পৃষ্ঠাসমূহ

ভারতের সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষা উন্নত করতে ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের ভূমিকা (Role of traditional foods in improving India's healthy food and nutrition security)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী ব্লগটিতে আমি সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যগত জ্ঞান কেন আবশ্যিক সেই বিষয়ে আলোচনা করেছি। সেখানে প্রধানত আমি কারণগুলিকে উল্লেখ করেছি, তবে বিশদে উদাহরণ সহযোগে সেগুলি বর্ণনার অবকাশ এখনও রয়েছে, সে বিষয়ে আমি পরে অবশ্যই লিখবো। বর্তমান ব্লগটিতে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কি কি উপায়ে সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষায় এই ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করবো। 

ভারত বর্তমানে পুষ্টিগত সমস্যা যেমন অপুষ্টি (Undernutrition) এবং স্থূলতার (Obesity) মতো দ্বৈত সমস্যার (Double burden) মুখোমুখি হচ্ছে। খাদ্য আসলে পুষ্টি উপাদানগুলির (Nutrients) উৎস।  প্রয়োজনের থেকে কম খাদ্য গ্রহণ করলে তার ফলে পুষ্টির ঘাটতি (Deficiency of nutrient) হয় এবং বিভিন্ন পুষ্টিউপাদানের ঘাটতি জনিত রোগ বৃদ্ধি পায়। যেমন ধরো, লোহার অভাবে এনিমিয়া, বা ভিটামিন ডি (Vitamin D), ভিটামিন বি-১২ (Vitamin B12), ভিটামিন এ (Vitamin A), ফোলিক অ্যাসিড (Folic acid) ইত্যাদির অভাব, এগুলো কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যমান। আবার অন্য দিকে প্রয়োজনাধিক খাদ্য গ্রহণ (মূলত অধিক ফ্যাট এবং শর্করা জাতীয়) এবং সেডেন্টারি জীবনযাপনের (Sedentary Lifestyle) জন্যে স্থূলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন, হার্টের রোগ বাড়ছে ইত্যাদি। কাজেই খাদ্য এবং পুষ্টির মাত্রা সঠিক থাকা প্রয়োজন, হ্রাস পাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া দুটোই কিন্তু সমস্যা। মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কাজেই খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে - এই যে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করা- এটা হলো খাদ্য সুরক্ষা (Food Security); সঠিক পরিমাণে তা গ্রহণ, কেবলমাত্র পেট ভরানো নয় বরং খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে পুষ্টি উপাদানগুলির প্রয়োজনীয় মাত্রা শরীরে সুনিশ্চিত করা - এটা হলো খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষা (Food and Nutrition Security)। এখন আবার আর একটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো এই খাদ্য উৎপাদন এবং ব্যবহারের পদ্ধতি এমন হওয়া দরকার যেন তা পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করে, অর্থাৎ খাদ্য পুষ্টি এবং পরিবেশের সুরক্ষা। এই তিনটি সুরক্ষাই, অর্থাৎ সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষা (Sustainable Food and Nutrition Security), নিশ্চিত করা অপরিহার্য।  

সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি (Traditional foods) গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি পুষ্টিগুণে ভরপুর (Rich in nutrients), সংস্কৃতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ (Culturally important) এবং পরিবেশগতভাবে টেকসই (Environmentally sustainable)। ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শস্য, ডাল, শাক-সবজি এবং দুগ্ধজাত পণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে (অনুগ্রহ করে পড়ুন আমাদের খাদ্যের পশ্চিমায়ন, এ ছাড়াও একাধিক কারণ রয়েছে, পরবর্তীতে কখনও সেই বিষয়ে আলোচনা করবো) ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলির ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে, আর এরফলে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স হারিয়ে ফেলছি। যেমন  মিলেট - এর পুষ্টিগুণ যেমন উন্নত তেমন পরিবেশ সহায়কও বটে, কাজেই মিলেটের ব্যবহার সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে (অনুগ্রহ করে পড়ুন পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট)। ভারতবর্ষ মিলেট ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা আশাপ্রদ। যে সকল ঐতিহ্যবাহী খাদ্যগুলি আদিবাসী সম্প্রদায় ব্যবহার করেন, সেগুলির উৎপাদন পদ্ধতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায় তাদের উৎপাদন টেকসই পদ্ধতিতে হয়, প্রচলিত পদ্ধতিতে এগুলির অন্তর্ভুক্তিকরণ পরিবেশের স্থায়িত্বকে বৃদ্ধি করবে। অনেক সময় দেখা যায়, বেশ কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ (প্রাণীজ, উদ্ভিজ্জ বা ছত্রাক) তাঁরা পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে ব্যবহার করেন। এখানে গুরুত্ব প্রদান করা উচিত কারণ পূর্বে তাদের সংগ্রহ পদ্ধতিগুলি নিয়ন্ত্রিত থাকলেও, বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে (বাস্তুতন্ত্রের পরিধি হ্রাস পাওয়া, চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন ইত্যাদি) তা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে পারে। যেমন খাদ্যোপযোগী বন, জলাভূমি বা জলাশয়গুলো থেকে বিভিন্ন উদ্ভিদ, ছত্রাক, শামুক-ঝিনুক বা বিভন্ন কীট সংগ্রহ। এই সকল সম্পদগুলিকে যদি  চাষের মাধ্যমে উৎপাদন করা যায়, তবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হতে পারে যা পুষ্টি প্রদানের পাশাপাশি পরিবেশকেও সুরক্ষা প্রদান করে। শুধু তাই নয়, এটি জীবনযাত্রার অন্যতম পথও হতে পারে। 

এস্থানে কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের এবং তাদের পুষ্টিগুণ সম্বন্ধে উল্লেখ করলে বিষয়টি আর একটু সরল হবে। 

বাজরা - ডাইয়েটারি ফাইবার, প্রোটিন, লৌহ, ভিটামিন বি সমৃদ্ধ, গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। 

রাগী - ডাইয়েটারি ফাইবার, ক্যালশিয়াম, লৌহ, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। 

বাঁশের আগা -  ডাইয়েটারি ফাইবার, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ফাইটোস্টেরল সমৃদ্ধ। 

ছুরপি (চমরিগাইয়ের দুধ থেকে প্রস্তুত) - প্রোটিন, ক্যালশিয়াম সমৃদ্ধ প্রোবায়োটিক।   

গুন্দ্রুক (ফার্মেন্টেড শাক ) - ডাইয়েটারি ফাইবার, লৌহ, ল্যাক্টিক অ্যাসিড ব্যাক্টেরিয়া সমৃদ্ধ।  

চুলি - লৌহ, ক্যালশিয়াম, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। অ্যামারান্থের বীজ অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড সমৃদ্ধ। 

শামুক - প্রোটিন সমৃদ্ধ কিন্তু স্নেহ খুব কম, অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড, ক্যালশিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ। 

লাল পিঁপড়ের 'ডিম' এবং লাল পিঁপড়ে -  প্রোটিন, ক্যালশিয়াম, জিঙ্ক, লৌহ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। 

রেশমকীটের পিউপা - প্রোটিন, লৌহ, জিঙ্ক সমৃদ্ধ।      

ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলি যে কেবলমাত্র পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ তা নয়, ঐতিহ্যবাহী ফসল এবং খাবারের ব্যবহার কৃষি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং টেকসই কৃষির জন্য সহায়ক। বাজরার মতো অনেক ঐতিহ্যবাহী ফসল খরা সহনশীল এবং কম উপকরণে বেড়ে ওঠে, যা অনিশ্চিত বৃষ্টিপাতের পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ এবং স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসের সাথে গভীর সংযোগ স্থাপন করে।

এবার কি করলে এই ব্যাপারে কিছুটা উন্নতি হতে পারে, সেই বিষয়ে আলোচনা করা যাক। এখানে আমি আমার ধারণা অনুসারে কিছু পথের উল্লেখ করছি।  

১. জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তি (Inclusion in National Nutrition Program): সরকারি কর্মসূচিগুলিতে যেমন পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (PDS), মিড-ডে মিল এবং ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস (ICDS), ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন বাজরা, ডাল এবং স্থানীয় সবজির অন্তর্ভুক্তি করা উচিত। এটি পুষ্টিগত মান উন্নত করার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ফসলের চাহিদা সৃষ্টি করবে। কিছু ক্ষেত্রে চালু হলেও, যা প্রশংসাযোগ্য, এতে আরো গুরুত্ব প্রদান করা যেতে পারে। 

২. কৃষক-কেন্দ্রিক উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খল সমর্থন (Supporting Farmer-led Production and Supply Chain): কৃষকদের ঐতিহ্যবাহী ফসল চাষে প্রণোদনা (Incentive) দিতে হবে, কারণ এগুলি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হলেও বাণিজ্যিক ফসলের তুলনায় কম লাভজনক। নীতিগুলি কৃষকদের বাজার সংযোগ, ভর্তুকি এবং কারিগরী সহায়তা প্রদান করা উচিত। ঐতিহ্যবাহী ফসলের চাষের জন্য বীজ ভর্তুকি, কারিগরী প্রশিক্ষণ এবং জৈব কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগ করা- এগুলি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

৩. জৈব এবং টেকসই কৃষির প্রচার (Promotion of Organic and Sustainable Agriculture): অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবার জৈব এবং টেকসই পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়, যা মাটি স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করতে সহায়ক। জৈব চাষকে উৎসাহিত করলে এই খাবারগুলির পুষ্টিমূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং বাজারে একটি বড় সুবিধা থাকবে। "পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা" (PKVY) বা তার প্রসারণ এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারে বলে মনে হয় ।  

৪. ভোক্তা সচেতনতা তৈরি (Increasing Consumer Awareness): নাগরিকদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে শিক্ষিত করার জন্য নীতিমালা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য প্রচারণা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সম্প্রদায়-ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে, বিশেষ করে শহুরে এলাকায়। 

৫. ঐতিহ্যবাহী খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and Development in Traditional Food Processing): ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলি আরও সুস্বাদু, সুবিধাজনক এবং আধুনিক ভোক্তাদের জন্য আকর্ষণীয় করতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলির উপর ভিত্তি করে উন্নত পুষ্টিসমৃদ্ধ পণ্য তৈরি এবং প্যাকেজিং ও সংরক্ষণের উন্নতি হবে।

৬. স্থানীয় জ্ঞান সংরক্ষণ (Preservation of Indigenous Knowledge): ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং তাদের পুষ্টিগুণ সম্পর্কিত স্থানীয় জ্ঞান সংরক্ষণ এবং প্রচার করা জরুরি। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঐতিহ্যবাহী খাবারের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে সহায়ক হবে। ঐতিহ্যবাহী খাদ্যব্যবস্থার অধ্যয়নকে শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ করা এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় জ্ঞানকে সংরক্ষণ ও প্রচার করা প্রয়োজন।

৭. পরিকাঠামো উন্নতি ও বাজার অ্যাক্সেস (Improving Infrastructure and Market Access): ঐতিহ্যবাহী খাবারের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং পরিবহন পরিকাঠামো উন্নত করতে হবে। বাজার অ্যাক্সেস উন্নত করে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা হ্রাস করে কৃষকরা তাদের ফসলের জন্য ন্যায্য মূল্য পেতে পারেন। গ্রামীণ এলাকায় ঐতিহ্যবাহী ফসলের জন্য অবকাঠামো এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে।

ভারতের খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষা নীতির অংশ হিসেবে ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচার অপুষ্টি মোকাবেলা, কৃষির টেকসই উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। কৃষক প্রণোদনা, ভোক্তা সচেতনতা, এবং গবেষণার মাধ্যমে গৃহীত নীতির মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব বলেই মনে হয়। 

সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় ঐতিহ্যগত জ্ঞান কেন আবশ্যিক? (Why is traditional knowledge essential for sustainable food and nutrition security?)

সম্পত ঘোষ  (Sampat Ghosh)

বর্তমান আলোচনায় প্রথম প্রয়োজন ঐতিহ্যগত জ্ঞান (বা  Traditional Knowledge) কি সেটা বোঝা।

ঐতিহ্যগত জ্ঞান বলতে বোঝায় সঞ্চিত জ্ঞান, অনুশীলন, দক্ষতা, উদ্ভাবন এবং প্রজ্ঞাকে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কোনো সম্প্রদায় বা সমাজের মধ্যে সময়ের সাথে সাথে প্রবাহিত হয়। এটি সাধারণত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (Cultural tradition), আদিবাসী বা স্থানীয় বিশ্বাস (Indigenous belief) এবং স্থানীয় পরিবেশগত প্রেক্ষাপটে (Ecology and Ecosystem) নিহিত থাকে। [অনুগ্রহ করে পড়ুন: বাস্তুতন্ত্রের সেবা প্রদান এবং খাদ্য, বাস্তুতন্ত্র-ভিত্তিক-অভিযোজন এবং খাদ্য নিরাপত্তা

কিভাবে সম্প্রদায়গুলি প্রকৃতি, সম্পদ এবং সমাজের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে, ঐতিহ্যগত জ্ঞান তাকে প্রভাবিত করে। ঐতিহ্যগত জ্ঞান প্রায়ই মৌখিকভাবে বা ব্যবহারিক প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রেরিত হয় এবং কৃষি (Agriculture), স্বাস্থ্যসেবা (Healthcare), প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা (Natural resource management), খাদ্য ব্যবস্থা (Food system), আধ্যাত্মিকতা (Spirituality) এবং কারুশিল্প (Crafts) সহ জীবনের বিভিন্ন দিককে অন্তর্ভুক্ত করে।  

সমসাময়িক সময়ে, খাদ্য ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত ঐতিহ্যগত জ্ঞান বিভিন্ন কারণে সুস্থায়ী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার আলোচনায় ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বর্তমান ব্লগটিতে এই ঐতিহ্যগত জ্ঞান কোন কারণগুলির জন্যে প্রাসঙ্গিক তার উল্লেখ করবো। 

() জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ (Conservation of Biodiversity): ঐতিহ্যগত জ্ঞানে প্রায়ই এমন অনুশীলন জড়িত থাকে যা জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণকে উৎসাহিত করে। উদাহরণস্বরূপ, আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি বিভিন্ন ধরণের শস্য এবং গবাদি পশুর জাত চাষ এবং ব্যবহারের পদ্ধতি তৈরি করেছে, যা কীটপতঙ্গ, রোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে স্থিতিস্থাপকতার জন্য প্রয়োজনীয় জিনগত বৈচিত্র্যে অবদান রাখে। 

() স্থানীয় পরিবেশের সাথে অভিযোজন (Adaptation to Local Environment): ঐতিহ্যগত জ্ঞান স্থানীয় পরিবেশ এবং জলবায়ুতে গভীরভাবে প্রোথিত। এটি নির্দিষ্ট বাস্তুসংস্থানীয় অবস্থা (Ecological conditions), যেমন মাটির ধরন, বৃষ্টিপাতের ধরন এবং তাপমাত্রার তারতম্যের জন্য টেকসই চাষাবাদ (Sustainable agriculture) অনুশীলনের জ্ঞান প্রদান করে। এই জ্ঞান সম্প্রদায়গুলিকে বহিরাগত ইনপুটগুলির (Input) উপর খুব বেশি নির্ভর না করে পরিবর্তিত পরিবেশগত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম করে। 

() প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ (Conservation of Natural Resources): অনেক ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি জল, মাটি এবং বনের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেয়। কৃষি-বনায়ন (Agroforestry), ফসলের ঘূর্ণন (Crop rotation) এবং টেরেসিংয়ের (Terracing) মতো কৌশলগুলি মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে, ক্ষয় রোধ করতে এবং জলের উৎস সংরক্ষণে সহায়তা করে, যা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বে অবদান রাখে।

() সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক তাৎপর্য (Cultural and Social Significance): ঐতিহ্যগত জ্ঞান প্রায়ই সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যে স্থাপন (Embed) করা হয়। তারা শতাব্দীর সঞ্চিত জ্ঞানের প্রতিফলন করে, মৌখিক ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান এবং সম্প্রদায়ের অনুশীলনের মাধ্যমে প্রজন্মের মধ্যে চলে গেছে। এই ঐতিহ্যগুলি সংরক্ষণ এবং সম্মান করা শুধুমাত্র মূল্যবান কৃষি জ্ঞানের সংক্রমণ নিশ্চিত করে না বরং সামাজিক সংহতি এবং পরিচয়ও বৃদ্ধি করে।

() পুষ্টির বৈচিত্র্য (Nutritional Diversity): ঐতিহ্যগত খাদ্যগুলি সাধারণত বৈচিত্র্যময় এবং সুষম, স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ খাবারের বিস্তৃত পরিসরকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই বৈচিত্র্য কেবলমাত্র উন্নত পুষ্টিতে অবদান রাখে না বরং কয়েকটি প্রধান ফসলের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে, ফসলের ব্যর্থতা বা বাজারের ওঠানামার ঝুঁকি হ্রাস করে।

() স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন (Resilience and Adaptation): ঐতিহ্যগত জ্ঞান সম্প্রদায়গুলিকে স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন কৌশলগুলির সাথে সজ্জিত করে যা বহু প্রজন্ম ধরে বৈচিত্র্যময় এবং প্রায়শই চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে বসবাস করে। এই অভিযোজিত ক্ষমতাগুলি চরম আবহাওয়ার ঘটনা, কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাব বা অর্থনৈতিক ধাক্কার মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলির সাথে মোকাবিলা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

() স্থায়িত্ব (Sustainability): ঐতিহ্যগত কৃষি অনুশীলনগুলি প্রায়শই তাদের কম বাহ্যিক ইনপুট প্রয়োজনীয়তা এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরতার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। জীববৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্য এবং বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিস্থাপকতার মতো কৃষি-বাস্তবতাত্ত্বিক নীতিগুলিকে প্রচার করে, ঐতিহ্যগত জ্ঞান টেকসই খাদ্য উৎপাদনের দিকে পথ দেখায় যা নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাবগুলি হ্রাস করে।

আশা করি সুস্থায়ী খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্যগত জ্ঞানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বোঝা গেলো। 

Photographs of some Insects: Capturing Nature's Beauty with a Mobile Camera

সম্পত ঘোষ (Photographer: Sampat Ghosh)


I captured photographs of some fascinating insects using my mobile phone. Previously, I wrote a blog to highlight the importance of wildlife in an ecosystem. These photographs illustrate how insects contribute to the pollination of wild plants. I invite you to enjoy these images. Please note, while these photos are not intended for any commercial use without the photographers' written permission, they may be available for academic purposes only with proper credit to the photographers and this blog.

ভারতের ট্রাইবাল খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ (Exploring Tribal Food Systems of India)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

পূর্ববর্তী ব্লগটিতে (ভারতের স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ) আমি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় খাদ্য এবং রন্ধনপ্রণালীর উল্লেখ করেছি । অবশ্যই তা একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ, বলাই বাহুল্য যে তার বাইরে অনেক উপাদেয় পদ রয়েছে, কয়েকটি আইকনিক পদ ও প্রণালীকে তুলে ধরেছি মাত্র। আশা করি কর্মসূত্রে বা বেড়াতে গেলে পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয়ই ওই সকল স্থানীয় খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ করবেন। আজকের এই ব্লগটিতে আমি আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপজাতিদের বিভিন্ন খাদ্য পদ নিয়ে আলোচনা করব, অন্যথা আমাদের দেশের খাদ্য বৈচিত্র্য সম্বন্ধে যে আলোচনা আমি শুরু করেছি তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। 

ভারতবর্ষ অসংখ্য আদিবাসী বা উপজাতির আবাসস্থল। দেশের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই উপজাতিরা তাদের অনন্য রীতিনীতি, ভাষা এবং উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছেন বা করে চলেছেন। এই ব্লগে, আমরা ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য ভান্ডারের অন্বেষণ করব যা এই সম্প্রদায়গুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রেখেছে। আমার জীবনের দীর্ঘ সময়কাল ভারতেবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে, কাজেই কিছু ক্ষেত্রে এই লেখা আমার কাছে অনেকটা নস্টালজিয়ার মতন। বাংলা সাহিত্যেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের খাদ্যের বা খাদ্যরীতির কথা উঠে এসেছে। এই মুহুর্তে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পালামৌ' এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের 'আরণ্যক' উপন্যাসটির কথা মনে আসছে। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পালামৌ’ ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকেও উক্ত অঞ্চলের কোল জাতির মধ্যে খাদ্য হিসেবে মহুয়া ফুলের ব্যবহারের কথা জানা যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'আরণ্যক' উপন্যাসে লিখেছেন- 'আমাদের এ জঙ্গল-মহালের পূর্বে-দক্ষিণ সীমানা হইতে সাত-আট ক্রোশ দূরে অর্থাৎ সদর কাছারি হইতে প্রায় চৌদ্দ-পনের ক্রোশ দূরে ফাল্গুন মাসে এক প্রসিদ্ধ মেলা বসে। ....... মেলার এক অংশে তরিতরকারির বাজার বসিয়াছে, কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় শুঁটকি কুচো চিংড়ি ও লাল পিঁপড়ের ডিম বিক্রয় হইতেছে। লাল পিঁপড়ের ডিম এখানকার একটি সুখাদ্য। তাছাড়া আছে কাঁচা পেঁপে, শুকনো কুল, কেঁদ-ফুল, পেয়ারা ও বুনো শিম।'

সত্যজিত রায় মহাশয়ের পরিচালিত 'আগুন্তুক' ছায়াছবিটি আমার অন্যতম প্রিয় সিনেমা। ছায়াছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মনমোহন মিত্র আদিবাসীদের কৃষি, বুনন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ঔষধি, স্থাপত্য, শিল্পকলা ইত্যাদির কথা সাধারণ শহুরে মানুষদের প্রতিনিধি অনিলা দেবীর পরিবার এবং পারিবারিক বন্ধুর সামনে তুলে ধরেন, যদিও তাঁরা সেগুলির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না। এখানে একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কাটে, মনমোহন বলেন তিনি আদিবাসী নন বলেই তাঁর ফিল্ড নোট (Field notes) নেওয়ার প্রয়োজন হয়। সত্যি, আজ পৃথিবী যখন স্থায়িত্বের (Sustainability) জন্যে লড়ে যাচ্ছে, তখন আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমাজ থেকেই নেওয়া ফিল্ড নোটগুলি উল্টাতে হয় বইকি, তাতেই যে রয়েছে স্থায়িত্বের চাবিকাঠি ।

ভারতে উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালী ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত, জমি, ঋতু এবং আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে স্থানীয়ভাবে উপলব্ধ উপাদানগুলি ব্যবহার করেন। উত্তর-পূর্বের জঙ্গল থেকে শুরু করে রাজস্থানের শুষ্ক মরুভূমি পর্যন্ত, প্রতিটি অঞ্চল ভূগোল, জলবায়ু এবং সাংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত স্বতন্ত্র রন্ধনসম্পর্কীয় পরিচয় নিয়ে গর্ব করে। 

ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, আদিবাসী উপজাতিদের আবাসস্থল, খাদ্য শুধুমাত্র ভরণ-পোষণ নয় বরং জীবনের একটি উদযাপন। ভাত, মাছ, শুঁটকি মাছ এবং বাঁশের আগা (Bamboo shoot) এই অঞ্চলের অনেক উপজাতীয় খাদ্যের ভিত্তি। নাগাল্যান্ডের নাগা উপজাতিরা তাদের ঝাল ঝাল সুস্বাদু মাংসের খাবারের জন্য বিখ্যাত, প্রায়শই শক্তিশালী 'ভুত ঝোলোকিয়া' মরিচ দিয়ে রান্না করা হয়। মেঘালয়ের গারো এবং খাসি উপজাতিরা সুস্বাদু আচার এবং চাটনি তৈরি করতে বাঁশের আগা ফার্মেন্ট করেন, যা খুবই উপাদেয়। উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় বিভিন্ন কীট-পতঙ্গকে খাদ্য (Edible insects) হিসেবে ব্যবহার করেন। অরুণাচল প্রদেশে বিভিন্ন উৎসবে মিথুনের মাংস (Bos frontalis) মানুষের রসনা তৃপ্ত করে। এখানে মুরগি বা মাটনের থেকে শুয়োরের মাংসের ধিক্য দেখা যায়। পানীয়ের মধ্যে অরুণাচলের আপং (Apong-rice beer), নাগাল্যান্ডের জুথো (Zutho), সিকিমের ছাঙ (Chang) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আবার মিজোদের স্থানীয় ডেলিকেসি জাওলাইদি- আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত ওয়াইন (Zawlaidi- Grape wine) এক প্রেমের গল্প বলে। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পানীয় গ্রহণে কোনো বৈষম্য আমি দেখিনি, স্থানীয় মানুষকে মাতলামি করতেও আমার বিশেষ চোখে পড়েনি।

মধ্য ভারত বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল, প্রত্যেকের নিজস্ব রন্ধন ঐতিহ্য রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের গোন্ড এবং বাইগা উপজাতিরা মহুয়া ফুল, তেন্দু পাতা ইত্যাদি বনজ পণ্যের দক্ষতার সাথে ব্যবহারের জন্য পরিচিত। মহুয়া, বিশেষ করে, উপজাতীয় রন্ধনপ্রণালীতে একটি বিশেষ স্থান রাখে, যা আলকোহলিক পানীয় (Alcoholic beverages) এবং মিষ্টি খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আদিবাসীদের বিভিন্ন মিলেটের, যেমন কোদো, কুটকি ইত্যাদির ব্যবহার (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-২: মিলেট), বীজ সংরক্ষণ, কৃষি পদ্ধতি ইত্যাদি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়িত্ব এবং পুষ্টির নিশ্চয়তার দৃষ্টিকোণ খুবই প্রাসঙ্গিক। ছত্তিশগড়ের লাল পিঁপড়ের চাটনী, ঊড়িষ্যার G.I. ট্যাগ প্রাপ্ত 'কাই-চাটনী' (লাল পিঁপড়ের চাটনী- watery semi-solid paste of red weaver ant), মধ্য ভারতের স্থানীয় আদিবাসীদের খাদ্য হিসেবে শামুকের (Edible snails) ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। 

সবুজ পশ্চিম ঘাটের মাঝখানে অবস্থিত, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং কেরালার উপজাতি সম্প্রদায়গুলি রন্ধনসম্পর্কীয় আনন্দের একটি আকর্ষণীয় সম্ভার অফার করে। মহারাষ্ট্রের ওয়ারলি উপজাতি, তাদের শিল্পের জন্য পরিচিত, এছাড়াও রন্ধনশিল্পে পারদর্শী, পিঠলা-ভাকড়ি (Pithla-Bhakri- খামিরবিহীন রুটির সাথে বেসনের তরকারি) এর মতো হৃদয়গ্রাহী খাবার তৈরি করে। দক্ষিণ ভারতে কুরিচিয়া এবং কুরুম্বা মতো আদিবাসী উপজাতিরা বনের সবুজ শাক (অনুগ্রহ করে পড়ুন: পুষ্টি সুরক্ষা এবং খাদ্য সংস্থান- পর্ব-৩: শাক), মিঠা পানির মাছ এবং বন্য মাংস দিয়ে রান্নার শিল্প আয়ত্ত করেছে, এমন খাবার তৈরি করেন যা যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর।

পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের কেন্দ্রস্থলে, রন্ধন প্রথাগুলি প্রকৃতি উপাসনা এবং পূর্বপুরুষদের আচারের সাথে গভীরভাবে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল উপজাতি ফসল কাটার মরসুম উদযাপন করে সোহরাই নামে পরিচিত একটি জমকালো ভোজের সাথে, যেখানে 'ধুসকা' (Dhuska- ডিপ-ফ্রাইড রাইস প্যানকেক) এবং পিঠা-র মতো খাবার রয়েছে। এদিকে, ওডিশার বোন্ডা উপজাতি বন্য মাশরুম, কন্দ এবং সবুজ শাক তাদের প্রতিদিনের খাবারে অন্তর্ভুক্ত করে।

আধুনিকীকরণ (?) এবং পরিবেশগত অবক্ষয় দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ভারতের সমৃদ্ধ উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য প্রচেষ্টা চলছে। ঐতিহ্যগত জ্ঞান (Traditional Knowledge) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রজম্নের পর প্রজন্ম মুখে মুখেই প্রচলিত, লিখিত ভাবে না থাকার জন্যে তা অবক্ষয়িত, এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তাই আমাদের সেই ফিল্ড নোটগুলিকেই ভরসা করতে হয়। 'আগুন্তুক' ছবিতে নিজের চিকিৎসার জন্যে মনমোহন মিত্র এমন এক ওঝাকে ডেকেছিলেন যাঁর নখদর্পনে ছিল ৫০০ ঔষধি গাছ-গাছড়ার গুণাবলীর তথ্য, এ কিন্তু নেহাত কল্পনা নয়, এরূপ উদাহরণ আমি দেখেছি। তবে স্থানান্তর (Migration), স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় (Ecosystem degradation), জীব বৈচিত্রের হ্রাস (Biodiversity loss) পাওয়া ইত্যাদির ফলে এই জ্ঞানভাণ্ডার আজ ক্ষয়িষ্ণু। এই মূল্যবান জ্ঞান ভান্ডারকে সংরক্ষণ করা আবশ্যক। আদিবাসী সমাজের এই কম কার্বণ ফুটপ্রিন্ট (Low carbon footprint) বৈশিষ্টযুক্ত খাদ্য ব্যবস্থা পরিবেশের স্থায়িত্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে। সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে খাদ্য উৎসব, রন্ধনসম্পর্কীয় কর্মশালা এবং ডকুমেন্টেশন প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলি দেশীয় খাবার এবং ঐতিহ্যগত রান্নার পদ্ধতির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে। উপজাতীয় রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য উৎযাপন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে, আমরা শুধুমাত্র ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করি না বরং ভবিষ্যত প্রজন্মকে লালন করার জন্য আমাদের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকেও রক্ষা করি।

উপসংহারে, ভারতের উপজাতীয় খাবারগুলি প্রকৃতির সাথে গভীর সংযোগের প্রমাণ যা সারা দেশে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। উত্তর-পূর্বের কুয়াশা-ঢাকা পাহাড় থেকে মধ্য ভারতের রৌদ্রে ভেজা সমভূমি পর্যন্ত, এই সকল খাদ্যের প্রতিটি কামড় স্থিতিস্থাপকতা (Resilience), ঐতিহ্য (Tradition) এবং খাদ্য ও সংস্কৃতির (Food culture) মধ্যে স্থায়ী বন্ধনের গল্প বলে। পরিশেষে উল্লেখ করি, এছাড়াও অনেক পদ বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে, সমস্ত পদের বর্ণনা একটি সংক্ষিপ্ত ব্লগে সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি আইকনিক পদের বর্ণনা এই ব্লগটিতে করলাম।

ভারতের স্থানীয় খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ (Exploring Local Food Systems of India)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

ভারতবর্ষের বাইরে কোনো স্থানে গেলে সেখানে যদি কোনো ভারতীয় রেস্তোরাঁ চোখে পরে তবে আনন্দের সীমা থাকে না। তবে সেখানে যে সকল প্রকার ভারতীয় খাবারের সম্ভার থাকে এমনটা কিন্তু নয়। কয়েকটি পদ-ই সেখানে প্রস্তুত করা হয় এবং ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী পরিবেশন করা হয়ে থাকে।  এই বিষয়ে আমি পূর্বে একটি ব্লগে বিস্তারিত লিখেছি [অনুগ্রহ করে পড়ুন ভারতীয় রান্নার একটি গল্প ]।  এই ব্লগে আমার উদ্দেশ্য এমন কিছু আইকনিক খাবারের পদ উল্লেখ করা যাতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্য বৈচিত্র্যের একটা ধারণা পাওয়া যায়। 

ভারত বিভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং রন্ধনপ্রণালীর দেশ। এ দেশ দেশীয় খাদ্য ব্যবস্থার সমৃদ্ধ টেপেস্ট্রি নিয়ে গর্ব করে। ইতিহাস ও ভূগোলের গভীরে প্রোথিত এই রন্ধন প্রথা উপমহাদেশের অনন্য ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। হিমালয়ের তুষারময় শিখর থেকে ভারত মহাসাগরের গ্রীষ্মমন্ডলীয় উপকূল পর্যন্ত, প্রতিটি অঞ্চল ভারতীয় খাবারের প্রাণবন্ত উপাদান, স্বাদ এবং রান্নার কৌশলগুলির নিজস্ব অবদান রাখে। এই ব্লগে, আমরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ করার জন্য একটি যাত্রা শুরু করব, সারা দেশে বিভিন্ন রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যের ঐতিহ্যবাহী অভ্যাস, উপাদান এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের সন্ধান করব। এই অন্বেষণের মাধ্যমে, আমরা এই প্রাচীন খাদ্যপথের অন্তর্নিহিত স্থিতিস্থাপকতা (Resilience), বৈচিত্র্য (Diversity) এবং স্থায়িত্বের (Sustainability) দিকে লক্ষ্য রাখব।

উত্তর ভারত

প্রথমেই উত্তর ভারতের পাঞ্জাবের দিকে তাকানো যাক। পাঞ্জাবকে প্রায়শই "ভারতের রুটির ঝুড়ি" (Breadbasket of India) হিসাবে উল্লেখ করা হয়, পাঞ্জাব এমন একটি রন্ধনপ্রণালীর গর্ব করে যা হৃদয়গ্রাহী, সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যে ভরপুর। পাঞ্জাব সমভূমির উর্বর মাটি প্রচুর পরিমাণে শস্য, শাকসবজি এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপন্ন করে, যা পাঞ্জাবি খাবারের মূল ভিত্তি। পাঞ্জাবি খাবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তন্দুরি রান্নার (Tandoori cooking) উপর জোর দেওয়া। তন্দুর, একটি নলাকার (Cylindrical) মাটির চুলা, মাংস গ্রিল করতে, এবং রুটি বেক করতে ব্যবহৃত হয়, যা খাবারে একটি অনন্য ধোঁয়াটে স্বাদ (Smoky flavour) দেয়। তন্দুরি চিকেন (Tandoori chicken), তন্দুরে রান্না করার আগে দই এবং মশলার মিশ্রণে ম্যারিনেট (Marinate) করা হয়, পাঞ্জাবি রান্নার একটি ক্লাসিক কুইসিন। পাঞ্জাবের আরেকটি আইকনিক খাবার হল সর্ষ দা সাগ’ (Sarson da saag) এবং মাক্কি দি রোটি’ (Makkai di roti), সরিষার শাক এবং কর্নমিল ফ্ল্যাটব্রেডের (Cornmeal flatbread- ভুট্টার আটার রুটি) একটি উপাদেয় মিল। এই খাবারটি ঐতিহ্যগতভাবে শীতের মাসগুলিতে উপভোগ করা হয় যখন সরিষার শাক মরশুমি এবং প্রায়শই বাড়িতে তৈরি মাখন বা ঘি (Ghee) দিয়ে পরিবেশিত হয়ে থাকে। সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি, পাঞ্জাব তার মিষ্টি খাবারের জন্যও বিখ্যাত, যেমন 'পিন্নি' (Pinni), ময়দা, ঘি এবং গুড় দিয়ে তৈরি একটি ঘন এবং বাদামের মিষ্টি। এই মিষ্টিগুলি প্রায়শই উৎসব এবং বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়।

এবার আসি উত্তরপ্রদেশের কথায়। উত্তর প্রদেশ, ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য, মুঘলাই ঘরানা-র সুস্বাদু খাবার থেকে আওয়াধি ঘরানা পর্যন্ত রন্ধনসম্পর্কীয় সমৃদ্ধ টেপেস্ট্রির (Tapestry) আবাসস্থল। উত্তরপ্রদেশের রন্ধনপ্রণালী তার সমৃদ্ধ এবং সুগন্ধযুক্ত গ্রেভি (Aromatic gravies), ধীরে-ধীরে রান্না করা মাংস (Slow-cooked meat) এবং সূক্ষ্ম মশলার মিশ্রণ (Delicate spice blends) দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। উত্তর প্রদেশের সবচেয়ে আইকনিক খাবারগুলির মধ্যে একটি হল বিরিয়ানি (Biryani), একটি সুগন্ধি চাল, কোমল মাংস, সুগন্ধি মশলা এবং ক্যারামেলাইজড পেঁয়াজ দিয়ে প্রস্তুত এই ডিশ। লখনউই বিরিয়ানি (Lucknowi biryani), বিশেষ করে, জাফরান, কেশর এবং গোলাপ জল দিয়ে মিশ্রিত মাংসের সূক্ষ্ম স্বাদ এবং কোমল টুকরার জন্য বিখ্যাত। উত্তরপ্রদেশ কুইসিনের আর একটি রত্ন হল কাবাব, একটি রসালো মাংসের প্রস্তুতি যা আওধের রাজকীয় রান্নাঘরে উদ্ভূত হয়েছিল। আপনার মুখের গলে যাওয়া 'গালোটি কাবাব' হোক (Galouti kebab) বা রসালো 'শিক কাবাব' (Seekh kebab), উত্তরপ্রদেশ কাবাব উৎসাহীদের জন্য প্রচুর ধরণ সরবরাহ করে।নিরামিষ রন্ধনপ্রণালীতেও উত্তর প্রদেশে সমৃদ্ধ, নিরামিষ খাদ্যের মধ্যে 'পনির টিক্কা' (Paneer tikka), 'ডাল মাখানি' (Dal makhani) এবং 'ছোলে ভাটুরে'র (Chole bhature) মত খাবারগুলি উল্লেখযোগ্য। উত্তর ভারতীয় খাবারের প্রধান উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে গম, চাল, মসুর, শাকসবজি, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং সুগন্ধি মশলা যেমন জিরা, ধনে, হলুদ এবং গরম মসলা।

দক্ষিণ ভারত

এবার আসি দক্ষিণ ভারতে। কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং অন্ধ্র প্রদেশের প্রত্যেকেরই নিজস্ব অনন্য রন্ধন ঐতিহ্য রয়েছে, যা অঞ্চলের ভূগোল, ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক দ্বারা প্রভাবিত। "মশলার দেশ" (Land of Spices) হিসাবে পরিচিত কেরালা তার নারকেল-ভরা তরকারি, সামুদ্রিক খাবারের (Seafood) উপাদেয় এবং কলা পাতায় পরিবেশিত ঐতিহ্যবাহী 'সাধ্য মিল'- (Sadhya meal) জন্য বিখ্যাত। কেরালার রন্ধনপ্রণালী নারকেল, মশলা এবং তাজা সামুদ্রিক খাবারের উদার ব্যবহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। 'মীন কারি' (Meen curry- মাছের কারি), 'অ্যাভিয়াল' (Avial- মিশ্র তরকারি), এবং 'আপাম' (Appam- গাঁজানো চালের প্যানকেক) এর মতো খাবারগুলি কেরালার সুস্বাদু খাবারের উদাহরণ দেয়।

তামিলনাড়ু একটি সমৃদ্ধ রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যের গর্ব করে, যেখানে চেটিনাড রন্ধনপ্রণালী (Chettinad cuisine) তার জ্বলন্ত স্বাদ এবং শক্তিশালী মশলার মিশ্রণের জন্য আলাদা। 'ইডলি' (Idli), 'দোসা' (Dosa) এবং 'সাম্বার' (Sambar) হল তামিল রন্ধনপ্রণালীর প্রধান পদ, যা সমগ্র অঞ্চল জুড়ে উপভোগ করা হয়। তামিলনাড়ুর চেটিনাড রন্ধনপ্রণালী তার জ্বলন্ত স্বাদ এবং দুর্দান্ত মশলার মিশ্রণের জন্য পরিচিত। সিগনেচার ডিশের মধ্যে রয়েছে 'চেটিনাদ চিকেন' (Chettinad chicken), প্রন মাসালা (Prawn masala), এবং 'কুঝি পানিয়ারম' (Kuzhi Paniyaram), প্রতিটি অঞ্চলের সাহসী এবং সুগন্ধি স্বাদকে তুলে ধরে।

কর্ণাটক ম্যাঙ্গালোরিয়ান রন্ধনপ্রণালী- (Mangalorean cuisine) সুস্বাদু চালের ডাম্পলিং (Rice dumpling) থেকে শুরু করে মহীশূর অঞ্চলের সুগন্ধি 'বিসি বেলে বাথ' (Bisi Bele Bath) পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের খাবার প্রদান করে। রাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলগুলি তাদের সামুদ্রিক খাবারের প্রস্তুতির জন্য বিখ্যাত, যখন অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলি অনন্য নিরামিষ বিশেষত্ব প্রদর্শন করে। কর্ণাটকের রন্ধনপ্রণালী তার অঞ্চল জুড়ে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যাঙ্গালোরিয়ান ফিশ কারি-র মতো সামুদ্রিক খাবারের বিশেষত্ব রয়েছে, যখন অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে 'বিসি বেলে বাথ' এবং 'রাগি মুদ্দে(Ragi Mudde-ফিঙ্গার মিলেটের বল) মতো নিরামিষ খাবারগুলি অফার করা হয়।

হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি (Hyderabadi biryani), 'গোঙ্গুরা পাচাদি' (Gongura pachadi) এবং 'পেসারাত্তু'-র (Pesarattu) মতো খাবারগুলি স্থানীয় এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করে অন্ধ্রপ্রদেশ তার মশলাদার এবং টক স্বাদের (ট্যাঙ্গি-Tangy) খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ। অন্ধ্রপ্রদেশের রন্ধনশৈলী তার সাহসী এবং মশলাদার স্বাদের জন্য বিখ্যাত, যার মধ্যে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, 'গোঙ্গুরা পাচাদি' (সারা পাতার চাটনি) এবং মিরচি ভাজি (মরিচের ভাজা) মতো খাবারগুলি এই অঞ্চলের রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে৷

পূর্ব ভারত

পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মাছ [অনুগ্রহ করে পড়ুন বাঙালী আহারে মাছ] এবং ভাতের প্রতি ভালোবাসার জন্য বিখ্যাত। মাছের ঝোল (মাছের তরকারি)চিংড়ি মালাই কারি (চিংড়ির তরকারি), সরিষা ইলিশ, এবং ভাপা ইলিশ- এর মতো উপাদেয় পদ যেমন এখানে রয়েছে তেমনই রাস্তার খাবারের সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত, যেখানে কাঠি রোলফুচকা ('পানি পুরি'), এবং ঝাল মুড়ি (মশলাদার পাফড রাইস) এর মতো সুস্বাদু খাবারগুলি পাওয়া যায়। মিষ্টির মধ্যে এখানে উল্লেখযোগ্য রসগোল্লা, সন্দেশ, মিষ্টি দই

ওড়িশার রন্ধনপ্রণালীতে পাঁচ ফোরোন (পাঁচ-মশলার মিশ্রণ), সরিষার তেল এবং বিভিন্ন সবজি ব্যবহার করা হয়। 'ডালমা' (মসুর ডাল এবং সবজি দিয়ে প্রস্তুত পদ), 'ছেনা পোড়া' (ক্যারামেলাইজড কটেজ পনির কেক), এবং 'রসবালি' (ঘন দুধে মিষ্টি কটেজ পনির বল) এর মতো খাবারগুলি স্থানীয় এবং পর্যটকদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়। [অনুগ্রহ করে পড়ুন ঊড়িষ্যার কয়েকটি বিশেষ খাদ্য পদ: আমার অভিজ্ঞতা]

বিহারের রন্ধনপ্রণালী তার সরলতা এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত উপাদান ব্যবহারের জন্য পরিচিত। 'লিট্টি চোখা', একটি সুস্বাদু গমের ডাম্পলিং যা ভাজা বেসন দিয়ে ভরা হয় এবং আলু এবং বেগুনের ভর্তার সাথে পরিবেশন করা হয়, এটি এই অঞ্চলের একটি প্রিয় খাবার। অন্যান্য বিশেষত্বের মধ্যে রয়েছে 'ছাতু পরাঠা', 'ঠেকুয়া' (মিষ্টি ভাজা কুকিজ), এবং 'পুয়া' (মিষ্টি প্যানকেক)।

আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা এবং অরুণাচল প্রদেশ সহ ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলি উপজাতীয় সংস্কৃতি এবং বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত একটি সমৃদ্ধ রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে। প্রতিটি রাজ্যে কচি বাঁশের আগা (Bamboo shoot), ফার্মেন্টেড মাছ (Fermented fish) এবং স্থানীয় রান্নায় বিশিষ্টভাবে সুগন্ধযুক্ত ভেষজ উপাদানের মতো উপাদান সহ খাবারের একটি অনন্য বিন্যাস রয়েছে।

আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি পূর্ব ভারতের রন্ধনপ্রণালীকে নানানভাবে প্রভাবিত করেছে। আদিবাসী উপাদান, রান্নার কৌশল এবং রন্ধন প্রথার অবদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যা প্রজন্মের মাধ্যমে চলে আসছে। উদাহরণ স্বরূপ, ওডিশায়, সাঁওতাল (Santal) এবং কোন্ধের (Kondh) মতো উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলি স্থানীয় রন্ধনপ্রণালীতে বাজরা, বুনো মাশরুম (Wild mushroom), কচি বাঁশের আগা (Bamboo shoot)ফার্মেন্টেড মাছ (Fermented fish), সুগন্ধি ভেষজ এবং বন্য সবুজ শাক-সবজির মতো উপাদানগুলি প্রবর্তন করেছে, এমন খাবার তৈরি করেছে যা পুষ্টিকর এবং স্বাদযুক্ত উভয়ই। একইভাবে, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, নাগা এবং খাসিদের মতো উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলি স্মোকিং (Smoking), শুকানো (Drying) এবং ফার্মেন্ট (Ferment) করার মতো প্রাচীন খাদ্য সংরক্ষণের কৌশলগুলি সংরক্ষণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গে, মাছকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করার জন্য প্রায়শই শুকানো হয়। শুঁটকি মাছ এক ধরণের ডেলিকেসি (Delicacy)।

একইভাবে, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে, কচি বাঁশের আগা এবং ফার্মেন্টেড মাছের মতো উপাদানগুলি সাধারণত 'অ্যাক্সোন' (Axone- গাঁজানো সয়াবিন) এবং 'এরোম্বা' (Eromba- গাঁজানো মাছের তরকারি) এর মতো খাবারগুলিতে গভীরতা এবং উমামি স্বাদ যোগ করতে ব্যবহৃত হয়। এই সংরক্ষণ কৌশলগুলি শুধুমাত্র উপাদানগুলির শেলফ লাইফকে প্রসারিত করে না বরং পূর্ব ভারতীয় রন্ধনশৈলীর অনন্য স্বাদ প্রোফাইল এবং রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যগুলিতে অবদান রাখে, এটিকে গ্যাস্ট্রোনমিক (Gastronomic) আনন্দের ভান্ডারে পরিণত করে।

পশ্চিম ভারত

ভারতের ব্যস্ততম আর্থিক রাজধানী মুম্বাইয়ের আবাসস্থল মহারাষ্ট্র, তার বৈচিত্র্যময় এবং স্বাদযুক্ত খাবারের জন্য পরিচিত। মুম্বাইয়ের মশলাদার রাস্তার খাবার, যেমন 'বড়া পাও' (Vada Pav) এবং 'পাও ভাজি' (Pav Bhaji) থেকে শুরু করে মালভানি অঞ্চলের সমৃদ্ধ এবং সুগন্ধযুক্ত কারি পর্যন্ত, মহারাষ্ট্রে সব রকম স্বাদের খাবারের সম্ভার রয়েছে।

গুজরাট, প্রায়শই "নিরামিষাশীদের দেশ" হিসাবে উল্লেখ করা হয়, এমন একটি রন্ধনপ্রণালী রয়েছে যা নিরামিষ-বান্ধব এবং স্বাদে সমৃদ্ধ। গুজরাটি থালি, একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার যা স্টেইনলেস স্টিলের থালায় পরিবেশন করা হয়, এতে ডাল, 'কাড়ি' (Kadhi), শাকসবজি, ভাত এবং রুটির মতো খাবারের ভাণ্ডার রয়েছে, যা এই অঞ্চলের স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাবারের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করে।

রাজস্থান, তার শুষ্ক ল্যান্ডস্কেপ এবং রাজকীয় দুর্গের জন্য পরিচিত, একটি রন্ধনপ্রণালী অফার করে যা তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মতোই সমৃদ্ধ এবং প্রাণবন্ত। রাজস্থানী রন্ধনপ্রণালীর বৈশিষ্ট্য হল এর মশলা, শুকনো ফল এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যের ব্যবহার, যেখানে 'ডাল বাটি চুরমা' (Dal Baati Churma), 'গাত্তে কি সবজি' (Gatte ki Sabzi) এবং 'লাল মাস'-র (Laal Maas) মতো খাবারগুলি এই অঞ্চলের রন্ধনসম্পর্কীয় দক্ষতা প্রদর্শন করে।

গোয়া, এর আদিম সমুদ্র সৈকত এবং শান্ত পরিবেশ সহ, সামুদ্রিক খাবারের সুস্বাদু এবং পর্তুগিজ-অনুপ্রাণিত খাবারের জন্য বিখ্যাত। গোয়ান রন্ধনপ্রণালীতে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক তরকারি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আইকনিক ফিশ কারি রাইস, পাশাপাশি 'গোয়ান সসেজ পোলাও' (Goan Sausage Pulao) এবং 'বেবিঙ্কা'-র (Bebinca) মতো ফিউশন খাবার, নারকেল দুধ এবং ডিম দিয়ে তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী গোয়ান ডেজার্ট। গোয়ান রন্ধনপ্রণালীতে, সামুদ্রিক খাবার একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, এই অঞ্চলের উপকূলীয় অবস্থান এবং প্রচুর সামুদ্রিক সম্পদের জন্য ধন্যবাদ। মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া এবং গলদা চিংড়ি সাধারণত গোয়ান খাবারে ব্যবহার করা হয়, যা তাদের সাহসী স্বাদ, ট্যাঙ্গি সস (Tangy sauce) এবং হলুদ, মরিচ এবং তেঁতুলের মতো মশলার উদার ব্যবহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, 'ফিশ কারি রাইস' (Fish Curry Rice): গোয়ান রন্ধনপ্রণালীর একটি প্রধান খাবার, এই থালাটিতে একটি ট্যাঙ্গি নারকেল তরকারিতে সিদ্ধ করা মাছ, ভাপানো ভাত এবং ভাজা মাছের সাথে পরিবেশন করা হয়; 'প্রন বালচাও' (Prawn Balchão): চিংড়িগুলি ভিনেগার, মরিচ এবং মশলা দিয়ে তৈরি একটি মশলাদার এবং ট্যাঞ্জি মসলায় মেরিনেট করা হয়, তারপরে সিদ্ধ করা হয়।

রাজস্থানে, যেখানে জলের ঘাটতি একটি চ্যালেঞ্জ, বাজরা দীর্ঘকাল ধরে তাদের স্থিতিস্থাপকতা (Resilience) এবং পুষ্টির মূল্যের কারণে একটি প্রধান খাদ্য উৎস। বাজরা, জোয়ার এবং রাগি দিয়ে প্রস্তুত রুটি বা চাপাটি (ফ্ল্যাটব্রেড), পোরিজ (Porridge) এবং ডেজার্ট (Dessert) সহ বিভিন্ন ধরণের খাবার তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, বাজরা রুটি (Bajra Roti): পার্ল মিলেটের (Pearl millet- বাজরা) আটা দিয়ে তৈরি একটি পুষ্টিকর রুটি, প্রায়শই ঘি বা দই দিয়ে পরিবেশন করা হয় এবং এর সাথে মশলাদার চাটনি বা তরকারি দেওয়া হয়; 'রাগি মুদ্দে' (Ragi Mudde): ফিঙ্গার মিলেটের (Finger millet- রাগি) আটা এবং জল দিয়ে তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা বল আকারে তৈরি করা হয় এবং ডাল বা সবজির তরকারি দিয়ে পরিবেশন করা হয়।

আশা করি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানীয় খাদ্যসম্ভারের একটা চিত্র তুলে ধরতে পারলাম। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে, এছাড়াও অনেক পদ বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে, সমস্ত পদের বর্ণনা একটি সংক্ষিপ্ত ব্লগে সম্ভব নয়, তাই বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকটি আইকনিক পদের বর্ণনা এই ব্লগটিতে করলাম। 

মালদা: পর্ব-৩ (Malda: Part-3)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

মালদা: পর্ব-২ -র পর [পূর্ববর্তী পর্বগুলি পড়ার জন্যে অনুগ্রহ করে ক্লিক করুন মালদা: পর্ব-১, মালদা: পর্ব-২

হাবশী বংশের পরে বাংলার শাসনভার ন্যস্ত হয় হুসেন শাহী বংশের (১৪৯৪ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ) উপর। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা।  বড়ো সোনা মসজিদ বা বারদুয়ারী মসজিদের নির্মাণ কার্য আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময়কালে আরম্ভ হলেও নির্মাণকার্যটি শেষ হয় নাসিরুদ্দিন নসরৎ শাহের আমলে। 


বড় সোনা মসজিদটি বারোদোয়ারী মসজিদ বলে পরিচিত হলেও এতে রয়েছে এগারোটি দরজা। মূল প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশ করে ডানদিকে মসজিদটি অবস্থিত।



সুলতান নসরৎ শাহের শাসনকালেই নির্মাণ হয় কদম রসুল মসজিদটি।    


এক গম্বুজ বিশিষ্ট চতুস্কোণ এই গৃহেই রয়েছে হজরত মহম্মদের পদচিহ্ন। শুনলাম পদচিহ্নটি দিনের বেলায় এই গৃহে থাকলেও প্রতিদিন নাকি সেটি রাত্রিবেলায় অন্যকোনো নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষিত থাকে। এই প্রাঙ্গনটিতেই রয়েছে ফতে খাঁ-র সমাধি। দোচালা বিশিষ্ট সমাধিটি যে গৃহে সংরক্ষিত রয়েছে এটি গ্রাম বাংলার দো-চালা গৃহের ন্যায়।


কদম রসুল মসজিদের নিকটে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লুকোচুরি দরওয়াজা, আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য, অবস্থিত। শাহ সুজা ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে সালে মোঘল  স্থাপত্য শৈলীতে এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। লুকোচুরির রাজকীয় খেলা থেকে এই নামের উৎপত্তি হয়েছে যেটি সুলতান তার বেগমদের সাথে খেলতেন। আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এটি ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এই দ্বিতল দরওয়াজাটি প্রাসাদের প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল।



আজ এই পর্যন্ত। পরবর্তী পর্বে আসবো রামকেলী দর্শনের বর্ণনা নিয়ে।

জানুয়ারী, ২০২৪


মালদা: পর্ব-২ (Malda: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)

মালদা ভ্রমণের প্রথম পর্বটি পড়ার জন্যে ক্লিক করুন মালদা: পর্ব-১

গতকাল রেডিওতে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরে। হোটেলে প্রাতঃরাশ সকাল ৮ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত। আমরা পৌনে ন'টার মধ্যে প্রাতঃরাশ সেরে ন'টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। গতকালই আমি অটো-র জন্যে বলে রেখেছিলাম। সঠিক সময়ে আমাদের অটো চালক দাদা এসে গিয়েছিলেন। বর্তমানে মালদা শহরের দক্ষিণে গৌড় এবং উত্তরে রয়েছে পাণ্ডুয়া। আমরা সকালে প্রথমে গৌড় ঘুরে মধ্যাহ্নভোজন সেরে পাণ্ডুয়া ঘুরতে যাবো। ঐতিহাসিক স্থানের বর্ণনা দিতে গেলে একটা কালানুক্রম বজায় রাখা প্রয়োজন, তবেই পারম্পর্য বোঝা যায়, নচেৎ স্থানটিকে অনুধাবন করা মুশকিল হয়ে যায়, তবে ঘোরা তো আর সেইভাবে হয় না, যে স্পটটি আগে পরে সেটি আগে ঘুরে নিতে নয়। তাই আমি এখানে আমার বেড়ানো অনুযায়ী নয় বরং ইতিহাসের হাত ধরে পাঠক-পাঠিকাকে আমাদের বেড়ানোটির বর্ণনা করবো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক স্থাপত্যটির সম্বন্ধে যে বর্ণনা পুরাতত্ত্ব বিভাগের বোর্ডে লেখা রয়েছে তার চিত্র দেওয়ার চেষ্টা করবো যাতে পাঠক পাঠিকা তথ্য সম্বন্ধে সেখান থেকেও অবগত হতে পারেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটি একটি ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণকাহিনী (গবেষণাধর্মী বা গবেষণা নির্ভর ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয়) যার অন্যতম উপাদান স্থানীয় গাইডদের প্রদত্ত তথ্য, সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান, প্রচলিত লোককথা, বিশ্বাস ইত্যাদি।

যে গৌড়ের প্রতি অসীম আগ্রহে আমরা এসে পৌঁছলাম, তখন সেখানে লক্ষণাবতী নামে এক নগর ছিল। কাশী জয় করে প্রবল পরাক্রমী লক্ষণ সেন নৌ-পথে এসে পৌঁছলেন মহানগরে। তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্যে পিতা বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ বল্লালবাটী তো বটেই সেজে উঠেছিল সমগ্র নগর। আজ আমরা যে ধ্বংসাবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, তাই অতীতের বল্লালবাটী, বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ। জানিনা আর কতদিন এই অবশেষটুকু টিঁকবে, বিশেষ কোনো সংরক্ষণ চোখে পড়েনি। 


প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের নিকটেই রয়েছে জাহাজঘাটা, এখানেই নাকি জাহাজ এসে নোঙ্গর করতো সেই সময়ে। 

এই সেই সেন বংশ (১৭৭০-১২৩০ খ্রিস্টাব্দ) যার প্রবল পরাক্রমে পাল বংশের রাজা গোপালদেব ত্যাগ করলেন বঙ্গদেশ। পরাজিত হৃতসর্বস্ব রাজা গোপালদেব আশ্রয় গ্রহণ করলেন মগধে। পাল বংশের রাজত্ব অস্তমিত হলো, ধন-সম্পত্তি বিলুপ্ত হলো, কামরূপ থেকে প্রয়াগ পর্যন্ত একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো সেন বংশের, কিন্তু পাল বংশের উদারতা, শিক্ষা-দীক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা, উন্নত সমাজচেতনা- এসব কিন্তু আজও প্রশংসিত, সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারলো না পরবর্তী শাসক। এর একটি নিদর্শন রয়েছে মালদা জেলার হাবিবপুর ব্লকের জগজ্জীবনপুর আর্কিওলজিক্যাল সাইটটিতে। সময়ের অভাবে আমরা যেতে পারিনি তবে পর্যটকরা দেখে আসতে পারেন। সাইটটি মালদা শহরের কেন্দ্র ইংরেজ বাজার থেকে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই স্থান থেকে পাওয়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে পাল সম্রাট মহেন্দ্রপালদেবের একটি তাম্র-ফলক শিলালিপি এবং নবম শতাব্দীর একটি বৌদ্ধ বিহারের কাঠামোগত অবশেষ যা নন্দদীর্ঘিকা-উদ্রাঙ্গ মহাবিহার নামে পরিচিত।

এরপর অনেক দিন অতিবাহিত হয়েছে। কালের নিয়ম মেনেই একের পর এক শাসক এসেছেন, প্রবল পরাক্রমে নিজেকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠা করেছেন, আবার কালের নিয়মেই সে যুগের সমাপ্তি হয়েছে। বাংলায় সেন বংশের পরে বখতিয়ার খিলজির হাতে গড়ে উঠেছে খিলজি সাম্রাজ্য, তারপর দিল্লি সালতানাত মামলুক এবং তুঘলক সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলায় গভর্নর নিযুক্ত হন। তুঘলক সাম্রাজ্যের মাঝামাঝি সময় থেকে ইলিয়াস শাহী বংশের হাত ধরে বাংলার স্বাধীন সুলতানী যুগের আরম্ভ হয়।

বাংলায় তখন ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্ব (১৩৫২ থেকে ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ) চলছে। ইলিয়াস শাহী বংশের দ্বিতীয় সুলতান সিকান্দার শাহের (১৩৫৮ থেকে ১৩৯০ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকালে নির্মিত হয় এই আদিনা মসজিদ। দিল্লীর সুলতানী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দুই বার জয়লাভের (যথাক্রমে ১৩৫৩ এবং ১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দ) এই মসজিদটি ছিল এই বংশের উচ্চাশার একপ্রকার প্রকাশ। মসজিদটির দেওয়ালের লিপিতে সুলতান সিকান্দার শাহকে একজন 'মহিমান্বিত সুলতান' বা 'বিশ্বস্থতার খলিফা' বলে বর্ণিত হয়েছে।





ইলিয়াস শাহী বংশের পরে আসে রাজা গণেশের বংশ (১৪১৪ থেকে ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দ)। রাজা গণেশের পুত্র সুলতান জালাউদ্দিন মুহম্মদ শাহ, জন্মগত ভাবে হিন্দু হলেও পরবর্তীকালে উনি মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, নির্মাণ করেন এই একলাখি মাজারটি। কথিত রয়েছে এই মাজারটি তৈরী করতে তৎকালীন সময়ের এক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল, তাই সমাধিসৌধটির নাম হয় একলাখি মাজার।


মাজারটির প্রবেশপথের ভাস্কর্য, টেরাকোটার কাজ, আট দিক বিশিষ্ট স্তম্ভ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।


রাজা গণেশের হাতে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন হলেও, রাজা গনেশের বংশ অধিক কাল যাবৎ স্থায়ী হয়নি। ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা গনেশ প্রথমবারের জন্যে সিংহাসন আরোহন করেন আর এই বংশের রাজত্বকাল চলে ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। অতঃপর নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের হাত ধরে পুনরায় বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের পুত্র রুকুনুদ্দিন বরবক শাহের আমলে বাইশ গাজি প্রাচীরের নির্মাণ হয়। বাইশ গজ উচ্চতার জন্যে এর নাম বাইশ গাজি হয়েছে। বহিঃশত্রুর হাত থেকে নগরকে সুরক্ষিত রাখার জন্যেই এর প্রাচীর নির্মাণ করা হয় বলে মনে হয়। বর্তমানে প্রাচীরের অনেকাংশ ভগ্নপ্রায় এবং এর সংরক্ষণের প্রয়োজন।



নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের পৌত্র শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (রুকুনুদ্দীন বরবক শাহের পুত্র)-র শাসনকালে চামকাটী মসজিদটিও নির্মিত হয়।


চমকাটী বা চিকা মসজিদের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত গুমটি দরওয়াজা। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই তোরণটি নির্মাণ করান, যা গৌড়ের পূর্বদিকের প্রবেশ পথ ছিল। 


এখনও কয়েকটি টালির গাত্রে রঙ বিদ্যমান রয়েছে, তবে আর কতদিন এগুলি স্থায়ী হবে তা জানিনা।


এর পরের গন্তব্য দাখিল দরওয়াজা, লক্ষণাবর্ত বা পরবর্তীকালের লাখনৌটির দুর্গের প্রবেশদ্বার এই দাখিল দরওয়াজা। ইলিয়াস শাহী বংশের দ্বিতীয় পর্বে (১৪৩৫ থেকে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ) নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের এই প্রবেশদ্বার নির্মিত হয়। তবে এই প্রবেশদ্বারের নির্মাণ এবং পুনঃনির্মাণ  নিয়ে ঐতিহাসিক মতান্তর রয়েছে।  মনে করা হয়, দাখিল দরওয়াজার  বর্তমান রূপটি হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হুসেন শাহী নির্মাণ করান।



ফিরোজ মিনারটি স্থাপন করেন সুলতান সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ। ইলিয়াস শাহী বংশের দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তির পর বাংলার শাসনভার এসেছিলো হাবশী বংশের (১৪৮৭ থেকে ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ) হাতে। সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন এই বংশের দ্বিতীয় সুলতান। এই মিনারটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় এটি একটি পাঁচ তলা বিশিষ্ট মিনার। প্রথম তিনটি তলা ১২ টি দিক বিশিষ্ট (Dodecagon) এবং উপরিস্থিত দুইটি তলা গোলাকার। এটি দিল্লীর কুতুব মিনার সদৃশ। কথিত আছে যে মিনারটির উচ্চতা সুলতানকে খুশি করতে না পারায় মিনারটির প্রধান আর্কিটেক্টকে সুলতান উপর থেকে নিচে ফেলে দেন, যদিও এই বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য আমার জানা নেই। মিনারটির বাইরের দেওয়ালে বেশ কয়েকটি মৌচাক হয়েছে দেখলাম। মনে হয় এগুলি জায়ান্ট মৌমাছির (Giant honey bee: Apis dorsata) চাক, তারা এরূপ চাক তৈরী করে। 



হাবশী বংশের পরে বাংলার শাসনভার ন্যস্ত হয় হুসেন শাহী বংশের (১৪৯৪ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ) উপর, সেই বিষয়ে আসছি পরবর্তী পর্বে।


জানুয়ারী, ২০২৪

রাজমহল: পর্ব-২ (Rajmahal: Part-2)

সম্পত ঘোষ (Sampat Ghosh)  রাজমহল: পর্ব-১  -র পর- ঘুম ভাঙলো প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের শব্দে। বাইরে তখন খুবই কুয়াশা, হোটেলের ঘরের কাঁচের ...