনেক বিদেশী বন্ধুরা অনেক সময় আমায় জিজ্ঞেস করেছেন যে আমার দেশে নাকি রাস্তায় মানুষ আর গরু একত্রে যাতায়াত করে। বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁরা এরূপ চিত্র দেখেছেন। তাঁরা বেশ উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করেন এতে অসুবিধা হয় না ! আমি হাসি, কথা সত্য, গ্রাম ভারতে এ চিত্র কষ্টকল্পনা নয়। ভারতের মনন, এর দার্শনিক গভীরতা উপলব্ধির, তা যে সংক্ষেপে বর্ণনা করা যায় না। গরু বা মহিষের পালের সাথে সাথে পথ চলা, হর্ন দিয়ে তাদের সরিয়ে গাড়ির যাত্রাপথটুকু বের করে নেওয়া, কখনও গাড়ি থেকে নেমে 'হুস-হুস' করে রাস্তার উপরে বিশ্রামরত গরু বাছুর সরানো, দেরী হওয়ার কারণে বিরক্ত হওয়া আবার গরু বা মহিষের কান্ড দেখে হেসে ফেলা, এসবই আমাদের যাত্রাপথের উপাদান, এ অভিজ্ঞতা দৈনন্দিনের। এভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা। 

পৌঁছলাম প্রাচীন দুর্গে। 

কে এই দুর্গটি স্থাপন করেছিলেন এবং কোন সময়ে সেই সংক্রান্ত নির্ভর করার মতন কোনো ঐতিহাসিক তথ্য আমি খুঁজে পাইনি (যা পেয়েছি সেই সকল তথ্যের কোনো রেফারেন্স আমি পাইনি) কাজেই তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি। ভবিষ্যতে যদি কোনো ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারি তবে তা নিশ্চয়ই উল্লেখ করবো।

প্রবেশের মূল ফটকের মধ্যে দিয়ে প্রাঙ্গনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়লো এক বিরাট গাছ আর তাতে প্রায় গোটা ত্রিশ মৌমাছির চাক। এগুলি Apis dorsata প্রজাতির মৌমাছির চাক। এ অঞ্চলে গাছে অনেক মৌচাক লক্ষ্য করা যায় রাস্তায় সদ্য চাক ভাঙা মধু বিক্রী হতে আমি অনেক বার দেখেছি।

প্রায় সাড়ে সাত একর জায়গার উপর গোন্ড রাজত্বের সময়কালের এই দুর্গ আজও তৎকালীন ইতিহাস, স্থাপত্য, এবং ভাস্কর্যের সাক্ষী বহন করে চলেছে। বর্তমানে দুর্গটির নানান অংশ ভগ্নপ্রাপ্ত এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এটিকে রক্ষণাবেক্ষন করছে। দুর্গের প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় 20 ফুট এবং চার কোণে ইট নির্মিত চারটি বুরুজ ছিল, যদিও বর্তমানে মাত্র দুটি দেখা যায়। 

দুর্গের প্রাচীর গাত্রে খোদিত ভাস্কর্য, মূর্তিগুলি সেই সময়ের উন্নত শিল্পকলার নিদর্শন। তবে এগুলির বিশেষ সংরক্ষণ প্রয়োজন।

দুর্গের চারপাশে একটি গভীর পরিখার অবশিষ্টাংশ এখনও দেখা যায়। দুর্গটিকে রক্ষা করার জন্যে পরিখায় কুমির রাখা হতো বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন। 

প্রাঙ্গনে রয়েছে বেলেপাথর নির্মিত পূর্বমুখী একটি  মন্দির। মন্দিরটিতে রয়েছে তিনটি প্রকোষ্ঠ। গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারটি অলংকৃত এবং সুন্দর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত। মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রস্তর নির্মিত মূর্তিগুলি উন্নত ভাস্কর্যের পরিচায়ক। আজ দীপাবলি, তাই মন্দির প্রাঙ্গনে এক মহিলা এবং একটি মেয়ে রঙ্গোলি বানাচ্ছেন।

আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য কোটেশ্বর মহাদেব ধাম। শ্রী দাদা কোটেশ্বর দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে এগিয়ে যেতে হবে কোটেশ্বর মহাদেব ধামের উদ্দেশ্যে। প্রতি বৎসর শ্রাবণ মাসে এখানে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। মন্দির চত্বরে, আশেপাশের গাছে রয়েছে অনেক মৌচাক। মন্দির ভবনে প্রবেশ করে সামনের দিকে একটু এগোলেই দেখে যাবে কুন্ড যেখানে শিবলিঙ্গ অবস্থান করছেন। এটি ভূমির থেকে কিছুটা নিচে অবস্থিত হাওয়ায় ভগবান দর্শন এবং পূজাপাঠের জন্য সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। মূল মন্দিরটি মূলত প্রস্তর নির্মিত, মন্দিরটি প্রদক্ষিণের সময় এটি স্পষ্ট হয়। মন্দিরগাত্রের উন্নত শিল্পকলার পরিচায়ক প্রস্তর ভাস্কর্যগুলি সহজেই আকর্ষণ করে। 

ফেরার পথে দেখে নিতে পারেন হাট্টা কি বাওলি। তবে আমাদের ফিরতে দেরি হওয়ার কারণে এটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এই বাওলিটিও স্থাপিত হয় সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়কালের মধ্যে। গোন্ড রাজা হাটটে সিং ভালকে বাওলিটি খনন করান। পানীয় জল, স্নান এবং ব্যবহারের জল, সৈন্যদের অবস্থান- এই সকল কাজের জন্যে দ্বিতলীয় প্রস্তর নির্মিত বাওলিটি এর স্থাপত্যের কারণে একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য। আশা করি সময় পেলে আমি পুনরায় সেই স্থানে বেড়াতে যাবো। জনশ্রুতি বাওলিটি থেকে লাঞ্জি দুর্গ পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গপথ রয়েছে। বর্তমানে এটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র তত্ত্বাবধানে রয়েছে। 

এবার ঘরে ফেরা। দীপাবলির প্রদীপ জ্বালানো, রঙ্গোলি বানানো ইত্যাদি নানান কাজের মধ্যে দিয়ে বেশ কাটলো দিনটা।

পরিশেষে বলি, বালাঘাট এবং তৎসংলগ্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলি অন্য রাজ্যের পর্যটকদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। কাজেই এগুলি পরিদর্শন করা হয়ে ওঠে না। অনেকেই কান্হা ন্যাশনাল পার্কে (Kanha National Park) বেড়াতে যান। কলকাতা থেকে ট্রেনে কান্হা ন্যাশনাল পার্ক যাওয়ার অন্যতম সহজ উপায় গোন্ডিয়া জানক্শনে (Gondia Junction railway station) নেমে ৪৫ কিলোমিটার দূরে বালাঘাট (Balaghat) পৌঁছনো। বালাঘাট শহর থেকে কান্হা টাইগার রিসার্ভের দূরত্ব মাত্র ৮০-৮৫ কিলোমিটার, সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন ফরেস্টের প্রবেশদ্বারে। বালাঘাট শহরে রয়েছে একাধিক হোটেল, রেস্তোরাঁ। যাতায়াতের পথে এক বা দুই দিন এই শহরটিতে কাটিয়ে সহজেই দেখে নিতে পারেন কাছেপিঠের দর্শনীয়স্থানগুলি। 

নভেম্বর, ২০১৮

কাঁকড়া: একটি উপাদেয় খাদ্য (Crab: A delicacy)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

কাঁকড়া বাঙালির কাছে বরাবরই উপাদেয় খাদ্যবস্তু হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। সমকালীন সাহিত্যেও উঠে এসেছে কাঁকড়ার কথা। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অনতিকালের মধ্যে আসে ভয়াবহ বন্যা। বাংলার মানুষ, বিশেষত নিম্নবিত্ত মানুষ, আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পরে। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলশ্রুতিতে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, যা তেতাল্লিশের (১৯৪৩) বাংলার মন্বন্তর নামে পরিচিত। জগডুমুর সেদ্ধ, কচুর লতির ঝোলের মাধ্যমে ক্ষুধা নিবৃত্তি, বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটকের চরিত্র মাখন যখন এই সকল খাদ্যের বিরূদ্ধে তীব্র অনীহা প্রকাশ করে, বিনোদিনী ঝাঁজিয়ে উঠেন মাখনের উদ্দেশ্যে, বলেন সে ভালো মন্দ কিছু খুঁজে আনলেই পারে, ঠিক তখন প্রধান সমাদ্দার কিছু কাঁকড়া সংগ্রহ করে নিয়ে প্রবেশ করেন। কাঁকড়া বেশ ভালো অর্থাৎ উপাদেয় বলেই গণ্য হয়েছিল চরিত্রগুলির কাছে। তবে কোনো যাত্রার প্রাক্কালে কাঁকড়া দর্শন কিন্তু আবার অলুক্ষণে চিহ্ন বলে বিবেচনা করা হয়। সমরেশ বসুর উপন্যাস 'গঙ্গা'-তে দেখি নিবারণ আর পাঁচু মাছ ধরতে যাওয়ার পূর্বে কচ্ছপ দেখে বেশ সন্দিহান হয়ে পড়েছিল; কচ্ছপ, কাঁকড়া আর কলা, এই তিন বস্তু অলুক্ষণে চিহ্ন বলেই মনে করা হয়। কেন তা আমার অজানা।

কাঁকড়া (Crab) অনেকের পছন্দ হলেও ছাড়ানো বেশ কঠিন বলে খাওয়া হয়ে ওঠে না। বেশ কয়েক বৎসর পূর্বে তাজপুর সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে কাঁকড়া খেয়েছিলাম, তবে তা খুব সুস্বাদু ছিল এমনটা বলা যায়না। আবার ইয়ংদক ক্র্যাব ভিলেজের (Yeongdeok crab village) বাজারে অনেক প্রকার কাঁকড়া দেখে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করলেও রেস্তোরাঁতে এক একটি কাঁকড়ার দাম ছিল প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার, কাজেই তা দিয়ে রসনা তৃপ্ত করা আমার সাধ্যের অতীত ছিল। কাজেই বাজার থেকে কিনে বাড়িতে এনে রান্না করে কাঁকড়া খাওয়া, এটিই হলো সহজ পথ। আমাদের দেশে নানান প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২০টি প্রজাতির কাঁকড়া খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।এদের মধ্যে রয়েছে  Scylla serrata, S. tranquebarica (এদের মূলত ম্যানগ্রোভ, খাড়ি বা নোনাজলের ভেড়িতে পাওয়া যায় বা চাষ করা হয়), Protonus pelagicus, P. sanguinolentus, P. argentatus, P. latipesCharybdis feriata, C. helleri, C. affinis, C. lucifera, C. quadrimaculata, C. acutifrons (এদের সাধারণত কর্দমাক্ত অঞ্চলে কাদার নিচে পাওয়া যায়), Varuna litterata (মিঠা জলের পুকুর, নোনা জলাশয়, খাড়ি সকল স্থানেই এরা বাস করে), Episesarma mederi, Muradium tetragonum (কাদা অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়), Sartoriana spinigera, Spiralothelphusa hydroma (বিল, বাওর, মিঠা জলের পুকুর ইত্যাদিতে পাওয়া যায়), Diogenes milesMatuta planipes, M. lunaris (সমুদ্র উপকূলে বেলে অঞ্চলে পাওয়া যায়)। আবার বেশ কয়েক প্রজাতির কাঁকড়া, যেমন Charybdis rostrata, C. orientalis, C. helleri ইত্যাদি মাছের খাদ্য (Fishmeal) প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

প্রতিটি প্রজাতির কাঁকড়া দেখতে একটু আলাদা হলেও তাদের মূল গঠন একই রকমের। দক্ষিণ কোরিয়াতেও ভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের কাঁকড়ার মধ্যে কিং ক্র্যাব (King crab), স্নো ক্র্যাব (Snow crab), নীল কাঁকড়া (Blue crab), লাল কাঁকড়া (Red crab) উল্লেখযোগ্য। 

আমি বাজার থেকে নীল কাঁকড়া কিনে এনেছিলাম, এটি হিমায়িত (Frozen) অবস্থায় ছিল। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাজারে টাটকা কাঁকড়া পাওয়া যায়। সেটি কিনে এনে ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে (গায়ে শ্যাওলা থাকলে তা ঘষে তুলে দিতে হবে) নিতে হবে। এবার কাঁকড়াগুলিকে ঘন্টা খানেক রেফ্রিজারেটরের শূণ্য (০) ডিগ্রী তাপমাত্রায় রেখে দিলেই এরা নিস্তেজ হয়ে মরে যাবে, অন্যথায় গরমজলে একটু ফুটিয়ে নিলেও হবে। এবার কাটাকাটি করতে সুবিধা হবে। অন্যথায় জীবন্ত অবস্থায় কাটতে গেলে কাঁকড়াটিও যন্ত্রণাভোগ করবে আবার যিনি কাটবেন তিনিও আহত হতে পারেন। 

কাঁকড়া একটি খোলার (Exoskeleton) আবরণে থাকে, এই খোলাটি ছাড়িয়ে তবে তা রেঁধে খাওয়ার উপযোগী হয়। এই খোলাটি কাইটিনের (Chitin) সাথে বেশ কিছু খনিজ পদার্থ মিলিত (Mineralized) হয়ে সৃষ্টি হয়। তবে যতটা শক্ত বলে মনে হয় সেটা ততটা শক্ত নয়। জীবজগতে কাঁকড়ার স্থান লক্ষ্য করলে দেখা যায় এটি আর্থ্রোপোড (Arthropod/সন্ধিপদ) পর্বের ক্রাস্টেশিয়া (Crustacea) উপ-পর্বের (Subphylum) অন্তর্গত ম্যালাকোস্ট্রাকা (Class- Malacostraca) শ্রেণীভুক্ত প্রাণী। এই ম্যালাকোস্ট্রাকা শব্দটিকে একটি ভাঙলে দাঁড়ায় গ্রীক শব্দ 'ম্যালাকস' (Malakos) অর্থাৎ নরম (Soft) এবং 'অস্ট্রাকন' (Ostracon)-র অর্থ খোলা (Shell), কাজেই ম্যালাকোস্ট্রাকা-র মানে হলো নরম খোলা আবৃত প্রাণী। প্রন (Prawn), শ্রিম্প (Shrimp), লবস্টার (Lobster), কাঁকড়া (Crab) সকলেই এই শ্রেণীভুক্ত। কাঁকড়ার পৃষ্ঠীয় দেশের (Dorsal) খোলাটিকে ক্যারাপেস (Carapace) বলা হয়। পৃষ্ঠীয় (Dorsal) এবং অঙ্কীয় (Ventral) দেশের সন্ধিস্থলে ছুরি একটু ঢুকিয়ে উপরের দিকে চাপ দিতেই ক্যারাপেসটি উঠে আসবে। এই কাজটিকেই মনে হয় সবথেকে কঠিন, আসলে কিন্তু তা নয়।  এমনকি চাপ একটু বেশি লাগলে ক্যারাপেসটি ভেঙে যায়, তখন সহজেই বোঝা যায় এটি বাস্তবে খোলাটি অতটা শক্ত নয়। 

এই ম্যালাকোস্ট্রাকা শ্রেণীর মধ্যে আবার কাঁকড়া ডেকাপোডা অর্ডারের (Order- Decapoda) অন্তর্গত। শব্দটি থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, ডেকা (Deca) অর্থাৎ দশ আর পোডা (Poda) শব্দটির অর্থ পদ বা পা। মানে কাঁকড়ার পায়ের সংখ্যা পাঁচ জোড়া বা দশটি। সাধারণত বেশির ভাগ কাঁকড়ার ক্ষেত্রে, এই পাঁচ জোড়া পায়ের মধ্যে প্রথম জোড়া পা বেশ বড় আকারের এবং বাকি চার জোড়া পা তুলনামূলকভাবে ছোট হয়। প্রতিটি পা কাঁকড়ার দেহ থেকে আলাদা করা প্রয়োজন। পা গুলি যে স্থানে শরীরের সাথে সংযুক্ত সেই স্থানে একটু ঘোরাতেই এগুলি সহজেই আলাদা হয়ে যায়। বড় আকারের পা দুটি ছাড়া বাকিগুলি ফেলে দেওয়াই বাঞ্চনীয়, তবে ইচ্ছে হলে এগুলো ব্যবহারও করতে পারেন। বড় আকারের পা দুটির খোলা একটু ভেঙে নিতে হবে যাতে রান্নার সময় ভিতরের মাংস সহজে সিদ্ধ হতে পারে এবং রান্নার মশলার উপকরণগুলি পৌঁছতে পারে।

এইবার ক্যারাপেস উঠিয়ে নেওয়ার পর যা চোখে পড়বে তা হলো গিল (Gills), জলচর কাঁকড়ার দেহে গিলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ডান ও বাম গিলের সংযোগস্থলে রয়েছে হৃৎপিণ্ড (Heart)। গিলের নিচে থেকে অন্যান্য অন্তরযন্ত্ৰীয় অঙ্গগুলি, যেমন পাচক গ্রন্থিসমূহ (Digestive glands), ডিম্বাশয় (Ovary, স্ত্রী কাঁকড়ার ক্ষেত্রে), ম্যান্ডিবুলার পেশী (Mandibular muscle) ইত্যাদি থাকে। তবে এগুলি আলাদা করে চিহ্নিতকরণের প্রয়োজন নেই কারণ আমরা এখানে খাদ্য হিসেবে বর্ণনা করছি। এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য, সেটা হলো কিভাবে স্ত্রী এবং পুরুষ কাঁকড়া চিহ্নিত করা যায়। কাঁকড়ার অঙ্কীয়দেশের নিচের দিকে অ্যাবডোমেন (Abdomen) অংশটি (প্লেটটি এপ্রোন (Apron) বলেও পরিচিত) লক্ষ্য করতে হয়, যদি এটি ত্রিভুজের ন্যায় এবং আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট বা সরু হয় তবে কাঁকড়াটি পুরুষ কাঁকড়া, আর যদি এবডোমেনটি আকারে বৃহৎ হয় তবে সেটি স্ত্রী কাঁকড়া হয়ে থাকে। যাই হোক, এইবার কাঁকড়ার দেহের আকার অনুযায়ী একে দু'টি বা চারটি টুকরো করে নিতে হবে।  ব্যাস, কাঁকড়া কাটার কাজ শেষ।

এবার টুকরো গুলোকে ভোজ্য তেলে ভেজে নিয়ে রান্না করতে হবে। বিভিন্ন অঞ্চলে রান্নার পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন ধরণের। কোনো অঞ্চলে আদা-পেঁয়াজ-রসুন-লঙ্কা বাটা দিয়ে, ধনে-জিরের গুঁড়ো সহযোগে কাঁকড়াকে কষিয়ে রান্না করা হয়। আবার কারোর কাছে নারিকেলের দুধ দিয়ে কাঁকড়া রান্না উপাদেয়। কেউ কাঁকড়ার পদে আলু ব্যবহার পছন্দ করেন আবার কেউ করেন না, কাজেই এটি ইচ্ছে অনুসারে।

এবার উপভোগ করুন সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাদ্যবস্তুটিকে।

পরিশেষে একটি কথা উল্লেখ্য। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব কিন্তু কাঁকড়ার উপর পড়ছে। বসবাসের উপযোগী পরিবেশ যেমন, জলের pH, লবণাক্ততা (Salinity), তাপমাত্রা ইত্যাদির পরিবর্তন কাঁকড়ার জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অণুজীবের (Microbes pathogens- Virus, Bacteria, Fungus) প্রভাব বাড়তে পারে, এর ফলে কাঁকড়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। আর পরিবেশগত দূষণ তো আছেই, যার মাধ্যমে বিষাক্ত যৌগ দূষণ বাড়াতে এবং কাঁকড়ার বাসস্থান ও শরীরকে দূষিত করতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে খাদ্যতালিকা থেকে শুধুমাত্র একটি পুষ্টিকর খাদ্য হারিয়ে যাবে তা নয়, যে সকল মানুষ কাঁকড়া ধরা এবং চাষের মাধ্যমে জীবনযাপন করেন তাঁদের জন্যেও প্রতিকূল অবস্থা তৈরী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই এই বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...